কুরআনের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ দিক
ইতিপূর্বেই আমরা জেনেছি যে , পবিত্র কুরআন তার শাব্দিক বর্ণনার মাধ্যমে স্বীয় দ্বীনি উদ্দেশ্যকে সুস্পষ্ট রূপে তুলে ধরে মৌলিক বিশ্বাস ও ব্যবহারিক বিষয়ে জনগণকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে থাকে । তবে পবিত্র কুরআনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য কেবল এরই মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় । বরং পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত এসব বাহ্যিক শব্দাবলীর কাঠামোতে এবং ঐসব উদ্দেশ্যের অন্তরালে এক সুগভীর ও প্রশস্ততর আধ্যাত্মিক অর্থ ও উদ্দেশ্য বিরাজমান । কুরআনের ভিতর আপাতঃ লুকায়িত ঐসব গভীর আধ্যাত্মিক বিষয় শুধুমাত্র আত্মশুদ্ধিকৃত পবিত্র হৃদয়ের অধিকারীদের কাছেই বোধগম্য । পবিত্র কুরআনের ঐশী শিক্ষক মহানবী (সা.) বলেছেন : পবিত্র কুরআনে সুন্দর ও শুভপরিণতি সম্পন্ন একটি বাহ্যিক দিক ও সুগভীর এক আভ্যন্তরীণ দিক রয়েছে ।
মহানবী (সা.) আরও বলেছেন : পবিত্র কুরআনের একটি অভ্যন্তরীণ দিক রয়েছে , সেই অভ্যন্তরের ও অভ্যন্তরীণ দিক রয়েছে । এভাবে কুরআন সাতটি অভ্যন্তরীণ দিকের অধিকারী ।
পবিত্র আহলে বাইতগণও (আ.) তাদের হাদীসে কুরআনের ঐ আভ্যন্তরীণ দিক সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন ।
উপরোল্লিখিত হাদীস সমূহের মূলভিত্তি হচ্ছে কুরআনের সূরা আর রা’
দের 17 নম্বর আয়াত ,ঐ আয়াতে মহান আল্লাহ ঐশী রহমতর্ক বৃষ্টির সাথে তুলনা করেছেন , যা আকাশ থেকে অবতির্ণ হয় । আর ঐ বৃষ্টির উপরই নির্ভরশীল হল ভূপৃষ্ঠ ও তার অধিবাসীদের জীবন ধারণ শক্তি । ভূপৃষ্ঠের বর্ষিত ঐ বৃষ্টিধারা স্রোতাকারে প্রবাহিত হয় এবং তার প্রবাহ পথের স্থানসমূহ নিজ নিজ ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী ঐ জল প্রবাহ থেকে কিছুটা গ্রহণ ও ধারণ করে এবং প্রবাহ সৃষ্টি করে । ঐ জল প্রবাহের উপরিভাগ যদিও প্রচুর ফেনা দ্বারা আচ্ছাদিত থাকে তথাপি তার তলদেশে রয়েছে সেই মৃতসঞ্জীবনী পানি , যা মানব জাতির জন্য অত্যন্ত উপকারী । পবিত্র কুরআনে উদ্ধৃত এই উদাহরণটি সেই ঐশী জ্ঞানধারার প্রতি ইংগিত করছে । যা থেকে মানুষ তার নিজ নিজ বোধশক্তি অনুসারে অর্জন ও ধারণ করে উপকৃত হতে পারে । আর ঐ ঐশী জ্ঞান মানুষের আধ্যাত্মিক মৃতসঞ্জীবনী স্বরূপ , যা গ্রহণ ও ধারণের মাত্রা ব্যক্তি বিশেষে পার্থক্য হয় । এ পৃথিবীতে এমন অনেক লোক আছে যারা , সম্পূর্ণ রূপে জড়বাদী । জড়বস্তু এবং পৃথিবীর এ নশ্বর জড়জীবন ছাড়া আর কিছুর মৌলিকত্বেই তারা বিশ্বাস করে না । এ পার্থিব ষড়রিপুর তাড়নার দাসত্ব ছাড়া জীবনে অন্য কিছুতেই তারা মন দেয় না । পার্থিব ক্ষতি ছাড়া তারা আর কিছুকেই ভয় পায় না । অবশ্য এরা ব্যক্তি বিশেষে বিভিন্ন ধরণের অবস্থার অধিকারী । ঐশী জ্ঞানমালা থেকে এরা খুব বেশী যেটুক উপকৃত হয় , তা হল , মৌলিক বিশ্বাস সংক্রান্ত বিষয়ে এরা মোটামুটি ভাবে একটা ধারণা গ্রহণ বা বিশ্বাস করে । আর ইসলামের ব্যবহারিক আইনগুলোকে অত্যন্ত শুষ্কভাবে এরা পালন করে । অবশেষে এরা এক আল্লাহকে পরকালীন পুরুস্কারের লাভে এবং পরকালীন শাস্তির ভয়ে উপাসনা করে । আবার এমন অনেক লোকও আছে , যারা তাদের হৃদয়ের স্বচ্ছতা ও খোদাপ্রদত্ত স্বভাবজাত সততার কারণে পার্থিব জীবনের ক্ষণকালীন আরাম আয়েশের প্রতি কখনও আসক্ত হয় না । জীবনের লাভ-ক্ষতি , মিত্রতা ও তিক্ততা তাদের জন্য প্রতারণামূলক কল্পনা বৈ আর কিছুই নয় । প্রাগৈতিহাসিক জাতিসমূহের“
স্মরণ , যা অতীতের দুনিয়ালোভীদের ইতিহাস এবং আজকের গল্প স্বরূপ , তা তাদের জন্য গ্রহণযোগ্য শিক্ষা বৈ কিছুই নয় । আর ঐতিহাসিক শিক্ষা তাদের হৃদয়ে সবসময় এক প্রেরণাদায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে । স্বাভাবিকভাবেই তাদের পবিত্র হৃদয়গুলো সেই অবিনশ্বর জগতের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকে । এ নশ্বর পৃথিবীর বৈচিত্রময় সৃষ্টিনিচয়কে তারা সর্ব শক্তিমান আল্লাহর নিদর্শনের দৃষ্টিতেই পর্যবেক্ষণ করে মাত্র । এছাড়া এসব পার্থিব বিষয়কে তারা কখনো মৌলিক ও সার্বভৌম বলে বিশ্বাস করে না । আর তখন এ আকাশ ও পৃথিবীতে অবস্থিত সব স্রষ্টার অন্তহীন ও মহত্বের নিদর্শনবাহী নতুন এক ঐশীজগতের রহস্যের দ্বার তাদের প্রানে খুলে যায় । তখনই তারা আত্মিক উপলদ্ধির চক্ষু দিয়ে সর্বস্ব অবলোকন করে । তাদের পবিত্র হৃদয়গুলো এ সৃষ্টিজগতের মূলরহস্য উপলদ্ধির প্রতি নিবদ্ধ হয়ে যায় । তখন এ পৃথিবীর লালসা আত্মলিপ্সার সংকীর্ণতায় বন্দী না হয়ে তাদের হৃদয়গুলো অন্তহীন ও মুক্ত মহাকাশে পাখা মেলে উড়তে থাকে । যখন তারা ঐশী ওহী মারফৎ শুনতে পায় যে , সর্বশক্তিমান আল্লাহ মূর্তি পূজাকে নিষিদ্ধ করেছেন ; তখন এ থেকে তারা বুঝতে পারে যে , একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো আনুগত্য করা যাবে না । কারণঃ দাসত্ব ও মাথানত করাই আনুগত্যের নিগুঢ় অর্থ । এছাড়া তারা এটাও বুঝে যে , একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করা যাবে না এবং আর কারো প্রতি আশাও করা যাবে না । এর পর তারা এটাও বুঝতে সক্ষম হয় যে , প্রবৃত্তির চাহিদার কাছে আত্মসমর্পণ করা যাবে না । আর একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর অন্য কারো প্রতি মনোনিবেশ করা যাবে না । একইভাবে যখন তারা শুনতে পায় যে , পবিত্র কুরআন নামায আদায়ের নির্দেশ দিয়েছে , যার বাহ্যিকরূপ হচ্ছে একটি বিশেষ প্রকৃতির উপাসনা ; তখন তারা ঐ কুরআনের আদেশের মর্মার্থ স্বরূপ কায়মনো বাক্যে মহান আল্লাহর প্রতি আত্মনিবেদনের মাধ্যমে প্রার্থনা করাকেই বোঝায় , শুধু তাই নয় , তারা সত্যের সম্মুখে নিজেকে একেবারেরই হীন ও নগন্য মনে করে এবং সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে একমাত্র আল্লাহর স্মরণেই নিমগ্ন থাকাকে শ্রেয় বলে বিশ্বাস করে । এটা স্পষ্ট যে , উপরোল্লিখিত আদেশ ও নিষেধের উদাহরণই্ আধ্যাত্মিকতার অর্থ বহন করে না । তবে ঐ আধ্যাত্মিক তত্ব উপলদ্ধি একমাত্র তাদের দ্বারাই সম্ভব , যারা উদার দৃষ্টি ও চিন্তার অধিকারী এবং বিশ্ব দর্শনকে আত্মকেন্দ্রিক সংকীর্ণ দর্শনের উপর অগ্রাধিকার দেয় । পূ্র্বোক্ত আলোচনার মাধ্যমে পবিত্র কুরআনের বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক অর্থ অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে । আর এটাও স্পষ্ট হয়েছে যে , কুরআনের নিগুঢ় আত্মিক অর্থ তার বাহ্যিক অর্থকে বাতিল করে না । বরং কুরআনের নিগূঢ় আধ্যাত্মিক অর্থ কুরআনের আত্মার মত । এটা দেহস্থিত আত্মার ন্যায় যা দেহের সঞ্জীবনী শক্তি স্বরূপ । ইসলাম একটি সার্বজনীন ও অনন্ত ধর্ম , ইসলাম সমাজ সংশোধনের বিষয়টিকে সবার উপরে অগধিকার দেয় । ইসলামের বাহ্যিক আইনসমূহ যা সমাজ সংস্কারক স্বরূপ । আর এর সহজ মৌলিক বিশ্বাস সমূহ যা এসব বাহ্যিক আইন সমূহের সংরক্ষকও প্রহরী স্বরূপ এগুলো সবই চির অপরিবর্তনশীল । আমরা দেখতে পাই যে , অনেক সমাজের লোকেরা বিশ্বাস করে যে , মানুষের হৃদয় পবিত্র হওয়াই বড় কথা তার কার্যক্রমের প্রকৃতির কোন গুরূত্ব নেই । তাই সে সমাজের লোকেরা এক অরাজকতাপূর্ণ ও উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করে । তাহলে এটা কি করে সম্ভব যে , এ ধরনের বিচ্ছৃঙ্খল জীবন-যাপনের মাধ্যমে তারা জীবনে সফল ও সৌভাগ্যবান হবে ? কিন্তু অপবিত্র কথন ও অসদাচরণের মাধ্যমে অন্তরের পবিত্রতা রক্ষা করা কি করে সম্ভব ? অপবিত্র ও নোংরা চরিত্র ও কথন থেকে পবিত্র হৃদয়ের পস্ফুটন সম্ভব কি ? তাই মহান আল্লাহ বলেছেন :“
উৎকৃষ্ট শহর , তার ফসল তারই প্রতিপালকের নির্দেশে (ভাল পরিমান) উৎপন্ন হয় এবং যা নিকৃষ্ট তাতে অল্পই ফসল উৎপন্ন হয় ।”
(সূরা আল্ আ’
রাফ 58 নং আয়াত) । অর্থাৎ পবিত্র উৎস থেকেই পবিত্রের জন্ম আর অপবিত্রদের উৎস হল অপবিত্র । পূ্র্বোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে , পবিত্র কুরআনের একটি বাহ্যিক ও একটি আত্মিকরূপ রয়েছে । ঐ আত্মিকরূপেরও আবার বহু স্তর রয়েছে । একইভাবে পবিত্র কুরআনের ব্যাখাকারী হাদীসেরও ঐ একই ধরণের স্তর বিন্যাস রয়েছে ।
কুরআনের“
তা
’
উইল
”
ইসলামের প্রাথমিক যুগে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অনুসারীদের অধিকাংশের মধ্যে কুরআনের ব্যাপারে একটি বিশ্বাস ব্যাপক ভাবে প্রচলিত ছিল । আর তা হল এই যে , কোথাও যদি উপযুক্ত দলিল পাওয়া যায় , তাহলে কুরআনের কোন আয়াতের প্রচলিত বাহ্যিক অর্থকে ত্যাগ করে তার বিরোধী অর্থকেও সেক্ষেত্রে গ্রহণ করা যেতে পারে । এভাবে কুরআনের কোন আয়াতের বাহ্যিক অর্থকে তার বিরোধী অর্থে রূপান্তরিত করাকেই‘
তা’
উইল’
বলা হয় । আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের ধর্মীয়গ্রন্থ সমূহ এবং বিভিন্ন ধর্মীয় বিতর্কের ঘটনা সম্বলিত গ্রন্থসমূহে এ ঘটনাটি ব্যাপক হারে পরিলক্ষিত হয় । যেমন : ধর্মীয় কোন একটি বিষয়ে যদি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অধিকাংশ আলেমগণ একমত হন , আর তা যদি পবিত্র কুরআনের এক বা একাধিক আয়াতের বাহ্যিক অর্থের পরিপন্থিও হয় তাহলে কুরআনের ঐ আয়াত বা আয়াত সমূহের বাহ্যিক অর্থকে রূপান্তরিত করেন । এভাবে অন্য কোন দলিল দ্বারাও যদি কুরআনের আয়াত বা আয়াতসমূহের বাহ্যিক অর্থের পরিপন্থি কোন বিষয় প্রমাণিত হয় , তাহলে কুরআনের ঐ বাহ্যিক অর্থকে প্রয়োজনবোধে রূপান্তরিত করেন । এমনকি অন্য সময় দেখা গেছে যে , পরস্পর বিবাদমান দু’
পক্ষ নিজেদের মতামত প্রমাণের স্বার্থে এক বা একাধিক কুরআনের আয়াতর্ক পরস্পর বিরোধী অর্থে রূপান্তরিত (তা’
উইল) বা ব্যাখা করেছে । এমনকি দুঃখজনক ভাবে , এধরণের আচরণে শীয়ারাও কম-বেশী কিছুটা আক্রান্ত হয়েছে । যার উদাহরণ শীয়াদের বেশ কিছু‘
কালাম’
(মৌলিক বিশ্বাস সংক্রন্ত) শাস্ত্র গ্রন্থে পরিলক্ষিত হয় । কিন্তু যে বিষয়টি পবিত্র কুরআন ও আহলে বাইতগণের (আ.) হাদীস সুগভীর ভাবে পর্যালোচনার মাধ্যমে অর্জিত হয় , তা’
হল পবিত্র কুরআনের সুস্পষ্ট , বোধগম্য ও সুমধুর বর্ণনা পদ্ধতির মধ্যে কখনও জটিল ও ধাধাঁ সদৃশ্য পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়নি । পবিত্র কুরআন তার বিষয়বস্তু শাব্দিক কাঠামোর গণ্ডি ছাড়া অন্য কোন মাধ্যমে তা জনগণের কাছে বর্ণনা করেনি । কিন্তু পবিত্র কুরআনের“
তা’
উইল”
বলতে যা বোঝানো হয়েছে , তা কোন শাব্দিক অর্থের ব্যাপার নয় । বরং তা এমন কিছু নিগুঢ় রহস্য , যা সাধারণ মানুষের উপলদ্ধির উর্দ্ধে । আর ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস ও ব্যবহারিক বিধান সংক্রান্ত জ্ঞান তা থেকেই উৎসরিত । হা , কুরআনের সর্বত্রই“
তা’
উইলের”
অস্তিত্ব বিদ্যমান । তবে সাধারণ চিন্তাভাবনার মাধ্যমে সরাসরি তা অনুধাবন করা সম্ভব নয় । আর শব্দের মাধ্যমে তা বর্ণনার যোগ্যও নয় । শুধুমাত্র আল্লাহর নবীগণ ও এবং সকল মানবীয় দোষ-ত্রুটি মুক্ত পবিত্র হৃদয়ের অধিকারী আল্লাহর নৈকট্য প্রাপ্ত আওলিয়াগণ কুরআনের“
তা’
উইল”
করতে সক্ষম । তারা আত্মিক দর্শনের মাধ্যমে কুরআনের“
তা’
উইলের”
নিগূঢ়তত্ব অর্জন করেন । কেয়ামতের দিন কুরআনের প্রকৃত“
তা’
উইলের”
বিষয়টি সকল মানুষের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে । ব্যাখ্যাঃ এটা সবারই জানা যে , মানুষ তার সামাজিক জীবনের বিভিন্ন পার্থিব প্রয়োজন মেটানোর স্বার্থে ভাষার বিভিন্ন শব্দসমূহ ব্যাবহার করতে বাধ্য হয়েছে । সামাজিক জীবন যাপনের ক্ষেত্রে মানুষ তার স্বজাতির কাছে নিজের মনোভাব প্রকাশ করতে বাধ্য । এ জন্যেই সে শব্দ ও তার কানের সাহায্য কামনা করতে বাধ্য হয় । কখনও বা কমবেশী চোখের ইশারার সাহায্যও তাকে নিতে হয় । আর এ কারণেই আমরা দেখতে পাই যে , একজন বধির ব্যক্তি কখনও একজন অন্ধব্যক্তির সাথে যোগাযোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় না । কারণঃ একজন অন্ধ যা কিছু বলে , বধির ব্যক্তি তা শুনতে পায় না । আবার বধির ব্যক্তি তার হাতের ইশারায় যা কিছু বুঝাতে চায় , অন্ধব্যক্তি তা দেখতে পায় না । তাই কোন জিনিসের নাম করণ ও ভাষা সৃষ্টির ক্ষেত্রে পার্থিব প্রয়োজন মেটানোর স্বার্থই কার্যকর ছিল । বিভিন্ন বস্তু , অবস্থা ও পরিবেশর জন্য শব্দ রচিত হয় , যা আমাদের পঞ্চেন্দ্রীয় শক্তি দ্বারা নির্ভরযোগ্য । তাই আমাদের প্রতিপক্ষ যদি পঞ্চেন্দ্রীয়ের কোন একটিরও অভাব ঘটে এবং আমারা যদি ঐ বিশেষ ইন্দ্রিয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত কোন একটি শব্দের অর্থ তাকে বোঝাতে চাই , তাহলে তা আমাদের জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাড়ায় । তখন ঐ নির্দিষ্ট বিষয়টি প্রতিপক্ষকে বোঝানোর জন্য আমরা বিভিন্ন ধরণের উদাহরণের আশ্রয় গ্রহণ করি । তবুও সংশ্লিষ্ট ইন্দ্রিয় বিহীন প্রতিপক্ষকে ঐ বিশেষ শব্দ বা বিষয়টি বোঝানো সহজ হয় না । যেমনঃ কোন জন্মান্ধকে যদি আমরা আলো বা রংয়ের ব্যাপারটি বোঝাতে চেষ্টা করি , বা কোন অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুকে যদি যৌন সুখের বিষয়টি বোঝাতে চাই , তাহলে আমাদের বহু তুলনা মূলক উদাহরণের আশ্রয় নিতে হয় । তেমনি এ বিশ্ব জগতের এমন অনেক অজড় বিষয়ের অস্তিত্ব আছে , যা জড় জগতের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত । আর প্রতি যুগেই এই মানবজাতির মধ্যে হাতে গোনা অল্প ক’
জন ছাড়া কেউই ঐ অজড় জগত অবলোকন ও উপলদ্ধি করতে সক্ষম হয়নি । আর ঐ অজড় জগতের বিষয়াদি শব্দাবলীর কাঠামোত বর্ণনা করা বা সাধারণ চিন্তাশক্তি দিয়ে তা অনুধাবন ও উপলদ্ধি করা আদৌ সম্ভব নয় । শুধুমাত্র তুলনামুলক ও সদৃশ্যসম কিছু উদাহরণ উত্থাপণ ছাড়া ঐসব বিষয়ের প্রতি ইংগিত করা সম্ভব নয় ।
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন : আমি একে অবতির্ণ করেছি কুরআনরূপে , আরবী ভাষায় , যাতে তোমরা বুঝতে পার । নিশ্চয়ই এ কুরআন আমার কাছে সমুন্নত অটল রয়েছে লওহে -মাহফুজে । (সূরা আল্ যুখরূফ , 3 ও 4 নং আয়াত ।)
মহান আল্লাহ আরও বলেছেন : নিশ্চয়ই এটা সম্মানিত কুরআন , যা আছে গোপন কিতাবে , যারা পবিত্র তারা ব্যতীত অন্য কেউ একে স্পর্শ করবে না । (সূরা আল্ ওয়াকিয়াহ , 77থেকে 79 নং আয়াত ।)
একইভাবে মহানবী (সা.) ও তার পবিত্র আহলে বাইতগণ (আ.) সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেনঃ হে আহলে বাইত মহান আল্লাহ চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণ রূপে পূতপবিত্র করতে । (সূরা আল্ আহযাব , 33 নং আয়াত ।)
উপরোল্লিখিত আয়াতসমূহের প্রকৃত ও গূঢ়অর্থ উপলদ্ধি করতে সাধারণ মানুষ অক্ষম । শুধুমাত্র আল্লাহর দ্বারা পবিত্র ব্যক্তিগণ ছাড়া রহস্য উপলদ্ধি অন্যদের দ্বারা সম্ভব নয় । আর আল্লাহর রাসূল ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতগণ (আ.)-ও আল্লাহর দ্বারা পবিত্র ব্যক্তিগণ ।
মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন :“
কিন্তু কথা হল এই যে , তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে আরম্ভ করেছে যা (তাদের জ্ঞান বহির্ভূত) বুঝতে তারা অক্ষম । অথচ এখনো এর (তাউইল) বিশ্লেষণ আসেনি । এমনি ভাবে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে তাদের পূর্ববতীরা অতএব লক্ষ্য করে দেখ যে কেমন হয়েছে পরিণতি ।”
(সূরা আল্ ইউনুস 39 নং আয়াত ।)
পবিত্র কুরআনের অন্যত্র আল্লাহ বলেছেনঃ তারা কি এখন এর তা’
উইলের অপেক্ষায় আছে যে , এর তা’
উইল প্রকাশিত হোক ? যেদিন এর তা’
উইল প্রকাশিত হবে সেদিন পূর্বে যারা ভুলে গিয়েছিল , তারা বলবে : বাস্তবিকই আমাদের প্রতিপালকের পয়গম্বরগ সত্যসহ আগমন করেছিলেন । (সূরা আল্ আ’
রাফ , 53 নং আয়াত ।)
হাদীস সংক্রান্ত আলোচ্য বিষয়ের সমাপ্তি
পবিত্র কুরআন যে হাদীস সংক্রান্ত বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে , এ ব্যাপারে শীয়া মাযহাবসহ অন্যান্য মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন বিতর্ক নেই । কিন্তু ইসলামের প্রাথমিক যুগে হাদীস সংরক্ষণের ব্যাপারে খলিফাদের দ্বারা যে বাড়াবাড়ীর সূত্রপাত ঘটে এবং হাদীসের প্রসারের ব্যাপারে সাহাবী ও তাবেঈনরা যে বাড়াবাড়ীর আশ্রয় নেন , ফলে হাদীস শাস্ত্র এক দুঃখজনক পরিণতির স্বীকার হয় । তার একদিকে খলিফা হাদীস লিখন ও সংরক্ষণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং লিপিবদ্ধ কোন হাদীস পাওয়া মাত্রই তা পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলতেন , কখনও বা হাদীস বর্ণনাতেই বাধা প্রদান করতেন , এ কারণেই প্রচুর সংখ্যক হাদীস বিকৃতির স্বীকার হয়েছে । আবার অন্য দিকে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর সাহাবীগণ যারা মহানবী (সা.) এর উপস্থিতি উপলদ্ধি ও তার বক্তব্য শ্রবণের সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন এবং সাধারণ মুসলমান ও খলিফাদের সম্মান লাভে সক্ষম হয়েছিলেন তারা হাদীস প্রচার ও প্রসারে আত্মনিয়োগ করেন । এভাবে পরবর্তীতে তাদের কাজের পরিণতি এমন এক জায়গায় গিয়ে দাড়ায় যে , কুরআনের উপর হাদীসের শাসন ও প্রভুত্ব বিস্তৃত হয় । এমন কি কখনও কখনও হাদীসের মাধ্যমে কুরআনের নির্দেশও বাতিল হয়ে যেত ।
অন্য সময় দেখা গেছে শুধুমাত্র একটি হাদীস শ্রবণের জন্য হাজার হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রমের মত অসংখ্য ঘটনা সে যুগে ঘটেছে । সে সময় ইসলাম বিরোধী অসংখ্য ব্যক্তি বাহ্যত ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে ইসলামী চেহারার অন্তরালে ইসলামের গৃহশত্রুতে পরিণত হয় । তারা অসংখ্য হাদীসের বিকৃতি সাধান ও জাল হাদীস তৈরীর মাধ্যমে হাদীস শাস্ত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা ও নির্ভরযোগ্যতার বিলোপ সাধান করে ।
হাদীস শাস্ত্রকে ঐ দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি থেকে ঊদ্ধারের উদ্দেশ্যে ইসলামী পণ্ডিতগণ ,‘
ইলমে রিজাল’
ও‘
ইলমে দিরায়াহ’
নামক দুটি শাস্ত্রের গোড়া পত্তন করেন । এ দুটো শাস্ত্রের মাধ্যমে সত্য হাদীসকে বিকৃত ও জাল হাদীস থেকে পৃথক করা যেতে পারে । কিন্তু শীয়া সম্প্রদায় হাদীসের সূত্র পরীক্ষার পূর্বে তাকে পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে যাচাই করাকে অবশ্য করণীয় বলে বিশ্বাস করে । শীয়া সূত্রে বর্ণিত মহানবী (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) অসংখ্য হাদীস (যার সূত্র সমূহ অকাট্য ও নির্ভরযোগ্য) আমাদের কাছে এসে পৌছেছে , যাতে বলা হয়েছে যে , কুরআন বিরোধী যে কোন হাদীসই মূল্যহীন ।
আর যে হাদীস কুরআনের বিষয়বস্তুর অনুকুলে একমাত্র তাই নির্ভরযোগ্য । আর এ ধরণের হাদীসের কারণে যেসব হাদীস কুরআনের পরিপন্থি , শীয়ারা তা মানা থেকে বিরত থাকে ।
একইভাবে যেসব হাদীস পবিত্র কুরআনের পরিপন্থি বা অনুকুলে হওয়ার বিষয় সুস্পষ্ট নয় , পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) নির্দেশ অনুযায়ী সেসব হাদীস গ্রহণ বা বর্জনের ব্যাপারে তারা নীরবতা অবলম্বন করে । অবশ্য শীয়াদের মধ্যেও এমন কিছু লোক পাওয়া যায় , যারা আহলে সুন্নাতের অনেকের মতই কোন যাচাই বাচাই ছাড়াই যে কোন হাদীস পাওয়া মাত্রই তার অনুসরণ করে থাকে ।
হাদীস অনুসরণের ক্ষেত্রে শীয়াদের নীতি
মহানবী (সা.) অথবা পবিত্র আহলে বাইতের যেসব হাদীস কোন মাধ্যম ছাড়া সরাসরি তাদের কাছ থেকে শোনা হয়ে থাকে , তা কুরআনের নির্দেশের মতই মর্যাদা সম্পন্ন । কিন্তু যেসব হাদীস বিভিন্ন মাধ্যম পেরিয়ে আমাদের হাতে এসেছে , সে সব হাদীস অনুসরণের ক্ষেত্রে শীয়াদের নীতি নিম্নরূপ:
ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসগত জ্ঞানের ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআনের নির্দেশ ,‘
মুতাওয়াতির’
হাদীস (যা সংশ্লিষ্ট কোন বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাসের জন্ম দেয়) অথবা যে হাদীস অত্যন্ত বিশ্বস্ত কোন সূত্রে অর্জিত হয়েছে , তাই অনুসরণযোগ্য । উপরোক্ত দু’
প্রকার হাদীস ছাড়া অন্য সব হাদীস (যেমন : খাবারে ওয়াহিদ) তেমন একটি নির্ভরযোগ্য নয় । তবে ইসলামী বিধানের কোন আইন প্রণয়ন
বা প্রমাণের ক্ষেত্রে দলিল হিসাবে‘
মুতাওয়াতির’
হাদীস ছাড়াও বিশ্বস্ত অ-মুতাওয়াতির (খাবারে ওয়হিদ) হাদীসও গৃহীত হয়ে থাকে । সুতরাং‘
মুতাওয়াতির’
যা বিশ্বস্ত সূত্রে বর্ণিত হাদীস শীয়াদের নিকট সম্পূর্ণ রূপে প্রমাণ্য দলিল স্বরূপ । আর তা অবশ্য অনুসরণীয় । আর অনির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হাদীস , যদি আস্থাযোগ্য হয় , তাহলে তা শুধুমাত্র ইসলামী আইনের ক্ষেত্রেই প্রমাণ্য দলিল হিসেবে গণ্য হবে ।
ইসলামে শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষা প্রদান
জ্ঞান অর্জন ইসলামের একটি ধর্মীয় কর্তব্য । মহানবী (সা.) বলেছেনঃ‘
জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি নর-নারীর জন্য ফরয’
।
আর এ ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রাপ্ত যেসব হাদীস রয়েছে , তা থেকে বোঝা যায় যে , জ্ঞান বলতে ইসলামের মৌলিক তিনটি বিষয় ও তদসংশ্লিষ্ট জ্ঞানের কথাই বোঝানো হয়েছে । আর তা’
হলঃ
1. তাওহীদ (আল্লাহর একত্ববাদ)
2. নবুয়ত
3. কেয়ামত (পুনরূত্থান দিবস)
আর প্রতিটি ব্যক্তির জন্য তার প্রয়োজন মাফিক ইসলামী আইন ও তার ব্যখ্যাসহ সে সংক্রান্ত প্রয়াজনীয় বিস্তারিত জ্ঞান অর্জন করা তার অবশ্য কর্তব্য । অবশ্য এটা বলা বাহুল্য যে , ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস সংক্রান্ত জ্ঞানের ব্যাপারে মোটামুটিভাবে দলিল প্রমাণ সহ জ্ঞান অর্জন করা সবার জন্যেই সহজ । কিন্তু অকাট্য দলিল প্রমাণ সহকারে মূল কুরআন ও হাদীস থেকে ইসলামী আইন-কানুন প্রণয়ন ও প্রমাণ করার মত বিস্তারিত ও সুক্ষ্ণাতিসুক্ষ্ণ জ্ঞান অর্জন করা সবার জন্য সহজবোধ্য ব্যাপার নয় । এটা শুধুমাত্র অল্প কিছুসংখ্যক লোকের ক্ষেত্রেই সম্ভব । আর ইসলাম সাধ্যাতীত কোন কাজই দায়িত্ব হিসেবে মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়নি । এ কারণেই দলিল প্রমাণ সহকারে ইসলামী আইন শাস্ত্রের বিস্তারিত জ্ঞান অর্জনের বিষয়টিকে ইসলামে‘
ওয়াজিবে কিফায়ী’
হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে । অর্থাৎ এ ধরণের ব্যাপক জ্ঞান অর্জনের যোগ্যতাসম্পন্ন অল্প কিছুসংখ্যক লোকের জন্যেই এটা দায়িত্ব স্বরূপহু আর অন্যান্য লোকদের দায়িত্ব হচ্ছে এ বিষয়ে তারা প্রয়োজন বোধে ঐসব ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হবে । জ্ঞানীর কাছে জ্ঞানহীনদের শরণাপন্ন হওয়া’
মূলনীতির উপরই উপরোক্ত নীতির মূলভিত্তি প্রতিষ্ঠিত । ইসলামী আইন-শাস্ত্রে পারদর্শী বিশেষজ্ঞরা‘
মুজতাহীদ’
বা‘
ফাকীহ’
নামে পরিচিত । মুজতাহিদদের কাছে ইসলামী আইন সংক্রান্ত বিষয়ে শরণাপন্ন হওয়ার মাধ্যমে মুজতাহীদদের অনুসরণকেই‘
তাকলীদ’
(অনুসরণ) বলা হয় । অবশ্য এখানে মনে রাখা দরকার যে , ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস সংক্রান্ত বিষয়ে কারও অনুসরণ করাকে ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে ।
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন : যে বিষয়ে তোমাদের কোন জ্ঞান নেই , তার অনুসরণ করো না । (সূরা আল ইসরা , 36 নং আয়াত ।)
এটা সবার জানা থাকা প্রয়োজন যে , শীয়া মাযহাবে মৃতব্যক্তির তাকলীদের মাধ্যমে তাকলীদের সূচনা করা জায়েয নয় ।
অর্থাৎ যে ব্যক্তি ইজতিহাদ সংক্রান্ত জ্ঞানে পারদর্শী নয় , তাকে অবশ্যই ইসলামী আইন সংক্রান্ত ব্যাপারে কোন না কোন মুজতাহিদের শরণাপন্ন হতে হবে । কিন্তু এ ব্যাপারে অবশ্যই তাকে কোন জীবিত মুজতাহিদের মতামতের শরণাপন্ন হতে হবে । সেক্ষেত্রে কোন মৃত মুজতাহিদের মতামতের অনুসরণ করা তার জন্য বৈধ হবে না । ঐ মুজতাহিদ জীবিত থাকাকালীন সময়েই যদি ঐ ব্যক্তি কোন বিষয়ে তার মতানুসরণ করে থাকে তাহলে উক্ত মুজতাহিদের মৃত্যুর পরও সে ঐ পূর্বোক্ত মতের অনুসরণ অব্যাহত রাখতে পারবে । তবে এ ব্যাপারে তাকে সমসাময়িক জীবিত অন্য কোন মুজতাহিদের অনুমতি গ্রহণের প্রয়োজন হবে । আর এ বিষয়টি শীয়া মাযহাবের ইসলামী ফেকহ্ (আইন) শাস্ত্রের চিরঞ্জীব ও চিরন্তন হিসেবে টিকে থাকার ব্যাপারে একটি অন্যতম কারণ বটে । এ কারণে শীয়া মাযহাবের অসংখ্য ব্যক্তি একের পর এক ইজতিহাদি জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের প্রচেষ্টায় প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকেন । কিন্তু আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের ব্যাপারটি ভিন্ন ধরণের । হিজরী পঞ্চম শতাব্দীর দিকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আলেমদের‘
ইজমা’
(ঐক্যমত) অনুসারে চার জন মুজতাহিদের চার মাযহাবের কোন একটির অনুসরণকে ওয়াজীব হিসেবে ঘোষণা করা হয় । ঐ চার মাযহাব হচ্ছে: ইমাম আবু হানিফা , ইমাম মালেক , ইমাম শাফেয়ী এবং ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের মাযহাব । তাদের মতে স্বাধীন ইজতিহাদ ও উপরোক্ত চারজন ফকীহ্ বা মুজতাহিদ ছাড়া অন্য কারও তাকলীদ বা অনুসরণ করা তাদের মতে বৈধ নয় । এর ফলে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের ফেকাহ্ বা আইন শাস্ত্রের গুণগতমান এখনও প্রায় সেই বারশত বছর পূর্বের অবস্থায় অবস্থান করছে । অবশ্য বর্তমানে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অনেক আলেমই তথাকথিত‘
ইজমা’
র সিদ্ধান্ত মানেন না । তারা স্বাধীনভাবে ইজতিহাদের পক্ষপাতি এবং তার প্রচেষ্টাও চালাচ্ছেন ।
কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক জ্ঞান এবং শীয়া মাযহাব
ইসলামী জ্ঞান মোটামুটি দু’
শ্রেণীতে বিভক্ত : (1) বুদ্ধিবৃত্তিগত জ্ঞান এবং (2) বর্ণনা ভিত্তিক জ্ঞান ।
বর্ণনা ভিত্তিক জ্ঞান মূলতঃ কুরআন ও সুন্নাহ থেকে বর্ণিত জ্ঞানের উপরই নির্ভরশীল । যেমন : আরবী ভাষা , হাদীস , ইতিহাস ইত্যাদি । তবে বুদ্ধিগত জ্ঞান অন্য ধরণের । গণিত , দর্শন ইত্যাদি বুদ্ধিগত জ্ঞান বা বিদ্যার উদাহরণ । এতে কোন সন্দেহ নেই যে , পবিত্র কুরআনই ইসলামের‘
বর্ণনা’
ভিত্তিক বিদ্যার মূল উৎস । অবশ্য এছাড়াও ইতিহাস , বংশ পরিচিতি শাস্ত্র এবং ভাষালংকার শাস্ত্রও এই ঐশী পুস্তকের এক অমূল্য অবদান । মুসলমানরা ইসলামী জ্ঞানের গবেষণা ও অনুসন্ধিৎসা মেটানোর লক্ষ্যে এসব শাস্ত্রের চর্চা ও গ্রন্থ রচনায় প্রয়াসী হন । ঐসব বিদ্যার মধ্যে মূলত্ঃ আরবী ভাষা ও সাহিত্য এবং তার ব্যাকারণ , ভাষা অলংকার , অভিধানসহ ইত্যাদি বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল । এছাড়াও তাজবীদ (কুরআন উচ্চারণ বিধিশাস্ত্র) , তাফসীর , হাদীস , রিজাল (হাদীস বর্ণনাকারীদের নির্ভরযোগ্যতা যাচাই শাস্ত্র) , দিরায়াহ্ (হাদীসের সত্যতা যাচাই শাস্ত্র) , উসুল (ইসলামী আইন প্রণয়নের মূলনীতি শাস্ত্র) , এবং ফিকহ ও (ইসলামী আইন শাস্ত্র) এসবের অন্তর্ভুক্ত । শীয়ারাও ইসলামী জ্ঞানের উপরোক্ত শাখাগুলোর বিকাশ ও উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রেখেছে । এমনকি উক্ত জ্ঞানের শাখাসমূহে অনেকগুলোর প্রতিষ্ঠাতাই ছিলেন শীয়া মাযহাবের অনুসারী । যেমন: আরবী ব্যাকারণের‘
নাহু’
(শব্দের স্বরচিহ্ন নির্ণয়বিদ্যা) শাস্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জনাব আবুল আসাদ আদ দোয়ালী । ইনি ছিলেন রাসূল (সা.) এবং ইমাম আলী (আ.)-এর একজন সাহাবী । তিনি হযরত আলী (আ.)-এর নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধনে এই শাস্ত্র রচনা করেন । আরবী ভাষার অলংকার শাস্ত্রের একজন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন‘
আলে বুইয়া’
বংশীয় শীয়া রাজ্যের জনৈক শীয়া মন্ত্রী । তার নাম ছিল সাহেব বিন ই’
বাদ ।
জনাব খলির বিন আহমাদ বসরী নামক জনৈক বিখ্যাত শীয়া শিক্ষাবিদ সর্বপ্রথম‘
আল আইন’
নামক আরবী ভাষার অভিধান রচনা করেন ।
তিনিই আরবী ভাষায়‘
কাব্যের ছন্দপ্রকরণ শাস্ত্রও’
প্রথম আবিস্কার করেন । এ ছাড়াও আরবী ব্যাকারণের‘
নাহু’
(শব্দের স্বরচিহ্ন নির্ণয় , পদবিন্যাস প্রকরণ) শাস্ত্রের অসাধারণ ও বিখ্যাত পণ্ডিত জনাব‘
সিবাওয়াই’
ছিলেন শীয়া মাযহাবের অনুসারী । পবিত্র কুরআন পঠনের বিখ্যাত ও স্বতঃসিদ্ধ সাতটি পদ্ধতির মধ্যে‘
কিরাআতে আসেম’
অন্যতম যার সূত্রও হযরত আলী (আ.) ।
পবিত্র কুরআনের তাফসীর (ব্যাখা) শাস্ত্রের অন্যতম মুফাচ্ছির ও বিখ্যাত সাহাবী হযরত ইবনে আব্বাস ছিলেন হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর শিষ্য । হাদীস ও ফিকাহ্ শাস্ত্রে আহলে বাইতগণ (আ.) ও শীয়াদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । শীয়াদের পঞ্চম ইমাম [বাকের (আ.)] ও ষষ্ঠ [ইমাম জাফর সাদিক (আ.)] ইমামের সাথে আহলে সুন্নার মাযহাবের ইমামগণের জ্ঞানগত বিষয়ের সম্পর্ক সর্বজনবিদিত ব্যাপার । এমনকি‘
উসুলে ফিকহ’
(ইসলামী আইন প্রণয়নের মূলনীতি বিষয়ক শাস্ত্র) শাস্ত্রে শীয়াদের আশ্চর্য জনক উন্নতিও বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় । জনাব ওয়াহীদ বেহবাহানীর (মৃত্যু -1205 হিঃ) যুগে এই শাস্ত্রে সাধিত উন্নতি , বিশেষ করে জনাব শেইখ মুরতাদা আনসারীর (মৃত্যু -1281 হিঃ) অবদান ইসলামী বিশ্বের এক নজির বিহীন ঘটনা , গুণগত মানের দিক থেকে যার সাথে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের‘
উসুলে ফিকাহ’
শাস্ত্রের আদৌ কোন তুলনা করা চলে না ।
দ্বিতীয় পদ্ধতি
বুদ্ধিগত আলোচনা