ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব 0%

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

লেখক: আল্লামা সাইয়্যেদ মুহাম্মদ হুসাইন তাবাতাবাঈ
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 40539
ডাউনলোড: 5458

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 31 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 40539 / ডাউনলোড: 5458
সাইজ সাইজ সাইজ
ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

‘ইসলাম ও শীয়া মাযহাব’ নামক এ গ্রন্থে ইসলামের দু’টি বৃহৎ উপদলের (শীয়া ও সুন্নী) অন্যতম শীয়া মাযহাবের প্রকৃত পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে । শীয়া মাযহাবের উৎপত্তি, বিকাশ ও চিন্তাধারার প্রকৃতি এবং ইসলামী জ্ঞানের ব্যাপারে শীয়া মাযহাবের দৃষ্টিভঙ্গী এ বইয়ে আলোচিত হয়েছে ।

ইসলামে ইমামত

নবী পরিচিতি অধ্যায়ে ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে যে , গণভাবে পথ নির্দেশনার (হেদায়েত) অপরিহার্য ও ধ্রুব আইন অনুসারে সৃষ্টি জগতের প্রতিটি সৃষ্টিই প্রাকৃতিক ভাবে স্বীয় শ্রেষ্ঠত্ব , পূর্ণত্ব ও মহত্ব প্রাপ্তির পথে পরিচালিত ও সদা ধাবমান । মানুষ ও জগতের অন্যান্য সৃষ্টির মতই একটি সৃষ্টি । তাই মানুষও উক্ত আইনের ব্যতিক্রম নয় । সুতরাং মানুষও তার বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গী ও সামাজিক চিন্তা-চেতনা দিয়ে তার নিজ জীবনে একটি বিশেষ পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে , যার মাধ্যমে সে ইহ ও পরকাল দু জীবনেই সাফল্য ও সৌভাগ্য লাভ করতে পারে । এক কথায় এমন এক শ্রেণীর বিশ্বাস ও বাস্তব দায়িত্বের ভিত্তিতে মানব জীবন পরিচালিত হওয়া উচিত , যার মাধ্যমে মানুষ , জীবনের সাফল্য ও মানবীয় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয় । মানব জীবন পরিচালনার ঐ কর্মসূচী ও জীবন দর্শনের নামই দ্বীন । এই দ্বীন মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে অর্জিত নয় । বরং তা ঐশীবাণী (ওহী) ও নবুয়তের মাধ্যমে প্রাপ্ত , যা মানব জাতির কিছু সংখ্যক বিশিষ্ট ও পবিত্র আত্মাসম্পন্ন ব্যক্তিদের (নবীগণ) মাধ্যমে অর্জিত হয় । আল্লাহর নবীরাই ওহী বা ঐশী বাণীর মাধ্যমে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মানব জাতির কাছে প্রয়োজনীয় দায়িত্ব সমূহ পৌছে দেন । যাতে করে ঐসব দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে মানব জীবন সাফল্য মণ্ডিত হয় । এটা খুবই স্পষ্ট যে , উক্ত যুক্তির ভিত্তিতে এ ধরণের একটি জীবন বিধানের প্রয়োজনীয়তা মানব জাতির জন্যে প্রমাণিত হয় । একইভাবে এর পাশাপাশি মানব জাতির ঐ মূল্যবান জীবন বিধান সম্পূর্ণ অবিকৃতরূপে সংরক্ষণের প্রয়াজনীয়তাও প্রমাণিত হয় । মহান আল্লাহর অনুগ্রহের মাধ্যমে সেই ঐশী জীবন বিধান মানুষের কাছে পৌছে দেয়ার জন্যে যেমন বিশিষ্ট কিছু ব্যক্তির প্রয়োজন , তেমনি ঐ জীবন বিধান সংরক্ষণের জন্যেও বিশিষ্ট কিছু ব্যক্তির প্রয়োজন । যাতে করে ঐ জীবন বিধান চিরদিন অবিকৃতরূপে সংরক্ষিত থাকে এবং প্রয়োজনে তা মানুষের কাছে উপস্থাপন ও শিক্ষা দেয়া যেতে পারে । অর্থাৎ , সর্বদাই একের পর এক এমন কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি থাকা প্রয়োজন , যারা আল্লাহর প্রদত্ত ঐ দ্বীনকে সর্বদাই অবিকৃতরূপে সংরক্ষণ ও প্রয়োজনে তা প্রচার করবেন । যে বিশিষ্ট বিশ্বাস ঐ ঐশী দ্বীনকে অবিকৃতভাবে সংরক্ষণের জন্যে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়োজিত , তাকেই ইমাম নামে অভিহিত করা হয় । একইভাবে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী বা ঐশীবাণী ও বিধান গ্রহণের যোগ্যতাসম্পন্ন আত্মার অধিকারী ব্যক্তিকে নবী হিসেবে অবিহিত করা হয় । নবুয়তও ইমামতের সমাহার একই ব্যক্তির মধ্যেও পাওয়া যেতে পারে , আবার পৃথক পৃথকও হতে পারে । পূর্বোক্ত দলিল প্রমাণের ভিত্তিতে নবী রাসূলগণের জন্যে ইমামত বা নিষ্পাপ হওয়ার গুণে গুণানিত হওয়ার অপরিহার্যতা যেমন প্রমাণিত হয় , তেমনি ইমামের জন্যে ইসমাত বা নিষ্পাপ হওয়ার গুণে গুণানিত হওয়ার অপরিহার্যতাও প্রমাণিত হয় । কেননা , দ্বীনকে কেয়ামত পর্যন্ত মানব জাতির মাঝে সম্পূর্ণ অবিকৃত ও প্রচারের যোগ্যতাসম্পন্ন অবস্থায় সংরক্ষণ করা আল্লাহর দায়িত্ব । আর এ উদ্দেশ্য ঐশী ইসমাত (নিষ্পাপ হওয়ার গুণ) ও ঐশী নিরাপত্তা বিধান ছাড়া বাস্তবায়ন সম্ভব নয় ।

নবী ও ইমামের পার্থক্য

পূ্র্বোক্ত আলোচনায় আনীত যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী বা ঐশীবাণী প্রাপ্তির মাধ্যমে নবী রাসূলগণের ঐশী বিধান লাভের বিষয়টিই শুধুমাত্র প্রমাণিত হয় । কিন্তু ঐ ঐশী বিধানের অব্যাহতভাবে টিকে থাকা ও অবিকৃতভাবে চিরদিন তা সংরক্ষিত থাকার বিষয়টি সর্বসম্মত একটি বিষয় হলেও উপরোক্ত যুক্তির মাধ্যমে তা প্রমাণিত হয় না । তবে ঐশী বিধানের ঐ অমরত্বের কারণেই পুনঃ পুনঃ নবী আগমনের প্রয়োজনহীনতাও প্রমাণিত হয় না । বরং ঐশী বিধানকে মানব জাতির মাঝে সম্পূর্ণ অবিকৃতরূপে চিরদিন সংরক্ষণের জন্যে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত ইমামের উপস্থিতির অপরিহার্যতা এখানে প্রমাণিত হয় । এমনকি সমাজের লোকেরা ঐ ঐশী ইমামতকে চিনতে পারুক অথবা নাই পারুক , মানব সমাজ কখনোই ঐশী ইমামের অস্তিত্ব থেকে মুক্ত থাকবে না ।

মহান আল্লাহ বলেনঃ এরা যদি আমাদের হেদায়েতকে অস্বীকার করে তবে এর জন্যে এমন সম্প্রদায় নির্দিষ্ট করেছি , (তারা) তার অবিশ্বাসী হবে না । (সূরা আল্ আনআম , 89 নং আয়াত । )

পূর্বে যেমনটি বলা হয়েছে যে , নবুয়ত ও ইমামত এ দু টি পদের সমাহার অন্য সময় একই ব্যক্তির মধ্যে পাওয়া যেতে পারে । আবার এ দু টি পদের অস্তিত্ব পৃথক পৃথক ভাবেও বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে পরিলক্ষিত হতে পারে । তাই নবীহীন যুগে কোন মূহুর্তই ইমামের অস্তিত্ব বিহীন অবস্থায় কাটবে না । আর স্বাভাবিক ভাবেই নবীদের সংখ্যা সীমিত এবং সবসময় তাদের অস্তিত্ব ছিল না ।

মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে তার কিছু সংখ্যক নবীকে ইমাম হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন । যেমনঃ মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে হযরত ইব্রাহীম (আ.) সম্পর্কে বলেন : যখন ইব্রাহীমকে তার পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন , অতঃপর তিনি তা পূর্ণ করে দিলেন , তখন পালনকর্তা বললেন : নিশ্চয় আমি তোমাকে মানব জাতির নেতা করব । তিনি বললেনঃ আমার বংশধর থেকেও ? তিনি (প্রভু) বললেন : আমার প্রতিশ্রুতিতে অত্যাচারীরা শামিল হবে না । (সূরা আল্ বাকারা , 124 নং আয়াত ।)

তিনি আরও বলেন : আমি তাদেরকে নেতা মনোনীত করলাম । তারা আমার নির্দেশ অনুসারে পথ প্রদর্শন করত...... । (সূরা আম্বিয়া , 73 নং আয়াত ।)

কাজের অন্তরালে ইমামত

ইমাম যেমন মানুষের বাহ্যিক কাজকর্মের ব্যাপারে নেতা ও পথ পদর্শক স্বরূপ , তেমনি তিনি মানুষের অন্তরেরও ইমাম বা পথ পদর্শক । তিনিই প্রকৃতপক্ষে মানবজাতি ও যে কাফেলা আধ্যাত্মপথে মহান আল্লাহর প্রতি ধাবমান তাদের কর্ণধার স্বরূপ । উক্ত বিষয়টি আরও স্পষ্টভাবে বোঝার জন্যে নিম্ন লিখিত ভূমিকাটির প্রতি লক্ষ্য করুন ।

প্রথমত : এতে কোন সন্দেহ নেই যে , ইসলাম সহ পৃথিবীর একত্ববাদী সকল ঐশী ধর্মের দৃষ্টিতে মানব জীবনের চিরন্তন ও প্রকৃতপক্ষে সাফল্য ও দূর্ভাগ্য তার কৃত সৎ ও অসৎ কর্মের উপর নির্ভরশীল । এটাই সকল ঐশী ধর্মের মূলশিক্ষা । মানুষ তার আপন সত্তায় নিহিত খোদাপ্রদত্ত স্বভাব দিয়ে ঐসব সৎ ও অসৎকর্মের পার্থক্য উপলদ্ধি করতে পারে । মহান আল্লাহ ওহী ও নবুয়তের মাধ্যমে ঐ সব কাজকর্মকে মানব জাতির চিন্তাশক্তি ও বাধশক্তির উপযোগী সামাজিক ভাষায় আদেশ ও নিষেধ এবং প্রশংসা ও তিরস্কারের আকারে বর্ণনা করেছেন । আল্লাহ নির্দেশিত ঐসব আদেশ নিষেধ আনুগত্যকারীদের জন্যে পরকাল এক সমধুর ও অনন্ত জীবনের সুসংবা দ দেয়া হয়েছে । যেখানে মানবতার শ্রেষ্ঠত্ব ও পূর্ণত্বের সকল কামনা-বাসনা বাস্তবায়িত হবে । আর তার অবাধ্যকারী অসৎলোকদের জন্যে সর্ব প্রকার ব্যর্থতা ও দুর্ভাগ্যপূর্ণ এক তিক্ত ও অনন্ত জীবনের সংবাদ দেয়া হয়েছে । এতে কোন সন্দেহ নেই যে , সর্বস্রষ্টা আল্লাহ সকল দিক থেকেই আমাদের কল্পনা শক্তির উর্ধ্বে । তিনি আমাদের মত সামাজিক চিন্তাধারার অধিকারী নন । কারণ , প্রভুত্ব , দাসত্ব , নেততৃ , আনুগত্য , আদেশ , নিষেধ , পারিশ্রমিক এবং পুরুস্কার প্রথা আমাদের সমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ । এই বস্তুজগতের বাইরে এ সবের কোন অস্তিত্ব নেই । এ সৃষ্টিজগতের সাথে সর্বস্রষ্টা আল্লাহর সম্পর্ক বাস্তব ও সত্য নির্ভর । যেমনটি পবিত্র কুরআন164 ও মহানবীর হাদীস সমূহে যেভাবে ইঙ্গিত করা হয়েছে । সে অনুযায়ী দ্বীন এমন কিছু নিগুঢ় সত্য ও উচ্চতর জ্ঞানমালার সমষ্টি , যা সাধারণ বোধশক্তির উর্ধ্বে । মহান আল্লাহ ঐসব জটিল ও উচ্চতর বিষয় সমূহকে সাধারণ মানুষের চিন্তা ও বোধশক্তির মাত্রার উপযোগী করে অত্যন্ত সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় মানব জাতির জন্যে অবতির্ণ করেছেন । উক্ত বর্ণনা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে , সৎ ও অসৎ কাজ এবং পরকালের অনন্ত জীবন ও তার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এক বাস্তব সম্পর্ক বিদ্যমান । ভবিষ্যৎ জীবনের (পরকাল) সৌভাগ্য ও দূর্ভাগ্য আল্লাহর ইচ্ছায় মানুষের ঐসব সৎ ও অসৎ কাজের সৃষ্ট ফলস্বরূপ । আরো সহজ ভাষায় বলতে গেলে , সৎ ও অসৎ কাজগুলো মানুষের আত্মায় এমন এক প্রতিচ্ছবির সৃষ্টি করে , যার উপর তার পরকালীন জীবনের সখ-দুঃখ নির্ভরশীল । মানুষ প্রকৃতপক্ষে শিশুর মতই । লালন-পালনকালীন সময়ে একটি শিশু তার অভিভাবকের কাছ থেকে এটা কর ওটা কর না এমনই সব আদেশ নিষেধই প্রতিনিয়ত শুনতে অভ্যস্ত । কিন্তু ঐ অবস্থায় ঐ শিশু ঐসব কাজ করা বা না করার মূলমর্ম আদৌ উপলদ্ধি করতে সক্ষম হয় না । ঐ শিশু যদি শৈশবে লালিত হওয়াকালীন সময়ে তার প্রশিক্ষক বা অভিভাবকের আদেশ নিষেধের ঠিকমত আনুগত্য করে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই সে ভবিষ্যতে মানুষের মত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে এবং ভবিষতে সামাজিক জীবনে সে সখী হবে । কিন্তু কোন শিশু যদি শৈশবে তার অভিভাবক বা প্রশিক্ষকের অবাধ্যতা করে , তাহলে সে মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে না এবং এর ফলে ভবিষ্যত জীবনে সে হতভাগ্য হবে । ঐসব আদেশ নিষেধের নিগূঢ়তত্ত ঐ শিশু বুঝুক অথবা নাই বুঝুক , ঐসবের আনুগত্যেই তার মঙ্গল নিহিত ।

একইভাবে মানবজাতিও সর্বস্রষ্টা আল্লাহর কাছে শিশুর মত । আল্লাহর আদেশ নিষেধের মর্ম সে উপলদ্ধি করুক অথবা নাই করুক , তা মানা বা না মানার উপরই তার পরকালীন জীবনের সুখ দুঃখ নির্ভরশীল । ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট ঔষধ-পথ্য গ্রহণ ও ব্যয়্যাম করার দায়িত্ব পালনই রোগীর একমাত্র দায়িত্ব । এভাবে ডাক্তারের নির্দেশ মেনে চলার মাধ্যমেই রোগীর দেহে শৃংখলা নেমে আসে এবং রোগী ক্রমেই রোমুক্ত হয়ে সুস্থ হয়ে ওঠে এবং এটাই তখন তার সুখের কারণ হয়ে দাড়ায় । মোটকথা , মানুষ তার এই বাহ্যিক জীবনের পাশাপাশি একটি আধ্যাত্মিক জীবনেরও অধিকারী । মানুষের ঐ আধ্যাত্মিক জীবনের প্রকৃতি তার কৃতকর্মের ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে এবং বিকাশ লাভ করে । আর তার পরকালীন জীবনের সকল সুখ ও দুঃখ সম্পূর্ণরূপে তার জীবনের ঐসব কৃতকর্মের উপরই নির্ভরশীল । পবিত্র কুরআনও উক্ত বুদ্ধিবৃত্তিগত যুক্তিকে সমর্থন করে । এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে অসংখ্য আয়াত রয়েছে ।

কুরআনের ঐসব আয়াতে সৎলোক ও আল্লাহতে বিশ্বাসীদের জন্যে এ পৃথিবীর জীবন ও বর্তমান আত্মার চেয়েও অনেক উন্নত ও উচ্চতর জীবন এবং উন্নত ও জ্যোতির্ময় আত্মার অধিকারী হওয়ার সসংবাদ দেয়া হয়েছে ।

পবিত্র কুরআন মানব জীবনের কৃতকর্ম সমূহের অদৃশ্য ফলাফলকে মানুষের নিত্যসঙ্গী হিসেবে বিশ্বাস করে । মহানবী (সা.)-এর হাদীসগুলোতেও এই অর্থই অসংখ্য বার উচ্চারিত হয়েছে ।165

দ্বিতীয়ত : প্রায়ই এমনটি ঘটতে দেখা যায় যে , অনেকেই হয়ত অন্যদেরকে কোন সৎ বা অসৎকাজের নির্দেশ দেয় , অথচ সে নিজে ঐসব কাজ করে না , কিন্তু আল্লাহর নবী , রাসূল বা ইমামগণের ক্ষেত্রে এমনটি কখনোই পরিলক্ষিত হবে না । কারণ , তারা সরাসরি আল্লাহর দ্বারা নির্দেশিত ও পরিচালিত । তারা মানুষকে যে দ্বীনের পথে পরিচালিত করেন এবং তার পথনির্দেশনা দেন , তারা নিজেরাও তা মেনে চলেন । তারা মানুষকে যে আধ্যাত্মিক জীবনের পথে পরিচালিত করেন , তাঁরা নিজেরাও ঐ আধ্যাত্মিক জীবনের অধিকারী । কারণ , মহান আল্লাহ যতক্ষণ পর্যন্ত স্বয়ং কাউকে হেদায়েত না করেন বা সৎপথে পরিচালিত না করবেন , ততক্ষণ পর্যন্ত অন্যদের সৎপথে পরিচালিত করার দায়িত্ব ভার তার উপর অর্পণ করেন না । আল্লাহর বিশেষ হেদায়েত কখনই ব্যর্থ হতে পারে না । উপরের আলোচনা থেকে আমরা নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি ।

1. বিশ্বের প্রতিটি জাতির মধ্যেই তাদের জন্যে প্রেরিত নবী-রাসূল বা ইমাম পূর্ণাঙ্গ দ্বীনি ও আধ্যাত্মিক জীবনের অধিকারী , যে জীবনাদর্শ অনুসরণের প্রতি তারা জনগণকে আহবান্ জানায় । আর ঐ আদেশের কার্যক্ষেত্রে (আমলের ব্যাপারে) তাঁরা অন্য সবার চেয়ে অগ্রগামী । কারণঃ নিজেদের প্রচারিত আদর্শকে অবশ্যই ব্যক্তি জীবনেও বাস্তবায়িত করতে হবে এবং আধ্যাত্মিক জীবনের অধিকারী হতে হবে ।

2. যেহেতু তারা অন্যদের তুলনায় অগ্রগামী এবং জনগণের পথ প্রদর্শক ও নেতা , তাই তারা অন্য সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও মহত্বের অধিকারী ।

3. যিনি মহান আল্লাহর নির্দেশে উম্মত বা জাতির নেতৃত্বের দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন , তিনি মানুষের বাহ্যিক কার্যক্রমের বিষয়ে যেমন নেতা ও পথপ্রদর্শক , তেমনি মানুষের আধ্যাত্মিক জীবন ও আধ্যাত্মিক বিষয়াদিরও নেতা ও পথ প্রদর্শক।166

ইমাম ও ইসলামের নেতৃবৃন্দ

পূর্বোক্ত আলোচনা সমূহের ভিত্তিতে এটাই পত্নীয়মান হয় যে , বিশ্বনবী (সা.)-এর তিরোধণের পর ইসলামী উম্মতের মাঝে আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত ইমামের (নেতা) অস্তিত্ব ছিল এবং থাকবে । এ ব্যাপারে বিশ্বনবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে অসংখ্য হাদীস167 বর্ণিত হয়েছে । ঐসব হাদীসে ইমামদের বৈশিষ্ট্য , পরিচিতি , সংখ্যা , ইত্যাদি বর্ণিত হয়েছে ।

এমনকি ইমামরা যে , সবাই কুরাইশ বংশীয় এবং মহানবী (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হবেন তাও বলা হয়েছে । সেখানে আরও বলা হয়েছে যে , পতীক্ষিত ইমাম হযরত মাহদী (আ.)-ই হবেন ইমামদের মধ্যে সর্বশেষ ইমাম । একইভাবে হযরত আলী (আ.)-এর প্রথম ইমাম হওয়ার ব্যাপারেও মহানবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে যথেষ্ট পরিমাণ হাদীস168 বর্ণিত হয়েছে । দ্বিতীয় ইমামের ইমামতের সমর্থনও মহানবী (সা.) ও হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর পক্ষ থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত অসংখ্য হাদীস রয়েছে । একইভাবে প্রত্যেক ইমাম তার পরবর্তী ইমামের ইমামতের সমর্থনে অকাট্য প্রমাণ্য দলিল রেখে গেছেন ।

উপরোক্ত হাদীসসমূহের দলিলের ভিত্তিতে ইমামদের মোট সংখ্যা বারজন । তাদের পবিত্র নামগুলো নিম্নরূপৃষ্ঠা

1. হযরত ইমাম আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)

2. হযরত ইমাম হাসান বিন আলী (আ.)

3. হযরত ইমাম হুসাইন বিন আলী (আ.)

4. হযরত ইমাম আলী বিন হুসাইন (আ.) [যয়নুল আবেদীন]

5. হযরত ইমাম মুহাম্মদ বিন আলী (আ.) [বাকের]

6. হযরত ইমাম জাফর বিন মুহাম্মদ (আ.) [জাফর সাদিক]

7. হযরত ইমাম মুসা বিন জাফর (আ.) [মুসা কাযিম]

8. হযরত ইমাম আলী বিন মুসা (আ.) [রেজা]

9. হযরত ইমাম মুহাম্মদ বিন আলী (আ.) [তাকী]

10. হযরত ইমাম আলী বিন মুহাম্মদ (আ.) [নাকী]

11. হযরত ইমাম হাসান বিন আলী (আ.) [আসকারী]

12. হযরত ইমাম মাহদী (আ.)

বারজন ইমামের সংক্ষিপ্ত জীবনী

প্রথম ইমাম

আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-ই সর্বপ্রথম ইমাম । তিনি মহানবী (সা.) এর চাচা এবং বনি হাশিম গোত্রের নেতা জনাব আবু তালিবের সন্তান ছিলেন । আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর এই চাচাই শৈশবেও তার অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেছিলেন । তিনি নিজের ঘরে মহানবী (সা.)-কে আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং লালন পালনের মাধ্যমে তাকে বড় করেছিলেন । মহানবী (সা.)এর নবুয়ত প্রাপ্তির ঘোষণার পর থেকে নিয়ে যত দিন তিনি (আবু তালিব) জীবিত ছিলেন , মহানবী (সা.)-কে সার্বিক সহযোগিতা ও সমর্থন করেছিলেন । তিনি সবসময়ই মহানবী (সা.)-কে কাফেরদের , বিশেষ করে কুরাইশদের সার্বিক অনিষ্ট থেকে রক্ষা করেছেন । হযরত ইমাম আলী (আ.) (প্রশিদ্ধ মতানুযায়ী) মহানবী (সা.)-এর নবুয়ত প্রাপ্তির ঘোষণার প্রায় দশ বছর পূর্বে জন্ম গ্রহণ করেন । হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর জন্মের প্রায় ছ বছর পর মক্কায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল । মহানবী (সা.)-এর আবেদনক্রমে ঐসময় হযরত আলী (আ.) বাবার বাড়ী থেকে মহানবী (সা.)-এর বাড়িতে স্থানান্তরিত হন । তারপর থেকে হযরত ইমাম আলী (আ.) সরাসরি মহানবী (সা.)-এর অভিভাবকত্ব ও তত্বাবধানে তাঁর কাছে লালিত পালিত ও প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হন ।169 মহানবী (সা.) হেরা গুহায় অবস্থানকালে তার কাছে সর্বপ্রথম আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী বা ঐশীবাণী অবতির্ণ হয় । যার ফলে তিনি নবুয়ত প্রাপ্ত হন । এরপর হেরা গুহা থেকে বের হয়ে মহানবী (সা.) নিজ গৃহে যাওয়ার পথে হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে তার সাক্ষাত ঘটে এবং তিনি তার কাছে সব ঘটনা খুলে বলেন । হযরত ইমাম আলী (আ.) সাথে সাথেই মহানবী (সা.)-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন ।170 অতঃপর নিকট আত্মীয়দেরকে ইসলাম গ্রহণের আহবান জানানোর উদ্দেশ্যে মহানবী (সা.) তাদের সবাইকে নিজ বাড়িতে খাওয়ার আমন্ত্রন জানিয়ে সমবেত করেন । ঐ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত সবার প্রতি লক্ষ্য করে মহানবী (সা.) বলেছিলেন যে , আপনাদের মধ্যে যে সর্বপ্রথম আমার আহবানে (ইসলাম গ্রহণে) সাড়া দেবে , সেই হবে আমার খলিফা , উত্তরাধিকারী এবং প্রতিনিধি । কিন্তু উপস্থিত অতিথিদের মধ্যে একমাত্র যে ব্যক্তিটি সর্বপ্রথম উঠে দাড়িয়ে সেদিন বিশ্বনবী (সা.)-এর আহবানে সাড়া দিয়েছিল এবং তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল তিনিই হচ্ছেন হযরত ইমাম আলী (আ.) । আর বিশ ্বনবী (সা.) সেদিন (তার প্রতি) হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর ঈমানকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং স্বঘোষিত প্রতিশ্রুতিও তিনি তার ব্যাপারে পালন করেছিলেন ।171 এভাবে হযরত ইমাম আলী (আ.)-ই ছিলেন সর্বপ্রথম মুসলিম । আর তিনিই সর্বপ্রথম ব্যক্তি , যিনি কখনই মূর্তি পুজা করেননি । মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় গমনের পূর্ব পর্যন্ত হযরত ইমাম আলী (আ.)-ই ছিলেন মহানবী (সা.)-এর নিত্যসঙ্গী । মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনা গমনের রাতে হযরত ইমাম আলী (আ.)-ই মহানবী (সা.) এর বিছানায় শুয়ে ছিলেন । ঐ রাতেই কাফেররা মহানবী (সা.) এর বাড়ী ঘেরাও করে শেষরাতের অন্ধকারে মহানবী (সা.)-কে বিছানায় শায়িত অবস্থায় হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল । মহানবী (সা.) কাফেরদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হবার পূর্বে ই গৃহত্যাগ করে মদীনার পথে পাড়ি দিয়েছিলেন ।172 এরপর হযরত ইমাম আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর নির্দেশ অনুযায়ী তার কাছে গচ্ছিত জনগণের আমানতের মালা- মাল তাদের মালিকদের কাছে পৌছে দেন । তারপর তিনিও নিজের মা , নবী কন্যা হযরত ফাতিমা (আ.) ও অন্য দু জন স্ত্রীলাক সহ মদীনার পথে পাড়ি দেন ।173 এমনকি মদীনাতেও হযরত ইমাম আলী (আ.)-ই ছিলেন মহানবী (সা.)-এর নিত্যসঙ্গী । নির্জনে অথবা জনসমক্ষে তথা কোন অবস্থাতেই মহানবী (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে নিজের কাছ থেকে দূরে রাখেননি । তিনি স্বীয় কন্যা হযরত ফাতিমা (আ.)-কেও হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর কাছেই বিয়ে দেন । সাহাবীদের উপস্থিতিতে মহানবী (সা.) , হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপনের ঘোষণা দেন ।174 একমাত্র তাবুকের যুদ্ধ ছাড়া বিশ্বনবী (সা.) (স্বীয় জীবদ্দশায়) যত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন , হযরত ইমাম আলী (আ.)-ও সেসব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন । তাবুকের যুদ্ধে যাওয়ার সময় বিশ্বনবী (সা.) হযরত ইমাম আলী (আ.)- কে মদীনায় তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নিযুক্ত করে গিয়েছিলেন ।175 এ ছাড়াও হযরত ইমাম আলী (আ.) কোন যুদ্ধেই আদৌ পিছপা হননি । জীবনে কোন শত্রুর মোকাবিলায় তিনি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেননি । তিনি জীবনে কখনোই মহানবী (সা.)-এর আদেশের অবাধ্যতা করেননি । তাই তার সম্পর্কে বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন যে , আলী কখনই সত্য থেকে অথবা সত্য আলী থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না ।176 বিশ্বনবী (সা.)-এর মৃত্যুর সময় হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বয়স ছিল প্রায় তেত্রিশ বছর । বিশ্বনবী (সা.)-এর সকল সাহাবীদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ এবং ইসলামের সকল মহত গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন তিনিই । সাহাবীদের মধ্যে হযরত ইমাম আলী (আ.) বয়সের দিক থেকে ছিলেন অপেক্ষাকৃত তরুণ । আর ইতিপূর্বে বিশ্বনবী (আ.)-এর পাশাপাশি অংশগ্রহণকৃত যুদ্ধসমুহে যে রক্তপাত ঘটেছিল , সে কারণে হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর প্রতি অনেকেই শত্রুতা পোষণ করত । এসব কারণেই বিশ্বনবী (সা.)-এর পরলোক গমনের পর হযরত আলী (আ.)-কে খেলাফতের পদাধিকার লাভ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল । আর এর মাধ্যমে সকল রাষ্ট্রিয় কাজ থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন । তাই বাধ্য হয়ে তখন তিনি নিরালায় জীবন যাপন করতে শুরু করেন এবং ব্যক্তি প্রশিক্ষণের কাজে নিজেকে ব্যপৃত করেন । মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর প্রায় 25 বছর পর তিনজন খলিফার শাসনামল শেষ হওয়া পর্যন্ত তিনি এভাবেই জীবন যাপন করতে থাকেন । তারপর তৃতীয় খলিফা নিহত হবার পর জনগণ হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর কাছে বাইয়াত (আনুগত্যের শপথ) গ্রহণ করেন এবং তাকে খেলাফতের পদে অধিষ্ঠিত করেন ।

হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর খেলাফতকাল ছিল প্রায় 4 বছর 9 মাস । তিনি তার এই খেলাফতের শাসন আমলে সম্পূর্ণরূপে মহানবী (সা.)-এর জীবনাদর্শ অনুসরণ করেন । তিনি তার খেলাফতকে আন্দোলনমুখী এক বিপ্লবীরূপ প্রদান করে ছিলেন । তিনি তার শাসন আমলে ব্যাপক সংস্কার সাধান করেন । অবশ্য ইমাম আলী (আ.)-এর ঐসব সংস্কারমূলক কর্মসূচী বেশকিছু সুবিধাবাদী ও স্বার্থান্বেষী ব্যক্তির ক্ষতির কারণ ঘটিয়ে ছিল । এ কারণে উম্মুল মু মিনীন আয়শা , তালহা , যুবাইর ও মুয়াবিয়ার নেতৃত্বে বেশকিছু সংখ্যক সাহাবী হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেন । তৃতীয় খলিফার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের দাবীর শ্লোগানকে তারা হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে একটি মোক্ষম রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যাবহার করে । আর তারা ইসলামী রাজ্যের সর্বত্র বিদ্রোহের আগুন প্রজ্জলিত করার মাধ্যমে এক ব্যাপক রাজনৈতিক অরাজকতার সৃষ্টি করে । যার ফলে উদ্ভুত ফিৎনা ও অরাজকতা দমনের জন্যে বসরার সন্নিকটে ইমাম আলী (আ.) নবীপ্রত্নি আয়শা , তালহা , ও যুবায়েরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতির্ণ হতে বাধ্য হন । ইসলামী ইতিহাসের ঐ যুদ্ধটিই জঙ্গে জামাল নামে পরিচিত । এ ছাড়াও ইরাক ও সিরিয়া সীমান্তে অনুরূপ কারণে মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে হযরত ইমাম আলী (আ.) সিফফিন নামক আরও একটি যুদ্ধে অবতির্ণ হতে বাধ্য হন । সিফফিন নামক ঐ যুদ্ধ দীর্ঘ দেড় বছর যাবৎ অব্যাহত ছিল । ঐ যুদ্ধ শেষ না হতেই নাহরাওয়ান নামক স্থানে খাওয়ারেজ (ইসলাম থেকে বহিস্কৃত) নামক বিদ্রোহিদের বিরুদ্ধে আরেকটি যুদ্ধ লিপ্ত হতে হয় । ঐ যুদ্ধিটি ইতিহাসে নাহরাওয়ানের যুদ্ধ নামে পরিচিত । এভাবে হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর সমগ্র খেলাফতকালই আভ্যন্তরীণ মতভেদ জনিত সমস্যা সমাধানের মধ্যেই অতিক্রান্ত হয় । এর কিছুদিন পরই 40 হিজরীর রমযান মাসের 19 তারিখে কুফার মসজিদে ফজরের নামাযের ইমামতি করার সময় জনৈক খারেজির তলোয়ারের আঘাতে তিনি আহত হন । অতঃপর 20শে রমযান দিবাগত রাতে তিনি শাহাদত বরণ করেন ।177 ইতিহাসের সাক্ষ্য এবং শত্রু ও মিত্র , উভয়পক্ষের স্বীকারোক্তি অনুসারে মানবীয় গুণাবলীর দিক থেকে আমিরুল মু মিনীন হযরত ইমাম আলী (আ.) ছিলেন সর্বশেষ্ঠ এবং এ ব্যাপারে সামান্যতম ক্রটির অস্তিত্বও তার চরিত্রে ছিল না । আর ইসলামে মহত গুণাবলীর দিক থেকে তিনি ছিলেন বিশ্বনবী (সা.)-এর আদর্শের এক পূর্ণাঙ্গ প্রতিভু ।

ইমাম আলী (আ.)-এর মহান ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে এ যাবৎ যত আলোচনা হয়েছে এবং শীয়া , সুন্নী , জ্ঞানী গুণী ও গবেষকগণ যে পরিমাণ গ্রন্থাবলী তার সম্পর্কে আজ পর্যন্ত রচনা করেছেন , ইতিহাসে এমনটি আর অন্য কারও ক্ষেত্রেই ঘটেনি । হযরত ইমাম আলী (আ.) ছিলেন সকল মুসলমান এবং বিশ্বনবী (সা.)-এর সাহাবীদের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানীব্যক্তি । ইসলামের ইতিহাসে তিনিই সর্বপ্রথম ব্যক্তি , যিনি তার অগাধ জ্ঞানগর্ভ বর্ণনার মাধ্যমে ইসলামে যুক্তিভিত্তিক প্রমাণ পদ্ধতির গোড়াপত্তন করেন । এভাবে তিনিই সর্বপ্রথম ইসলামী জ্ঞান ভান্ডারে দর্শন চর্চার মাত্রা যোগ্য করেন । তিনিই কুরআনের জটিল ও রহস্যপূর্ণ বিষয়গুলোর ব্যাখা করেন । কুরআনের বাহ্যিক শব্দাবলীকে বিকৃতির হাত থেকে রক্ষার জন্যে তিনি আরবী ভাষার ব্যাকরণ শাস্ত্র রচনা করেন । (এ বইয়ের প্রথম অধ্যায়েও এ সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে) বীরত্বের ক্ষেত্রেও হযরত আলী (আ.) ছিলেন মানবজাতির জন্য প্রতীক স্বরূপ । বিশ্বনবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় এবং তার পরেও জীবনে যত যুদ্ধেই তিনি অংশগ্রহণ করেছেন , কখনোই তাকে ভীত-সন্ত্রস্ত হতে বা মানসিক অস্থিরতায় ভূগতে দেখা যায়নি । এমনকি ওহুদ , হুনাইন , খান্দাক এবং খাইবারের মত কঠিন যুদ্ধগুলো যখন মহানবী (সা.)-এর সাহাবীদের অন্তরাত্মা কাপিয়ে দিয়েছিল এবং সাহাবীরা যুদ্ধক্ষেত্রে ছত্রভঙ্গ হয়ে ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন , সেই কঠিন মূহুর্তগুলোতেও হযরত ইমাম আলী (আ.) কখনোই শত্রুদের সম্মুখে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেননি । ইতিহাসে এমন একটি ঘটনাও খুজে পাওয়া যাবে না , যেখানে কোন খ্যাতিমান বীর যোদ্ধা ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে নিরাপদে নিজের প্রাণ নিয়ে ফিরতে পেরেছে । তিনি এমন মহাবীর হওয়া সত্ত্বেও কখনও কোন দূর্বল লোককে হত্যা করেননি এবং তার নিকট থেকে পালিয়ে যাওয়া (প্রাণ ভয়ে) ব্যক্তির পিছু ধাওয়া করেননি । তিনি কখনোই রাতের আধারে শত্রুর উপর অতর্কিত আক্রমন চালাননি । শত্রুপক্ষের জন্য পানি সরবরাহ কখনোই তিনি বন্ধ করেননি । এটা ইতিহাসের একটি সর্বজন স্বীকৃত ঘটনা যে , ইমাম আলী (আ.) খাইবারের যুদ্ধে শত্রুপক্ষের দূর্গম দূর্গের বিশাল লৌহ তোরণটি তাঁর হাতের সামান্য ধাক্কার মাধ্যমে সম্পূর্ণ রূপে উপড়ে ফেলেছিলেন ।178

একইভাবে মক্কা বিজয়ের দিন মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে ইমাম আলী (আ.) কা বা ঘরের মূর্তি গুলো ধ্বংস করেন । আকিক পাথরের তৈরী হাবল নামক মক্কার সর্ববৃহৎ মূর্তিটি কা বা ঘরের ছাদে স্থাপিত ছিল । ইমাম আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর কাধে পা রেখে কা বা ঘরের ছাদে উঠে একাই বৃহাদাকার মূর্তিটির মূলোৎপাটন করে নীচে নিক্ষেপ করেন ।179

খোদাভীতি ও আল্লাহর ইবাদতের ক্ষেত্রে ইমাম আলী (আ.) ছিলেন অনন্য । জনৈক ব্যক্তির প্রতি ইমাম আলী (আ.)-এর রূঢ় ব্যবহারের অভিযোগের উত্তরে মহানবী (সা.) তাকে বলেছিলেন যে , আলীকে তিরস্কার করো না । কেননা সে তো আল্লাহর প্রেমিক ।180 একবার রাসূল (সা.)-এর সাহাবী হযরত আবু দারদা (রা.) কোন এক খেজর বাগানে ইমাম আলী (আ.)-এর দেহকে শুষ্ক ও নিঃষ্প্রাণ কাঠের মত পড়ে থাকতে দেখেন । তাই সাথে সাথে নবীকন্যা হযরত ফাতিমা (আ.)-এর কাছে তার স্বামীর মৃত্যু সংবাদ পৌছালেন এবং নিজের পক্ষ থেকে শোকও জ্ঞাপন করেন । কিন্তু ঐ সংবাদ শুনে হযরত ফাতিমা (আ.) বললেন : না , আমার স্বামী মৃত্যু বরণ করেননি । বরং ইবাদত করার সময় আল্লাহর ভয়ে তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছেন । আর এ অবস্থা তার ক্ষেত্রে বহু বারই ঘটেছে । অধীনস্থদের প্রতি দয়াশীলতা , অসহায় ও নিঃস্বদের প্রতি ব্যথিত হওয়া এবং দরিদ্র ও অভাবীদের প্রতি পরম উদারতার ব্যাপার ইমাম আলী (আ.)-এর জীবনে অসংখ্য ঘটনার অস্তিত্ব বিদ্যমান । ইমাম আলী (আ.) যা-ই উপার্জন করতেন , তাই অসহায় ও দরিদ্রদেরকে সাহায্যের মাধ্যমে আল্লাহর পথে দান করতেন । আর তিনি ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত সহজ সরল ও কষ্টপূর্ণ জীবন যাপন করতেন । ইমাম আলী (আ.) কৃষি কাজকে পছন্দ করতেন । তিনি সাধারণতঃ পানির নালা কেটে সেচের ব্যবস্থা করতেন । বৃক্ষ রোপণ করতেন । চাষের মাধ্যমে মৃত জমি আবাদ করতেন । কিন্তু পানি সেচের নালা ও আবাদকৃত সব জমিই তিনি দরিদ্রদের জন্যে ওয়াকফ (দান) করতেন । হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর পক্ষ থেকে দরিদ্রদের জন্যে ওয়াকফ কৃত ঐসব সম্পত্তির বার্ষিক গড় আয়ের পরিমাণ 24 হাজার সোনার দিনারের সমতুল্য ছিল । তার ঐসব ওয়াকফ্ কৃত সম্পত্তি আলী (আ.)-এর সাদ্কা নামে খ্যাত ছিল ।181

দ্বিতীয় ইমাম

হযরত ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.) ছিলেন দ্বিতীয় ইমাম । তিনি আমিরুল মু মিনীন হযরত ইমাম আলী (আ.) এবং নবীকন্যা হযরত ফাতিমা (আ.)-এর প্রথম সন্তান এবং তৃতীয় ইমাম হযরত হুসাইন (আ.) এর ভাই ছিলেন । মহানবী (সা.) অসংখ্যবার বলেছেন : হাসান ও হুসাইন আমারই সন্তান । এমনকি হযরত ইমাম আলী (আ.) তার সকল সন্তানদের প্রতি লক্ষ্য করে একই কথার পুনারুক্তি করেছিলেন । তিনি বলেছেনঃ তোমরা আমার সন্তান এবং হাসান ও হুসাইন আল্লাহর নবীর সন্তান ।182 হযরত ইমাম হাসান (আ.) হিজরী 3য় সনে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন ।183 তিনি প্রায় সাত বছরেরও কিছু বেশী সময় মহানবী (সা.)-এর সাহচর্য লাভ করতে সক্ষম হন । তিনি বিশ্বনবী (সা.)-এর মৃত্যুর প্রায় তিন বা ছয় মাস পর যখন নবীকন্যা হযরত ফাতিমা (আ.) পরলোক গমন করেন , তখন তিনি তার মহান পিতা হযরত আলী (আ.)-এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হতে থাকেন । পিতার শাহাদতের পর মহান আল্লাহর নির্দেশে এবং পিতার ওসিয়াত অনুযায়ী তিনি ইমামতের পদে আসীন হন । অতঃপর তিনি প্রকাশ্যে খেলাফতের পদাধিকারীও হন । প্রায় 6মাস যাবৎ তিনি খলিফা হিসেবে মুসলমানদের রাষ্ট্রিয় কার্যক্রম পরিচালনা করেন । কিন্তু মুয়াবিয়া ছিলেন নবীবংশের চরম ও চিরশত্রু । ইসলামী রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় খেলাফতের মসনদ অধিকারের লাভে ইতিপূর্বে বহু যুদ্ধের সূত্রপাত সে ঘটিয়ে ছিল (প্রথমত : 3য় খলিফার রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণের ছলনাময়ী রাজনৈতিক শ্লোগানের ধোয়া তুলে এবং পরবর্তীতে সরাসরি খলিফা হওয়ার দাবী করে) । তখন ইরাক ছিল হযরত ইমাম হাসান (আ.)-এর খেলাফতের রাজধানী । মুয়াবিয়া হযরত ইমাম হাসান (আ.)-কে কেন্দ্রীয় খেলাফতের পদ থেকে অপসারণের লক্ষ্যে ইরাক সীমান্তে সেনাবাহিনী প্রেরণ করে । একইসাথে বিপুল পরিমাণ অর্থের ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে গোপনে ইমাম হাসান (আ.)-এর সেনাবাহিনীর বহু অফিসারকে ক্রয় করে । এমনকি ঘুষ ছাড়াও অসংখ্য প্রতারণামূলক লোভনীয় প্রতিশ্রুতি প্রদানের মাধ্যমে মুয়াবিয়া , ইমাম হাসান (আ.)-এর সেনাবাহিনীকে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘটাতে সক্ষম হয় ।184

যার পরিণামে হযরত ইমাম হাসান (আ.) মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হন । উক্ত চুক্তি অনুসারে হযরত ইমাম হাসান (আ.) প্রকাশ্যে খেলাফতের পদত্যাগ করতে বাধ্য হন । চুক্তির শর্ত অনুসারে মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পরপরই হযরত ইমাম হাসান (আ.) পুনরায় খলিফা হবেন এবং খেলাফতের পদ নবীবংশের নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে । আর এই অন্তর্বর্তী কালীন সময়ে মুয়াবিয়া শীয়াদের যে কোন প্রকারের রাষ্ট্রিয় নিপীড়ন থেকে বিরত থাকবে ।185 আর এভাবেই মুয়াবিয়া কেন্দ্রীয় খেলাফতের পদ দখল করতে সমর্থ হয় এবং ইরাকে প্রবেশ করে । কিন্তু ইরাকে প্রবেশ করে সে এক জনসভার আযোজন করে । ঐ জনসভায় প্রকাশ্যভাবে জনসমক্ষে সে ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে ইতিপূর্বে সম্পাদিত চুক্তিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পূর্ণ বাতিল বলে ঘোষণা করে ।186 আর তখন থেকেই সে পবিত্র আহলে বাইত (নবীবংশ) ও তাদের অনুসারী শীয়াদের উপর সর্বাত্মক অত্যাচার ও নিপীড়ন চালাতে শুরু করে । হযরত ইমাম হাসান (আ.) তার দীর্ঘ দশ বছর সময়কালীন ইমামতের যুগে শাসকগোষ্ঠির পক্ষ থেকে সৃষ্ট প্রচন্ড চাপের মুখে এক শ্বাসরূদ্ধকর পরিবেশে জীবন যাপন করতে বাধ্য হন । এমনকি নিজের ঘরের মধ্যকার নিরাপত্তাও তিনি হারাতে বাধ্য হন । অবশেষে হিজরী 50সনে মুয়াবিয়ার ষড়যন্তে ইমাম হাসান (আ.) জনৈকা স্ত্রীর দ্বারা বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি শাহাদত বরণ করেন ।187 মানবীয় গুণাবলীর শ্রেষ্ঠত্বের দিক দিয়ে হযরত ইমাম হাসান (আ.) ছিলেন স্বীয় পিতা ইমাম আলী (আ.) এর স্মৃতিচিহ্ন এবং স্বীয় মাতামহ মহানবী (সা.)-এর প্রতিভু । মহানবী (সা.) যতদিন জীবিত ছিলেন , হযরত ইমাম হাসান (আ.) ও হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) সবসময়ই তাঁর সাথে থাকতেন । এমনকি মহানবী (সা.) প্রায়ই তাদেরকে নিজের কাধেও চড়াতেন ।

শীয়া ও সুন্নী উভয় সূত্রে বর্ণিত একটি হাদীসে মহানবী (সা.) বলেছেন : আমার এই দু সন্তানই (ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন) ইমাম , তারা আন্দোলন করুকু অথবা না করুক , সব অবস্থাতেই তারা ইমাম (এখানে আন্দোলন বলতে প্রকাশ্যে খেলাফতের অধিকারী হওয়া বা না হওয়ার প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে)188 । এ ছাড়া হযরত ইমাম হাসান (আ.)-এর ইমামতের পদাধিকার লাভ সম্পর্কে মহানবী (সা.) এবং হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর পক্ষ থেকে অসংখ্য হাদীস বিদ্যমান রয়েছে ।

তৃতীয় ইমাম

শহীদকূলশিরোমণি হযরত ইমাম হুসাইন ( আ ) ছিলেন হযরত ইমাম আলী ( আ ) ও হযরত ফাতিমা ( আ ) - এর দ্বিতীয় সন্তান । তিনি চতুর্থ হিজরীতে জন্ম গ্রহণ করেন । বড় ভাই হযরত ইমাম হাসানের শাহাদতের পর তিনি মহান আল্লাহর নির্দেশে এবং ইমাম হাসান ( আ ) - এর ওসিয়ত ক্রমে 3য় ইমাম হিসেবে মনোনীত হন ।189 হযরত ইমাম হুসাইন ( আ ) - এর ইমামতকাল ছিল দশ বছর । তার ইমামতের শেষ 6মাস ছাড়া বাকী সমগ্র ইমামতকালই মুয়াবিয়ার খেলাফতের যুগেই কেটেছিল । তার ইমামতের পুরা সময়টাতেই তিনি অত্যন্ত কঠিন দূরযোগপূর্ণ ও শ্বাসরূদ্ধকর পরিবেশে জীবন যাপন করেন । কারণ , ঐযুগে ইসলামী আইন - কানুন মর্যাদাহীন হয়ে পড়েছিল । তখন খলিফার ব্যক্তিগত ইচ্ছাই আল্লাহ ও তার রাসূল ( সা ) - এর ইচ্ছার স্থলাভিষিক্ত হয়ে পড়ে । মুয়াবিয়া ও তার সঙ্গীসাথীরা পবিত্র আহলে বাইতগণ ( আ ) ও শীয়াদের ধ্বংস করা এবং ইমাম আলী ( আ ) ও তার বংশের নাম নিশ্চিহ্ন করার জন্যে এমন কোন প্রকার কর্মসূচী নেই যা অবলম্বন করেনি । শুধু তাই নয় মুয়াবিয়া স্বীয় পুত্র ইয়াযিদকে তার পরবর্তী খলিফা হিসেবে মনোনীত করার মাধ্যমে স্বীয় ক্ষমতার ভিত্তিকে আরও শক্তিশালী করে তোলে । কিন্তু ইয়াযিদের চরিত্রহীনতার কারণে একদল লোক তার প্রতি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট ছিল । তাই মুয়াবিয়া এ ধরণের বিরোধীতা রোধের জন্যে অত্যন্ত কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করে । ইচ্ছাকৃতভাবে হোক আর অনিচ্ছাকৃত ভাবেই হোক , হযরত ইমাম হুসাইন ( আ ) - কে এক অন্ধকারাচ্ছান্ন দূর্দিন কাটাতে হয়েছে । মুয়াবিয়া ও তার অনুচরদের পক্ষ থেকে সর্বপ্রকার মানসিক অত্যাচার তাকে নিরবে সহ্য করতে হয়েছিল । অবশেষে হিজরী 60 সনের মাঝামাঝি সময়ে মুয়াবিয়া মৃত্যু বরণ করে । তার মৃত্যুর পর তদীয় পুত্র ইয়াযিদ তার স্থলাভিষিক্ত হয় ।190 সে যুগে বাইয়াত (আনুগত্য প্রকাশের শপথ গ্রহণ ) ব্যবস্থা আরবদের মধ্যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রথা হিসেবে প্রচলিত ছিল । বিশেষ করে রাষ্ট্রিয়কার্য পরিচালনার দায়িত্বে নিযুক্তির মত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে বাইয়াত গ্রহণ করা হত । বিশেষ করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের পক্ষ থেকে রাজা বাদশা বা খলিফার প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশের জন্যে অবশ্যই বাইয়াত গ্রহণ করা হত । বাইয়াত প্রদানের পর তার বিরোধীতা করা বিরোধী ব্যক্তির জাতির জন্যে অত্যন্ত লজ্জাকর ও কলঙ্কের বিষয় হিসেবে গণ্য করা হত । এমনকি মহানবী ( সা ) - এর জীবনাদর্শে ও স্বাধীন ও ঐচ্ছিকভাবে প্রদত্ত বাইয়াতে র নির্ভরযোগ্যতার অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল । মুয়াবিয়াও তার জাতীয় প্রথা অনুযায়ী তার পরবর্তী খলিফা হিসেবে জনগণের কাছ থেকে স্বীয়পুত্র ইয়াযিদের জন্যে বাইয়াত সংগ্রহ করে । কিন্তু মুয়াবিয়া এ ব্যাপারে ইমাম হুসাইন ( আ ) - এর বাইয়াত গ্রহণের ব্যাপারে তাকে কোন প্রকার চাপ প্রয়োগ করেনি । শুধু তাই নয় , মৃত্যুর পূর্বে সে ইয়াযিদকে বিশেষভাবে ওসিয়াত করে গিয়েছিল191 যে , ইমাম হুসাইন ( আ ) যদি তার ( ইয়াযিদ ) আনুগত্য স্বীকার ( বাইয়াত ) না করে , তাহলে সে ( ইয়াযিদ ) যেন এ নিয়ে আর বেশী বাড়াবাড়ি না করে । বরং নীরব থেকে এ ব্যাপারটা যেন সে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করে । কারণঃ মুয়াবিয়া এ ব্যাপারে আদ্যোপান্ত চিন্তা করে এর দুঃসহ পরিণাম সম্পর্কে উপলদ্ধি করতে পরেছিল ।

কিন্তু ইয়াযিদ তার চরম অহংকার ও দুঃসাহসের ফলে পিতার ওসিয়তের কথা ভুলে বসল । তাই পিতার মৃত্যুর পর পরই সে মদীনার গভর্ণরকে তার (ইয়াযিদ) পক্ষ থেকে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কাছ থেকে বাইয়াত গ্রহণের নির্দেশ দিল । শুধু তাই নয় , ইমাম হুসাইন (আ.) যদি বাইয়াত প্রদান অস্বীকৃতি জানায় , তাহলে তৎক্ষণাৎ তার কর্তিত মস্তক দামেস্কে পাঠানোর জন্যেও মদীনার গভর্ণরের কাছে কড়া নির্দেশ পাঠানো হয় ।192

মদীনার প্রশাসক হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-কে যথা সময়ে ইয়াযিদের নির্দেশ সম্পর্কে অবহিত করেন । ইমাম হুসাইন (আ.) ঐ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে দেখার জন্যে কিছু অবসর চেয়ে নিলেন । আর ঐ রাতেই তিনি স্বপরিবারে মক্কার উদ্দেশ্যে মদীনা নগরী ত্যাগ করেন ।

মহান আল্লাহ ঘোষিত মক্কার হারাম শরীফের নিরাপত্তার বিধান অনুযায়ী তিনি সেখানে আশ্রয় নেন । সময়টা ছিল হিজরী 60 সনে রজব মাসের শেষ ও শা বান মাসের প্রথম দিকে । ইমাম হুসাইন (আ.) প্রায় চার মাস যাবৎ মক্কায় আশ্রিত অবস্থায় কাটান । আর ধীরে ধীরে এ সংবাদ তদানিন্তন ইসলামী বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে । মুয়াবিয়ার অত্যাচারমূলক ও অবৈধ শাসনে ক্ষিপ্ত অসংখ্য মুসলমান ইয়াযিদের এহেন কার্যকলাপে আরও অসন্তুষ্ট ও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল । তারা সবাই ইমাম হুসাইন (আ.)-এর প্রতি নিজেদের সহমর্মিতা প্রকাশ করল । পাশাপাশি ইরাকের বিভিন্ন শহর থেকে , বিশেষ করে ইরাকের কুফা শহর থেকে সেখানে গমনের আমন্ত্রনমূলক চিঠির বন্যা মক্কায় ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কাছে প্রবাহিত হতে লাগলো । ঐসব চিঠির বক্তব্য ছিল একটাই আর তা হল , ইমাম হুসাইন (আ.) যেন অনুগ্রহ পূর্বক ইরাকে গিয়ে সেখানকার জনগণের নেতৃত্বের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন এবং অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ব্যাপারে যেন তাদের নেতৃত্ব প্রদান করেন । এ বিষয়টি ইয়াযিদের জন্যে অবশ্যই অত্যন্ত বিপদজনক ব্যাপার ছিল । মক্কায় ইমাম হুসাইন (আ.)-এর অবস্থান হজ্জ মৌসুম শুরু হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে । সারা বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে মুসলমানরা দলে দলে হজ্জ উপলক্ষ্যে মক্কায় সমবেত হতে লাগল । হাজীরা সবাই হজ্জপর্ব সম্পূর্ণের জন্যে পস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে । ইতিমধ্যে গোপন সূত্রে ইমাম হুসাইন (আ.) অবগত হলেন যে , ইয়াযিদের পক্ষ থেকে বেশ কিছু অনুচর হাজীর বেশে মক্কায় প্রবেশ করেছে । ইহরামের কাপড়ের ভতর তারা অস্ত্র বহন করছে । তারা হজ্জ চলাকালীন সময়ে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-কে তাদের ইহরামের কাপড়ের ভেতর লুকানো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করবে ।193

ইমাম হুসাইন (আ.) ইয়াযিদের গোপন ষড়যন্ত্রের ব্যাপার টের পেয়ে স্বীয় কর্মসূচী সংক্ষিপ্ত করে মক্কা ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেন । এ সিদ্ধান্তের পর হজ্জ উপলক্ষ্যে আগত বিশাল জনগোষ্ঠীর সামনে তিনি সংক্ষিপ্ত এক বক্তব্য পেশ করেন ।194 ঐ বক্তব্যে তিনি ইরাকের পথে যাত্রা করার ব্যাপারে নিজ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করেন । একই সাথে তার আসন্ন শাহাদত প্রাপ্তির কথাও তিনি ঐ জনসভায় ব্যক্ত করেন । আর তাকে ঐ মহান লক্ষ্যে (অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ) সহযোগিতা করার জন্যে উপস্থিত মুসলমানদেরকে আহবান্ জানান । উক্ত বক্তব্যের পরপরই তিনি কিছু সংখ্যক সহযোগীসহ স্বপরিবারে ইরাকের পথে যাত্রা করেন ।

হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) কোন ক্রমেই ইয়াযিদের কাছে বাইয়াত প্রদান না করার জন্যে সুদৃঢ় সিদ্ধান্ত নেন । তিনি ভাল করেই জানতেন যে , এ জন্যে তাকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হবে । তিনি এটাও জানতেন যে , বনি উমাইয়াদের বিশাল ও ভয়ংকার যোদ্ধা বাহিনীর দ্বারা তাকে সম্পূর্ণ রূপে নিশ্চিহ্ন করা হবে । অথচ , ইয়াযিদের ঐ বাহিনী ছিল সাধারণ মুসলমানদের , বিশেষ করে ইরাকী জনগণেরই সমর্থনপুষ্ট । কেননা , সে যুগের সাধারণ মুসলমানদের বেশীর ভাগই গণদূর্নীতি , সিদ্ধান্ত গ্রহণে দুর্বলতা এবং চিন্তা ও চেতনাগত অধঃপতনে নিমজ্জিত ছিল ।

শুধুমাত্র সে যুগের অল্প ক জন গণ্যমান্য ব্যক্তি হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জ্ঞভাকাংখী হিসাবে ইরাক অভিমুখে যাত্রার ব্যাপারে তাকে বিরত রাখার চেষ্টা করেন । তারা ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ঐ যাত্রা ও আন্দোলনের বিপজ্জনক পরিণতির কথা তাকে স্মরণ করিয়ে দেন । কিন্তু তাদের প্রতিবাদের উত্তরে ইমাম হুসাইন (আ.) বলেন , আমি কোন অবস্থাতেই ইয়াযিদের বশ্যতা শিকার করব না । অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠিকে আমি কোন ক্রমেই সমর্থন করব না । আমি যেখানেই যাই না কেন , অথবা যেখানেই থাকি না কেন , তারা আমাকে হত্যা করবেই । আমি এ মূহুর্তে মক্কা নগরী এ কারণেই ত্যাগ করছি যে , রক্তপাত ঘটার মাধ্যমে আল্লাহর ঘরের পবিত্রতা যেন ক্ষুন্ন না হয় ।195

অতঃপর ইমাম হুসাইন (আ.) ইরাকের কুফা শহরের অভিমুখে রওনা হন । কুফা শহরে পৌছাতে তখনও বেশ ক দিনের পথ বাকী ছিল । এমন সময় পথিমধ্যে তার কাছে খবর পৌছাল যে , ইয়াযিদের পক্ষ থেকে নিযুক্ত কুফার প্রশাসক ইমাম হুসাইন (আ.)-এর প্রেরিত বিশেষ প্রতিনিধিকে হত্যা করেছে । একই সাথে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জনৈক জোরালো সমর্থক এবং কুফা শহরের একজন বিখ্যাত ব্যক্তিকেও হত্যা করা হয়েছে । এমনকি হত্যার পর তাদের পায়ে রশি বেধে কুফা শহরের সকল বাজার এবং অলি গলিতে টেনে হিছড়ে বেড়ানো হয়েছে ।196 এছাড়াও সমগ্র কুফা শহর ও তার পার্শ্বস্থ এলাকায় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে । অসংখ্য শত্রু সৈন্য ইমাম হুসাইন (আ.)-এর আগমনের প্রতিক্ষায় দিন কাটাচ্ছে । সুতরাং শত্রু হস্তে নিহত হওয়া ছাড়া ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জন্যে আর কোন পথই বাকী রইল না । তখন সবকিছু জানার পর ইমাম সুদৃঢ় ও দ্বিধাহীনভাবে শাহাদত বরণের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং কুফা র পথে যাত্রা অব্যাহত রাখলেন ।197

কুফা পৌছার প্রায় 70 কিঃ মিঃ পূর্বে কারবালা নামক মরুভুমিতে ইমাম পৌছলেন । তখনই ইয়াযিদের সেনাবাহিনী ইমাম হুসাইন (আ.) -কে ঐ মরু প্রান্তরে ঘেরাও করে ফেললো । ইয়াযিদ বাহিনী আটদিন পর্যন্ত ইমাম হুসাইন (আ.) ও তার সহচরদের সেখানে ঘেরাও করে রাখল । প্রতিদিনই তাদের ঘেরাওকৃত বৃত্তের পরিসীমা সংকীর্ণ হতে থাকে । আর শত্রু সৈন্য ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে লাগল । অবশেষে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) তার স্বীয় পরিবারবর্গ ও অতি নগণ্য সংখ্যক সহচরসহ তিরিশ হাজার যুদ্ধাংদেহী সেনাবাহিনীর মাঝে ঘেরাও হলেন ।198 হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) আটকাবস্থায় ঐ দিনগুলোতে স্বীয় অবস্থান সুদৃঢ় করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন । নিজের সহচরদের মধ্যে শুদ্ধিঅভিযান চালান । রাতের বেলা তার সকল সঙ্গীদেরকে বৈঠকে সমবেত করেন । ঐ বৈঠকে সমবেতদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত সংক্ষিপ্ত ভাষণে তিনি বলেন : মৃত্যু ও শাহাদত বরণ ছাড়া আমাদের সামনে আর কোন পথ নেই । আমি ছাড়া আর অন্য কারো সাথেই এদের (ইয়াযিদ বাহিনী) কোন কাজ নেই । আমি তোমাদের কাছ থেকে গৃহীত আমার প্রতি বাইয়াত (আনুগত্যের শপথ) এ মূহুর্ত থেকে বাতিল বলে ঘোষণা করছি । তোমাদের যে কেউই ইচ্ছে করলে রাতের এ আধারে এ স্থান ত্যাগ করার মাধ্যমে এই ভয়ংকর মৃত্যু কুপ থেকে নিজেকে মুক্তি দিতে পারে । ইমামের ঐ বক্তৃতার পর শিবিরের বাতি নিভিয়ে দেয়া হল । তখন পার্থিব উদ্দেশ্যে আগত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর অধিকাংশ সঙ্গীরাই রাতের আধারে ইমামের শিবির ছেড়ে পালিয়ে গেল । যার ফলে হাতে গোনা ইমামের অল্পকিছু অনুরাগী এবং বনি হাশিম গোত্রের অল্প ক জন ছাড়া ইমামের আর কোন সঙ্গী বাকী রইল না । ইমামের ঐসব অবশিষ্ট সঙ্গীদের সংখ্যা ছিল প্রায় 40 জন । অতঃপর ইমাম হুসাইন (আ.) পুনরায় তার অবশিষ্ট সঙ্গীদেরকে পরীক্ষা করার জন্যে সমবেত করেন । সমবেত সঙ্গী ও হাশেমীয় গোত্রের আত্মীয় স্বজনদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) বলেন : আমি ছাড়া তোমাদের কারো সাথে এদের কোন কাজ নেই । তোমাদের যে কেউ ইচ্ছে করলে রাতের আধারে আশ্রয় গ্রহণের (পালিয়ে যাওয়া) মাধ্যমে নিজেকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পার ।

কিন্তু এবার ইমামের অনুরাগী ভক্তরা একে একে সবাই দৃঢ় কন্ঠে জবাব দিল । তারা বললো , আমরা অবশ্যই সে সত্যের পথ থেকে বিমুখ হব না , যে পথের নেতা আপনি । আমরা কখনোই আপনার পবিত্র সহচর্য ত্যাগ করবো না । আমাদের হাতে যদি তলোয়ার থাকে , তাহলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ পর্যন্ত আপনার স্বার্থ রক্ষার্থে যুদ্ধ করে যাব ।199

ইমাম (আ.)-কে প্রদত্ত অবকাশের শেষ দিন ছিল মহররম মাসের 9 তারিখ । আজ ইমাম হুসাইন (আ.) কে ইয়াযিদের বশ্যতা স্বীকারের (বাইয়াত) ঘোষণা প্রদান করতে হবে অথবা ইয়াযিদ বাহিনীর সাথে যুদ্ধ লিপ্ত হতে হবে । শত্রু বাহিনীর পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে ইমামের জবাব চেয়ে পাঠানো হল । প্রত্যুত্তরে ইমাম (আ.) ঐ রাতে (9ই মহররমের দিবাগত রাত) সময় টুকু শেষ বারের মত ইবাদত করার জন্যে অবসর প্রদানের আবেদন করলেন । আর পর দিন ইয়াযিদ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতির্ণ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন ।200

হিজরী 61 সনের 10ই মহররম আশুরার দিন , ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বাহিনীর সদস্য সংখ্যা 90জনের চেয়েও কম । যাদের মধ্যে 40 জনই ইমামের পুরনো সঙ্গী । আর আনুমানিক 30জনেরও কিছু বেশী সৈন্য এক দিনে (1লা মহররম থেকে 10ই মহররম পর্যন্ত) ইয়াযিদের বাহিনী ত্যাগ করে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বাহিনীতে যোগদান করেছেন । আর অবশিষ্টরা ইমামের হাশেমী বংশীয় আত্মীয় স্বজন , ইমামের ভাই বোনরা ও তাদের সন্তানগণ , চাচাদের সন্তানগণ এবং তার নিজের পরিবারবর্গ । ইয়াযিদের বিশাল বাহিনীর মোকাবিলায় ইমাম হুসাইন (আ.) তার ঐ অতি নগন্য সংখ্যক সদস্যের ক্ষুদ্র বাহিনীকে যুদ্ধের জন্যে বিন্যস্ত করলেন । অতঃপর যুদ্ধ শুরু হল । সেদিন আশুরার সকাল থেকে শুরু করে সারাদিন যুদ্ধ চললো । ইমামের হাশেমী বংশীয় সকল যুবকই একের পর এক শাহাদত বরণ করলেন । ইমামের অন্যান্য সাথীরা একের পর এক সবাই শহীদ হয়ে গেলেন । ঐ সকল শাহাদত প্রাপ্তদের মাঝে ইমাম হাসান (আ.)-এর দু জন কিশোর পুত্র এবং স্বীয় ইমাম হুসাইন (আ.)-এর একজন নাবালক পুত্র ও একটি দুগ্ধ পোষ্য শিশু ছিলেন ।201 যুদ্ধ শেষে ইয়াযিদ বাহিনী ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পরিবারের মহিলাদের শিবির লুটপাট করার পর তাদের তাবুগুলোতে অগ্নি সংযোগ করে তা জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয় । তারা ইমামের বাহিনীর শহীদদের মাথা কটে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে । শহীদদের লাশগুলোকে তারা বিবস্ত্র করে । দাফন না করেই তারা লাশগুলোকে বিবস্ত্র অবস্থায় মাটিতে ফেলে রাখে । এরপর ইয়াযিদ বাহিনী শহীদদের কর্তিত মস্তকসহ ইমাম পরিবারের বন্দী অসহায় নারী ও কন্যাদের সাথে নিয়ে কুফা শহরের দিকে রওনা হল । ঐসব বন্দীদের মাঝে ইমাম পরিবারের পুরুষ সদস্যের সংখ্যা ছিল মাত্র অল্প ক জন । এদের একজন ছিলেন চরমভাবে অসুস্থ তিনি হলেন , হযরত ইমাম হুসাইনের 22 বছর বয়স্ক পুত্র হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) । ইনিই সেই চতুর্থ ইমাম । অন্য একজন ছিলেন ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.)-এর 4 বছর বয়স্ক পুত্র মুহাম্মদ বিন আলী । ইনিই হলেন পঞ্চম ইমাম হযরত বাকের (আ.) । আর তৃতীয় জন হলেন , হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জামাতা এবং হযরত ইমাম হাসান (আ.)-এর পুত্র হযরত হাসান মুসান্না (রহঃ) । তিনি চরমভাবে আহত অবস্থায় শহীদদের লাশের মাঝে পড়ে ছিলেন । তখনও তার শ্বাসক্রিয়া চলছিল । শহীদদের মাথা কাটার সময় ইয়াযিদ বাহিনীর জনৈক সেনাপতির নির্দেশে তার মাথা আর কাটা হয়নি । অতঃপর তাকেও সেখান থেকে উঠিয়ে নিয়ে বন্দীদের সাথে কুফার দিকে নিয়ে যাওয়া হল । তারপর কুফা থেকে সকল বন্দীকে দামেস্কে ইয়াযিদের দরবারের নিয়ে যাওয়া হয় ।

ইমাম পরিবারের নারী ও কন্যাদেরকে বন্দী অবস্থায় এক শহর থেকে অন্য শহরে ঘুড়িয়ে বেড়ানো হয় । পথিমধ্যে আমিরুল মু মিনীন ইমাম আলী (আ.)-এর কন্যা হযরত জয়নাব (আ.) ও ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) জনগণের উদ্দেশ্যে কারবালার ঐ মর্মান্ত্রিক ঘটনার ভয়াবহ বর্ণনা সম্বলিত মর্মস্পর্শী বক্তব্য রাখেন । কুফা ও দামেস্কে তাদের প্রদত্ত ঐ হৃদয়বিদারক গণভাষণ উমাইয়াদেরকে জনসমক্ষে যথেষ্ট অপদস্থ করে । যার ফলে মুয়াবিয়ার বহু বছরের অপপ্রচারের পাহাড় মূহুর্তেই ধুলিসাৎ হয়ে যায় । এমনকি শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে গিয়ে দাড়ালো যে , ইয়াযিদ তার অধীনস্থদের এহেন ন্যক্কারজনক কার্যকলাপের জন্যে বাহ্যিকভাবে জনসমক্ষে অসন্তুষ্টি প্রকাশে বাধ্য হয়েছিল । কারবালার ঐ ঐতিহাসিক মর্মান্তিক ঘটনা এতই শক্তিশালী ছিল যে , অদূর ভবিষ্যতে তারই প্রভাবে উমাইয়া গোষ্ঠি তাদের শাসনক্ষমতা থেকে চিরতরে উৎখাত হয়ে যায় । ঐতিহাসিক কারবালার ঘটনাই শীয়া সম্প্রদায়ের মূলকে অধিকতর শক্তিশালীভাবে প্রতিষ্ঠিত করে । শুধু তাই নয় , কারবালার ঐ ঘটনাকে কেন্দ্র করে একের পর এক বিদ্রোহ , বিপ্লব এবং ছোট বড় অনেক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও সংঘাত ঘটতে থাকে । এ অবস্থা প্রায় বার বছর যাবৎ অব্যাহত ছিল । শেষ পর্যন্ত ইমাম হুসাইন (আ.)-কে হত্যা করার সাথে জড়িত একটি ব্যক্তিও জনগণের প্রতিশোধের হাত থেকে প্রাণ নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়নি ।

হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জীবন ইতিহাস , ইয়াযিদ এবং তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে যার সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ জ্ঞান রয়েছে , তিনি নিঃসন্দেহে জানেন যে , সে দিন হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর সামনে শুধুমাত্র একটা পথই খোলা ছিল । আর তা ছিল শাহাদত বরণ । কেননা , ইয়াযিদের কাছে বাইয়াত প্রদান , প্রকাশ্যভাবে ইসলামকে পদদলিত করারই নামান্তর । তাই ঐ কাজটি ইমামের জন্যে আদৌ সম্ভব ছিল না । কারণ , ইয়াযিদ যে শুধুমাত্র ইসলামী আদর্শ ও ইসলামী আইন কানুনকে সম্মান করত না , তাই নয় ; বরং সে ছিল উচ্ছৃংখল চরিত্রের অধিকারী । এমনকি ইসলামের পবিত্র বিষয়গুলো এবং ইসলামী বিধানকে প্রকাশ্যে পদদলিত করার মত স্পর্ধাও সে প্রদর্শন করত । অথচ , ইয়াযিদের পূর্ব পুরুষরা ইসলামের বিরোধী থাকলেও তারা ইসলামী পরিচ্ছদের অন্তরালে ইসলামের বিরোধীতা করত । কিন্তু প্রকাশ্যভাবে তারা ইসলামকে সম্মান করত । তারা প্রকাশ্যে মহানবী (সা.)-কে সহযোগিতা করত এবং ইসলামের গণ্যমান্য ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সম্পর্কে বাহ্যত গর্ববোধ করত । কারবালার ইতিহাসের অন্য বিশ্লেষকই বলে থাকেন যে , ঐ দুই ইমামের [ইমাম হাসান (আ.) ও ইমাম হুসাইন (আ.)] মতাদর্শ ছিল দু ধরণের যেমন : ইমাম হাসান (আ.) প্রায় 40 হাজার সেনাবাহিনীর অধিকারী হয়েও মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি করেন । আর ইমাম হুসাইন (আ.) মাত্র 40 জন অনুসারী নিয়েই ইয়াযিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে: অবতির্ণ হন । কিন্তু ইতোপূর্বের আলোচনা থেকে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে , এ ধরণের মন্তব্য সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন । কারণ , ইমাম হুসাইন (আ.) , যিনি মাত্র একটি দিনের জন্যেও ইয়াযিদের বশ্যতা স্বীকার করেননি , সেই তিনিই ইমাম হাসান (আ.)- এর পরপর দীর্ঘ দশ বছর যাবৎ মুয়াবিয়ার শাসনাধীনে সন্ধিকালীন জীবন যাপন করেন । ঐ সময় তিনি প্রকাশ্যে প্রশাসনের বিরুদ্ধে কোন বিদ্রোহ করেননি । প্রকৃতপক্ষে , ইমাম হাসান (আ.) এবং ইমাম হুসাইন (আ.) যদি সেদিন মুয়াবিয়ার সংগে যুদ্ধে অবতির্ণ হতেন , তাহলে অবশ্যই তারা নিহত হতেন । আর এর ফলে ইসলামের এক বিন্দু মাত্র উপকারও হত না । কেননা , মুয়াবিয়ার কপটতাপূর্ণ রাজনীতির কারণে , বাহ্যত তাকেই সত্য পথের অনুসারী বলে মনে হত । এছাড়া মুয়াবিয়া নিজেকে রাসূল (সা.)-এর সাহাবী , ওহী লেখক এবং মু মিনদের মামা (মুয়াবিয়ার জনৈকা বোন রাসূলের স্ত্রী ছিলেন) হিসেবে জনসমক্ষে প্রচার করে বেড়াত । আপন স্বার্থ উদ্ধারের প্রয়োজনে এমন কোন চক্রান্ত নেই যা সে অবলম্বন করেনি । এমতাবস্থায় মুয়াবিয়ার এহেন প্রতারণামূলক রাজনীতির মোকাবিলায় ইমাম হাসান (আ.) বা ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কোন কর্মসূচীই ফলপ্রসূ হত না ।

মুয়াবিয়া এতই চতুর ছিল যে , সে অতি সহজেই লোক লাগিয়ে ইমামদের হত্যা করত । আর সে নিজেই নিহত ইমামদের জন্যে প্রকাশ্যে শোক অনুষ্ঠানের নেতৃত্ব দিত । কেননা , একই কর্মসূচী সে তৃতীয় খলিফার ক্ষেত্রেও বাস্তবায়িত করেছিল ।

চতুর্থ ইমাম

তৃতীয় ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পুত্র হযরত আলী বিন হুসাইন (আ.) হলেন চতুর্থ ইমাম । তার প্রসিদ্ধ উপাধি হল সাজ্জাদ ও জয়নুল আবেদীন । আর এ দুটো নামেই (উপাধি) তিনি অধিক পরিচিত । তার মা হলেন ইরানের ইয়াযদগের্দের রাজকন্যা । হযরত ইমাম সাজ্জাদই (আ.) ছিলেন ইমাম হুসাইন (আ.)-এর একমাত্র জীবিত পুত্র । কারণ , ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর অন্য তিন ভাই কারবালায় শাহাদৎ বরণ করেন ।202

অবশ্য হযরত ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-ও পিতার সাথে কারবালায় উপস্থিত ছিলেন । কিন্তু তিনি সেখানে ভীষণভাবে অসুস্থ ছিলেন । যার ফলে অস্ত্র বহন বা যুদ্ধ করার মত দৈহিক সামর্থ তখন তার মোটেই ছিল না । তাই তিনি জিহাদে অংশ গ্রহণ বা শাহাদত বরণ করতে পারেননি । যুদ্ধশেষে ইমাম পরিবারের নারী ও কন্যাদের সাথে বন্দী অবস্থায় তাকে দামেস্কে পাঠানো হয় । তারপর সেখানে কিছুদিন বন্দী জীবন কাটানোর পর গণসন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে ইয়াযিদের নির্দেশে সসম্মানে তাকে মদীনায় পা ঠানো হয় । পরবর্তীতে আব্দুল মালেক নামক জনৈক উমাইয়া খলিফার নির্দেশে চতুর্থ ইমামকে পুনরায় বন্দী করে শিকল দিয়ে হাত পা বেধে দামেস্কে পাঠানো হয় । অবশ্য দামেস্ক থেকে আবার তাকে মদীনায় ফেরৎ পাঠানো হয় ।203

চতুর্থ ইমাম হযরত জয়নুল আবেদীন (আ.) মদীনায় ফেরার পর ঘরকুণো জীবন যাপন করতে শুরু করেন । অপরিচিতদেরকে সাক্ষাত প্রদান থেকে তিনি বিরত থাকেন । তখন থেকেই সর্বক্ষণ তিনি নিজেকে আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে ব্যস্ত রাখেন । হযরত আবু হামজা সামালী (রা.) ও হযরত আবু খালেদ কাবুলীর (রা.) মত বিশিষ্ট শীয়া ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারও সাথেই তিনি যোগাযোগ করতেন না । ইমামের ঐ বিশিষ্ট সাহাবীরা তার কাছ থেকে যেসব জ্ঞান আরহণ করতেন , তা তারা শীয়াদের মধ্যেই বিতরণ করতেন । এভাবে শীয়া মতাদর্শের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে । আর এর প্রভাব পরবর্তীতে পঞ্চম ইমামের যুগে প্রকাশিত হয় । সাহিফাতুস সাজ্জাদিয়াহ নামক চতুর্থ ইমামের দোয়ার সংকলন তার অবদান সমূহের অন্যতম । এই ঐতিহাসিক দোয়ার গ্রন্থটিতে 57টি দোয়া রয়েছে । যার মধ্যে ইসলামের সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ জ্ঞান রয়েছে । এই গ্রন্থ কে মহানবী (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতের যাবুর (হযরত দাউদের (আ.) কাছে অবতির্ণ ঐশী গন্থ) বলে অভিহিত করা হয় । বেশকিছু শীয়া সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) 35 বছর যাবৎ ইমামতের দায়িত্ব পালন করেন । এরপর উমাইয়া খলিফা হিশামের প্ররোচণায় ওয়লিদ। ইবনে আব্দুল মালেক নামক জনৈক ব্যক্তি বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে ইমাম (আ.)-কে হত্যা করে ।204 এভাবে হিজরী 95 সনে ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) শাহাদত বরণ করেন ।

পঞ্চম ইমাম

হযরত মুহাম্মদ বিন আলী ওরফে বাকের (আ.) হলেন পঞ্চম ইমাম । বাকের অর্থ পরিস্ফুটনকারী । মহানবী (সা.) স্বয়ং তাকে এই উপাধিতে ভূষিত করেন ।205 তিনি ছিলেন চতুর্থ ইমাম হযরত জয়নুল আবেদীন (আ.)-এর পুত্র । তিনি হিজরী 57 সনে জন্মগ্রহণ করেন । ঐতিহাসিক কারবালার ঘটনার সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র চার বছর । কারবালায় তিনি স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন । পিতার মৃত্যুর পর মহান আল্লাহর নির্দেশে এবং পূর্ব পুরুষদের ওসিয়তের মাধ্যমে তিনি ইমামতের আসনে সমাসীন হন ।

হিজরী 114 অথবা 117 সনে (কিছু শীয় বর্ণনা অনুযায়ী) উমাইয়া খলিফা হিশামের ভ্রাতুষ্পুত্র ইব্রাহীম বিন ওয়লিদ বিন আব্দুল মালেকের দ্বারা বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি শাহাদত বরণ করেন ।206

পঞ্চম ইমামের যুগে ইসলামী খেলাফতের বিভিন্ন অঞ্চলে উমাইয়া শাসক গোষ্ঠির অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রায় প্রতিদিন গণঅভ্যুত্থান ও যুদ্ধ সংঘটিত হতে থাকে । এমনকি স্বয়ং উমাইয়া পরিবারের মধ্যেও মতভেদ শুরু হয় । এ সব সমস্যা উমাইয়া প্রশাসনকে এতই ব্যস্ত রাখে যে , পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) প্রতি সদাসতর্ক দৃষ্টি দেয়ার সুযোগ তাদের তেমন একটা হয়ে উঠতো না । যার ফলে পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) প্রতি তাদের অত্যাচারের মাত্রা অনেকটা কমে যায় । এছাড়া কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা এবং পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) নির্যাতিত অবস্থা জনগণের হৃদয়ের আবেগ অনুভুতিকে ভীষণভাবে আন্দোলিত করেছিল । আর চতুর্থ ইমাম ছিলেন কারবালার সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার অন্যতম সাক্ষী । এর ফলে ক্রমেই মুসলমানরা পবিত্র আহলে বাইতগণের প্রতি আকৃষ্ট ও অনুরক্ত হয়ে পড়েন । এ সব কারণে , পঞ্চম ইমামের দর্শন লাভের সৌভাগ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে মদীনায় জনগণ এবং বিশেষ করে শীয়াদের গণস্রোতের ঢল নামে । যার ফলে ইসলামের প্রকৃত জ্ঞান ও পবিত্র আহলে বাইতের শিক্ষার প্রচার ও প্রসারের ব্যাপক সুযোগ ইমাম বাকের (আ.)-এর জন্যে সৃষ্টি হয় । এমনকি তার পূর্ববতী ইমামগণের (আ.) জীবনেও এমন সুবর্ণ সুযোগ কখনও আসেনি । এ যাবৎ প্রাপ্ত অসংখ্য হাদীসই এ বক্তব্যের উত্তম সাক্ষী । শীয়া সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট জ্ঞানী গুণী , পণ্ডিত ও ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিশেষজ্ঞ অসংখ্য বিখ্যাত আলেমই হযরত ইমাম বাকেরর (আ.) পবিত্র জ্ঞান নিকেতনে প্রতিপালিত ও শিক্ষিত হয়েছেন । ঐসব বিশ্ববিখ্যাত আলেম ও পণ্ডিতগণের পূর্ণ পরিচিতি রিজাল (ইসলামী ঐতিহাসিক জ্ঞানী গুণীদের পরিচিতি শাস্ত্র) শাস্ত্রের গ্রন্থ সমূহে উল্লেখিত আছে ।207

ষষ্ঠ ইমাম

পঞ্চম ইমামের পুত্র হযরত জাফর বিন মুহাম্মদ আস্ সাদেক (আ.) ছিলেন ষষ্ঠ ইমাম । তিনি হিজরী 83 সনে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি হিজরী 148 সনে (শীয়া সূত্রে বর্ণিত হাদীস অনুসারে) আব্বাসীয় খলিফা মানসুরের চক্রান্তে বিষ প্রয়োগের ফলে শাহাদত বরণ করেন ।208 ষষ্ঠ ইমামের ইমামতের যুগে তদানিন্তন ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একের পর এক উমাইয়া শাসক গোষ্ঠির বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান ঘটেছিল । ঐসবের মধ্যে উমাইয়া শাসক গোষ্ঠিকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে মুসাওয়াদাহু বিদ্রোহের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । কেননা , ঐ বিদ্রোহের মাধ্যমেই উমাইয়া শাসকগোষ্ঠি সম্পূর্ণরূপে ক্ষমতাচ্যুত হয় । এছাড়াও ঐসময়ে সংঘটিত বেশকিছু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধও উমাইয়া খেলাফতের পতনের কারণ ঘটিয়েছিল । পঞ্চম ইমাম তার দীর্ঘ বিশ বছরের ইমামতের যুগে উমাইয়া খেলাফতের বিশৃংখল ও অরাজক রাজনৈতিক পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করেন । এর মাধ্যমে তিনি জনগণের মাঝে ইসলামের প্রকৃত জ্ঞান ও পবিত্র আহলে বাইতের পবিত্র শিক্ষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার করেন । এভাবে প্রকৃতপক্ষে ইসলামের জ্ঞান শিক্ষা দেয়া এবং তার প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে ষষ্ঠ ইমাম হযরত জাফর সাদেক (আ.)-এর জন্যে এক চমৎকার ও উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয় ।

ষষ্ঠ ইমামের ইমামতের যুগটি ছিল উমাইয়া খেলাফতের শেষ ও আব্বাসীয় খেলাফতের শুরুর সন্ধিক্ষণ । হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) ঐ সুবর্ণ সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন এবং ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের প্রয়াস পান । ইসলামী ইতিহাসের অসংখ্য বিখ্যাত পণ্ডিত ও ইসলামের বিভিন্ন শাখায় বিশেষজ্ঞ আলেমগণ তার কাছেই প্রশিক্ষণপ প্রাপ্ত হয়েছেন । যাদের মধ্যে জনাব যরারাহ , মুহাম্মদ বিন মুসলিম , মুমিন তাক , হিশাম বিন হাকাম , আবান বিন তাগলুব , হিশাম বিন সালিম , হারিয , হিশাম কালবী নাসাবাহ , জাবের বিন হাইয়্যান সুফীর (রসায়নবিদ) নাম উল্লেখযোগ্য । এ ছাড়াও আহলে সুন্নাতের অসংখ্য বিখ্যাত আলেমগণও তার শিষ্যত্ব বরণের মাধ্যমে ইসলামী পাণ্ডিত্য অর্জন করেন । যাদের মধ্যে হানাফী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবু হানিফা , সুফিয়ান সাওরী , কাযী সাকুনী , কাযী আব্দুল বাখতারী , প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য , যারা ষষ্ঠ ইমামের শিষ্যত্ব বরণের সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন । হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর কাছে শিক্ষাপ্রাপ্ত শিষ্যদের মধ্যে ইতিহাস বিখ্যাত প্রায় 14 হাজার মুহাদ্দিস (হাদীস বিশারদ) ও ইসলামী পন্ডিতের নাম উল্লেখযোগ্য ।209 হযরত ইমাম বাকের (আ.) ও হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর দ্বারা বর্ণিত হাদীস সমূহের পরিমাণ , মহানবী এবং অন্য দশ ইমামের বর্ণিত হাদীসসমূহের চেয়ে অনেক বেশী ।

কিন্তু হযরত জাফর সাদেক (আ.) তাঁর ইমামতের শেষ পর্বে এসে আব্বাসীয় খলিফা মানসুরের কু-দৃষ্টির শিকার হন । খলিফা মানসুর তাকে সদা কড়া পাহারা , নিয়ন্ত্রণ ও সীমাবদ্ধতার মাঝে বসবাস করতে বাধ্য করেন । আব্বাসীয় খলিফা মানসুর নবীবংশের সাইয়্যেদ বা আলাভীদের উপর অসহ্য নির্যাতন চালাতে শুরু করেন । তার ঐ নির্যাতনের মাত্রা উমাইয়া খলিফাদের নিষ্ঠুরতা ও বিবেকহীন স্পর্ধাকেও হার মানিয়ে দেয় । খলিফা মানসুরের নির্দেশে নবীবংশের লোকদের দলে দলে গ্রেপ্তার করে জেলে ভরা হত । অন্ধকারাচ্ছান্ন জেলের মধ্যে তাদের উপর সম্পূর্ণ অমানবিকভাবে অকথ্য নির্যাতন চালানো হয় । নির্যাতনের মাধ্যমে তিলেতিলে তাদের হত্যা করা হত । তাদের অনেকের শিরোচ্ছেদও করা হয়েছে । তাদের বহুজনকে আবার জীবন্ত কবর দেয়া হত । তাদের অনেকের দেহের উপর দেয়াল ও অট্রালিকা নির্মাণ করা হত ।

খলিফা মানসুর হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-কে মদীনা ত্যাগ করে তার কাছে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ জারী করে । অবশ্য হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) ইতিপূর্বে একবার আব্বাসীয় খলিফা সাফ্ফাহ-র নির্দেশে তার দরবারের উপস্থিত হতে বাধ্য হয়েছিলেন । এছাড়াও তার পিতার (পঞ্চম ইমাম) সাথে একবার উমাইয়া খলিফা হিশামের দরবারের তাকে উপস্থিত হতে হয়েছিল । খলিফা মানসুর বেশ কিছুকাল যাবৎ ষষ্ঠ ইমামকে কড়া পাহারার মাঝে নজরবন্দী করে রাখেন । খলিফা মানসুর বহুবার ইমামকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল । সে ইমামকে বহুবারই অপদস্থ করেছিল । অবশেষে সে ইমামকে মদীনায় ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয় । ইমাম মদীনায় ফিরে যান । ইমাম তার জীবনের বাকী সময়টুকু অত্যন্ত কঠিন তাকীয়ার মাঝে অতিবাহিত করেন । তখন থেকে তিনি স্বেচ্ছায় গণসংযোগবিহীন ঘরকুণো জীবন যাপন করতে শুরু করেন । এরপর এক সময় খলিফা মানসুরের ষড়যন্ত্রে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে ইমামকে শহীদ করা হয় ।210

মানসুর ষষ্ঠ ইমামের শাহাদতের সংবাদ পেয়ে মদীনার প্রশাসককে চিঠি মারফৎ একটি নির্দেশ পাঠালো । ঐ লিখিত নির্দেশে বলা হয়েছে , মদীনার প্রশাসক ষষ্ঠ ইমামের শোকার্ত পরিবারের প্রতি সান্তনা জ্ঞাপনের জন্যে যেন তাঁর বাড়িতে যায় । অতঃপর সে যেন ইমামের ওসিয়ত নামা (উইল) তার পরিবারের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে তা পড়ে দেখে । ইমামের ওসিয়ত নামায় যাকে তার পরবর্তী ইমাম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে , তাকে (পরবর্তী ইমাম) যেন তৎক্ষণাৎ সেখানেই শিরোচ্ছেদ করা হয় । এই নির্দেশ জারীর ব্যাপারে মানসুরের মূল উদ্দেশ্য ছিল এর মাধ্যমে ইমামতের বিষয়টি চিরতরে নিঃশেষ করে দেয়া । কেননা এর ফলে শীয়াদের প্রাণ প্রদীপ চিরতরে নিভে যাবে । খলিফার নির্দেশ অনুসারে মদীনার প্রশাসক ইমামের বাড়িতে গিয়ে তার ওসিয়ত নামা চেয়ে নেয় । কিন্তু তা পড়ার পর সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে । কারণ , ঐ ওসিয়ত নামায় ইমাম পাঁচ ব্যক্তিকে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত ও ঘোষণা করেছেন । ঐ পাঁচ ব্যক্তি হচ্ছেন : স্বয়ং মানসুর , মদীনার প্রশাসক , ইমামের সন্তান আব্দুল্লাহ আফতাহ্ , ইমামের ছোট ছেলে মুসা কাজেম এবং হামিদাহ । এ ধরণের অপ্রত্যাশিত ঘটনার কারণে খলিফার সকল ষড়যন্ত্র ধুলিষ্যাৎ হয়ে গেল ।211

সপ্তম ইমাম

ষষ্ঠ ইমামের পুত্র হযরত মুসা বিন জাফরই (কাযিম) (আ.) ছিলেন সপ্তম ইমাম । তিনি হিজরী 128 সনে জন্ম গ্রহণ করেন এবং হিজরী 183 সনে জেলে বন্দী অবস্থায় বিষ প্রয়োগের ফলে শাহাদত বরণ করেন ।212 পিতার মৃত্যুর পর মহান আল্লাহর নির্দেশে এবং পূর্ববতী ইমামগণের ওসিয়ত অনুযায়ী ইমামতের পদে আসীন হন । সপ্তম ইমাম হযরত মুসা কাযিম (আ.) আব্বাসীয় খলিফা মানসুর , হাদী , মাহদী , এবং হারুনুর রশিদের সমসাময়িক যুগে বাস করতেন । তার ইমামতের কালটি ছিল অত্যন্ত অন্ধকারাচ্ছান্ন ও সুকঠিন যার ফলে তাকিয়া নীতি অবলম্বনের মাধ্যমে তার জীবনকাল অতিবাহিত হয় । অবশেষে খলিফা হারুনুর রশিদ হজ্জ উপলক্ষ্যে মদীনায় গিয়ে ইমামকে বন্দী করে । খলিফা হারুনের নির্দেশে মসজিদে নববীতে নামাযরত অবস্থায় ইমামকে গ্রেপ্তার ও শিকল পরানো হয় । শিকল পরানো অবস্থাই ইমামকে মদীনা থেকে বসরায় এবং পরে বাগদাদে বন্দী হিসেবে স্থানান্তর করা হয় । ইমামকে বহু বছর একাধারে জেলে বন্দী অবস্থায় রাখা হয় । এসময় তাকে একের পর এক বিভিন্ন জেলে স্থানান্তর করা হয় । অবশেষে সিন্দি ইবনে শাহেক নামক বাগদাদের এক জেলে বিষ প্রয়োগের ফলে তিনি শাহাদত বরণ করেন ।213 অতঃপর মাকাবিরে কুরাইশ নামক স্থানে তাকে দাফন করা হয় । ঐ স্থানের বর্তমান নাম কাযেমাইন নগরী ।

অষ্টম ইমাম

সপ্তম ইমামের পুত্র হযরত আলী বিন মুসা আর রেযা (আ.)-ই হলেন অষ্টম ইমাম । তিনি হিজরী 148 সনে জন্মগ্রহণ করেন এবং হিজরী 203 সনে তিনি শাহাদত বরণ করেন ।214 পিতার মৃত্যুর পর মহান আল্লাহর নির্দেশে ও পূর্ববতী ইমামদের নির্দেশনায় তিনি ইমামতের আসনে সমাসীন হন । আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশিদের পুত্র খলিফা আমিনের এবং তার অন্য আর এক পুত্র খলিফা মামুনুর রশিদের শাসনামলেই অষ্টম ইমামের ইমামতকাল অতিবাহিত হয় । পিতার মৃত্যুর পর মামুনুর রশিদের সাথে তার ভাই খলিফা আমিনের মতভেদ শুরু হয় । তাদের ঐ মতভেদ শেষ পর্যন্ত একাধিক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায় । অবশেষে খলিফা আমিনের নিহত হওয়ার মাধ্যমে ঐ সব রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান ঘটে । আর এর ফলে মামুনুর রশিদ খেলাফতের সিংহাসনে আরোহণ করতে সমর্থ হয় ।215 মামুনুর রশিদের যুগ পর্যন্ত আলাভী (রাসূল বংশের লোক) সৈয়দদের ব্যাপারে আব্বাসীয় খেলাফত প্রশাসনের নীতি ছিল আক্রোশমূলক ও রক্তলোলুপ । নবীবংশের প্রতি তাদের গৃহীত ঐ হিংসাত্মক নীতি দিনদিন কঠোরতর হতে থাকে । তৎকালীন রাজ্যের কোথাও কোন আলাভী (নবীবংশের লোক) বিদ্রোহ করলেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও মহাবিশৃংখলার সৃষ্টি হত । যে বিষয়টি স্বয়ং রাষ্ট্রিয় প্রশাসনের জন্যেও এক জটিল সমস্যার সৃষ্টি করত । পবিত্র আহলে বাইতের ইমামগণ ঐসব আন্দোলন ও বিদ্রোহের ব্যাপারে আদৌ কোন সহযোগিতা বা হস্তক্ষেপ করতেন না । সেসময় আহলে বাইতের অনুসারী শীয়া জনসংখ্যা ছিল যথেষ্ট লক্ষণীয় । নবীবংশের ইমামগণকে (আ.) তারা তাদের অবশ্য অনুকরণীয় দ্বীনি নেতা এবং মহানবী (সা.)-এর প্রকৃত প্রতিনিধি বা খলিফা হিসেবে বিশ্বাস করত । সেযুগে খেলাফত প্রশাসন কায়সার ও কায়সার রাজ দরবার সদৃশ্য ছিল । ঐ খেলাফত প্রশাসন তখন মুষ্টিমেয় চরিত্রহীন লোকদের দ্বারা পরিচালিত হত । শীয়াদের দৃষ্টিতে তা ছিল এক অপবিত্র প্রশাসন যা তাদের ইমামদের পবিত্রাংগন থেকে ছিল অনেক দূরে । এ ধরণের পরিবেশের অগ্রগতি খেলাফত প্রশাসনের জন্যে ছিল বিপদজনক এক প্রতিবন্ধক , যা খেলাফতকে প্রতিনিয়তই হুমকির সম্মুখীন করছিল । ঐ ধরণের শ্বাসরুকর পরিবেশ থেকে খেলাফত প্রশাসনকে উদ্ধারের জন্যে খলিফা মামুনুর রশিদ ভীষণভাবে চিন্তিত হল । খলিফা মামুন লক্ষ্য করল , 70 বছর যাবৎ আব্বাসীয় খেলাফত মরচে পড়া ঐ রাজনৈতিক পরিস্থিতি উন্নয়নে ব্যর্থতারই প্রমাণ দিয়েছে । বাপ দাদার আমল থেকে চলে আসা ঐ রাজনীতি সংস্কারের মধ্যেই সে ঐ দূরাবস্থার চির অবসান খুজে পেল । তার গৃহীত নতুন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সে অষ্টম ইমাম হযরত রেজা (আ.)-কে তার খেলাফতের পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে ঘোষণা করে । এই ঘোষণার মাধ্যমে সে খেলাফতের পথকে সম্পূর্ণরূপে কন্টকমুক্ত করতে চেয়েছিল । কেননা , নবীবংশের সৈয়দগণ যখন রাষ্ট্রিয় প্রশাসনের সাথে জড়িত হয়ে পড়বেন , তখন খেলাফতের বিরুদ্ধে যে কোন ধরণের বিদ্রোহ থেকেই তারা বিরত থাকবেন ।

আর আহলে বাইতের অনুসারী শীয়াগণ তখন তাদের ইমামকে খেলাফত প্রশাসনের মাধ্যমে অপবিত্র হতে দেখবে , যে প্রশাসনের পরিচালকদের এক সময় অপবিত্র বলে বিশ্বাস করত । তখন আহলে বাইতের ইমামদের প্রতি শীয়াদের আধ্যাত্মিক বিশ্বাস ও পরম ভক্তি ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাবে । এভাবে তাদের ধর্মীয় সাংগঠনিক কাঠামো ধ্বংস হয়ে যাবে ।216 এর ফলে রাষ্ট্রিয় প্রশাসনের সামনে কোন প্রতিবন্ধকতাই আর অবশিষ্ট থাকবে না । আর এটা খুবই স্বাভাবিক যে , উদ্দেশ্য চারিতার্থের পর ইমাম রেজা (আ.)-কে তার পথের সামনে থেকে চিরদিনের জন্যে সরিয়ে দেয়া খলিফা মামুনের জন্যে কোন কঠিন কাজই নয় । মামুনের ঐ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে হযরত ইমাম রেজা (আ.)-কে মদীনা থেকে মারওয় নামক স্থানে নিয়ে আসে । ইমামের সাথে প্রথম বৈঠকেই মামুন তাকে খেলাফতের দায়িত্ব ভার গ্রহণের প্রস্তাব দেয় । এরপর সে ইমামকে তার মৃত্যুর পর খেলাফতের উত্তাধিকারী হবার প্রস্তাব দেয় । কিন্তু ইমাম রেজা (আ.) মামুনের ঐ প্রস্তাব সম্মানের সাথে প্রত্যাখ্যান করেন । কিন্তু মামুন চরমভাবে পীড়াপীড়ির মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত তার পরবর্তী খেলাফতের উত্তরাধিকার গ্রহণের ব্যাপারে সম্মত হতে ইমামকে বাধ্য করে । কিন্তু হযরত ইমাম রেজা (আ.) এই শর্তে মামুনের প্রস্তাবে সম্মত হন যে , ইমাম প্রশাসনিককারযে লোক নিয়োগ বা বহিস্কারসহ কোন ধরণের রাষ্ট্রিয় কর্মকান্ডে হস্তক্ষেপ করবেন না ।217 এটা ছিল হিজরী 200সনের ঘটনা । কিছুদিন না যেতেই মামুন দেখতে পেল যে , শীয়াদের সংখ্যা পূর্বের চেয়েও দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে । এমনকি ইমামের প্রতি সাধারণ জনগণের ভক্তি দিনদিন আশ্চর্যজনক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে । শুধু তাই নয় , মামুনের সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রিয় প্রশাসনের বহু দায়িত্বশীল ব্যক্তিই ইমামের ভক্ত হয়ে পড়ছে । এ অবস্থাদৃষ্টে খলিফা মামুন তার রাজনৈতিক ভুল বুঝতে পারে । মামুন ঐ জটিল সমস্যার সমাধান কল্পে ইমামকে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে শহীদ করেন । শাহাদতের পর অষ্টম ইমামকে ইরানের তুস নগরীতে (বর্তমানে মাশহাদ নামে পরিচিত) দাফন করা হয় । খলিফা মামুনুর রশিদ দর্শন শাস্ত্রের গ্রন্থ সমূহ আরবী ভাষায় অনুবাদের ব্যাপারে অত্যন্ত আগহ দেখিয়ে ছিল । সে প্রায়ই জ্ঞান- বিজ্ঞান সংক্রান্ত পর্যালোচনার বৈঠকের আয়োজন করত । সে যুগের বিভিন্ন ধর্মের জ্ঞানী গুণী ও পণ্ডিতগণ তার ঐ বৈঠকে উপস্থিত হতেন এবং জ্ঞানমূলক আলোচনায় অংশ নিতেন । অষ্টম ইমাম হযরত রেজা (আ.)-ও ঐ বৈঠকে অংশ গ্রহণ করতেন । দেশ বিদেশের বিভিন্ন ধর্মের জ্ঞানী ও পণ্ডিতদের সাথে পর্যালোচনা ও তর্কবিতর্কে তিনিও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতেন । ইমামের ঐসব জ্ঞানমূলক ঐতিহাসিক বিতর্ক অনুষ্ঠানের বর্ণনা শীয়াদের হাদীসসমূহে লিপিবদ্ধ রয়েছে ।218

নবম ইমাম

অষ্টম ইমামের পুত্র হযরত মুহাম্মদ বিন আলী আত তাকী (আ.) হলেন নবম ইমাম । তিনি ইমাম যাওয়াদ এবং ইবনুর রেযা নামেও সম্যক পরিচিত । তিনি হিজরী 195 সনে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন । শীয়া সূত্রে বর্ণিত হাদীস অনুসারে হিজরী 220 সনে আব্বাসীয় খলিফা মু তাসিম বিল্লাহর প্ররোচনায় বিষ প্রয়োগের ফলে তিনি শাহাদত বরণ করেন । আব্বাসীয় খলিফা মামুনের কন্যা ছিল তার স্ত্রী । খলিফা মু তাসিম বিল্লাহর প্ররোচনায় ইমামের স্ত্রী (খলিফা মামুনের কন্যা) ইমামকে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে শহীদ করেন । বাগদাদের কাযেমাইন এলাকায় দাদার (সপ্তম ইমাম) কবরের পাশেই তাকে কবরস্থ করা হয় । পিতার মৃত্যুর পর মহান আল্লাহর নির্দেশে এবং পূর্ববতী ইমামগণের নির্দেশনায় তিনি ইমামতের পদে অধিষ্ঠিত হন । মহান পিতার মৃত্যুর সময় নবম ইমাম মদীনায় ছিলেন । আব্বাসীয় খলিফা মামুন তাকে বাগদাদে ডেকে পাঠায় । আব্বাসীয় খেলাফতের তৎকালীন রাজধানী ছিল বাগদাদ । খলিফা মামুন প্রকাশ্যে ইমামকে অত্যন্ত সম্মান প্রদর্শন করে এবং তার সাথে নম্র ব্যাবহার করে । এমনকি খলিফা মামুন তার নিজ কন্যাকে ইমামের সাথে বিয়ে দেয় । এভাবে সে ইমামকে বাগদাদেই রেখে দেয় । প্রকৃতপক্ষে ঐ বিয়ের মাধ্যমে ইমামকে ঘরের ভিতরে এবং বাইরে উভয় দিক থেকেই পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ পায় । ইমাম তাকী (আ.) বেশ কিছুদিন বাগদাদে কাটানোর পর খলিফা মামুনের অনুমতি নিয়ে মদীনায় ফিরে যান । তারপর খলিফা মামুনের মৃত্যু পর্যন্ত তিনি মদীনাতেই ছিলেন । খলিফা মামুনের মৃত্যুর পর মু তাসিম বিল্লাহ খলিফার সিংহাসনে আরোহণ করেন । এরপরই খলিফা মু তাসিম ইমামকে পুনরায় বাগদাদে ডেকে পাঠায় এবং তাকে নজরবন্দী করে রাখা হয় । অতঃপর খলিফা মু তাসিমের প্ররোচনায় ইমামের স্ত্রী (খলিফা মামুনের কন্যা) ইমামকে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে শহীদ করে ।219

দশম ইমাম

নবম ইমামের পুত্র হযরত আলী ইবনে মুহাম্মদ আন্ নাকী (আ.)-ই হলেন দশম ইমাম । ইমাম হাদী নামেও তাকে ডাকা হত । তিনি হিজরী 212 সনে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন । শীয়া সূত্রে বর্ণিত হাদীস অনুযায়ী 254 হিজরী সনে আব্বাসীয় খলিফা মু তায বিল্লাহর নির্দেশে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে তাকে শহীদ করা হয় ।220 ইমাম নাকী (আ.) তার জীবদ্দশায় 7জন আব্বাসীয় খলিফার (মামুন , মুতাসিম , ওয়াসিক , মুতাওয়াক্কিল , মুনতাসির , মুসতাঈন ও মুতায বিল্লাহ) শাসনামল প্রত্যক্ষ করেন । আব্বাসীয় খলিফা মুতাসিমের শাসনামলেই ইমাম নাকী (আ.)-এর মহান পিতা (নবম ইমাম) বিষ প্রয়োগের ফলে হিজরী 220 সনে বাগদাদে শাহাদত বরণ করেন । তখন তিনি (দশম ইমাম) মদীনায় অবস্থান করছিলেন । পিতার মৃত্যুর পর মহান আল্লাহর নির্দেশে এবং পূর্ববতী ইমামদের নির্দেশনায় তিনি ইমামতের পদে অভিষিক্ত হন । তিনি ইসলাম প্রচার ও তার শিক্ষা প্রদানে ব্যাপৃত হয়ে পড়েন । এরপর আব্বাসীয় খলিফা মুতাওয়াক্কিলের শাসনামল শুরু হয় । ইতিমধ্যে অনেকেই ইমাম নাকী (আ.) সম্পর্কে খলিফার কান গরম করে তোলে । ফলে খলিফা মুতাওয়াক্কিল হিজরী 243 সনে তার দরবারের জনৈক উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে , ইমামকে মদীনা থেকে সামেররা শহরে নিয়ে আসার নির্দেশ দেয় । সামেররা শহর ছিল তৎকালীন আব্বাসীয় খেলাফতের রাজধানী । খলিফা মুতাওয়াক্কিল অত্যন্ত সম্মানসূচক একটি পত্র ইমামের কাছে পাঠায় । পত্রে সে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে ইমামের সাক্ষাত লাভের প্রত্যাশা ব্যক্ত করে এবং ইমামকে দ্রুত সামেররা শহরের দিকে রওনা হওয়ার জন্যে অনুরোধ জ্ঞাপন করেন ।221 কিন্তু সামেররা শহরে প্রবেশের পর ইমামকে আদৌ কোন অভ্যর্থনা জানান হয়নি । বরং ইমামকে কষ্ট দেওয়া ও অবমাননা করার জন্যে প্রয়োজনীয় সব কিছুরই আয়োজন করা হয়েছিল । এ ব্যাপারে খলিফা বিন্দুমাত্র ত্রুটিও করেনি । এমনকি ইমামকে হত্যা এবং অবমাননা করার লক্ষ্যে বহুবার তাকে খলিফার রাজ দরবারের উপস্থিত করানো হত । খলিফার নির্দেশে বহুবার ইমামের ঘর তল্লাশী করা হয় ।

নবীবংশের সাথে শত্রুতার ব্যাপারে আব্বাসীয় খলিফাদের মধ্যে মুতাওয়াক্কিলের জড়িু মেলা ভার । খলিফা মুতাওয়াক্কিল হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর প্রতি মনে ভীষণ বিদ্বেষ ও শত্রুতা পোষণ করত । এমনকি হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর ব্যাপারে প্রকাশ্যে সে অকথ্য মন্তব্য করত । খলিফা কৌতুক অভিনেতাকে বিলাস বহুল পোষাকে হযরত আলী (আ.)-এর অনুকরণমূলক ভঙ্গীতে তার (ইমাম আলী) প্রতি ব্যাঙ্গাত্মক অভিনয় করার নির্দেশ দিত । আর ঐ দৃশ্য অবলোকন খলিফা চরমভাবে উল্লাসিত হত । হিজরী 237 সনে খলিফা মুতাওয়াক্কিলের নির্দেশেই কারবালায় হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মাযার (রওজা শরীফ) এবং তদসংলগ্ন অসংখ্য ঘরবাড়ী সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয় । তার নির্দেশে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মাযার এলাকায় পানি সরবরাহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়া হয় এবং ইমামের মাযারের উপর চাষাবাদের কাজ শুরু করা হয় । যাতে করে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর নাম এবং মাযারের ঠিকানা চিরতরে ইতিহাস থেকে মুছে যায় ।222 আব্বাসীয় খলিফা মুতাওয়াক্কিলের শাসন আমলে হেজাজে (বর্তমান সৌদি আরব) বসবাসকারী সাইয়্যেদদের (নবীবংশের লোকজন) দূর্দশা এতই চরম পর্যায়ে গিয়ে পৌছায় যে , তাদের স্ত্রীদের পরার মত বোরখাও পর্যন্ত ছিল না । অল্প ক জনের জন্যে মাত্র একটি বোরখা ছিল , যা পরে তারা পালাক্রমে নামায পড়তেন ।223 শাসকগোষ্ঠির পক্ষ থেকে ঠিক এমনি ধরণের অত্যাচারমূলক কার্যক্রম মিশরে বসবাসকারী সাইয়্যেদদের (নবীবংশের লোকজন) উপরও করা হয় । দশম ইমাম খলিফা মুতাওয়াক্কিলের সবধরণের অত্যাচার ও শাস্তিই অম্লান বদনে সহ্য করেন ।

এরপর একসময় খলিফা মুতাওয়াক্কিল মৃত্যুবরণ করে । মুতাওয়াক্কিলের মৃত্যুর পর মুনতাসির , মুস্তাঈন ও মু তায একের পর এক খেলাফতের পদে আসীন হয় । অবশেষে খলিফা মু তাযের ষড়যন্ত্রে ইমামকে বিষ প্রয়োগ করা হয় এবং ইমাম শাহাদত বরণ করেন ।

একাদশ ইমাম

দশম ইমামের পুত্র হযরত হাসান বিন আলী আল আসকারী (আ.) হলেন একাদশ ইমাম । তিনি হিজরী 232 সনে জন্ম গ্রহণ করেন । শীয়া সূত্রে বর্ণিত হাদীস অনুসারে হিজরী 260 সনে আব্বাসীয় খলিফা মু তামিদের দ্বারা বিষ প্রয়োগে তিনি শাহাদত বরণ করেন ।224

পিতার মৃত্যুর পর মহান আল্লাহর নির্দেশে এবং পূর্ববতী ইমামদের নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি ইমামতের পদ লাভ করেন । তার ইমামতের মেয়াদকাল ছিল মাত্র সাত বছর । ইমাম আসকারী (আ.)-এর যুগে আব্বাসীয় খলিফার সীমাহীন নির্যাতনের কারণে অত্যন্ত কঠিন তাকীয়া নীতি অবলম্বনের মাধ্যমে তাকে জীবন অতিবাহিত করতে হয় । তিনি হাতে গোনা বিশিষ্ট ক জন শীয়া ব্যতীত অন্য সকল সাধারণ শীয়াদের সাথে গণসংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে বাধ্য হন । এরপরও তার ইমামত কালের অধিকাংশ সময় জেলে বন্দী অবস্থায় জীবন কাটাতে হয় ।225 রাষ্ট্রিয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে আরোপিত ঐ প্রচন্ড রাজনৈতিক চাপের মূল কারণ ছিল এই যে ,

প্রথমত : সে সময় চারিদিকে শীয়াদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়ে ছিল । শীয়ারা যে ইমামতে বিশ্বাসী এবং কে তাদের ইমাম , এটা তখন সবাই ভাল করেই জানত । এ কারণেই খেলাফতের পক্ষ থেকে ইমামদেরকে অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় অধিকতর কড়া নিয়ন্ত্রণাধীনে রাখার ব্যবস্থা করা হয় । আর এসকল রহস্যময় পরিকল্পনার মাধ্যমে ইমামদেরকে চিরতরে ধ্বংস করার জন্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা তারা চালাত ।

দ্বিতীয়ত : খেলাফত প্রশাসন এটা জানতে পরেছিল যে , ইমামের অনুসারী বিশিষ্ট শীয়ারা ইমামের এক বিশেষ সন্তানের আগমনে বিশ্বাসী এবং তাঁর জন্যে প্রতীক্ষারত । এছাড়াও স্বয়ং একাদশ ইমাম এবং তার পূর্ববতী ইমামগণের (আ.) বর্ণিত হাদীস অনুযায়ী একাদশ ইমামের আসন্ন পুত্র সন্তানই সেই প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদী (আ.) যার আগমনের সু সংবাদ স্বয়ং মহানবী (সা.)-ই দিয়েছেন । মহানবী (সা.)-এর ঐ সকল হাদীস শীয়া এবং সুন্নী উভয় সূত্রেই বর্ণিত হয়েছে ।226 আর ঐ নবজাতকই হলেন ইমাম মাহদী (আ.) বা দ্বাদশ ইমাম । এ সকল কারণেই একাদশ ইমামকে খেলাফতের পক্ষ থেকে পূর্ববতী যে কোন ইমামের তুলনায়ই অধিকতর কড়া নিয়ন্ত্রণাধীনে রাখা হয় । তৎকালীন আব্বাসীয় খলিফা এ ব্যাপারে সুদৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল যে , যে কোন মূল্যেই হোক না কেন , ইমামতের এই বিষয়টিকে চিরদিনের জন্যে নিশ্চিহ্ন করতে হবেই । ইমামতের এই দরজাকে চিরতরে বন্ধ করে দিতে হবে । এ কারণেই যখন আব্বাসীয় খলিফা মু তামিদ ইমামের অসুস্থ অবস্থার সংবাদ পেল , সাথে সাথেই সে ইমামের কাছে একজন ডাক্তার পাঠায় । ঐ ডাক্তারের সাথে খলিফার বেশ ক জন বিশ্বস্থ অনুচরসহ ক জন বিচারককেও ইমামের বাড়িতে পাঠানো হয় । এ জাতীয় পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে তারা ইমামের বাড়ীর আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সম্পর্কে জ্ঞাত ও তা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয় । আর এটাই ছিল খলিফা মু তামিদের মূল উদ্দেশ্য ইমামের শাহাদত বরণের পরও তার সমস্ত বাড়ী ঘরে তল্লাশী চালানো হয় । এমনকি ধাত্রীদের দিয়ে ইমামের বাড়ীর মহিলা ও তার দাসীদেরকেও দৈহিক পরীক্ষা করানো হয় । ইমামের শাহাদত বরণের পর প্রায় দু বছর পর্যন্ত খলিফার নির্দেশে ইমামের সন্তানের অস্তিত্ব খুজে পাওয়ার জন্যে সর্বত্র ব্যাপক তল্লাশী অব্যাহত থাকে । দীর্ঘ দু বছর পর খলিফা ঐ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরাশ হয়ে পড়ে ।227 শাহাদত বরণের পর সামেরা শহরে নিজ গৃহে পিতার (দশম ইমাম) শিয়রে ইমাম আসকারীকে (আ.) দাফন করা হয় । পবিত্র আহলে বাইতের ইমামগণ তাদের জীবদ্দশায় অসংখ্য খ্যাতনামা আলেম ও হাদীস বিশারদ তৈরী করেছিলেন । যাদের সংখ্যা শতাধিক । এই বইয়ের কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় ঐসব (ইমামদের শিষ্যবর্গ) বিশ্ববরেণ্য আলেমদের নাম ও তাদের রচিত গ্রন্থাবলীর বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখে বিরত থেকেছি ।228

দ্বাদশ ইমাম

একাদশ ইমামের পুত্র হযরত মুহাম্মদ বিন হাসান আল্ মাহদী হলেন দ্বাদশ ইমাম । তিনি মাহদী মাওউদ , ইমামুল আসর এবং সাহেবুজ জামান নামে পরিচিত । হিজরী 255 অথবা 256 সনে ইরাকের সামেরা শহরে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন । পিতার শাহাদতের (260 হিঃ) পূর্ব পর্যন্ত তিনি সরাসরি পিতার তত্ত্বাবধানেই লালিত পালিত হন । অবশ্য ঐসময় তাকে লোক চক্ষুর অন্তরালে বসবাস করতে হয় । শুধুমাত্র ইমামের অনুসারী অল্প ক জন বিশিষ্ট শীয়া ব্যতীত তার সাথে সাক্ষাতের সৌভাগ্য আর কারও ঘটেনি । পিতার (একাদশ ইমাম) শাহাদত প্রাপ্তির পর তিনি ইমামতের পদে অভিষিক্ত হন । কিন্তু তার পরপরই মহান আল্লাহর নির্দেশে তিনি আত্মগোপন করেন । দু একটি ব্যতিক্রম ব্যতীত তার বিশেষ প্রতিনিধিবর্গ ছাড়া আর কারো নিকট তিনি আত্মপ্রকাশ করেননি ।229

বিশেষ প্রতিনিধি

দ্বাদশ ইমাম হযরত মাহদী (আ.) আত্মগোপন করার পর জনাব ওসমান বিন সাঈদ ওমারীকে (রহঃ) নিজের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ করেন । তিনি ইমামের দাদা (দশম ইমাম) ও বাবার (একাদশ ইমাম) বিশিষ্ট সাহাবীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন । ব্যক্তিগত ভাবে ছিলেন অত্যন্ত সৎ ও বিশ্বস্ত । জনাব ওসমান বিন সাঈদ ওমারীর (রহঃ) মাধ্যমেই হযরত ইমাম মাহদী (আ.) শীয়া জনগণের প্রশ্নের উত্তর দিতেন । জনাব ওসমান বিন সাঈদ ওমারীর (রহঃ) মৃত্যুর পর তারই পুত্র মুহাম্মদ বিন ওসমান ইমাম মাহদী (আ.) এর বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হন । জনাব মুহাম্মদ বিন ওসমান ওমারীর মৃত্যুর পর জনাব আবুল কাসিম হুসাইন বিন রূহ্ আন নওবাখতি (রহঃ) ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হন । তার মৃত্যুর পর জনাব আলী বিন মুহাম্মদ সামেরী (রহঃ) ইমাম মাহদী (আ.)-এর বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হন । জনাব আলী বিন মুহাম্মদ সামেরী (রহঃ) হিজরী 329 সনে মৃত্যু বরণ করেন । তার মৃত্যুর অল্প ক দিন পূর্বে ইমামের স্বাক্ষরসহ একটি নির্দেশ নামা জনাব আলী বিন মুহাম্মদ সামেরীর হাতে পৌছে । ঐ নির্দেশ লিপিতে ইমাম মাহদী (আ.) তাকে বলেন যে , আর মাত্র ছয় দিন পরই তুমি এ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিবে । তার পরপরই বিশেষ প্রতিনিধিত্বের যুগের অবসান ঘটবে এবং দীর্ঘকালীন অর্ন্তধানের যুগ শুরু হবে । মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ইমাম মাহদীর আত্মপ্রকাশের নির্দেশনা আসা পর্যন্ত ঐ দীর্ঘ কালীন অর্ন্তধানের যুগ অব্যাহত থাকবে ।230 ইমামের হপ্তলিপি সম্পন্ন ঐ পত্রের বক্তব্য অনুসারে ইমাম মাহদী (আ.)-এর অর্ন্তধানকালীন জীবনকে দু টো পর্যায়ে ভাগ করা যায় ।

প্রথম : স্বল্পকালীন অর্ন্তধান । হিজরী 250 সনে এই অর্ন্তধান শুরু হয় এবং হিজরী 329 সন পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে । অর্থাৎ প্রায় 70 বছর পর্যন্ত এই অর্ন্তধান স্থায়ী ছিল ।

দ্বিতীয় : দীর্ঘকালীন অর্ন্তধান । হিজরী 329 সন থেকে এই অর্ন্তধান শুরু হয় এবং মহান আল্লাহর ইচ্ছামত এই অর্ন্তধান অব্যাহত থাকবে । মহানবী (সা.)-এর একটি সর্বসম্মত হাদীসে বলা হয়েছে : এ বিশ্বজগত ধ্বংস হওয়ার জন্যে যদি একটি দিনও অবশিষ্ট থাকে , তাহলে মহান আল্লাহ অবশ্যই সে দিনটিকে এতখানি দীর্ঘায়িত করবেন , যাতে আমারই সন্তান মাহদী (আ.) আত্মপ্রকাশ করতে পারে এবং অন্যায় অত্যাচারে পরিপূর্ণ এ পৃথিবীতে সম্পূর্ণরূপে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে ।231