ভূমিকা
‘
ইসলাম ও শীয়া মাযহাব’
নামক এ গ্রন্থে ইসলামের দু’
টি বৃহৎ উপদলের (শীয়া ও সুন্নী) অন্যতম শীয়া মাযহাবের প্রকৃত পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে । শীয়া মাযহাবের উৎপত্তি , বিকাশ ও চিন্তাধারার প্রকৃতি এবং ইসলামী জ্ঞানের ব্যাপারে শীয়া মাযহাবের দৃষ্টিভঙ্গী এ বইয়ে আলোচিত হয়েছে ।
ধর্ম :
এখানে কোন সন্দেহ নেই যে , মানুষ তার স্বজাতীয় লোকদের সাথে সমাজবদ্ধ হয়ে একসংগে জীবন যাপন করে । মানুষ তার জীবনে সামাজিক পরিবেশে যে সব কাজ করে , সে সকল কাজ পরস্পর সম্পর্কহীন নয় । যেমনঃ মানুষের খাওয়া , পড়া , পান করা , চলা , ঘুমানো , জাগ্রত হওয়া , পরস্পরের সাথে মেলা মেশা ইত্যাদি কাজ বাহ্যতঃ পরস্পর সম্পর্কহীন বলে মনে হলেও প্রকৃত পক্ষে এগুলো সম্পূর্ণ রূপে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত । যে কোন কাজই ইচ্ছেমত যত্র-তত্র ও যখন ইচ্ছে তখন করা যায় না । বরঞ্চ যে কোন কাজের জন্যেই একটি নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন রয়েছে । তাই মানুষ তার জীবনের প্রয়োজনীয় কাজ-কর্মগুলো সুনির্দিষ্ট একটি নিয়মতান্ত্রিকতার অধীনে সম্পন্ন করে , যা কখনই ঐ নিয়ম থেকে বিচ্যুত হয় না । আর মানব জীবনে সম্পাদিত সকল কাজের উদ্দেশ্যই বিশেষ একটি বিন্দু থেকে উৎসারিত । আর সেই কেন্দ্র বিন্দুটি হল , মানব জীবনের সাফল্য ও সৌভাগ্র লাভের আকাংখা , অর্থাৎ মানুষ তার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্যে তার অভাব ও প্রয়োজন গুলোকে যথাসম্ভব পূর্ণ করার আকাংখা পোষণ করে ।
এ কারণেই মানুষ তার জীবনের সকল কাজকর্মকে তার স্বরচিত নিজের ইচ্ছেমত রচিত আইন বা অন্যের কাছ থেকে গৃহীত আইনের সাথে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করে । এ ভাবে সে আপন জীবন যাপনের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ জীবন পদ্ধতির অনুসরণ করে । তাই জীবন যাপনের স্বার্থে সে প্রয়োজনীয় জীবন উপ্রকরণ সংগ্রহের জন্যে আত্মনিয়োগ করে । কেননা , সে বিশ্বাস করে জীবন উপ্রকরণ সংগ্রহ জীবন যাপনের জন্যে প্রয়োজনীয় একটি বিধান । সে রসনার তৃস্তি সাধান এবং ক্ষুধা ও তৃষ্ণা নিবারণের জন্যে খাদ্য ও পানি পান করে থাকে । কেননা , সে সৌভাগ্যপূর্ণভাবে বেচে থাকার জন্যে খাওয়া ও পান করাকে সে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে মনে করে । ঠিক এভাবেই সে প্রতিটি ক্ষেত্রে সাফল্যের লক্ষ্যে পূর্বনির্ধারিত কিছু নিয়ম মেনে চলে ।
মানব জীবনের উপর প্রভুত্ব বিস্তারকারী উল্লিখিত বিধি বিধানের ভিত্তিমূল একটি বিশেষ মৌলিক বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত । আর তার উপরই মানব জীবন নির্ভরশীল ।
মানুষ এই সৃষ্টি জগতেরই একটি অংশ বিশেষ এবং সমগ্র সৃষ্টি জগতের অস্তিত্বের মূলরহস্য সম্পর্কে প্রতিটি মানুষেরই একটি সুনির্দিষ্ট ধারণা বা বিশ্বাস রয়েছে । সৃষ্টি জগতের রহস্য সম্পর্কে মানুষের চিন্তা-ভাবনা বা ধারণার প্রকৃতি কেমন হতে পারে , একটু চিন্তা করলেই তা আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে । যেমন-যারা এ সৃষ্টি জগতর্ক শুধুমাত্র জড় বা বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে এবং মানুষকেও সস্পূর্ণরূপে (100%) জড় অস্তিত্ব (জন্মের মাধ্যমে জীবনের সূচনা এবং মৃত্যুর মাধ্যমে তার ধ্বংস) বলে বিশ্বাস করে , তাদের অনুসৃত জীবন পদ্ধতিও জড়বাদের উপর ভিত্তি করেই রচিত । অর্থাৎ স্বল্পকালীন এ পার্থিব জীবনের স্বাদ উপভোগই তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আর এ জন্যেই সমগ্র বিশ্বজগৎ ও প্রকৃত্রিক বশে আনার জন্যে তারা তাদের জীবনের সকল প্রচেষ্টা ও সাধানা বিনিয়োগ করে ।
আবার অনেকেই (মূর্তি উপাসকরা) এ বিশ্ব জগৎ ও প্রকৃত্রিক তার চেয়ে উচ্চতর ও মহান এক অস্তিত্বের (আল্লাহ) সৃষ্টিকর্ম বলে বিশ্বাস করে । তারা বিশ্বাস করে মহান আল্লাহ মানুষকে তার অসংখ্য অনুগ্রহ মূলক দান ও নেয়ামতের মাঝে নিমজ্জিত রেখেছেন , যাতে মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত অসীম অনুগ্রহ উপভোগ করে উপকৃত হতে পারে । সৃষ্টি জগতের অস্তিত্বের রহস্য সম্পর্কে এ ধরণের বিশ্বাসের অধিকারী ব্যক্তিগণ এমন এক জীবন পদ্ধতির অনুসরণ করেন , যার মাধ্যমে সর্বস্রষ্টা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা এবং তার ক্রোধ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় । কেননা , যদি তারা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে সমর্থ হন , তাহলে তিনি তাদের প্রতি তার অনুগ্রহের পরিমাণ বাড়িয়ে দিবেন এবং তাদেরকে অসীম ও চিরন্তন অনুগ্রহ বা নেয়ামতের অধিকারীও করবেন । আর মানুষ যদি তার কৃতকর্মের মাধ্যমে মহান স্রষ্টার ক্রোধের সঞ্চার করে , তাহলে তারা আল্লাহ প্রদত্ত অনুগ্রহ বা নেয়ামত থেকে বঞ্চিত হবে ।
অন্য দিকে যারা শুধুমাত্র আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ছাড়াও মানুষের জন্যে এক অনন্ত জীবনে বিশ্বাসী , এবং মানুষকে তার পার্থিব জীবনের কৃত সকল ভাল ও মন্দ কাজের জন্যে দায়ী বলে বিশ্বাস করে । ফলে তারা কেয়ামত দিনের প্রতিও বিশ্বাসী , যে দিন মানুষকে তার ভাল মন্দ সব কাজের জবাবদিহি করতে হবে এবং ভাল কাজের জন্যে পুরস্কৃত করা হবে ; এই কেয়ামতের দিনকে ইহুদী , খৃষ্টান , মাজুসী এবং মুসলমানরা ও বিশ্বাস করে । এ ধরণের বিশ্বাসের অধিকারী ব্যক্তিরা এমন এক জীবন পদ্ধতির অনুসরণ করে যা ঐ মৌলিক বিশ্বাসের সাথে সামঞ্জশ্যপূর্ণ এবং মানুষের ইহকাল ও পরকালীন উভয় জীবনেই সৌভাগ্যবান হওয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করে । এ বিশ্ব জগতের সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কিত মৌলিক বিশ্বাসসমূহ এবং তার ভিত্তিতে রচিত অনুকরণীয় জীবন পদ্ধতির নীতিমালা সমষ্টির অপর নামই‘
দ্বীন’
।‘
দ্বীনের’
মধ্যে সৃষ্ট শাখা সমূহকে‘
মাযহাব’
বলা হয় । উদাহরণ স্বরূপ যেমন : আহলুস সুন্নাহ ও আহলুস তাশাইয়ূ ইসলামের অন্যতম দু’
টি মাযহাব এবং খৃষ্টান ধর্মের মালেকানী ও নাসতুরী মাযহাবদ্বয় ।
ইতিপূর্বের আলোচনা থেকে সুস্পষ্টভাবে বলা যায় যে , মানুষ দ্বীনের (এক শ্রেণীর মৌলিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে রচিত জীবন পদ্ধতি) প্রতি নির্ভরশীলতা থেকে (যদি সে আল্লাহতে বিশ্বাসী নাও হয়) আদৌ মুক্ত নয় । সুতরাং‘
দ্বীন’
মানুষের জন্যে প্রয়োজনীয় এমন এক জীবন পদ্ধতি , যা মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ স্বরূপ । পবিত্র কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী‘
দ্বীন’
কে এড়িয়ে যাওয়া মানুষের জন্যে অসম্ভব । এটা এমন এক পথ যা স্বয়ং মহান আল্লাহ মানব জাতির প্রতি প্রসারিত করেছেন এবং মহান আল্লাহতে গিয়েই এ পথের পরিসমাপ্তি ঘটেছে । অর্থাৎ সত্য‘
দ্বীন’
(ইসলাম) গ্রহণের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে মানুষ আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথেই ধাবিত হয় । আর যারা সত্য‘
দ্বীন’
কে গ্রহণ করেনি প্রকৃতপক্ষে তারা ভ্রান্ত পথই অনুসরণ করেছে এবং পথভ্রষ্ট হয়েছে ।
ইসলাম :
আত্মসমর্পণ ও মাথানত করাই‘
ইসলাম’
শব্দের আভিধানিক অর্থ । পবিত্র কুরআনে যে‘
দ্বীন’
অনুসরণের প্রতি মানব জাতিকে আহবান্ করা হয়েছে , তা হচ্ছে‘
ইসলাম’
। ইসলাম নাম করণের মূল কারণ হচ্ছে , সমগ্র বিশ্ববাসী একমাত্র মহান আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমপণ করবে । এই আত্মসমর্পণের ফলশ্রুতিতে সে এক আল্লাহর নির্দেশ ব্যতীত অন্য কারো নির্দেশের আনুগত্য করবে না এবং একমাত্র তারই উপাসনা ব্যতীত অন্য কারো উপাসনা করবে না । আর এটাই হল ইসলামের মূল কর্মসূচী ।
পবিত্র কুরআনের বক্তব্য অনুযায়ী সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি এই‘
দ্বীন’
কে ইসলাম’
ও এর অনুসারীদেরকে‘
মুসলমান’
হিসেবে নাম করণ করেন , তিনি হলেন হযরত ইব্রাহীম (আ.) ।
শীয়া:‘
শীয়া’
শব্দের আভিধানিক অর্থ হল অনুসারী । যারা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পরিবারকে তার প্রকৃত ও একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে গণ্য করেন , তারাই‘
শীয়া’
নামে পরিচিত । তারা ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পবিত্র আহলে বাইত (আ.)-এর আদর্শের অনুসারী ।