ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব 0%

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

লেখক: আল্লামা সাইয়্যেদ মুহাম্মদ হুসাইন তাবাতাবাঈ
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 40547
ডাউনলোড: 5460

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 31 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 40547 / ডাউনলোড: 5460
সাইজ সাইজ সাইজ
ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

‘ইসলাম ও শীয়া মাযহাব’ নামক এ গ্রন্থে ইসলামের দু’টি বৃহৎ উপদলের (শীয়া ও সুন্নী) অন্যতম শীয়া মাযহাবের প্রকৃত পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে । শীয়া মাযহাবের উৎপত্তি, বিকাশ ও চিন্তাধারার প্রকৃতি এবং ইসলামী জ্ঞানের ব্যাপারে শীয়া মাযহাবের দৃষ্টিভঙ্গী এ বইয়ে আলোচিত হয়েছে ।

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

আল্লামা সাইয়্যেদ মুহাম্মদ হুসাইন তাবাতাবাঈ

এই বইটি আল হাসানাইন (আ.) ওয়েব সাইট কর্তৃক আপলোড করা হয়েছে ।

http://alhassanain.org/bengali

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

লেখক পরিচিতি

আল্লামা মুহাম্মদ হুসাইন তাবাতাবাঈ একটি অতীব সম্ভ্রান্ত আলেম পরিবারের জন্ম গ্রহণ করেন । যে পরিবারের চৌদ্দ পুরুষ বংশ পরস্পরায় তাব্রীজের আলেম হিসাবে প্রখ্যাত ছিলেন । তিনি হিজরী 1321 সনের 29 শে জিলক্বদ জন্ম গ্রহণ করেন । প্রাথমিক শিক্ষা তিনি নিজের এলাকাতেই অর্জন করেন । অতঃপর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর তিনি হিজরী 1344 সনে ইরাকের নাজাফে আশরাফ নামক শহরে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনে যান । শীয়াদের সর্ব বৃহৎ এই জ্ঞান কেন্দ্রে তিনি ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পরিপূর্ণরূপে জ্ঞান অর্জনে মশগুল হন । তিনি ফিকহ্ ও উসুল শাস্ত্রদ্বয়কে আয়াতুল্লাহ শায়খ মুহাম্মদ হুসাইন নায়েনী ও আয়াতুল্লাহ শায়খ মুহাম্মদ হুসাইন গারাবী ইস্পাহানী কোম্পানী নামক প্রসিদ্ধ শিক্ষকদ্বয়ের নিকট এবং দর্শন শাস্ত্র আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ হুসাইন বদকুবী ও গণিতশাস্ত্র আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আবুল কাসিম খুনসারী নামক প্রসিদ্ধ শিক্ষকের নিকট থেকে শিক্ষা লাভ করেন । অন্যদিকে আধ্যাত্ম বা নিজেকে নৈতিক ভাবে গড়ে তোলার জন্যে হাজী মির্জা আলী কাজীর শিষ্যত্ব বরণ করেন । এই মহান ব্যক্তি প্রজ্ঞাশাস্ত্রের তত্ত্বগত ও ব্যবহারিক শাখায় উচ্চ পর্যায়ের মানুষ ছিলেন ।

উল্লেক্ষ্য যে ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহঃ) ও আত্মগঠনের ক্ষেত্রে জনাব কাজী (রহঃ)-এর শিষ্যত্ব বরণ করেছিলেন । অতঃপর তিনি হিজরী 1354 সনে নিজের জন্ম স্থান তাব্রিজে ফিরে আসেন । আল্লামা তাবাতাবাঈর শিক্ষা কেবল মাত্র ফেকাহ্ শাস্ত্রের সাধারণ পর্যায়েই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং তিনি আরবী ব্যাকারণ , অলংকার শাস্ত্র ও সাহিত্যে এবং ফেকহ্ ও উসুল শাস্ত্রে গভীর ভাবে জ্ঞান অর্জন করেন । একই ভাবে তিনি প্রাচীন গণিত ইউক্লিডের মুলনীতি থেকে টলেমীর লেখা জ্যোর্তি বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ (The Almagest ) টলেমী পদ্ধতি পর্যন্ত অধ্যয়ন করেছেন । অন্য দিকে তাফসীর , দর্শন শাস্ত্র , তর্কবিদ্যা ও ইরফান শাস্ত্রে এত গভীর ভাবে জ্ঞান অর্জন করেন যে , ইজতিহাদের পর্যায়ে উপনীত হন ।

জনাব আল্লামা হিজরী 1365 সনে আপন জন্মভূমি ত্যাগ করে কোমে এসে অবস্থান নেন । কোমে তিনি নীরবে কোন হৈ চৈ ছাড়াই তাফসীর ও দর্শনের ক্লাশ নেয়া শুরু করেন । এ সময়ে তিনি তেহরান সহ আরো বিভিন্ন অঞ্চলের দর্শন বা ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানপ্রিয় লোকদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন । যাদের মধ্যে অবশ্যই ওস্তাদ হেনরী কার্বনের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য । জনাব আল্লামা কয়েক বছর যাবৎ জ্ঞানী-গুনী-পণ্ডিত ও ছাত্রদের উপস্থিতিতে হেনরী কার্বনের সাথে বৈঠক অব্যাহত রাখেন । উক্ত আলোচনায় ধর্ম , দর্শন ও আধুনিক বিশ্বের প্রেক্ষাপটে একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তি ও বাস্তবতা অনুসন্ধানীর করণীয় দায়িত্ব সম্পর্কে অতিগুরুত্ব পূর্ণ বিষয় উপস্থাপন করা হত । ঐ জাতীয় উচ্চ মার্গীয় উন্মুক্ত চিন্তার আলোচনা বর্তমান মুসলিম বিশ্বে অতি বিরল । এই আলোচনা সমষ্টি পরবর্তীতে দু খণ্ডে গন্থাকারে প্রকাশ করা হয় । কোমের ধর্মীয় শিক্ষা কেন্দ্র আল্লামার সবচেয়ে বড় অবদান হল বুদ্ধিবৃত্তিক ও কুরআনের তাফসীর সংক্রান্ত জ্ঞান চর্চায় পুনরুজ্জীবন সঞ্চার করা । তারই একান্ত প্রচেষ্টায় দর্শন শাস্ত্রের মৌলিক ও সর্বোচ্চ পর্যায়ের গ্রন্থ আশ্ শাফা আসফার এই গন্থদ্বয়ের শিক্ষার প্রসার ঘটে ।

আল্লামার বিশ্বাস ও আচার-আচারণ ছিল অতীব আকর্ষনীয় , একজন পরিশুদ্ধ মানবের ন্যায় । তাই জ্ঞান প্রিয় ব্যক্তিরা অতি সহজে তার আলোচনা সভার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়তেন । আল্লামা বিশ্বাস করতেন জ্ঞান অর্জনের সাথে সাথে আত্মশুদ্ধি ও নৈতিক গঠন একান্ত প্রয়োজন । এ জন্যেই তিনি আপন ছাত্রদের আত্মশুদ্ধি ও চরিত্র গঠনের ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করতেন । প্রকৃতপক্ষে নৈতিকতা ও জ্ঞানের সমন্বয়ে ব্যক্তি গঠনের এক সুনিপুন আদর্শ তিনি প্রতিষ্ঠা করেন।

ভূমিকা

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব নামক এ গ্রন্থে ইসলামের দু টি বৃহৎ উপদলের (শীয়া ও সুন্নী) অন্যতম শীয়া মাযহাবের প্রকৃত পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে । শীয়া মাযহাবের উৎপত্তি , বিকাশ ও চিন্তাধারার প্রকৃতি এবং ইসলামী জ্ঞানের ব্যাপারে শীয়া মাযহাবের দৃষ্টিভঙ্গী এ বইয়ে আলোচিত হয়েছে ।

ধর্ম : এখানে কোন সন্দেহ নেই যে , মানুষ তার স্বজাতীয় লোকদের সাথে সমাজবদ্ধ হয়ে একসংগে জীবন যাপন করে । মানুষ তার জীবনে সামাজিক পরিবেশে যে সব কাজ করে , সে সকল কাজ পরস্পর সম্পর্কহীন নয় । যেমনঃ মানুষের খাওয়া , পড়া , পান করা , চলা , ঘুমানো , জাগ্রত হওয়া , পরস্পরের সাথে মেলা মেশা ইত্যাদি কাজ বাহ্যতঃ পরস্পর সম্পর্কহীন বলে মনে হলেও প্রকৃত পক্ষে এগুলো সম্পূর্ণ রূপে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত । যে কোন কাজই ইচ্ছেমত যত্র-তত্র ও যখন ইচ্ছে তখন করা যায় না । বরঞ্চ যে কোন কাজের জন্যেই একটি নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন রয়েছে । তাই মানুষ তার জীবনের প্রয়োজনীয় কাজ-কর্মগুলো সুনির্দিষ্ট একটি নিয়মতান্ত্রিকতার অধীনে সম্পন্ন করে , যা কখনই ঐ নিয়ম থেকে বিচ্যুত হয় না । আর মানব জীবনে সম্পাদিত সকল কাজের উদ্দেশ্যই বিশেষ একটি বিন্দু থেকে উৎসারিত । আর সেই কেন্দ্র বিন্দুটি হল , মানব জীবনের সাফল্য ও সৌভাগ্র লাভের আকাংখা , অর্থাৎ মানুষ তার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্যে তার অভাব ও প্রয়োজন গুলোকে যথাসম্ভব পূর্ণ করার আকাংখা পোষণ করে ।

এ কারণেই মানুষ তার জীবনের সকল কাজকর্মকে তার স্বরচিত নিজের ইচ্ছেমত রচিত আইন বা অন্যের কাছ থেকে গৃহীত আইনের সাথে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করে । এ ভাবে সে আপন জীবন যাপনের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ জীবন পদ্ধতির অনুসরণ করে । তাই জীবন যাপনের স্বার্থে সে প্রয়োজনীয় জীবন উপ্রকরণ সংগ্রহের জন্যে আত্মনিয়োগ করে । কেননা , সে বিশ্বাস করে জীবন উপ্রকরণ সংগ্রহ জীবন যাপনের জন্যে প্রয়োজনীয় একটি বিধান । সে রসনার তৃস্তি সাধান এবং ক্ষুধা ও তৃষ্ণা নিবারণের জন্যে খাদ্য ও পানি পান করে থাকে । কেননা , সে সৌভাগ্যপূর্ণভাবে বেচে থাকার জন্যে খাওয়া ও পান করাকে সে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে মনে করে । ঠিক এভাবেই সে প্রতিটি ক্ষেত্রে সাফল্যের লক্ষ্যে পূর্বনির্ধারিত কিছু নিয়ম মেনে চলে ।

মানব জীবনের উপর প্রভুত্ব বিস্তারকারী উল্লিখিত বিধি বিধানের ভিত্তিমূল একটি বিশেষ মৌলিক বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত । আর তার উপরই মানব জীবন নির্ভরশীল ।

মানুষ এই সৃষ্টি জগতেরই একটি অংশ বিশেষ এবং সমগ্র সৃষ্টি জগতের অস্তিত্বের মূলরহস্য সম্পর্কে প্রতিটি মানুষেরই একটি সুনির্দিষ্ট ধারণা বা বিশ্বাস রয়েছে । সৃষ্টি জগতের রহস্য সম্পর্কে মানুষের চিন্তা-ভাবনা বা ধারণার প্রকৃতি কেমন হতে পারে , একটু চিন্তা করলেই তা আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে । যেমন-যারা এ সৃষ্টি জগতর্ক শুধুমাত্র জড় বা বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে এবং মানুষকেও সস্পূর্ণরূপে (100%) জড় অস্তিত্ব (জন্মের মাধ্যমে জীবনের সূচনা এবং মৃত্যুর মাধ্যমে তার ধ্বংস) বলে বিশ্বাস করে , তাদের অনুসৃত জীবন পদ্ধতিও জড়বাদের উপর ভিত্তি করেই রচিত । অর্থাৎ স্বল্পকালীন এ পার্থিব জীবনের স্বাদ উপভোগই তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আর এ জন্যেই সমগ্র বিশ্বজগৎ ও প্রকৃত্রিক বশে আনার জন্যে তারা তাদের জীবনের সকল প্রচেষ্টা ও সাধানা বিনিয়োগ করে ।

আবার অনেকেই (মূর্তি উপাসকরা) এ বিশ্ব জগৎ ও প্রকৃত্রিক তার চেয়ে উচ্চতর ও মহান এক অস্তিত্বের (আল্লাহ) সৃষ্টিকর্ম বলে বিশ্বাস করে । তারা বিশ্বাস করে মহান আল্লাহ মানুষকে তার অসংখ্য অনুগ্রহ মূলক দান ও নেয়ামতের মাঝে নিমজ্জিত রেখেছেন , যাতে মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত অসীম অনুগ্রহ উপভোগ করে উপকৃত হতে পারে । সৃষ্টি জগতের অস্তিত্বের রহস্য সম্পর্কে এ ধরণের বিশ্বাসের অধিকারী ব্যক্তিগণ এমন এক জীবন পদ্ধতির অনুসরণ করেন , যার মাধ্যমে সর্বস্রষ্টা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা এবং তার ক্রোধ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় । কেননা , যদি তারা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে সমর্থ হন , তাহলে তিনি তাদের প্রতি তার অনুগ্রহের পরিমাণ বাড়িয়ে দিবেন এবং তাদেরকে অসীম ও চিরন্তন অনুগ্রহ বা নেয়ামতের অধিকারীও করবেন । আর মানুষ যদি তার কৃতকর্মের মাধ্যমে মহান স্রষ্টার ক্রোধের সঞ্চার করে , তাহলে তারা আল্লাহ প্রদত্ত অনুগ্রহ বা নেয়ামত থেকে বঞ্চিত হবে ।

অন্য দিকে যারা শুধুমাত্র আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ছাড়াও মানুষের জন্যে এক অনন্ত জীবনে বিশ্বাসী , এবং মানুষকে তার পার্থিব জীবনের কৃত সকল ভাল ও মন্দ কাজের জন্যে দায়ী বলে বিশ্বাস করে । ফলে তারা কেয়ামত দিনের প্রতিও বিশ্বাসী , যে দিন মানুষকে তার ভাল মন্দ সব কাজের জবাবদিহি করতে হবে এবং ভাল কাজের জন্যে পুরস্কৃত করা হবে ; এই কেয়ামতের দিনকে ইহুদী , খৃষ্টান , মাজুসী এবং মুসলমানরা ও বিশ্বাস করে । এ ধরণের বিশ্বাসের অধিকারী ব্যক্তিরা এমন এক জীবন পদ্ধতির অনুসরণ করে যা ঐ মৌলিক বিশ্বাসের সাথে সামঞ্জশ্যপূর্ণ এবং মানুষের ইহকাল ও পরকালীন উভয় জীবনেই সৌভাগ্যবান হওয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করে । এ বিশ্ব জগতের সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কিত মৌলিক বিশ্বাসসমূহ এবং তার ভিত্তিতে রচিত অনুকরণীয় জীবন পদ্ধতির নীতিমালা সমষ্টির অপর নামই দ্বীন দ্বীনের মধ্যে সৃষ্ট শাখা সমূহকে মাযহাব বলা হয় । উদাহরণ স্বরূপ যেমন : আহলুস সুন্নাহ ও আহলুস তাশাইয়ূ ইসলামের অন্যতম দু টি মাযহাব এবং খৃষ্টান ধর্মের মালেকানী ও নাসতুরী মাযহাবদ্বয় ।

ইতিপূর্বের আলোচনা থেকে সুস্পষ্টভাবে বলা যায় যে , মানুষ দ্বীনের (এক শ্রেণীর মৌলিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে রচিত জীবন পদ্ধতি) প্রতি নির্ভরশীলতা থেকে (যদি সে আল্লাহতে বিশ্বাসী নাও হয়) আদৌ মুক্ত নয় । সুতরাং দ্বীন মানুষের জন্যে প্রয়োজনীয় এমন এক জীবন পদ্ধতি , যা মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ স্বরূপ । পবিত্র কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী দ্বীন কে এড়িয়ে যাওয়া মানুষের জন্যে অসম্ভব । এটা এমন এক পথ যা স্বয়ং মহান আল্লাহ মানব জাতির প্রতি প্রসারিত করেছেন এবং মহান আল্লাহতে গিয়েই এ পথের পরিসমাপ্তি ঘটেছে । অর্থাৎ সত্য দ্বীন (ইসলাম) গ্রহণের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে মানুষ আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথেই ধাবিত হয় । আর যারা সত্য দ্বীন কে গ্রহণ করেনি প্রকৃতপক্ষে তারা ভ্রান্ত পথই অনুসরণ করেছে এবং পথভ্রষ্ট হয়েছে ।1

ইসলাম : আত্মসমর্পণ ও মাথানত করাই ইসলাম শব্দের আভিধানিক অর্থ । পবিত্র কুরআনে যে দ্বীন অনুসরণের প্রতি মানব জাতিকে আহবান্ করা হয়েছে , তা হচ্ছে ইসলাম । ইসলাম নাম করণের মূল কারণ হচ্ছে , সমগ্র বিশ্ববাসী একমাত্র মহান আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমপণ করবে । এই আত্মসমর্পণের ফলশ্রুতিতে সে এক আল্লাহর নির্দেশ ব্যতীত অন্য কারো নির্দেশের আনুগত্য করবে না এবং একমাত্র তারই উপাসনা ব্যতীত অন্য কারো উপাসনা করবে না । আর এটাই হল ইসলামের মূল কর্মসূচী ।2 পবিত্র কুরআনের বক্তব্য অনুযায়ী সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি এই দ্বীন কে ইসলাম ও এর অনুসারীদেরকে মুসলমান হিসেবে নাম করণ করেন , তিনি হলেন হযরত ইব্রাহীম (আ.) ।

শীয়া: শীয়া শব্দের আভিধানিক অর্থ হল অনুসারী । যারা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পরিবারকে তার প্রকৃত ও একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে গণ্য করেন , তারাই শীয়া নামে পরিচিত । তারা ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পবিত্র আহলে বাইত (আ.)-এর আদর্শের অনুসারী ।3

শীয়া মাযহাবের উৎপত্তি ও তার বিকাশ প্রক্রিয়া

সর্বপ্রথম যারা শীয়াতু-আলী বা হযরত আলী (আ.) [পবিত্র আহলে বাইতের (আ.) ইমামদের প্রথম ইমাম]-এর অনুসারী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল , তাদের আবির্ভাব মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশাতেই ঘটেছিল । মহানবী (সা.)-এর দীর্ঘ 23 বছর যাবৎ নবুয়ত কাল ইসলামের আবির্ভাব , প্রচার ও অগ্রগতির ঘটনা অন্য উপলক্ষ্য বা হেতুর সৃষ্টি করেছিল । ঐসব উপলক্ষ্য বা হেতুগুলোই রাসূল (সা.)-এর সাহাবীদের মাঝে এ ধরণের একটি সম্প্রদায়ের (শীয়া) আবির্ভাব ঘটিয়ে ছিল ।4

1. নবুয়ত প্রাপ্তির প্রথম দিনগুলোতে মহানবী (সা.) পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে সর্বপ্রথম নিকটআত্মীয়দের কাছে ইসলাম প্রচারের জন্যে আদিষ্ট হয়েছিলেন ।5 তখন তিনি স্পষ্টভাবে তাদেরকে আহবান জানিয়ে বলেছিলেন , তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম আমার আহবানে সাড়া দিবে , সেই হবে আমার প্রতিনিধি এবং স্থলাভিষিক্ত ও উত্তরাধিকারী । তখন একমাত্র হযরত আলী (আ.)-ই সবার আগে মহানবী (সা.)-এর আহবানে সাড়া দিয়েছিলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন । মহানবী (সা.) ও হযরত আলী (আ.)-এর ঈমান আনয়নের বিষয়টিকে স্বাগত জানান এবং তাঁর ব্যাপারে স্বীয় প্রতিশ্রুত্রিকও তিনি রক্ষা করেছিলেন ।6 এটা কখনই সম্ভব নয় যে , কোন একটি আন্দোলনের নেতা , আন্দোলনের সূচনা লেগে কোন একজন সহযোগীকে তার প্রতিনিধি ও উত্তরাধিকারী হিসেবে অন্য সবার কাছে পরিচিত করাবেন , অথচ তার একনিষ্ট ও আত্মত্যাগী সহযোগীদের কাছে তাকে তিনি পরিচিত করাবেন না । অথবা তাকে তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে পরিচিত করাবেন , কিন্তু তার সমগ্র জীবদ্দশায় তাকে তার দায়িত্ব থেকে অপসারণ করবেন , তার স্থলাভিষিক্তের পদমর্যাদাকে উপেক্ষা করবেন এবং অন্যান্যদের সাথে কোন পার্থক্যই রাখবেন না ।

1. শীয়া ও সুন্নী উভয় সূত্রে বর্ণিত অসংখ্য মুতাওয়াতির মুস্তাফিজ হাদীসে মহানবী (সা.) স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে , হযরত আলী (আ.) তার কথায় ও কাজে ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত।7 তিনি যা কিছু বলেন এবং করেন , সবই ইসলামের প্রচার কাজের সাথে সম্পূর্ণ সংগতিপূর্ণ । ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শরীয়তের ক্ষেত্রে তিনিই সর্বাধিক জ্ঞানী ব্যক্তি ।8

2. হযরত আলী (আ.) ইসলামের জন্যে অতীব মূল্যবান সেবামুলক কাজ করেছেন । ইসলামের পথে তিনি আশ্চর্যজনক আত্মত্যাগের প্রমাণ রেখেছেন । উদাহরণ স্বরূপ মদীনায় হিজরতের রাতে মহানবী (আ.)-এর বিছানায় শয়ন ,9 বদর , ওহুদ , খন্দক ও খায়বারের যুদ্ধ তার দ্বারা অর্জিত বিজয়সমূহ উল্লেখযোগ্য । এ সব ঘটনার কোন একটিতেও যদি তিনি উপস্থিত না থাকতেন তাহলে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ্ সেদিন আল্লাহর শত্রুদের হাতে ধ্বংস হয়ে যেত ।10

3. গাদিরে খুমের ঘটনা , এ ঘটনায় মহানবী (সা.) হযরত আলী (আ.) -কে জনসাধারণের মাঝে তাদের গণনেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত ও পরিচিত করিয়ে দেন । তিনি আলী (আ.)-কে নিজের মতই জনগণের অভিভাবকের পদে প্রতিষ্ঠিত করেন ।

4 হযরত আলী (আ.)-এর এধরণের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও মহত্বের অধিকারী হওয়ার বিষয়টি ছিল একটি সর্বসম্মত ব্যাপার ।11 এ ছাড়াও তাঁর প্রতি আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর ভালবাসা ছিল অপরিসীম ।12 সব মিলিয়ে এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল যে , সত্য ও মহত্বের অনুরাগী রাসূল (সা.)-এর বেশ কিছু সংখ্যক সাহাবী আলী (আ.)-এর প্রেমে অনুরক্ত ও তার অনুসারীতে পরিণত হবেন । একইভাবে এ বিষয়টি বেশ কিছু সংখ্যক সাহাবীর ঈর্ষা ও বিদ্বেষের কারণও ঘটিয়েছিল , যা তাদেরকে আলী (আ.)-এর প্রতি শত্রুতায় উদ্বুদ্ধ করেছিল । এ সকল বিষয় ছাড়াও স্বয়ং আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর পবিত্র বাণীসমূহে শীয়াতুআলী [আলী (আ.)-এর অনুসারী] এবং শীয়াতু আহলুল বাইত (পবিত্র আহলে বাইতের অনুসারী) নামক শব্দগুলোর বহুল ব্যাবহার পরিলক্ষিত হয় ।13

সুন্নী জনগোষ্ঠী থেকে শীয়া জনগোষ্ঠীর পৃথক হওয়ার কারণ

রাসূল (সা.) সাহাবাবৃন্দ এবং মুসলমানদের কাছে হযরত আলী (আ.) উচ্চমর্যাদার অধিকারী ছিলেন । স্বাভাবিকভাবেই হযরত আলী (আ.)-এর ভক্ত ও অনুসারীদের এ ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে , মহানবী (সা.)-এর তিরোধনের পর মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব ও খেলাফতের অধিকার একমাত্র হযরত আলী (আ.)-এর-ই-রয়েছে । আর রাসূল (সা.)-এর মৃত্যুপূর্ব অসুস্থ অবস্থার সময়ে সংঘটিত কিছু ঘটনা ছাড়া অন্য সকল ঘটনা প্রবাহ তাদের এ ধারণারই সাক্ষ্য দিচ্ছিল ।14

কিন্তু পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ সম্পূর্ণরূপে তাদের ধারণার বিপক্ষে বইতে শুরু করল । আর এটা তখনই ঘটল , যখন বিশ্বনবী (সা.) সবেমাত্র শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন । তার পবিত্র দেহ এখনও দাফন হয়নি । রাসূল (সা.)-এর শোকগ্রস্থ পবিত্র আহলে বাইত (আ.) ও কিছু সংখ্যক সাহাবী যখন রাসূল (সা.)-এর দাফন কাফনের আয়োজন্য ব্যস্ত , ঠিক তখনই খবর এল , কিছু সংখ্যক সাহাবী খলিফা নির্বাচন করে ফেলেছেন । খলিফা নির্বাচনের ঘটনা এত দ্রুত ও তাড়াহুড়ার মধ্যে ঘটানো হয়েছিল যে , এ ব্যাপারে রাসূল (সা.) এর পবিত্র আহলে বাইত (রাসূলের পরিবার) , আত্মীয় স্বজন এবং ভক্ত ও অনুসারীদেরকে পরামর্শের জন্যেও কোন প্রকারে সংবাদ দেয়া হয়নি । এ ঘটনার মূল ব্যক্তিরা পরবর্তীতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও প্রথম অবস্থায় এদের সংখ্যা ছিল খুবই নগন্য । অথচ তারা বাহ্যত মুসলমানদের কল্যাণকামীতার দাবিদ্যার ছিল । এ ভাবেই হযরত আলী (আ.) ও তার অনুসারীরা এক অপ্রত্যাশিত ঘটনার মুখোমুখী হলেন ।15

হযরত সালমান ফারসী , হযরতুমিকদাদ , হযরত আবুযার , হযরত আব্বাস , হযরত যুবাইর , হযরত আম্মারসহ হযরত আলী (আ.) ও তার অন্যান্য অনুসারীরা রাসূল (সা.)-এর দাফন কাফনের অনুষ্ঠান শেষ করা এবং খলিফা নির্বাচনের ঘটনা সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত হওয়ার পর এ ব্যাপারে তারা কঠোর সমালোচনা করেন । এ ছাড়াও তথাকথিত নির্বাচিত খলিফা এবং এ ঘটনার মূল ব্যক্তিদের কাছে এ ব্যাপারে তারা ব্যাপক প্রতিবাদ জানান । এমন কি এ ব্যাপারে তারা কিছু গণজমায়েতও করেন । কিন্তু এর উত্তরে তাদেরকে বলা হয় , এ ঘটনাকে মেনে নেয়ার মাঝেই মুসলমানদের কল্যাণ নিহিত রয়েছে ।16

প্রতিষ্ঠিত খলিফার প্রতি সমালোচনা ও বিরুদ্ধাচারণই হযরত আলী (আ.) ও তাঁর অনুসারীদেরকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে পৃথক ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে পরিণত হওয়ার কারণ ঘটিয়ে ছিল । আর তখন থেকেই হযরত আলী (আ.)-এর অনুসারীরা শীয়াতু আলী (আলীর অনুসারী) নামে সমাজে পরিচিতি লাভ করে । অবশ্য খলিফার প্রশাসনিক অঙ্গনে এমন এক সতর্কপূর্ণ প্রচেষ্টা ছিল যে , আলী (আ.)-এর অনুসারীরা এভাবে বিশেষ একটি নামে সমাজে পসিদ্ধি লাভ না করুক । মুসলিম সমাজ এভাবে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগরিষ্ঠ দু টি দলে বিভক্ত না হোক । বরং তাদের প্রচেষ্টা ছিল খেলাফতর্ক একটি সর্বসম্মত বিষয় হিসেবে সমাজের কাছে তুলে ধরা । তাই খেলাফতের বিরোধীদেরকে তারা বাইয়াতের বিরোধী ও মুসলিম উম্মার বিরোধী হিসেবে সমাজে পরিচিতি করাতে খাকলেন । কখনও বা খেলাফতের বিরোধীদেরকে এর চেয়ে জঘণ্য ভাষায় সম্বোধন করা হত ।17

অবশ্য শীয়াদেরকে সেদিন তাদের জন্ম লেগেই প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা পদদলিত হতে হয়েছিল । শুধুমাত্র মৌখিক প্রতিবাদ-কর্ম সূচীর মাধ্যমে তারা একপাও অগ্রসর হতে পারেনি । আর হযরত ইমাম আলী (আ.) ইসলাম ও মুসলমানদের বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষা এবং প্রয়োজনীয় শক্তি সামর্থের অভাবে একটি রক্তক্ষয়ী বিপ্লব থেকে বিরত রইলেন । কিন্তু খেলাফত বিরোধী পক্ষ তাদের মতাদর্শের ব্যাপারে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে আত্মসমর্পণ করেনি । রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকার ও জ্ঞানগত নেতৃত্বের ব্যাপারে তারা একমাত্র হযরত ইমাম আলী (আ.)-কেই যোগ্য বলে বিশ্বাস করতেন ।18 তারা জ্ঞানগত ও আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের গুণাবলী একমাত্র হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর মধ্যেই দেখতে পেয়েছিলেন । তাই তারা তাঁর দিকেই মুসলমানদেরকে আহবান জানাতেন ।19