পুনরূত্থান বা পরকাল পরিচিতি
মানুষ দেহ ও আত্মার সমষ্টি
ইসলাম সম্পর্কে মোটামুটি যাদের জানা আছে , তারা নিশ্চয়ই জানেন যে , পবিত্র কুরআন বা হাদীসে প্রায়ই মানুষের দেহ ও আত্মা প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে । সবাই জানেন যে , প্রঞ্চন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভবযোগ্য এই দেহ সম্পর্কে ধারণা করা আত্মার তুলনায় অনেক সহজ । আর আত্মা সম্পর্কে ধারণা অর্জন যথেষ্ট জটিল ও দুর্বোধ্য । শীয়া ও সুন্নি , উভয় সম্প্রদায়ের কালাম (মৌলিক বিশ্বাস শাস্ত্র) শাস্ত্রবিদ এবং দার্শনিকদের মধ্যে আত্মা সম্পর্কিত মতামতের ক্ষেত্রে যথেষ্ট মতভেদ বিরাজমান । তবে এটা একটা সর্বজন স্বীকৃত বিষয় যে , ইসলামের দৃষ্টিতে দেহ ও আত্মা দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির অস্তিত্ব । মৃত্যুর মাধ্যমে মানবদেহ তার জীবনীশক্তি হারায় এবং ধীরে ধীরে তা ধ্বংসপ্রাপ্ত ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় । কিন্তু আত্মার বিষয়টি মোটেও এমন নয় । বরং জীবনীশক্তি মূলতঃ আত্মা থেকেই উৎসরিত । যতক্ষণ পর্যন্ত আত্মা দেহের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকবে , দেহও ততক্ষণ ঐ আত্মা থেকে সঞ্জীবনীশক্তি লাভ করবে । যখনই আত্মা ঐ দেহ থেকে পৃথক হবে এবং (মৃত্যুর মাধ্যমে) দেহের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করবে , তখনই দেহ নির্জীব হয়ে পড়বে । তবে আত্মা তার জীবনীশক্তি নিয়ে আপন জীবনকাল অব্যাহত রাখে । পবিত্র কুরআন এবং ইমামগণের (আ.) হাদীস সমূহের মাধ্যমে যা আমরা বুঝতে পারি , তা হল , আত্মা মহান আল্লাহর এক অসাধারণ ও অভিনব সৃষ্টি । তবে আত্মা ও দেহের অস্তিত্বের মধ্যে এক ধরণের সংগতি ও ঐক্য বিদ্যমান ।
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন : আমরা মানুষকে মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি করেছি অতঃপর আমরা তাকে শুক্র বিন্দুরূপে এক সংরক্ষিত আধারে স্থাপন করেছি । এরপর আমরা শুক্রবিন্দুকে জমাটবাধাঁ রক্তে পরিনত করেছি । অতঃপর জমাট বাধাঁ রক্তকে মাংসপিন্ডে পরিণত করেছি । এরপর সেই মাংসপিন্ড থেকে অস্থি সৃষ্টি করেছি , অতঃপর অস্থিকে মাংস দ্বারা আবৃত করেছি , অবশেষে তাকে এক নতুন রূপে দাড় করিয়েছি । (সূরা আল মু’
মিনীন , 12-14 নং আয়াত ।)
উপরোল্লিখিত আয়াত থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয় যে , উক্ত আয়াতের প্রথম অংশে সৃষ্টির জড়গত ক্রমবিবর্তন সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে । আর উক্ত আয়াতের শেষাংশে আত্মা , অনুভূতি এবং ইচ্ছাশক্তির সৃষ্টির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে । এভাবে উক্ত আয়াতের শেষা্ংশে দ্বিতীয় প্রকৃতির সৃষ্টির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে , যা প্রথম প্রকৃতির সৃষ্টির চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নতর । পবিত্র কুরআনের অন্যত্র মানুষের পুনরূত্থানের বিষয় অস্বীকারকারীদের প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়েছে । তাদের পশ্ন ছিল , মৃত্যুর পর মানুষের দেহ যখন ধ্বংস প্রাপ্ত হয় এবং পুনরায় তাকে প্রথম অবস্থার ন্যায় সৃষ্টি করা সম্ভব ?
এর উত্তরে মহান আল্লাহ বলেছেন : তারা বলে , আমরা মৃত্তিকায় মিশ্রিত হয়ে গেলেও পুনরায় নতুন করে সৃজিত হব কি ? বরং তারা তাদের পালনকর্তার সাক্ষাতকে অস্বীকার করে । বলুন , তোমাদের প্রাণহরণের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেস্তা তোমাদের প্রাণহরণ করবে । অতঃপর তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে । (সূরা আস সিজদাহ , 10-11 নং আয়াত ।)
এ ছাড়া পবিত্র কুরআনে আরও বিস্তারিতভাবে আত্মা সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে । সেখানে আত্মাকে এক অজড় অস্তিত্ব হিসেবে পরিচয় করানো হয়েছে । এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেছেন : (হে রাসূল সঃ) তোমাকে তারা আত্মার (রূহ) রহস্য সম্পর্কে পশ্ন করে থাকে । বলে দাও ; আত্মা সে আমার প্রতিপালকের আদেশঘটিত । (সূরা আল ইসরা , 85 নং আয়াত ।)
এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে তিনি যখন কোন কিছু করতে ইচ্ছে করেন , তখন তাকে কেবল বলে দেন , হও তখনই তা হয়ে যায় । (সূরা আল্ ইয়াসিন , 83 নং আয়াত।)
উপরোক্ত আয়াত থেকে এটাই প্রতীয়মাণ হয় যে , কোন কিছু সৃষ্টির ব্যাপারে মহান আল্লাহর আদেশের বাস্তবায়ন কোন ক্রমধারা বা পর্যায়ক্রমের নীতি অনুসরণ করে না । তার আদেশ বাস্তবায়ন কোন স্থান বা কালের করতলগত নয় । সুতরাং আত্মা যেহেতু মহান আল্লাহর আদেশ বৈ অন্য কিছু নয় , তাই তা অবশ্যই কোন জড়বস্তু নয় । অতএব যার অস্তিত্বের মাঝে ক্রমধারা , স্থান ও কালের ন্যায় জড় বস্তুবাচক কোন গুণাবলীরই উপস্থিতি নেই ।
আত্মার রহস্য সম্পর্কে অন্য একটি আলোচনা
আত্মার রহস্য সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গী বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধানের মাধ্যমেও সমর্থিত হয় । পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই তার নিজের মধ্যে এক সত্তার অস্তিত্ব উপলদ্ধি করে , যাকে সে‘
আমি’
বলে আখ্যায়িত করে । মানুষের এ উপলদ্ধি চিরদিনের । এমনকি মানুষ মাঝে মাঝে তার নিজের হাত , পা , মাথাসহ দেহের সকল অঙ্গকে ভুলে গেলেও যতক্ষণ সে বেচে আছে , তার ঐ আত্মোপলদ্ধি (আমি) সে কখনই ভুলে যায় না । যেমনটি সর্বত্র পরিদৃষ্ট হয় , এই সত্তার (আমি) অস্তিত্ব কখনই বিভাজ্য নয় । মানুষের দেহ প্রতিনিয়তই পরিবর্তনশীল । মানবদেহ সর্বদাই একটি সুনির্দিষ্ট স্থান অধিকার করে এবং সময়ের অগণিত মূহুর্তের স্রোত সর্বদাই তার উপর দিয়ে প্রবাহমাণ । কিন্তু ঐ মূল সত্তার অস্তিত্ব সর্বদাই স্থির । কোন পরিবর্তনশীলতাই তার অস্তিত্বকে কখনোই স্পর্শ করে না । এতে এটাই প্রতীয়মাণ হয় যে , ঐ সত্তার অস্তিত্ব (আমি বা আত্মা) অবশ্যই জড় অস্তিত্ব নয় । তা না হলে অবশ্যই তা স্থান , কাল , বিভাজন ও পরিবর্তনশীলতার মত জড়বস্তুর গুণবাচক বৈশিষ্ট্য সমূহও তাতে পাওয়া যেত । হ্যাঁ , আমাদের সবার দেহই জড়বস্তুর গুণবাচক ঐসব বৈশিষ্টে পরিপূর্ণ । আর আত্মার সাথে দেহের ওতপ্রোত সম্পর্কের কারণে , ঐসব দৈহিক বৈশিষ্ট্য সমূহকে আত্মার প্রতিও আরোপ করা হয় । কিন্তু সামান্য একটু মনোযোগের সাথে লক্ষ্য করলেই এ ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে , এখন ও তখন (সময়) , এখানে ও সেখানে (স্থান) ,এরকম ও সেরকম (আকৃতি ও আয়তন) এবং এদিক ও সেদিক (দিক) এসবই আমাদের এ জড় দেহেরই বৈশিষ্ট্য । কিন্তু আত্মা ঐ সকল জড়বাচক বৈশিষ্ট্য থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত । দেহের মাধ্যমেই ঐসব বৈশিষ্ট্য তাকে স্পর্শ করে । ঠিক একই কথা আত্মার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য । যেমন : অনুভূতি ও উপলদ্ধি (জ্ঞান) একমাত্র আত্মারই বৈশিষ্ট্য । সুতরাং এটা চিরসত্য যে , জ্ঞান যদি জড়বস্তু হত , তাহলে স্থান ও কাল বিভাজনের ন্যায় জড়বাচক গুণাবলীও তার ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রযোজ্য হত । অবশ্য উক্ত বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়টি একটি ব্যাপক আলোচনা ও অসংখ্য প্রশ্ন ও উত্তরের সূত্রপাত ঘটাতে বাধ্য । তাই এই বইয়ের এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে তার অবতারণা না করাই যুক্তিযুক্ত বলে মনে করছি । এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জ্ঞান আহরণে আগ্রহীদেরকে ইসলামী দর্শনের বইগুলো পড়ার অনুরোধ জানাচ্ছি ।