অন্তর্ধানে থাকার ভাল
-
মন্দ দিকসমূহ
ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর উপর বিশ্বাস স্থাপন
,বিশ্বাসীদের চিন্তার বিকাশ দান করে ও মনে মুক্তির আশাকে জাগ্রত রাখে। তাঁর উপর এমন বিশ্বাস রাখা যে
,সম্ভাবনা আছে তিনি যে কোন সময় আবির্ভূত হতে পারেন। পবিত্র হৃদয় ও যোগ্য ব্যক্তিদের উপর গঠনমূলক ও গভীর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। তারা জুলুম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে
,ন্যায় বিচার করবে
,একে অপরের মধ্যে ভালবাসার সৃষ্টি করবে যেন ইমামকে সাহায্য করার তৌফিক অর্জন করে এবং ইমামের সাক্ষাত লাভ করতে পারে বা তার জিয়ারত করা থেকে যেন বঞ্চিত না হয় বা ইমামের অসন্তুষ্টির কারণ না হয়। যারাই তার উপর ঈমান রেখেছে তারা কখনই কোন অত্যাচারী ও দুঃস্কৃতিকারী শাসকের পক্ষে যায় নি। আর যারা তার উপর ঈমান রেখে চলে তাদের ভিতর এক দৃঢ় শক্তির সঞ্চার করে যার কারণে তারা জুলুম ও শয়তানী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সক্ষম হয় এবং কখনই তারা শয়তানী শক্তির অধীন হয় না বরং তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকে।
তার আবির্ভাবের প্রতি ঈমান রাখার অর্থ এটা নয় যে
,মুসলমানরা তার আসার অপেক্ষায় সব কিছু থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রাখবে এবং ইমাম মাহ্দীর আগমনের আশায় নির্লিপ্ত থেকে সমাধানের দায়িত্ব তাঁর উপর ছেড়ে দিয়ে ঘরের কোণায় অবস্থান গ্রহণ করবে। অথবা কাফির ও দুষ্ট লোকের শাসনকে তারা মেনে নেবে বা জ্ঞান-বিজ্ঞানে ও শিল্পের
ক্ষেত্রে কোনরূপ উন্নতি করবে না বা সমাজকে পরিশুদ্ধ করার কোন চিন্তা করবে না
,এমনটি নয়।
যদি এমনটি মনে করা হয় যে
,তাঁর প্রতি ঈমান অলসতা
,উদাসীনতা বা দায়-দায়িত্বহীনতা ও অবসন্নতা নিয়ে আসবে
,তবে এটা সম্পূর্ণ বাতিল বিষয়। কেননা পবিত্র ইমামগণ ও তাদের সাহাবাগণ নিজেদের উন্নতির ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করতেন এবং এ লক্ষ্যে কাজ করতেন সেই সাথে তারা ইমামের আবির্ভাবের প্রতিও ঈমান রাখতেন। ইসলামের বড় বড় যত আলেম ছিলেন
,যারা দীন ও দুনিয়া উভয় জ্ঞানে পারদর্শি ছিলেন তারা কি তাঁর আবির্ভাবের প্রতি বিশ্বাসী ছিলেন না
?বিশ্বাসী ছিলেন এবং তারা বিশ্বাসী থেকেই দীনের ও সমাজের উন্নতির জন্য সাধ্যমত কাজ করে গেছেন
,এজন্য আত্মোৎসর্গও করেছেন। তারা কখনও নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে সরে আসেন নি। কঠিনতম কাজ করা থেকেও বিরত থাকেন নি বরং তারা নিজেদের তৈরী করার ক্ষেত্রে আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রেখে অকুতোভয়ে এগিয়ে গিয়েছেন।
ইসলামের প্রথম দিকের মুসলমানরা প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছ থেকে শুনেছিলেন যে
,ইসলাম এগিয়ে যাবে এবং তাঁর সামনে বিজয়ের পর বিজয় রয়েছে। কিন্তু তারপরও এই বিজয়ের খবর তাদেরকে অলসে পরিণত করে নি বা তাদের কাজ করা হতে বিরত করতে পারে নি
;বরং তাদের চেষ্টার পরিমান আরও দ্বিগুণ হয়েছিল এবং কষ্ট ও ত্যাগের মাধ্যমে সফলতায় পৌঁছেছিল।
বর্তমান সময়ও মুসলমানরা বিভিন্ন বড় বড় দায়িত্বে রয়েছেন। তাদেরকে অবশ্যই দৃঢ়তার সাথে সে সকল দায়িত্ব পালন করতে হবে। পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রেখে সময় ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করবেন। সকল সময় সকল ক্ষেত্রে উপস্থিত থাকবেন এবং সকলকে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করবেন। শত্রুর অবৈধ অনুপ্রবেশকে প্রতিহত করবেন। ইসলাম ও মুসলমানদের উপর শত্রুর চিন্তাগত
,অর্থনৈতিক
,রাজনৈতিক ও সামরিক হামলাকে প্রতিহত করবে। যতটুকু বা যে পরিমানই সম্ভব নিজেদেরকে নৈতিকতার ব্যাপারে সচেতন করবে যাতে করে ইমাম মাহ্দীর সাহায্য ও সহযোগিতা
,দয়া ও করুণা বেশী করে তাদের ভাগ্যে জোটে। যতটুকু সম্ভব ক্ষেত্রকে এমনভাবে প্রস্তুত করা যাতে করে আল্লাহর সর্বশেষ প্রতিনিধি ও এই শেষ জামানার ইমাম দ্রুত আবির্ভূত হন।
আমিরুল মু
’
মিনীন আলী (আ.) নবী করিম (সা.)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করে বলেছেন :
اَفْضَلُ الْعِبادَةِ اِنْتِظارُ الْفَرَجِ
হযরত বাকিয়াতুল্লাহর অর্থাৎ ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের অপেক্ষায় থাকা হচ্ছে সর্ব উৎকৃষ্ট ইবাদত।
ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) বলেছেন : দ্বাদশ ইমামের অন্তর্ধান বেশ দীর্ঘ হবে। যারা তাঁর অন্তর্ধানের সময় তাঁর ইমামতের উপর বিশ্বাসী এবং তাঁর আবির্ভাবের অপেক্ষায় থাকবে তারা অন্যান্য সকল জামানার জনগণের থেকে উত্তম হবে। কেননা আল্লাহ্ রাব্বুল আ
’
লামিন তাদেরকে এতটা বিবেক-বুদ্ধি
,বোঝার ক্ষমতা ও জ্ঞান দান করেছেন যে ইমাম অন্তর্ধানে থাকা সত্ত্বেও তাদের কাছে উপস্থিত মনে হবে। আর এ কারণেই আল্লাহ্ রাব্বুল আ
’
লামিন তাদের মর্যাদাকে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সঙ্গী হিসেবে তাঁর সাথে যুদ্ধকারী মুজাহিদের স্থান দিয়েছেন। তারা সত্য সত্যই নিবেদিত প্রাণ এবং প্রকৃতই আমাদের অনুসারী। আর তারাই জনসাধারণকে লুকিয়ে বা গোপনে আল্লাহর দিকে আহ্বান করে।
আরও বলেছেন :
اِنْتِظارُ الْفَرَجِ مِنْ اَعْظَمِ الْفَرَجِ
মহামুক্তির প্রতীক্ষা থাকা হচ্ছে সবচেয়ে বড় মুক্তি।
মরহুম আয়াতুল্লাহ্ সাইয়্যেদ সাদরুদ্দিন সাদর এভাবে লিখেছেন : মহা মুক্তির জন্য অপেক্ষা হচ্ছে যে বিষয়ের প্রতি অপেক্ষমান তা বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য সচেষ্ট থাকা। এটা গোপন নয় যে হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের অপেক্ষায় থাকার অর্থই হচ্ছে নিজের ও সমাজের বিশেষ করে শিয়া সমাজকে পরিশুদ্ধ করা যা নিম্নরূপ :
1-অপেক্ষা স্বয়ং মানুষের আত্মার জন্য একটি বিশেষ অনুশীলন বা প্রশিক্ষণ। যেমন বলা হয়ে থাকে :
اَلْاِنْتِظارُ أَشَدُّ مِنَ الْقَتْلِ
অপেক্ষা হচ্ছে নিহত হওয়া থেকেও কষ্টকর।
আর অপেক্ষা করার জন্য যা প্রয়োজন তা হচ্ছে
,যে বিষয়ে বা জিনিসের জন্য অপেক্ষা করা হয় তার প্রতি চিন্তা-ভাবনাকে ব্যস্ত রাখা ও দৃষ্টি রাখা এবং চিন্তা শক্তিকে একটি বিষয়ে কেন্দ্রীভূত করা। আর এই কঠিন কাজের দু
’
টি সুফল আছে যা নিম্নরূপ :
ক) মানুষের চিন্তাশক্তি তার কার্যশক্তির পরিমান বৃদ্ধি করে।
খ) মানুষ একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের প্রতি গভীর চিন্তা-ভাবনা করার জন্য তার চিন্তাশক্তি ও ক্ষমতাকে এক বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত করার শক্তি অর্জন করে। আর এই দু
’
টি সুফল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা মানুষ তার জীবন পরিচালনা করার ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুভব করে থাকে।
2-অপেক্ষার কারণে মানুষের মুসিবত ও সমস্যা হালকা হয়। কেননা সে জানে যে পরবর্তীতে এই সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে বা এর ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব। আর এ দু
’
টির মধ্যে কত পার্থক্য যে সে জানে পরবর্তীতে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব বা আদৌও জানে না যে পরবর্তীতে এই সমস্যা সমাধান হবে কি হবে না। বিশেষ করে যদি সম্ভাবনা থাকে যে অতি দ্রুত এই সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে
;হযরত মাহ্দী (আ.) আবির্ভূত হয়ে পৃথিবী থেকে সব অন্যায় ও অত্যাচারকে নির্মূল করে ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠা করবেন এবং সমস্ত সমস্যা সমাধান করবেন।
3-মহামুক্তির প্রতীক্ষায় থাকার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানুষ ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সঙ্গী ও অনুসারী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করবে এমন কি তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকবে তার বিশেষ সহযোগী ও সৈনিকে পরিণত হওয়ার। আর তার জন্য প্রয়োজন হচ্ছে নিজের নফসকে পরিশুদ্ধ করার বিশেষ চেষ্টা করা ও নৈতিক গুণাবলীকে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। যাতে করে তাঁর সহযোগী হওয়ার যোগ্যতা অর্জিত হয় ও তাঁর নির্দেশে তাঁর সাথে থেকে জিহাদ করার তৌফিক অর্জন করতে পারে। হ্যাঁ
,এসবের জন্য প্রয়োজন হচ্ছে প্রকৃত চরিত্র
,যা আজ আমাদের সমাজে দুষ্প্রাপ্য।
4-মহামুক্তির প্রতীক্ষা শুধুমাত্র ব্যক্তি চরিত্র সংশোধন নয়
,বরং অন্যের আত্মিক সংশোধনেরও কারণ হয়। এর ফলে মানুষ ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর শত্রুদের উপর আধিপত্য অর্জনের পরিবেশ ও ক্ষেত্রও প্রস্তুত করতে সক্ষম হয়। আর এই উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্যে প্রয়োজন হলো জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখায় নিজেদেরকে পারদর্শী করা। কারণ শত্রুদের উপর ইমামের বিজয় লাভের বিষয়টি সাধারণ প্রক্রিয়াতেই সংঘটিত হবে।
বর্ণিত চারটি বিষয় প্রকৃত মহামুক্তির প্রতীক্ষায় থাকার অসংখ্য ইতিবাচক প্রভাবের ক্ষুদ্রতম একটি অংশ মাত্র।
মরহুম মুজাফফার এভাবে লিখেছেন : হযরত মাহ্দী (আ.)-এর অপেক্ষায় থাকার অর্থ এই নয় যে
,যেহেতু তিনি এসে দুনিয়াকে সংস্কার করবেন এবং যারা সত্যের পথে আছে তাদেরকে নাজাত দিবেন তাই এটা ভেবে হাত গুটিয়ে বসে থাকা
,দীনের কাজ না করা
,বিশেষ করে দীনের ওয়াজিব বিষয়গুলো যেমন দীনের আইন-কানুনকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য জিহাদ করা
,সৎ কাজের আদেশ দান ও মন্দ কাজে নিষেধ করা ইত্যাদি বর্জন করা কখনই বাঞ্ছনীয় নয়। কেননা মুসলমানরা যে কোন পরিস্থিতিতেই আল্লাহর হুকুম মেনে চলতে বাধ্য এবং আল্লাহর নির্দেশাবলী সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভের মাধ্যমেই সম্ভব সৎ কাজে আদেশ ও মন্দ কাজে বাধা দান করা। এটা সমীচীন নয় যে
,দুনিয়া সংস্কার হওয়ার অপেক্ষায় ওয়াজিব কাজ করা থেকেও বিরত থাকবো। অপেক্ষা কখনই মুসলমানদের ওয়াজিব দায়িত্বকে লাঘব করে না এবং কোন কাজ সম্পাদনের সময়কে পিছিয়ে নিয়ে যায় না।
এ কারণে নিশ্চিত যে ইমামের অন্তর্ধানের সময়ে তার অনুসারীরাও (শিয়ারা) বড় ধরনের পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। অবশ্যই পরীক্ষিত হওয়ার সময় একদিকে যেমন দীনের ছায়াতলে থেকে নিজেকে বাঁচাবে আর অন্যদিকে তেমনই ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে যাতে করে ইমামের সৈনিক হিসেবে ইসলামের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারে। বেশীর ভাগ জনগণই এই কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে নি।
জাবির জো
’
ফী বলেন : ইমাম বাকির (আ.)-এর কাছে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে
,আপনাদের মহামুক্তির সময় কখন
?
বললেন : দূরে! দূরে! আমাদের মহামুক্তি ততক্ষণ আসবে না যতক্ষণ না তোমাদেরকে চালনি দিয়ে চালা হচ্ছে। চালনি দিয়ে চালা হবে (তারপর ইমাম চালনি দিয়ে চালার কথাটিকে তিনবার উচ্চারণ করলেন) যাতে করে খারাপ লোকজন ধুলা-বালির ন্যায় চালনির নিচে পড়ে যায় আর ভালরা পৃথক হয়ে যায়।
হ্যাঁ অপেক্ষার এই বৈশিষ্ট্য আছে যে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে কোন প্রকার নিরাশার অবকাশ নেই এবং অপেক্ষাকারীরা আশান্বিত যে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাব ঘটবে ও আল্লাহর পক্ষ থেকে অতি দ্রুত মহা মুক্তি আসবে।
অপরদিকে অন্তর্ধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মানুষ এই সময়ে তাদের নিজের যোগ্যতাকে কাজে লাগাবে এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করবে যে
,কোন প্রকার ওহী
,এলহাম অলৌকিক সাহায্য ব্যতিরেকে তারা মানবতার কাফেলাকে তার প্রকৃত ও মহান লক্ষ্য অর্থাৎ আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছাতে সক্ষম নয়। তখন তারা (মানব সমাজের মাঝে অবস্থানের) অবশ্যই ওহী ও আসমানী জ্ঞান
,শিক্ষা ও ঐশী প্রশিক্ষণের সামনে মাথা নোয়াবে।