আবির্ভাবের আলামতসমূহ
যে সকল রেওয়ায়েতে আবির্ভাবপূর্ব ঘটনাবলীর বিষয়াদি উল্লেখ আছে তার পরিমান অনেক ও বিভিন্ন ধরণের। কিছু সংখ্যক রেওয়ায়েত সামাজিক অবস্থার উপর বিশেষ করে আবির্ভাবের পূর্বে মুসলিম সমাজের অবস্থা বর্ণনা করেছে এবং অন্য কিছু সংখ্যক রেওয়ায়েতে যে সকল ঘটনা আবির্ভাবকে ত্বরান্বিত করবে তার বর্ণনা দিয়েছে। অন্যান্য রেওয়ায়েতগুলো বিভিন্ন আশ্চর্য বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছে।
এই সমস্ত রেওয়ায়েতগুলোতে যে সকল জটিল ও সাংকেতিক বিষয়সমূহ বর্ণিত হয়েছে যদি বিশ্লেষণ করতে চাই তাহলে তার প্রতিটির জন্য আলাদা আলাদা বই লেখার প্রয়োজন হবে। যারা এ বিষয়ে আগ্রহী তারা যে বই বা টেক্সট সমূহে এ রেওয়ায়েতগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে তা অধ্যয়ন করতে পারেন। আমরা এই বইতে কয়েকটি আলামত যা সহজেই বোধগম্য তা উল্লেখ করব :
ক) যে সকল রেওয়ায়েত আবির্ভাবের আগেকার অবস্থার বর্ণনা করেছে যেমন : ইসলামী বিশ্বে ও পৃথিবী ব্যাপী জুলুম
,অত্যাচার
,ফিতনা-ফ্যাসাদ
,পাপ ও ধর্মহীনতার ব্যাপক বিস্তার ঘটবে : অনেক রেওয়ায়েতে ইমামগণ (আ.) ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর পবিত্র কিয়ামের ব্যাপারে এভাবে ইশারা করেছে যে
“
ইমাম মাহ্দী (আ.) তখনই কিয়াম করবেন যখন পৃথিবী পরিপূর্ণভাবে জুলুম
,অত্যাচার
,পাপ ও পঙ্কিলতায় ভরে যাবে।
”
এছাড়া আরও ব্যাপক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। অন্য রেওয়ায়েতে উল্লেখ করেছেন যে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের আগে এমনকি একেবারে নিকটতম সময়ে বিশেষ করে মুসলিম সমাজ বিভিন্ন ধরনের পাপ-পঙ্কিলতায় ভরে যাবে যেমন :
মদ বা নেশাকর পানীয় অবাধে বেচা-কেনা হবে। সুদ খাওয়ার প্রবণতা ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পাবে। ব্যভিচার অন্যান্য অপছন্দনীয় কাজসমূহের (যেমন সমকামিতা) ব্যাপক বিস্তার ঘটবে এবং তা প্রকাশ্যে করা হবে। নির্মম-নিষ্ঠুরতা
,অবৈধ কর্ম
,মুনাফেকী
,ঘুস খাওয়া
,লোক দেখানো কাজ
,বিদআত
,গীবত
,অপরের ক্ষতি করার পরিমাণ বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। অসচ্চরিত্রতা
,বেহায়াপনা
,জুলুম-অত্যাচার
,যেখানে সেখানে দেখা যাবে। মহিলারা বেপর্দা ও উত্তেজক পোশাক পরে সমাজে বের হবে। পুরুষেরা মহিলাদের মত
,মহিলারা পুরুষের মত পোশাক পরবে এবং একই রকম সাজ-সজ্জা করবে। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে বাধা দান করার প্রক্রিয়া উঠে যাবে। মুমিন ব্যক্তিরা অপমান-অপদস্থ হবে এবং পাপ ও খারাপ কাজগুলো ঠেকানোর মত শক্তি তাদের থাকবে না। কাফের বা ধর্মহীনদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং ইসলাম ও কোরআনের প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপই থাকবে না। সন্তানরা তাদের পিতা-মাতাকে অসম্ভব কষ্ট দিবে এবং তাদের অসম্মান করবে। বড়দের সামান্য পরিমাণ সম্মান দেয়া থেকেও তারা বিরত থাকবে। কারো অন্তরে কিঞ্চিত পরিমাণ ভালবাসাও থাকবে না। কেউ খুমস ও জাকাত দিবে না আর দিলেও তা প্রকৃত পথে খরচ হবে না। বেদীন ও কাফের এবং অসৎ লোকেরা মুসলমানদের উপর আধিপত্যশীল হবে এবং তাদেরকে নিজেদের দিকে নিয়ে যাবে
,মুসলমানরা তাদের পোশাক-আষাক
,চাল-চলন
,ধ্যান-ধরনকে অনুসরণ করে চলবে এবং আল্লাহর আইন-কানুনকে অকার্যকর করে দিবে ...।
এবং আরও অনেক বিষয় যা আমাদের পবিত্র ইমামগণ (আ.) তাঁদের রেওয়ায়েতে উল্লেখ করেছেন।
ইরানের জনগণ এই ধরনের ঘটনাগুলোকে অতীত শতাব্দীতে ইরানের ভূ-খণ্ডে দেখেছেন। এ দেশের (ইরানের) মুসলমানদের ইসলামী বিপ্লব প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের পাপ-পঙ্কিলতার বিরুদ্ধেই হয়েছিল (এ বিপ্লব সম্পর্কে তাদের আশা এটাই যে হয়তো ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর কিয়ামের সূচনা স্বরূপ হতে পারে) । পাপ-পঙ্কিলতা
,ফিতনা-ফ্যাসাদ
,ধর্মহীনতা
,অসৎ লোকদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা ও অশুভ বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে সকলেই একযোগে রুখে দাঁড়িয়েছিল। ঐ সকল ধর্মবিরোধী কর্মের মন্দ প্রভাব মুসলমানদের জীবনের প্রতিটি দিকে পড়ছিল। আল্লাহর অশেষ প্রশংসা যে
,এই দেশের প্রচুর মন্দ বিষয়কে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সকলেই জানেন যে পৃথিবীতে বিশেষ করে ইসলামী দেশগুলোতে এ ধরনের খারাপ কাজগুলো এখনও অব্যাহত আছে ...।
খ) যে সকল রেওয়ায়েতগুলোতে আবির্ভাবের আগেকার ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে
যেমন :
1
-
সুফিয়ানীর
উত্থান
।
2-সুফিয়ানীর বাহিনীর মাটির তলায় প্রোথিত হওয়া।
এই আলামতগুলোর প্রতি আমাদের পবিত্র ইমামগণ (আ.) বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন এবং পরিষ্কারভাবে সেগুলো বর্ণনা দিয়েছেন। যার একটি হচ্ছে সুফিয়ানীর উত্থান। রেওয়ায়েত অনুযায়ী বুঝা যায় সুফিয়ানী হচ্ছে উমাইয়া বংশোদ্ভূত ইয়াযিদ বিন মুয়াবিয়া বিন আবু সুফিয়ান এর উত্তর পুরুষ এবং জঘন্য প্রকৃতির লোক হবে। তার নাম উসমান বিন আ
’
নবাসেহ। সে নবী ও পবিত্র ইমামদের পরিবার (বংশ) ও তাদের অনুসারীদের সাথে ঘোর শত্রুতা পোষণ করে। লাল বংয়ের চেহারা
,গাঢ় নীল বংয়ের চোখ
,মুখে বসন্তের দাগ
,দেখতে কুৎসিত
,অত্যাচারী ও বিশ্বাসঘাতক। সিরিয়ায় আবির্ভূত হবে এবং দ্রুত পাঁচটি শহরকে (দামেস্ক
,জর্ডান
,হিমস
,কানসিরিন ও ফিলিস্তিন) তার দখলে নিয়ে আসবে। তারপর একটি বড় সৈন্য বাহিনী নিয়ে ইরাকের কুফা শহরের দিকে আসবে। ইরাকের বিভিন্ন শহর বিশেষ করে নাজাফ ও কুফাতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে। তার আরেকটি সৈন্য দলকে মদীনার দিকে পাঠাবে। তারা মদীনায় পৌঁছে মানুষদেরকে ব্যাপকভাবে হত্যা করবে
,তাদের অর্থ সম্পত্তি লুট করবে। তারপর সেই সৈন্য বাহিনীটি মদীনা হয়ে মক্কায় যাওয়ার পথে মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী স্থানে আল্লাহ্ রাব্বুল আ
’
লামিনের নির্দেশে মরুভূমির মধ্যে মাটির নিচে তলিয়ে যাবে। সে সময় ইমাম মাহ্দী (আ.) আবির্ভূত হবেন। এই ঘটনার পরে তিনি মক্কা থেকে মদীনায় এবং মদীনা থেকে ইরাক ও কুফাতে আসবেন। এদিকে সুফিয়ানী ইরাক থেকে সিরিয়ায় (দামেস্কে) পালিয়ে যাবে। ইমাম একটি বিশাল সৈন্য বাহিনীকে তার পিছু ধাওয়া করার জন্য পাঠাবেন। অবশেষে তাকে বাইতুল মুকাদ্দাসের মধ্যে তার শিরোচ্ছেদ করা হবে।
3
-
সাইয়্যেদ
হাসানীর
উত্থান
:
ইমামগণের রেওয়ায়েত অনুযায়ী সাইয়্যেদ হাসানী শিয়া মাযহাবের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। যিনি ইরানের দেইলামী ও কাযভীন শহর থেকে উত্থিত হবেন। তিনি একজন খোদাভীরু ও মহানুভব ব্যক্তি। ইমাম ও মাহ্দী হওয়ার দাবি করবেন না। শুধুমাত্র জনগণকে ইমামগণের পদ্ধতিতে ইসলামের প্রতি দাওয়াত দিবেন। তার এই দাওয়াতী কাজটি প্রসারলাভ করবে এবং প্রচুর সঙ্গী সাথিও পাবেন। নিজের এলাকা থেকে নিয়ে কুফা পর্যন্ত জুলুম-অত্যাচার ও সকল ধরনের পাপ-পঙ্কিলতাকে উৎখাত করবেন। ন্যায় পরায়ন শাসকের ন্যায় প্রশাসনিক কার্য পরিচালনা করবেন। তিনি যখন তার সৈন্য সামন্ত নিয়ে কুফাতে পৌঁছাবেন সে সময় তাকে খবর দেয়া হবে যে ইমাম তার সৈন্য বাহিনী ও সঙ্গী সাথিদের নিয়ে কুফার নিকটে চলে এসেছেন। তখন তিনি তার বাহিনী নিয়ে ইমামের সাখে দেখা করবেন
;ইমাম সাদিক (আ.) বলেন যে
,সাইয়্যেদ ইমামকে চেনেন ও জানেন কিন্তু যাতে করে তার সঙ্গী-সাথিরা ইমামের ইমামত ও ফযিলতকে জানতে পারে সে কারণে তিনি তার পরিচয়কে গোপন করবেন। ইমামের কাছে তাঁর ইমামতের পক্ষে প্রমাণ চাইবেন এবং নবিগণের পক্ষ থেকে যে জিনিসগুলো তাঁর কাছে আছে তা দেখাতে বলবেন। ইমাম সে জিনিসগুলোকে দেখাবেন এবং অলৌকিক ঘটনাও ঘটাবেন। সাইয়্যেদ হাসানী ইমামের হাতে বাইয়াত করবেন এবং তার সঙ্গী-সাথিরাও ইমামের হাতে বাইয়াত করবে। শুধুমাত্র চার হাজার লোক ব্যতীত আর সবাই ইমামকে মেনে নিবে। ঐ চার হাজার লোক ইমামকে যাদুকর বলে সম্বোধন করবে। ইমাম তিন দিন ধরে তাদের সাথে বিভিন্ন আলাপ-আলোচনায় রত থাকবেন। তারপরও যখন তারা তাকে মেনে নিতে রাজী হবে না
,তিনি তাদেরকে হত্যা করার জন্য নির্দেশ দিবেন। ইমামের নির্দেশে তাদেরকে হত্যা করা হবে।
4
-
আসমানী
ধ্বনি
:
অন্য আরেকটি আলামত হচ্ছে আসমানী ধ্বনি। এটা এরূপ যে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের পূর্বে মক্কায় বিরাট ভয়ংকর ও স্পষ্ট আসমানী চিৎকার ধ্বনি শোনা যাবে। তাতে ইমামের নাম ও বংশ পরিচিতি তুলে ধরে মানুষের সামনে তাঁর পরিচয় পেশ করা হবে। এই ধ্বনি হচ্ছে আল্লাহর নিদর্শনসমূহের একটি। এই ধ্বনিতে জনগণকে আদেশ দান করা হবে তারা যেন ইমামের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে যাতে করে তারা হেদায়েত প্রাপ্ত হয়। তার বিরুদ্ধে যেন কেউ কথা না বলে বা তার নির্দেশের বিপরীতে যেন কেউ না চলে
,যাতে করে তারা বিভ্রান্ত না হয়ে যায়।
আর ইমামের আবির্ভাবের আগে অন্য আরেকটি ধ্বনি উচ্চারিত হবে তাতে ইমাম আলী (আ.) ও তাঁর অনুসারীরাই যে সত্য পথের প্রতীক ছিল তার প্রমাণ দিবে।
5-ঈসা (আ.)-এর প্রত্যাবর্তন এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-কে অনুসরণ করা :
আসমান থেকে ঈসা (আ.)-এর অবতরণ এবং নামাযের সময় ইমাম মাহ্দী (আ.)-কে অনুসরণ করা (ইমাম মাহ্দীর পিছনে নামায পড়বেন) এ সকল বিষয় তাঁর আবির্ভাবের সাথে সাথে ঘটবে। এভাবেই বিভিন্ন রেওয়ায়েতে উল্লেখ আছে। নবী আকরাম (সা.) তাঁর প্রিয় কন্যা হযরত ফাতিমা (আ.)-কে বলেছেন :
وَ مِناَّ وَ اللَّهِ الَّذِى لاَ اِلَهَ اِلاَّ هُوَ مَهْدِىُّ هَذِهِ الْاُمَّةِ الَّذِى يُصَلِّى خَلْفَهُ عِيسى بْنُ مَريمَ
সেই আল্লাহ্ যিনি এক ও অদ্বিতীয় তাঁর কসম যে
,মাহ্দী আমার উম্মতের থেকেই। আর এমনই যে
,ঈসা ইবনে মারিয়াম তাঁর পিছনে নামায পড়বে।
অন্যান্য আলামতসমূহ বিভিন্ন বইতে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে
,এ সমস্ত আলামত বা সংকেতের সবগুলোই কী যেভাবে বলা হয়েছে সেভাবেই রূপ নেবে না প্রয়োজন বোধে তার পরিবর্তনও হতে পারে
?এটা এমন একটা বিষয় যা তার নিজের জায়গায় আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। আলামতসমূহের ব্যাপারে যেভাবে বলা হয়েছে তা হচ্ছে
,আলামত দুই ধরনের : নিশ্চিত ও অনিশ্চিত। যা কিছু নিশ্চিত তা অবশ্যই ঘটবে।
অন্য কিছু রেওয়ায়েতে আবার বলা হয়েছে যে
,এমনকি নিশ্চিত বিষয়গুলোও প্রয়োজন বোধে পরিবর্তিত হতে পারে
।
শুধুমাত্র ঐ বিষয়গুলোর পরিবর্তন সম্ভব নয়
,যে বিষয়গুলোর ব্যাপারে আল্লাহ্ রাব্বুল আ
’
লামিন ওয়াদা দান করেছেন। আর আল্লাহ্ রাব্বুল আ
’
লামিন কখনও ওয়াদার বরখেলাপ করেন না :
)
ا
ِنَّ اللَّهَ لاَ يُخْلِفُ الْميعادَ
(
সুস্পষ্ট যে
,যেখানে রেওয়ায়েতসমূহে উদ্ধৃত বিষয়সমূহেরও পরিবর্তন হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে সেক্ষেত্রে ইমাম মাহ্দীর জন্য অপেক্ষার অনুভূতিকে শিয়া সমাজে আরও শক্তিশালী ও মজবুত করবে। এজন্য যে
,সবসময় তাঁর আগমনের অপেক্ষায় থাকতে হবে এবং নিজেকে সেভাবে তৈরী করবে। কেননা সম্ভাবনা আছে যে হয়তো আলামত বা সংকেতের কোন খবর নেই অথচ ইমাম আবির্ভূত হয়েছেন।