রাসূলুল্লাহর (সা.) আহলে বাইত ও বিবিগণ

রাসূলুল্লাহর (সা.) আহলে বাইত  ও  বিবিগণ 16%

রাসূলুল্লাহর (সা.) আহলে বাইত  ও  বিবিগণ লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ইতিহাস

  • শুরু
  • পূর্বের
  • 22 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 13959 / ডাউনলোড: 3572
সাইজ সাইজ সাইজ
রাসূলুল্লাহর (সা.) আহলে বাইত  ও  বিবিগণ

রাসূলুল্লাহর (সা.) আহলে বাইত ও বিবিগণ

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

রাসূলুল্লাহর (সা.) আহলে বাইত কারা ?

আমরা ভূমিকায় যেমন উল্লেখ করেছি ,হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর যুগ থেকে শুরু করে এ ব্যাপারে যে সর্বসম্মত মত (ইজমা )চলে এসেছে তা হচ্ছে ,কোরআন মজীদে আহলে বাইত বলতে ন্যূনকল্পে হযরত ফাতেমাহ্ (সালামুল্লাহি আলাইহা) এবং হযরত আলী ,হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসেন (আ.)-কে বুঝানো হয়েছে তেমনি আলে মুহাম্মাদ (সা.) বলতেও ন্যূনকল্পে তাঁদেরকেই বুঝানো হয়েছে । এ বিষয়ের সমর্থনে বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত প্রচুর হাদীছ রয়েছে ।

বর্ণনাসূত্রের বিচারে এ বিষয়ক হাদীছগুলো মুতাওয়াতির কিনা সে বিষয়ে পর্যালোচনায় না গিয়েও আমরা বলতে পারি যে ,প্রথমতঃ এ সব হাদীছের বিষয়বস্তু ইসলামের চারটি অকাট্য জ্ঞানসূত্রের কোনোটির সাথেই সাংঘর্ষিক নয় এবং দ্বিতীয়তঃ সংশ্লিষ্ট আয়াত নাযিলকালে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর পুত্রসন্তান না থাকা ও কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে তাঁর বিবিগণ মা ছুম্ না হওয়া তথা আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার প্রেক্ষাপটে এ বিষয়ক হাদীছগুলো গ্রহণ করা ছাড়া সংশ্লিষ্ট আয়াতাংশের প্রায়োগিকতা থাকে না । কারণ ,সে ক্ষেত্রে আদৌ তাঁর কোনো আহলে বাইত থাকে না এবং সংশ্লিষ্ট আয়াতাংশ অর্থহীন হয়ে যায় -যে ধরনের উক্তি থেকে চির জ্ঞানময় সর্বজ্ঞাতা আল্লাহ্ তা আলা পরম প্রমুক্ত ।

অধিকন্তু আয়াতে মুবাহালাহ্ (সূরা আলে ইমরান : ৬১) অনুযায়ী হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) যে আমল করেন তদ্সংক্রান্ত যে তথ্যের ওপরে উম্মাহর মধ্যে ইজমা রয়েছে তা থেকেও উক্ত চারজন মহান ব্যক্তিত্বের আহলে বাইত বা আলে মুহাম্মাদ (সা.) হওয়ার ব্যাপারে অকাট্য সমর্থন পাওয়া যায় ।

নাজরানের খৃস্টান ধর্মনেতাদের কাছে ইসলামের সত্য দ্বীন ও হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর সত্যিকারের পয়গাম্বর হওয়ার বিষয়টি অকাট্যভাবে সুস্পষ্ট হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তারা ইসলাম ও হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর বিরোধিতার ব্যাপারে ,বিশেষ করে হযরত ঈসা (আ.)-এর ব্যাপারে একগুঁয়েমি করতে থাকলে আল্লাহ্ তা আলা তাদেরকে লা নতের চ্যালেঞ্জ দেয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ্ (সা.) কে নির্দেশ দেন ;এরশাদ করেন :

) فَمَنْ حَاجَّكَ فِيهِ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ فَقُلْ تَعَالَوْا نَدْعُ أَبْنَاءَنَا وَأَبْنَاءَكُمْ وَنِسَاءَنَا وَنِسَاءَكُمْ وَأَنْفُسَنَا وَأَنْفُسَكُمْ ثُمَّ نَبْتَهِلْ فَنَجْعَلْ لَعْنَتَ اللَّهِ عَلَى الْكَاذِبِين (

(হে রাসূল!) আপনার কাছে প্রকৃত জ্ঞান এসে যাওয়ার পরেও যে আপনার সাথে এ ব্যাপারে (ঈসার ব্যাপারে) বিতর্ক করে তাকে বলুন : এসো আমরা ডেকে নেই আমাদের পুত্রদেরকে ও তোমাদের পুত্রদেরকে ,আমাদের নারীদেরকে ও তোমাদের নারীদেরকে এবং আমাদের নিজেদেরকে ও তোমাদের নিজেদেরকে ,অতঃপর আমরা প্রার্থনা করি এবং মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর লা নত করি । (সূরা আলে ইমরান : ৬১)

ইসলামের সকল মাযহাব ও ফির্কাহর সূত্রে বর্ণিত হাদীছ সমূহের ভিত্তিতে সমগ্র উম্মাহর কাছে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত তথ্য অনুযায়ী হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) হযরত ফাতেমাহ্ (সালামুল্লাহি আলাইহা) এবং হযরত আলী ,হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসেন (আ.)-কে স্বীয় চাদর বা আবা-র নীচে নিয়ে নাজরানের খৃস্টানদের সাথে মুবাহালাহ্ করতে যান এবং এ সময় আল্লাহ্ তা আলার কাছে যে দো আ করেন তাতে তাঁদেরকে এরাই আমার আহলে বাইত বলে উল্লেখ করেন । এ সংক্রান্ত হাদীছগুলোরও বিষয়বস্তু এমন যা ইসলামের অকাট্য জ্ঞানসূত্র সমূহের কোনোটির সাথেই সাংঘর্ষিক নয় এবং এ ব্যাপারে এতদ্ব্যতীত অন্য কোনো বর্ণনা নেই । এমতাবস্থায় এটিকে গ্রহণ করা ছাড়া উপায় নেই । নচেৎ ধরে নিতে হয় যে ,রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এ আয়াত অনুযায়ী আমল করেন নি -যে ধারণা নির্দ্বিধায় প্রত্যাখ্যানযোগ্য ।

লক্ষণীয় যে ,সংশ্লিষ্ট আয়াত অনুযায়ী হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর জন্য তাঁর সবচেয়ে কাছের মানুষগুলোকে নিয়ে মুবাহালাহ্ করতে যাওয়া অপরিহার্য ছিলো । এ আয়াতে উভয় পক্ষে মুবাহালায় অংশগ্রহণকারীকে তিন ধরনের লোকদেরকে নিয়ে এতে অংশগ্রহণ করতে বলা হয় ,তা হচ্ছে : انفسنا (আমরা নিজেরা) ,ابنئنا (আমাদের পুত্রগণ/ বংশধর পুরুষগণ) ও نسائنا (আমাদের নারীগণ/ স্ত্রী-কন্যাগণ) । এ আয়াতে প্রদত্ত নির্দেশের ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যাদেরকে নিয়ে মুবাহালাহ্ করতে গেলেন সুস্পষ্ট যে ,তাঁদের মধ্য থেকে হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসেন (আ.)কে ابنئنا (আমাদের পুত্রগণ/ পুরুষ বংশধরগণ) হিসেবে ,হযরত ফাতেমাহ্ (আ.)কে نسائنا (আমাদের নারীগণ অর্থাৎ প্রিয়তম নারীগণ) ও হযরত আলী (আ.)কে انفسنا (আমরা নিজেরা) হিসেবে সাথে নিয়ে যান । অর্থাৎ তিনি তাঁর পুরো আহলে বাইতকে সাথে নিয়ে যান ।

এখানে আরো গভীরভাবে তলিয়ে চিন্তা করার বিষয় হচ্ছে এই যে ,মুবাহালাহর আয়াতে যাদেরকে সাথে নিয়ে মুবাহালাহ্ করার নির্দেশ দেয়া হয় তাঁদের সম্পর্কে আভিধানিক অর্থ গ্রহণ করা হলে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর জন্য কন্যাকে নয় ,বরং তাঁর স্ত্রীগণকে সাথে নিতে হতো ,অথবা কন্যার সাথে সাথে স্ত্রীগণকেও সাথে নিতে হতো । অবশ্য জীবিত পুত্রসন্তান না থাকা অবস্থায় নাতিদ্বয়কে নিয়ে যাওয়ার যৌক্তিকতা থাকলেও আভিধানিক তাৎপর্যের দৃষ্টিতে জামাতাকে সাথে নেয়ার বিষয়টি এর আওতায় আসে না । কিন্তু যেহেতু মুবাহালাহর ক্ষেত্রে রক্ত বা বৈবাহিক সম্পর্কের নিকটতম ব্যক্তিদেরকে সাথে নেয়ার যৌক্তিকতা ছিলো না এবং প্রতিপক্ষও তা দাবী করতো না ,বরং দু টি আদর্শিক পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক চ্যালেঞ্জের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নেতার জন্য আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে যারা তাঁর নিকটতম ও পরবর্তী উত্তরাধিকারী তথা নেতার সাথে যারা ধ্বংস হয়ে গেলে সংশ্লিষ্ট আদর্শের চিরবিলুপ্তি ঘটবে তাঁদেরকে সাথে নিয়েই মুবাহালাহ্ করা অপরিহার্য ছিলো ।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে ,ইসলামের সকল মত-পথের সূত্রে বর্ণিত হাদীছ-ভিত্তিক সর্বসম্মত মত অনুযায়ী হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) হযরত আলী (আ.)-এর সাথে তাঁর সম্পর্ককে হযরত মূসা ও হযরত হারূন (আ.)-এর মধ্যকার সম্পর্কের অনুরূপ বলে উল্লেখ করেছেন । এর মানে হচ্ছে ,হযরত হারূন (আ.) যেরূপ হযরত মূসা (আ.)-এর আদর্শিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন ,ঠিক সেভাবেই হযরত আলী (আ.) হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর আদর্শিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন । এমতাবস্থায় তাঁকে সাথে নিয়ে না গেলে মুবাহালাহ্ অসম্পূর্ণ থাকতো । সম্ভবতঃ প্রতিপক্ষও এ বিষয়টি অবগত ছিলো এবং এ কারণে তাঁকে সাথে নিয়ে না গেলে তা প্রতিপক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতো না ।

অনুরূপভাবে বুঝা যায় ,হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) জানতেন যে ,তিনি তাঁর স্ত্রীদেরকে আমাদের নারীগণ হিসেবে তথা আহলে বাইতের নারী সদস্য হিসেবে সাথে না নেয়ায় প্রতিপক্ষের কাছ থেকে প্রতিবাদের আশঙ্কা ছিলো না অর্থাৎ প্রতিপক্ষও জানতো যে ,তাঁর স্ত্রীগণ আদর্শিক-পারিভাষিক দিক থেকে তাঁর আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না ।

এ থেকে আরো প্রমাণিত হয় যে ,পারিভাষিক অর্থে কোনো নবী বা রাসূলের আহলে বাইত বা আলে রাসূলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য অভিধানিক অর্থে পরিবারের সদস্য বা বংশধর হওয়া অপরিহার্য নয় ,বরং এর বাইরে থেকেও অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে । অর্থাৎ পারিভাষিক অর্থে একজন নবী বা রাসূলের আহলে বাইত বা আলে রাসূলের অন্তর্ভুক্ত তাঁরাই যারা তাঁর আদর্শিক সত্তার অংশ এবং তাঁর আদর্শিক উত্তরাধিকারী । হযরত মূসা (আ.) ও হযরত হারূন (আ.) এবং হযরত মূসা ও হযরত ইউশা বিন্ নূন্ (আ.)-এর মধ্যে যে সম্পর্ক ছিলো তা এ ধরনেরই এবং এ কারণেই হযরত ইউশা বিন্ নূন্ (আ.) হযরত মূসা (আ.)-এর পুত্র না হওয়া সত্ত্বেও তাঁর আদর্শিক নেতৃত্বের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন । একই কারণে হযরত আলী (আ.) হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর পুত্র না হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে আহলে বাইত-এর অন্তর্ভুক্ত করা হয় ।

বিষয়টি অধিকতর সুস্পষ্ট করে তুলে ধরার জন্য উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ,পারিভাষিক অর্থে একজন নবীর আহলে বাইতের সদস্যগণের জন্য পবিত্র রক্তধারা থেকে আগত হওয়া অপরিহার্য হলেও (যে সম্পর্কে পরে আলোচনা করা হয়েছে) কেবল নবীর বংশধর হওয়ার কারণেই যে কেউ তাঁর আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না । এ কারণেই আল্লাহ্ তা আলা যেমন হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর পাপাচারী বংশধরদেরকে ইমামতের প্রতিশ্রুতির বাইরে রেখেছেন (সূরা আল্-বাক্বারাহ্ : ১২৪) ,অনুরূপভাবে তিনি হযরত নূহ্ (আ.) কে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে ,তাঁর পাপাচারী পুত্র তাঁর আহল্- এর অন্তর্ভুক্ত নয় (সূরা হূদ্ : ৪৬) । এর মানে হচ্ছে ,একজন নবীর আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্তি পবিত্র রক্তধারা থেকে হলেও কেবল পবিত্র রক্তধারার কারণে নয় ,বরং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গুণগত অবস্থার কারণে হয়ে থাকে ।

বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারীদের জবাব

আহলে বাইত ও আলে মুহাম্মাদ্ (সা.) কারা এ ব্যাপারে ইসলামের প্রথম যুগের মতৈক্যের বরখেলাফে কোনো কোনো মহল থেকে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে । অবশ্য তাদের বিভ্রান্তি এক ধরনের নয় ,বরং বিভিন্ন ধরনের । এখানে আমরা তাদের কয়েকটি ব্যাপক প্রচারিত বিভ্রান্তির জবাব দেয়া প্রয়োজন মনে করছি ।

তাদের একটি বিভ্রান্তিকর মত হচ্ছে এই যে ,রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর আহলে বাইত হচ্ছেন কেবল তাঁর স্ত্রীগণ -যা কথাটির আভিধানিক অর্থের দাবী । তাদের আরেকটি বিভ্রান্তিকর মত হচ্ছে এই যে ,রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর আহলে বাইত হচ্ছেন মূলতঃ তাঁর স্ত্রীগণ ,তবে নবী করীম (সা.)-এর আবেদনের প্রেক্ষিতে আল্লাহ্ তা আলা তাঁর কন্যা ,জামাতা ও নাতিদেরকে এর অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন ।

তাদের এ দাবী যে ভিত্তিহীন তা আমরা ওপরে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছি -যা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে ,আহলে বাইতের শা নে নাযিলকৃত আয়াত্ -যা আয়াতে তাতহীর নামে মশহুর -তাঁর স্ত্রীদের বেলায় প্রযোজ্য নয় । সুতরাং তাঁরা এককভাবে বা হযরত ফাতেমাহ্ (সালামুল্লাহি আলাইহা) এবং হযরত আলী ,হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসেন (আ.)-এর সাথে আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত নন ।

তাদের সৃষ্ট আরেকটি বিভ্রান্তিকর বক্তব্য হচ্ছে এই যে ,ইসলামে রক্তধারার বিশেষ মর্যাদা নেই । এর ভিত্তিতে তারা প্রশ্ন তুলেছে যে ,রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর বংধরদের মধ্যকার পাপাচারী লোকদেরকেও আহলে বাইত ও আলে মুহাম্মাদ্ (সা.) হিসেবে সম্মান দিতে হবে কিনা ?

বলা বাহুল্য যে ,তাদের এ বিভ্রান্তি একটি অপযুক্তি (ফ্যালাসি) মাত্র । কারণ ,নবুওয়াত্ ও আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত ইমামতের গুরুদায়িত্ব কেবল পবিত্র রক্তধারার মানুষের পক্ষেই বহন করা সম্ভব এবং এ কারণে আল্লাহ্ তা আলা এ দায়িত্ব কেবল পবিত্র রক্তধারার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন । এ ব্যাপারে আমরা পরে আলোচনা করেছি । আর রাসূলুল্লাহর (সা.) বংশধরদের মধ্যকার পাপাচারীদেরকে সম্মান প্রদর্শনের প্রশ্নটি একটি অবান্তর প্রশ্ন । কারণ ,আলোচ্য ক্ষেত্রে আহলে বাইত ও আলে মুহাম্মাদ্ (সা.) কথাগুলো পারিভাষিক অর্থে ব্যবহার করা হয় ,আভিধানিক অর্থে নয় । তাই কেউই রাসূলুল্লাহর (সা.) বংশধরদের মধ্যকার পাপাচারীদেরকে আহলে বাইত ও আলে মুহাম্মাদ্ (সা.)-এর অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করেন না ,বরং বিশেষভাবে হযরত হযরত ফাতেমাহ্ (সালামুল্লাহি আলাইহা) ও হযরত আলী (আ.) এবং তাঁদের বংশে আগত এগারো জন ইমামকে এর অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করা হয় ,যদিও সম্প্রসারিত অর্থে অনেকে রাসূলুল্লাহর (সা.) বংশধরদের মধ্যকার সমস্ত নেককার ও বুযুর্গ ব্যক্তিদেরকে আহলে বাইত ও আলে মুহাম্মাদ্ (সা.)-এর অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করে থাকেন । আর হযরত ইব্রাহীম্ (আ.) কে প্রদত্ত আল্লাহ্ তা আলার প্রতিশ্রুতি কেবল আহলে বাইত ও আলে মুহাম্মাদ্ (সা.)-এর ক্ষেত্রে বিশেষ ও পারিভাষিক অর্থেই প্রযোজ্য ।

তাদের আরেকটি বিভ্রান্তিকর বক্তব্য হচ্ছে এই যে ,আলে মুহাম্মাদ্ (সা.) বলতে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় ছ্বাহাবীও অন্তর্ভুক্ত । এমনকি কেউ কেউ এমনটিও দাবী করছে যে ,আলে মুহাম্মাদ্ (সা.) বলতে গোটা উম্মাতে মুহাম্মাদী (সা.)কেই বুঝানো হয়েছে । এ দু টি সংজ্ঞার মধ্যে কোনোটিই আল্ কথাটির প্রচলিত সংজ্ঞার পর্যায়ভুক্ত নয় এবং আলে মুহাম্মাদ্ (সা.)-এর ক্ষেত্রে কোনোটির প্রযোজ্যতার সপক্ষে কোনো অকাট্য দলীল নেই ,তবে দ্বিতীয়টি নিয়ে আলোচনা অবান্তর । কারণ ,জ্ঞানী-মূর্খ ও নেককার- বদকার নির্বিশেষে প্রচলিত সংজ্ঞার উম্মাতে মুহাম্মাদীর (সা.) সকলে আলে মুহাম্মাদ্ (সা.)-এর অন্তর্ভুক্ত এবং নামাযে আমরা তাঁদের প্রতি দরূদ পাঠাবার জন্য আল্লাহ্ তা আলার কাছে আবেদন জানাই এমন দাবী পাগল ছাড়া কারো কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না ।

তবে প্রথমটি যদি আমরা যুক্তির খাতিরে মেনে নেই তো সে ক্ষেত্রে আমরা এর প্রবক্তাদের কাছে সেই ব্যক্তিদের নামের তালিকা চাইতে পারি যাদেরকে তারা আলে মুহাম্মাদ্ (সা.)-এর অন্তর্ভুক্ত বলে দাবী করতে চাচ্ছে । অতঃপর তাঁদের আমল বিচার করে দেখতে হবে যে ,আয়াতে তাতহীর তাঁদের বেলা প্রযোজ্য কিনা । তাঁদের কারো আমলে আল্লাহ্ তা আলার বিধানের লঙ্ঘন পাওয়া গেলে [উদাহরণ স্বরূপ ,শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে প্রমাণিত যেনাকারকে শাস্তিদান থেকে বিরত থাকা ,কারো বৈধ সম্পদ বাযেয়াফ্ত করা ,কোরআনের সুস্পষ্ট বিধানের বরখেলাফে আইন্ জারী করা ,কোরআনে ঘোষিত যাকাতের হক্ব্ থেকে কাউকে বঞ্চিত করা ,স্বজনপ্রীতির পরিচয় দেয়া ইত্যাদি] নিঃসন্দেহে আয়াতে তাতহীর তাঁর বেলা প্রযোজ্য হবে না । আমরা তাঁদের সমালোচনার দফতর খুলে বসতে চাই না ,কিন্তু যে মর্যাদা তাঁদের নয় সে মর্যাদা তাঁদেরকে দিতে চাইলে অবশ্যই তাঁদেরকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার অধিকার মানতে হবে । কারণ ,তাঁরা আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে মনোনীত নবী-রাসূল বা ইমাম এবং মা ছুম্ নন যে ,তাঁদেরকে সমালোচনার উর্ধে গণ্য করে চোখ বুঁজে আলে মুহাম্মাদ্ (সা.)-এর অন্তর্ভুক্ত বলে মেনে নিতে হবে ।

প্রকৃত পক্ষে যারা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর বিবিগণকে ও ছ্বাহাবীদেরকে তাঁর আহলে বাইত (আ.)-এর বা আল্-এর অন্তর্ভুক্ত বলে দাবী করছে তাদের এ দাবীর সাথে সাধারণভাবে আহলে সুন্নাতের আহলে বাইত সংক্রান্ত আক্বীদাহর সম্পর্ক নেই । কারণ ,আহলে সুন্নাতের মধ্যে নামাযের বাইরে বিভিন্নভাবে দরূদ পাঠ করতে দেখা যায় । এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে :

اللهم صل علی سیدنا و نبینا و شافعنا و مولانا محمد و علی آله و اصحابه و ازواجه اجمعین .

- হে আল্লাহ্! আমাদের নেতা ,আমাদের নবী ,আমাদের শাফা আত্কারী ও আমাদের মাওলা মুহাম্মাদের প্রতি এবং তাঁর আল্ ,তাঁর ছ্বাহাবীগণ ও তাঁর স্ত্রীদের -সকলের -প্রতি দরূদ প্রেরণ করো ।

আবার এভাবেও পড়া হয় :

اللهم صل علی سیدنا و نبینا و شافعنا و مولانا محمد. صل الله علیه و علی آله و اصحابه و ازواجه اجمعین

- হে আল্লাহ্! আমাদের নেতা ,আমাদের নবী ,আমাদের শাফা আত্কারী ও আমাদের মাওলা মুহাম্মাদের প্রতি দরূদ প্রেরণ করো ;আল্লাহ্ তাঁর প্রতি এবং তাঁর আল্ ,তাঁর ছ্বাহাবীগণ ও তাঁর স্ত্রীদের -সকলের -প্রতি দরূদ প্রেরণ করেন ।

যারা এ দরূদ পাঠ করেন তাঁরা নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ছ্বাহাবীগণকে ও তাঁর স্ত্রীগণকে তাঁর আল্-এর অন্তর্ভুক্ত মনে করেন না বলেই তাঁদের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করেন ।

বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারীদের আরেকটি বিভ্রান্তিকর অপযুক্তি হচ্ছে এই যে ,আয়াতে তাত্হীরে আল্লাহ্ তা আলা আহলে বাইতকে পবিত্র করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন ,তাঁদেরকে পবিত্র বলে ঘোষণা করেন নি অর্থাৎ তাঁদেরকে পবিত্র হতে বলেন নি । তারা এ ব্যাপারে ওযূ প্রসঙ্গ উত্থাপন করে এবং বলে যে ,আল্লাহ্ তা আলা সে ক্ষেত্রে মু মিনদেরকে পবিত্র করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন যার মানে তিনি মু মিনদেরকে পবিত্র হতে বলেছেন ,তাদেরকে পবিত্র বলে ঘোষণা করেন নি ।

এদের এ অপযুক্তির প্রথম জবাব হচ্ছে এই যে ,ওযূর মাধ্যমে পবিত্র করণের যে ইচ্ছা আল্লাহ্ তা আলা ব্যক্ত করেছেন তাতে আহলে বাইতের সদস্যগণও শামিল রয়েছেন ,তাহলে আয়াতে তাত্হীরে তাঁদেরকে পুনরায় পবিত্র করতে চাওয়ার মানে কী ?এ থেকে সুস্পষ্ট যে ,এতদুভয় ক্ষেত্রে দুই ধরনের পবিত্রতার কথা বলা হয়েছে : সাধারণ ও বিশেষ । ওযূর ক্ষেত্রে পবিত্রতার মানে হচ্ছে ইবাদতের পূর্বপ্রস্তুতি ও পূর্বশর্ত হিসেবে এক ধরনের শারীরিক-মানসিক পবিত্রতা । আর আয়াতে তাত্হীরে পরিপূর্ণরূপে পবিত্রতা র মানে হচ্ছে সর্বাবস্থায় মানসিক ,আত্মিক ও চৈন্তিক পবিত্রতা -যা গুনাহ্ ও ভুল থেকে ফিরিয়ে রাখে ।

এদের অপযুক্তির দ্বিতীয় জবাব হচ্ছে এই যে ,আল্লাহ্ তা আলা জানেন যে ,আহলে বাইতের সদস্যগণ তাঁদের পবিত্র রক্তধারার কারণে সর্বাবস্থায় মানসিক ,আত্মিক ও চৈন্তিক ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ পবিত্রতা র অধিকারী থাকা এবং গুনাহ্ ও ভুল থেকে মুক্ত থাকার উপযুক্ততার অধিকারী ,অতঃপর তাঁরা চাইলে এরূপ থাকতে পারেবন । কিন্তু অন্যরা এ জন্য উপযুক্ততার অধিকারী নয় ,সুতরাং তারা চেষ্টা করলে পবিত্রতার অধিকারী থাকতে ও বড় বড় গুনাহ্ থেকে মুক্ত থাকতে পারবে বটে ,তবে যে কোনো সময়ই তাদের ভুল ও বিচ্যুতির সম্ভাবনা রয়েছে ,তাই তাদের পক্ষে পরিপূর্ণ পবিত্রতার অধিকারী হওয়া সম্ভব হবে না । [আল্লাহ্ তা আলা যে ,তাঁর মনোনীত নবী-রাসূল ও ইমামগণ এবং অন্যান্য খাছ্ব বান্দাহর কাছ থেকে গুনাহে লিপ্ত হবার ক্ষমতা কেড়ে নেন নি এবং কেন নেন নি সে সম্পর্কে পরে আলোচনা করা হয়েছে এবং তাঁদের ইছ্বমাত্ বা পাপমুক্ততা এ অর্থেই । ]

কোরআন মজীদে রাসূলুল্লাহর ( সা .) আহলে বাইত ও বিবিগণ

আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন কোরআন মজীদের সূরা আল্- আহযাবের 28 নং আয়াত থেকে 33 নং আয়াতের প্রথমাংশ পর্যন্ত হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর বিবিগণ সম্পর্কে নির্দেশাদি দিয়েছেন এবং এরপর 33 নং আয়াতের দ্বিতীয়াংশে আহলে বাইতের কথা উল্লেখ করেছেন । আয়াতগুলো হচ্ছে :

) يَاأَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ إِنْ كُنْتُنَّ تُرِدْنَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا فَتَعَالَيْنَ أُمَتِّعْكُنَّ وَأُسَرِّحْكُنَّ سَرَاحًا جَمِيلًا (28) وَإِنْ كُنْتُنَّ تُرِدْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَالدَّارَ الْآخِرَةَ فَإِنَّ اللَّهَ أَعَدَّ لِلْمُحْسِنَاتِ مِنْكُنَّ أَجْرًا عَظِيمًا (29) يَانِسَاءَ النَّبِيِّ مَنْ يَأْتِ مِنْكُنَّ بِفَاحِشَةٍ مُبَيِّنَةٍ يُضَاعَفْ لَهَا الْعَذَابُ ضِعْفَيْنِ وَكَانَ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرًا (

) وَمَنْ يَقْنُتْ مِنْكُنَّ لِلَّهِ وَرَسُولِهِ وَتَعْمَلْ صَالِحًا نُؤْتِهَا أَجْرَهَا مَرَّتَيْنِ وَأَعْتَدْنَا لَهَا رِزْقًا كَرِيمًا )

) يَانِسَاءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِنَ النِّسَاءِ إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَعْرُوفًا (

) وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى وَأَقِمْنَ الصَّلَاةَ وَآتِينَ الزَّكَاةَ وَأَطِعْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا

হে নবী! আপনার স্ত্রীদেরকে বলুন ,তোমরা যদি পার্থিব জীবন ও তার সৌন্দর্য (ভোগ-বিলাসিতা) কামনা কর তাহলে এসো ,আমি তোমাদেরকে ভোগ্য উপকরণাদির ব্যবস্থা করে দেই এবং তোমাদেরকে উত্তমভাবে বিদায় করে দেই । আর তোমরা যদি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে এবং পরকালের গৃহকে কামনা কর তাহলে অবশ্যই (জেনো যে ,)আল্লাহ্ তোমাদের মধ্যকার উত্তম কর্ম সম্পাদনকারীদের জন্য মহাপুরস্কার প্রস্তুত করে রেখেছেন । হে নবী-পত্নীগণ! তোমাদের মধ্য থেকে যে প্রকাশ্যে অশ্লীল কাজ করবে তাকে দ্বিগুণ শাস্তি দেয়া হবে এবং এটা আল্লাহর জন্য খুবই সহজ । আর তোমাদের মধ্য থেকে যে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের অনুগত থাকবে এবং নেক আমল সম্পাদন করবে সে জন্য তাকে আমি দুই বার পুরষ্কার প্রদান করবো এবং আমি তার জন্য সম্মানজনক রিয্ক্ব প্রস্তুত করে রেখেছি । হে নবী-পত্নীগণ! তোমরা অন্য কোনো নারীর মতো নও ; (অতএব ,)তোমরা যদি তাক্বওয়া অবলম্বন করে থাকো তাহলে তোমরা (পরপুরুষদের সাথে) তোমাদের কথায় কোমলতার (ও আকর্ষণীয় ভঙ্গির) আশ্রয় নিয়ো না ,কারণ ,তাহলে যার অন্তরে ব্যধি আছে সে প্রলুব্ধ হবে । বরং তোমরা স্বাভাবিকভাবে কথা বলো । আর তোমরা তোমাদের গৃহে অবস্থান করো এবং পূর্বতন জাহেলীয়াত-যুগের সাজসজ্জা প্রদর্শনীর ন্যায় সাজসজ্জা প্রদর্শন করে বেড়িয়ো না । আর তোমরা নামায কায়েম রাখো ,যাকাত প্রদান করো এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো । হে আহলে বাইত! আল্লাহ্ অবশ্যই তোমাদের থেকে অপকৃষ্টতা অপসারিত করতে এবং তোমাদেরকে পরিপূর্ণরূপে পূতপবিত্র করতে চান ।

এখানে সর্বপ্রথম লক্ষণীয় বিষয় এই যে ,33 নং আয়াতের শেষাংশে আহলে বাইতকে সম্বোধন করে কথা বলার পূর্ব পর্যন্ত আলোচনা ও নির্দেশাদির লক্ষ্য হচ্ছেন হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর বিবিগণ । প্রথমে নবী করীম (সা.) কে সম্বোধন করে তাঁর স্ত্রীগণকে বলার জন্য তাঁকে নির্দেশ দান ,এরপর সরাসরি তাঁদেরকে হে নবী-পত্নীগণ! বলে সম্বোধন এবং তাঁদেরকে বুঝাতে   کنتنّ، تردن، منکنّ ইত্যাদিতে বহুবচনে স্ত্রীবাচক সংযুক্ত সর্বনাম ব্যবহার থেকে এ ব্যাপারে কোনোই সন্দেহের অবকাশ থাকছে না । কিন্তু 33 নং আয়াতের শেষাংশে আহলে বাইতকে সম্বোধন করে কথা বলার ক্ষেত্রে عَنْكُمُ   ও يُطَهِّرَكُمْ বলা হয়েছে -যাতে বহুবচনে পুরুষবাচক সংযুক্ত সর্বনাম ব্যবহার করা হয়েছে । আর আরবী ভাষায় বহুবচনে দু টি ক্ষেত্রে পুরুষবাচক সর্বনাম ব্যবহার করা হয় : শুধু পুরুষ বুঝাতে এবং নারী ও পুরুষ একত্রে বুঝাতে ।

অতএব ,এ থেকে সুস্পষ্ট যে ,এখানে আহলে বাইত কথাটি আভিধানিক অর্থে ব্যবহৃত হয় নি । কারণ ,যেহেতু হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর পরিবারে কেবল তাঁর স্ত্রীগণ ছিলেন ;কোনো নাবালেগ (এমনকি সাবালেগও) পুরুষ সন্তান ছিলেন না ,সেহেতু আহলে বাইত কথাটি আভিধানিক অর্থে ব্যবহার করা হলে আগের মতোই বহুবচনে স্ত্রীবাচক সম্বোধন ব্যবহার করা হতো । অতএব ,এতে সন্দেহের অবকাশ নেই যে ,এখানে কথাটি বিশেষ পারিভাষিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে ,আর সে অর্থে নারী ও পুরুষ উভয়ই হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর আহলে বাইত-এর মধ্যে শামিল রয়েছেন ।

দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে এই যে ,আহলে বাইত-এ শামিলকৃত পুরুষ সদস্য কে বা কারা এবং নারী সদস্যই বা কে অথবা কারা ?এ নারী সদস্য কি হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর বিবিগণ ,নাকি অন্য কেউ ,নাকি তাঁর বিবিগণের সাথে অন্য কেউ ?

এখানে আমাদেরকে আয়াতের বক্তব্যের ও তার বাচনভঙ্গির প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে ।

উল্লিখিত আয়াত সমূহে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর বিবিগণ সম্পর্কে এবং তাঁদেরকে সম্বোধন করে যে সব কথা বলা হয়েছে তাতে তাঁদেরকে কয়েকটি বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে ,বরং চরম পত্র দেয়া হয়েছে ,কয়েকটি বিষয়ে নিষেধ করা হয়েছে এবং কয়েকটি বিষয়ে আদেশ দেয়া হয়েছে । চরম পত্রের বিষয় হচ্ছে এই যে ,তাঁরা পার্থিব জীবন ও তার সৌন্দর্য (ভোগ-বিলাসিতা) কামনা করলে তাঁদেরকে বিদায় করে দেয়া হবে । এতে এ ইঙ্গিত রয়েছে যে ,তাঁরা পার্থিব উপায়-উপকরণাদির জন্য হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন ।

এছাড়া তাঁদেরকে পরবর্তী বক্তব্যে যে সব বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে ও নিষেধ করা হয়েছে সে সব বিষয়ে কোরআন মজীদের অন্যত্র সাধারণভাবে এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সকল মু মিনা নারীকেই সতর্ক ও নিষেধ করা হয়েছে ,কিন্তু এ সত্ত্বেও নবী- পত্নীগণকে স্বতন্ত্রভাবে সতর্কীকরণ ও নিষেধকরণ থেকে এ ইঙ্গিত মিলে যে ,অন্য মু মিনা নারীদের মতোই তাঁদেরও ঐ সব বিষয় থেকে মুক্ত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত নয় ,কিন্তু রাসূলের (সা.)-এর বিবি হিসেবে তাঁর মর্যাদার সাথে জড়িত বিধায় তাঁদের এ সব থেকে মুক্ত থাকা অনেক বেশী প্রয়োজন এবং এ কারণেই তাঁদেরকে আলাদাভাবে সতর্ক করা ও নিষেধ করা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে । সুস্পষ্ট যে ,একই অপরাধ করলে সাধারণ মু মিনা নারীর তুলনায় তাঁদের দ্বিগুণ শাস্তি দেয়ার ফয়ছ্বালার কারণও এটাই যে ,তাঁদের আচরণের সাথে রাসূলের (সা.) ব্যক্তিগত মর্যাদা ও আল্লাহর দ্বীনের মর্যাদা জড়িত ।

এখানে আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় এই যে ,বিদায় করে দেয়ার হুমকির ক্ষেত্রে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর বিবিগণের সকলকে একত্রে শামিল করা হয়েছে যা থেকে প্রমাণিত হয় যে ,এ ব্যাপারে দাবী তোলা বা চাপ সৃষ্টির ক্ষেত্রে তাঁরা সকলেই শামিল ছিলেন ।

যদিও ,উল্লেখ না করলে নয় যে ,স্ত্রী বা স্ত্রীগণ স্বামীর কাছে স্বাভাবিক ভরণ-পোষণ ও ভোগোপকরণ দাবী করলে ,এবং এমনকি তার অতিরিক্ত অলঙ্কারাদি ও আরাম-আয়েশের উপকরণাদির জন্য আবদার করলে তা গুনাহর কাজ নয় ,তেমনি স্বামীর জন্যও স্ত্রীকে বা স্ত্রীদেরকে তালাক দেয়া নাজায়েয নয় । কিন্তু রাসূলের (সা.) বিবি হওয়ার মর্যাদার এটাই দাবী ছিলো যে ,তিনি যা কিছু দিতে সক্ষম তার চেয়ে বেশী দাবী করে (এমনকি বৈধ হলেও) তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করা হবে না ,কিন্তু তা সত্ত্বেও চাপ সৃষ্টি করা হলে তা আল্লাহ্ তা আলার পছন্দনীয় হয় নি ।

কিন্তু গুনাহর জন্য শাস্তির ভয় দেখানো ও নেক আমলের পুরষ্কারের সুসংবাদের বিষয়গুলোতে তাঁদের সকলকে সম্মিলিতভাবে শামিল না করে প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে সতর্ক করা হয়েছে ও সুসংবাদ দেয়া হয়েছে ।

অতঃপর আহলে বাইত সম্পর্কে এরশাদ হয়েছে :

) إِنَّمَا وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ (

হে আহলে বাইত! আল্লাহ্ অবশ্যই তোমাদের থেকে অপকৃষ্টতা অপসারিত করতে এবং তোমাদেরকে পরিপূর্ণরূপে পূতপবিত্র করতে চান ।

আয়াতের এ অংশে ব্যবহৃত শব্দাবলীর প্রতি সতর্কতার সাথে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাই যে ,এখানে আল্লাহ্ তা আলা আহলে বাইতকে সম্বোধন করলেও হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর বিবিগণের ন্যায় তাঁদেরকে কোনোরূপ সতর্কীকরণ তো দূরের কথা ,কোনো আদেশ দেন নি বা নছ্বীহতও করেন নি । বরং এখানে আল্লাহ্ তা আলা আহলে বাইত সম্পর্কে তাঁর দু টি ফয়ছ্বালা বা সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়েছেন । তা হচ্ছে ,তিনি তাঁদের থেকে অপকৃষ্টতা অপসারিত করতে এবং তাঁদেরকে পরিপূর্ণরূপে পূতপবিত্র করতে চান । আর এ সিদ্ধান্ত ঘোষণার বাক্য শুরু করা হয়েছে انّما (অবশ্যই) শব্দ দ্বারা । এর মানে হচ্ছে ,এটি একটি অপরিবর্তনীয় সিদ্ধান্ত ;কোনোরূপ দুই সম্ভাবনাযুক্ত বিকল্প সিদ্ধান্ত নয় । এ থেকে আহলে বাইতের পাপমুক্ততা (عصمة )-ও অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় ।

কিন্তু এর বাইরে কোরআন মজীদে কোথাওই হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর বিবিগণের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনোভাবেই পাপমুক্ততা ( عصمة )-এর ঘোষণা দেয়া হয় নি ।

[এখানে আমরা বলে রাখতে চাই যে ,কারো মা ছুম্ ( معصوم   -পাপমুক্ত) হওয়ার মানে এই যে ,তিনি নিশ্চিতভাবেই পাপমুক্ত ছিলেন ,কিন্তু কারো মা ছুম্ না হওয়ার মানে এই নয় যে ,তিনি নিশ্চিতভাবেই পাপ করেছেন । বরং মা ছুম্ না হওয়ার মানে হচ্ছে ,পাপ থেকে মুক্ত থাকার নিশ্চয়তা না থাকা । এমতাবস্থায় কারো পাপে লিপ্ত হওয়ার বিষয়টি অকাট্যভাবে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে পাপী বলে গণ্য করা চলে না । ]

কোরআন মজীদের উপরোদ্ধৃত আয়াত সমূহে ব্যবহৃত বাচনভঙ্গি থেকেই সুস্পষ্ট যে ,হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর   বিবিগণ মা ছুম্ ছিলেন না । অবশ্য কোরআন মজীদে তাঁদেরকে মু মিনদের মাতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে (সূরা আল্-আহযাব্ : 6) এবং হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর ইন্তেকালের পর তাঁদের কাউকে বিবাহ করা মু মিনদের জন্য হারাম করে দেয়া হয় (সূরা আল্-আহযাব্ : 53) । এ কারণে তাঁদের সাথে মু মিনদের যে সম্মানার্হ সম্পর্ক তার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে তাঁদের মর্যাদাকে পাপমুক্ততার পর্যায়ে উন্নীত করার চেষ্টা করেন ।

কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার হলো মু মিনদের জন্য মাতৃস্বরূপ হওয়া আর মা ছুম্ হওয়ার মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই ,ঠিক যেমন কোনো মু মিন ব্যক্তির জন্মদাত্রী মায়ের সাথে তার সম্মানার্হ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও তার মাকে অনিবার্যভাবেই মা ছুম্ বলে গণ্য করা সঠিক হতে পারে না । এমনকি কোনো মু মিন ব্যক্তির পিতা-মাতা যদি কাফেরও হয় তাহলেও তাদের সাথে সম্মানার্হ ও সৌজন্যমূলক আচরণ অব্যাহত রাখার জন্য কোরআন মজীদে নির্দেশ দেয়া হয়েছে ,কিন্তু ঐ মু মিন ব্যক্তির এ আচরণ তার পিতা-মাতাকে মু মিনে পরিণত করবে না ।

মু মিনদের জন্য হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর বিবিগণকে মায়ের ন্যায় সম্মানার্হ গণ্য করার বিষয়টিও একই ধরনের । প্রকৃত পক্ষে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর স্ত্রীর মর্যাদাই তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনকে মু মিনদের জন্য অপরিহার্য করেছে । কারণ ,হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) মু মিনদের জন্য পিতৃতুল্য ,বরং তিনি পিতার চেয়েও অধিকতর সম্মান ,শ্রদ্ধা ,ভক্তি ও ভালোবাসা পাবার হক্বদার । এমতাবস্থায় তাঁর পরে তাঁর কোনো স্ত্রীকে বিবাহ করলে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর প্রতি পূর্বানুরূপ সম্মান ,শ্রদ্ধা ,ভক্তি ও ভালোবাসা বজায় থাকবে না এটাই স্বাভাবিক । এমতাবস্থায় তাঁর পরে তাঁর বিবিগণকে বিবাহ করা হারাম হওয়া ও তাঁদেরকে মাতৃতুল্য গণ্য করা অপরিহার্য ছিলো । কিন্তু এর দ্বারা কিছুতেই তাঁদেরকে মা ছুম্ বলে গণ্য করা চলে না ।

যদিও অনুরূপ ক্ষেত্রে অতীতের নবী-রাসূলগণের (আ.) বিবিগণের ব্যাপারে আল্লাহ্ তা আলার বিধান কী ছিলো তা কোরআন মজীদে উল্লেখ করা হয় নি (এবং তা উল্লেখের প্রয়োজনও ছিলো না) । তবে আমরা নির্দ্বিধায় ধরে নিতে পারি যে ,অতীতের নবী-রাসূলগণের (আ.) বিবিগণের ক্ষেত্রেও আল্লাহ্ তা আলার বিধান অভিন্ন ছিলো । কিন্তু তাঁদের ক্ষেত্রেও মা ছুম্ হওয়ার বিষয় প্রমাণিত হয় না । অর্থাৎ তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ মা ছুম্ থেকে থাকলে তা ব্যক্তি হিসেবে ,নবী-রাসূলের (আ.) স্ত্রী হিসেবে নয় । তার প্রমাণ ,কোরআন মজীদে হযরত নূহ্ (আ.) ও হযরত লূত (আ.)-এর স্ত্রীর কুফরী ও জাহান্নামী হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লিখিত হয়েছে । একটি ঐশী মূলনীতি হিসেবে নবী-রাসূলের (আ.) স্ত্রী তথা মু মিনদের মাতা হওয়া যদি কারো পাপমুক্ততা নিশ্চিত করতো তাহলে ঐ দু জন নারী তার ব্যতিক্রম হতো না ।

নীতিগতভাবে তথা একটি ঐশী মূলনীতি হিসেবে উম্মাহাতুল মু মিনীন অর্থাৎ হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর বিবিগণ-এর মা ছুম্ না হওয়ার তথা আহলে বাইত-এর অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার বিষয়টি উল্লিখিত আয়াত সমূহ ও উপরোক্ত আলোচনা থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় । কোরআন মজীদের আরো কতক আয়াত থেকে এ বিষয়টি অধিকতর সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় । অর্থাৎ এখানে যা এজমালীভাবে প্রমাণিত হয় অন্য কতক আয়াত থেকে তা দৃষ্টান্ত সহকারে প্রমাণিত হয় ।

কোরআন মজীদের সূরা আত্-তাহরীম্ থেকে জানা যায় যে ,হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) তাঁর কোনো একজন স্ত্রীর কাছে একটি গোপন কথা বললে তিনি গোপনীয়তা ভঙ্গ করে তা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর অপর এক স্ত্রীর কাছে বলে দেন । এছাড়া তাঁর দুই স্ত্রী [যথাসম্ভব ঐ দু জনই অর্থাৎ যারা একজন আরেক জনের কাছে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর গোপন কথা বলে দিয়েছিলেন] রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর বিরুদ্ধে পরস্পরকে সাহায্য করতে তথা তাঁর বিরুদ্ধে কোনো একটি বিষয়ে চক্রান্ত করতে যাচ্ছিলেন । এ জন্য আল্লাহ্ তা আলা তাঁদেরকে কঠোর ভাষায় তিরস্কার করেন ও সতর্ক করে দেন এবং তাওবাহ্ করার জন্য নছ্বীহত্ করেন । 2

এরশাদ হয়েছে :

) وَإِذْ أَسَرَّ النَّبِيُّ إِلَى بَعْضِ أَزْوَاجِهِ حَدِيثًا فَلَمَّا نَبَّأَتْ بِهِ وَأَظْهَرَهُ اللَّهُ عَلَيْهِ عَرَّفَ بَعْضَهُ وَأَعْرَضَ عَنْ بَعْضٍ فَلَمَّا نَبَّأَهَا بِهِ قَالَتْ مَنْ أَنْبَأَكَ هَذَا قَالَ نَبَّأَنِيَ الْعَلِيمُ الْخَبِيرُ (

আর নবী যখন তাঁর স্ত্রীদের কারো কাছে কোনো একটি কথা গোপনে বললেন ,অতঃপর সে (অন্য কাউকে) তা জানিয়ে দিলো এবং আল্লাহ্ তাঁর [রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর] কাছে তা প্রকাশ করে দিলেন তখন তিনি (তাঁর ঐ স্ত্রীকে) তার কিছুটা জানালেন এবং কিছুটা জানালেন না । আর তিনি যখন তাকে তা জানালেন তখন সে বললো : কে আপনাকে এটি জানিয়েছে ?তিনি বললেন : পরম জ্ঞানী সর্বজ্ঞ (আল্লাহ্)ই আমাকে জানিয়েছেন । (সূরা আত্-তাহরীম : 3)

এতে কোনোই সন্দেহ নেই যে ,যে কোনো ঈমানদার কর্তৃক ,বিশেষ করে নবীর (সা.) একজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি কর্তৃক -যাকে তিনি বিশ্বাস করে কোনো গোপন কথা বলেছিলেন -তাঁর গোপন কথা অন্যের কাছে বলে দেয়া একটি গুরুতর বিষয় ছিলো । কিন্তু এখানেই শেষ নয় ।

আল্লাহ্ তা আলা এরপর এরশাদ করেছেন :

) إِنْ تَتُوبَا إِلَى اللَّهِ فَقَدْ صَغَتْ قُلُوبُكُمَا وَإِنْ تَظَاهَرَا عَلَيْهِ فَإِنَّ اللَّهَ هُوَ مَوْلَاهُ وَجِبْرِيلُ وَصَالِحُ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمَلَائِكَةُ بَعْدَ ذَلِكَ ظَهِيرٌ (

তোমাদের দু জনের অন্তর অন্যায়ের প্রতি ঝুঁকে পড়ার কারণে তোমরা যদি তাওবাহ্ করো (তো ভালো কথা) ,নচেৎ তোমরা দু জন যদি তাঁর (রাসূলের) বিরুদ্ধে পরস্পরকে সহায়তা করো (তথা তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করো) তাহলে (জেনে রেখো ,)অবশ্যই আল্লাহ্ই তাঁর অভিভাবক ,আর এছাড়াও জিবরাঈল ,উপযুক্ত মু মিনগণ ও ফেরেশতাগণ তাঁর সাহায্যকারী । (সূরা আত্-তাহরীম : 4)

পরবর্তী আয়াত থেকে মনে হয় যে ,তাঁদের দু জনের কাজটি এমনই গুরুতর ছিলো যে কারণে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর পক্ষ থেকে তাঁদেরকে তালাক্ব প্রদান করা হলেও অস্বাভাবিক হতো না । আর তাতে দ্বিবচনের পরিবর্তে স্ত্রীবাচক বহুবচন ব্যবহার থেকে মনে হয় যে ,রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর স্ত্রীগণের মধ্যে যারা এ চক্রান্তে অংশ নেন নি সম্ভবতঃ তাঁরাও বিষয়টি জানার পরে তাতে বাধা দেন নি বা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে সাথে সাথে অবগত করেন নি ,তাই এ শৈথিল্যের কারণে তাঁদেরকেও তালাক্ব দেয়া হলে তা-ও অস্বাভাবিক হতো না ।

এরশাদ হয়েছে :

) عَسَى رَبُّهُ إِنْ طَلَّقَكُنَّ أَنْ يُبْدِلَهُ أَزْوَاجًا خَيْرًا مِنْكُنَّ مُسْلِمَاتٍ مُؤْمِنَاتٍ قَانِتَاتٍ تَائِبَاتٍ عَابِدَاتٍ سَائِحَاتٍ ثَيِّبَاتٍ وَأَبْكَارًا (

তিনি (রাসূল) যদি তোমাদেরকে তালাক্ব প্রদান করেন তাহলে হয়তো তাঁর রব তোমাদের পরিবর্তে তাঁকে তোমাদের চেয়ে উত্তম অকুমারী ও কুমারী স্ত্রীবর্গ প্রদান করবেন যারা হবে ঈমানদার , (আল্লাহর কাছে) আত্মসমর্পিত ,আজ্ঞাবহ ,তাওবাহ্কারিনী , ইবাদত- কারিনী ও রোযা পালনকারিনী (বা আল্লাহর পথে পরিভ্রমণকারিনী) । (সূরা আত্-তাহরীম : 5)

এ আয়াতে এ ধরনের ইঙ্গিতও রয়েছে যে ,হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর ঐ সময় জীবিত বিবিগণের কারো মধ্যেই এতে উল্লিখিত সবগুলো গুণ-বৈশিষ্ট্য বাঞ্ছিত সর্বোচ্চ মাত্রায় ছিলো না ।

এ থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে ,হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর বিবিগণ মা ছুম্ ছিলেন না এবং তাঁরা আহলে বাইত-এর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না । কিন্তু এরপরও অনেকে ভাবাবেগের বশে কেবল আল্লাহর রাসূলের স্ত্রী হবার কারণে তাঁদেরকে পাপ ও ভুলের উর্ধে গণ্য করেন । তাঁদের এ ভুল ভেঙ্গে যাওয়ার জন্য কোরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতই যথেষ্ট হওয়া উচিত -যা হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর স্ত্রীগণের সমালোচনা ও তাঁদের উদ্দেশে উচ্চারিত হুমকির ধারাবাহিকতায় তাঁদেরকে সতর্ক করার লক্ষ্যে নাযিল হয়েছে :

) ضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا لِلَّذِينَ كَفَرُوا امْرَأَتَ نُوحٍ وَامْرَأَتَ لُوطٍ كَانَتَا تَحْتَ عَبْدَيْنِ مِنْ عِبَادِنَا صَالِحَيْنِ فَخَانَتَاهُمَا فَلَمْ يُغْنِيَا عَنْهُمَا مِنَ اللَّهِ شَيْئًا وَقِيلَ ادْخُلَا النَّارَ مَعَ الدَّاخِلِينَ (

যারা কাফের হয়েছে তাদের জন্য আল্লাহ্ নূহের স্ত্রী ও লূত্বের স্ত্রীর উপমা প্রদান করেছেন ;তারা দু জন আমার দু জন নেক বান্দাহর আওতায় (বিবাহাধীনে) ছিলো ,কিন্তু তারা উভয়ই তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো । ফলে তারা দু জন (নূহ্ ও লূত্ব) তাদের দু জনকে আল্লাহর (শাস্তি) থেকে রক্ষা করতে পারলো না ;আর তাদেরকে বলা হলো : (অন্যান্য) প্রবেশকারীদের সাথে দোযখে প্রবেশ করো । (সূরা আত্-তাহরীম্ : 10)

এছাড়াও আল্লাহ্ তা আলা কোরআন মজীদে বিশেষভাবে উম্মাহাতুল্ মু মিনীনকে সম্বোধন করে বলেছেন : ( وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ ) - আর তোমরা তোমাদের গৃহে অবস্থান কর । (সূরা আল্-আহযাব্ : 33) কিন্তু তা সত্ত্বেও সর্বসম্মত ও মশহুর ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী তাঁদের একজন আল্লাহ্ তা আলার এ বিশেষ আদেশ অমান্য করে বৈধ খলীফাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং রণাঙ্গনে গিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান করেন যার পরিণতিতে হাজার হাজার মুসলমানের প্রাণহানি ঘটে । এ থেকেও প্রমাণিত হয় যে ,উম্মাহাতুল্ মু মিনীন্ মা ছুম্ ছিলেন না এবং আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না ।


3

4

5

6

7

8

9

10

11

12