ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ব্যাপারে ইমামগণের বাণী
যে বিষয়টি এখানে খুবই তাৎপর্যমণ্ডিত তা হচ্ছে
,আমরা ইমামগণকে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর প্রতি তাঁদের নিজস্ব বিশেষ আবেগ ও উদ্দীপনা প্রকাশ করতে দেখি। তাঁরা মহানবী (সা.) কর্তৃক প্রদত্ত অঙ্গীকারের প্রতি দৃঢ় আস্থা রাখতেন এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর জন্মগ্রহণ করার আগেই তাঁদের এ বংশধর এবং তাঁর হাতে যেসব মুজিযা বাস্তবায়িত হবে সেগুলোর ব্যাপারে জানতেন। এখন আমরা আমীরুল মুমিনীন (আলী) এবং ইমাম সাদিক (আ.)-এর কতিপয় বাণী উল্লেখ করব।
হযরত আলী (আ.) বলেন :
“
তোমরা জেনে রাখ যে
,মুহাম্মদ (সা.)-এর আহলে বাইতের উপমা হচ্ছে আকাশের তারকাসমূহের ন্যায়। যখনই কোন তারকা অস্ত যায় তখন আরেকটি তারকার উদয় হয়। যেন আমি দেখতে পাচ্ছি
,ঐশী নেয়ামতসমূহ মহানবীর আহলে বাইতের আলোকে তোমাদের ওপর পূর্ণ করা হয়েছে এবং তোমরা তোমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষায় উপনীত হয়েছ (তোমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হয়েছে)।
”
তোমরা মহানবীর আহলে বাইতের দিকে তাকাও। যদি তারা নীরবতা অবলম্বন করে তাহলে তোমরাও নীরবতা অবলম্বন কর। তারা যদি তোমাদের কাছে সাহায্য চান তাহলে তোমরাও তাদেরকে সাহায্য করবে। কারণ
,মহান আল্লাহ্ হঠাৎ আমাদের অর্থাৎ আহলে বাইতভুক্ত এক ব্যক্তিকে আনবেন যে মুক্তি পাবার পথ প্রশস্ত ও সুগম করবে। আমার পিতা সর্বোত্তম দাসীর সন্তানের জন্য উৎসর্গীকৃত হোক
,যে শত্রুদেরকে তরবারি ব্যতীত আর কিছুই দেবে না এবং তাদেরকে হত্যা ও ধ্বংস করতে থাকবে। সে আট মাস অস্ত্র কাঁধে রাখবে (সংগ্রাম করতে থাকবে) যার ফলে কুরাইশরা বলতে থাকবে : যদি এ ব্যক্তি হযরত ফাতিমার বংশধর হতো তাহলে আমাদের ওপর দয়া করত।
সে নিজ প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার ওপর ঐশ্বরিক হেদায়েতকে কর্তৃত্বশীল করবে। আর ঐ সময় অন্যরা তাদের নিজেদের প্রবৃত্তির কামনা-বাসনাকে মহান আল্লাহর হেদায়েতের ওপর প্রাধান্য দেবে। সে পবিত্র কোরআনকে চিন্তা ও কর্মের মানদণ্ড ধার্য করবে
,আর অন্যরা তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত ধ্যান-ধারণা ও চিন্তাধারার ভিত্তিতে পবিত্র কোরআনকে ব্যাখ্যা করতে থাকবে। তার জন্য পৃথিবী তার গভীর হতে সম্পদরাজি বের করে দেবে এবং এগুলোর চাবি তার হাতে তুলে দেবে। তখন সে ন্যায়পরায়ণতা এবং মহানবীর পথ ও পদ্ধতি তোমাদের দেখিয়ে দেবে। সে কিতাব (কোরআন) ও সুন্নাতকে পুনরুজ্জীবিত ও পুনপ্রতিষ্ঠিত করবে যেগুলো আগে থেকেই পরিত্যাগ করা হয়েছিল এবং সবাই কোরআন ও সুন্নাহর কথা ভুলে গিয়েছিল।
সে প্রজ্ঞার বর্ম পরিধান করে তা পূর্ণ সচেতনতা
,মনোযোগ
,অদম্য চেষ্টা ও একাগ্রতাসহ পূর্ণাঙ্গ নিয়ম ও পদ্ধতি অবলম্বন করে তা শিক্ষা দেবে। কারণ
,প্রজ্ঞা তার হারানো সম্পদ এবং সে প্রজ্ঞা অনুসন্ধানরত যা তার প্রয়োজন
,আর সেও তা অর্জন করতে চায়। আর যখনই ইসলাম নিঃসঙ্গ ও উপেক্ষিত হবে এবং ঐ উটের মতো হয়ে যাবে যা পথ চলার ভারে ক্লান্ত হয়ে হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ে এবং ঘাঁড় মাটির ওপর পেতে দেয় তখন সে সকলের দৃষ্টিশক্তির অন্তরালে চলে যাবে। সে মহান আল্লাহর হুজ্জাতদের মধ্য থেকে এক হুজ্জাত এবং মহান নবীদের অন্যতম স্থলাভিষিক্ত।
সুদাইর সাইরাফী বলেছেন :
“
আমি
,মুফাযযাল ইবনে উমর
,আবু বসীর ও আবান ইবনে তাগলিব ইমাম জাফর আস সাদিক (আ.)-এর নিকট উপস্থিত হলাম। আমরা দেখলাম
,তিনি কলারবিহীন ও খাটো হাতাবিশিষ্ট খাইবরী জামা পড়ে মাটির ওপর অত্যন্ত উদ্বিগ্ন অবস্থায় বসে রয়েছেন ও মর্মস্পর্শীভাবে কাঁদছেন। তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডলে দুঃখ ও বিষাদের ছাপ ফুটে উঠেছিল। তাঁর মুখমণ্ডল পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। তাঁর পবিত্র চোখদু
’
টি অশ্রুতে ভরে গিয়েছিল
।
তিনি বলছিলেন : হে আমার নেতা! তোমার অন্তর্ধান আমার থেকে ঘুম কেড়ে নিয়েছে
,আমার জন্য পৃথিবীকে সংকীর্ণ করে ফেলেছে এবং আমার অন্তরের শান্তি ধ্বংস করেছে। হে আমার নেতা! তোমার অন্তর্ধান আমার বিপদাপদকে চিরন্তন বিপদের সাথে যুক্ত করে দিয়েছে যে
,একের পর একজনকে হারানোর কারণে আমাদের সংখ্যা ও পরিমাণ বিলুপ্ত হতে বসেছে। আমি অনুভব করছি না যে
,আমার চোখের পানি শুকিয়ে যাবে এবং আমার হৃদয়ের কান্না থেমে গিয়ে আমার হৃদয় স্থির ও শান্ত হবে।...
”
সুদাইর বলেন :
“
এ ভয়ঙ্কর অবস্থা প্রত্যক্ষ করার পর আমরা হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমাদের হৃদয় অস্থির হয়ে গেল এবং আমরা মনে করতে লাগলাম যে
,এ অবস্থা এক ভয়ঙ্কর ও বিপদ ও দুঃখের লক্ষণ অথবা এমন এক বিরাট বিপদ যা তাঁকে স্পর্শ করেছে। আমি বললাম : হে মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টির সন্তান! মহান আল্লাহ্ আপনাদের নয়নকে কখনো অশ্রুসজল না করেন। কোন্ ঘটনার কারণে আপনি এভাবে কাঁদছেন
?আপনার কী হয়েছে যে
,এভাবে শোক প্রকাশ করছেন
?”
সুদাইব বলেন :
“
তখন ইমাম এমনভাবে তাঁর বুক থেকে দুঃখভারাক্রান্ত আহ্ শব্দ করলেন যে
,তা ছিল তাঁর ভয়ের তীব্রতা প্রকাশকারী। তিনি বললেন : তোমার জন্য আক্ষেপ! আজ আমি জাফরের গ্রন্থ (কিতাবে জাফর) দেখলাম। আর এটি এমন এক গ্রন্থ যাতে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত অতীত ও ভবিষ্যতের সকল মৃত্যু
,বিপদ ও জ্ঞান বিদ্যমান। মহান আল্লাহ্ এ গ্রন্থ হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর পরবর্তী ইমামদের জন্য বিশেষভাবে নির্ধারণ করে প্রদান করেছেন। এ গ্রন্থে আমাদের আহলে বাইতের কায়েমের (মাহ্দী) জন্মগ্রহণ
,তার অন্তর্ধান ও তা দীর্ঘায়িত হওয়া
,তার দীর্ঘ আয়ুষ্কাল
,তার অন্তর্ধানকালে মুমিনদের বিপদাপদে জড়িয়ে পড়া
,কায়েমের অন্তর্ধানকাল দীর্ঘ হওয়ার কারণে তাদের অন্তঃকরণসমূহে সন্দেহ-সংশয়ের উদ্ভব
,তাদের অধিকাংশের দীনে ইসলাম থেকে (কুফরের দিকে) ফিরে যাওয়া ও হাত গুটিয়ে নেয়ার কথা পড়েছি। মহান আল্লাহ্ বলেছেন : আমরা প্রত্যেক মানুষের ভাগ্য ও ভালো-মন্দের ফল তার ঘাড়ের ওপর নিক্ষেপ করেছি। আর এগুলো পড়ার কারণে আমার অন্তর জ্বলে গেছে এবং আমার উপর দুঃখ ও বিষাদ প্রভাব বিস্তার করেছে।
আমি বললাম : হে আল্লাহর রাসূলের সন্তান! আপনি যা জানেন তা থেকে কিয়দংশ আমাদেরকে জানান। তিনি বললেন : মহান আল্লাহ্ আমাদের কায়েমের ব্যাপারে এমন তিনটি জিনিস বাস্তবায়ন করবেন যা তিনি পূর্ববর্তী তিন জন নবীর ক্ষেত্রেও বাস্তবায়িত করেছিলেন। মূসা (আ.)-এর জন্মগ্রহণের মতোই তার জন্ম গোপন রেখেছিলেন। হযরত ঈসা (আ.)-এর অন্তর্ধানের মতো তার অন্তর্ধান এবং হযরত নূহ (আ.)-এর দীর্ঘ জীবনের মতোই তার দীর্ঘ জীবন নির্ধারণ করেছেন এবং এরপর তাঁর যোগ্য বান্দা হযরত খিযির (আ.)-এর জীবনকে তার দীর্ঘ জীবনের দলিল স্বরূপ উপস্থাপন করেছেন।
আমি বললাম : হে আল্লাহর রাসূলের সন্তান! এ সব বিষয় আমাদেরকে ব্যাখ্যা করে শুনান। তিনি বললেন : তবে হযরত মূসা (আ.)-এর জন্মগ্রহণ সম্পর্কে : যখন ফিরআউন বুঝতে পারল যে
,তার রাজত্বের ধ্বংস মূসা (আ.)-এর হাতে হবে তখন সে ভবিষ্যদ্বক্তাদেরকে উপস্থিত করেছিল। তার ফিরআউনকে হযরত মূসার বংশধারা ও জাতির ব্যাপারে পথ প্রদর্শন করে বলেছিল যে
,সে বনি ইসরাইলের অন্তর্ভুক্ত হবে। ফিরআউন তার কর্মকর্তাদেরকে নির্দেশ দিল যেন তারা ইসরাইল বংশীয় অন্তঃস্বত্তা মহিলাদের পেট চিড়ে ফেলে। আর এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করার জন্য বিশ হাজারেরও অধিক সংখ্যক নবজাতক শিশুর শিরচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু যেহেতু মহান আল্লাহ্ তাঁকে রক্ষা করার ইচ্ছা করেছিলেন সেহেতু তারা তাঁর নাগাল পায় নি এবং তাঁকে হত্যা করতেও সক্ষম হয় নি।
একইভাবে বনু উমাইয়্যা ও বনু আব্বাস যখন বুঝতে পারল যে
,তাদের সরকারের বিলুপ্তি এবং তাদের শাসনকর্তা ও দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ব্যক্তিবর্গের ধ্বংসের দায়িত্ব কায়েম আল মাহ্দীর হাতে ন্যস্ত তখন তারা আমাদের শত্রুতায় লিপ্ত হলো এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর আহলে বাইতের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করল এবং কায়েমকে নিশ্চিতভাবে হত্যা করার আশায় মহানবীর বংশধরদেরকে হত্যা করতে লাগল। কিন্তু মহান আল্লাহ্ কোন জালেমের কাছে তাঁর প্রকৃত পরিকল্পনা ও বিষয় প্রকাশ করতে দেন নি যাতে তিনি তাঁর নূরকে পূর্ণ করতে সক্ষম হন। যদিও তা মুশরিকদের কাছে অপছন্দনীয় হোক না কেন।
ঈসা (আ.)-এর অন্তর্ধান প্রসঙ্গে : ইহুদী ও খ্রিস্টানরা সবাই বিশ্বাস করে যে
,তিনি নিহত হয়েছেন। তবে পবিত্র কোরআন তাদের অভিমত প্রত্যাখ্যান করে বলেছে : না তারা তাকে হত্যা করেছে
,আর না তাকে ফাঁসী দিয়েছে
;বরং তারা এ ক্ষেত্রে ভুল করেছে। (নিসা : 156)
কায়েমের অন্তর্ধানও ঠিক এমনই। কারণ
,তার অন্তর্ধানকাল দীর্ঘ হবার কারণে মুসলিম উম্মাহ্ তা অস্বীকার করবে।
আর এখন নূহ (আ.)-এর আয়ুষ্কাল দীর্ঘ হবার বিষয় : যখন তিনি তাঁর জাতির ওপর আকাশ থেকে আযাব প্রেরণ করার জন্য প্রার্থনা করলেন তখন মহান আল্লাহ্ জিবরাইল (আ.)-কে সাতটি খুরমার বীজসহ তাঁর কাছে প্রেরণ করে বলতে বললেন : হে আল্লাহর রাসূল! মহান আল্লাহ্ বলেছেন : এ জনগণ আমারই সৃষ্ট এবং আমারই দাস এবং তাদের কাছে আমার বাণী প্রচার ও দলিল পূর্ণ করা ব্যতীত তাদেরকে আমি বজ্রপাতের দ্বারা ধ্বংস করব না। অতএব
,আপনি আপনার উম্মতের কাছে ফিরে যান। আর এ কারণে আমি আপনাকে প্রতিদান দেব। এ খুরমা বীজগুলো বুনে ফেলুন। এগুলো থেকে বৃক্ষ জন্মানো
,বৃদ্ধিপ্রাপ্ত এবং ফলবতী হবার পর আপনি মুক্তি পাবেন। এ ব্যাপারে আপনার মুমিন অনুসারীদের সুসংবাদ দিন।
যখন খুরমা গাছগুলো জন্মালো
,শাখা-প্রশাখা পত্রবিশিষ্ট হলো
,গাছগুলোতে ফল ধরলো এবং দীর্ঘকাল ফল ধারণ করে রইল তখল নূহ (আ.) মহান আল্লাহর কাছে তাঁর প্রতিশ্রুতি পূরণ করার আবেদন জানালেন। কিন্তু মহান আল্লাহ্ তাঁকে পুনরায় ঐ গাছগুলোর বীজ বপন ও ধৈর্যধারণ করতে এবং নিজের জাতির কাছে সুস্পষ্ট দলিল পেশ করার আদেশ দিলেন। এ সময় যেসব দল তাঁর প্রতি ঈমান এনেছিল তারা ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে জ্ঞাত হলো। ফলে তাদের মধ্য থেকে তিনশ
’
জন ধর্মত্যাগী হয়ে বলতে লাগল : যদি নূহের দাবি ও প্রচার সত্য হতো তাহলে তার প্রভুর পক্ষে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা একান্ত অনুচিত হতো।
আর এভাবেই মহান আল্লাহ্ নূহ (আ.)-কে পরপর সাত বার খুরমার বীজ বপন করে সেগুলো ফলবান বৃক্ষে পরিণত করার জন্য আদেশ দিয়েছিলেন। আর প্রতিবারই তাঁর একদল অনুসারী ধর্ম থেকে বের হয়ে আসতে থাকে
,যার ফলে তাঁর সমর্থক ও অনুসারীর সংখ্যা সত্তরের সামান্য বেশি রয়ে গেল। তখনই মহান আল্লাহ্ তাঁর কাছে ওহী পাঠিয়ে বলেছিলেন : হে নূহ! মনোযোগ দিয়ে শোন। এখন রাতের আঁধার আলোকোজ্জ্বল প্রভাতে পরিণত হয়েছে। এখন ঐ সকল অপবিত্র ব্যক্তিদের ধর্মত্যাগের মাধ্যমে সত্য অসত্য থেকে পৃথক হয়ে গেছে এবং কুফরের অস্বচ্ছতা থেকে ঈমানের স্বচ্ছ পানি পাতিত হয়েছে।
ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন : হযরত কায়েম আল মাহ্দীর অন্তর্ধানকাল এতটা দীর্ঘ হবে যে
,এর ফলে সত্য পরিপূর্ণরূপে আলোকোজ্জ্বল এবং আঁধার ও অবিশুদ্ধতা থেকে ঈমানের স্বচ্ছতা পবিত্র ও পৃথক হয়ে যাবে।
”