রক্তধারার পবিত্রতা
:
একটি বিভ্রান্তির নিরসন
ইতিপুর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে
,কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে (সূরা আলে ইমরান : ৩৩-৩৪) নবী-রাসূলগণ (আ.)
ذُرِّیَّةً بعضها من بعضٍ
(কতক অপর কতকের বংশধর)
।
এ আয়াতাংশ থেকে এটা সুস্পষ্ট যে
,কোনো নবী-রাসূলের (আ.) (তেমনি আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত যে কোনো নিষ্পাপ ইমামের) পূর্বতন রক্তধারায় কখনোই শিরক ও গুনাহের সংমিশ্রণ ঘটে নি
।
যদিও
ذُرِّیَّةً بعضها من بعضٍ
বলতে কেবল একে অপরের অব্যবহিত বংশধরই বুঝায় না
,বরং মধ্যবর্তী স্তরে এক বা একাধিক অ-নবী সহ পরবর্তী বংশধরও বুঝায়
,কিন্তু এ মধ্যবর্তী স্তরগুলোতে যদি শিরক ও গুনাহের সংমিশ্রণ ঘটে তাহলে পরবর্তী স্তরের নবীকে (এবং সেই সাথে আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত নবীর গুণাবলী সম্পন্ন নিষ্পাপ ইমামকে) পূর্ববর্তী নবীর বংশধর বুঝাতে
ذُرِّیَّةً بعضها من بعضٍ
-এর উল্লেখ অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়
।
কারণ
,সে ক্ষেত্রে কথাটি দাঁড়ায় আল্লাহর নবী হযরত আদম (আ.)-এর বংশধর হিসেবে নমরূদ ও ফিরআউন সহ সমস্ত মানুষকে নবীর বংশধর বলে উল্লেখ করার অনুরূপ - যার উল্লেখ অর্থহীন বৈ নয়
।
আর আল্লাহ্ তা
‘
আলা যে কোনো ধরনের অর্থহীন কথা ও কাজ থেকে প্রমুক্ত
।
অতএব
,সন্দেহ নেই যে
,এটি আল্লাহ্ তা
‘
আলার একটি নীতি যে
,তিনি যে কোনো নবী- রাসূলকেই (এবং তাঁর পক্ষ থেকে মনোনীত নবীর গুণাবলী সম্পন্ন নিষ্পাপ ইমামকে) এমন রক্তধারায় পাঠিয়েছেন যাতে কখনোই শিরক বা গুনাহের সংমিশ্রণ ঘটে নি
।
কিন্তু হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর পিতৃপরিচয় সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার কারণে অনেকেই এটিকে আল্লাহ্ তা
‘
আলার একটি নীতি হিসেবে গণ্য করতে প্রস্তুত নন
।
যদিও এ বিষয়টি নবী-রাসূলগণের (আ.) পাপমুক্ততা (
عصمة الانبیاء
) সম্পর্কিত আলোচনায় বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা সর্বোত্তম এবং অত্র গ্রন্থকারের রচনাধীন গ্রন্থ নবী-রাসূলগণের (আ.) পাপমুক্ততা-য় এ সম্পর্কে অপেক্ষাকৃত বিস্তারিত আলোচনা করা হবে
,তবে আলোচ্য পুস্তকের বিষয়বস্তুর সাথে প্রাসঙ্গিক বিধায় এখানেও আমরা সংক্ষেপে বিষয়টির ওপর আলোকপাত করছি
।
কোরআন মজীদের সূরা আল্-আন্আমের ৭৪ নং আয়াতে হযরত ইব্রাহীম (আ.) কর্তৃক আযর ও তার সম্প্রদায়ের মূর্তি পূজার সমালোচনার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে
ابیه آزر
(তার
“
আব্
”
আযার) উল্লেখ করা হয়েছে এবং এ থেকেই আযর-কে হযরত ইব্রাহীম্ (আ.)-এর
‘
জন্মদাতা পিতা
’
বলে গণ্য করা হয়েছে
।
কিন্তু প্রকৃত পক্ষে উক্ত আয়াতের ভিত্তিতে এটা নিশ্চিতরূপে ধরে নেয়া সম্ভব নয় যে
,আযর তাঁর জন্মদাতা পিতা ছিলো
।
কারণ
,আরবী ভাষায়
“
আব্
”
(বাক্যমধ্যে ভূমিকাভেদে
ابو/ابی/ابا
) শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক যা দ্বারা জন্মদাতা পিতা ছাড়াও দাদা
,চাচা
,পালক পিতা ও বিপিতাকে এবং দাদার পূর্ববর্তী যে কোনো পূর্বপুরুষকেও বুঝানো হয়
।
কিন্তু শুধু জন্মদাতা পিতা বুঝানো উদ্দেশ্য হলে
“
ওয়ালেদ
”
(ولاد
)বলা হয়
।
এমতাবস্থায় কয়েকটি কারণে উক্ত আয়াতে আযরকে হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর জন্মদাতা পিতা বুঝানো হয়েছে বলে মনে করা যায় না
।
তা হচ্ছে :
১) আল্লাহ্ তা
‘
আলা জানতেন যে
,এ বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে
,এমতাবস্থায় জন্মদাতা পিতা বুঝানো উদ্দেশ্য হলে
ابیه
না বলে
والده
বললে বিভ্রান্তির কোনোই অবকাশ থাকতো না
।
অথবা শুধু
ابیه
বলা হতো
,আযরের নামোল্লেখ করার প্রয়োজন ছিলো না
।
কারণ
,যেহেতু শব্দটির প্রথম অর্থ
‘
জন্মদাতা পিতা
’
সেহেতু এর সাথে অন্য অর্থজ্ঞাপক নিদর্শন না থাকলে এ থেকে
‘
জন্মদাতা পিতা
’
ছাড়া অন্য অর্থ গ্রহণের কোনোই কারণ থাকতো না
।
এমতাবস্থায় নিদর্শন জুড়ে দেয়া অর্থাৎ আযরের নামোল্লেখ থেকে সুস্পষ্ট যে
,এখানে শব্দটিকে এর প্রথম অর্থে ব্যবহার করা হয় নি
,বরং বুঝানো হয়েছে যে
,এখানে
ابیه
বলতে তাঁর জন্মদাতাকে বুঝানো হয় নি
,বরং আযরকে (যে সম্ভবতঃ তাঁর পালক পিতা ছিলো) বুঝানো হয়েছে
।
২) বিদ্যমান তাওরাতে হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর জন্মদাতা পিতার নাম
‘
তেরহ্
’
বা
‘
তারেহ্
’
বলে উল্লেখ করা হয়েছে
।
এমতাবস্থায় কোরআন মজীদে তাঁর জন্মদাতা পিতার নাম
“
আযর
”
বলে উল্লেখ করা হলে তৎকালীন ইয়াহূদী ও খৃস্টান পণ্ডিতরা এর বিরুদ্ধে আপত্তি জানাতো ও এর ভিত্তিতে দাবী করতো যে
,কোরআন আল্লাহর কালাম নয় বলেই এতে ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে এবং এ নিয়ে তারা ব্যাপক প্রচার চালাতো
।
কিন্তু এ ধরনের প্রতিবাদ ও দাবীর কথা জানা যায় না
।
এ থেকে বুঝা যায় যে
,তৎকালীন ইয়াহূদী ও খৃস্টান পণ্ডিতরা
ابیها
থেকে
‘
তার জন্মদাতা পিতা
’
অর্থ গ্রহণ করে নি
।
৩) হযরত ইব্রাহীম (আ.) তাঁর নম্রহৃদয় বৈশিষ্ট্যের কারণে আযরের জন্য আল্লাহ্ তা
‘
আলার কাছে মাগফেরাত কামনা করতেন
,কিন্তু তাঁর কাছে যখন অকাট্যভাবে সুস্পষ্ট হয়ে গেলো যে
,সে আল্লাহর শত্রু তখন তিনি তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলেন (এবং তার জন্য মাগফেরাত কামনা বন্ধ করে দিলেন)
।
(সূরা আত্-তাওবাহ্ : ১১৪)
।
এটা কখনকার ঘটনা কোরআন মজীদে তা উল্লেখ করা হয় নি (উল্লেখের প্রয়োজনও ছিলো না)
,তবে এটা নিঃসন্দেহে ধরে নেয়া যায় যে
,হযরত ইব্রাহীম (আ.) অগ্নিকুণ্ড থেকে নিরাপদে বেরিয়ে এসে ফিলিস্তিনে হিজরতের আগেই তাঁর কাছে সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে
,আযরের ঈমান আনার আর কোনোই সম্ভাবনা নেই
।
এ কারণে তিনি তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং তার জন্য মাগফেরাত কামনা বন্ধ করে দেন (সূরা আত্-তাওবাহ্ : ১১৪)
।
কিন্তু আমরা দেখতে পাই যে
,হিজরতের বহু বছর পরে তরুণ হযরত ইসমাঈল (আ.) কে মক্কায় আল্লাহর ঘরের পাশে রেখে আসার (সূরা ইব্রাহীম : ৩৭) সময় - যার আগেই হযরত ইসহাক (আ.)-এর জন্ম হয়েছে ও তিনি [ইব্রাহীম (আ.)] বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন (সূরা ইব্রাহীম : ৩৯) (যখন তাঁর বয়স একশ
’
বছর পেরিয়ে গেছে)
,তখন তিনি তাঁর পিতা-মাতার (
والدی
) মাগফেরাতের জন্য আল্লাহ্ তা
‘
আলার কাছে দো
‘
আ করেন (সূরা ইব্রাহীম্ : ৪১)
।
এ থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে
,আযর তাঁর জন্মদাতা পিতা ছিলো না
।
এ উপসংহার থেকে আরো একটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে
,যেহেতু হযরত আলী (আ.)-এর আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার
,উম্মাতে মুহাম্মাদীর মধ্যে শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি হওয়ার
,দ্বীনী নেতৃত্ব ও শাসন-কর্তৃত্বের জন্য উপযুক্ততম ব্যক্তি হওয়ার এবং নবী না হয়েও পাপমুক্ততা সহ নবী-রাসূলগণের (আ.) গুণাবলী সম্পন্ন হওয়ার বিষয়টি অকাট্যভাবে প্রমাণিত সেহেতু তাঁর পিতৃপুরুষদের রক্তধারায় কখনো শিরক ও গুনাহের সংমিশ্রণ ঘটে নি
।
অতএব
,তাঁর পিতা হযরত আবু তালিবের মুশরিক হওয়ার ও ইসলাম গ্রহণ না করার দাবী চরম রাজনৈতিক মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই ছিলো না
।
বরং হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর পিতা আবদুল্লাহ্ ও দাদা আবদুল মুত্তালিবের ন্যায় তাঁর চাচা ও হযরত আলী (আ.)-এর পিতা হযরত আবু তালিব-ও শিরক ও গুনাহ্ থেকে মুক্ত তাওহীদবাদী ছিলেন
,আর নবী করীম (সা.) কর্তৃক ইসলাম প্রচারের সূচনাতেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন
।
এ কারণেই তিনি তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নবী করীম (সা.)কে সর্বাত্মকভাবে সাহায্য করেছিলেন
।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় যে
,হযরত আবু তালিব কর্তৃক নবী করীম (সা.) কে আশ্রয়
,পৃষ্ঠপোষকতা ও সর্বাত্মক সাহায্য- সহযোগিতা প্রদানের বিষয়টি ইসলামের ইতিহাসের একটি বিতর্কাতীত বিষয় যে ব্যাপারে ইসলামের সকল মাযহাব ও ফির্কাহর মধ্যে ইজমা রয়েছে
।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে
,এটা কি সম্ভব যে
,নবীকুল শিরোমণি হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ লাভের পরেও বছরের পর বছর ধরে একজন মুশরিকের আশ্রয়ে থাকবেন এবং তার কাছ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা গ্রহণ করবেন
?এরূপ হলে তা কি ইসলামের জন্য একটি লজ্জাজনক ও অপমানজনক বিষয় হতো না
?এমনকি স্বয়ং আল্লাহ্ তা
‘
আলার জন্যও কি তাঁর শ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূলকে এরূপ লজ্জাজনক ও অপমানজনক অবস্থায় রেখে দেয়া সম্ভব
?অতএব
,হযরত আবু তালিব মুশরিক ছিলেন বলে যে দাবী করা হয়েছে তা যে স্রেফ রাজনৈতিক মিথ্যাচার ছিলো এ ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ নেই
।