আকাশ থেকে হযরত ঈসা (আ.)-এর অবতরণ
মুসলিম উম্মাহর ইজমা (ঐকমত্য) আছে যে
,হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.) আখেরী যামানায় (সর্বশেষ যুগে) আকাশ থেকে পৃথিবীতে অবতরণ করবেন। আর এতদর্থেই অধিকাংশ মুফাসসির পবিত্র কোরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটির ব্যাখ্যা করেছেন
:
)
و إن من أهل الكتاب إلا ليؤمننّ به قبل موته و يوم القيامة يكون عليهم شهيدا
(
এ আয়াতটি (আহলে কিতাবের মধ্য থেকে প্রত্যেক ব্যক্তিই তাঁর (ঈসা) প্রতি তাঁর মৃত্যুর আগে অবশ্যই ঈমান আনবে এবং কিয়ামত দিবসে তিনি তাদের সবার ওপর সাক্ষী থাকবেন।
-সূরা নিসা : 159)
ইবনে আব্বাস
,উবাই
,মালিক
,কাতাদাহ্
,ইবনে যাইদ এবং বলখী থেকে উপরিউক্ত বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়েছেন এবং বলেছেন :
“
আর তাবারীও তা গ্রহণ করেছেন।
”
আল্লামা মাজলিসী এই একই অর্থে বিহারুল আনওয়ার গ্রন্থে (14তম খণ্ড
,পৃ. 530) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা ইমাম বাকির (আ.) থেকে উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেন :
“
তিনি (ঈসা) কিয়ামত দিবসের আগে পৃথিবীতে অবতরণ করবেন। তখন তাঁর সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে কেউ ইহুদী ধর্মাবলম্বী অথবা খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের অন্তর্ভুক্ত থাকবে না
;অথচ তারা তাঁর মৃত্যুর আগেই তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে। আর তিনি মাহ্দীর পেছনে নামায পড়বেন।
”
শিয়া-সুন্নী সূত্রসমূহে হযরত ঈসা (আ.)-এর অবতরণ করার হাদীসসমূহ অগণিত। শাওকানী ও কাশ্মীরী ইমাম মাহ্দী (আ.) এবং ঈসা মসীহ্ (আ.)-এর অবতরণের হাদীসসমূহ মুতাওয়াতির হবার বিষয় প্রমাণ করে দু
’
টি সন্দর্ভ রচনা করেছেন। এ সব মুতাওয়াতির হাদীসের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত প্রসিদ্ধ এ হাদীসটি। মহানবী (সা.) বলেছেন :
كيف بكم (أنتم) إذا نزل عيسى بن مريم فيكم و إمامكم منكم
“
তোমাদের অবস্থা তখন কেমন হবে যখন তোমাদের মাঝে ঈসা ইবনে মরিয়ম অবতরণ করবেন
-ঐ অবস্থায় যখন তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের ইমাম বিদ্যমান থাকবে।
”
ইবনে হাম্মাদ তাঁর হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপিতে 159 থেকে 162 পৃষ্ঠা পর্যন্ত
‘
হযরত ঈসা ইবনে মরিয়মের অবতরণ এবং তাঁর সীরাত
’
এবং
‘
অবতরণের পর হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.)-এর আয়ুষ্কাল
’
-এ শিরোনামে প্রায় ত্রিশটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন।
এ সব হাদীসের মধ্যে 162 পৃষ্ঠায় নিম্নোক্ত হাদীসটি রয়েছে যা সকল সহীহ হাদীসগ্রন্থ এবং বিহারুল আনওয়ারে মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। মহানবী বলেছেন :
“
ঐ সত্তার শপথ
,যাঁর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে
,নিঃসন্দেহে হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম ন্যায়পরায়ণ বিচারক ও (ন্যায়পরায়ণ) নেতা হিসেবে তোমাদের মাঝে অবতরণ করবেন
;তিনি ক্রুশ ধ্বংস করবেন
,শুকর হত্যা করবেন
,জিযিয়া কর আরোপ করবেন এবং তিনি এত সম্পদ দান করবেন যে
,কেউ তা আর নেবে না।
”
একই গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে :
“
বিশেষ কতকগুলো কারণে নবিগণ পরস্পর ভ্রাতা
;তাঁদের ধর্ম এক ও অভিন্ন
,তবে তাঁদের জননীরা ভিন্ন। নবীদের মধ্যে আমার সবচেয়ে নিকটবর্তী হচ্ছেন ঈসা ইবনে মরিয়ম। কারণ
,তাঁর ও আমার মাঝে কোন নবী নেই। তিনি তোমাদের মাঝে অবতরণ করবেন। তাই তোমাদের উচিত তাঁকে যথাযথভাবে জানা ও চেনা। তিনি হবেন প্রশস্ত কাঁধ বিশিষ্ট
,শক্তিশালী দেহ সৌষ্ঠবের অধিকারী শ্বেত বর্ণের পুরুষ। তিনি শুকর হত্যা ও ক্রুশ ধ্বংস করবেন এবং (জিযিয়া) কর আরোপ করবেন। তাঁর কাছে ইসলাম ব্যতীত আর কোন ধর্ম গ্রহণযোগ্য হবে না। তাঁর আহ্বান সব সময় একদিক বিশিষ্ট হবে অর্থাৎ তিনি কেবল নিখিল বিশ্বের মহামহিম প্রভুর দিকেই সবাইকে আহ্বান করবেন।
”
ইবনে হাম্মাদের বেশ কিছু রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে
,ঈসা (আ.)-এর অবতরণস্থল হবে আল কুদ্স (বাইতুল মুকাদ্দাস নগরী)। তবে আরো কিছু সংখ্যক রেওয়ায়েতে বর্ণিত হযেছে যে
,তাঁর অবতরণস্থল হবে দামেস্ক নগরীর পূর্ব ফটক এবং আরো কিছু সংখ্যক রেওয়ায়েত অনুসারে ফিলিস্তিনের লুদ্দ-এর ফটক। অবশ্য যেমনভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে তদনুযায়ী এও সম্ভব যে
,প্রথমে তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসে অবতরণ করবেন এবং এরপর শাম ও পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলেও ভ্রমণ করবেন।
কতিপয় রেওয়ায়েতে বর্ণিত হযেছে যে
,তিনি ইমাম মাহ্দীর পেছনে নামায পড়বেন এং প্রতি বছর হজ্ব পালন করার জন্য পবিত্র মক্কা গমন করবেন। মুসলমানরা তাঁর সাথে ইহুদী
,রোম (পাশ্চাত্য) ও দাজ্জালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। তিনি পৃথিবীতে চার বছর জীবন যাপন করবেন এবং এরপর মৃত্যুবরণ করবেন। মুসলমানরা তাঁর পবিত্র দেহ দাফন করবে।
আহলে বাইত থেকে একটি রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে
,মাহদী (আ.) জনগণের চোখের সামনে প্রকাশ্যে ঈসা (আ.)-এর দাফন সম্পন্ন করবেন যাতে খ্রিস্টানরা আর অতীতের কথা পুনর্ব্যক্ত করতে না পারে। ইমাম মাহ্দী (আ.) হযরত মরিয়ম (আ.)-এর হাতে বোনা কাপড় দিয়ে ঈসা (আ.)-এর দেহে কাফন পড়াবেন এবং তাঁর মা হযরত মরিয়মের কবরের পাশে তাঁকে সমাহিত করবেন।
আমার দৃষ্টিতে হযরত ঈসা (আ.)-এর পৃথিবীতে পুনরাগমন সংক্রান্ত শক্তিশালী সম্ভাবনা হচ্ছে এই যে
,‘
আহলে
কিতাবের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তি বিদ্যমান থাকবে না যে তাঁর প্রতি ঈমান আনবে না
’
-পবিত্র কোরআনের এ আয়াতের ভিত্তিতে বলা যায় যে
,সকল খ্রিস্টান ও ইহুদী তাঁর প্রতি ঈমান আনবে। তাঁর ঊর্ধ্বকাশে উড্ডয়ন ও দীর্ঘ জীবন লাভ করার দর্শন হচ্ছে
,ইতিহাসের সবচেয়ে সংবেদনশীল পর্যায়ে যখন ইমাম
মাহ্দী (আ.) আবির্ভূত হবেন এবং খ্রিস্টানরা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পরাশক্তিতে পরিণত হবে তখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য মহান আল্লাহ্ ঈসা (আ.)-কে দীর্ঘজীবন দান করেছেন এবং তাঁকে জীবিত রেখেছেন। খ্রিস্টানদের বৃহত্তম পরাশক্তিতে পরিণত হওয়াই হচ্ছে বিভিন্ন জাতির কাছে ইসলামের শাশ্বত বাণী ও শিক্ষা পৌঁছানো এবং ঐশী হুকুমত ও সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত হবার পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়স্বরূপ। এ কারণেই মহান আল্লাহ্ ঈসা (আ.)-কে তাঁর ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার জন্য জীবিত রেখেছেন এবং তাঁকে সংরক্ষণ করেছেন।
আর এ কারণেই যে সমগ্র খ্রিস্ট বিশ্বজুড়ে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল ও সমাবেশ এবং এক বিশেষ ধরনের আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি হবে তা আসলেই এক বাস্তব বিষয়। কারণ
,তারা (খ্রিস্টানরা) হযরত ঈসা (আ.)-এর অবতরণকে তাদের নিজেদের জন্য এবং মুসলমানদের জন্য ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের বিপরীতে এক বিরাট নেয়ামত বলে মনে করবে। হযরত ঈসা (আ.) যে বিভিন্ন খ্রিস্টান দেশ সফর করবেন এবং মহান আল্লাহ্ যে তাঁর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ঐশী নিদর্শন ও মুজিযা জনসমক্ষে প্রকাশ করবেন এবং তিনিও যে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার আওতায় সমগ্র খ্রিস্ট বিশ্বকে পর্যায়ক্রমে ধীরে ধীরে ইসলাম গ্রহণ করার দিকে পরিচালিত করবেন তা নিতান্ত স্বাভাবিক। হযরত ঈসা (আ.)-এর অবতরণ বা পুনরাগমনের প্রাথমিক রাজনৈতিক ফলাফল হচ্ছে এই যে
,ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি পাশ্চাত্য সরকারসমূহের শত্রুতা হ্রাস পাবে। কতিপয় রেওয়ায়েত অনুসারে
,ইমাম মাহ্দী (আ.) এবং পাশ্চাত্য সরকারসমূহের মাঝে একটি
‘
যুদ্ধবিরতি ও শান্তিচুক্তি
’
সম্পাদিত হবে।
রেওয়ায়েতসমূহে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে তদনুসারে পাশ্চাত্য কর্তৃক একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ও শান্তিচুক্তি লঙ্ঘন এবং এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করার পরিপ্রেক্ষিতে ইমাম মাহ্দীর পেছনে নামায পড়ার বিষয়টি ঐ স্থানে সংঘটিত হতে পারে যেখানে ঈসা (আ.) ইমাম মাহ্দী (আ.) এবং মুসলমানদের প্রতি স্বীয় সমর্থনের কথা স্পষ্ট ভাষায় ও দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করবেন।
তবে এ অঞ্চলে পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং ইমাম মাহ্দীর হাতে এ মহাযুদ্ধে পাশ্চাত্যের পরাজয়বরণ করার পর ক্রুশ ধ্বংস ও শুকর নিধন অভিযান পরিচালিত হবার সম্ভাবনা আছে। একইভাবে হযরত ঈসা (আ.)-এর সমর্থনকারী পাশ্চাত্য জনগণের ব্যাপক গণ-আন্দোলনের তরঙ্গ যা ইমাম মাহ্দীর বিরুদ্ধে বিশাল যুদ্ধের আগে ও পরে পাশ্চাত্য সরকারসমূহের ওপর আশ্চর্যজনক প্রভাব ফেলবে তাও বিবেচনায় আনা যেতে পারে।
তবে দাজ্জাল সংক্রান্ত রেওয়ায়েত ও হাদীসমূহের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমার (এ গ্রন্থের লেখক) কাছে শক্তিশালী সম্ভাবনার ভিত্তিতে মনে হচ্ছে যে
,ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর বিশ্ব সরকার প্রতিষ্ঠা
,বিশ্বের সকল জাতির ব্যাপক কল্যাণ ও সুখ-সমৃদ্ধির বাস্তবায়ন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্ময়কর উৎকর্ষ সাধিত হবার অব্যবহিত পরে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই দাজ্জালের আবির্ভাব হবে।
দাজ্জালের উত্থান ও আবির্ভাব ইহুদী এবং তাদের সদৃশ পাশ্চাত্য দল ও ধারাসমূহ থেকে উদ্ভূত এক আন্দোলন হবে। উক্ত পাশ্চাত্য ধারা ও দলসমূহ হবে ইন্দ্রিয় পরায়ণ এবং আমোদ-প্রমোদ ও স্ফূর্তিকেন্দ্রিক। এক চক্ষুবিশিষ্ট দাজ্জালের আন্দোলন হবে প্রযুক্তিগত দিক থেকে অত্যন্ত অগ্রসর এবং ব্যাপক বস্তুবাদী মতাদর্শ ও রাজনৈতিক দিকসম্পন্ন। ইহুদীরা হবে দাজ্জালের উক্ত আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষক ও মূল ভিতস্বরূপ। তারা তরুণ-তরুণীদেরকে ধোঁকা দিয়ে প্রতারিত করে নিজেদের হীন স্বার্থে ব্যবহার করবে। দাজ্জালের ফিতনা ও গোলযোগ মুসলমানদের জন্য খুব কঠিন ও কষ্টদায়কই হবে।
হযরত ঈসা (আ.) যে দাজ্জালকে বধ করবেন এতৎসংক্রান্ত রেওয়ায়েতসমূহ সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করা দরকার। কারণ
,এটি হচ্ছে খ্রিস্টানদের আকীদা-বিশ্বাস যা তাদের ইঞ্জিলের বিভিন্ন অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে। অথচ মুসলমানদের ঐকমত্য অনুসারে বিশ্ব সরকার ও প্রশাসনের প্রকৃত শাসনকর্তা ও প্রধান হবেন ইমাম মাহ্দী এবং হযরত ঈসা (আ.) হবেন তাঁর সহকারী। মহানবী (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতের রেওয়ায়েত ও হাদীসসমূহে বর্ণিত হয়েছে যে
,ইমাম মাহ্দীর নেতৃত্বে মুসলমানরা দাজ্জালকে বধ করবে।
ইমাম মাহ্দী (আ.) এবং পাশ্চাত্যের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ও শান্তিচুক্তি সম্পাদন
এ সন্ধি সংক্রান্ত রেওয়ায়েত অগণিত। এটি হবে অনাক্রমণ ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সংক্রান্ত চুক্তি। মনে হচ্ছে
,এ চুক্তি সম্পাদন করার পেছনে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর উদ্দেশ্য হবে হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্য পাশ্চাত্যের জাতিসমূহের মাঝে তাঁর প্রচার কার্যক্রম সাফল্যের সাথে পরিচালনা করার ক্ষেত্র সৃষ্টি করা যাতে তিনি (ঈসা) পাশ্চাত্য জাতিসমূহকে হেদায়েত করার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাদের আকীদা-বিশ্বাস এবং রাজনীতিতে পরিবর্তন সাধন করতে এবং পাশ্চাত্যের সরকারসমূহ ও সভ্যতার বিচ্যুতিসমূহ তাদের কাছে সঠিকভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হন। উক্ত শান্তি ও যুদ্ধবিরতি চুক্তি সংক্রান্ত রেওয়ায়েত ও হাদীসসমূহ পর্যালোচনা করলে এ চুক্তি এবং মহানবী (সা.) ও কুরাইশদের মধ্যে সম্পাদিত হুদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তির মাঝে যে বহু সাদৃশ্য আছে
,তা স্পষ্ট হয়ে যায়। হুদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তিতে দশ বছরের জন্য যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে উভয় পক্ষ একমত হয়েছিল এবং মহান আল্লাহ্ এ সন্ধিচুক্তিকে
‘
ফাতহুম মুবীন
’
বা
‘
মহা বিজয়
’
বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু কুরাইশ গোত্রের অত্যাচারী নেতৃবর্গ এ চুক্তিকে একতরফাভাবে লঙ্ঘন করেছিল বিধায় আরব উপদ্বীপের জনগণ ইসলাম ধর্মের দিকে আকৃষ্ট হয়েছিল এবং কাফির-মুশরিকদের শক্তি চিরতরে আরবের বুক থেকে নিঃশেষ করে দেয়ারও উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। আর ইমাম মাহ্দী (আ.) ও পাশ্চাত্যের মাঝে সম্পাদিত এ চুক্তিও পাশ্চাত্যই ভঙ্গ করবে এবং এভাবে তাদের আগ্রাসী ও সীমা লঙ্ঘনকারী চরিত্রও উন্মোচিত হয়ে যাবে। বেশ কিছু রেওয়ায়েতে উল্লিখিত হয়েছে যে
,দশ লক্ষ সৈন্য নিয়ে পাশ্চাত্য এ অঞ্চলকে সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দেবে এবং এ অঞ্চলে এমন এক যুদ্ধবাঁ
ধবে যা ইমাম মাহ্দীর নেতৃত্বে আল কুদ্স মুক্ত করার যুদ্ধ অপেক্ষাও ভয়াবহ হবে।
মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে :
“
তোমাদের ও রোমের মাঝে চারটি সন্ধিচুক্তি সম্পাদিত হবে যেগুলোর চতুর্থটি রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াসের এক বংশধর কর্তৃক স্বাক্ষরিত হবে। আর তা কয়েক বছর (দু
’
বছর) পর্যন্ত স্থায়ী হবে।
”
সুদুদ ইবনে গাইলান নাম্নী আবদুল কাইস বংশীয় এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল :
“
তখন জনগণের নেতা কে হবেন
?”
তখন তিনি বলেছিলেন :
“
আমার বংশধর মাহ্দী।
”
ইমাম মাহ্দী (আ.) সংক্রান্ত হাফেয আবু নাঈম কর্তৃক বর্ণিত চল্লিশ হাদীসের বারোতম হাদীসটি নিম্নরূপ। হুযাইফা ইবনে ইয়ামান থেকে বর্ণিত :
“
মহানবী (সা.) বলেছেন : তোমাদের ও হলুদ বর্ণবিশিষ্ট ত্বকের অধিকারীদের মাঝে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। অথচ তারা নারীদের গর্ভধারণকাল পরিমাণ সময়ের মধ্যেই অর্থাৎ নয় মাস পরেই তোমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে এবং আশি ডিভিশন সৈন্যসহ স্থল ও নৌ পথে তোমাদের ওপর হামলা করবে। প্রত্যেক ডিভিশনে বারো হাজার সৈন্য থাকবে। ঐ বিশাল সেনাবাহিনী ইয়াফা ও আক্কার মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবতরণ করবে। তাদের সর্বাধিনায়ক তাদের যুদ্ধ জাহাজসমূহে আগুন ধরিয়ে দেবে এবং সেনাবাহিনীকে নিজের দেশ ও ভূ-খণ্ডকে রক্ষা করার জন্য যুদ্ধ করার নির্দেশ দেবে। ঐ সময় উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ ও রক্তপাত শুরু হয়ে যাবে। সৈন্যরা সবাই পরস্পরের সাহায্যার্থে দ্রুত ছুটে আসতে থাকবে
,এমনকি ইয়েমেনের হাদরামাউত অঞ্চল থেকেও তোমাদেরকে সাহায্য করার জন্য লোকজন ছুটে আসতে থাকবে। ঐ দিন মহান আল্লাহ্ তাঁর বর্শা
,তরবারি ও তীর-ধনুক দিয়ে তাদেরকে আঘাত করবেন এবং এ কারণেই তাদের মাঝে সেদিন সবচেয়ে বেশি হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হবে।
”
আরো বর্ণিত হয়েছে
,রোমীয়দের যুদ্ধ জাহাজসমূহ সূর থেকে আক্কা পর্যন্ত নোঙ্গর ফেলবে এবং অবস্থান গ্রহণ করবে। তখন সেখানে বিশাল যুদ্ধ সংঘটিত হবে।
হাদীসে আরো বর্ণিত হয়েছে
,মহান আল্লাহ্ খ্রিস্টানদের জন্য দু
’
ধরনের হত্যাযজ্ঞ নির্ধারণ করেছেন যেগুলোর একটি অতীতে সংঘটিত হয়েছে এবং অন্যটি এখনো সংঘটিত হয় নি।
‘
ঐদিন মহান আল্লাহ্ তাঁর বর্শা
,তরবারি ও তীর-ধনুক দিয়ে তাদেরকে আঘাত করবেন
’
-এ কথার অর্থ হচ্ছে
,মহান আল্লাহ্ ফেরেশতাদের প্রেরণ করে এবং তাঁর গায়েবী সাহায্য পাঠিয়ে মুসলমানদেরকে তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে সাহায্য করবেন।
হাদীসে আরো বর্ণিত হয়েছে :
“
তখন মহান আল্লাহ্ রোমীয়দের ওপর বাতাস ও পাখিদেরকে আধিপত্যশীল করে দেবেন যার ফলে পাখিগুলো ডানা দিয়ে তাদের মুখমণ্ডলের ওপর উপর্যুপরি আঘাত করতে থাকবে এবং কোটর থেকে তাদের চোখ বেরিয়ে আসবে। তাদের কারণে ভূমি ফেটে যাবে এবং এরপর তারা বজ্রপাত ও ভূমিকম্পের শিকার হবে এবং উচু খাড়া পাহাড় বা ভূমি থেকে নিম্নভূমি বা উপত্যকার অভ্যন্তরে নিক্ষিপ্ত ও পতিত হবে। মহান আল্লাহ্ ধৈর্য ধারণকারীদেরকে সাহায্য করবেন এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গী-সাথিদেরকে যেভাবে পূণ্য ও পুরস্কার প্রদান করেছেন এবং তাঁদের বক্ষকে সাহস ও শক্তি দিয়ে ভরপুর করে দিয়েছিলেন ঠিক তদ্রূপ তাদেরকে উত্তম প্রতিদান ও পুরস্কার প্রদান করবেন।
”
উপরিউক্ত দুই রেওয়ায়েতে যেমনটি লক্ষ্য করা যাচ্ছে তদ্রূপ ইয়াফা ও আক্কা অথবা সূর ও আক্কার মাঝে নৌবাহিনী অবতরণ ও মোতায়েন করার পেছনে তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ফিলিস্তিনকে পুনরায় ইহুদীদের হাতে অর্পণ করা। আসলে কুদ্স হবে তাদের সামরিক অভিযানে মূল অনুপ্রেরণা ও লক্ষ্য।
পরের রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে
,মিশরের আবীশ সমুদ্রতট থেকে তুরস্কের আনতাকিয়া পর্যন্ত রোমীয়রা তাদের সেনাবাহিনী মোতায়েন করবে। হুযাইফাহ্ বিন ইয়েমেন থেকে বর্ণিত হয়েছে :
“
রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর এমন এক বিজয় অর্জিত হয়েছে
,যার অনুরূপ বিজয় তাঁর নুবুওয়াত প্রাপ্তির পর থেকে আর কখনো অর্জিত হয় নি। আমি বললাম : হে রাসূলাল্লাহ্! এ বিজয় ও সাফল্য আপনার জন্য মোবারক হোক। এ বিজয় অর্জিত হবার মাধ্যমে কি যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটবে
?তিনি বললেন : কখনোই না
,কখনোই না। ঐ সত্তার শপথ যাঁর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে। হে হুযাইফাহ্! এর আগে ছয়টি বৈশিষ্ট্য আছে... এবং সর্বশেষ যুদ্ধকে তিনি
‘
রোমের ফিতনা
’
বলে উল্লেখ করলেন এবং বললেন : রোমীয়রা মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে এবং শান্তিচুক্তি লঙ্ঘন করে আশি ডিভিশন সৈন্য নিয়ে আনতাকিয়া থেকে শুরু করে আরীশ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় অবতরণ করবে।
”
হযরত ঈসা (আ.)-এর পৃথিবীতে অবতরণ ও পুনরাগমন সংক্রান্ত রেওয়ায়েতসমূহে বর্ণিত হয়েছে যে
,ঐ সময় (হযরত ঈসার পৃথিবীতে আগমন কালে) যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটবে। আর রোমীয়দের (পাশ্চাত্য) সাথে মুসলমানদের যুদ্ধসমূহের বাস্তবতাও উপরিউক্ত বিষয়কে সমর্থন করে। আসলে এখনো পাশ্চাত্যের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে নি এবং ইমাম মাহ্দীর আবির্ভাব ও আকাশ থেকে ঈসা (আ.)-এর অবতরণ করা পর্যন্ত পাশ্চাত্য সমগ্র বিশ্বব্যাপী আগ্রাসন চালাবে। যতক্ষণ পর্যন্ত মহান আল্লাহ্ আমাদেরকে তাদের ওপর বিজয়ী না করবেন ততক্ষণ পর্যন্ত এ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটবে না।
রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে
,ফিলিস্তিনে রোমীয়দের সাথে দু
’
টি যুদ্ধ হবে যেগুলোর একটিকে
‘
পুষ্পচয়ন
’
এবং অপরটিকে
‘
ফসল মাড়াই
’
বলে অভিহিত করা হয়।
নামকরণ থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে
,দ্বিতীয় যুদ্ধ প্রথম যুদ্ধ অপেক্ষা অধিকতর ধ্বংসাত্মক হবে।
পরের রেওয়ায়েত এ অর্থের দিকে ইঙ্গিত করে যে
,পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে ইমাম মাহ্দীর যুদ্ধ হবে একটি অসম যুদ্ধ। অবশ্য যেহেতু ক্ষমতা ও শক্তির ভারসাম্য বাহ্যত পাশ্চাত্যের অনুকূলে থাকবে সেহেতু কিছু কিছু ভীরু আরব পাশ্চাত্যের সাথে যোগ দেবে এবং বাকী আরব নিরপেক্ষ থাকবে।
‘
তোমাদেরকে অতি সত্বর এক অত্যন্ত শক্তিশালী জাতির মোকাবিলা করার দিকে আহ্বান করা হবে
’
-এ আয়াতের তাফসীরে মুহাম্মদ ইবনে কাব থেকে ইবনে হাম্মাদ বর্ণনা করেছেন যে
,তিনি বলেন :
“
(ভবিষ্যতে) রোমীয়দের একটি ভয়ঙ্কর যুদ্ধ আছে।
”
এরপর তিনি বলেন :
“
মহান আল্লাহ্ যখন ইসলামের শুরুতে আরবদেরকে কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আহ্বান করেছিলেন তখন তারা বলেছিল : ধনসম্পদ
,স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি আমাদেরকে মত্ত করে রেখেছে। তখন তিনি বললেন : তোমাদেরকে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি জাতির দিকে আহ্বান জানান হবে। যুদ্ধের দিনে আবারও তারা ঐ কথাই বলবে যা তারা ইসলামের সূচনালগ্নে বলেছিল। আর
‘
মহান আল্লাহ্ তোমাদেরকে মহা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রদান করবেন
’
-এ আয়াতটি তাদের ব্যাপারে বাস্তবায়িত হবে। সাফওয়ান বলেন :
“
আমাদের শিক্ষক বলেছেন যে
,সেদিন কিছু কিছু আরব ধর্ম ত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে যাবে এবং অন্যান্য আরব সন্দেহের মধ্যে পড়ে ইসলাম ও মুসলিম বাহিনীকে সাহায্য করা থেকে বিরত থাকবে।
”
মুরতাদ হবে ঐ সকল ব্যক্তি যারা রোমীয়দেরকে সাহায্য করবে এবং ইসলাম ও মুসলিম বাহিনীকে সাহায্য করা থেকে যারা বিরত থাকবে। তারা হবে নিরপেক্ষতা অবলম্বনকারী। এ সব মুরতাদ ও নিরপেক্ষতা অবলম্বনকারী রোমীয়দের ওপর বিজয় লাভ করার পর ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হাতে অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি লাভ করবে। ইবনে হাম্মাদ একটি রেওয়ায়েত উদ্ধৃত করেছেন যাতে বলা হয়েছে যে
,এ যুদ্ধের শহীদদের পুরস্কার হবে মহানবী (সা.)-এর সাথে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী শহীদদের পুরস্কারের সমতুল্য। রেওয়ায়েতটি নিম্নরূপ : সৃষ্টির শুরু থেকে এ আসমানের নিচে সর্বশ্রেষ্ঠ নিহত (শহীদ) ব্যক্তিরা হচ্ছেন
: 1. হাবীল
,যিনি অভিশপ্ত কাবিলের হাতে অন্যায়ভাবে নিহত হয়েছিলেন
,2. ঐ সব নবী যাঁরা তাঁদের নিজ নিজ জাতির হাতে নিহত হয়েছেন অথচ তাঁরা তাদের হেদায়েতের জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন এবং তাঁদের কথা ছিল
,‘
আমাদের প্রভু হচ্ছেন মহান আল্লাহ্
’
এবং জনগণকে তাঁরা মহান আল্লাহর দিকে আহ্বান করতেন
,3. ফিরআউন বংশের মুমিন
,4. ইয়াসীনের সঙ্গী
,5. হামযাহ্ ইবনে আবদুল মুত্তালিব
,6. উহুদ যুদ্ধের শহীদগণ এবং তাঁদের পর 7. হুদায়বিয়ার শহীদগণ এবং তাঁদের পর 8. আহযাব বা খন্দক যুদ্ধের শহীদগণ এরপর 9. হুনাইন যুদ্ধের শহীদগণ
,তাঁদের পর 10. ঐ সব শহীদ যাঁরা অসৎ খারেজীদের হাতে নিহত হবে
,তাঁদের পর 11. রোমের (পাশ্চাত্য) মহাসমরের পূর্ব পর্যন্ত মহান আল্লাহর পথের মুজাহিদগণ। অতঃপর যখন রোমের মহাসমর সংঘটিত হবে তখন ঐ যুদ্ধের শহীদগণ বদর যুদ্ধের শহীদদের সমতুল্য হবেন।
উক্ত রেওয়ায়েতে উল্লিখিত
‘
হুদায়বিয়ার শহীদগণ
’
-এ বাক্যটি সম্ভবত ভুলক্রমে সংযোজিত হয়েছে। কারণ
,কোন ঐতিহাসিক গ্রন্থেই হুদায়বিয়ায় যুদ্ধ সংঘটিত হওয়া ও তাতে কেউ নিহত হওয়ার কথা বলা হয় নি।
আহলে বাইতের উদ্ধৃতি দিয়ে শিয়া হাদীস সূত্রসমূহে বর্ণিত হয়েছে যে
,মহান আল্লাহর দরবারে সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন ও শ্রেষ্ঠ শহীদগণ হচ্ছেন শহীদদের নেতা ইমাম হুসাইন (আ.)-এর সঙ্গী-সাথিগণ এবং ঐ সব শহীদ যাঁরা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সঙ্গী হবেন।