সাধারণ দৃষ্টিতে ইমাম মাহদী (আ.) এর আবির্ভাব
ইতিপূর্বে আমরা নবুয়ত ও ইমামতের অধ্যায়ে উল্লেখ করেছি যে , গণহেদায়েতের নীতি সমগ্র সৃষ্টিজগতের মধ্যে বলবৎ রয়েছে । সেই নীতির , অপরিহার্য ফলাফল স্বরূপ মানবজাতি‘
ওহী’
ও‘
নবুয়তের’
শক্তি সরঞ্জামে সুসজ্জিত । ঐ বিশেষ শক্তিই মানব জাতিকে মানবতার শ্রেষ্ঠত্ব ও সৌভাগ্যের পথে পরিচালিত করে । আর এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার যে , আল্লাহ প্রদত্ত ঐ বিশেষ শক্তি যদি সামাজিক জীবন যাপনকারী মানবজাতিকে শ্রেষ্ঠত্ব ও সৌভাগ্যের পথে পরিচালিত করতেই না পারে , তাহলে ঐ বিশেষ শক্তির সরঞ্জাম মানবজাতিকে সুসজ্জিত করার মূলকাজটিই বৃথা বলে প্রমাণিত হবে । অথচ , এ সৃষ্টিজগতে বৃথা বলে কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই । অন্যকথায় বলতে গেলে , মানব জাতি যেদিন থেকে এ জগতে জীবন যাপন করতে শুরু করেছে , সেদিন থেকেই সে সৌভাগ্যপূর্ণ (সার্বিক অর্থে) এক সামাজিক জীবন যাপনের আকাংখা তার হৃদয়ে লালন করে আসছে । আর সেই কাংখিত লক্ষ্যে পৌছার জন্যেই সে প্রয়াজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে । তার হৃদয়ে ঐ আকাংখা সত্যিই যদি অবাস্তব হত , তাহলে নিশ্চয়ই সে ঐ আকাংখার স্বপ্নিল ছবি তার হৃদয় পটে আকতো না । অথচ , আবহমান কাল থেকে জগতের প্রতিটি মানুষই তার জীবনে এমন একটি আকাংখা হৃদয় কঠুরীতে লালন করে আসছে । যদি খাদ্যের অস্তিত্ব না থাকত তা হলে ক্ষুধার অস্তিত্ব থাকত না । পানির অস্তিত্বই যদি না থাকবে , তাহলে কিভাবে তৃষ্ণার অস্তিত্ব থাকতে পারে ? যৌনাংগের অস্তিত্বই যদি না থাকত তা হলে যৌন কামনার অস্তিত্বও থাকত না । এ কারণেই বিশ্ব জগতে এমন এক দিনের আবির্ভাব ঘটবে , যখন মানব সমাজ সম্পূর্ণ রূপে ন্যায়বিচার ভোগ করবে । সমগ্র বিশ্বে তখন শান্তি নেমে আসবে । সবাই শান্তিপূর্ণ ভাবে সহাবস্থান করবে । তখন মানুষ শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বের মাঝে নিমিজ্জিত হবে । অবশ্য ঐ ধরণের পরিবেশ টিকিয়ে রাখার ব্যাপরটি তখন মানুষের উপরই নির্ভরশীল হবে । ঐধরণের সমাজের নেতৃত্ব দান করবে বিশ্ব মানবতার মুক্তিদাতা ; হাদীসের ভাষায় যার নাম হবে মাহ্দী (আ.) । পৃথিবীতে প্রচলিত সকল ধর্মেই বিশ্ব মানবতার মুক্তিদাতা সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে এবং সাধারণভাবে তার আবির্ভাবের সুসংবাদও প্রদান করা হয়েছে । যদিও ঐ বক্তব্যের বাস্তব প্রয়োগে কমব েশী মতভেদ রয়েছে । সর্বসম্মত হাদীসে মহানবী (সা.) হযরত ইমাম মাহদী (আ.) সম্পর্কে বলেছেনঃ“
প্রতিশ্রুত মাহদী আমারই সন্তান ।”
বিশেষ দৃষ্টিকোণে ইমাম মাহদী (আ.)-এর আবির্ভাব
মহানবী (সা.) ও পবিত্র আহলে বাইতের ইমামদের পক্ষ থেকে ইমাম মাহদী (আ.)-এর আবির্ভাব সম্পর্কে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে । সেখানে বলা হয়েছে যে , ইমাম মাহদী (আ.) তার আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে সমগ্র মানব সমাজকে প্রকৃত শ্রেষ্ঠত্বে উন্নীত করবে এবং আধ্যাত্মিক জীবন দান করবে ।
অসংখ্য হাদীসের সাক্ষ্য অনুযায়ী একাদশ ইমাম
হযরত হাসান আসকারীর (আ.) সন্তানই ইমাম মাহদী (আ.) ।
হাদীস সমূহের বক্তব্য অনুযায়ী হযরত ইমাম মাহদী (আ.)-এর জন্মের পরে সুদীর্ঘকালের জন্যে তিনি অদৃশ্যে অবস্থান করবেন । তারপর তিনি আত্মপ্রকাশ করবেন এবং অন্যায় ও অত্যাচারপূর্ণ বিশ্বে সত্যিকার অর্থে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন ।
কিছু প্রশ্ন ও তার উত্তর
প্রশ্ন :
শীয়া বিদ্বেষী লোকেরা এ ব্যাপারে আপত্তিমূলক প্রশ্ন উপস্থাপন করে যে , ইমাম মাহদী (আ.) শীয়াদের বিশ্বাস অনুযায়ী এ যাবৎ প্রায় 1200 বছর জীবন যাপন করেছেন । অথচ এযাবৎ পৃথিবীর কোন মানুষই এত দীর্ঘ জীবন যাপন করতে পারে না ।
উত্তর :
বাহ্যিকভাবে আপত্তিটি গ্রহণযোগ্য বটে । তবে আমরা যদি উক্ত বিষয় সংক্রান্ত মহানবী (সা.) ও ইমামগণের (আ.) হাদীসগুলো পড়ে দেখি , তা হলে অবশ্যই দেখতে পাব যে , সেখানে ইমাম মাহদী (আ.)-এর ঐ দীর্ঘ জীবনকে অলৌকিক ও অসাধারণ একটি বিষয় হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে । অবশ্য অলৌকিক বিষয় এবং অসম্ভব বিষয় এক নয় । বরং দু’
টিই সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয় । জ্ঞানগত দিক থেকে অলৌকিক বিষয়কে অস্বীকার করা সম্ভব নয় । কারণ , এটা কারও পক্ষে আদৌ বলা সম্ভব নয় যে , শুধুমাত্র আমাদের দেখা এবং জানা কার্য-কারণ গুলোই এ বিশ্বজগতে ক্রিয়াশীল । আর এর বাইরে এ জগতে অন্য কোন কার্য-কারণই ক্রিয়াশীল নয় , যা সম্পর্কে আমাদের আদৌ কোন জ্ঞান বা ধারণা নেই । অথবা যে সব কার্য-কারণ , কখনই আমরা দেখিনি , অনুধাবন করিনি তার কোন অস্তিত্বই এ জগতে থাকতে পারে না । সুতরাং উপরোক্ত বিষয়ের ভিত্তিতে বলা যায় যে , এক বা একাধিক মানুষের ক্ষেত্রে এ বিশ্ব জগতে এমন কোন কার্য কারণ ঘটতে পারে , যার ফলে তাদের আয়ু একাধিক হাজার বছর পর্যন্তও দীর্ঘায়িত হতে পারে । আর এই সম্ভাবনার অস্তিত্বের কারণেই আজ আমরা দেখতে পাই যে , চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা মানুষের দীর্ঘায়ু লাভ সংক্রান্ত বিষয়ের গবেষণায় আজও নিরাশ হয়নি । আর ঐশীগ্রন্থের অধিকারী এবং নবীদের অলৌকিক নিদর্শনে বিশ্বাসী ইহুদী বা খৃষ্টান ধর্মের অনুসারীদের পক্ষ থেকে এ ধরণের আপত্তিমূলক প্রশ্নের উপস্থাপন সত্যিই আশ্চার্যজনক ।
প্রশ্ন :
শীয়া বিরোধীরা আপত্তি করে বলে যে , শীয়ারা তো দ্বীনি বিধান ও ইসলামের নিগূঢ়তত্ত্ব বর্ণনা ও জনগণের নেতৃত্ব প্রদানের জন্যেই ইমামের উপস্থিতিকে অপরিহার্য বলে বিশ্বাস করে । কিন্তু ইমামের অর্ন্তধানের বিষয়টি শীয়াদের বর্ণিত ঐ উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ বলেই প্রমাণ করে । অর্ন্তধানের ফলে জনগণ যদি ইমামের নাগালই না পায় , তাহলে ঐ ইমামের অদৃশ্য অস্তিত্বই তো মূল্যহীন । মানবসমাজ সংস্কারের জন্যে যদি ইমামের অস্তিত্বের প্রয়োজন আল্লাহ কখনও উপলদ্ধি করেন , তাহলে ঐ মুহুর্তেই তাকে সৃষ্টি করার মত ক্ষমতাও আল্লাহর রয়েছে ।
সুতরাং ইমামের আবির্ভাবের নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে কয়েক হাজার বছর পর্যন্ত ইমামের আয়ু দীর্ঘায়িত করার কোন প্রয়োজন আল্লাহর নেই ।
উত্তর :
উপরোক্ত প্রশ্ন উত্থাপনকারী আসলে ইমামতের প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করতে সক্ষম হননি । ইতিপূর্বে ইমামতের অধ্যায়ে আলোচনায় এটা সুস্পষ্ট হয়েছে যে , ইসলামের বাহ্যিক জ্ঞান ও বিধিবিধান বর্ণনা এবং জনগণের প্রকাশ্যে নেতৃত্ব দানই ইমামের একমাত্র দায়িত্ব নয় । মানুষের বাহ্যিক পথনির্দেশনা যেমন ইমামের দায়িত্ব , তেমনি গোপন ও আধ্যাত্মিক কার্যক্রমের নেতৃত্ব দানও তারই দায়িত্ব । মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনকে তো তিনিই বিন্যাস করেন এবং মানুষের কৃতকর্মের প্রকৃত স্বরূপকেও তিনিই আল্লাহর অভিমুখে পরিচালিত করেন । এটা খুবই স্বাভাবিক যে , ইমামের দৈহিক উপস্থিতি অথবা অনুপস্থিতি এখানে আদৌ কার্যকর নয় । আধ্যাত্মিকভাবে সকল মানুষের হৃদয় ও আত্মার সাথে ইমামের সংযোগ বিদ্যমান এবং সবার আত্মার উপরই তিনি সম্যক দ্রষ্টা ও প্রভাবশালী । যদিও বাহ্যিক দৃষ্টিতে তিনি অদৃশ্য অবস্থায় রয়েছেন এবং তার দ্বারা মানবসমাজের সংস্কার ও তার আত্মপ্রকাশের সময় এখনও উপস্থিত হয়নি । তবুও তার প্রতিনিয়ত অদৃশ্য উপস্থিতি মানবজাতির জন্যে একান্ত প্রয়োজন ।