দ্বিতীয় অধ্যায়
শীয়াদের ধর্মীয় চিন্তাধারা
ধর্মীয় চিন্তাধারার সংজ্ঞা
ধর্মীয় চিন্তাধারা বলতে এখানে সেসব বিষয়ের ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা , আলোচনা ও অনুসন্ধিসাকে বোঝায় , যা ধর্ম সংক্রান্ত কোন সিদ্ধান্ত বা ফলাফল প্রদান করে । যেমনি ভাবে গণিত সংক্রান্ত চিন্তাধারা বলতে সেই চিন্তা ধারাকেই বোঝায় , যা গণিত সংক্রান্ত কোন সিদ্ধান্ত প্রদান করে , অথবা গণিত সংক্রান্ত কোন সমস্যার সমাধান করে ।
ইসলামের ধর্মীয় চিন্তাধারার মূল উৎস
অন্য যে কোন বিষয়ক চিন্তা ধারার মত ধর্মীয় চিন্তা ধারারও উৎস থাকা প্রয়োজন , যা থেকে চিন্তাধারা উৎসারিত হবে এবং যার উপর তা হবে নির্ভরশীল । যেমন : গণিত সংক্রান্ত কোন একটি সমস্যা সমাধানের চিন্তাধারার ক্ষেত্রে গণিত সংক্রান্ত কিছু সূত্র ও জ্ঞান কাজে লাগাতে হয় , যা শেষ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কোন কারিগরি বিষয়ে গিয়ে সমাপ্ত হয় । ধর্মীয় চিন্তাধারার ব্যাপারে ঐশী ধর্ম ইসলাম একমাত্র যে জিনিসটিকে নির্ভরযোগ্য ও মূল উৎস হিসেবে ঘোষণা করেছে , তা হচ্ছে পবিত্র কুরআন । পবিত্র কুরআনই মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চিরন্তন নবুয়তের অকাট্য প্রমাণ স্বরূপ । ইসলামের প্রতি আহবানই কুরআনের মূল বিষয়বস্তু । অবশ্য এখানে বলে রাখা দরকার যে ধর্মীয় চিন্তাধারার ক্ষেত্রে কুরআনকে একমাত্র মূল উৎস বলার অর্থ এটা নয় যে , এ সংক্রান্ত অন্যান্য নির্ভরযোগ্য ও প্রমাণ্য উৎসগুলোকে অস্বীকার করা । এ বিষয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করব ।
কুরআন নির্দেশিত ধর্মীয় চিন্তা ধারার নিয়ম-নীতি
ধর্মীয় লক্ষ্যে পৌছা এবং ইসলামী জ্ঞান উপলদ্ধির ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআনের শিক্ষা তার অনুসারীদেরকে তিনটি পদ্ধতি উপহার দেয় । সেগুলো হচ্ছে: নিষ্ঠা , দাসত্ব বা আনুগত্যের মাধ্যমে ধর্মের বাহ্যিকরূপ , বুদ্ধিমত্তাগত দলিল , ও আধ্যাত্মিক উপলদ্ধি । ব্যাখ্যা : আমরা যদি পবিত্র কুরআনের দিকে লক্ষ্য করি , তাহলে দেখতে পাব যে , কুরআনের বিভিন্ন স্থানে মানব জাতিকে উদ্দেশ্য করে মৌলিক বিশ্বাস সংক্রান্ত বিষয় যেমনঃ তৌহীদ (একত্ববাদ) ,নবুয়ত , মা’
আদ (কেয়ামত) এবং ব্যবহারিক আইন কানুন সংক্রান্ত বিষয় , যেমনঃ নামায , রোযা..... ইত্যাদি নিয়ম নীতিগুলো মেনে চলার আহবান জানানো হয়েছে । একইভাবে কিছু কাজ করতে নিষেধ করা হয়েছে । কিন্তু সেখানে মহান আল্লাহ স্বীয় বক্তব্যের স্বপক্ষে কোন দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করেনি । বরং স্বীয় প্রভুত্বের ক্ষমতা সেখানে খাটানো হয়েছে । মহান আল্লাহ যদি পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত তার শাব্দিক বক্তব্যগুলোকে নির্ভরযোগ্যতা (প্রামাণ্য) ও গুরুত্ব প্রদান না করতেন , তাহলে অবশ্যই তিনি মানুষের কাছ থেকে ঐ ব্যাপারে আনুগত্য কামনা করতেন না । তখন বাধ্য হয়ে তিনি বলতেন যে , কুরআনের এ ধরণের সাধারণ বক্তব্যসমূহ ধর্মীয় লক্ষ্যসমুহ এবং ইসলামী জ্ঞান অনুধাবন করার একটি পদ্ধতি মাত্র । আমরা পবিত্র কুরআনের এ ধরণের শাব্দিক বর্ণনা গুলোকে (ঈমান আনো আল্লাহর এবং তার রাসূলের প্রতি) ও (নামায প্রতিষ্ঠা কর) ইসলামের বাহ্যিক দিক বলে গণ্য করি । অন্যদিকে আমরা দেখতে পাই যে , পবিত্র কুরআনে তার প্রচুর আয়াত বুদ্ধিমত্তাগত প্রমাণের ব্যাপারে নেতৃত্ব দিচ্ছে । পবিত্র কুরআন মানুষকে আল্লাহর নিদর্শন স্বরূপ এ বিশ্বে ও তাতে বসবাসরত জাতিসমুহ সম্পর্কে সুগভীর চিন্তা ভাবনা করার আহবান্ জানায় । এ ছাড়া স্বয়ং আল্লাহর প্রকৃতপক্ষে সত্য প্রমাণের জন্য বুদ্ধিমত্তাগত দলিল প্রমাণের মাধ্যমে মুক্ত আলোচনার আশ্রয় নিয়েছেন । সত্যি বলতে কি , বিশ্বের কোন ঐশী পুস্তকই পবিত্র কুরআনের মত যুক্তি প্রমাণ ভিত্তিক জ্ঞানের শিক্ষা দেয় না । পবিত্র কুরআন এসব বর্ণনার মাধ্যমে বুদ্ধিমত্তাগত দলিল ও স্বাধীন যুক্তি ভিত্তিক প্রমাণের বিষয়কে নির্ভরযোগ্য ও স্বীকৃত বলে গণ্য করে । কুরআন কখনও প্রথমে ইসলামী জ্ঞানের সত্যতা গ্রহণ করে অতঃপর বুদ্ধিমত্তা প্রসূত যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে সেগুলো যাচাই করার আহবান জানায় না । বরঞ্চ , বাস্তবতার প্রতি পূর্ণ আস্থা সহ কুরআন বলেঃ বুদ্ধিবৃত্তিগত যুক্তি প্রমাণের সাহায্যে যাচাই-বাছাইর মাধ্যমে ইসলামী জ্ঞানমালা অর্জন ও গ্রহণ কর । যখন ইসলামের আহবান্ শুনতে পাবে , তখন তা যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে নেবে । অর্থাৎ যুক্তিভিত্তিক দলিল-প্রমাণের মাধ্যমে ইসলামী জ্ঞানাবলী অর্জন ও গ্রহণ বা তার প্রতি ঈমান আনয়ন করবে । প্রথমে তার প্রতি ঈমান এনে তারপর স্বপক্ষে যুক্তি -প্রমাণ আনার চেষ্টা করবে না । এরপর দার্শনিক চিন্তাধারারও পথ আছে , যা পবিত্র কুরআনও সমর্থন করে । অন্য দিকে পবিত্র কুরআন তার চমৎকার বর্ণনার মাধ্যমে এ ব্যাপারটা স্পষ্ট করেছে যে , সকল সত্য ভিত্তিক জ্ঞানই তাওহীদ (একত্ববাদ) এবং সর্বস্রষ্টা আল্লাহর প্রকৃত পরিচয়গত জ্ঞান থেকেই উৎসারিত । পরিপূর্ণ খোদা পরিচিতি লাভ একমাত্র তাদের জন্যেই সম্ভব , যাদেরকে মহান প্রভু নির্ধারণ করেছেন এবং তিনি নিজেই ঐ সকল বিশেষ বিশ্বাস নিজের জন্যে বেছে নিয়েছেন । আর তারা হচ্ছেন সেসব ব্যক্তি , যারা সবার থেকে নিজেকে পৃথক করেছেন এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য সবকিছুকে ভুলে গেছেন । অতঃপর হৃদয়ের সততা ও আনুগত্যের মাধ্যমে নিজের সকল শক্তিকে একমাত্র সর্বস্রষ্টা আল্লাহর প্রতি বিনিয়োগ করেছেন । মহাপ্রভু আল্লাহর পবিত্র জ্যোতিচ্ছটায় তারা তাদের দৃষ্টিকে জ্যোতির্ময় করেছেন । তারা তাদের বাস্তব দৃষ্টিতে বস্তু নির্ণয়ের নিগুঢ়তত্ব এবং আকাশ ও পৃথিবীর ঐশী রহস্য আবলোকন করেছেন । কারণঃ আত্মিক নিষ্ঠা ও উপাসনার মাধ্যমে তারা দৃঢ় বিশ্বাসের স্তরে উন্নীত হয়েছেন । আ র‘
দৃঢ় বিশ্বাসের’
(ইয়াকীন) স্তরে উন্নতি হওয়ার কারণে এ আকাশ , পৃথিবী ও অনন্ত জীবনের গোপন রহস্য তাদের কাছে উন্মোচিত হয়েছে । নিম্নলিখিত কুরআনের আয়াতগুলো এ বক্তব্যের প্রমাণ বহন করে ।
(ক) আপনার পূর্বে আমি যে রাসূলই প্রেরণ করেছি , তাকে এ আদেশ দিয়েছি যে , আমি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই । সুতরাং আমারই ইবাদত কর ।
(সূরা আল্ আম্বিয়া 25 নং আয়াত ।)
(খ) তারা যা বলে আল্লাহ তা থেকে পবিত্র । তবে কেবল মাত্র‘
সত্যনিষ্ঠ’
বান্দারা ব্যতীত ।
(সূরা আল্ সাফাত 159 নং আয়াত থেকে 160 নং আয়াত পর্যন্ত ।)
(গ) বলুনঃ আমিও তোমাদের মতই একজন মানুষ , আমার প্রতি পত্যাদেশ হয় যে , তোমাদের উপাস্যই একমাত্র উপাস্য । অতএব যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাত কামনা করে , সে যেন সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তার পালনকর্তার ইবাদতে কাউকে শরীক না করে ।
(সূরা আল্ কাহাফ 110 নং আয়াত ।) (
ঘ) এবং পালনকর্তার ইবাদত কর যে পর্যন্ত তোমার নিকট নিশ্চিত জ্ঞান না আসে । (সূরা আল্ হিজর 99 নং আয়াত ।)
(ঙ) আমি এ রূপেই ইব্রাহীমকে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের পরিচালন ব্যবস্থা দেখিয়ে ছিলাম,য
াতে সে দৃঢ় বিশ্বাসী হয়ে যায় ।
(সূরা আল্ আনয়াম 75 নং আয়াত ।)
(চ) কখনও না , নিশ্চয় সৎ লোকদের আমলনামা আছে ইল্লিয়্যীনে আপনি জানেন ইল্লিয়্যীন কি ? এটা লিপিবদ্ধ খাতা , আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ একে প্রত্যক্ষ করে ।
(সূরা আল্ মুতাফফিফিন 18 নং আয়াত থেকে 21 নং আয়াত পর্যন্ত )
(ছ) কখনও নয় ; যদি তোমরা নিশ্চিত জ্ঞানের অধীকারী হতে তবে অবশ্যই জাহান্নামকে (এই পৃথিবীতেই) দেখতে পেতে ।
(সূরা আত তাকাসুর 5 ও 6 নং আয়াত ।)
অতএব এখান থেকে প্রমাণিত হল যে , ঐশী জ্ঞান উপলদ্ধির একটি অন্যতম উপায় হচ্ছে আত্মশুদ্ধি ও উপাসনায় আত্মিক নিষ্ঠা রক্ষা করা ।
পূর্বে উল্লিখিত তিনটি পদ্ধতির পারস্পরিক পার্থক্য পূর্বোক্ত বর্ণনা অনুসারে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে ,পবিত্র কুরআন ইসলামী শিক্ষা উপলদ্ধির জন্যে তিনটি পদ্ধতি (ইসলামের বাহ্যিকরূপ , বুদ্ধিবৃত্তি ও উপাসনা) উপস্থাপন করেছে । তবে এটাও জানা প্রয়োজন যে , বিভিন্ন দিক থেকে এ তিনটি পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান ।
প্রথমত
:
ইসলামের বাহ্যিক দিক অর্থাৎ শরীয়তি বিধান , যা অত্যন্ত সহজ ভাষায় শাব্দিকভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং যা সর্ব সাধারণের নাগালে রয়েছে । প্রত্যেক ব্যক্তি তার বোধশক্তির মাত্রা অনুযায়ী তা থেকে উপকৃত হয় ।
এই প্রথম পদ্ধতিটি অন্য দুটি পদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক । কারণ অন্য দুটি পদ্ধতি সব সাধারণের জন্যে নয় । বরং তা বিশেষ একটি গোষ্ঠিরজন্য ।
দ্বিতীয়ত
:
প্রথম পদ্ধতিটি এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে ইসলামের মৌলিক ও গৌণ বা শাখা-প্রশাখাগত অংশের জ্ঞান সম্পর্কে অবগত হওয়া যায় । আর এর মাধ্যমে ইসলামের বিশ্বাসগত ও ব্যবহারিক (জ্ঞান ও চরিত্র গঠনের মূলনীতি) জ্ঞান অর্জন করা যায় । তবে অন্য পদ্ধতি দুটি (বুদ্ধিবৃত্তি ও আত্মশুদ্ধি) এমন নয় । অবশ্য যদিও বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস ও শিষ্টাচারগত এবং ব্যবহারিক বিষয় (শরীয়তের বিধান) সম্পর্কে সামষ্টিক জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব । তবে ঐসবের সুক্ষ্ণাতিসুক্ষ্ণ ও খুঁটি-নাটি ব্যাপারগুলো বুদ্ধিবৃত্তির নাগালের বাইরে । একইভাবে আত্মশুদ্ধির পথ , যার মাধ্যমে সৃষ্টি রহস্যের উম্নোচন ঘটে , তা হচ্ছে খোদাপ্রদত্ত একটি কাজ । খোদাপ্রদত্ত ঐ বিষয়ের পরিণতিতে বিশ্বের সকল গুস্তরহস্য মানুষের কাছে উদঘাটিত ও দৃশ্যমান হয় , যার কোন সীমা বা পরিসীমা নির্ধারণ করা সম্ভব নয় । কেননা এ পদ্ধতির মাধ্যমে মানুষ নিজেকে বিশ্বের সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর অন্য সবকিছুকেই সে ভুলে যায় । ঐ অবস্থায় সে সরাসরি এবং স্বয়ং আল্লাহর বিশেষ‘
বিলায়াত’
(কর্তৃত্ব ) ও তত্বাবধানে থাকে । তখন আল্লাহ যা কিছু চান (ব্যক্তি ইচ্ছায় নয়) , তাই তার কাছে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে ।
প্রথম পদ্ধতি
ইসলামের বাহ্যিক অংশ ও তার প্রকারভেদ
যেমনটি ইতিপূর্বে বলা হয়েছে , মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের শাব্দিক অংশকে এর অধ্যয়ন ও শ্রবণকারীদের জন্যে অনুসরণযোগ্য হওয়ার স্বীকৃতি প্রদান করেছেন । আর পবিত্র কুরআন মহানবী (সা.)-এর বাণীকেও মাননীয় দলিল ও প্রমাণ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন । তাই মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন :“
তোমার কাছে কুরআন অবতির্ণ করেছি মানুষকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্যে , যা তাদের প্রতি অবতির্ণ করা হয়েছিল ।”
(সূরা আন্ নাহল , 44 নং আয়াত ।)
পবিত্র কুরআনে তিনি আরও বলেছেন :“
তিনি তাদের মধ্য থেকেই (গোত্রীয়) একজনকে পাঠিয়েছেন রাসূল হিসেবে । যে তাদের কাছে তার আয়াত আবৃতি করে , তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয় ।”
(সূরা আল্ জুমআ , 2 নং আয়াত ।)
আল্লাহ আরও বলেছেন :“
নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূলের মধ্যেই রয়েছে তোমাদের জন্যে সর্বোত্তম আদর্শ ।”
(সূরা আল্ আহজাব , 21 নং আয়াত ।)
এটা অত্যন্ত সুস্পষ্ট ব্যাপার যে , মহানবী (সা.)-এর বাণী , আচরণ , অনুমোদন এবং নিরবতা যদি পবিত্র কুরআনের মতই আমাদের জন্যে অনুকরণীয় আদর্শ না হত , তাহলে পবিত্র কুরআনের উপরোল্লিখিত আয়াত গুলোর অর্থ আদৌ সঠিক হত না । সুতরাং যে কেউ সরাসরি মহানবী (সা.)-এর কোন বানী শ্রবণ করবে , অথবা নির্ভরযোগ্য কোন সূত্র থেকে তার কাছে বর্ণিত হবে , তখন তার জন্যে অবশ্য অনুকরণীয় বলে গণ্য হবে । একইভাবে মহানবী (সা.)-এর“
মুতাওয়াতের”
হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে , রাসূল (সা.)
-এর আহলে- বাইতের বাণীও রাসূল (সা.)-এর বাণীর মতই নির্ভরযোগ্য ও অবশ্য অনুকরণীয় । এভাবে বিশ্বস্ত সূত্রে বর্ণিত মহানবী (সা.)-এর হাদীস দ্বারা আহলে-বাইতের হাদীসের আনুগত্যের অপরিহার্যতা প্রমাণিত । রাসূল (সা.)-এর আহলে-বাইতগণ ইসলামী জ্ঞান জগতের নেতৃত্বের আসনে সমাসীন রয়েছেন । ইসলামী জ্ঞান ও বিধান শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা সম্পূর্ণরূপে নির্ভুল । তাদের যে কোন মৌখিক বক্তব্যই আমাদের জন্যে নির্ভরযোগ্য দলিল ও প্রমাণ স্বরূপ । উপরোল্লিখিত বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে , ইসলামী চিন্তাধারার ক্ষেত্রে ইসলামের বাহ্যিক অংশ , যা একটি মৌলিক সূত্র বা উৎস হিসেবে গণ্য তা দু’
ধরণের : (1) পবিত্র কুরআন ও (2) সুন্নাত ।
এখানে‘
পবিত্র কুরআন’
বলতে , কুরআনের সুস্পষ্ট ও বাহ্যিক অর্থ সম্পন্ন আয়াতগুলোকে বোঝান হচ্ছে । আর‘
সুন্নাত’
বলতে , মহানবী (সা.) এবং তার পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) হাদীসকেই বোঝান হচ্ছে ।
সাহাবীদের হাদীস
সাহাবীদের বর্ণিত হাদীসও যদি মহানবী (সা.)-এর বাণী ও কাজের অনুরূপ এবং পবিত্র আহলে বাইত (আ.)-এর হাদীসের বিরোধী না হয় , তাহলে তাও গ্রহণযোগ্য হবে । কিন্তু সাহাবীদের ঐসব হাদীস যদি তাদের নিজস্ব মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গীর উপর ভিত্তি করে রচিত হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই তা গ্রহণযোগ্য বা নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত হবে না । ইসলামী আইনের দৃষ্টিতে সাহাবীরাও অন্য সকল সাধারণ মুসলমানদের মতই । এমনকি স্বয়ং সাহাবীরাও তাদের নিজেদের মধ্যে সাধারণ মুসলমানদের মতই আচরণ করেছেন ।
পবিত্র কুরআন ও সুন্নতে‘
মুজাদ্দিদ
’
সংক্রান্ত আলোচনা
পবিত্র কুরআনই ইসলামী চিন্তাধারার একমাত্র মূলভিত্তি ও উৎসস্বরূপ । আর একমাত্র কুরআনই ইসলামের অন্যান্য মূল ভিত্তিগুলোকে নির্ভরযোগ্যতার স্বীকৃতি প্রদানের ক্ষমতার অধিকারী । এছাড়া পবিত্র কুরআন নিজেকে জ্যোতি ও অন্যদের জ্যোতির্ময় হিসেবে বর্ণনা করেছে । কুরআন মানব জাতিকে চালেঞ্জ করে আরও বলেছে যে , তারা যদি সুগভীর ভাবে কুরআনকে পর্যবেক্ষণ করে , তাহলে নিঃসন্দেহে তারা ঐ কুরআনের মধ্যে পরস্পর বিরোধী কোন বিষয় খুজে পাবে না । কুরআন মানব জাতিকে চালেঞ্জ করে আরও বলেছে যে , যদি তারা সক্ষম হয় তাহলে কুরআনের মুকাবেলায় কুরআনের মতই আরেকটি গ্রন্থ রচনা করে নিয়ে আসুক । পবিত্র কুরআন যদি সর্ব সাধারণের জন্যে বোধগম্যই না হত , তাহলে মানবজাতির উদ্দেশ্যে কুরআনের এধরণের বক্তব্য প্রদানই বৃথা বলে গণ্য হত । অবশ্য এটা কারও ভাবাও উচিত নয় যে , কুরআনের এ বিষয়টি (কুরআন নিজেই সকলের জন্যে বোধগম্য) এর পূর্ববর্তী বিষয়ের [মহানবী (সা.) ও তার পবিত্র আহলে বাইতগণ কুরআনে বর্ণিত ইসলামী জ্ঞান ও তার নিগূঢ়তত্ব সম্পর্কে জ্ঞান আরোহনের মূল উৎস] সাথে অসংগতিপূর্ণ । কারণঃ ইসলামী বিধানের শুধুমাত্র মূল বিষয়গুলোই সংক্ষিপ্ত আকারে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে । আর তার বিস্তারিত ও সুক্ষ্ণাতিসুক্ষ্ণ ব্যাখার জন্যে আমাদেরকে সুন্নাত তথা মহানবী (সা.) ও তার আহলে বাইতগণের হাদীসের মুখাপেক্ষী হতে হয় । যেমন : নামায , রোযা , ক্রয়-বিক্রয় , বিচার সহ ইবাদত সংক্রান্ত সকল বিষয়েই আমাদেরকে সুন্নাত বা রাসূল (সা.) ও তার আহলে বাইতদের হাদীসের প্রতি নির্ভর করতে হয় । আর মৌলিক বিশ্বাস ও শিষ্টাচার সংক্রান্ত বিষয়গুলোর অর্থ ও ব্যাখা যদিও মোটামুটিভাবে সর্ব সাধারণের বোধগম্য , তথাপি এ ব্যাপারে একমাত্র আহলে বাইতগণের (আ.) গৃহীত পদ্ধতিই আমাদের গ্রহণ করতে হবে । কুরআনের প্রত্যেকটি আয়াতকে অন্য একটি আয়াতের দ্বারা ব্যাখা করতে হবে । নিজেদের মনমত তাফসীর বা ব্যাখা করা যাবে না । পারিপার্শ্বিক পরিবেশে অভ্যস্ত মনের ইচ্ছেমত ব্যাখা করা যাবে না । হযরত ইমাম আলী (আ.) বলেছেন : পবিত্র কুরআনের কিছু আয়াত অন্য কিছু আয়াতের ব্যাখা স্বরূপ । কিছু আয়াত অন্য কিছু আয়াতের জন্যে সাক্ষী স্বরূপ ।
আর মহানবী (সা.) বলেছেন : কুরআনের কিছু অংশ অন্য কিছু অংশের জন্যে ব্যাখা বা বাস্তব নমুনা স্বরূপ ।
মহানবী (সা.) বলেছেন : যে ব্যক্তি তার নিজস্ব মতামতের ভিত্তিতে পবিত্র কুরআনের ব্যাখা করবে , এর মধ্যে সে , নিজেই নিজের জন্যে জাহান্নামে বসবাসের স্থান নির্ধারণ করবে ।
কুরআনকে কুরআনের মাধ্যমে তাফসীরের একটি সহজ উদাহরণ হল : মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের একস্থানে পাপিষ্ট লুত জাতির প্রতি অবতির্ণ ঐশী শাস্তির ব্যাপারে বলেছেন যে , আমি তাদের উপর খারাপ বৃষ্টি বর্ষণ করেছি ।
একই বিষয়ে কুরআনের অন্যত্র তিনি এ ব্যাপারটি শব্দ পরিবর্তনের মাধ্যমে এভাবে বর্ণনা করেছেন : আমি তাদের প্রতি প্রস্তর বর্ষণ করেছি ।
এখানে উল্লেখিত প্রথম আয়াতটিকে দ্বিতীয় আয়াতের সাথে মিলিয়ে নিলেই অর্থ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে । প্রথম আয়াতে উল্লেখিত খারাপ বৃষ্টি বলতে এখানে ঐশী প্রস্তর বৃষ্টি বর্ষণই বোঝানো হয়েছে । কেউ যদি সুক্ষ্ণভাবে গবেষণার দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে এবং সাহাবী ও তাবেঈন মুফাসসিরদের (তাফসীর কারক) হাদীস ও পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) হাদীস সমূহ পর্যবেক্ষণ করে , তাহলে নিঃসন্দেহে সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হবে যে , কুরআনকে কুরআনের মাধ্যমে ব্যাখার নীতি একমাত্র পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) অনুসৃত নীতি ছিল ।