ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব 0%

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

লেখক: আল্লামা সাইয়্যেদ মুহাম্মদ হুসাইন তাবাতাবাঈ
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 40538
ডাউনলোড: 5458

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 31 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 40538 / ডাউনলোড: 5458
সাইজ সাইজ সাইজ
ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

‘ইসলাম ও শীয়া মাযহাব’ নামক এ গ্রন্থে ইসলামের দু’টি বৃহৎ উপদলের (শীয়া ও সুন্নী) অন্যতম শীয়া মাযহাবের প্রকৃত পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে । শীয়া মাযহাবের উৎপত্তি, বিকাশ ও চিন্তাধারার প্রকৃতি এবং ইসলামী জ্ঞানের ব্যাপারে শীয়া মাযহাবের দৃষ্টিভঙ্গী এ বইয়ে আলোচিত হয়েছে ।

ইমাম পরিচিতি

ইমাম শব্দের অর্থ

ইমাম বা নেতা তাকেই বলা হয় , যে একদল লোককে নির্দিষ্ট কোন সামাজিক , রাজনৈতিক , বৈজ্ঞানিক অথবা ধর্মীয় লক্ষ্যে পৌছানোর জন্যে নেতৃত্ব প্রদানের দায়িত্ব গ্রহণ করে । অবশ্য নেতা তার নেতৃত্বের পরিধির বিস্তৃতি ও সংকীর্ণতার ক্ষেত্রে সময় ও পরিবেশগত পরিস্থিতির অনুসারী পবিত্র ইসলাম ধর্ম (যেমনটি পূর্বে আলোচিত হয়েছে) মানব জীবনের সকল দিক পর্যবেক্ষণপূর্বক তার জন্যে নীতিমালা প্রণয়ন করেছে ।

ইসলাম মানুষের আধ্যাত্মিক জীবন বিশ্লেষণপূর্বক তার জন্যে প্রয়োজনীয় পথনির্দেশ দান করেছে । পার্থিব জীবনের ক্ষেত্রে এবং মানুষের ব্যক্তিগত জীবন যাপন ও তার পরিচালনার ব্যাপারেও ইসলামের হস্তক্ষেপ রয়েছে । ঠিক একইভাবে মানুষের সামাজিক (পার্থিব) জীবন ও তার পরিচালনার (রাষ্ট্রিয় ব্যবস্থা) ক্ষেত্রেও ইসলামের নির্দেশ রয়েছে ।

উপরে মানব জীবনের যেসব দিক সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে , তার ভিত্তিতে ইসলামী নেতৃত্ব তিনটি দিকে গুরুত্বের অধিকারী । সেই দিক গুলো হচ্ছে : ইসলামী শাসন ব্যবস্থা , ইসলামী জ্ঞানমালা ও আইন কানুন বর্ণনা এবং আধ্যাত্মিক জীবনে নেতৃত্ব ও পথ নির্দেশনার দিক । শীয়াদের দৃষ্টিতে ইসলামী সমাজের জন্যে উক্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনটি দিকের নেতৃত্ব দানের জন্যে নেতার প্রয়োজন অপরিহার্য । যিনি ইসলামী সমাজের এ তিনটি দিকের উপযুক্ত নেতৃত্ব দেবেন অবশ্যই তাকে মহান আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.)-এর দ্বারা মনোনীত হতে হবে । অবশ্য মহান আল্লাহর নির্দেশে বিশ্বনবী (সা.) এই মনোনয়ন কার্য সম্পন্নও করে গেছেন ।

ইমামত এবং ইসলামী শাসনব্যবস্থা ও মহানবী (সা.)-এর উত্তরাধিকার

মানুষ তার খোদাপ্রদত্ত স্বভাব দিয়ে অতি সহজেই এ বিষয়টি উপলদ্ধি করে যে , কোন দেশ , শহর গ্রাম বা গোত্র এবং এমনকি গুটি কয়েক লোক সম্বলিত কোন একটি সংসারও একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির নেতৃত্ব ছাড়া চলতে পারে না । একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির নেতৃত্ব ছাড়া সমাজের চাকা সচল রাখা সম্ভব নয় । একজন নেতার ইচ্ছাই সমাজের অসংখ্য ব্যক্তির ইচ্ছার উপর প্রভুত্ব করে । এভাবে সে সমাজের প্রতিটি ব্যক্তিকে তার সামাজিক দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে । সুতরাং একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির নেতৃত্ব ছাড়া সমাজের গতি অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না । তাই অতি অল্প সময়ের মধ্যেই নেতাহীন ঐ সমাজ ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে বাধ্য ।

যার ফলে এক ব্যাপক অরাজকতা ঐ সমাজকে ছেয়ে ফেলবে । সুতরাং , উক্ত যুক্তির উপর ভিত্তি করে নিঃসন্দেহে এ কথা বলা যায় যে , সমাজ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত (সে সমাজ বৃহত্তরই হোক অথবা ক্ষুদ্র তরই হোক) নেতা , সমাজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে যার অবদান অনস্বীকার্য তিনি যদি কখনও অস্থায়ীভাবে অথবা স্থায়ীভাবে তার পদ থেকে অনুপস্থিত থাকেন , তাহলে অবশ্যই তার ঐ অনুপস্থিতকালীন সময়ের জন্যে অন্য কাউকে দায়িত্বশীল হিসেবে নিয়োজিত করে যাবেন । এধরণের দায়িত্বশীল কোন নেতা কোনক্রমেই এমন কাজ করতে প্রস্তুত হবেন না , যার ফলে নিজের দায়িত্বের পদ থেকে সরে দাড়ানোর কারণে নেতার অভাবে ঐ সমাজের অস্তিত্ব ধ্বংসোন্মুখ হয়ে পড়বে । কোন পরিবারের কর্তাব্যক্তিও যদি কিছুদিনের জন্যে অথবা কয়েক মাসের জন্যে পরিবারের সদস্যদের ত্যাগ করে দূরে কোথাও ভ্রমনে যান । তখন অবশ্যই তিনি তার অনুপস্থিতকালীন সময়ে সংসার পরিচালনার জন্যে পরিবারের কাউকে (অথবা তৃতীয় কোন ব্যক্তিকে) দায়িত্বশীল হিসাবে নিয়োগ করে যান । কোন প্রতিষ্ঠানের পরিাচালক বা স্কুলের প্রধান শিক্ষক অথবা দোকানের মালিক , যাদের অধীনে বেশ ক জন কর্মচারী কর্মরত , তারা যদি অল্প ক ঘন্টার জন্যেও কোন কারণে কর্মস্থল ত্যাগ করেন , তাহলে অধীনস্থ কাউকে তার অনুপস্থিতকালীন সময়ে তার দায়িত্ব পালনের জন্যে নিযুক্ত করে যান । আর অন্যদেরকে ঐ নবনিযুক্ত দায়িত্বশীলের আনুগত্য করার নির্দেশ দেন । ইসলাম এমন এক ধর্ম , যা খোদাপ্রদত্ত মানব প্রকৃতি অনুযায়ী পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত । ইসলাম একটি সামাজিক আদর্শ যার প্রকৃতি এমন এক দৃষ্টান্ত মূলক যে , পরিচিত ও অপরিচিত সবাই ঐ আদেশের দর্পন থেকে এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারে । মহান আল্লাহ ও বিশ্বনবী (সা.) এই আদেশের সামাজিকতার ক্ষেত্রে যে মহান অবদান রেখেছেন , তা সবার কাছেই অনস্বীকার্য । এই ঐশী আদর্শ পৃথিবীর অন্য কিছুর সাথেই তুলনাযোগ্য নয় । মহানবী (সা.)- ও ইসলামের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন সামাজিক বিষয়ই পরিত্যাগ করতেন না । যখনই কোন শহর বা গ্রাম মুসলমানদের দ্বারা বিজিত হত , সম্ভাব্য সংক্ষিপ্ত সময়ে বিশ্বনবী (সা.) তার পক্ষ থেকে কাউকে ঐ অঞ্চলের শাসনকর্তা ও স্বীয় প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে পাঠাতেন । এমনকি জিহাদ পরিচালনার উদ্দেশ্যে প্রেরিত সেনাবাহিনীর জন্যে প্রয়োজন বোধে (অত্যাধিক গুরুত্বের কারণে) একাধিক সেনাপতিও তিনি নিযুক্ত করতেন । এমনকি ঐতিহাসিক মুতার যুদ্ধে বিশ্বনবী (সা.) চারজন সেনাপতি নির্বাচন করেছিলেন । যাতে প্রথম সেনাপতি শাহাদত বরণ করলে দ্বিতীয় সেনাপতি দায়িত্ব গ্রহণ করবেন । দ্বিতীয়জন শাহাদত বরণ করলে তৃতীয়জন দায়িত্ব গ্রহণ করবেন । আর এইভাবে এ ধারা বাস্তবায়িত হবে । রাসূল (সা.)-এর এসকল কার্যের মাধ্যমেই নেতা নিয়োগের গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে যায় । একইভাবে বিশ্বনবী (সা.) তার স্বীয় উত্তরাধিকারের বিষয়েও সম্পূর্ণ সজাগ ছিলেন । তিনি স্বীয় উত্তরাধিকারী নির্ধারণের ব্যাপারে কখনোই পিছপা হননি । যখনই তিনি প্রয়োজন বোধে মদীনার বাইরে যেতেন , তখনই তিনি কাউকে তার স্থলাভিষিক্ত করে যেতেন । এমন কি যখন তিনি মদীনার উদ্দেশ্যে মক্কা নগরী ত্যাগ করে ছিলেন , যখন কেউই সে সংবাদ সম্পর্কে অবহিত ছিল না তখনও মাত্র অল্প ক দিনের জন্য স্বীয় ব্যক্তিগত দায়িত্ব পালন ও জনগণের গচ্ছিত আমানত দ্রব্যাদি মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার জন্যে মক্কায় হযরত ইমাম আলী (আ.)-কে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যান । এভাবেই বিশ্বনবী (সা.) মৃত্যুর পূর্বে স্বীয় ঋণ পরিশোধ ও বিশ্বাসগত অসমাপ্ত কার্যাবলী সম্পাদনের জন্যে ইমাম আলী (আ.)-কে নিজের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন । তাই শীয়ারা বলে : উপরোক্ত দলিলের ভিত্তিতে এটা আদৌও কল্পনাপ্রসূত নয় যে , বিশ্বনবী (সা.) মৃত্যুর পূর্বে কাউকে তার উত্তরাধিকারী বা স্থলাভিষিক্ত ´ হিসেবে নির্বাচিত করে যাননি । মুসলমানদের প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা এবং ইসলামী সমাজের চালিকা শক্তি নিয়ন্ত্রণের জন্যে কাউকেই মহানবী (সা.) মনোনীত করে যাননি , এটা এক কল্পনাতীত ব্যাপার বটে । এক শ্রেণীর আইন-কানুন ও কিছু সাধারণ আচার অনুষ্ঠান , যা সমাজের অধিকাংশ জনগণের দ্বারা বাস্তবে স্বীকৃত ও সমর্থিত , তার উপর ভিত্তি করেই একটি সমাজের সৃষ্টি হয় । আর ঐ সমাজের অস্তিত্ব টিকে থাকার বিষয়টি সম্পূর্ণ রূপে ন্যায়বিচার ভিত্তিক ও দায়িত্বশীল একটি প্রশসানের অস্তিত্বের উপরই নির্ভরশীল । এটা এমন কোন বিষয় নয় যে , মানব প্রকৃতি এর গুরুত্ব ও মূল্য সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করবে । কোন বিজ্ঞ ব্যক্তির কাছেও এটা কোন অজ্ঞাত বিষয় নয় এবং এটা ভোলার বিষয়ও নয় , কারণ , ইসলামী শরীয়তের (বিধান) সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ ও বিস্তৃতি একটি সন্দেহাতীত ব্যাপার । আর এ ব্যাপারটিও অনস্বীকার্য যে , বিশ্বনবী (সা.) এ ব্যাপারে অত্যাধিক গুরুত্বারোপ করতেন এবং এপথে তিনি নিজের সর্বস্ব উৎসর্গ করেছেন । তার ঐ আত্মত্যাগ , অসাধারণ চিন্তাশক্তি , প্রজ্ঞার শ্রেষ্ঠত্ব , সূক্ষ্ণ ও সঠিক দৃষ্টিভঙ্গী এবং সূক্ষ্ণ বিশ্লেষণ ক্ষমতার (ওহী ও নবুয়তের সাক্ষ্য ছাড়াও) বিষয়টি নিঃসন্দেহে বিতর্কের উর্ধ্বে । শীয়া ও সুন্নী উভয় দলেরই মত নির্বিশেষে বর্ণিত মুতাওয়াতির হাদীস অনুযায়ী ( ফিৎনা অধ্যায়ের হাদীস) বিশ্বনবী (সা.) তার অন্তর্ধানের পর ইসলামী সমাজ যেসব দূর্নীতিমূলক সমস্যায় আক্রান্ত হবে , তার ভবিষ্যৎবাণী করেছেন । ঐসব সমস্যার মধ্যে যেসব সমস্যাগুলো ইসলামকে অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্থ করেছে , উমাইয়া বংশ সহ আরও অন্যান্যদের খেলাফত লাভের বিষয়টি তার মধ্যে অন্যতম । কারণ : তারা ইসলামের পবিত্র আদর্শকে তাদের বিভিন্ন ধরণের অপবিত্রতা ও অরাজকতামূলক জঘণ্য কাজে ব্যাবহার করেছে । এ ব্যাপারে বিশ্বনবী (সা.) তার হাদীসে বিস্তারিতভাবে ভবিষ্যৎবাণী করেছেন । বিশ্বনবী (সা.) তার মৃত্যুর হাজার হাজার বছর পরের ইসলামী সমাজের খুটিনাটি বিষয়াদি ও সমস্যা সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত সচেতন এবং সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ভবিষ্যৎবাণীও করে গেছেন । তাহলে এটা কি করে সম্ভব যে , যিনি তার পরবর্তী সুদুর ভবিষ্যতের ব্যাপারে এত সচেতন , অথচ স্বীয় মৃত্যু পরবর্তী মূহুর্তগুলোতে সংঘটিত ঘটনাবলীর ব্যাপারে আদৌ সচেতন নন ?! বিশ্বনবী (সা.)-এর পরবর্তী উত্তরাধিকারের মত এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি কি তাহলে তিনি ইচ্ছাকৃত ভাবে অবহেলা করেছেন , অথবা এটাকে গুরুত্বহীন একটি বিষয় হিসেবে গণ্য করেছেন ? এটা কেমন করে সম্ভব যে , খাওয়া পরা , ঘুমানো এবং যৌন বিষয়াদির মত মানব জীবনের শতশত খুটিনাটি বিষয়ের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশ তিনি জারী করেছেন , অথচ ঐ ধরণের একটি অতি মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণরূপে নীরবতা পালন করেছেন ? নিজের উত্তরাধিকারীকে তিনি মনোনীত করে যাননি ? ধরে নেয়া যাক (যদিও এটা অসম্ভব একটি ধারণা) যে , মহানবী (সা.) তার স্থলাভিষিক্ত নির্বাচনের দায়িত্বভার মুসলমানদের উপরে ছেড়ে দিয়েছেন , তাহলে এ ব্যাপারে অবশ্যই বিশ্বনবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট বর্ণনা থাকার কথা । এ ব্যাপারে অবশ্যই জনগণের প্রতি তার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা থাকা উচিত । কারণঃ ইসলামী সমাজের অস্তিত্ব ও বিকাশ এবং ইসলামী নিদর্শনাবলীর অস্তিত্ব এ বিষয়টির উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল । তাই এ ব্যাপারে সমগ্র মুসলিম উম্মতকে সদা সচেতন থাকতে হবে । অথচ , এ ব্যাপারে বিশ্বনবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট কোন নির্দেশনার অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায় না । কারণ যদি এমন সুস্পষ্ট কোন নির্দেশনার অস্তিত্ব থাকত , তাহলে নিশ্চয়ই বিশ্বনবী (সা.)-এর পরে তার স্থলাভিষিক্তের পদাধিকারী নির্ধারণের ব্যাপারে এত মতভেদের সৃষ্টি হত না । অথচ আমরা দেখতে পাই যে , প্রথম খলিফা ওসিয়তের ( উইল ) মাধ্যমে দ্বিতীয় খলিফার কাছে খেলাফত হস্তান্তর করেছিলেন ।

দ্বিতীয় খলিফা তার মৃত্যু পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের ব্যাপারে একটি খলিফা নির্বাচন কমিটি গঠন করেছিলেন । ছয় সদস্য বিশিষ্ট ঐ কমিটির প্রতিটি সদস্যই দ্বিতীয় খলিফার দ্বারা মনোনীত হয়েছিলেন । ঐ কমিটির খলিফা নির্বাচন সংক্রান্ত মূলনীতিও তিনি নিজেই নির্ধারণ করেছিলেন । যার ভিত্তিতেই তৃতীয় খলিফা নির্বাচিত হন । তৃতীয় খলিফা নিহত হওয়ার পর চতুর্থ খলিফা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হন । ইমাম হাসান (পঞ্চম খলিফা) চতুর্থ খলিফার ওসিয়তের (উইল) মাধ্যমে নির্বাচিত হন । এরপর মুয়াবিয়া পঞ্চম খলিফা হযরত ইমাম হাসান (আ.)-কে বলপূর্বক সন্ধিচুক্তিতে বাধ্য করার মাধ্যমে খেলাফতের পদটি ছিনিয়ে নেন । তারপর থেকেই খেলাফত রাজতন্ত্রে রূপান্তরিত হয় । আর তখন থেকেই জিহাদ , সৎকাজে আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ , ইসলামী দন্ড বিধি প্রয়োগ , ইত্যাদি ইসলামী নির্দেশনাবলী একের পর এক ক্রমান্বয়ে ইসলামী সমাজ থেকে উধাও হতে থাকে । এভাবে বিশ্বনবী (সা.)- এর সারা জীবনের লালিত সাধানা ধুলিসাৎ হয়ে গেল ।157 শীয়ারা আল্লাহ প্রদত্ত মানব প্রকৃতি এবং জ্ঞানী ও প্রজ্ঞা সম্পন্ন ব্যক্তিদের জীবনাদর্শ অনুযায়ী এ বিষয়ে ব্যাপক পর্যালোচনা ও অনুসন্ধান চালায় । তারা ফিৎরাত বা মানব প্রকৃতি সঞ্জীবনী ইসলামী আদেশের মূল দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতি গভীর দৃষ্টিপাত , মহানবী (সা.)-এর অনুসৃত সামাজিক পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ এবং মহানবী (সা.)-এর মৃত্যু পরবর্তী দুঃখজনক ঘটনাবলী অধ্যয়ন করে । মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর পর ইসলাম ও মুসলমানরা যেসব দূর্দশা ও জটিল সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছিল তারও আদ্যোপান্ত আলোচনা করে । এছাড়াও ইসলামের প্রাথমিক যুগের ইসলামী প্রশাসকদের ইসলামের ব্যাপারে ইচ্ছাকৃত উদাসীনতার বিষয়টিও সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণভাবে বিশ্লেষণ করে । উক্ত গবেষণার মাধ্যমে শীয়ারা একটি সুনিশ্চিত ফলাফলে পৌছুতে সক্ষম হয় । আর তা হচ্ছে এই যে , বিশ্বনবী (সা.)-এর পরবর্তী স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণের ব্যাপারে তার পক্ষ থেকে যথেষ্ট পরিমাণ বর্ণনার অস্তিত্ব ইসলামে বিদ্যমান । এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনের বহু আয়াত এবং বিশ্বনবী (সা.)-এর বর্ণিত অসংখ্য হাদীস রয়েছে , যার সত্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা অকাট্যরূপে প্রমাণিত ও সর্বজনস্বীকৃত । এ ব্যাপারে বিলায়ত সংক্রান্ত আয়াত এবং গাদীরে খুমের হাদীস , সাফিনাতুন নুহ -এর হাদীস , হাদীসে সাকালাইন হাদীসে হাক্ক হাদীসে মানযিলাত নিকট আত্মীয়দের দাওয়াত সংক্রান্ত হাদীস সহ আরও অসংখ্য হাদীসের কথা উল্লেখযোগ্য ।158

উপরোক্ত আয়াত ও হাদীস সমূহের বক্তব্যে শীয়াদের বক্তব্যেরই সমর্থন পাওয়া যায় । অবশ্য ঐসব হাদীসের যথেষ্ট অপব্যাখা করা হয়েছে । আর এই অপব্যাখার মাধ্যমে ঐগুলোর মূল অর্থকে গোপন রাখার চেষ্টা করা হয়েছে ।

পূ্র্বোক্ত আলোচনার পক্ষে কিছু কথা

বিশ্বনবী (সা.) জীবনের শেষ দিনগুলো যখন অসুস্থ অবস্থায় কাটাচ্ছিলেন । তখন একদল সাহাবী রাসূল (সা.)-এর কাছে উপস্থিত ছিলেন । হযরত রাসূল (সা.) সাহাবীদেরকে নির্দেশ দিলেন : আমার জন্যে কাগজ ও কলম নিয়ে এসো । কারণ , আমি এমন কিছু তোমাদের জন্য লিখে রেখে যেতে চাই , যা মেনে চললে তোমারা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না । উপস্থিত সাহাবীদের মধ্যে কিছু লোক বললো : এ লোক তো অসুস্থতার ফলে প্রলাপ ( ?) বকছে । কারণ , আল্লাহর কুরআনই তো আমাদের জন্যে যথেষ্ট !! এ নিয়ে উপস্থিত সাহাবীদের মধ্যে হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল । রাসূল (সা.)-এ অবস্থা দেখে বললেন : তোমারা এখান থেকে উঠে পড় । আমার কাছ থেকে দুর হয়ে যাও । আল্লাহর রাসূলের কাছে হৈ চৈ করা উচিত নয়159

পূ্র্বোক্ত অধ্যায়ের বিষয়বস্তু এবং এ অধ্যায়ে বর্ণিত ঘটনা প্রবাহ যদি আমরা আলোচনা করি , তাহলে দেখতে পাব যে , যারা রাসূল (সা.)-এর ঐ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সেদিন বাধা প্রদান করেছিল , তারাই রাসূল (সা.)-এর মৃত্যুর পর খেলাফত নির্বাচনের ঘটনা থেকে লাভবান হয়েছিল । বিশেষ করে তারা হযরত আলী (আ.) ও তার অনুসারীদের অজ্ঞাতসারেই খেলাফত নির্বাচনের পর্বটি সম্পন্ন করে ।

তারা হযরত আলী (আ.) ও তার অনুসারীদের বিপরীতে ঐ কাজটি সম্পন্ন করেছিল । এরপর সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না যে , উপরোক্ত হাদীসে বর্ণিত ঘটনায় মহানবী (সা.) তার পরবর্তী উত্তরাধিকারী বা স্থলাভিষিক্ত হিসেবে হযরত আলী (আ.)-এর নাম ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন । মহানবী (সা.)-এর নির্দেশ বাস্তবায়নে বাধা প্রদানপূর্বক ঐ ধরণের কথা বলার মাধ্যমে কথা কাটা-কাটি বা বিতর্ক সৃষ্টিই ছিল মূল উদ্দেশ্য , যাতে করে এর ফলে মহানবী (সা.) তার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন থেকে বিরত হতে বাধ্য হন । সুতরাং অসুস্থতাজনিত প্রলাপ বকার কারণে তার নির্দেশ বাস্তবায়নে বাধা দেয়াই তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল না । কারণ ,

প্রথমত : আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর পবিত্র মুখ থেকে অসুস্থ কালীন সময়ে অসংলগ্ন একটি কথাও শানা যায়নি । আর এ যাবৎ এ ধরণের কোন ঘটনাও (অসংলগ্ন কথাবার্তা) কেউই বর্ণনা করেনি । ইসলাম নির্ধারিত নীতিমালা অনুযায়ী কোন মুসলমানই মহানবী (সা.)- এর প্রতি প্রলাপ বকার ( ?) মত অপবাদ আরোপ করতে পারে না । কারণ , আল্লাহর রাসূল (সা.) ছিলেন ঐশী ইসমাত বা নিষ্পাপ হওয়ার গুণে গুণান্বিত ।

দ্বিতীয়ত : যদি তাদের কথা (প্রলাপ বকার মিথ্যা অভিযোগ সত্যই হত , তাহলে এর পরের কথাটি (কুরআনই আমাদের জন্যে যথেষ্ট) বলার কোন প্রয়োজন হত না । কারণঃ তাদের পরবর্তী কথার অর্থ হচ্ছে , কুরআনই তাদের জন্যে যথেষ্ট , এরপর রাসূল (সা.)-এর বক্তব্যের কোন প্রয়োজন নেই । কিন্তু রাসূল (সা.) এর সাহাবীরা ভাল করেই জানতেন যে , পবিত্র কুরআনই মহানবী (সা.) এর অনুসরণকে সবার জন্যে ফরজ হিসেবে ঘোষণা করেছে । রাসূল (সা.)-এর বাণীকে আল্লাহর বাণীরই মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে । পবিত্র কুরআনের সুস্পষ্ট দলিল অনুসারে আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.)-এর নির্দেশের মোকাবিলায় মানুষের ইচ্ছার কোন স্বাধীনতা বা অধিকার নেই ।

তৃতীয়ত : প্রথম খলিফার মৃত্যুর সময় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল । তখন প্রথম খলিফা তার পরবর্তী খলিফা হিসেবে দ্বিতীয় খলিফার নামে খেলাফতের ওসিয়ত (উইল) লিখে যান । তৃতীয় খলিফা ওসমান যখন প্রথম খলিফার নির্দেশে উক্ত ওসিয়ত (উইল) লিখছিলেন , তখন প্রথম খলিফা সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন । কিন্তু , তখন বার দ্বিতীয় খলিফা প্রথম খলিফার ব্যাপারে মোটেই প্রতিবাদ করেননি , যে প্রতিবাদটি তিনি আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর ব্যাপারে করেছিলেন ।160

এ ছাড়া হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণিত হাদীসে161 দ্বিতীয় খলিফার যে স্বীকারোক্তি উল্লিখিত হয়েছে , তাতে তিনি বলেছেনঃ আমি বুঝতে পরে ছিলাম যে আল্লাহর রাসূল (সা.) আলীর খেলাফতের বিষয়টি লিখে দিতে চেয়েছিলেন । কিন্তু বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে তা আমি হতে দেইনি । তিনি আরও বলেন যে আলীই ছিল খেলাফতের অধিকারী ।162 কিন্তু সে যদি খেলাফতের আসনে বসত , তাহলে জনগণকে সত্যপথে চলার জন্যে উদ্বুদ্ধ করত । কিন্তু কুরাইশরা তার আনুগত্য করত না । তাই আমি তাকে খেলাফতের পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছি !!!

ইসলামের নীতি অনুযায়ী সত্য প্রত্যাখানকারীদের জন্যে সত্যবাদীদেরক পরিত্যাগ না করে বরং সত্য প্রত্যাখানকারীদেরকে সত্য গ্রহণে বাধ্য করা উচিত । যখন প্রথম খলিফার কাছে সংবাদ পৌছলো যে মুসলমানদের একটি গোত্র যাকাত প্রদানে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে , তৎক্ষণাত তিনি তাদের সাথে যুদ্ধের নির্দেশ দিলেন এবং বললেন : আল্লাহ রাসূল (সা.) কে মাথার রূমাল বাধার যে দড়ি দেয়া হত , তা যদি আমাকে না দেয়া হয় , তাহলেও তাদের সাথে আমি যুদ্ধে অবতির্ণ হব ।163 অবশ্য এ বক্তব্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে , যে কোন মূল্যের বিনিময়েই হোক না কেন , সত্যকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে । অথচ , সত্য ভিত্তিক খেলাফতের বিষয়টি মাথার রূমাল বাধার দড়ির চেয়ে অবশ্যই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান ছিল ।