ইমাম মাহদী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশ(আসরে যুহুর)

ইমাম মাহদী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশ(আসরে যুহুর)0%

ইমাম মাহদী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশ(আসরে যুহুর) লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: ইসলামী সেবা দপ্তর,কোম,ইরান
বিভাগ: ইমাম মাহদী (আ.)

ইমাম মাহদী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশ(আসরে যুহুর)

লেখক: আল্লামা আলী আল কুরানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: ইসলামী সেবা দপ্তর,কোম,ইরান
বিভাগ:

ভিজিট: 84975
ডাউনলোড: 10116

পাঠকের মতামত:

ইমাম মাহদী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশ(আসরে যুহুর)
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 62 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 84975 / ডাউনলোড: 10116
সাইজ সাইজ সাইজ
ইমাম মাহদী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশ(আসরে যুহুর)

ইমাম মাহদী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশ(আসরে যুহুর)

লেখক:
প্রকাশক: ইসলামী সেবা দপ্তর,কোম,ইরান
বাংলা

শিয়া মাজহাবের দৃষ্টিতে ইমাম মাহ্দী (আ.)

মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইতভুক্ত বারো ইমামের ইমামতে বিশ্বাস শিয়া মাজহাবের অন্যতম মূল ভিত্তিস্বরূপ। এ কারণেই আমাদের মাজহাবকে ইমামীয়া মাজহাব , মাজহাব-ই তাশাইয়ু এবং আহলে বাইতের মাজহাব বলে অভিহিত করা হয়। আর আমরা যারা এ আকীদার অনুসারী তাদেরকে ইমামী শিয়া এবং আহলে বাইতের অনুসারী বলা হয়।

শিয়াদের বিশ্বাস মতে প্রথম নিষ্পাপ ইমাম হলেন আমীরুল মুমিনীন আলী ইবনে আবী তালিব (আ.) এবং সর্বশেষ ইমাম হলেন প্রতিশ্রুত হযরত মাহ্দী -মুহাম্মদ ইবনে হাসান আল-আসকারী (আ.) -যাঁর জন্য সবাই অপেক্ষমাণ এবং যিনি 255 হিজরীতে ইরাকের সামাররা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। মহান আল্লাহ্ তাঁর আয়ুষ্কাল ও জীবন দীর্ঘায়িত করেছেন এবং তাঁকে মানুষের দৃষ্টিশক্তির অন্তরালে গোপন রেখেছেন ঐ দিন পর্যন্ত যে দিন তিনি তাঁর ঐশী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত ও তাঁকে আবির্ভূত করবেন এবং তাঁর মাধ্যমে সকল ধর্মের ওপর ইসলামকে বিজয়ী ও সমগ্র পৃথিবীকে ন্যায়বিচার দিয়ে পরিপূর্ণ করবেন।

অতএব ,প্রতিশ্রুত মাহ্দী (আ.) যে দ্বাদশ ইমাম এবং জীবিত ও গায়েব (অপ্রকাশ্য) ইমাম তা বিশ্বাস করা আমাদের মাজহাবের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে গণ্য। এ বিশ্বাস ব্যতীত একজন মুসলিম বারো ইমামী শিয়া ,এমনকি একজন সুন্নী অথবা যায়দী অথবা ইসমাঈলী মুসলিমও হতে পারবে না।

অবশ্য আমাদের কতিপয় ধর্মীয় ভাই ইমামত ,নিষ্পাপ ইমামগণ এবং হযরত মাহ্দীর গাইবতে (অন্তর্ধানে থাকাতে) বিশ্বাস সম্পর্কে বিস্ময় প্রকাশ করে থাকেন। অথচ সম্ভাব্য বিষয়াদির ক্ষেত্রে মানদণ্ড তা অসম্ভব বলে বিবেচনা অথবা সেগুলোকে মনোপুত হলে গ্রহণ করা নয় বরং মহানবী (সা.)-এর থেকে অবশ্যই সুস্পষ্ট হাদীস বিদ্যমান থাকতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ইমামত ও গাইবাত নির্দেশকারী যেসব স্পষ্ট উক্তি বিদ্যমান সেগুলো অকাট্য ও মুতাওয়াতির। যদি দ্ব্যর্থহীন উক্তি বিদ্যমান থাকে এবং এর জন্য দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করা যায় ,তাহলে যে কোন মুসলমান তা মেনে নিতে এবং পালন করতে বাধ্য। আর অন্যদের উচিত হবে দলিল উপস্থাপনকারীর অবস্থানকে সঠিক বলে গণ্য করা অথবা তাকে বিপরীত দলিল উপস্থাপনের মাধ্যমে নিঃসন্দেহ করা (অর্থাৎ সে যা মেনে চলছে তা ভুল বলে প্রমাণ করা এবং সন্তুষ্ট করা)। এক আরব কবি কতই না চমৎকার বলেছেন :

আমরা যুক্তি ও দলিল-প্রমাণের অনুসারী

যুক্তি ও দলিল-প্রমাণ যে দিকে যাবে আমরাও সেদিকে ঝুঁকে পড়ব।

আমাদের সুন্নী ভাইয়েরা যদিও ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান আল আসকারী যে প্রতিশ্রুত মাহ্দী (আ.) এ ব্যাপারে আমাদের সাথে একমত নন ,তবুও যে সব রেওয়ায়েত ইমাম মাহ্দী প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর ক্ষেত্রে আমাদের সাথে একমত এবং অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। যেমন তাঁর অস্তিত্ব ,আন্দোলন ও আবির্ভাব ,তাঁর হাতে ইসলাম ধর্মের পুনপ্রবর্তন ও প্রতিষ্ঠা ,তাঁর হুকুমত বিশ্বজনীন এবং সমগ্র পৃথিবীব্যাপী কর্তৃত্বশীল হওয়া ইত্যাদি। আর আপনার শিয়া ও সুন্নী হাদীস সূত্রসমূহে ইমাম মাহ্দী সংক্রান্ত হাদীস ও রেওয়ায়েতসমূহ একই ধরনের অথবা পরস্পর সদৃশ বলে লক্ষ্য করে থাকবেন। এ সব রেওয়ায়েত পরবর্তী অধ্যায়ে আপনাদের সামনে পেশ করা হবে।

একই সময় ইবনে আরাবী ,শারানী এবং অন্যান্য ব্যক্তির মতো কতিপয় সুন্নী আলেমও আমাদের অনুরূপ বিশ্বাস পোষণ করেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে ,হযরত মাহ্দী (আ) ইমাম মুাহম্মদ ইবনে হাসান আল আসকারীই হবেন। তাঁরা তাঁর নাম ও বংশ পরিচিতি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন এবং তাঁকে তাঁরা জীবিত ও গায়েব বলে বিশ্বাস করেন। প্রতিশ্রুত মাহ্দী গ্রন্থের রচয়িতা এ সব সুন্নী আলেমের মধ্য থেকে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করেছেন।

মুসলিম মনীষিগণ এবং ইসলামী আন্দোলনসমূহের কর্মতৎপর কর্মীবৃন্দের উচিত উপযুক্ত পন্থায় ইমাম মাহ্দী (আ.) সংক্রান্ত এ অভিন্ন আকীদা-বিশ্বাসের সদ্ব্যবহার করা। কারণ ,এ বিশ্বাস সকল মুসলমানের মধ্যে বিদ্যমান এবং তা গায়েব (অদৃশ্য অবস্তুগত জগত) এবং মহান আল্লাহর সাহায্যের ক্ষেত্রে আপামর মুসলিম জনতার ঈমানের মাত্রা উন্নীত করার ক্ষেত্রে প্রাণ উজ্জীবনী প্রভাব রাখবে। সে সাথে শত্রুদের বিপক্ষে তাদের দৃঢ়তা ও আপোষহীন দৃষ্টিভঙ্গি সমুন্নত হবে এবং তারা তাদের প্রতিশ্রুত নেতাকে সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত হবে।

ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান আল আসকারী (আ.)-এর ওপর মাহ্দী উপাধি আরোপ করার বিষয়টি যা আমাদের সুন্নী ভাইদের কাছে প্রতিষ্ঠিত নয় তা অবশ্যই যেন যারা এ বিশ্বাস পোষণ করে এবং তাঁকে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম বলে অভিহিত করে তাদের সমালোচনা ও ভর্ৎসনা করার কারণ না হয়।

অবশ্য এখানে ইমাম মাহ্দী প্রসঙ্গে শীয়াদের বিশ্বাস সংক্রান্ত কালামী আলোচনা উত্থাপন করা আমাদের লক্ষ্য নয় ;বরং লক্ষ্য হচ্ছে প্রবল উদ্যম সহকারে প্রবহমান ও উপচে পড়া এ আত্মিক মনোবল উদ্ভূত দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন যার সাথে শিয়া মুসলিম সমাজ পরিচিত। আর এটি এমন এক বিশ্বাস ও চেতনা যা দিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে শিয়া পিতামাতারা তাদের নিজ সন্তানদেরকে প্রতিপালন করেছেন। তাই এ বিশ্বাস ও চেতনা শিয়াদের অন্তরে ইমাম মাহ্দীর প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শন এবং তাঁর আবির্ভাবের জন্য অপেক্ষমাণ থাকার এক বিশাল ভাণ্ডার তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।

এ কারণেই মাহ্দী (আ.) -আমাদের প্রাণ তাঁর জন্য উৎসর্গীকৃত হোক -পৃথিবীতে মহান আল্লাহর রেখে দেয়া ,মহানবী (সা.)-এর বংশধর মহান হুজ্জাত এবং সর্বশেষ ইমাম ও ওয়াসী। তিনি পবিত্র কোরআন ও ওহীর রক্ষক এবং পৃথিবীর বুকে মহান আল্লাহর নূর প্রক্ষেপকারী বলে গণ্য। ইসলামের যাবতীয় আদর্শ ও মূল্যবোধ তাঁর ব্যক্তিত্বের মধ্যে প্রস্ফুটিত হয়েছে এবং এগুলো নবুওয়াত সদৃশ এবং রিসালাতের আলোকরশ্মিরই সম্প্রসারিত রূপ।

তাঁর অন্তর্ধানের মধ্যে অনেক বড় লক্ষ্য ,ঐশ্বরিক রহস্যাবলী ও প্রজ্ঞা এবং মহান নবী ,ইমাম ,আহলে বাইত ,ওলী ও মুমিনদের মাজলুমীয়াত যা অত্যাচারী শাসক ও বৈষম্যকারী রাজা-বাদশাহ কর্তৃক সৃষ্ট তা নিহিত রয়েছে। মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাব সংক্রান্ত মহানবীর প্রতিশ্রুতি দ্বারা মুমিনদের আকাঙ্ক্ষা আরো শক্তিশালী ও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং তাদের দুঃখ-ভারাক্রান্ত হৃদয় কর্মচাঞ্চল্য ও উৎসাহ-উদ্দীপনায় ভরে যায়। তখন তীব্র ঝড়-ঝঞ্ঝা এবং যাত্রাপথ দীর্ঘ হওয়া সত্ত্বেও তারা পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করে ইসলামের পতাকা সমুন্নত রাখে। তারা ঐ পতাকার অধিপতির সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

শিয়ারা যদি তাদের আধ্যাত্মিক জীবনের পাথেয়সহ মহানবী (সা.) এবং তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের সাথে জড়িত এবং এ ব্যাপারে প্রসিদ্ধ হয়ে থাকে তাহলে তা এজন্য যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ব্যক্তিত্ব এবং তাঁর প্রতিশ্রুত দায়িত্ব ও মিশন আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ভালোবাসার দ্বারা শিয়াদের আত্মাকে পরিতৃপ্ত করার ক্ষেত্রে এক বিশেষ আকর্ষণ শক্তির অধিকারী।

যেহেতু শিয়ারা তাদের আলেমদের ক্ষেত্রে অপরিসীম শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে সেহেতু কোন কোন গোষ্ঠী তাদের সমালোচনা করে। অথচ আরেকটি গোষ্ঠী এর প্রশংসা করেছে। বিস্ময় ও সমালোচনা ঐ সময় বৃদ্ধি পায় যখন তারা দেখে যে ,শিয়ারা তাদের মারজায়ে তাকলীদ ও ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর প্রতিনিধির প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তাঁর ফতোয়া অনুসরণ করে। কিন্তু নিষ্পাপ ইমামদের প্রতি যখন এই মাত্রায় তারা তাদের ভক্তি ও ভালোবাসা ব্যক্ত করে তখন একদল লোক তাদেরকে চরমপন্থী বলে অভিযুক্ত করে ,এমনকি অপবাদ আরোপের ক্ষেত্রে (মহান আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাচ্ছি) তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ আবার বাড়াবাড়ি করে বলে : শিয়ারা মহানবী (সা.) ,ইমাম ও মারজাদেরকে খোদা বলে বিশ্বাস করে এবং তাদের উপাসনা করে!

তবে আসল বিষয় কেবল খোদাভীরু আলেম এবং নিষ্পাপ ইমামদের প্রতি শিয়াদের অগাধ সম্মান প্রদর্শন এবং তাঁদের আনুগত্য ও তাঁদেরকে পবিত্র বলে জ্ঞান করাই নয় ;বরং তা হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে আমরা মুসলমানরা মানুষ ও তার সাথে লেন-দেন ও আচার-আচরণ সংক্রান্ত ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দূরে সরে গিয়েছি। ফলে আমরা পবিত্র কোরআনে মানুষের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে যে তিনটি পদ্ধতি লক্ষ্য করি যথা : জাহেলী পদ্ধতি যা পবিত্র কোরআনের কতিপয় আয়াত অনুসারে আরব জাতির ঐ সব ব্যক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট যারা মহানবী (সা.)-কে হুজরাসমূহের পেছন থেকে আহ্বান করত ,দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হচ্ছে বস্তুবাদী মতাদর্শ যা নবীদের শত্রু এবং নাস্তিক্যবাদী সভ্যতার ধারক-বাহকদের অনুসৃত পদ্ধতি যা তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট আয়াতসমূহে উল্লিখিত হয়েছে ,আর তৃতীয় পদ্ধতি হচ্ছে স্বয়ং পবিত্র ইসলাম ধর্মের পন্থা ও পদ্ধতি যা মানুষের প্রতি সম্মান এবং তাকে বুদ্ধিবৃত্তিক ,আধ্যাত্মিক ও কার্যকর ব্যবহারিক জগতের দিকে পরিচালনা সংক্রান্ত আয়াতসমূহে আলোচিত হয়েছে -তার মধ্যে অনৈসলামিক পথ দুটিই গ্রহণ করেছি।

আমরা যে মুসলিম বিশ্বে বসবাস করি সেখানে মহান নবী ,ইমাম ,ওয়ালী ,শহীদ ,মুমিন এবং মুসলিম জাতিসমূহ ,এমনকি আমাদের নিজেদের ব্যাপারেও আমরা যে (অবমাননাকর) দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করি তাতে জাহেলিয়াত ও পাশ্চাত্য বস্তুবাদের বহু প্রভাব লক্ষ্য করে থাকি। আর তাই আলেমদের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধার সমালোচনার জবাবে এ পর্যবেক্ষণই যথেষ্ট।

বস্তুবাদী সভ্যতার অধঃপতন এবং আমাদের সমাজের ওপর পাশ্চাত্যের আধিপত্য ও কর্তৃত্ব রাজনৈতিক ,অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে বেশ কিছু কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যার ফলে এখন মুসলমানদের জীবন সম্মানিত বলে গণ্য হচ্ছে না। অতএব ,এমতাবস্থায় তাদের জীবনের অন্যান্য দিকের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের প্রতি কিভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা সম্ভব ?

ঠিক একইভাবে আমাদের চিন্তাচেতনাকে জাহেলী যুগের মন-মানসিকতায় পরিণত করে যা সবসময় অগভীর ও সরল চিন্তার দিকে পরিচালিত করে এবং সার্বিক ,সমন্বিত ও গভীর চিন্তা থেকে দূরে রাখে। আর তা বিভিন্ন গুণ ও বৈশিষ্ট্যের সংমিশ্রণ ও বিন্যাস বিরোধী। এ কারণেই আপনারা প্রত্যক্ষ করেন যে ,আমরা কোন একটি বিষয়কে কেবল একটি পর্যায় বা দিক থেকে চিনতে চাই এবং এর বিভিন্ন দিক ও পর্যায় উপেক্ষা করে থাকি। ঠিক একইভাবে আমাদের অন্তরে কোন একটি সমস্যা বা বিষয়ের দিকে এক ধরনের দৃষ্টি ও মনোযোগের উপস্থিতি অনুভব করি কিন্তু আমরা ঐ বিষয় বা সমস্যার অন্যান্য দিক সম্পর্কে বোঝার ও জানার চেষ্টাই করি না। আমরা মহান নবী ,ওয়ালী ও ইমামদের ব্যাপারেও এ ধরনের আচরণ করে থাকি। বরং আমরা তাঁদের বাহ্য অবস্থাকেই পর্যবেক্ষণ করি অথচ আমরা তাদের সুমহান আধ্যাত্মিক পূর্ণতা এবং তাঁদের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের ব্যাপারে সম্পূর্ণ অমনোযোগী থাকি। আর যদি কোন ব্যক্তি যাবতীয় বিষয়ের ব্যাপারে এমন চিন্তা-ভাবনা করে (সকল বিষয়ের সার্বিক দিক নিয়ে চিন্তা -ভাবনা করে) তাহলে আমরা বলি যে ,সে চরমপন্থা অবলম্বন করেছে ও বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। আর তার বিবেক ও অন্তর যদি এ জন্য কেঁপে ওঠে তাহলে আমরা তাকে পাগল ও বিচ্যুত বলে অভিহিত করি।

এটি তখনই সবচেয়ে বিপজ্জনক পর্যায়ে উপনীত হয় যখন আমরা একে মাজহাব অর্থাৎ ধর্মের পোশাক পড়াই এবং মহান নবী-রাসূল ,ইমাম ও ওয়ালীদের সম্মান ও মর্যাদার বিপরীতে এ অজুহাতে দাঁড়িয়ে যাই যে ,তা মহান আল্লাহর পবিত্র সত্তার সম্মান-মর্যাদা এবং তাঁর তাওহীদের পরিপন্থী। আর তারাও মানুষ -এ কথার অর্থ হচ্ছে তাঁরা যেন মরুভূমির এক মুষ্ঠি পাথর বালুর মতই। আর মরুভূমি ও আসমানের পাথরের মধ্যেই কেবল তুলনা চলে এবং এ ক্ষেত্রে তৃতীয় কোন অস্তিত্বই নেই। যেন এ মানব সমাজের ঊষর মরুভূমিতে উদ্যান ,নহর-নদী ,উঁচু জায়গা ও পর্বত শৃঙ্গের কোন অস্তিত্ব নেই। যেন মহান ঐশী আলো যে ব্যাপার মহান আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনে বলেছেন : তাঁর নূরের উপমা হচ্ছে প্রদীপদানীর ন্যায় যাতে প্রদীপ আছে ,তা অন্য গ্রহে এবং মহান আল্লাহ্ নবী-ইমাম ও ওয়ালিগণ ব্যতীত অন্য সৃষ্ট জীব ও পদার্থসমূহের মধ্যে সেই নূর প্রস্ফুটিত হয়েছে।

আমি বিশ্বাস করি যতই দার্শনিক ,চিন্তাবিদ ও আলেমদের চিন্তা ও জ্ঞানের বিকাশ ঘটবে ততই মহানবী (সা.) এবং তাঁর আহলে বাইতের বাণীসমূহের নতুন দিক তাদের সামনে প্রকাশিত হবে এবং তাঁদের মহান মর্যাদাকে তারা বুঝতে পারবে। সেই সাথে জানবে পবিত্র ব্যক্তিদের অবশ্যই তাঁদের বাণী থেকে  চিনতে হবে। একথা সত্য যে ,আল্লাহ বলেছেন : (হে নবী) বলুন ,নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরই মত মানুষ যার প্রতি ওহী অবতীর্ণ হয়। কিন্তু তাঁর সত্তার একটি দিক (মানুষ হওয়ার ক্ষেত্রে) আমাদের মত হলেও অপর দিকটি আমাদের মত নয় যার মাধ্যমে তিনি ওহী লাভ করেন। আমাদের তাঁর অদৃশ্যের সাথে সম্পর্কেও দিকটি ভুলে গেলে চলবে না । তিনি আমাদের মত হওয়ার অর্থ এটা নয় যে ,তাঁর চিন্তা ,বোধশক্তি ও আত্মিক যোগ্যতাও আমাদের পর্যায়ে বরং তা এতটা উঁচু পর্যাযের যে ,সেখানে অন্য কেউ পৌঁছা সম্ভব নয় যেমন তাঁর পক্ষে আমাদের পর্যায়ে নামা সম্ভব নয়। ইব্রাহিম(আ.)-এর ব্যাপারে যেমন বলা হয়েছে অদৃশ্যের জ্ঞান এতটা ছিল যে ,বিশ্ব জগতের পরিচালনা ব্যবস্থা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছিল তেমন যোগ্যতা কি নবিগণ ব্যতীত  অন্যকেউ অর্জন করতে পারে ?

আমি এ বিশ্বাসের ওপর আছি যে ,মুসলিম উম্মাহর সচেতনতা এবং ইসলাম ধর্মের দিকে তাদের প্রত্যাবর্তন ও শত্রুদের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধই হচ্ছে সেই পথ যার মাধ্যমে আমরা আমাদের নিজেদের এবং একজন মুসলিম ব্যক্তির ইসলামী পরিচয় ও অস্তিত্ব খুঁজে পাব ,নতুন করে মহানবী (সা.)-কে চিনতে পারব ,আমাদের নেতা ও আলেমদেরকে পুনরায় খুঁজে পাব ,তাঁদের সাথে এমনভাবে থাকতে পারব এবং এমন আচরণ করতে পারব যা একজন পূর্ণাঙ্গ আল্লাহ্ওয়ালা (রাব্বানী) ব্যক্তিত্ব এবং তাঁদের সুউচ্চ মর্যাদার জন্য উপযোগী আর আমাদের অন্তকরণকে তাঁদের ভালোবাসা দ্বারা পূর্ণ করতে পারব। আর এ সত্যপ্রেম আমাদেরকে এক মহান প্রেম অর্থাৎ তাঁদের ও আমাদের প্রতিপালক আল্লাহর প্রতি প্রেম ও ভালোবাসায় রূপান্তরিত করে দেবে। কারণ প্রেম মহান আল্লাহর গোপন রহস্যাবলীর স্বরূপ।

যে ব্যক্তিকে একটি বৃক্ষ দর্শন গোটা জঙ্গল দর্শন করা থেকে বিরত রাখে সে যে ব্যক্তি জঙ্গল ,পাহাড়-পর্বত ও আকাশসহ বৃক্ষ দর্শন করে তাকে কিভাবে বুঝবে। আর একারণেই যে ব্যক্তি আলেম-ওলামা ,নবী-রাসূল ,ইমাম ও ওয়ালীদের পবিত্রতা ও সম্মান প্রদর্শন এবং তাঁদের বিশ্বে জীবন-যাপন করাকে মহান আল্লাহর তাওহীদের পরিপন্থী বলে গণ্য করে তার পক্ষে যে ব্যক্তি এ ধরনের সম্মান প্রদর্শনকে ইসলামেরই এক নিদর্শন বলে গণ্য করে -যা শরীয়ত কর্তৃক এজন্য প্রণীত হয়েছে যাতে তাঁদের উসীলায় জীবন চলার যাবতীয় উপায়-উপকরণ আমাদের হস্তগত হয় এবং সেই মহান আল্লাহর যিনি কোন কিছুরই অনুরূপ নন তাঁর পবিত্রতা ,সুমহান মর্যাদা ও স্মরণের দিকে আমাদের পথ উন্মুক্ত হয়ে যায় -তাকে বোঝা সম্ভব নয় ।

অতএব ,যখন আমাদের চিন্তা-ভাবনার ধারণক্ষমতা সীমিত এবং আমাদের অন্তর ছোট হবে কেবলমাত্র তখনই তাঁর বড় বড় সৃষ্টির ভালোবাসা দ্বারা আমাদের অন্তর পূর্ণ হয়ে যাবে এবং মহান আল্লাহর জন্য ভালোবাসা আর বিদ্যমান থাকবে না। আর তখন সমুদ্রের মতো প্রশস্ত হৃদয়ের প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিগণ যাঁদের অন্তরে অস্তিত্বগত বিভিন্ন দিক ও পর্যায়ের সমাবেশ ঘটেছে এবং যাঁরা আকাশ ও পৃথিবীর উচ্চ শৃঙ্গগুলো উপলব্ধি করতে এবং সেগুলোর সাথে শান্তিপূর্ণ অবস্থান করতে সক্ষম তাঁদেরকে সম্মানের দর্শনও বোঝা সম্ভব হবে না ।

মহান আল্লাহর দরবারে ইমাম মাহদী (আ.)-এর মর্যাদা

রেওয়ায়েত ,দু আ ও যিয়ারতসমূহ যেগুলো ইমাম মাহদী (আ.)-এর প্রতি আমাদের বিশ্বাস ,ভক্তি ও শ্রদ্ধার নিদর্শন সেগুলোর মধ্য থেকে গুটি কতক এখানে উল্লেখ করার পূর্বে যে সব রেওয়ায়েত ও হাদীসে মহান আল্লাহর কাছে তাঁর মর্যাদার কথা বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা যথার্থ হবে। শিয়া-সুন্নী হাদীস সূত্রসমূহে বর্ণিত হয়েছে যে ,মহান আল্লাহর দরবারে তাঁর মর্যাদা অত্যন্ত উচ্চ। তিনি দুনিয়া ও আখেরাতের নেতা। তিনি বেহেশতের নেতৃবৃন্দের অন্তর্ভুক্ত। তিনি বেহেশতবাসীর ময়ূর। তিনি মহান আল্লাহর নূর নির্মিত উজ্জ্বল পোশাক পরিহিত। তিনি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ঐশী ইলহাম ও হেদায়েতপ্রাপ্ত ,যদিও তিনি নবী নন। মহান আল্লাহ্ তাঁর মাধ্যমে অনেক কারামত এবং মুজিযার বাস্তবায়ন করবেন।

বরং যে প্রসিদ্ধ রেওয়ায়েতটি শিয়া-সুন্নী সূত্রসমূহে বর্ণিত হয়েছে তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে ,তিনি মহান নবী ও রাসূলের কাতারে অবস্থান করবেন। মহানবী (সা.) বলেছেন : আমরা আবদুল মুত্তালিবের বংশধররা বেহেশতবাসীর নেতা অর্থাৎ আমি ,হামযাহ্ ,আলী ,হাসান ,হুসাইন ও মাহদী। 441

ঠিক একইভাবে আমাদের শিয়া সূত্রসমূহে মাসুম ইমামদের ফযীলত এবং মহান আল্লাহর কাছে তাঁদের উচ্চ মর্যাদা সংক্রান্ত বেশ কিছু রেওয়ায়েত বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রতীক্ষিত ইমাম মাহ্দী সংক্রান্ত কতগুলো বিশেষ রেওয়ায়েত বিদ্যমান যেগুলোয় বর্ণিত হয়েছে যে ,তিনি পৃথিবীর বুকে মহান আল্লাহর নূর। তাঁর আনুগত্য ওয়াজিব হবার ক্ষেত্রে তিনি পবিত্র কোরআনের অংশীদার অর্থাৎ পবিত্র কোরআনকে যেমন অনুসরণ করা ওয়াজিব ঠিক তেমনি তাঁকেও অনুসরণ করা ওয়াজিব। তিনি ঐশী জ্ঞানের খনি এবং মহান আল্লাহর রহস্যের ভাণ্ডার। অধিকাংশ শ্রদ্ধেয় আলেম আকায়েদ ,তাফসীর ও হাদীস গ্রন্থসমূহে আমীরুল মুমিনীন ,হাসান ও হুসাইন (আ.)-এর ব্যতীত অন্যান্য ইমামদের ওপর তাঁকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। আর এ ব্যাপারে রেওয়ায়েতও বর্ণিত হয়েছে ।

আহলে সুন্নাতের কাছেও হযরত আবু বকর ও হযরত উমরের চেয়েও মাহ্দী (আ.)-এর শ্রেষ্ঠ হওয়া সংক্রান্ত রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে। ইবনে সীরীনকে প্রশ্ন করা হলো : মাহ্দী শ্রেষ্ঠ নাকি আবু বকর ও উমর ? তিনি বললেন : মাহ্দী ঐ দু জন অপেক্ষা বহুগুণে শ্রেষ্ঠ। আর তিনি নবী-রাসূলগণের সমমর্যাদার অধিকারী। 442