ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব 11%

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 31 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 42943 / ডাউনলোড: 6209
সাইজ সাইজ সাইজ
ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

ইসলাম ও শীয়া মাযহাব

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

‘ইসলাম ও শীয়া মাযহাব’ নামক এ গ্রন্থে ইসলামের দু’টি বৃহৎ উপদলের (শীয়া ও সুন্নী) অন্যতম শীয়া মাযহাবের প্রকৃত পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে । শীয়া মাযহাবের উৎপত্তি, বিকাশ ও চিন্তাধারার প্রকৃতি এবং ইসলামী জ্ঞানের ব্যাপারে শীয়া মাযহাবের দৃষ্টিভঙ্গী এ বইয়ে আলোচিত হয়েছে ।

দ্বিতীয় অধ্যায়

শীয়াদের ধর্মীয় চিন্তাধারা

ধর্মীয় চিন্তাধারার সংজ্ঞা

ধর্মীয় চিন্তাধারা বলতে এখানে সেসব বিষয়ের ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা , আলোচনা ও অনুসন্ধিসাকে বোঝায় , যা ধর্ম সংক্রান্ত কোন সিদ্ধান্ত বা ফলাফল প্রদান করে । যেমনি ভাবে গণিত সংক্রান্ত চিন্তাধারা বলতে সেই চিন্তা ধারাকেই বোঝায় , যা গণিত সংক্রান্ত কোন সিদ্ধান্ত প্রদান করে , অথবা গণিত সংক্রান্ত কোন সমস্যার সমাধান করে ।

ইসলামের ধর্মীয় চিন্তাধারার মূল উৎস

অন্য যে কোন বিষয়ক চিন্তা ধারার মত ধর্মীয় চিন্তা ধারারও উৎস থাকা প্রয়োজন , যা থেকে চিন্তাধারা উৎসারিত হবে এবং যার উপর তা হবে নির্ভরশীল । যেমন : গণিত সংক্রান্ত কোন একটি সমস্যা সমাধানের চিন্তাধারার ক্ষেত্রে গণিত সংক্রান্ত কিছু সূত্র ও জ্ঞান কাজে লাগাতে হয় , যা শেষ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কোন কারিগরি বিষয়ে গিয়ে সমাপ্ত হয় । ধর্মীয় চিন্তাধারার ব্যাপারে ঐশী ধর্ম ইসলাম একমাত্র যে জিনিসটিকে নির্ভরযোগ্য ও মূল উৎস হিসেবে ঘোষণা করেছে , তা হচ্ছে পবিত্র কুরআন । পবিত্র কুরআনই মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চিরন্তন নবুয়তের অকাট্য প্রমাণ স্বরূপ । ইসলামের প্রতি আহবানই কুরআনের মূল বিষয়বস্তু । অবশ্য এখানে বলে রাখা দরকার যে ধর্মীয় চিন্তাধারার ক্ষেত্রে কুরআনকে একমাত্র মূল উৎস বলার অর্থ এটা নয় যে , এ সংক্রান্ত অন্যান্য নির্ভরযোগ্য ও প্রমাণ্য উৎসগুলোকে অস্বীকার করা । এ বিষয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করব ।

কুরআন নির্দেশিত ধর্মীয় চিন্তা ধারার নিয়ম-নীতি

ধর্মীয় লক্ষ্যে পৌছা এবং ইসলামী জ্ঞান উপলদ্ধির ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআনের শিক্ষা তার অনুসারীদেরকে তিনটি পদ্ধতি উপহার দেয় । সেগুলো হচ্ছে: নিষ্ঠা , দাসত্ব বা আনুগত্যের মাধ্যমে ধর্মের বাহ্যিকরূপ , বুদ্ধিমত্তাগত দলিল , ও আধ্যাত্মিক উপলদ্ধি । ব্যাখ্যা : আমরা যদি পবিত্র কুরআনের দিকে লক্ষ্য করি , তাহলে দেখতে পাব যে , কুরআনের বিভিন্ন স্থানে মানব জাতিকে উদ্দেশ্য করে মৌলিক বিশ্বাস সংক্রান্ত বিষয় যেমনঃ তৌহীদ (একত্ববাদ) ,নবুয়ত , মা আদ (কেয়ামত) এবং ব্যবহারিক আইন কানুন সংক্রান্ত বিষয় , যেমনঃ নামায , রোযা..... ইত্যাদি নিয়ম নীতিগুলো মেনে চলার আহবান জানানো হয়েছে । একইভাবে কিছু কাজ করতে নিষেধ করা হয়েছে । কিন্তু সেখানে মহান আল্লাহ স্বীয় বক্তব্যের স্বপক্ষে কোন দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করেনি । বরং স্বীয় প্রভুত্বের ক্ষমতা সেখানে খাটানো হয়েছে । মহান আল্লাহ যদি পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত তার শাব্দিক বক্তব্যগুলোকে নির্ভরযোগ্যতা (প্রামাণ্য) ও গুরুত্ব প্রদান না করতেন , তাহলে অবশ্যই তিনি মানুষের কাছ থেকে ঐ ব্যাপারে আনুগত্য কামনা করতেন না । তখন বাধ্য হয়ে তিনি বলতেন যে , কুরআনের এ ধরণের সাধারণ বক্তব্যসমূহ ধর্মীয় লক্ষ্যসমুহ এবং ইসলামী জ্ঞান অনুধাবন করার একটি পদ্ধতি মাত্র । আমরা পবিত্র কুরআনের এ ধরণের শাব্দিক বর্ণনা গুলোকে (ঈমান আনো আল্লাহর এবং তার রাসূলের প্রতি) ও (নামায প্রতিষ্ঠা কর) ইসলামের বাহ্যিক দিক বলে গণ্য করি । অন্যদিকে আমরা দেখতে পাই যে , পবিত্র কুরআনে তার প্রচুর আয়াত বুদ্ধিমত্তাগত প্রমাণের ব্যাপারে নেতৃত্ব দিচ্ছে । পবিত্র কুরআন মানুষকে আল্লাহর নিদর্শন স্বরূপ এ বিশ্বে ও তাতে বসবাসরত জাতিসমুহ সম্পর্কে সুগভীর চিন্তা ভাবনা করার আহবান্ জানায় । এ ছাড়া স্বয়ং আল্লাহর প্রকৃতপক্ষে সত্য প্রমাণের জন্য বুদ্ধিমত্তাগত দলিল প্রমাণের মাধ্যমে মুক্ত আলোচনার আশ্রয় নিয়েছেন । সত্যি বলতে কি , বিশ্বের কোন ঐশী পুস্তকই পবিত্র কুরআনের মত যুক্তি প্রমাণ ভিত্তিক জ্ঞানের শিক্ষা দেয় না । পবিত্র কুরআন এসব বর্ণনার মাধ্যমে বুদ্ধিমত্তাগত দলিল ও স্বাধীন যুক্তি ভিত্তিক প্রমাণের বিষয়কে নির্ভরযোগ্য ও স্বীকৃত বলে গণ্য করে । কুরআন কখনও প্রথমে ইসলামী জ্ঞানের সত্যতা গ্রহণ করে অতঃপর বুদ্ধিমত্তা প্রসূত যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে সেগুলো যাচাই করার আহবান জানায় না । বরঞ্চ , বাস্তবতার প্রতি পূর্ণ আস্থা সহ কুরআন বলেঃ বুদ্ধিবৃত্তিগত যুক্তি প্রমাণের সাহায্যে যাচাই-বাছাইর মাধ্যমে ইসলামী জ্ঞানমালা অর্জন ও গ্রহণ কর । যখন ইসলামের আহবান্ শুনতে পাবে , তখন তা যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে নেবে । অর্থাৎ যুক্তিভিত্তিক দলিল-প্রমাণের মাধ্যমে ইসলামী জ্ঞানাবলী অর্জন ও গ্রহণ বা তার প্রতি ঈমান আনয়ন করবে । প্রথমে তার প্রতি ঈমান এনে তারপর স্বপক্ষে যুক্তি -প্রমাণ আনার চেষ্টা করবে না । এরপর দার্শনিক চিন্তাধারারও পথ আছে , যা পবিত্র কুরআনও সমর্থন করে । অন্য দিকে পবিত্র কুরআন তার চমৎকার বর্ণনার মাধ্যমে এ ব্যাপারটা স্পষ্ট করেছে যে , সকল সত্য ভিত্তিক জ্ঞানই তাওহীদ (একত্ববাদ) এবং সর্বস্রষ্টা আল্লাহর প্রকৃত পরিচয়গত জ্ঞান থেকেই উৎসারিত । পরিপূর্ণ খোদা পরিচিতি লাভ একমাত্র তাদের জন্যেই সম্ভব , যাদেরকে মহান প্রভু নির্ধারণ করেছেন এবং তিনি নিজেই ঐ সকল বিশেষ বিশ্বাস নিজের জন্যে বেছে নিয়েছেন । আর তারা হচ্ছেন সেসব ব্যক্তি , যারা সবার থেকে নিজেকে পৃথক করেছেন এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য সবকিছুকে ভুলে গেছেন । অতঃপর হৃদয়ের সততা ও আনুগত্যের মাধ্যমে নিজের সকল শক্তিকে একমাত্র সর্বস্রষ্টা আল্লাহর প্রতি বিনিয়োগ করেছেন । মহাপ্রভু আল্লাহর পবিত্র জ্যোতিচ্ছটায় তারা তাদের দৃষ্টিকে জ্যোতির্ময় করেছেন । তারা তাদের বাস্তব দৃষ্টিতে বস্তু নির্ণয়ের নিগুঢ়তত্ব এবং আকাশ ও পৃথিবীর ঐশী রহস্য আবলোকন করেছেন । কারণঃ আত্মিক নিষ্ঠা ও উপাসনার মাধ্যমে তারা দৃঢ় বিশ্বাসের স্তরে উন্নীত হয়েছেন । আ র দৃঢ় বিশ্বাসের (ইয়াকীন) স্তরে উন্নতি হওয়ার কারণে এ আকাশ , পৃথিবী ও অনন্ত জীবনের গোপন রহস্য তাদের কাছে উন্মোচিত হয়েছে । নিম্নলিখিত কুরআনের আয়াতগুলো এ বক্তব্যের প্রমাণ বহন করে ।

(ক) আপনার পূর্বে আমি যে রাসূলই প্রেরণ করেছি , তাকে এ আদেশ দিয়েছি যে , আমি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই । সুতরাং আমারই ইবাদত কর ।১০২ (সূরা আল্ আম্বিয়া ২৫ নং আয়াত ।)

(খ) তারা যা বলে আল্লাহ তা থেকে পবিত্র । তবে কেবল মাত্র সত্যনিষ্ঠ বান্দারা ব্যতীত ।১০৩ (সূরা আল্ সাফাত ১৫৯ নং আয়াত থেকে ১৬০ নং আয়াত পর্যন্ত ।)

(গ) বলুনঃ আমিও তোমাদের মতই একজন মানুষ , আমার প্রতি পত্যাদেশ হয় যে , তোমাদের উপাস্যই একমাত্র উপাস্য । অতএব যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাত কামনা করে , সে যেন সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তার পালনকর্তার ইবাদতে কাউকে শরীক না করে ।১০৪ (সূরা আল্ কাহাফ ১১০ নং আয়াত ।) ( ঘ) এবং পালনকর্তার ইবাদত কর যে পর্যন্ত তোমার নিকট নিশ্চিত জ্ঞান না আসে । (সূরা আল্ হিজর ৯৯ নং আয়াত ।)

(ঙ) আমি এ রূপেই ইব্রাহীমকে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের পরিচালন ব্যবস্থা দেখিয়ে ছিলাম,য াতে সে দৃঢ় বিশ্বাসী হয়ে যায় ।১০৫ (সূরা আল্ আনয়াম ৭৫ নং আয়াত ।)

(চ) কখনও না , নিশ্চয় সৎ লোকদের আমলনামা আছে ইল্লিয়্যীনে আপনি জানেন ইল্লিয়্যীন কি ? এটা লিপিবদ্ধ খাতা , আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ একে প্রত্যক্ষ করে ।১০৬ (সূরা আল্ মুতাফফিফিন ১৮ নং আয়াত থেকে ২১ নং আয়াত পর্যন্ত )

(ছ) কখনও নয় ; যদি তোমরা নিশ্চিত জ্ঞানের অধীকারী হতে তবে অবশ্যই জাহান্নামকে (এই পৃথিবীতেই) দেখতে পেতে ।১০৭ (সূরা আত তাকাসুর ৫ ও ৬ নং আয়াত ।)

অতএব এখান থেকে প্রমাণিত হল যে , ঐশী জ্ঞান উপলদ্ধির একটি অন্যতম উপায় হচ্ছে আত্মশুদ্ধি ও উপাসনায় আত্মিক নিষ্ঠা রক্ষা করা ।

পূর্বে উল্লিখিত তিনটি পদ্ধতির পারস্পরিক পার্থক্য পূর্বোক্ত বর্ণনা অনুসারে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে ,পবিত্র কুরআন ইসলামী শিক্ষা উপলদ্ধির জন্যে তিনটি পদ্ধতি (ইসলামের বাহ্যিকরূপ , বুদ্ধিবৃত্তি ও উপাসনা) উপস্থাপন করেছে । তবে এটাও জানা প্রয়োজন যে , বিভিন্ন দিক থেকে এ তিনটি পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান ।

প্রথমত : ইসলামের বাহ্যিক দিক অর্থাৎ শরীয়তি বিধান , যা অত্যন্ত সহজ ভাষায় শাব্দিকভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং যা সর্ব সাধারণের নাগালে রয়েছে । প্রত্যেক ব্যক্তি তার বোধশক্তির মাত্রা অনুযায়ী তা থেকে উপকৃত হয় ।১০৮ এই প্রথম পদ্ধতিটি অন্য দুটি পদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক । কারণ অন্য দুটি পদ্ধতি সব সাধারণের জন্যে নয় । বরং তা বিশেষ একটি গোষ্ঠিরজন্য ।

দ্বিতীয়ত : প্রথম পদ্ধতিটি এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে ইসলামের মৌলিক ও গৌণ বা শাখা-প্রশাখাগত অংশের জ্ঞান সম্পর্কে অবগত হওয়া যায় । আর এর মাধ্যমে ইসলামের বিশ্বাসগত ও ব্যবহারিক (জ্ঞান ও চরিত্র গঠনের মূলনীতি) জ্ঞান অর্জন করা যায় । তবে অন্য পদ্ধতি দুটি (বুদ্ধিবৃত্তি ও আত্মশুদ্ধি) এমন নয় । অবশ্য যদিও বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস ও শিষ্টাচারগত এবং ব্যবহারিক বিষয় (শরীয়তের বিধান) সম্পর্কে সামষ্টিক জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব । তবে ঐসবের সুক্ষ্ণাতিসুক্ষ্ণ ও খুঁটি-নাটি ব্যাপারগুলো বুদ্ধিবৃত্তির নাগালের বাইরে । একইভাবে আত্মশুদ্ধির পথ , যার মাধ্যমে সৃষ্টি রহস্যের উম্নোচন ঘটে , তা হচ্ছে খোদাপ্রদত্ত একটি কাজ । খোদাপ্রদত্ত ঐ বিষয়ের পরিণতিতে বিশ্বের সকল গুস্তরহস্য মানুষের কাছে উদঘাটিত ও দৃশ্যমান হয় , যার কোন সীমা বা পরিসীমা নির্ধারণ করা সম্ভব নয় । কেননা এ পদ্ধতির মাধ্যমে মানুষ নিজেকে বিশ্বের সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর অন্য সবকিছুকেই সে ভুলে যায় । ঐ অবস্থায় সে সরাসরি এবং স্বয়ং আল্লাহর বিশেষ বিলায়াত (কর্তৃত্ব ) ও তত্বাবধানে থাকে । তখন আল্লাহ যা কিছু চান (ব্যক্তি ইচ্ছায় নয়) , তাই তার কাছে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে ।

প্রথম পদ্ধতি

ইসলামের বাহ্যিক অংশ ও তার প্রকারভেদ

যেমনটি ইতিপূর্বে বলা হয়েছে , মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের শাব্দিক অংশকে এর অধ্যয়ন ও শ্রবণকারীদের জন্যে অনুসরণযোগ্য হওয়ার স্বীকৃতি প্রদান করেছেন । আর পবিত্র কুরআন মহানবী (সা.)-এর বাণীকেও মাননীয় দলিল ও প্রমাণ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন । তাই মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন : তোমার কাছে কুরআন অবতির্ণ করেছি মানুষকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্যে , যা তাদের প্রতি অবতির্ণ করা হয়েছিল । (সূরা আন্ নাহল , ৪৪ নং আয়াত ।)

পবিত্র কুরআনে তিনি আরও বলেছেন : তিনি তাদের মধ্য থেকেই (গোত্রীয়) একজনকে পাঠিয়েছেন রাসূল হিসেবে । যে তাদের কাছে তার আয়াত আবৃতি করে , তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয় । (সূরা আল্ জুমআ , ২ নং আয়াত ।)

আল্লাহ আরও বলেছেন : নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূলের মধ্যেই রয়েছে তোমাদের জন্যে সর্বোত্তম আদর্শ । (সূরা আল্ আহজাব , ২১ নং আয়াত ।)

এটা অত্যন্ত সুস্পষ্ট ব্যাপার যে , মহানবী (সা.)-এর বাণী , আচরণ , অনুমোদন এবং নিরবতা যদি পবিত্র কুরআনের মতই আমাদের জন্যে অনুকরণীয় আদর্শ না হত , তাহলে পবিত্র কুরআনের উপরোল্লিখিত আয়াত গুলোর অর্থ আদৌ সঠিক হত না । সুতরাং যে কেউ সরাসরি মহানবী (সা.)-এর কোন বানী শ্রবণ করবে , অথবা নির্ভরযোগ্য কোন সূত্র থেকে তার কাছে বর্ণিত হবে , তখন তার জন্যে অবশ্য অনুকরণীয় বলে গণ্য হবে । একইভাবে মহানবী (সা.)-এর মুতাওয়াতের হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে , রাসূল (সা.) -এর আহলে- বাইতের বাণীও রাসূল (সা.)-এর বাণীর মতই নির্ভরযোগ্য ও অবশ্য অনুকরণীয় । এভাবে বিশ্বস্ত সূত্রে বর্ণিত মহানবী (সা.)-এর হাদীস দ্বারা আহলে-বাইতের হাদীসের আনুগত্যের অপরিহার্যতা প্রমাণিত । রাসূল (সা.)-এর আহলে-বাইতগণ ইসলামী জ্ঞান জগতের নেতৃত্বের আসনে সমাসীন রয়েছেন । ইসলামী জ্ঞান ও বিধান শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা সম্পূর্ণরূপে নির্ভুল । তাদের যে কোন মৌখিক বক্তব্যই আমাদের জন্যে নির্ভরযোগ্য দলিল ও প্রমাণ স্বরূপ । উপরোল্লিখিত বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে , ইসলামী চিন্তাধারার ক্ষেত্রে ইসলামের বাহ্যিক অংশ , যা একটি মৌলিক সূত্র বা উৎস হিসেবে গণ্য তা দু ধরণের : (১) পবিত্র কুরআন ও (২) সুন্নাত ।

এখানে পবিত্র কুরআন বলতে , কুরআনের সুস্পষ্ট ও বাহ্যিক অর্থ সম্পন্ন আয়াতগুলোকে বোঝান হচ্ছে । আর সুন্নাত বলতে , মহানবী (সা.) এবং তার পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) হাদীসকেই বোঝান হচ্ছে ।

সাহাবীদের হাদীস

সাহাবীদের বর্ণিত হাদীসও যদি মহানবী (সা.)-এর বাণী ও কাজের অনুরূপ এবং পবিত্র আহলে বাইত (আ.)-এর হাদীসের বিরোধী না হয় , তাহলে তাও গ্রহণযোগ্য হবে । কিন্তু সাহাবীদের ঐসব হাদীস যদি তাদের নিজস্ব মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গীর উপর ভিত্তি করে রচিত হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই তা গ্রহণযোগ্য বা নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত হবে না । ইসলামী আইনের দৃষ্টিতে সাহাবীরাও অন্য সকল সাধারণ মুসলমানদের মতই । এমনকি স্বয়ং সাহাবীরাও তাদের নিজেদের মধ্যে সাধারণ মুসলমানদের মতই আচরণ করেছেন ।

পবিত্র কুরআন ও সুন্নতে মুজাদ্দিদ সংক্রান্ত আলোচনা

পবিত্র কুরআনই ইসলামী চিন্তাধারার একমাত্র মূলভিত্তি ও উৎসস্বরূপ । আর একমাত্র কুরআনই ইসলামের অন্যান্য মূল ভিত্তিগুলোকে নির্ভরযোগ্যতার স্বীকৃতি প্রদানের ক্ষমতার অধিকারী । এছাড়া পবিত্র কুরআন নিজেকে জ্যোতি ও অন্যদের জ্যোতির্ময় হিসেবে বর্ণনা করেছে । কুরআন মানব জাতিকে চালেঞ্জ করে আরও বলেছে যে , তারা যদি সুগভীর ভাবে কুরআনকে পর্যবেক্ষণ করে , তাহলে নিঃসন্দেহে তারা ঐ কুরআনের মধ্যে পরস্পর বিরোধী কোন বিষয় খুজে পাবে না । কুরআন মানব জাতিকে চালেঞ্জ করে আরও বলেছে যে , যদি তারা সক্ষম হয় তাহলে কুরআনের মুকাবেলায় কুরআনের মতই আরেকটি গ্রন্থ রচনা করে নিয়ে আসুক । পবিত্র কুরআন যদি সর্ব সাধারণের জন্যে বোধগম্যই না হত , তাহলে মানবজাতির উদ্দেশ্যে কুরআনের এধরণের বক্তব্য প্রদানই বৃথা বলে গণ্য হত । অবশ্য এটা কারও ভাবাও উচিত নয় যে , কুরআনের এ বিষয়টি (কুরআন নিজেই সকলের জন্যে বোধগম্য) এর পূর্ববর্তী বিষয়ের [মহানবী (সা.) ও তার পবিত্র আহলে বাইতগণ কুরআনে বর্ণিত ইসলামী জ্ঞান ও তার নিগূঢ়তত্ব সম্পর্কে জ্ঞান আরোহনের মূল উৎস] সাথে অসংগতিপূর্ণ । কারণঃ ইসলামী বিধানের শুধুমাত্র মূল বিষয়গুলোই সংক্ষিপ্ত আকারে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে । আর তার বিস্তারিত ও সুক্ষ্ণাতিসুক্ষ্ণ ব্যাখার জন্যে আমাদেরকে সুন্নাত তথা মহানবী (সা.) ও তার আহলে বাইতগণের হাদীসের মুখাপেক্ষী হতে হয় । যেমন : নামায , রোযা , ক্রয়-বিক্রয় , বিচার সহ ইবাদত সংক্রান্ত সকল বিষয়েই আমাদেরকে সুন্নাত বা রাসূল (সা.) ও তার আহলে বাইতদের হাদীসের প্রতি নির্ভর করতে হয় । আর মৌলিক বিশ্বাস ও শিষ্টাচার সংক্রান্ত বিষয়গুলোর অর্থ ও ব্যাখা যদিও মোটামুটিভাবে সর্ব সাধারণের বোধগম্য , তথাপি এ ব্যাপারে একমাত্র আহলে বাইতগণের (আ.) গৃহীত পদ্ধতিই আমাদের গ্রহণ করতে হবে । কুরআনের প্রত্যেকটি আয়াতকে অন্য একটি আয়াতের দ্বারা ব্যাখা করতে হবে । নিজেদের মনমত তাফসীর বা ব্যাখা করা যাবে না । পারিপার্শ্বিক পরিবেশে অভ্যস্ত মনের ইচ্ছেমত ব্যাখা করা যাবে না । হযরত ইমাম আলী (আ.) বলেছেন : পবিত্র কুরআনের কিছু আয়াত অন্য কিছু আয়াতের ব্যাখা স্বরূপ । কিছু আয়াত অন্য কিছু আয়াতের জন্যে সাক্ষী স্বরূপ ।১০৯ আর মহানবী (সা.) বলেছেন : কুরআনের কিছু অংশ অন্য কিছু অংশের জন্যে ব্যাখা বা বাস্তব নমুনা স্বরূপ ।১১০

মহানবী (সা.) বলেছেন : যে ব্যক্তি তার নিজস্ব মতামতের ভিত্তিতে পবিত্র কুরআনের ব্যাখা করবে , এর মধ্যে সে , নিজেই নিজের জন্যে জাহান্নামে বসবাসের স্থান নির্ধারণ করবে ।১১১ কুরআনকে কুরআনের মাধ্যমে তাফসীরের একটি সহজ উদাহরণ হল : মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের একস্থানে পাপিষ্ট লুত জাতির প্রতি অবতির্ণ ঐশী শাস্তির ব্যাপারে বলেছেন যে , আমি তাদের উপর খারাপ বৃষ্টি বর্ষণ করেছি ।১১২ একই বিষয়ে কুরআনের অন্যত্র তিনি এ ব্যাপারটি শব্দ পরিবর্তনের মাধ্যমে এভাবে বর্ণনা করেছেন : আমি তাদের প্রতি প্রস্তর বর্ষণ করেছি ।১১৩ এখানে উল্লেখিত প্রথম আয়াতটিকে দ্বিতীয় আয়াতের সাথে মিলিয়ে নিলেই অর্থ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে । প্রথম আয়াতে উল্লেখিত খারাপ বৃষ্টি বলতে এখানে ঐশী প্রস্তর বৃষ্টি বর্ষণই বোঝানো হয়েছে । কেউ যদি সুক্ষ্ণভাবে গবেষণার দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে এবং সাহাবী ও তাবেঈন মুফাসসিরদের (তাফসীর কারক) হাদীস ও পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) হাদীস সমূহ পর্যবেক্ষণ করে , তাহলে নিঃসন্দেহে সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হবে যে , কুরআনকে কুরআনের মাধ্যমে ব্যাখার নীতি একমাত্র পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) অনুসৃত নীতি ছিল ।

রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকার ও জ্ঞানগত নেতৃত্বের বিষয়

ইসলামের শিক্ষা থেকে শীয়ারা যে জ্ঞান লাভ করেছিল , তাতে শীয়ারা বিশ্বাস করত যে , যে বিষয়টি সমাজের জন্যে সর্বপ্রথম জরুরী তা হল , ইসলামের শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সবার সুস্পষ্ট ধারণার অধিকারী হওয়া ।20 আর পরবর্তী পর্যায়ে সেই ইসলামী শিক্ষা সমূহকে পূর্ণ ভাবে সমাজে প্রয়োগ করা । অন্য কথায় ,

প্রথমতঃ সমাজের প্রত্যেককেই এ পৃথিবী ও মানব জাতিকে বাস্তব দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে একজন মানুষ হিসেবে নিজ দায়িত্ব সম্বন্ধে অবগত এবং তা পালনে বর্ত হওয়া উচিত । এমন কি তা যদি তার ইচ্ছার বিরোধীও হয় তবুও তা পালন করা উচিত ।

দ্বিতীয়তঃ একটি ইসলামী শাসন ব্যবস্থা সমাজে ইসলামের প্রকৃত বিধি বিধান সমূহকে সংরক্ষণ ও বাস্তবায়ন করবে । যাতে করে ঐ সমাজের কেউই যেন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপাসনা না করে এবং সবাই পূর্ণ স্বাধীনতাসহ ব্যক্তি ও সামাজিক ন্যায়বিচার ভোগ করতে পারে । আর এদু টি মহান লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্যে এমন এক ব্যক্তির প্রয়োজন , যে সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে নিস্পাপ হওয়ার মত গুণের অধিকারী হবে । অন্যথায় হয়ত এমন কোন লোক সেই শাসন ব্যবস্থা ও জ্ঞানগত নেতৃত্বের আসনের অধিকারী হয়ে বসবে , যে তার ঐ গুরুদায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে চিন্তাগত পথভ্রষ্টতা বা বিশ্বাসঘাতকতার সম্ভবনা থেকে মুক্ত নয় । এর ফলে তখন ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতা ব্যহত হবে ও ইসলামী শাসন ব্যবস্থা একটি অত্যাচারী একনায়েক বা রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হবে । তখন ইসলামের পবিত্র জ্ঞানভান্ডার পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মের মতই স্বেচ্ছাচারী ও স্বার্থান্বেষী পণ্ডিত মহলের দ্বারা বিকৃতির স্বীকার হবে । বিশ্বনবী (সা.)-এর সাক্ষ্য অনুযায়ী একমাত্র যে ব্যক্তি কথায় ও কাজে এ পদের জন্যে উপযুক্ত ছিল এবং যার পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর পবিত্র কুরআন ও রাসূল (সা.)-এর সুন্নাতের অনুরূপ ছিল , তিনি হচ্ছেন হযরত আলী (আ.) ।21

যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠদের বক্তব্য ছিল এই যে , কুরাইশরা খেলাফতের ব্যাপারে হযরত আলী (আ.)-এর ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তির বিরোধী । তারপরও তাদের উচিত ছিল বিরোধীদেরকে সত্যের দিকে ফিরে আসতে বাধ্য করা এবং বিদ্রোহীদেরকে দমন করা । ঠিক যেমনটি যাকাত প্রদান অস্বীকারকারীদের সাথে করা হয়েছিল । এমনকি তাদের সাথে যুদ্ধও করা হয়েছিল । তবুও যাকাত আদায় থেকে তারা বিরত হয়নি । তাই কুরাইশদের বিরোধীতার ভয়ে সত্য প্রতিষ্ঠার কাজ থেকে হাত গুটিয়ে সত্যকে হত্যা করা তাদের কখনও উচিত হয়নি । নির্বাচিত খেলাফতর্ক সম্মতি প্রদান থেকে যে কারণটি শীয়াদের বিরত রেখে ছিল , তা হচ্ছে এ ঘটনার অনাকাংখিত পরিণতি , যা ইসলামী শাসন ব্যবস্থার জন্যে বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসত এবং ইসলামের সুমহান শিক্ষার ভিত্তিকে ধ্বংস করে দিত । বাস্তবিকই পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে ক্রমেই এ ধারণার সত্যতা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় । এর ফলে শীয়াদের এ সংক্রান্ত বিশ্বাস আরও দৃঢ়তর হতে থাকে । যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে শীয়ারা বাহ্যত হাতে গানা অল্প কয়েকজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল , যা বৃহত্তর জনসমুদ্রে হারিয়ে গিয়েছিল , তথাপি পবিত্র আহলে বাইতগণ (আ.) গোপনে ইসলামের শিক্ষাদান কর্মসূচী এবং নিজস্ব পদ্ধতিতে ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে নিরন্তন চেষ্টা চালিয়ে যান । অন্যদিকে এর পাশাপাশি ইসলামী শক্তির উন্নতি ও সংরক্ষণের বৃহত্তর স্বার্থে তারা শ্বাসক গোষ্ঠির সাথে প্রকাশ্যে বিরোধীতা থেকে বিরত থাকেন । এমন কি শীয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠদের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে সকল জিহাদেরও অংশ গ্রহণ করতেন এবং গণ-স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে প্রয়োজনে হস্তক্ষেপও করতেন । স্বয়ং হযরত আলী (আ.) ইসলামের স্বার্থে সংখ্যাগরিষ্ঠদের পথ নির্দেশনা দিতেন ।22

নির্বাচিত খেলাফতের রাজনীতি ও শীয়াদের দৃষ্টিভঙ্গী

শীয়া মাযহাবের অনুসারীরা বিশ্বাস করতেন যে , ইসলামের ঐশী আইন বা শরীয়ত , যার উৎস পবিত্র কুরআন ও বিশ্বনবী (সা.)-এর সুন্নাত তা কেয়ামত পর্যন্ত সম্পূর্ণ অক্ষুন্ন ও অপরিবর্তীত অবস্থায় এবং স্বীয় মর্যাদায় টিকে থাকবে ।23 ইসলামী আইনসমূহের পূর্ণ বাস্তবায়নের ব্যাপারে এতটকু টাল-বাহানা করার অধিকার ইসলামী সরকারের নেই । ইসলামী সরকারের একমাত্র দায়িত্ব হচ্ছে পরামর্শ সভার পরামর্শ ও সমস্যামায়িক পরিস্থিতি অনুযায়ী ইসলামী শরীয়তের (আইন) ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ । কিন্তু রাসূল (সা.)-এর মৃত্যু পুর্ব অসুস্থ অবস্থার সময়ে সেই ঐতিহাসিক কাগজ কলম আনার ঘটনা খলিফা নির্বাচন ও রাজনৈতিক বাইয়াত গ্রহণসহ ইত্যাদি ঘটনা তদানিন্তন খেলাফতের উদ্দেশ্যকে স্পষ্ট করে তোলে । এ ব্যাপারটি পরিস্কার হয়ে যায় যে , নির্বাচিত খেলাফতের মূল ব্যক্তিবগ ও সমর্থকগণ পবিত্র কুরআনকে কেবল মাত্র একটি সংবিধান হিসাবে সংরক্ষণে বিশ্বাসী । কিন্তু রাসূল (সা.)-এর সুন্নাত ও আদর্শকে তারা অপরিবর্তনীয় বলে মনে করত না । বরং তাদের ধারণা ছিল ইসলামী সরকার নিজ স্বার্থের প্রয়োজনে রাসূল (সা.)-এর সুন্নাত বাস্তবায়ন থেকেও বিরত থাকতে পারে । তদানিন্তন খেলাফততন্ত্রের এ দৃষ্টি ভঙ্গীর প্রমাণ পরবর্তীতে রাসূল (সা.)-এর বহু সাহাবীদের কথা ও কাজে পরিলক্ষিত হয় (সাহাবীরা মুজতাহিদ । ইজতিহাদ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যদি সত্যে উপনীত হন , পুরস্কৃত হবেন । আর যদি ভুল করেন , ক্ষমা প্রাপ্ত হবেন) । এর স্পষ্ট উদাহরণ জনৈক সাহাবী ও সেনাপতি খালিদ বিন ওয়া লিদের ঐতিহাসিক ঘটনায় পাওয়া যায় । কোন এক রাতে খালিদ বিন ওয়ালিদ জনাব মালিক বিন নুওয়াইরা নামক জনৈক গণ্যমান্য মুসলমানের বাড়িতে আকস্মিকভাবে অতিথি হন । খালিদ বিন ওয়ালিদ তাকে অপ্রত্যাশিতভাবে হত্যা করেন এবং তাঁর কর্তিত মাথা চুলার আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন ।

অতঃপর ঐ রাতেই নিহতের স্ত্রীকে ধর্ষণ করেন । কিন্তু , সামরিক বাহিনীর জন্যে খালিদ বিন ওয়ালিদের মত সুযোগ্য সেনাপতির প্রয়োজন । এই স্বার্থে খলিফা এ ধরণের জঘণ্য ও নৃশংস হত্যা কান্ডের বিচার ও প্রয়োজনীয় শাস্তি , খালিদ বিন ওয়ালিদের উপর প্রয়োগ থেকে বিরত খাকলেন ।24 একইভাবে খলিফার প্রশাসন মহানবী (সা.)-এর আত্মীয়- স্বজন ও পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) প্রতি নিয়মিত প্রদত্ত খুমস্ বন্ধ করে দেন ।25 রাসূল (সা.)-এর হাদীস লেখা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় । যদি কখনও লিপিবদ্ধ কোন হাদীস কোথাও কারো কাছে পাওয়া যেত তাহলে সাথে সাথেই তা বাজেয়াপ্ত করা হত এবং পুড়িয়ে ফেলা হত ।26 হাদীস লিপিবদ্ধকরণ নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি সমগ্র খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে অব্যাহত ছিল । আর তা উমাইয়া খলিফা ওমর বিন আব্দুল আজিজের শাসন আমলে (হিঃ 99 - 102 হিঃ) পর্যন্ত বলবৎ থাকে ।27 দ্বিতীয় খলিফা ওমরের সময় (হিঃ 13 - 25 হিঃ) খেলাফত প্রশাসনের এ রাজনৈতিক পদক্ষেপটি আরও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে । এ সময় দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইসলামী শরীয়তের বেশ কিছু আইনের পরিবর্তন সাধান করেন । যেমন : হজ্জে তামাত্তু মুতা বিবাহ্ এবং আযান হাইয়্যা আলা খায়রিল আমাল ব্যাক্যটির ব্যাবহার তিনি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন ।28 তিনিই একই বৈঠকে তিন তালাকসহ এজাতীয় আরো অন্য নীতির প্রচলন শুরু করেন ।29

দ্বিতীয় খলিফা ওমর সর্বপ্রথম বাইতুল মালের অর্থ জনগণের মধ্যে বন্টনের সময় বৈষম্যেরে সৃষ্টি করেন ।30 এ বিষয়টি পরবর্তীতে মুসলমানদের মাঝে আশ্চর্যজনক শ্রেণীবৈষম্য এবং ভয়ংকর ও রক্তাক্ত সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটায় । দ্বিতীয় খলিফা ওমরের খেলাফতের সময়েই মুয়াবিয়া সিরিয়ায় রাজপ্রাসাদে বসে শাসনকার্য পরিচালনার মাধ্যমে রাজতন্ত্রের সূচনা করেন । দ্বিতীয় খলিফা ওমর তাকে আরবের কাসূরা (জনৈক বিখ্যাত পারস্য সম্রাটের উপাধি) বা বাদশাহ্ বলে ডাকতেন । তিনি কখনো মুয়াবিয়ার এধরণের কাজের প্রতিবাদ করেননি ।

দ্বিতীয় খলিফা ওমর হিজরী 23 সনে জনৈক পারসিক ক্রীতদাসের হাতে নিহত হন । মৃত্যুর পূর্বে খলিফা ওমরের নির্দেশে 6 সদস্য বিশিষ্ট খলিফা নির্বাচন কমিটি গঠিত হয় । এ কমিটির সংখ্যাধিক্যের মতামতের ভিত্তিতে তৃতীয় খলিফা নির্বাচিত হন ও তার শাসনভার গ্রহণ করেন । তৃতীয় খলিফা ওসমান তার শাসন আমলে উমাইয়া বংশীয় আপন আত্মীয় স্বজনদের ব্যাপক হারে প্রশাসনে নিযুক্ত করার মাধ্যমে উমাইয়্যাদেরকে জনগণের উপর প্রভুত্ব বিস্তারে সহায়তা করেন । হিজাজ (বর্তমান সৌদি আরব) ইরাক ও মিশরসহ অন্যান্য ইসলামী প্রদেশগুলোর শাসনভার তিনি উমাইয়া বংশের লোকজনের উপর অর্পন করেন ।31 এরা সবাই প্রকাশ্যভাবে অন্যায়-অত্যাচার , দূর্নীতি , ইসলামী নীতিমালা লংঘন ও পাপাচার পচলনের মাধ্যমে ইসলামী প্রশাসনে চরম অরাজকতার সূত্রপাত ঘটায় ।32 তৎকালীন ইসলামী বিশ্বের চতুর্দিক থেকে জনগণের অভিযোগ ওসমানের কাছে পৌছতে লাগল । কিন্তু খলিফা ওসমান উমাইয়া বংশীয় ক্রীতদাসী এবং বিশেষ করে জনাব মারওয়ান বিন হাকামের (খলিফার চাচাতো ভাই এবং প্রধানমন্ত্রী) দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবান্বিত ছিলেন । ফলে জনগণের অভিযোগকে তিনি কখনই গুরুত্ব দিতেন না ।

শুধু তাই নয় , মাঝে মাঝে তিনি অভিযোগকারীদের শায়েস্তা করার নির্দেশ জারী করতেন ।33 অবশেষে হিজরী 35 সনে জনগণ খলিফার বিরূদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে । খলিফা ওসমানের বাড়ী বেশ ক দিন ঘেরাও রাখা হয় এবং কিছু সংঘর্ষের পর তারা খলিফাকে হত্যা করে । সিরিয়ার শাসনকর্তা মুয়াবিয়া ছিলেন উমাইয়া বংশের লোক এবং তৃতীয় খলিফা ওসমানের ঘনিষ্ট আত্মীয় । ওসমান তার শাসন আমলে সিরিয়ার প্রশাসনকে অধিক শক্তিশালী করেন । প্রকৃতপক্ষে খেলাফতের গুরুভার ক্রমেই সিরিয়ায় কেন্দ্রীভূত হতে থাকে । যদিও রাষ্ট্র পরিচালনার কাঠামোগত কেন্দ্র ছিল মদীনা । তবে তা একটি বাহ্যিকরূপ ছাড়া আর কিছুই ছিল না ।34

ইসলামের প্রথম খলিফা সাহাবীদের দ্বারা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হন । দ্বিতীয় খলিফা , প্রথম খলিফার ওসিয়াত নামার মাধ্যমে মনোনয়ন লাভ করে ক্ষমতায় আসেন । আর তৃতীয় খলিফা , দ্বিতীয় খলিফার দ্বারা মনোনিত ছয় সদস্য বিশিষ্ট কমিটির মাধ্যমে মনোনীত হন । ঐ কমিটির নির্বাচনের নীতিমালাও পূর্ব থেকেই দ্বিতীয় খলিফার দ্বারা নির্ধারিত হয়েছিল । যাই হোক , ইসলামের প্রথম তিন খলিফা , যাদের শাসনকাল প্রায় পচিশঁ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তাদের গৃহীত রাজনীতির স্বরূপ এটাই ছিল যে , তারা নিজস্ব ইজতিহাদু (গবেষণা) অনুসারে প্রয়োজনীয় যুগপোযাগী সিদ্ধান্ত নিবেন এবং সমাজে তা প্রয়োগ করবেন । ইসলামী জ্ঞান ও সংস্কৃতি প্রসারের ব্যাপারে তাদের নীতি ছিল এই যে , পবিত্র কুরআন , তাফসীর (ব্যাখা) বা গবেষণা ছাড়াই পঠিত হবে । আর রাসূল (সা.) এর হাদীস অলিখিত ভাবে প্রচারিত হবে এবং অবশ্যই তা মৌখিক বর্ণনা ও শবণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে । পবিত্র কুরআনের অনুলিপি তৈরী করণ অত্যন্ত সীমিত ও সুনিয়ন্ত্রিত ছিল । আর হাদীস লিখন ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ।35 হিজরী 12 সনে সংঘটিত ইয়ামামা র যুদ্ধ পর্যন্ত এ অবস্থা বলবৎ ছিল । ঐ যুদ্ধে বেশ কিছু সাহাবী নিহত হন যারা কুরআনের কারী ও হাফেজ ছিলেন । তখন দ্বিতীয় খলিফা ওমর , প্রথম খলিফা আবুব বকরকে সমগ্র কুরআনকে গ্রন্থবদ্ধ আকারে এক যায়গায় সংগৃহীত করার জন্য প্রস্তাব দেন । দ্বিতীয় খলিফা ওমর বিন খাত্তাব বলেন , ভবিষ্যতে যদি এ ভাবে কুরআনের আরও হাফিজ নিহত হন , তাহলে অদুর ভবিষ্যতে আমাদের মধ্যে আর কুরআনের অস্তিত্ব থাকবে না । সুতরাং কুরআনের সব আয়াতগুলো এক যায়গায় সংগ্রহ করে পুস্তক আকারে লিপিবদ্ধ করা প্রয়োজন ।36

এ সিদ্ধান্ত শুধু কুরআনের ক্ষেত্রেই গৃহীত হয় । অথচ রাসূল (সা.)-এর হাদীস , কুরআনের পরই যার অবস্থান , তাও একই বিপদের সম্মুখীন ছিল । কারণ , রাসূল (সা.)-এর হাদিসের ভাবার্থ মুলক বর্ণনা তার পরিবর্তন , পরিবর্ধন সংকোচন , বিস্মৃতি , বিকৃতি ও জালকৃত হওয়ার হাত থেকে আদৌ নিরাপদ ছিল না । কিন্তু রাসূল (সা.)-এর হাদীস সংরক্ষণের ব্যাপারে আদৌ কোন গুরুত্ব দেয়া হয়নি । এমন কি যেখানেই লিপিবদ্ধ কোন হাদীস পাওয়া যেত , সাথে সাথেই তা পুড়িয়ে ফেলা হত । পরিণতিতে অবস্থা এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌছালো যে , খুব অল্প দিনের মধ্যেই নামায , রোযা.... ইত্যাদির মত ইসলামের অতীব প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ব্যাপারেও পরস্পর বিরোধী মতামতের সৃষ্টি হল । একইভাবে এ যুগে ইসলামী জ্ঞানবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাগুলোর উন্নয়নের ব্যাপারেও আদৌ কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি । অথচ , পবিত্র কুরআনে ও হযরত রাসূল (সা.)-এর হাদীসে , জ্ঞান অর্জন ও তার প্রসারের ব্যাপারে যে প্রশংসা , অনুপ্রেরণা ও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে , খেলাফতের যুগে এসে তা সম্পূর্ণ নিস্ক্রীয় ও স্থবির হয়ে পড়ে । অধিকাংশ মুসলমানই তখন একের পর এক রাজনৈতিক বিজয় নিয়ে মেতে ছিল । আর তখন তাদের যুদ্ধলদ্ধ গণিমতের সীমাহীন সম্পদের স্রোত সমগ্র আরব সাম্রাজ্যের দিকে ধাবিত হয়েছিল । যার ফলে নবীবংশের পবিত্র জ্ঞানের ঝর্ণাধারা থেকে উপকৃত হওয়ার ব্যাপারে মুসলমানরা আদৌ কোন গুরুত্ব দেয়নি । ঐ পবিত্র জ্ঞানধারার উৎসমুখ ছিলেন হযরত ইমাম আলী (আ.) তার ব্যাপারে মহানবী (সা.) বলেছেন যে , হযরত আলী (আ.)-ই ইসলাম এবং পবিত্র কুরআন সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী ব্যক্তি । এমন কি কুরআন সংগ্রহের সময়ও খেলাফত প্রশাসন হযরত আলী (আ.)-কে সে ব্যাপারে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করার অধিকার দেয়নি । শুধু তাই নয় , এ ব্যাপারে তার নামটাও তারা উচ্চারণ করেনি সেদিন । অথচ খেলাফত প্রশাসন এটা ভাল করেই জানতেন যে , রাসূল (সা.)-এর মৃত্যুর পর হযরত আলী (আ.) বহুদিন পর্যন্ত নিজেকে ঘরে আবদ্ধ করে রাখেন । আর ঐ সময়ে তিনি কুরআনের সমগ্র লিপিসমূহকে একর্তিতে ভাবে সংগ্রহ করে ছিলেন ।37 খেলাফত প্রশাসনের এমনই ধরণের আরও অনেক কর্মকান্ড হযরত আলী (আ.) এর ভক্ত ও অনুসারীদের বিশাসকে অধিকতর সূদৃঢ় এবং সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সতর্ক হতে সাহায্য করেছিল । এর ফলে দিনের পর দিন তাদের কার্যক্রমের গতিও বহু গুণে বৃদ্ধি পেতে থাকে । ওদিকে ব্যাপক ভাবে গণ-প্রশিক্ষণের সুযোগ না থাকায় হযরত আলী (আ.) ব্যক্তিগত পর্যায়ে লোক তৈরীর কাজ চালিয়ে যান । এই দীর্ঘ 25 বছরের মধ্যে হযরত আলী (আ.)-এর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চারজন শিষ্য ও আপ্রাণ সহযোগীর তিনজনই পরলোক গমন করেন । যারা ছিলেন হযরত সালমান ফারসী (রা.) , হযরত আবুযার গিফারী (রা.) এবং হযরতুমিকদাদ কিন্তু ইতিমধ্যেই আরও বহু সংখ্যক সাহাবী এবং হেজাজ (বর্তমান সৌদি আরব) , ইয়ামান , ইরাক সহ বিভিন্ন স্থানের অসংখ্য তাবেয়ীন (যারা রাসূলের সাহাবীদের সাক্ষাত লাভ করেছেন) হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর অনুসারীতে পরিণত হন । যার ফলে তৃতীয় খলিফা নিহত হওয়ার পর প্রশাসন রাজ্যের চতুর্দিক থেকে গণসমর্থনের জোয়ার হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর দিকে ধাবিত হয় । সকলে গণভাবে হযরত আলী (আ.)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন এবং তিনি খলিফা হিসেবে নির্বাচিত হন ।

হযরত আলী ( আ .)- এর খেলাফত ও তার প্রশাসনিক পদ্ধতি

হিজরী 35 সনের শেষ ভাগে হজরত আলী (আ.)-এর খেলাফত কাল শুরু হয় । প্রায় 4 বছর 5 মাস পর্যন্ত এই খেলাফত স্থায়ী ছিল । হযরত আলী (আ.) খেলাফত পরিচালনার ব্যাপারে হযরত রাসূল (সা.)-এর নীতির অনুসরণ করেন ।38 তার পূর্ববতী খলিফাদের যুগে যেসব (ইসলামী নীতি মালার) পরিবর্তন ঘটানো হয়েছিল , তিনি সেগুলোকে পুনরায় পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসেন । খেলাফত প্রশাসনে নিযুক্ত অযোগ্য লোকদের তিনি দায়িত্ব থেকে অপসারণ করেন ।39 তার এসব পদক্ষেপ প্রকৃতপক্ষে এক বৈপ্লবিক আন্দোলন ছিল , যা পরবর্তিতে প্রচুর সমস্যারও সৃষ্টি করেছে । হযরত ইমাম আলী (আ.) খেলাফতের প্রথম দিনে জনগণের উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেখানে তিনি বলেন : হে জনগণ! জেনে রেখো নবুয়তের যুগে যে সমস্যায় তোমরা ভুগেছিলে আজ আবার সেই সমস্যাতেই জড়িয়ে পড়লে । তোমাদের মধ্যে একটা ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে । যে সকল মহৎ ব্যক্তিরা এতদিন পিছিয়ে ছিলেন তারা এখন সামনের সারিতে চলে আসবেন । একইভাবে যেসব অযোগ্য লোক এতদিন সামনের সারিতে অবস্থান নিয়েছিল আজ তারা পিছনে চলে যাবে । (সত্য ও মিথ্যা বিদ্যমান এবং এতদুভয়ের প্রত্যেকেরই অনুসারীও রয়েছে । তবে সবারই উচিত সত্যকে অনুসরণ করা) মিথ্যার পরিমাণ যদি অধিকও হয় , সেটা এমন নতুন কিছু নয় । সত্যের পরিমাণ যদি কমও হয় , হোক না! অনেক সময় কমওতো সবার চেয়ে অগ্রগামী হয়ে থাকে । আর উন্নতির আশাও এতের রয়েছে । তবে এমনটি খুব কমই দেখা যায় যে , যা একবার মানুষের হাতছাড়া হয়ে গেছে তা পনুরায় তার কাছে ফিরে এসেছে ।40

এ ভাবে হযরত আলী (আ.) তার বৈপ্লবিক প্রশাসনকে অব্যাহত রাখেন । কিন্তু বৈপ্লবিক আন্দোলন সমূহের স্বাভাবিক পরিণতি হচ্ছে , এই আন্দোলনের ফলে যাদের স্বার্থ বিঘ্নিত হয় , তারা এ ধারার বিরোধী হয়ে ওঠে । আমরা দেখতে পাই হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফতের বৈপ্লবিক নীতি বহু স্বার্থন্বেষী মহলকে আঘাত করেছিল । তাই শুরুতেই সারা দেশের যত্রতত্র থেকে আলী (আ.)-এর খেলাফতের বিরোধী সূর বেজে ওঠে । বিরোধীরা তৃতীয় খলিফার রক্তের প্রতিশোধের ষড়যন্ত্র মুলক শ্লোগানের ধুয়া তুলে বেশ কিছু রক্তাক্ত যুদ্ধের অবতারণা করে । এ জাতীয় গৃহযুদ্ধ হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর সমগ্র খেলাফতকালব্যাপী অব্যাহত ছিল । শীয়াদের দৃষ্টিতে ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার ছাড়া এসব যুদ্ধ সূচনাকারীদের অন্য কোন উদ্দেশ্যই ছিল না ।

তৃতীয় খলিফার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের শ্লোগান ছিল সম্পূর্ণরূপে গণপ্রতারণামূলক একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার । এমনকি কোন ভুল বোঝা বুঝির এখানে অবকাশ নেই ।41

হযরত আলী (আ.)-এর যুগে সংঘটিত প্রথম যুদ্ধ যা জংগে জামাল নামে পরিচিত , তা শুধুমাত্র শ্রেণী বৈষম্যগত মত পার্থক্যের জঞ্জাল বৈ আর কিছুই ছিল না । ঐ মতপার্থক্য দ্বিতীয় খলিফার দ্বারা বাইতুল মালের অর্থ বন্টনে শ্রেণীগত বৈষম্য সৃষ্টির ফলে উদ্ভুত হয়েছিল । হযরত ইমাম আলী (আ.) খলিফা হওয়ার পর ঐ সমস্যার সমাধান ঘটান এবং তিনি জনগণের মধ্যে সমতা ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে বাইতুল মালের অর্থের সুষম বন্টন করেন ।42 আর এটাই ছিল হযরত রাসূল (সা.)-এর জীবনাদর্শ । কিন্তু হযরত আলী (আ.)- এর এ পদক্ষেপ তালহা ও যুবাইরকে অত্যন্ত ক্রোধান্বিত করেছিল । যার ফলে তারা হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বিরোধীতা করতে শুরু করেন । তারা যিয়ারতের নাম করে মদীনা ছেড়ে মক্কায় গেলেন । উম্মুল মুমেনীন হযরত আয়শা তখন মক্কায় অবস্থান করছিলেন । তারা এটা ভাল করেই জানতেন যে , ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে উম্মুল মুমেনীন আয়শার সম্পর্কের টানা পোড়ন চলছে । এ অবস্থাকে তারা আপন স্বার্থে কাজে লাগান এবং নবীপত্মী আয়েশাকে খুব সহজেই হযরত আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে নিজ পক্ষে টেনে নিতে সমর্থ হন । অতঃপর তৃতীয় খলিফার হত্যার বিচারের দাবীর শ্লোগানে আন্দোলন গড়ে তোলেন । অবশেষে জংগে জামাল নামক এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধর সূচনা করেন ।43 অথচ এই প্রসিদ্ধ সাহাবীদ্বয় তালহা ও যুবায়ের বিপ্লবীদের দ্বারা ওসমানের বাড়ী ঘেরাওকালীন মুহুর্তে মদীনাতেই ছিলেন । কিন্তু তৃতীয় খলিফা ওসমানকে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষার ব্যাপারে এতটুকু সাহায্যও তারা করেননি ।44 এমনকি খলিফা ওসমান নিহত হওয়ার পর মুহাজিরদের পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম তিনিই হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন ।45 ওদিকে নবীপত্নী আয়শাও স্বয়ং ওসমানের বিরোধীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন । তিনি ওসমানকে হত্যার ব্যাপারে সব সময়ই বিরোধীদেরকে উদ্বুদ্ধ করতেন ।46 নবীপত্নী আয়শা ওসমানের নিহত হওয়ার সংবাদ শোনা মাত্রই তার প্রতি অপমান সূচক শব্দ উচ্চারণ করেন এবং আনন্দ প্রকাশ করেন । তৃতীয় খলিফাকে হত্যার ব্যাপারে মূলত রাসূল (সা.)-এর সাহাবীরাই জড়িত ছিলেন । তারা মদীনার বাইরে বিভিন্ন স্থানে চিঠি পাঠানোর মাধ্যমে জনগণকে খলিফার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করেন ।

হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফতের যুগে দ্বিতীয় যে যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল , তা হচ্ছে সিফফিনের যুদ্ধ । দীর্ঘ দেড়টি বছর এ যুদ্ধ অব্যাহত থাকে । এ যুদ্ধটি ছিল কেন্দ্রীয় খেলাফত প্রসাশন দখলের জন্যে মুয়াবিয়ার চরম লালসার ফসল । তৃতীয় খলিফার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের ছলনাময়ী শ্লোগানের ছত্রছায়ায় তিনি এ যুদ্ধের অবতারণা করেন । এ যুদ্ধে প্রায় এক লক্ষ্যেরও বেশী লোক অন্যায়ভাবে নিহত হন । এ যুদ্ধে মুয়াবিয়াই ছিলেন প্রথম আক্রমনকারী । এটা কোন আত্মরক্ষামুলক যুদ্ধ ছিল না । বরং এটা ছিল মুয়াবিয়ার পক্ষ থেকে একটি আক্রমনাত্মক যুদ্ধ । কারণ , প্রতিশোধ গ্রহণ মূলক যুদ্ধ কখনই আত্মরক্ষামূলক হতে পারে না । এ যুদ্ধের শ্লোগান ছিল তৃতীয় খলিফার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ । অথচ তৃতীয় খলিফা তার জীবনের শেষ দিনগুলোতে দেশের রাজনৈতিক অরাজকতা ও বিশৃংখলা দমনে মুয়াবিয়ার কাছে সাহা্য্য চেয়ে পাঠান । মুয়াবিয়াও তার সেনাবাহিনীসহ সিরিয়া থেকে মদিনার দিকে অগ্রসর হন । কিন্তু মুয়াবিয়া উদ্দেশ্য মূলক ভাবে পথিমধ্যে এত বেশী দেরী করেন যে , ততদিনে তৃতীয় খলিফা বিপ্লবীদের হাতে নিহত হন । এ সংবাদ পাওয়া মাত্রই মুয়াবিয়া তার বাহিনী সহ সিরিয়ায় ফিরে যান । এর পর সিরিয়ায় ফিরে গিয়ে তিনি তৃতীয় খলিফার হত্যার বিচারের দাবীতে বিদ্রোহ শুরু করেন ।47 সিফফিন যুদ্ধের পর নাহরাওয়ান যুদ্ধ সংঘটিত হয় । রাসূল (সা.)-এর বেশ কিছু সাহাবীও এ যুদ্ধে জড়িত ছিলেন । একদল লোক যারা সিফফিনের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিল , তারাই পরবর্তিতে আবার মুয়াবিয়ার প্ররাচণায় হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে । তারা তদানিন্তন ইসলামী খেলাফত বা রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক বিশৃংখলা সৃষ্টি করতে থাকে । তারা হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর অনুসারী বা সমর্থকদের সন্ধান পাওয়া মাত্রই তাদেরকে হত্যা করত । এমন কি গর্ভবতী মহিলাদের পেট চিরে গর্ভস্থ সন্তানকে বের করে তাদের মাথা কেটে হত্যা করত ।48

সিফফিন যুদ্ধের পর মুয়াবিয়ার প্ররাচণায় সংঘটিত এ-বিদ্রোহও হযরত ইমাম আলী (আ.) দমন করেন । কিন্তু এর কিছুদিন পরই একদিন কুফা শহরের এক মসজিদে নামাযরত অবস্থায় ঐসব খাওয়ারেজদের হাতেই তিনি শাহাদৎ বরণ করেন ।


3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18