প্রাচ্যবাসী এবং কালো পতাকাসমূহ সংক্রান্ত রেওয়ায়েত
এ হাদীসটি শিয়া-সুন্নী হাদীস গ্রন্থ ও সূত্রসমূহে বর্ণিত হয়েছে এবং তা
‘
কালো পতাকাসমূহের হাদীস
’
,‘
প্রাচ্যবাসীদের হাদীস
’
এবং
‘
মহানবী (সা.)-এর পরে তাঁর পবিত্র আহলে বাইত যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হবেন সে বিষয় সংক্রান্ত রেওয়ায়েত
’
-এর শিরোনামে খ্যাতি লাভ করেছে। আরেকদিকে
,এ হাদীসটি বিভিন্ন হাদীসগ্রন্থ ও সূত্রে মহানবী (সা.)-এর কতিপয় সাহাবী থেকে শব্দ ও বাক্যসমূহের মধ্যে সামান্য পার্থক্যসহ বর্ণিত হয়েছে। কতিপয় রেওয়ায়েত ও বর্ণনায় এ হাদীসের কতিপয় অংশ বর্ণিত হয়েছে। আবার কতিপয় হাদীস গ্রন্থ ও সূত্রে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে যে
,এ সব হাদীসের রাবীরা (বর্ণনাকারী) সকলেই বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য।
আহলে সুন্নাতের হাদীস বিষয়ক প্রাচীনতম গ্রন্থ ও সূত্রসমূহ যেগুলোয় এ রেওয়ায়েত অথবা এর অংশবিশেষ বর্ণিত হয়েছে সেগুলো হচ্ছে : সুনান-ই ইবনে মাজাহ্
,2য় খণ্ড
,পৃ. 269 ও 518
;হাকিমের মুস্তাদরাকুস সাহীহাইন
,4র্থ খণ্ড
,পৃ. 464 ও 553
;ইবনে হাম্মাদের হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি
,ফিতান
,পৃ. 84 ও 85
;ইবনে আবি শাইবার মুসান্নিফ গ্রন্থ
,15তম খণ্ড
,পৃ. 235
;সুনান-ই আদ দারেমী
,পৃ. 93 এবং পরবর্তী হাদীস গ্রন্থসমূহে পূর্বোক্ত গ্রন্থাদির বরাত দিয়ে এ রেওয়ায়েতটি বর্ণিত হয়েছে।
কতিপয় সহীহ হাদীস গ্রন্থপ্রণেতা
,যেমন ইবনে মাজাহ্
,আহমাদ ইবনে হাম্বাল এবং অন্যান্য মুহাদ্দিস কর্তৃক বর্ণিত এ রেওয়ায়েতটি যা হচ্ছে নিম্নরূপ :
“
একদল লোক প্রাচ্য থেকে বের হবে (বিপ্লব করবে) এবং হযরত মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে
”
,তা সম্ভবত নিম্নোক্ত এ রেওয়ায়েতটিরই অংশ ।
আল হাকিমের মুস্তাদরাকুস সাহীহাইন গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত হাদীসটি হুবহু নিচে উল্লেখ করা হলো :
আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন : আমরা মহানবী (সা.)-এর সমীপে উপস্থিত হলাম। তিনি অত্যন্ত হাস্যোজ্জ্বল মুখে ও আনন্দের সাথে আমাদের বরণ করলেন। আমরা তাঁর কাছে যা জিজ্ঞাসা করলাম সে ব্যাপারে তিনি উত্তরও দিলেন। আর আমরা নীরব হলে তিনি কথা বলে যাচ্ছিলেন। আর ঐ সময় একদল হাশিম বংশীয় যুবক সেখান দিয়ে যাচ্ছিল যাদের মধ্যে ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনও ছিলেন। মহানবী (সা.)-এর দৃষ্টি তাদের ওপর পড়লে তাঁর দু
’
নয়ন অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল। আমরা তখন বললাম : হে রাসূলাল্লাহ্! আমরা প্রায়ই অপনার মুখমণ্ডলে এমন কিছু দেখতে পাই যা আমাদেরকে কষ্ট দেয়। মহানবী (সা.) বললেন : আমরা এমন এক পরিবার
,মহান আল্লাহ্ আমাদের জন্য পার্থিব জগতের ওপর আখেরাতকে মনোনীত করেছেন। শীঘ্রই আমার পরে আমার আহলে বাইত শহর-নগর
,অঞ্চল ও দেশসমূহে শরণার্থীর মতো ছড়িয়ে পড়বে। আর এ অবস্থা ঐ সময় পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে যখন প্রাচ্য (ইরান) থেকে কালো পতাকাসমূহ উত্থিত হবে ও পতপত করে উড়তে থাকবে। কালো পতাকাবাহীরা তাদের ন্যায্য অধিকার দাবি করবে। তবে তাদের অধিকারসমূহ প্রদান করা হবে না। এজন্য তারা তাদের অধিকারসমূহ থেকে হাত গুটিয়ে নেবে না। কিন্তু তাদের দাবির প্রতি সাড়া দেয়া হবে না। তারা পুনরায় তাদের অধিকার চাইবে কিন্তু তাদের দাবির প্রতি গুরুত্ব দেযা হবে না। এমতাবস্থায় তারা সংগ্রাম করার পথ বেছে নেবে এবং বিজয়ী হবে। যদি তোমাদের মধ্য থেকে কেউ অথবা তোমাদের বংশধরদের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তি ঐ সময় বিদ্যমান থাকবে তখন তার উচিত হবে আমার আহলে বাইতভুক্ত নেতার সাথে যোগ দেয়া
,এমনকি কষ্ট করে বরফের ওপর দিয়ে হামাগুঁড়ি দিয়ে হলেও তার সঙ্গে যোগ দেবে। কারণ
,এ সব কালো পতাকা হবে হেদায়েতের পতাকা যেগুলো আমার আহলে বাইতের এক ব্যক্তির (ইমাম মাহ্দী) হাতে তারা অর্পণ করবে
,যার নাম হবে আমার নামের অনুরূপ এবং যার পিতার নাম হবে আমার পিতার নাম। সে পৃথিবীর অধিপতি হবে এবং এ পৃথিবী অন্যায়
,অত্যাচার ও বৈষম্যে পরিপূর্ণ হয়ে যাবার পর সে তা ন্যায় ও সুবিচার দিয়ে পূর্ণ করে দেবে।
অনুরূপ হাদীস আহলে বাইতের অনুসারীদের রচিত হাদীস গ্রন্থ ও সূত্রসমূহে বর্ণিত হয়েছে। যেমন সাইয়্যেদ ইবনে তাউস তাঁর আল মালাহিয ওয়াল ফিতান গ্রন্থের 60 ও 117 পৃষ্ঠায় এবং আল্লামা মাজলিসী হাফিয আবু নাঈম প্রণীত গ্রন্থ আরবাঈন থেকে বিহারুল আনওয়ার গ্রন্থের 51 খণ্ডের 83 পৃষ্ঠায় (প্রাচ্য থেকে হযরত ইমাম মাহ্দীর আগমনের সাথে সংশ্লিষ্ট 27তম রেওয়ায়েত) এবং এরূপ রেওয়ায়েত এ গ্রন্থের 52তম খণ্ডের 243 পৃষ্ঠায় ইমাম বাকির (আ.) থেকে রেওয়ায়েত করেছেন।
ইমাম বাকির (আ.) বলেছেন :
“
যেন আমি দেখতে পাচ্ছি যে
,প্রাচ্য থেকে একদল বের হচ্ছে এবং তারা তাদের অধিকার দাবি করছে
;কিন্তু তাদের দাবির প্রতি সাড়া দেয়া হচ্ছে না
;তারা পুনরায় তাদের দাবির ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করবে। কিন্তু তাদের বিরোধীরা তা মেনে নেবে না। যখন তারা এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করবে তখন তারা কাঁধে তরবারি তুলে নেবে এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে
;আর তখনই তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত দাবির ইতিবাচক জবাব পাবে
;কিন্তু এবার তারা নিজেরাই তা মেনে নেবে না
;অবশেষে তাদের সবাই সংগ্রাম করতে থাকবে। আর তারা হেদায়েতের পতাকা তোমাদের অধিপতির (ইমাম মাহ্দী) শক্তিশালী হাত ব্যতীত আর কারো হাতে অর্পণ করবে না। তাদের নিহত ব্যক্তিরা শহীদ বলে গণ্য হবে। কিন্তু আমি যদি ঐ সময় পর্যন্ত বেঁচে থাকতাম তাহলে এ বিষয়ে অর্থাৎ ইসলামের অধিপতিকে সাহায্য করার জন্য নিজেকে সংরক্ষণ করতাম।
”
এ রেওয়ায়েত বা হাদীসটি বিশ্লেষণ করে কয়েকটি বিষয এ থেকে বের হয়ে আসে :
প্রথম বিষয়
:
এ রেওয়ায়েতটি ইজমালী মুতাওয়াতির । এর মুখ্য বিষয় হচ্ছে
,মহানবী (সা.) কর্তৃক তাঁর পরে তাঁর আহলে বাইতের অত্যাচারিত ও নিপীড়িত হওয়া সংক্রান্ত তথ্য প্রদান এবং যে উম্মত বা জাতি তাঁর আহলে বাইতের অধিকার প্রদানের দাবি জানাবে তারা ঐ সব ব্যক্তি যারা প্রাচ্য থেকে উত্থিত হবে এবং তাদের মহান নেতা হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর বিশ্ব সরকার ও প্রশাসনের ক্ষেত্র ও পটভূমি প্রস্তুত করবে। এসব ব্যক্তির শাসন ক্ষমতা লাভ করার পরেই ইমাম মাহ্দী আবির্ভূত হবেন। মহান আল্লাহ্ তাঁর মাধ্যমে ইসলামকে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত করাবেন
;তিনি পৃথিবীকে ন্যায় ও সুবিচার দিয়ে পূর্ণ করে দেবেন।
দ্বিতীয় বিষয়
:
‘
একদল লোক প্রাচ্য থেকে বের হবে যাদের পতাকাগুলো হবে কালো
’
-এ বাক্যে
‘
একদল লোক
’
বলতে ইরানীদেরকে বোঝানো হয়েছে। এ ব্যাপারে সকল সাহাবী যাঁরা এ রেওয়ায়েত ও অন্যান্য রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন তাঁদের মধ্যে ঐকমত্য আছে এবং তাবেঈন যাঁরা এ রেওয়ায়েতটি সাহাবীদের থেকে গ্রহণ করেছেন তাঁরাও এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন এবং একইভাবে তাঁদের পরে পূর্ববর্তী শতাব্দীগুলোর সকল হাদীস সংকলকের মধ্যেও এ বিষয়টির ব্যাপারে ঐকমত্য রয়েছে। অর্থাৎ এসব ব্যক্তির (ইরানীদের) অভ্যুত্থান এবং উত্থানের ব্যাপারটা ঐ যুগে সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত ব্যাপার বলে গণ্য হতো। এ কারণেই তাদের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তিই এ দল বা গোষ্ঠী ভিন্ন মত
,উদাহরণস্বরূপ তুরস্কবাসী অথবা ভারতীয় অথবা অন্য কোন দেশের অধিবাসী হতে পারে
-এ ব্যাপারে কোন ইঙ্গিতই করেন নি। বরং কতিপয় রাবী এবং সংকলক স্পষ্ট বলেছেন যে
,তারা ইরানী হবে
,এমনকি বেশ কিছু সংখ্যক বর্ণনায়
‘
খোরাসানীরা
’
শব্দটি এসেছে। পরবর্তীতে খোরাসানের পতাকাসমূহ সংক্রান্ত রেওয়ায়েতে এ বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
তৃতীয় বিষয়
:
ঐ সব ব্যক্তির উত্থান ও আন্দোলন বিশ্ববাসীর শত্রুতা এবং (তাদের পক্ষ থেকে চাপিয়ে দেয়া) যুদ্ধের মোকাবিলা করে অবশেষে জয়ী হবে এবং এর পরপর ইমাম মাহ্দী (আ.) আবির্ভূত হবেন।
চতুর্থ বিষয়
:
এমনকি খুব সঙ্কটজনক পরিস্থিতির মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তাদের সমসাময়িক প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির ওপর অত্যাবশ্যক তাদের সাহায্যার্থে অগ্রসর হওয়া। এমনকি তাদেরকে সাহায্য করার জন্য জমাট বরফর ওপর দিয়ে পথ চলতে হলেও তাদের এ কাজই করতে হবে।
পঞ্চম বিষয়
:
তাদের পতাকা হবে হেদায়েতের পতাকা। অর্থাৎ তাদের প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও প্রশাসনের সঠিক ধর্মীয় রূপ ও পরিচিতি থাকবে। তাদের কর্মকাণ্ড ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ইসলামের বিধি-বিধান ও এ ধর্মের পবিত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে এমনভাবে সামঞ্জস্যশীল হবে যে
,যদি কোন মুসলমান এ দল বা গোষ্ঠীটির সাথে সহযোগিতা করে তাহলে সে তার ধর্মীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পন্ন করেছে এবং তারা দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাবে।
ষষ্ঠ বিষয়
:
এ রেওয়ায়েত অনাগত ভবিষ্যৎ এবং গাইব সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে এবং মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াতের সত্যতা নির্দেশকারী অন্যতম মুজিযাস্বরূপ। এটা এ কারণে যে
,মহানবী (সা.) তাঁর আহলে বাইতের অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হওয়া এবং পৃথিবীর আনাচে-কানাচে তাঁদের ছড়িয়ে পড়া ও শরণার্থী হওয়ার ব্যাপারে যা কিছু বলেছেন তা বিগত শতাব্দীগুলোয় ঘটেছে হয়েছে। অবস্থা এতদূর গড়িয়েছে যে
,আমরা ইতিহাসে এবং সমগ্র বিশ্বব্যাপী এমন কোন পরিবার সম্পর্কে জানি না যে
,তারা মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইত এবং হযরত আলী (আ.) ও হযরত ফাতেমা (আ.)-এর বংশধরদের মতো নির্বাসিত হতে এবং উদ্বাস্তু জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়েছে।
উপরিউক্ত বিষয়টি আলোচনা করার পর যেহেতু ইমাম বাকির (আ.) থেকে বর্ণিত পূর্বে উল্লিখিত রেওয়ায়েতে তাদের উত্থান
,বিপ্লব ও আন্দোলন সংক্রান্ত সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্যাবলী বর্ণিত হয়েছে সেহেতু আমরা এ রেওয়ায়েতে ব্যবহৃত কিছু বাক্য পর্যালোচনা করব। আমার দৃষ্টিতে যা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে এ রেওয়ায়েতটি মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত পূর্ববর্তী হাদীসটির সাথে সম্পর্কযুক্ত অথবা তার সদৃশ। যদিও ইমাম বাকির (আ.) এরূপ সম্পর্ক থাকার ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলেন নি
,তবে তিনি এবং অন্য সকল ইমাম বলেছেন যে
,তাঁরা যা বর্ণনা করেন তা তাঁদের শ্রদ্ধেয় প্রপিতামহগণ এবং তাঁদের ঊর্ধ্বতন পুরুষ মহানবী (সা.) থেকেই বর্ণিত।
‘
আমি যেন দেখতে পাচ্ছি যে
,একদল লোক প্রাচ্য থেকে বের হযেছে...
’
-এ বাক্যটি থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে
,জনগণের এ উত্থান ও বিপ্লব মহান আল্লাহর অন্যতম অবশ্যম্ভাবী অঙ্গীকার এবং এ কারণেই যে সব বাক্যে মহানবী (সা.) অথবা ইমামগণ
‘
আমি যেন দেখতে পাচ্ছি
’
অথবা
‘
ঐ বিষয়টি বাস্তবায়িত হয়েছে
’
-এ ধরনের উক্তি করেছেন সেগুলো থেকে তাঁদের চিন্তা-বিশ্বাসে এ বিষয়টি অবশ্যম্ভাবী
,সুস্পষ্ট এবং অকাট্য হওয়া এবং এ ব্যাপারে তাঁদের দৃঢ় আস্থা থাকার বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়ে যায়। যেন তা এমনই যে
,তাঁরা পুরো ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করছেন
;বরং বলা যায় যে
,মহান আল্লাহ্ তাঁদের যে বিশেষ অন্তর্দৃষ্টি দিয়েছেন এবং যা মহানবী (সা.) ও আহলে বাইতের মর্যাদার সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল সেই অর্ন্তদৃষ্টি সহকারে তাঁদের এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করার বিষয়টি স্পষ্ট প্রতিভাত হয়।
এতে আরো ইঙ্গিত রয়েছে যে
,ইরানীদের আন্দোলন
,বিপ্লবের মাধ্যমে হবে। কারণ
,‘
তারা অবশ্যই কিয়াম করবে
’
-এ উক্তির অর্থও ঠিক এটাই। আর
‘
আমি যেন দেখতে পাচ্ছি যে
,একদল লোক প্রাচ্য থেকে বের হবে এবং তারা তাদের অধিকার দাবি করবে। তাদের দাবির ওপর পুনরায় জোর গুরুত্বারোপ করবে। কিন্তু তাদের বিরোধীরা তা মেনে নেবে না। যখন এ ধরনের অবস্থা তারা প্রত্যক্ষ করবে তখন তারা তাদের কাধে তরবারি তুলে শত্রুদের মোকাবিলায় দাঁড়াবে। আর এরূপ পরিস্থিতিতে তারা তাদের শত্রুর পক্ষ থেকে (তাদের দাবির ব্যাপারে) ইতিবাচক সাড়া পাবে। তবে তারা নিজেরাই এবার তা মেনে নেবে না। অবশেষে তাদের সবাই সংগ্রাম করতে থাকবে। পরবর্তী এ উক্তিতেও একই বিষয়ের ইঙ্গিত বিদ্যমান।
ইরানীদের ধারাবাহিক এ আন্দোলনকে 80 বছর পূর্বের তাদের সাংবিধানিক আন্দোলন হিসাবেও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে
;কারণ জনগণ চেয়েছিল যে
,কতিপয় আলেম ও ইসলামী চিন্তাবিদ রাষ্ট্রের আইন-কানুন তদারক ও নিয়ন্ত্রণ করবেন এবং দেশের যে আইন ইসলামের বিধি-বিধানের পরিপন্থী হবে তা তাঁরা প্রত্যাখ্যান করবেন। তদান্তীন্তন ইরান সরকার 1906 সালের সংবিধানে বাহ্যত: জনগণের এ দাবি মেনে নেয়
,কিন্তু আসলে তারা তা মেনে নেয় নি। এরপর 1951 সালে আয়াতুল্লাহ্ কাশানী ও মুসাদ্দেকের আন্দোলনে আবার তারা এ দাবি জানালে ইরান সরকার এর প্রতি ভ্রূক্ষেপও করেনি
;আর এ পর্যায়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের দ্বিতীয় বিপ্লব ব্যর্থ করার মাধ্যমে শাহ্ যে ঐ দিনগুলোতে ইরান থেকে পালিয়ে গিয়েছিল তাকে ইরানে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল। ইরানী জনগণ এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে কাঁধে অস্ত্র তুলে নিয়ে ইমাম খোমেইনীর আন্দোলনে আত্মোৎসর্গ করার জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হয়ে যায় এবং লক্ষ লক্ষ জনতা শত্রুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এ যুগ সন্ধিক্ষণেও শাহ্ ও তার বিদেশী প্রভুরা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্য) নিজেদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়ন করার প্রয়াস চালিয়ে যেতে থাকে এবং ইরানী জনগণকে বলা হয় যে
,শাহের শাসন কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ণ
থাকার শর্তে দেশের আইন-কানুনের ওপর 6 জন ফকীহ্-মুজতাহিদের তদারক ও তত্ত্বাবধান সম্বলিত 1906 সালে গৃহীত সংবিধানের ধারাগুলো শাহ্ সরকার মেনে নেবে। তবে কতিপয় আলেমের পক্ষ থেকে শাহ্ সরকারের এ প্রস্তাব ও পরিকল্পনা মেনে নেয়া হলেও ইমাম খোমেইনী এবং ইরানের কোটি কোটি জনতা তা মেনে নেন নি। তারা পবিত্র ইসলামী সংগ্রাম অব্যাহত রাখে এবং উদ্ধত সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তির ওপর বিজয় লাভ করার মাধ্যমে দেশে ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। তারা নিশ্চিতভাবে হেদায়েতের এ পতাকা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবকালে তাঁর হাতে অর্পণ করবে।
তবে অধিকতর ভালো ব্যাখ্যা হচ্ছে
,তারা তাদের শত্রুদের কাছে ন্যায্য অধিকারের দাবি করবে। আর তাদের এসব শত্রু
হবে পরাশক্তিবর্গ। পরাশক্তিবর্গের কাছে ইরানী জাতির দাবি ছিল যেন তারা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে এবং তাদের দেশে ইসলাম ধর্মের বিধি-বিধান কায়েম করতে দেয়। আর এভাবে তারা (পরাশক্তিবর্গ) তাদেরকে তাদের আধিপত্য ও প্রভাব থেকে মুক্তি দেয় এবং তাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব যেন মেনে নেয়। কিন্তু তাদের ন্যায় দাবির প্রতি ভ্রূক্ষেপ করা হবে না যার ফলে তারা পরাশক্তিবর্গের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হবে। কিন্তু তারা এ যুদ্ধে বিজয়ী হবে। তাদের শত্রুরা এ অবস্থা দেখে একটি শর্তের ভিত্তিতে তাদের পূর্বের দাবি মেনে নিতে এবং অধিকার প্রদান করতে চাইবে। আর শর্তটা হচ্ছে
,তারা ইরানে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে পারবে
,কিন্তু তারা বিপ্লব রফতানী করতে পারবে না। তবে তখন দেরী এবং বিশ্ব-পরিস্থিতি বদলে যাওয়ার কারণে ইরানীরা পরাশক্তিবর্গের এ প্রস্তাবে রাজী হবে না। এরপর ইরানী জনগণের নতুন বিপ্লব শুরু হয়ে যাবে এবং তারা সংগ্রামের পথ বেছে নেবে। পরাশক্তিবর্গ তাদেরকে যেসব সুবিধা প্রদান করতে চাইবে তারা সেগুলো প্রত্যাখ্যান করবে এবং ইরানের চেয়েও অনেক বৃহত্তর ও বিস্তৃত সামাজিক পরিমণ্ডলে ইসলাম ধর্মের কর্তৃত্ব ও কার্যকারিতা অব্যাহত রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করবে। আর এ সব ঘটনা ঘটার পরপরই ইমাম মাহ্দী (আ.) আবির্ভূত হবেন এবং ইরানী জাতি তাঁর হাতে সংগ্রামের পতাকা অর্পণ করবে।
দ্বিতীয় ব্যাখ্যায় যে বিষয়টি অধিকতর উত্তম পন্থায় এসেছে তা হচ্ছে এই যে
,ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর আন্দোলনের দাবি ও আকাঙ্ক্ষাসমূহ
,সাংবিধানিক আন্দোলন বা হযরত আয়াতুল্লাহ্ কাশানী ও ড. মোসাদ্দেকের আন্দোলনের দাবি-দাওয়ার অনুরূপ ছিল না। বরং সেগুলো আলেম সমাজের নেতৃত্বে বৈধ ইসলামী হুকুমতের দাবি থেকেই উদ্ভূত ছিল।
তবে
‘
এবং তারা তাদের কাঁধে তরবারি তুলে নেবে
’
-এ উক্তি থেকে মনে হচ্ছে যে
,বর্তমান যুদ্ধ অথবা যুদ্ধের পূর্ণপ্রস্তুতি হতে পারে
।
তবে বাক্যটিকে শাহের ঘুণে ধরা পতন্মুখ সরকার ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে লক্ষ-কোটি জনতার সংগ্রাম
,প্রতিরোধ
,বিক্ষোভ ও শাহাদাত বরণের প্রবল ইচ্ছা ইত্যাদির ওপর প্রয়োগ করা যায় না। কারণ
,ঐ সময় জনগণের হাতে অস্ত্র ছিল না যে
,তারা তা কাঁধে তুলে নিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হবে। বরং তাদের আন্দোলন ও বিপ্লব ছিল নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ। তারা খালি হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বিপ্লব করেছে এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে। আর যদি শাহের সামরিক ঘাঁটি ও ক্যান্টনমেন্টসমূহের পতন এবং জনগণের হাতে অস্ত্র আসার বিষয়টি ধরে নিয়ে এ বিষয়ের সাথে যোগ করি তুবও এ বিপ্লবটি সশস্ত্র ও সামরিক সংঘর্ষ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ওপর নির্ভরশীল ছিল না। শাহের গার্ড বাহিনীর সাথে জনগণের যে সামান্য সংঘর্ষ হয়েছিল তা বিবেচনায় আনলেও ইসলামী বিপ্লব বিজয়ে অন্যান্য সকল বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের সাথে সশস্ত্র অভিযানসমূহের অনুপাত পাঁচ শতাংশের চেয়েও কম হবে। অধিকন্তু রেওয়ায়েতটির বর্ণনাধারা ও বাচনভঙ্গি থেকে বোঝা যায় যে
,ইরানী জাতির অভ্যুত্থান এবং নিজেদের বিভিন্ন দাবি উত্থাপন একই আন্দোলনে এবং একের পর এক সংঘটিত হবে। আর তা বেশ কিছু ধাপে এবং দীর্ঘ একশ
’
বছর ধরে সংঘটিত হবে না।
এ ছাড়াও
,এ হাদীস ও অন্যান্য হাদীসের অধিকাংশ পূর্ণাঙ্গ বিবরণ ও মূল পাঠ থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে
,নিজেদের প্রথম দাবি-দাওয়া ও আকাঙ্ক্ষাসমূহের ক্ষেত্রে ইরানীদের এ প্রতিক্রিয়া আসলে তাদের এক অসম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পরই হবে। উল্লেখ্য যে
,তারা ঐ যুদ্ধে জয়লাভ করবে। তবে
“
তারা তাদের অধিকারে দাবি জানাবে এবং যখন তারা তাদের ন্যায্য অধিকার পাবে না তখনই তারা সংগ্রামে অবতীর্ণ এবং বিজয়ী হবে। অতঃপর তারা ইতিবাচক সাড়া পাবে। কিন্তু তারা নিজেরাই তখন তা মেনে নেবে না...।
”
এ ব্যাখ্যার ভিত্তিতে কেবল দু
’
টি বিষয় থেকে যায় :
প্রথম বিষয়
:
‘
এবং তারা তাদের অধিকার অন্বেষণ করবে
,কিন্তু ইতিবাচক সাড়া পাবে না
’
-এ বাক্যটি থেকে বোঝা যায় যে
,তাদের দাবি দু
’
পর্যায়ে বাস্তবায়িত হবে। তাই ঐ পর্যায়দ্বয় কি কি
?
এ দু
’
পর্যায়কে তিনভাবে উত্তর দেয়া যায় :
1. যেহেতু এ একই বিররণের পুনরাবৃত্তি থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় যে
,তারা তাদের বৈধ ন্যায়সঙ্গত কাঙ্ক্ষিত অধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে তাদের শত্রুদের কাছে জোর দাবি জানাবে ও তীব্র চাপ প্রয়োগ করবে। তবে কোন ব্যক্তি যদি মহানবী (সা.) ও ইমামদের থেকে বর্ণিত রেওয়ায়েতসমূহে সূক্ষ্ম দৃষ্টি দেয় তাহলে তাঁদের (আ.) থেকে
,বিশেষ করে আলোচ্য এ রেওয়ায়েতের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক পুনরাবৃত্তিকে সে অসম্ভব বলে মনে করবে।
2. এ উত্তর যা সম্ভবত এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী হবে তা হচ্ছে এই যে
,তাদের বিপ্লবের দুই পর্যায়ে এ ঘটনা ঘটবে
,প্রথমে তারা যুদ্ধের পূর্বে তাদের ন্যায্য দাবি ও আকাঙ্ক্ষাসমূহ ব্যক্ত করবে যা গ্রহণ করা হবে না
;কিন্তু পরবর্তী পর্যায় যুদ্ধে তাদের বিজয় লাভ করার পর তারা নিজেরাই তা মেনে নেবে না।
3. যেহেতু শত্রুদের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধের উভয় পর্যায়েই তারা তাদের অধিকার দাবি করবে
,অথচ তাদের দাবির প্রতি মনোযোগ দেয়া হবে না সেহেতু বিজয় অর্জন করা পর্যন্ত তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। এ পর্যায়ে তাদের পূর্বেকার দাবিসমূহ বাস্তবায়িত করা হবে। তবে তারা নিজেরাই তা মেনে নেবে না। আর এভাবে তাদের বিপ্লব ব্যাপক পরিসরে বাস্তবায়িত হবে। অবশেষে তাদের সবাই রুখে দাঁড়াবে এবং সংগ্রাম ও যুদ্ধ করবে। আর এর পরেই ইমাম মাহ্দী (আ.) আবির্ভূত হবেন।
দ্বিতীয় বিষয়
:
‘
অবশেষে তারা রুখে দাঁড়াবে এবং সংগ্রাম ও যুদ্ধ করবে
’
-ইমামের এ বাণী এ বিষয়টি নির্দেশ করে যে
,এই কিয়াম তাদের উত্থান ও বিপ্লবের চেয়েও আরো ব্যাপক ও মহান হবে। ঠিক একইভাবে উপরিউক্ত বাণী এ বিষয়টিও নির্দেশ করে যে
,এ পর্যায়টি এ বিপ্লবের পূর্ণতা লাভ ও দৃঢ় হওয়ারও পর্যায়
;ইরানীরা বিপ্লবের এ পর্যায়ে মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে সর্বজনীন ব্যাপকভিত্তিক সংগ্রাম এবং জিহাদের নির্দেশ ও ফতোয়া লাভ করবে এবং অত্র এলাকায় বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখবে। আর এটাই ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী হবে
।
এখানে উল্লেখ্য যে
,ইরানী জাতির বিপ্লবের খুরুজ অর্থাৎ উত্থান-অভ্যুত্থান অর্থে এবং তাদের দাবি ও আকাঙ্ক্ষাসমূহ যা বাস্তবায়িত হচ্ছিল সেগুলো তাদের নিজেদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর তাদের আন্দোলনকে
‘
কিয়াম
’
অর্থাৎ
‘
ব্যাপকভিত্তিক গণ-জাগরণ এবং সর্বাত্মক সংগ্রাম ও যুদ্ধ
’
বলে ব্যাখ্যা করা হযেছে।
বর্ণনায় বলা হয়েছে
,‘
অবশেষে তারা রুখে দাঁড়াবে এবং ব্যাপকভিত্তিক সংগ্রাম শুরু করবে
’
,এটি বলা হয় নি যে
,‘
সুতরাং তারা বিপ্লব ও ব্যাপকভিত্তিক সংগ্রাম শুরু করবে
’
।
এ উক্তি থেকে এটিই বোধগম্য হয় যে
,যুদ্ধে বিজয় লাভ করার পর নিজেদের দাবি-দাওয়া
,
চাওয়া-পাওয়া এবং আকাঙ্ক্ষাসমূহের ব্যাপারে শত্রুদের থেকে বিশেষ সুবিধা আদায় করা এবং তাদের সুমহান গণ-জাগরণ ও সর্বব্যাপী যুদ্ধের মধ্যে একটা ব্যবধান থাকতে পারে। বরং কখনো কখনো এ উক্তি থেকে এ বিষয়টি বোধগম্য হয় যে
,তাদের মধ্যে একটা চিন্তাধারা
-যা কেবল শত্রুদের কাছ থেকে বড় ছাড় ও সুবিধা আদায় করার ব্যাপারেই সম্মতি প্রকাশ করে তা উদ্ভব হওয়ার কারণে তাদের মধ্যে সন্দেহ-সংশয়ের একটা পর্যায়ের উদ্ভব হবে। অথবা যে সব বহিঃপরিস্থিতি তাদেরকে পরিবেষ্টিত রাখবে সেগুলোর কারণেও তাদের মধ্যে এ ধরনের সন্দেহ-সংশয়ের উদ্ভব হতে পারে। তবে এ সময় অন্য একটি দল তাদের মধ্যে প্রাধান্য বিস্তার করে পুনরায় রুখে দাঁড়াবে এবং সর্বাত্মক সংগ্রাম ও প্রতিরোধ গড়ে তুলবে
;আর এ আন্দোলনই ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের ক্ষেত্র প্রস্তত করবে।
‘
তাদের নিহতরা শহীদ হবে
’
-এ উক্তিটি হচ্ছে ইমাম বাকির (আ.)-এর পক্ষ থেকে এক মহান সাক্ষ্য ঐ সব ব্যক্তির জন্য যারা ইরানী জাতির আন্দোলন
,বিপ্লব
,যুদ্ধ ও সংগ্রামে নিহত হবে
-তারা ইরানী জাতির আন্দোলন
,অভ্যুত্থান ও বিপ্লবের সময় অথবা শত্রুদের সাথে তাদের যুদ্ধে লিপ্ত হবার সময় নিহত হোক অথবা তাদের সর্বশেষ ব্যাপকভিত্তিক আন্দোলন ও সংগ্রামকালে।
ইমামের এ উক্তি থেকে প্রমাণিত হয় যে
,তারা সত্য ও হেদায়েতের পতাকাবাহী হবে এবং তাদের নেতৃত্বধারা বৈধ এবং তাদের ইসলামী ও রাজনৈতিক ধারাও ক্রুটিমুক্ত ও সমালোচনার ঊর্ধ্বে। কারণ
,যে সব ব্যক্তি অনৈসলামিক নেতার নেতৃত্বে এবং বিচ্যুত-পথভ্রষ্টদের পতাকাতলে নিহত হবে তাদেরকে কখনই শহীদ বলা যাবে না। আর শহীদকে যে কারণে শহীদ বলা হয় তা হচ্ছে যারা তাদের হত্যা করেছে তাদের ব্যাপারে সে সাক্ষ্য দেবে এবং সে জনগণের ব্যাপারেও সাক্ষ্য দিয়ে বলবে যে
,সে জনগণকে ইসলামের দিকে আহবান জানিয়েছিল আর তারা তাকে কুফর ও গোমরাহীর দিকে আহবান জানিয়েছে
।
যদি কোন ব্যক্তি বলে যে
,হ্যাঁ
,‘
তাদের নিহতরা শহীদ
’
-ইমাম বাকির (আ.)-এর এ সাক্ষ্য তাদের যোদ্ধাদের যুদ্ধের সঠিকতা ও তাদের উদ্দেশ্যের পবিত্রতা অথবা তাদের মধ্য থেকে যে সব বেসামরিক লোক নিহত হবে তাদের বিনা অপরাধে ও অন্যায়ভাবে নিহত হওয়াকে নির্দেশ করে
,কিন্তু তা তাদের নেতার সততা ও উদ্দেশ্যের বিশুদ্ধতা এবং তাদের চিন্তাধারা ও ধর্মীয় বিশ্বাসের বিশুদ্ধতা নির্দেশ করে না। যদি আমরা তর্কের খাতিরে যুক্তিহীন এ অর্থ মেনেও নিই এবং মুসলমানের কর্মের ও নিয়তের বিশুদ্ধতা সংক্রান্ত সর্বজনীন সূত্র থেকে বের হয়েও আসি তবুও এ ধরনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ মানুষের নীতি অবস্থানের পরিবর্তন এবং দায়িত্বভার লাঘব করার ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ভূমিকা রাখবে না।
‘
যদি আমি ঐ সময় পর্যন্ত বেঁচে থাকতাম তাহলে এ বিষয়ের অধিকর্তাকে সাহায্য করতাম
’
-এ বাক্যটি যা হযরত বাকির (আ.) তাঁর নিজের ব্যাপারেই করেছেন এবং বলেছেন যে
,যদি তিনি তাদেরকে পান
,যদিও তাদের নিহত ব্যক্তিরা শহীদ বলে গণ্য হবে
,তবুও তিনি হযরত মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবকাল প্রত্যক্ষ করার জন্য নিজেকে বিপদাপদ থেকে সংরক্ষণ করবেন। ইমামের এ উক্তিটি ইমাম মাহ্দী (আ.) এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীদের সুমহান বিপ্লব
,আন্দোলন ও সংগ্রামের সুমহান মর্যাদার কথাই এমনভাবে ব্যক্ত করে যে
,ইমাম বাকির (আ.) ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সাথে থাকার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন এবং একে তাঁর জন্য সৌভাগ্য বলে মনে করেছেন। আরেক দিকে এসব উক্তি নিজ বংশধর হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর প্রতি তাঁর পূর্ণ শ্রদ্ধাবোধ ও সৌজন্য প্রকাশেরই নামান্তর।
এ উক্তি থেকে এটাও প্রতিভাত হয় যে
,ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাব পর্যন্ত ইরানীদের আন্দোলনের সময়গত ব্যবধান একজন মানুষের স্বাভাবিক আয়ুষ্কালের চেয়ে বেশি হবে না। কারণ ইমাম বাকির (আ.)-এর বাণী বা হাদীসের বাহ্য অর্থ হচ্ছে এই যে
,যদি তিনি তাদের আন্দোলন প্রত্যক্ষ করেন তাহলে তিনি নিজেকে সংরক্ষণ করবেন। আর এটা মুজিযাবশত নয়। বরং নিতান্ত স্বাভাবিক ব্যাপার মাত্র। আর এটি হচ্ছে ঐ বিষয়টিরও অতি গুরুত্বপূর্ণ দলিল যে
,আমরা বর্তমানে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের যুগে পদার্পণ করেছি এবং ঠিক একইভাবে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের যুগের সাথে ইরানীদের আন্দোলনের সংযুক্তি ও নিকটবর্তী হবার বিষয়টিও এ হাদীস থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়।
যা হোক রাবী এবং ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞাত ব্যক্তিবর্গের কাছে কোন সন্দেহ নেই যে
,এ রেওয়ায়েত ও অন্যান্য রেওয়ায়েতে যে কালো পতাকাসমূহের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে সেগুলো ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের ক্ষেত্র প্রস্তুতকারীদের পতাকা। যদিও যে সব রেওয়ায়েতে বনি আব্বাসের পতাকাসমূহের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো বিশুদ্ধ বলে আমরা মনে করি। কারণ আপনার লক্ষ্য করেছেন যে
,রেওয়ায়েতসমূহ পতাকবাহীদের দু
’
টি দল বা গোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য করেছে এবং প্রকৃত ব্যাপারটাও ঠিক এমন যে
,হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাব আব্বাসী বংশ বা অন্যান্য বংশে হবে না (বরং তিনি হবেন হযরত আলী ও হযরত ফাতেমার বংশধর)। আরেকদিকে
,আমরা ইঙ্গিত করেছি যে
,আব্বাসী পতাকাসমূহের গমনস্থল ও উদ্দেশ্য ছিল দামেস্ক এবং হযরত মাহ্দী (আ.)-এর পতাকবাহী ও সঙ্গী-সাথীদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হবে বাইতুল মুকাদ্দাস।
যদিও এ রেওয়ায়েতে কালো পতাকাসমূহের ঘটনা ও প্রসঙ্গটি সংক্ষিপ্ত বর্ণিত হয়েছে
;কিন্তু তা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর সুসংবাদ দিয়েছে
,যদিও আল কুদ্স অর্থাৎ বাইতুল মুকাদ্দাসে তাঁদের পৌঁছানোর পথে অনেক কষ্ট ও অসুবিধা বিদ্যমান। এ ঘটনা ঘটার সময়কাল রেওয়ায়েতে উল্লেখ করা হয় নি। তবে অন্যান্য রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে :
“
এসব পতাকার নেতৃত্ব সালেহ্ ইবনে শুআইবের দায়িত্বে থাকবে।
”
মুহম্মদ ইবনে হানাফিয়াহ্ বর্ণনা করেছেন :
“
বনি আব্বাসের কালো পতাকাসমূহ বের হবে। অতঃপর আরো বেশ কিছু সংখ্যক সদৃশ কালো পতাকা যেগুলোর বাহকরা কালো টুপি এবং সাদা পোশাক পরিহিত থাকবে। তাদের সামনাসামনি বনি তামীম গোত্রভুক্ত সালেহ্ নামের এক ব্যক্তি থাকবেন। তারা সুফিয়ানী বাহিনীকে পরাজিত করবে। অবশেষে এ কালো পতাকাবাহী সেনাবাহিনী বাইতুল মুকাদ্দাসে অবতরণ ও প্রবেশ করবে এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে।
”
এ রেওয়ায়েত থেকে বোঝা যায় যে
,আল কুদ্স অভিমুখে এ অগ্রযাত্রার কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য হচ্ছে আল কুদ্স ও ফিলিস্তিন মুক্ত করার জন্য ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আক্রমণ। তবে সালেহ্ ইবনে শুআইবের পূর্বে আল কুদ্স অভিমুখে এসব পতাকার (ইরানী সেনাবাহিনীর) অগ্রসর হতে কোন বাধা নেই। যেমন আমরা ইতোমধ্যে শামদেশের ঘটনাবলী সংক্রান্ত অধ্যায়ে বর্ণনা করেছি যে
,সুফিয়ানীর পূর্বেই ইরানী সেনাবাহিনী শামদেশে বিদ্যমান থাকবে।
তালেকানের হাদীস
তালেকান প্রসঙ্গ আহলে সুন্নাতের হাদীস গ্রন্থ ও সূত্রসমূহে হযরত আলী (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন :
“
তালেকানের জন্য সৌভাগ্য! সেখানে মহান আল্লাহর এমন কিছু গুপ্তধন আছে যেগুলো না স্বর্ণের
,না রৌপ্যের
;বরং সেখানে কিছু সংখ্যক লোক বিদ্যমান আছে মহান আল্লাহকে যেভাবে চেনা উচিত ঠিক সেভাবে তারা তাঁকে চিনেছে এবং তারা শেষ যামানায় মাহ্দীর সঙ্গী হবে।
”
আর একটি রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে :
“
তালেকানকে অভিনন্দন! তালেকানকে অভিনন্দন!
”
এই রেওয়ায়েত শিয়া হাদীসসূত্র ও গ্রন্থসমূহে আরেকভাবে বর্ণিত হয়েছে। যেমন : বিহারুল আন্ওয়ার গ্রন্থে আলী ইবনে আবদুল হামীদ প্রণীত সুরূর-ই আহলে ঈমান গ্রন্থ থেকে ইমাম সাদিক (আ.) থেকে সনদ সহকারে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন :
“
তালেকানে মহান আল্লাহর বেশ কিছু গুপ্তধন আছে যেগুলো না স্বর্ণ
,না রৌপ্য এবং (সেখানে তাঁর) এমন একটি পতাকা আছে যা শুরু থেকে এখন পর্যন্ত খুলে উড়ানো হয়নি। এ অঞ্চলে এমন কিছু সংখ্যক মানুষ আছে যাদের অন্তঃকরণ লোহার টুকরোর মতো মজবুত। তারা ক্লান্ত হয় না। মহান আল্লাহর পবিত্র সত্তার ব্যাপারে তাদের অন্তরে কখনই সন্দেহ-সংশয়ের উদ্রেক হয় না। তারা আগুনের চেয়েও অধিকতর শক্তিশালী। তারা যদি কোন পর্বতে আক্রমণ চালায় তাহলে সেই পর্বতকেও স্থানচ্যুত করতে পারবে। হাতে পতাকা নিয়ে তারা যে দেশের দিকে যাবে তারা তা বিরাণ ও ধ্বংস করে দেবে। ঈগলের মতো তারা তাদের অশ্বসমূহের পৃষ্ঠদেশে সওয়ার হয়ে কল্যাণ লাভের আশায় ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সওয়ারী পশুর জীন চুম্বন এবং হাত দিয়ে তা স্পর্শ করবে। তারা আগুনে আত্মাহুতি দানকারী প্রজাপতিগুলোর মতো তাঁকে (ইমাম মাহ্দী) চারদিক থেকে ঘিরে রাখবে এবং বিপদের সময় তাঁকে নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করে রক্ষা করবে। রাতগুলো তারা মুনাজাত করে কাটাবে এবং দিবাভাগে তারা অশ্বারোহণ করে যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধ করতে থাকবে। তারা রাতের বেলা দুনিয়া ত্যাগী তাপস এবং দিবাভাগে সিংহবৎ। তারা তাদের নেতার আনুগত্যের ব্যাপারে প্রভুর প্রতি দাস-দাসীরা যেভাবে অনুগত থাকে তার চেয়েও বেশি অনুগত হবে। তাদের ঔজ্জ্বল্য তীব্র আলো বিশিষ্ট বাতিসমূহের মতো
,যেন তাদের অন্তঃকরণসমূহ ঈমানে পূর্ণ প্রদীপ। তারা মহান আল্লাহর ভয়ে ভীত
;তারা শাহাদাতকামী এবং মহান আল্লাহর পথে নিহত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাদের আছে
;শহীদ সম্রাট ইমাম হুসাইন (আ.)-এর রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণ তাদের শ্লোগান
;যখন তারা সামনের দিকে এগিয়ে যাবে তখন একমাস পথ চলার দূরত্বে অবস্থিত শত্রুদের অন্তরে ভয়-ভীতি আসন গেড়ে বসবে। তারা দলে দলে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর দিকে গমন করতে থাকবে। এসব মহানুভব ব্যক্তির মাধ্যমেই মহান আল্লাহ্ সত্যাশ্রয়ী নেতা ইমাম মাহ্দীকে বিজয়ী করবেন
।
”
আমার দৃষ্টিতে এ সব রেওয়ায়েতে তালেকান বলতে একটি অঞ্চলকে বোঝানো হয়েছে যা আলবুর্য পবর্তমালায় অবস্থিত এবং তেহরান থেকে 100 কি.মি উত্তরে। ঐ এলাকাটিতে বেশ কতকগুলো গ্রাম আছে এবং তা
‘
তালেকান
’
নামে প্রসিদ্ধ। এতদ্ব্যতীত সেখানে কোন বড় শহর বিদ্যমান নেই। এখানে উল্লেখ্য যে
,তালেকান অঞ্চলের জনগণের মধ্যে অনেক বৈশিষ্ট্য
,যেমন আন্তরিকতা
,তাকওয়া এবং অন্যদেরকে পবিত্র কোরআন শিক্ষা দেয়ার আগ্রহ বিদ্যমান যে কারণে উত্তর ইরান এবং ইরানের অন্যান্য স্থানের অধিবাসীরা ধর্মীয় উপলক্ষ্যসমূহে কোরআন পাঠ এবং তাদের সন্তানদের পবিত্র কোরআন শিক্ষাদানের তালেকান অঞ্চলের পল্লী থেকে শিক্ষক নির্বাচন করে থাকে।
কিন্তু তালেকানের সাথে সংশ্লিষ্ট রেওয়ায়েতসমূহ অধ্যয়ন করার পর আমাদের দৃষ্টিতে যে অভিমতটি উৎকৃষ্ট বলে মনে হয় তা হচ্ছে যে
,তালেকান শহরের অধিবাসীরা বলতে তালেকানের ভৌগোলিক এলাকা নয়
;বরং সমগ্র ইরানবাসীকেই বোঝানো হয়েছে। তবে
,ইমামগণ তালেকানবাসীদেরকে তাদের তালকানের নামে ঐ এলাকার ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যগুলো এবং অধিবাসীদের ধর্মীয় ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যাবলীর ভিত্তিতে নামাঙ্কিত করেছেন।
তালেকানের সাথে সংশ্লিষ্ট রেওয়ায়েতসমূহ
ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর একদল সঙ্গীর কথাই বর্ণিত হয়েছে। তবে তাদের সংখ্যা সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। অতএব
,এ সংখ্যা কি ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সেনাবাহিনীর বৃহৎ অংশ নাকি তাঁর বিশেষ সঙ্গী-সাথীদের ওপরই কেবল প্রযোজ্য
?
আহলে সুন্নাতের হাদীস গ্রন্থ ও সূত্রসমূহে বর্ণিত রেওয়ায়েতের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে
,তারা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর বিশেষ সঙ্গী-সাথীদের অন্তর্ভুক্ত হবে। কারণ
,রেওয়ায়েতে তাদের প্রকৃতি সুনির্দিষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। তবে বিহারুল আনওয়ার গ্রন্থে তাদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা ছাড়াও তাদের সংখ্যা
,বিজয়কেতন এবং তাদের জয়ী হওয়ার বিষয়টিও বর্ণিত হয়েছে।
কারণ
,তালেকান সংক্রান্ত রেওয়ায়েতসমূহে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর পাশে ইরানীদেরকে পরিচিত করিয়ে দেয়া এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের পরে তাঁর আন্দোলনে তাদের অংশগ্রহণ করার প্রসঙ্গটি বর্ণিত হয়েছে। তবে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকার ব্যাপারে কোন কিছু বলা হয়নি।
তবে মহান আল্লাহর এই ওলীদের এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর এই সঙ্গীদের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যসমূহ সত্যবাদী ইমামদের সুমহান সাক্ষ্যসমূহে এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে
,তারা মহান আল্লাহর একনিষ্ঠ সাধক
,অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন
,দৃঢ় বিশ্বাস এবং অসাধারণ বীরত্ব ও সাহসিকতার অধিকারী অর্থাৎ যুদ্ধক্ষেত্রেও তারা অতুলনীয় বীর যোদ্ধা। তারা মহান আল্লাহর পথে শাহাদাতকে ভালোবাসে এবং তারা মহান আল্লাহর কাছে ঐ মহান সাফল্য অর্থাৎ শাহাদাত কামনা করে। তারা শহীদ সম্রাট আবু আবদিল্লাহ্ ইমাম হুসাইন (আ.)-এর প্রকৃত প্রেমিক এবং তাদের স্লোগান হচ্ছে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণ এবং তাঁর সুমহান বিপ্লবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা। আর যেহেতু ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর প্রতি তাদের ভক্তি
,বিশ্বাস ও ভালোবাসা গভীর এবং অস্বাভাবিক মাত্রায় অধিক সেহেতু ইরানীরাও এ ধরনের বৈশিষ্ট্যের অধিকারী
;আর এসব বৈশিষ্ট্যই তাদের যুবকদের মাঝে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর প্রতি তাদের ভক্তি-শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার উত্তাল তরঙ্গ ও জোয়ার সৃষ্টি করছে।
ক্ষেত্র প্রস্তুতকারীদের সাথে সংশ্লিষ্ট রেওয়ায়েতসমূহ কি আবির্ভাবের যুগের শুরুর নির্দেশক
?
যদি কেউ সূক্ষ্মভাবে আবির্ভাবের যুগে ইরানীদের ভূমিকা সংক্রান্ত বর্ণিত হাদীস ও রেওয়ায়েতসমূহ অধ্যয়ন করেন তাহলে তিনি দু
’
টি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারবেন।
প্রথম সিদ্ধান্ত
: নিশ্চিতভাবে মহানবী (সা.) ও ইমামদের থেকে বর্ণিত হাদীসসমূহে ইরানীদের প্রশংসা করা হয়েছে। যদিও ইসলামের পতাকা বহন এবং ইসলামী সভ্যতা ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে ইরানীদের ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা যে সকল রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে সেগুলোকে জাতীয়তাবাদী
,বর্ণবাদী বা শিয়া-সুন্নী সাম্প্রদায়িকতার মাপকাঠিতে বিচার-বিশ্লেষণ করে বাতিল করার প্রয়াস আমরা চালাতে পারি। কিন্তু মুস্তাফিয সূত্রে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমত প্রতিষ্ঠায় ইরানীদের ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী ভূমিকার বিষয়ে বর্ণিত হাদীসগুলোকে অস্বীকার করা প্রকৃতপক্ষে অসম্ভব। এ সব রেওয়ায়েত থেকে আমরা স্পষ্টভাবে জানতে পারি যে
,
(
ليُظهره على الدّين كلّه
)
-এর মতো আয়াতসমূহে শেষ যামানায় ইসলামের বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠা লাভ ও প্রতিশ্রুত বিজয়টি আল কুদ্স অভিমুখে দু
’
দিক থেকে বাস্তবায়িত হবে। প্রথমটি হলো ইরান থেকে সামরিক ও গণবাহিনীর অগ্রযাত্রার মাধ্যমে (উল্লেখ্য যে
,ইরান আহলে বাইতের প্রেমিক এক বিশাল জনসংখ্যা অধ্যূষিত দেশ) এবং দ্বিতীয় আন্দোলনটি পবিত্র মক্কা নগরী ও হিজায থেকে শুরু হবে। এই দুই মহান আন্দোলন ইরাকে পরস্পরের সাথে মিলিত হবে এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর নেতৃত্বে সম্মিলিত বাহিনীদ্বয় আল কুদ্স অভিমুখে অগ্রসর হবে।
দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত
:
আমরা এখন আবির্ভাবের যুগে প্রবেশ করেছি যা রেওয়ায়েতসমূহে বর্ণিত হয়েছে। আর আবির্ভাবের যুগের প্রথম পর্যায় হচ্ছে ইরানীদের আন্দোলন ও গণবিপ্লব যা হযরত মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের প্রারম্ভিকাস্বরূপ এবং কোম নগরীস্থ এক ব্যক্তির (ইমাম খোমেইনী) দ্বারা শুরু হয়েছে। এ বিপ্লব তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে ঘোষণা করেছে। আর তা হচ্ছে আল কুদ্স মুক্ত করা এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। আর এখন এ বিপ্লব ঐ সব সমস্যা ও সংকট মোকাবিলা করছে যেগুলো এর শত্রুরা এর অগ্রযাত্রার পথে সৃষ্টি করেছে। আর এ ঐশী বিপ্লবের স্থায়িত্ব কেবল ঐ দু
’
জন উদার ব্যক্তিত্বের প্রতীক্ষার মধ্যে নিহিত রয়েছে যাঁরা এ বিপ্লবের প্রতিশ্রুত নেতা হবেন। এঁদের একজন
‘
খোরাসানী সাইয়্যেদ
’
এবং অপরজন তাঁর সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক
-যিনি হবেন বাদামী বর্ণের যুবক ও রাই নগরীর অধিবাসী। তাঁর নাম রেওয়ায়েতসমূহে
‘
শুআইব ইবনে সালিহ্
’
এবং কিছু কিছু রেওয়ায়েতে
‘
সালিহ্ ইবনে শুআইব
’
বর্ণিত হয়েছে। খোরাসানী সাইয়্যেদ তাঁকে ইরানী সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করবেন। এরপর ইমাম মাহ্দীও তাঁকে তাঁর সেনাবাহিনীর সেনাপতি নিযুক্ত করবেন।
‘
ইরানে ইসলামী বিপ্লবের অগ্রযাত্রা শুরু হওয়ার মাধ্যমে হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের যুগও শুরু হয়ে গেছে
’
-এ বিষয়টি অবশ্য এমন একটি আলোচনা যা ব্যাপক ও গভীর পর্যালোচনার দাবি রাখে। আর এ কারণেই পূর্ববর্তী রেওয়ায়েত ও অন্যান্য রেওয়ায়েত থেকে এ বিষয়টির সপক্ষে যে সব দলিল পেশ করা হয়েছে সেগুলো আমরা সংক্ষেপে পুনরায় আলোচনা করব।
কখনো কখনো বলা হয় যে
,ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর পুণ্যময় আবির্ভাব অবশ্যম্ভাবী এবং এ ব্যাপারে বিশ্বাস স্থাপন করা শিয়া মাযহাবের অন্যতম মূলনীতি। আর শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে সকল মুসলমানের কাছে এ ধরনের আকীদা মহান আল্লাহর ঐ সব ঐশ্বরিক অঙ্গীকারসমূহের অন্তর্ভুক্ত যেগুলো মহানবী (সা.) এবং ইমামগণের পবিত্র কণ্ঠে বর্ণিত হয়েছে। যেমন শিয়া ও সুন্নী হাদীসশাস্ত্রের গ্রন্থাদিতে যে সব অবশ্যম্ভাবী বিষয় উল্লিখিত হয়েছে তন্মধ্যে এটিও আছে যে
,ইরানীরা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের পটভূমি ও ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী হবে। কিন্তু ইরানীদের এ বৈশিষ্ট্য যা রেওয়ায়েতসমূহে স্পষ্ট বর্ণিত হয়েছে এবং যা হচ্ছে অবশ্যম্ভাবী তা খোরাসানী সাইয়্যেদ এবং তাঁর সেনাবাহিনীর প্রধান শুআইব ইবনে সালিহ্ নামের দুই প্রতিশ্রুত ব্যক্তির আবির্ভাবের মাধ্যমে শুরু হবে। শিয়া হাদীস গ্রন্থসমূহে বলা হয়েছে যে
,এ দু
’
ব্যক্তির আবির্ভাবকাল সুফিয়ানী ও ইয়েমেনীর আবির্ভাবের সমসাময়িক হবে। আর আহলে সুন্নাতের হাদীস গ্রন্থসমূহে এসেছে যে
,ইমামের এ দুই সাথীর আবির্ভাব এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হাতে তাঁদের ইসলামের পতাকা অর্পণ করার মাঝে বায়াত্তর মাস অর্থাৎ ছয় বছর ব্যবধান থাকবে।
তবে ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বে ইরানে বর্তমান ইসলামী বিপ্লব যে প্রতিশ্রুত ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী ঘটনাবলীর অন্তর্ভুক্ত এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাব পর্যন্ত তা যে অব্যাহত থাকবে অথবা আপেক্ষিকভাবে তাঁর আবির্ভাবের কাছাকাছি সময় অথবা আবির্ভাবের প্রায় নিকটবর্তী মুহূর্তে
‘
খোরাসানী সাইয়্যেদ
’
এবং
‘
শুআইব ইবনে সালিহ্
’
আবির্ভূত হবেন
-এ বিষয়টি হচ্ছে একটি সম্ভাব্য ও ধারণাভিত্তিক বিষয় যা বাস্তবায়িত হওয়ার ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।
তবে এ বিপ্লব সম্পর্কে যে সব রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে এবং এর ব্যাখ্যা ও বিস্তারিত বিবরণ হিসাবে এসেছে সেগুলো থেকে আসলে ধারণা ব্যতীত আর কিছুই লাভ করা যায় না। অতএব
,এ বিপ্লব এবং ইমাম মাহ্দীর আবির্ভাবের মাঝে কয়েক শতাব্দীর ব্যবধান থাকার সম্ভাবনাটি যে হাদীসে এসেছে তা পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান।
এটি হচ্ছে এরূপ কতকগুলো বিষয়ের সংক্ষিপ্ত সার যেগুলোর কারণে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাব কালের শুরু সম্পর্কে স্পষ্ট অভিমত দানের ক্ষেত্রে আপত্তি তোলা হয়েছে
।
এ বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য যে
,ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবকালকে বছরের ভিত্তিতে দশ
,বিশ অথবা এরূপ কোন সংখ্যার মধ্যে নির্ধারণ করা যাবে না। বরং প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে
,যে সব ঘটনা রেওয়ায়েতসমূহে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে সেগুলো তাঁর আবির্ভাবের পটভূমি ও ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী হিসাবে গণ্য এবং সেগুলো তাঁর আবির্ভাবকাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। আসলে এ সব ঘটনার মধ্য থেকে দু
’
টি ঘটতে শুরু করেছে।
প্রথম ঘটনা
:
পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের ফিতনা
,গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা যা সব মুসলমানকেই স্পর্শ করবে এবং অপর একটি ফিতনা যা রেওয়ায়েতসমূহে
‘
ফিলিস্তিনের ফিতনা
’
বলে অভিহিত হয়েছে
-তা পরাশক্তিসমূহের অপকর্ম ও ফিতনা থেকেই উদ্ভূত।
দ্বিতীয় ঘটনা
:
ইরানে ইসলামী শাসনব্যবস্থার গোড়াপত্তন।
অতএব
,আবির্ভাবের যুগের অর্থ হচ্ছে আমাদের বক্তব্যের সেই প্রচলিত অর্থ অর্থাৎ ইসরাইলের পরাজয় বরণের যুগ অথবা বিপ্লবসমূহে যুগ অথবা ইসলামের বহিঃপ্রকাশের যুগ
-যা
‘
আবির্ভাবের শতাব্দী
’
অথবা
‘
আবির্ভাবের সমসাময়িক প্রজন্ম
’
বলেও উল্লেখ করা যেতে পারে। কারণ ইমাম বাকির (আ.) থেকে বর্ণিত যে রেওয়ায়েতটি বর্ণিত হয়েছে তাতে ইরানীদের বিপ্লব এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের মধ্যে ব্যবধানটাকে একজন লোকের স্বাভাবিক আয়ুষ্কালের সমান বলে উল্লিখিত হয়েছে। তিনি বলেছেন :
“
আমি যদি ঐ সময়টি পাই তাহলে এ বিষয়ের অধিপতিকে (ইমাম মাহ্দী) সাহায্য করার জন্য নিজেকে সংরক্ষণ করব।
”
ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবকালের শুভ সূচনা নির্দেশকারী রেওয়ায়েতসমূহ অগণিত। এ রেওয়ায়েতসমূহ ইজমালী তাওয়াতুর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। সূক্ষ্মভাবে এ সব রেওয়ায়েতকে বর্তমানে যে সব ঘটনা ঘটছে সেগুলোর সাথে মিলালে আমরা এগুলোর ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারব। বরং দাবি করা যেতে পারে যে
,এ সব রেওয়ায়েতের মধ্যে গুটিকতক রেওয়ায়েত এককভাবে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের যুগ শুরু হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত জ্ঞান দানের জন্য যথেষ্ট।
সর্বশেষ ফিতনা সংক্রান্ত রেওয়ায়েতসমূহকে
‘
পাশ্চাত্যের কালা-বধির ফিতনা
’
যা থেকে ফিলিস্তিনের ফিতনারও উৎপত্তি হয়েছে তা ব্যতীত আর অন্য কোন কিছু দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় কি
?এখানে উল্লেখ্য যে
,এ সর্বশেষ ফিতনা সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন যে
,তা অচিরেই তাঁর উম্মতের ওপর আপতিত হবে এবং মুসলমানদের ঘরে ঘরে প্রবেশ করবে
;অতঃপর ইমাম মাহ্দীর আবির্ভাবের যুগে তা স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হবে। এটি হবে ঐ ফিতনা যা রেওয়ায়েতে
‘
শামের ফিতনা
’
বলে স্পষ্ট উল্লিখিত হয়েছে।
“
যখন ফিলিস্তিনের ফিতনার উদ্ভব হবে তখন মশকের মধ্যে পানি যেভাবে আন্দোলিত হয় সেভাবে শাম আন্দোলিত হবে।
”
এ ফিতনা এমনভাবে শাম অর্থাৎ ফিলিস্তিনের আশে-পাশের এলাকার ওপর ভয়াল কালো থাবা বিস্তার করবে যে
,মশকের মধ্যে পানি যেভাবে টগবগ করে আন্দোলিত হয় ঠিক সেভাবে তা সেখানকার অধিবাসীদের তীব্রভাবে আন্দোলিত করবে।
আমরা যদি
‘
সর্বশেষ ফিতনা
’
সংক্রান্ত রেওয়ায়েতসমূহ যেগুলো ইজমালী তাওয়াতুরের পর্যায়ে রয়েছে এবং একইভাবে ফিলিস্তিন ও শামদেশের ফিতনা যা এ সর্বশেষ ফিতনা হতে উদ্ভূত এ সম্পর্কিত হাদীসসমূহ সূক্ষ্মভাবে অধ্যয়ন করি এবং সে সাথে মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করি তাহলে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয় যে
,রেওয়ায়েতে বর্ণিত ফিতনার প্রকৃত অর্থ বর্তমান যুগের প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের পরাশক্তিসমূহ কর্তৃক সৃষ্ট বিশ্বব্যাপী ফিতনা ও গোলযোগ। আর রেওয়ায়েতসমূহও ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবকাল পর্যন্ত উক্ত ফিতনা অব্যাহতভাবে চলতে থাকার বিষয়টিকেই নির্দেশ করে। আমরা
‘
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ফিতনা
’
শীর্ষক অধ্যায়ে যে সব রেওয়ায়েত উল্লেখ করেছি সেগুলোর নমুনা এতদপ্রসঙ্গে বিদ্যমান অসংখ্য রেওয়ায়েতের যে কোন একটিও হতে পারে
।
আর এ সব রেওয়ায়েতের মধ্যে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক রেওয়ায়েতটিই হচ্ছে
‘
ফিলিস্তিনের ফিতনা
’
সংক্রান্ত রেওয়ায়েত যা নাম ও শনাক্তকারী চি
হ্নসহ বর্ণিত হয়েছে।
খোরাসানী সাইয়্যেদ ও শুআইব ইবনে সালিহের আবির্ভাবের সাথে সংশ্লিষ্ট রেওয়ায়েতসমূহকে আমরা কিভাবে ব্যাখ্যা করব
?এ সব রেওয়ায়েতে স্পষ্ট করে উল্লিখিত হয়েছে ঐ দু
’
মহান ব্যক্তি ইরানে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং শত্রুর সাথে এ ইসলামী হুকুমতের দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পর ইরানে আবির্ভূত হবেন এবং প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ করবেন
।
তাঁরা ইরানী সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব নিয়ে ফিলিস্তিনে একটি ভাগ্য নির্ধারণী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বেন যা হবে ইমাম মাহ্দীর হুকুমত ও প্রশাসনের ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী। এখন প্রশ্ন হলো যে দু
’
মহান ব্যক্তিত্ব আবির্ভূত হবেন তাঁরা কি ইরানের সেনাবাহিনীকে অথবা নিজ জাতিকে সরাসরি ও কোনরূপ পটভূমি ছাড়াই হঠাৎ করে নেতৃত্ব দেবেন অর্থাৎ তাঁরা কি শূন্য থেকে শুরু করবেন
?অবশ্যই এমন নয়। তাই রেওয়ায়েতসমূহে তাঁদের আবির্ভাবের যে ধরনটির কথা স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে তা থেকে বোঝা যায় যে
,তখন সেখানে উপযুক্ত ক্ষেত্র ও পটভূমির অস্তিত্বের পাশাপাশি ইরানের জনগণের পূর্ণ প্রস্তুতি থাকবে
;আর তাদের এ প্রস্তুতি কেবল ধর্মীয় ও আদর্শিক দিক থেকেই উপযুক্ত হবে না
;বরং বিশ্ব ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতির বিবেচনায়ও তা উপযুক্ত বলে গণ্য হবে। আর ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সমর্থক ইরানী এবং তাদের শত্রুদের মধ্যকার যুদ্ধের সূচনা এ কারণেই হবে। আর তাই রেওয়ায়েতসমূহে বর্ণিত আছে যে
,যখন ইরানীরা অনুভব করবে যে
,শত্রুদের সাথে তাদের যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হচ্ছে তখন তারা খোরাসানী সাইয়্যেদের শরণাপন্ন হবে এবং তাঁকে তাদের সর্ব বিষয়ের তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করবে যদিও তিনিও প্রথমে তা গ্রহণ করবেন না। কিন্তু যখন প্রশাসনিক দায়িত্ব তাঁর ওপর বর্তাবে তখন তিনি তাঁর বন্ধু ও সঙ্গী শুআইব ইবনে সালিহকে তাঁর সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করবেন।
যে হাদীসটি ইমাম বাকির (আ.) থেকে শিয়া হাদীস গ্রন্থসমূহে বর্ণিত হয়েছে এবং ইরানের ইসলামী বিপ্লবের সাথে মিলে যায় সেই হাদীসটিকে আমরা কিভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি
?হাদীসটিতে ইমাম বাকির (আ.) বলেছেন :
“
আমি যেন দেখতে পাচ্ছি যে
,প্রাচ্য থেকে একদল লোক বের হয়ে তাদের অধিকার দাবি করছে
;কিন্তু তাদের দাবির প্রতি সাড়া দেয়া হচ্ছে না। পুনরায় তারা তাদের অধিকার দেয়ার ব্যাপারে তাগীদ করতে থাকবে
,কিন্তু বিরোধীরা তা মেনে নেবে না। যখন তারা এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করবে তখন তারা তাদের কাঁধে অস্ত্র তুলে নিয়ে তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে
,তখনই তাদের দাবির প্রতি ইতিবাচক সাড়া দেয়া হবে। কিন্তু সর্বাত্মক ও চূড়ান্ত আন্দোলন না করা পর্যন্ত তারা তা গ্রহণ করবে না। আর তারা তোমাদের নেতা ইমাম মাহ্দীর শক্তিশালী হাতে হেদায়েতের পতাকা অর্পণ করা ব্যতীত অন্য কারো হাতে তা অর্পণ করবে না। তাদের নিহত ব্যক্তিরা শহীদ বলে গণ্য হবে। কিন্তু আমি যদি ঐ সময় পেতাম তাহলে এ বিষয়ের অধিপতিকে সাহায্য করার জন্য নিজকে সংরক্ষণ করতাম।
”
ইতোমধ্যে এ রেওয়ায়েতটির ব্যাখ্যা প্রাচ্যবাসী ও কালো পতাকাসমূহের সাথে সংশ্লিষ্ট রেওয়ায়েতে প্রদান করা হয়েছে এবং ঠিক একইভাবে পূর্বোল্লিখিত একটি রেওয়ায়েতে এসেছে :
“
অতঃপর তারা সংগ্রাম করবে এবং বিজয়ী হবে
;আর তারা যা দাবি করবে তা অর্জন করবে
;কিন্তু তারা নিজেরাই তা আর মেনে নেবে না।
”
এ রেওয়ায়েতটি যখন ইরানী জাতির বর্তমান বিপ্লব ও আন্দোলনের সাথে খাপ খাচ্ছে তখন আমরা কিভাবে তা এভাবে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস নিতে পারি যে
,মহানবী (সা.) ও ইমামগণ ইরানীদের ভবিষ্যতের অন্য কোন বিপ্লব ও আন্দোলন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন
?অথচ আমরা দেখেছি ইরানীদের বর্তমান বিপ্লব এবং এতৎসংক্রান্ত যা ঘটছে তার সঙ্গেই এ রেওয়ায়েতটি অধিকতর সামঞ্জস্যশীল
,তাই তা প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে এ বিষয়টিকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। তাই রেওয়ায়েতটিকে আমরা তাদের এই বিপ্লব ও আন্দোলনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য বলব নাকি অন্য কোন বিপ্লব ও আন্দোলন যা একই রকম রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য ও শর্তের অধিকারী হবে এবং বহু শতাব্দী পরে তাদের দ্বারা সংঘটিত হবে তার ওপর প্রয়োগ করব
?শেষোক্ত ধরনের ব্যাখ্যা কি কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি গ্রহণ করতে পারে
?
মহানবী (সা.) ও ইমামদের থেকে বর্ণিত যে সব রেওয়ায়েতে কোম এবং এ নগরীর আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও অবস্থান সম্পর্কে বলা হয়েছে সেগুলো আমরা কিভাবে ব্যাখ্যা করব
?বিশেষ করে ঐ রেওয়ায়েতগুলো কিভাবে ব্যাখ্যা করব যেগুলোয় বর্ণিত হয়েছে যে
,এ অবস্থান ও মর্যাদা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের নিকটবর্তী কালে অর্জিত হবে এবং তাঁর আবির্ভূত হওয়া পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যমান থাকবে
;আর ঠিক একই অবস্থা ঐ রেওয়ায়েতটির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য যাতে কোম নগরী থেকে এক প্রতিশ্রুত ব্যক্তি এবং তাঁর বিশ্বস্ত সঙ্গীদের আবির্ভাবের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে
,তাঁরা যেমন যুদ্ধকে ভয় করবে না ঠিক তেমনি তারা যুদ্ধ করে ক্লান্তও হবে না। আর আমরা এ নগরীর অবস্থা প্রত্যক্ষ করতে পারছি যে
,এই গত দিন পর্যন্ত এ নগরীতে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও এটি ছিল একটি দুর্বল শহর এবং শিয়া বিশ্ব ও ধর্মপ্রাণ শিয়াদের মধ্যেই কেবল এ নগরীর আধ্যাত্মিক প্রভাব বিদ্যমান ছিল।
আর এখন আপনারা দেখতে পাচ্ছেন যে
,এ কোম নগরী
,এর বিপ্লব ও আন্দোলন
,এর বৈপ্লবিক পথ ও পদ্ধতি এবং ইসলাম ধর্মকে আধুনিক বিশ্বে উপস্থাপন ও পরিচিত করার বিষয়টি বিশ্ববাসীদের কর্ণকুহরকে পূর্ণ করে দিয়েছে। কোম নগরীর গৃহীত পরিকল্পনা ও কৌশলগুলো মুসলমানদের অন্তঃকরণ ও মুসলিম সমাজসমূহে মজবুত আসন গেড়ে নিয়েছে। এ নগরী থেকে জ্ঞান আজ বিশ্বমুসলিমের হৃদয়ে প্রবেশ করছে ও পৌঁছে যাচ্ছে।
অতএব
,যখন কোম নগরীর বিশেষ মর্যাদা এবং এ শহর হতে এক প্রতিশ্রুত ব্যক্তির বিপ্লব করা সম্পর্কে বর্ণিত রেওয়ায়েতসমূহ পবিত্র কোম নগরী থেকে শুরু হওয়া এই বিপ্লবের সাথে মিলে যাচ্ছে তখন এটি কি যৌক্তিক যে
,সংঘটিত এ ঘটনাকে উপেক্ষা করে বর্ণিত রেওয়ায়েতকে এভাবে ব্যাখ্যা করব যে
,এ ঘটনাটি শত-সহস্র বছর পর কোমে ঘটবে এবং তখন কোম থেকে এক ব্যক্তি আবির্ভূত হবেন
,তাঁর সঙ্গী ও সমর্থকদের বৈশিষ্ট্য হবে এমন এবং তাঁর বিপ্লব ও শাসনব্যবস্থা হবে এমন।
কোম নগরীর প্রতিশ্রুত ব্যক্তির ব্যাপারে এ ধরনের বিষয় যদি সত্য হয় তাহলে কোম শহরের প্রতিশ্রুত আন্তর্জাতিক অবস্থান ও মর্যাদা সংক্রান্ত রেওয়ায়েতসমূহের ক্ষেত্রেও তা সঠিক হবে। যে দু
’
রেওয়ায়েতে ইমাম মাহ্দীর আবির্ভাবের নিকটবর্তী সময় এ অবস্থান ও মর্যাদার সৃষ্টি এবং তাঁর আবির্ভাবকাল পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকার বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে সেই রেওয়ায়েতদ্বয়ের ব্যাপারে কী করা যেতে পারে
?
কারণ
,এতদুভয়ে বর্ণিত হয়েছে :
“
(পবিত্র কোম নগরীর) উক্ত অবস্থান ও মর্যাদা আমাদের কায়েমের (ইমাম মাহ্দী) আবির্ভাবের নিকটবর্তী কালে সংঘটিত হবে। মহান আল্লাহ্ কোম এবং এর অধিবাসীদেরকে হুজ্জাতের (ইমাম মাহ্দী) স্থলাভিষিক্ত প্রতিনিধি করবেন।
”
“
আর তা হবে আমাদের কায়েমের অন্তর্ধানকালে এবং তা তার আবির্ভূত হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকবে।
”
আর এ রেওয়ায়েতদ্বয় ইতোমধ্যে বিহার 60তম খণ্ড
,পৃ. 213 থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে।
প্রকৃত বিষয় হচ্ছে এই যে
,কোম ও ইরানে যে সব ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর প্রতি গুটিকতক হাদীসে যে ইশারা-ইঙ্গিত বিদ্যমান সে ব্যাপারে আপত্তি করা এবং হাদীসসমূহে ব্যবহৃত শব্দগুলোকে এর প্রকাশ্য অর্থ থেকে অন্য অর্থে নেয়ার চেষ্টা এবং অতীত ও বর্তমানকালে সংঘটিত ঘটনাবলীর ওপর তা আরোপ করার ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে সন্দেহ পোষণ আসলে আগাম বিচার এবং মহানবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের প্রতি দুর্বল বিশ্বাসের পরিচয় ছাড়া আর কিছুই নয়
।
বরং আমরা যদি বিষয়টি ইনসাফপূর্ণ দৃষ্টিতে বিচার করি তাহলে আমাদেরকে অবশ্যই বলতে হবে যে
,মাসুমদের (নিষ্পাপদের) বাণী যা
‘
ইজমালী তাওয়াতুর
’
সূত্রে বর্ণিত হয়েছে তা থেকে যদি কেউ নিশ্চিত বিশ্বাস অর্জন করতে না পারে তাহলে সে অবশ্যই এ বিষয়ে সন্দেহ-সংশয় এবং বিতর্ক থেকে মুক্ত হতে পারে নি। আর মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি যে
,তিনি আমাদেরকে এবং সকল মুসলমানকে এ ধরনের অবস্থা থেকে হেফাজত করুন।
ইরানে খোরাসানী ও শুআইবের আবির্ভাব
রেওয়ায়েতসমূহে বর্ণিত হয়েছে যে
,এ দু
’
ব্যক্তিত্ব ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সঙ্গী-সাথীদের অন্তর্ভুক্ত এবং ইমামের আবির্ভাবের কাছাকাছি সময় তাঁরা ইরান থেকে আবির্ভূত হবেন। তাঁরা ইমামের আবির্ভাবের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করবেন।
মোটামুটিভাবে আহলে সুন্নাত এবং শিয়া সূত্রে বর্ণিত কতিপয় রেওয়ায়েত অনুসারে এ দু
’
ব্যক্তির ভূমিকা হবে ঐ সময় ইরানীরা নিজ শত্রুদের সাথে এক অসম যুদ্ধে লিপ্ত থাকবে এবং ঐ যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদী হওয়ার কারণে তারা খোরাসানী সাইয়্যেদকে তাদের যাবতীয় বিষয়ের তত্ত্বাবধায়ক নির্বাচিত করবে যদিও তিনি এ পদ গ্রহণে আগ্রহ প্রদর্শন করবেন না। কিন্তু তাদের অত্যধিক পীড়াপীড়ির কারণে তিনি অবশেষে এ দায়িত্ব নেবেন। যখন তিনি ইরানীদের নেতৃত্ব গ্রহণ করবেন তখন তিনি ইরানী সশস্ত্র বাহিনীতে ঐক্য ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে তাঁর সেনাপতি শুআইব ইবনে সালিহকে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক পদে নিযুক্ত করবেন।
এভাবেই খোরাসানী ও শুআইব ইরান-তুরস্ক-ইরাক সীমান্তে যুদ্ধ পরিচালনা করবেন এবং শামে অবস্থানরত ইরানী সেনাবাহিনীকে সামনের দিকে (ইসরাইলের দিকে) প্রেরণ করবেন এবং ঐ একই সময় ইরাক ও শাম ফ্রন্ট থেকে প্রিয় কুদ্স ও ফিলিস্তিনের দিকে বৃহৎ সেনা অগ্রাভিযানের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবেন।
এ যুদ্ধে খোরাসানী সাইয়্যেদ রাজনৈতিক ও সামরিক ফ্রন্টে বেশ কিছু পরিবর্তনের মুখোমুখি হবেন। এগুলো হচ্ছে :
ইরাক ফ্রন্ট
:
যা সুফিয়ানীর আধিপত্য ও কর্তৃত্বাধীনে চলে যাবে এবং সে ইরাক দখল করার জন্য তার সেনাবাহিনীকে প্রেরণ করবে। কিন্তু তারা পথিমধ্যে কিরকিসীয়াহ্ নামক স্থানে তুর্কদের (রুশ) সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হবে। আমরা সুফিয়ানীর আন্দোলন ও বিপ্লব সংক্রান্ত অধ্যায়ে এ বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
হিজায ফ্রন্ট
:
হযরত মাহ্দী (আ.) পবিত্র মক্কা থেকে আবির্ভূত হবেন এবং মক্কা শহর মুক্ত করে সেখানে অবস্থান করতে থাকবেন। ঐ সময় অমুক বংশের অবশিষ্ট ব্যক্তি এবং স্থানীয় গোত্রসমূহের দ্বারা হিজায-সরকার পরিচালিত হবে।
হিজাযে ইরানী সেনাবাহিনী প্রেরণ করা হবে সে ব্যাপারে রেওয়ায়েতসমূহে কোন কিছু বর্ণিত হয়নি। কারণ তা দু
’
দিক থেকে বাস্তবায়নযোগ্য নয় :
1
.
আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক পরিবেশ
-
পরিস্থিতি
।
2. এ ব্যাপারে স্বয়ং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর অসম্মতি জ্ঞাপন। কারণ সুফিয়ানী মক্কার উদ্দেশ্যে সৈন্য প্রেরণ এবং মহানবী (সা.) কর্তৃক প্রতিশ্রুত ভূমিধ্বসের মুজিযা সংঘটিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি মক্কা নগরীতে অবস্থান করার জন্য আদিষ্ট হবেন। আর এ ভূমিধ্বস হবে মুসলমানদের জন্য নিদর্শন।
অবশ্য খোরাসানী সাইয়্যেদ কর্তৃক কিছু সংখ্যক সৈন্য ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সাহায্যার্থে পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রেরণ করার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ
,রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে যে
,ইমাম মাহ্দী (আ.) ভূমিধ্বসের মাধ্যমে সুফিয়ানী বাহিনীর ধ্বংস হওয়ার পর প্রায় বারো হাজার সৈন্যের এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে মক্কা থেকে বের হবেন। অপেক্ষাকৃত উত্তম অভিমত হচ্ছে এই যে
,এ সেনাবাহিনী হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর বিশেষ সঙ্গী-সাথীবৃন্দ এবং যে সব মুমিন পবিত্র মক্কায় পৌঁছতে সক্ষম হবেন তাঁরা
,ইয়েমেনী বাহিনীর একটি অংশ এবং খোরাসানী সাইয়্যেদ যে সেনাদল পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রেরণ করবেন তাদের একটি অংশের দ্বারা গঠিত হয়ে থাকবে।
খোরাসানী সাইয়্যেদ ও শুআইবের সাথে সংশ্লিষ্ট রেওয়ায়েতসমূহ অধ্যয়ন করলে স্পষ্ট হয়ে যায় যে
,তিনি ইরাকের কিরকিসীয়ার রণাঙ্গনে যুদ্ধরত সুফিয়ানী ও তুর্কীদের ফাঁকি দিয়ে নিজ সেনাবাহিনীকে কিরকিসীয়ার নিকটবর্তী স্থান দিয়ে নিরাপদ স্থানে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবেন। কারণ
,তিনি ও ইরানী সেনাবাহিনী কিরকিসীয়ার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন না।
এ থেকে বোঝা যায় যে
,যেহেতু খোরাসানী বাহিনী ইরাকের খুব কাছাকাছি অবস্থান করবে এবং ইরাক দখল করার উদ্দেশে আগত সুফিয়ানী বাহিনীর গতিবিধি সম্পর্কে অবগত থাকবে তবুও তারা ইরাকে প্রবেশ করা থেকে বিরত থাকবে। এ কারণেই সুফিয়ানী বাহিনী তাদের চেয়ে আঠার দিন আগে ইরাকে প্রবেশ করে সেখানে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড এবং জঘন্য অপরাধ ও অপকর্মে লিপ্ত হবে।
ইবনে হাম্মাদের হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপিতে (48 পৃ.) বর্ণিত হয়েছে :
“
সুফিয়ানী কুফায় প্রবেশ করে তিন দিন সে শহরটিতে রক্তপাত ও লুটপাট বৈধ করে দেবে। সে এ শহরের ষাট হাজার অধিবাসীকে হত্যা করবে এবং আঠার রাত সেখানে অবস্থান করবে। কালো পতাকাবাহীরাও পানির কাছে অবস্থান গ্রহণ করার জন্য সেখানে আগমন করবে। তাদের আগমনের সংবাদ কুফায় প্রচারিত হবে এবং সুফিয়ানী বাহিনীর কানে পৌঁছবে। তারা এ সংবাদ শোনার পর সেখানে অবস্থান করার চেয়ে পলায়ন করাকে প্রাধান্য দেবে।
”
অবশ্য ইরাকে এ বাহিনীর প্রবেশ বিলম্বিত হওয়ার কারণ পারস্যোপসাগর বা অন্য কোন স্থানে অন্যান্য শত্রুর বিরুদ্ধে তাদের সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া অথবা ইরানের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও গোলযোগ দমন করাও হতে পারে। কতিপয় রেওয়ায়েতে এ বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
অথবা বিলম্ব করার কারণ রাজনৈতিক বিষয় হতে পারে। তারা ইরাকে প্রবেশ করার জন্য একটি উপযুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ ও অবস্থার অপেক্ষায় থাকবে। কিন্তু ইমাম বাকির (আ.) থেকে বর্ণিত পরবর্তী রেওয়ায়েতে বিলম্ব করার কারণ যে সামরিক কৌশলগত দিক হবে
-এ বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত বিদ্যমান।
“
যাতে খোরাসানী ও সুফিয়ানী তাদের (ইরাকবাসীদের) পানে অগ্রসর হয় এবং উভয়ে দু
’
টি প্রতিযোগী অশ্বের ন্যায় একজন এখান থেকে
,আরেকজন ওখান থেকে কুফার দিকে যাত্রা করবে।
”
তবে মদীনা নগরী এবং হিযাজের অন্যান্য শহর মুক্ত করার লক্ষ্যে হযরত মাহ্দী (আ.)-এর সাহায্যার্থে ইরানী বাহিনী প্রেরণের বিষয়টি রেওয়ায়েতসমূহে বর্ণিত হয় নি। বাহ্যত সৈন্য প্রেরণের প্রয়োজনও হবে না। এ কারণেই ইরানী সেনাবাহিনী যখন ইরাকে প্রবেশ করবে তখন তারা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর প্রতি তাদের বন্ধুত্ব
,ভালোবাসা এবং বাইআতের ঘোষণা দেবে।
রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে :
“
যে সব কালো পতাকা খোরাসান থেকে বের হবে সেগুলো কুফায় আগমন করবে এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের সাথে সাথে কালো পতাকাবাহীরা বাইআত নবায়ন করার জন্য তাঁর সামনে উপস্থিত হবে।
”
অন্যদিকে ইরানীদের অগ্রযাত্রা এবং দক্ষিণ ইরানে তাদের সমাবেশ সংক্রান্ত রেওয়ায়েতসমূহ সম্ভবত হিজায এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর দিকে তাদের (ইরানীদের) ব্যাপক হারে গমন সংক্রান্ত তথ্য জ্ঞাপন করে।
“
যখন সুফিয়ানীর সাঁজোয়া বাহিনী কুফার দিকে যাত্রা করবে তখন তিনি (ইমাম মাহ্দী) খোরাসানবাসীদের খোঁজে দূত প্রেরণ করবেন এবং খোরাসানীরাও ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর খোঁজে বের হবে।
”
কতিপয় রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে
,খোরাসানী সাইয়্যেদের নেতৃত্বে দক্ষিণ ইরানের আহ্ওয়ায শহরের অদূরে (কূহে সেফীদ) এলাকায় ইরানী জনগণের এক বিশাল সমাবেশ হবে। ইমাম মাহ্দী
(
আ
.)
হিজায মুক্ত
করার পর এ অঞ্চলের দিকে যাত্রা করবেন এবং সেখানে তিনি তাঁর খোরাসানী সঙ্গী-সাথী এবং নিজ সৈন্যদের সাথে মিলিত হবেন। সেখানেই তাঁর নেতৃত্বাধীন এ সেনাবাহিনী এবং সুফিয়ানী বাহিনীর মধ্যে এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধ বেধে যাবে।
এ যুদ্ধটা সম্ভবত সুফিয়ানীকে সাহায্যকারী পাশ্চাত্য নৌবাহিনীর সাথে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সেনাবাহিনীর যুদ্ধও হতে পারে
।
আর এ বিষয়টি ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাব আন্দোলনের অধ্যায়ে বিস্তারিত বর্ণনা করা হবে। আমাদের এ বক্তব্যের সমর্থন করে একটি বিষয়। আর তা হলো যে
,সুফিয়ানী ও ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সঙ্গী-সাথীদের মধ্যকার যুদ্ধটা হবে ভাগ্যনির্ধারণী যুদ্ধ যা ইমাম মাহ্দী (আ.)-কে সাহায্য করার জন্য বিশ্বব্যাপী গণজোয়ারের পথ উন্মুক্ত করবে। এ সময় জনগণ তাঁর সাক্ষাৎ করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা পোষণ করবে এবং তাঁকে অন্বেষণ করতে থাকবে।
তখন থেকেই খোরাসানী ও শুআইব ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর বিশেষ সঙ্গীদের অন্তর্ভুক্ত হবেন এবং শুআইব ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সেনাবহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হবেন। আর খোরাসানীদের সেনাবাহিনী ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সশস্ত্র বাহিনীর কেন্দ্রমূল বা মূল অক্ষ হিসাবে গণ্য হবে। ইমাম মাহ্দী (আ.) ইরাকের অভ্যন্তরীণ অবস্থার সংস্কার এবং সকল গোলযোগ সৃষ্টিকারী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হাত থেকে সে দেশটিকে মুক্ত করবেন। এরপর তিনি তুর্কীদের (রুশজাতি) সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবেন এবং সবশেষে আল কুদ্স মুক্ত করার লক্ষ্যে বৃহৎ সামরিক অভিযান পরিচালনা করার জন্য তিনি তাদের (খোরাসানী বাহিনী) ওপর নির্ভর করবেন।
আর এটা ছিল ইরানের এ দু
’
জন প্রতিশ্রুত ব্যক্তিত্বের ভূমিকা সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত বিবরণ। আহলে সুন্নাতের হাদীস সূত্র ও গ্রন্থসমূহে এবং কিছু সংখ্যক শিয়া হাদীস সূত্র ও গ্রন্থসমূহে এ দু
’
ব্যক্তি সংক্রান্ত অসংখ্য রেওয়ায়েত ও হাদীস থেকে যে ধারণা জন্মে সেটার ভিত্তিতে এ ঘটনা (অর্থাৎ ইরানে উক্ত প্রতিশ্রুত ব্যক্তিত্বদ্বয়ের আবির্ভাব) আমাকে পুনরায় শিয়া হাদীস সূত্র ও গ্রন্থসমূহে খোরাসানী ও শুআইব সংক্রান্ত রেওয়ায়েতসমূহের ব্যাপারে আরো ব্যাপক অধ্যয়ন ও গবেষণা চালানোর ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে। কারণ
,প্রথম প্রথম আমার মনে হয়েছিল যে
,খোরাসানী ও শুআইবের আবির্ভাবের বিষয়টি
,বিশেষ করে আবু মুসলিম খোরাসানীর বিষয়টি বনি আব্বাস অর্থাৎ আব্বাসীদের সৃষ্ট উপাখ্যান হতে পারে। কিন্তু শিয়া হাদীস সূত্র ও গ্রন্থসমূহে অনুসন্ধান ও গবেষণা এবং এগুলো অধ্যয়ন করার পর সহীহ সনদ ও সূত্র সহকারে বেশ কিছু রেওয়ায়েত দেখতে পাই যেগুলোয় খোরাসানীর কথা উল্লিখিত হয়েছে
,যেমন ইমাম সাদিক (আ.) ও অন্যান্য ইমাম থেকে আবু বাসীরের রেওয়ায়েত যা ইয়েমেনী সম্পর্কে তথ্য জ্ঞাপন করে স্বয়ং সেই রেওয়ায়েত এবং আরো কতিপয় রেওয়ায়েত দেখতে পেয়েছি যেগুলো থেকে প্রতীয়মান হয় যে
,ইমামদের সঙ্গী-সাথীদের মধ্যে প্রতিশ্রুত খোরাসানীর আবির্ভাব প্রসঙ্গটি আবু মুসলিমের অভ্যুত্থানের পূর্বেই এবং মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত হাদীসসমূহকে আব্বাসীরা নিজেদের এবং আবু মুসলিমের সাথে সংশ্লিষ্ট করার আগেই ব্যাপকভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল।
অতএব
,খোরাসানীর আন্দোলন ও অভ্যুত্থান শিয়া হাদীস সূত্রসমূহেও একটি প্রতিষ্ঠিত ও নিশ্চিত বিষয়। আর শিয়া সূত্রসমূহে তাদের যে ভূমিকার কথা উল্লিখিত হয়েছে ঠিক সেই ভূমিকার কথাই সুন্নী সূত্রসমূহেও বিদ্যমান।
আর ঠিক একইভাবে তাঁর (খোরাসানী) বন্ধু শুআইব ইবনে সালিহের আবির্ভাব সংক্রান্ত বিবরণের সার সংক্ষেপও আমাদের সূত্রসমূহে বর্ণিত হয়েছে যদিও খোরাসানী সাইয়্যেদের সাথে সংশ্লিষ্ট রেওয়ায়েতসমূহ বহু দিক থেকে শুআইব ইবনে সালিহ্ সংক্রান্ত রেওয়ায়েতসমূহ অপেক্ষা অধিকতর শক্তিশালী।
খোরাসানী ও শুআইবের ব্যক্তিত্ব সংক্রান্ত অনেক প্রশ্নই উত্থাপিত হয়ে থাকে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হচ্ছে এই যে
,এ সব রেওয়ায়েতে উল্লিখিত খোরাসানী বলতে কি কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে অথবা ইরানের ঐ নেতাকে বোঝানো হয়ে থাকতে পারে যিনি ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবকালে ইরানে বিদ্যমান থাকবেন
?
তবে খোরাসানী সংক্রান্ত রেওয়ায়েতসমূহ যেগুলো আহলে সুন্নাতের সূত্রে এবং একইভাবে পরবর্তী শিয়া সূত্রসমূহে বিদ্যমান সেগুলো থেকে প্রতীয়মান হয় যে
,তিনি ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.) অথবা ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বংশধর হবেন এবং তিনি খোরাসানী হাশিমী নামে উল্লিখিত হয়েছেন। ঐ সব হাদীসে তাঁর দৈহিক বৈশিষ্ট্যসমূহও উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন তিনি জ্যোতির্ময় মুখমণ্ডলের অধিকারী হবেন এবং তাঁর ডান গালে বা ডান হাতে তিল থাকবে।
তবে খোরাসানীর ব্যাপারে যে সব রেওয়ায়েত শিয়াদের প্রথম শ্রেণীর হাদীস সূত্র ও গ্রন্থসমূহ
,যেমন নূমানী ও শেখ তূসীর গাইবাত গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে সেগুলো খুব সম্ভবত তাঁকে খোরাসানীদের সাহায্যকারী অথবা খোরাসানবাসীদের নেতা অথবা খোরাসান সেনাবাহিনীর অধিনায়ক বলে ব্যাখ্যা করেছে
।
কারণ এ সব রেওয়ায়েত তাঁকে
‘
খোরাসানী হাশিমী
’
বলে আখ্যায়িত না করে কেবল
‘
খোরাসানী
’
নামে উল্লেখ করেছে। তবে তাঁর ব্যক্তিত্ব সংক্রান্ত যাবতীয় দলিল-প্রমাণ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে
,তিনি যে সুফিয়ানী ও ইয়েমেনীর আবির্ভাব ও আন্দোলনের সময় আবির্ভূত হয়ে ইরাক অভিমুখে নিজ সেনাবাহিনী প্রেরণ করবেন তা একটি সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট বিষয়।
এ দু
’
ব্যক্তি সম্পর্কে যে সব প্রশ্ন উত্থাপিত হয় তন্মধ্যে এ প্রশ্নটিও আছে যে
,খোরাসানী ও শুআইব কি দু
’
টি রূপক ও প্রতীকী নাম হতে পারে
?এর উত্তরে খোরাসানীর ব্যাপারে বলতে হয় যে
,রেওয়ায়েতসমূহে তাঁর প্রকৃত নাম উল্লেখ করা হয় নি। সুতরাং এটা ভাবার কোন অবকাশ নেই যে
,তাঁর নাম রূপক ও প্রতীকী। হ্যাঁ
,আমরা বলতে পারব যে
,খোরাসানের সাথে তাঁর সম্পর্ক এতদর্থে নয় যে
,তিনি অবশ্যই বর্তমানে খোরাসান প্রদেশের অধিবাসী হবেন। কারণ ইসলামের প্রথম যুগে খোরাসানকে প্রাচ্য বলে অভিহিত করা হতো যার অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে বর্তমান ইরান এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের
শাসনাধীন ইরানসংলগ্ন মুসলিম অধ্যূষিত এলাকাসমূহ। তাই খোরাসানী উক্ত ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে যে কোন এলাকার অধিবাসী হতে পারেন। তাই খোরাসানের সাথে তাঁর সম্পর্কিত হওয়া অর্থাৎ তাঁকে শুধু
‘
খোরাসানী
’
বলাই সঠিক। কারণ সুন্নী সূত্রসমূহে যেভাবে তাঁকে হাসানী বা হুসাইনী বলা হয়েছে ঠিক তদ্রূপ শিয়াদের প্রথম সারির প্রসিদ্ধ হাদীস সূত্রসমূহ থেকে তিনি যে হাসানী বা হুসাইন সাইয়্যেদ হবেন তা বোঝা যায় না।
কিন্তু শুআইব ইবনে সালিহ অথবা সালিহ্ ইবনে শুআইব-এর ব্যাপারে অবশ্যই বলতে হয় যে
,রেওয়ায়েতসমূহে তাঁর (শারীরিক ও চারিত্রিক) বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লিখিত হয়েছে। যেমন তাঁর দেহের রং হবে তামাটে বা শ্যামলা। তাঁর দেহের গড়ন হবে হালকা-পাতলা। তাঁর দাঁড়ি হবে খুব সামান্য। তিনি হবেন বিচক্ষণ ও স্থির বিশ্বাসের অধিকারী। তাঁর ইচ্ছাশক্তি হবে দৃঢ় ও স্থায়ী। তিনি অন্যতম প্রসিদ্ধ ও প্রতিভাধর সমর বিশারদ হবেন ইত্যাদি। তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে মহান আল্লাহর ঐশী অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হওয়া পর্যন্ত এটা হতে পারে তাঁর ছদ্ম নাম। আর ঠিক একইভাবে তাঁর নাম ও তাঁর পিতার নাম শুআইব (আ.) ও সালিহ্ (আ.)-এর নামের অনুরূপ অথবা এ দু
’
নামের সমার্থকও হতে পারে। কিছু কিছু রেওয়ায়েতে তাঁকে সামারকান্দের অধিবাসী বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে
,সামারকান্দ নগরী বর্তমানে সোভিয়েত শাসনাধীন।
কিন্তু অধিকাংশ রেওয়ায়েতে উল্লেখ করা হয়েছে যে
,তিনি রেই নগরীর অধিবাসী
,বনি তামীম গোত্রভুক্ত অথবা মাহরূম নাম্নী বনি তামীমের এক শাখা গোত্রের সাথে সম্পর্কযুক্ত অথবা বনি তামীম গোত্রের একজন দাস হবেন। যা হোক এটি যদি সত্য হয় তাহলে তিনি সম্ভবত দক্ষিণ ইরানের অধিবাসী হবেন। কারণ সেখানে আজও বনি তামীম গোত্রের শাখা গোত্রসমূহ বিদ্যমান অথবা তিনি বনি তামীম গোত্রের ঐ সব শাখা গোত্রের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন যারা ইসলামের প্রথম যুগে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য খোরাসান প্রদেশে চলে এসেছিল। আজ তাদের অধিকাংশই ইরানী জনগণের মাঝে মিলেমিশে গেছে এবং মাশহাদ নগরীর অদূরে গুটিকতক ছোট গ্রামে তাদের কিছু সংখ্যক আজও বিদ্যমান আছে যারা আরবী ভাষায় কথা বলে। অথবা তাদের সাথে তাঁর রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়তার বন্ধন থাকাটাও সম্ভব।
দ্বিতীয় প্রশ্নটি এ দু
’
ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব সংক্রান্ত। আমরা এ অধ্যায়ের শুরুতে উল্লেখ করেছিলাম যে
, (রেওয়ায়েতসমূহ থেকে) মনে হয় যে
,ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের বছরে এবং সুফিয়ানী ও ইয়েমেনীর অভ্যুত্থান ও বিপ্লবের সময এ দু
’
জন আবির্ভূত হবেন
।
অবশ্য যে রেওয়ায়েতটিতে উল্লিখিত হয়েছে যে
,শুআইবের আন্দোলন এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হাতে সার্বিক দায়িত্বভার অর্পণ করার মাঝে 72 মাস ব্যবধান থাকবে
,তা সহীহ বলা যেতে পারে। তাহলে এমতাবস্থায় খোরাসানী ও শুআইবের আবির্ভাব ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের 6 বছর পূর্বে হবে।
তবে কোমের ইরানী এক ব্যক্তির মাধ্যমে ক্ষেত্র প্রস্তুতকারীদের হুকুমতের শুভ সূচনাকাল এবং খোরাসানী ও শুআইবের আবির্ভাবকালের মধ্যকার ব্যবধান রেওয়ায়েতসমূহে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লিখিত হয় নি। তবে যে সব ইশারা-ইঙ্গিত এবং দলিল-প্রমাণের মাধ্যমে তা সংক্ষেপে নির্ধারণ করা সম্ভব সেই সব দলিল-প্রমাণের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে ঐ সকল রেওয়ায়েত যেগুলোয় কোম নগরী এবং এর ঘটনাবলী
,যেমন এ নগরীর বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় ও চিন্তাগত অবস্থান ও গুরুত্বের কথা বর্ণিত হয়েছে এবং এ সব কিছু যে হযরত কায়েম আল মাহ্দীর আবির্ভাবের খুব নিকটবর্তী সময় সংঘটিত হবে এতৎসংক্রান্ত বিবরণ ও বর্ণনা এ সব রেওয়য়েতে এসেছে। আমরা এ বিষয়টি
‘
বিহারুল আনওয়ার
’
গ্রন্থের 60তম খণ্ড
,পৃ. 213 থেকে বর্ণনা করেছি।
যে রেওয়ায়েতটি ইমাম বাকির (আ.) থেকে
‘
বিহারুল আনওয়ার
’
গ্রন্থের 52তম খণ্ড
,পৃ. 243-এ বর্ণিত হয়েছে [যাতে তিনি বলেছেন : আমি যদি ঐ সময়টি পেতাম তাহলে আমি এ বিষয় অর্থাৎ ইসলামের অধিপতির জন্য নিজেকে সংরক্ষণ করতাম।] তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে
,কায়েম আল মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাব ও প্রাচ্যবাসীদের (ইরানীদের) হুকুমত প্রতিষ্ঠা এবং শত্রুদের সাথে তাদের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার মধ্যকার ব্যবধান একজন মানুষের স্বাভাবিক আয়ুষ্কাল অপেক্ষা বেশি হবে না
।
এতদপ্রসঙ্গে বর্ণিত রেওয়ায়েতসমূহের অন্তর্ভুক্ত একটি হাদীস আছে যা আগে বিহারুল আনওয়ার
,52তম খণ্ড
,পৃ. 269 থেকে বর্ণিত হয়েছে। হাদীসটি হলো :
“
মহান আল্লাহ্ আমার আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত এক ব্যক্তির কাছে তা অর্পণ করবেন যার অনুসৃত কর্মপন্থা হবে তাকওয়া নির্ভর এবং যার কর্মকাণ্ড হবে জনগণের হেদায়েতকারী। সে জনগণের মাঝে বিচার ও ফয়সালা করার ব্যাপারে কোন উৎকোচ গ্রহণ করবে না
।
মহান আল্লাহর শপথ
,আমি তার নাম ও তার পিতার নাম জানি। অতঃপর ঐ বলিষ্ট ও ক্ষুদ্রকায় ব্যক্তি... যার মুখমণ্ডলে তিল এবং দেহের ত্বকে আরো দু
’
টি চি
হ্ন রয়েছে সে আসবে। সে ঐ আমানতের সংরক্ষণকারী যা তার কাছে রাখা আছে এবং সে সমগ্র পৃথিবীকে ন্যায়বিচারে পূর্ণ করে দেবে।
”
সর্বপ্রথম আহলে বাইতের বংশোদ্ভূত একজন সাইয়্যেদের মাধ্যমে যে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সঙ্গী-সাথীদের হুকুমতের শুভ সূচনা হবে এতৎসংক্রান্ত ইশারা-ইঙ্গিত এ রেওয়ায়েতে বিদ্যমান। আর সম্ভাবনার ভিত্তিতে এ রেওয়ায়েতটি হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর ওপর প্রযোজ্য হয় অথবা ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর পরে এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের আগে এক বা একাধিক ব্যক্তি উক্ত হুকুমতের কর্ণধার হতে পারেন সে বিষয়টিও ইঙ্গিত করে। কারণ
,যেহেতু আমরা বলেছি যে
,এ রেওয়ায়েতটি অসম্পূর্ণ
,সেহেতু এই খোরাসানী সাইয়্যেদ হবেন সর্বশেষ ব্যক্তি যিনি হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের আগে ইরানে শাসন করবেন অথবা ইরানের সর্বশেষ শাসকের সমসাময়িক হবেন।
আর সর্বশেষ প্রশ্ন যা খোরাসানী সাইয়্যেদের ব্যাপারে উত্থাপন করা হয় তা হলো যে
,তিনি কি মারাজায়ে তাকলীদ অথবা মারজা-ই তাকলীদের পাশে অবস্থানকারী একজন রাজনৈতিক নেতা
,যেমন প্রেসিডেন্ট অথবা কোন মারজা-ই তাকলীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহকারী ও উপদেষ্টা হবেন
?
‘
খোরাসানী
’
সংক্রান্ত রেওয়ায়েতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে
,তিনি প্রাচ্য (ইরান) সরকারের শীর্ষ নেতা হবেন। কেবল এ সম্ভাবনাটাই থেকে যায় যে
,তিনি মারজা ও নেতার নির্দেশে একজন রাজনৈতিক নেতা হিসাবে সার্বিক বিষয়ের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন
।
সম্ভবত এমনটিও হতে পারে। আর মহান আল্লাহ্ই (এ বিষয়ে) একমাত্র জ্ঞাত।
আমরা শীঘ্রই মহান আল্লাহ্ ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হাতে যে সব গায়েবী সাহায্য
,কারামত ও মুজিযাসমূহ প্রকাশ করবেন সে দিকে ইঙ্গিত করব এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে পরিবর্তন
,পূর্ণতা ও উৎকর্ষ সাধিত হবে তা হাদীসের আলোকে অধ্যয়ন ও ব্যাখ্যা করব।
ইমাম মাহ্দী (আ.)
‘
সাহলা
’
এলাকাকে যে তাঁর নিজের ও নিজ পরিবারের বাসস্থান হিসাবে মনোনীত করবেন তা বেশ কিছু সংখ্যক রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছ। উল্লেখ্য যে
,সাহলা কারবালার দিক থেকে কুফা নগরীর কাছে অবস্থিত একটি এলাকার নাম।
ইমাম মাহ্দীর অন্যান্য কাজের মধ্যে একটি হচ্ছে আর কুদ্স অভিমুখে অগ্রযাত্রা এবং বৃহৎ সামরিক অভিযান পরিচালনা করার আগে ইরাকে দীর্ঘ অবস্থান
।
যেমন :
“
তখন সে কুফায় আসবে এবং যে পর্যন্ত মহান আল্লাহ্ চাইবেন ততদিন সে সেখানে থাকবে।
”
সম্ভবত ইরাককে তাঁর সরকারের রাজধানী হিসাবে মনোনীত করা এবং সেখানকার অভ্যন্তরীণ অবস্থা স্থিতিশীল করার উদ্দেশ্য ছাড়াও তাঁর সেখানে অবস্থানের অন্যতম কারণ হবে সারা বিশ্ব থেকে স্বীয় নির্বাচিত সহযোগী ও উপদেষ্টাদের এ রাজধানীতে একত্রিত করা এবং সামরিক অভিযানের উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী গঠন ও বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করা।
অতঃপর তিনি তাঁর নিজ সেনাবাহিনী নিয়ে আল কুদ্স (বাইতুল মুকাদ্দাস) মুক্ত করার জন্য রওয়ানা হয়ে যাবেন। ইমাম বাকির (আ.) থেকে একটি রেওয়ায়েত (হাদীস) বর্ণিত হয়েছে যাতে তিনি বলেছেন :
“
আল কায়েম যখন কুফায় প্রবেশ করবে তখন পৃথিবীতে এমন কোন মুমিন বিদ্যমান থাকবে না যে সেখানে উপস্থিত হবে না অথবা সেখানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেবে না। আর এটা হচ্ছে আমীরুল মুমিনীনের বাণী যে
,সে তার সাথীদেরকে বলবে : এ তাগুতকে (সুফিয়ানী) ধ্বংস করার জন্য আমাদের সাথে চল।
”
আর আলী (আ.) থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে যে
,“
তোমরা জেনে রাখ
,আমি আল কায়েম আল মাহ্দীকে নাজাফে দেখতে পাচ্ছি
,সে পবিত্র মক্কা থেকে 5000 ফেরেশতার মাঝে সেখানে আগমন করবে এমতাবস্থায় যে
,জিবরাঈল তার ডান পাশে এবং মীকাঈল তার বাম পাশে এবং মুমিনরা তার সামনাসামনি হাঁটতে থাকবে। আর সে তার সেনাবাহিনীকে শহরসমূহে প্রেরণ ও মোতায়েন করবে।
”
আরেকটি রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে : শুআইব ইবনে সালিহ্ তার সেনাবাহিনীর অগ্রনায়ক হবে।
”
তিনি (শুআইব) আল কায়েম আল মাহ্দী (আ.)-এর সেনাবাহিনীর সেনাপতিও হবেন।
কতিপয় রেওয়ায়েত অনুসারে প্রথম যে সেনাদলটিকে ইমাম যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণ করবেন তা তিনি তুর্কীদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করবেন। ইবনে হাম্মাদ এ ব্যাপারে আরতাত থেকে একটি রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন :
“
সুফিয়ানী তুর্কদের (রুশজাতি) বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবে। তবে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হাতে তাদের চূড়ান্ত ধ্বংস সাধিত হবে এবং এটিই তুর্কীদের বিরুদ্ধে প্রেরিত তাঁর প্রথম সেনাদল।
”
ইবনে তাউসের
‘
আল মালাহিম ওয়াল ফিতান
’
নামক গ্রন্থে (পৃ. 52) প্রায় এই একই অর্থসম্বলিত রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে যে
,তিনি ইবনে হাম্মাদের গ্রন্থ থেকে সত্তর বা ততোধিক পৃষ্ঠা তাঁর নিজ গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। আর আমরা তুর্কী জাতির সাথে সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ে বলেছি যে
,এ সব রেওয়ায়েতে তুর্কী জাতি বলতে তুর্কী মুসলমানদেরকে বোঝানো হয় নি
;বরং কাফির তুর্কীদেরকেই বোঝানো হয়েছে। যেমন রেওয়ায়েতসমূহে বিদ্যমান প্রচুর সাক্ষ্য-প্রমাণ এ বিষয়টি স্পষ্ট করে ব্যক্ত করে এবং আরো কতিপয় রেওয়ায়েতে তুর্কীরা বলতে তুর্কী ভ্রাতৃবৃন্দ অথবা তুর্কীদের পক্ষ থেকে একদলকে বোঝানো হয়েছে। তুর্কীরা শব্দের সম্ভাব্য শক্তিশালী অর্থ হচ্ছে রুশজাতি।