বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)0%

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

লেখক: দার রাহে হাক প্রকাশনীর লেখকবৃন্দ
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 15889
ডাউনলোড: 3915

পাঠকের মতামত:

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 87 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 15889 / ডাউনলোড: 3915
সাইজ সাইজ সাইজ
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

দার রাহে হাক প্রকাশনীর লেখকবৃন্দ

http://alhassanain.org/bengali/books/0040-imam_askari/images/image001.jpg

ভূমিকা

দার রাহে হাক নামক প্রকাশনা সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত সাময়িকীর প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের যবনিকাপাত ঘটেছে। এ দুটি পর্যায় সংক্ষিপ্ত ও ক্ষুদ্রাকারে মহানবী (সা.)-এর জীবনেতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। আর সেই সাথে অনর্থক ও অসার বাক্যবান ও ইসলামের শত্রুদের ও প্রাচ্যবিদদের উদ্দেশ্য প্রণোদিত বাক্যালাপের জবাবে শত সহস্র খণ্ড অনুলিপি বিনামূল্যে সমস্ত ইরান ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বিতরণ করা হয়েছে।

এখন ঐ সাময়িকীর সমষ্টিকে স্বতন্ত্র পুস্তকাকারে প্রকাশ করা হবে , যাতে পাঠক বন্ধুগণ একটি ছোট পুস্তিকা , অথচ মহানবী (সা.)-এর জীবনেতিহাসের প্রামাণ্য চিত্র হাতের নাগালে পেতে পারেন। আপনারা লক্ষ্য করে থাকবেন যে , এ পুস্তকের বিষয়বস্তু বিশ্বস্ত সূত্র থেকে ইতিহাসের উপর বিশেষ গবেষণার মাধ্যমে সংকলন করা হয়েছে এবং আমরা আশা করি সর্বস্তরের পাঠকবৃন্দের জন্যে তা স্বার্থক ও আকর্ষণীয় হবে।

এ পুস্তকের বিষয়বস্তু ও দার রাহে হাক নামক ইসলামী সংস্থার অন্যান্য সাময়িকী সম্পর্কে আপনাদের পরামর্শ , সমালোচনা ও মতামত সানন্দে গৃহীত হবে। পরিশেষে আপনাদের মত বন্ধুবর ও মুসলমান ভাইদের সহযোগিতা ও সহায়তায় বৃহত্তর ক্ষেত্রে এ ঐশী উদ্দেশ্যের পথে সাফল্য লাভ করতে পারব বলে আশা করি।

লেখক পরিষদ

দার রাহে হাক

ইসলাম পূর্ব বিশ্ব

ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে সারা বিশ্বের মানুষ বিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনাগত দিক থেকে এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক মর্যাদার দিক থেকে দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে জীবন অতিবাহিত করছিল। যদিও বিশ্বের সর্বত্র একই অবস্থা বিরাজমান ছিলনা তথাপি সামগ্রিকভাবে বলা যায় যে , বিশ্বের সকল মানুষ চিন্তাগত বিচ্যুতি , কুসংস্কার ভ্রান্ত সামাজিক রীতি-নীতি , অলীক ও অবাস্তব কল্পনা এবং সামাজিক ও নৈতিক অনাচারের ক্ষেত্রে পরস্পরের অংশীদার ছিল।

ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে ইহুদীরা হযরত মূসা (আ.)-এর দীনকে পরিবর্তন করেছিল ; বস্তুবাদী চিন্তা-চেতনা মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করেছিল। পরিতাপের বিষয় হলো খ্রিস্টবাদ , যা কলুষতা থেকে মানুষের চারিত্রিক সংযম ও আত্মার পবিত্রতার জন্যে এসেছিল (এবং এর প্রবর্তক হযরত ঈসা (আ.) মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এ দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন) ধর্মগুরু পাদ্রীদের মাধ্যমে তা স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে পরিবর্তিত রূপ লাভ করেছিল এবং অধিকাংশ খ্রিস্টান ধর্ম গুরুদের জন্যে তা ব্যবসায়িক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।

অনুরূপ যেহেতু পূর্ণাঙ্গ সামাজিক নীতিমালা বিবর্জিত হয়ে পড়েছিল , সেহেতু মানুষের সার্বিক মুক্তি ও নেতৃত্বের ক্ষেত্রে অক্ষম ছিল।

এরই ফলশ্রুতিতে , বিশ্বের সকল মানুষ কুসংস্কারাচ্ছন্ন সামাজিক রীতি-নীতি , সামাজিক ও চারিত্রিক অনাচারের ক্ষেত্রে পরস্পরের অংশীদার হয়েছিল।

অন্যায় ও অত্যাচারের দাবানলে মানুষ জ্বলছিল... কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতি তথাকথিত দীন ও ধর্মরূপে মানুষের উপর রাজত্ব করত ; একাধিক (কল্পিত) খোদার উপাসনা , ত্রিত্ববাদ মানুষের মধ্যে প্রচলিত ছিল ; অনুরূপ অধিকাংশ মানুষ মূর্তি , অগ্নি , গরু ও নক্ষত্র পূজায় নিয়োজিত ছিল। সবচেয়ে লজ্জাকর ছিল নর ও নারীর লজ্জাস্থান পূজার প্রচলন। আর এ ধরনের অনাচার এবং চারিত্রিক ও আত্মিক বিচ্যুতিই ,যা সমস্ত বিশ্বকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলেছিল এবং মানব সমাজের বিচ্যুতি ও বিভ্রান্তির কারণ হয়েছিল। নর হত্যা , হানাহানি অন্যায় , অত্যাচারে নিমগ্ন হয়ে গিয়েছিল সারা পৃথিবী। বস্তুত মানবতা বিপন্ন অবস্থায় পতিত হয়েছিল!

ইসলামের আবির্ভাবের প্রাক্কালে আরব ভূ-খণ্ড

পোড়ামাটি বলে পরিচিত আরবে তখন এক অদ্ভুদ পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল। অসমতল প্রান্তর ,বালুকাময় উপত্যকা টিলাময় ভূমির নাম ছিল আরব। ছিল না পানি ,ছিলনা কোন বৃক্ষরাজি ;তীক্ষ্ণ কণ্টকময় বুনো বৃক্ষকে সেথায় বৃক্ষ বলা হতো ;গৃহগুলোকে যদি গৃহ বলা হতো তবে তা ভুল হতো ;ক্ষুদ্রাকার কুটিরগুলোতে মানুষ নামক কিছু অস্তিত্ব বসবাস করত ;আর পচা দুর্গন্ধময় খোরমা পানি দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করত। আন্তগোত্রীয় যুদ্ধ -বিগ্রহ আরবের সামাজিক নিয়ম রীতিতে পরিণত হয়েছিল। মক্কা মূর্তির বাজার বৈ কিছুই ছিল না। উপদ্বীপের অধিবাসীরা ছিল বনিক সুদ -খোর। তারা দেরহাম দিনারের বিনিময়ে মানুষের জীবন ক্রয় করত !

মরু প্রান্তরের যাযাবর জীবন , পশুপালন ও রাখালী আর সার্বক্ষণিক রক্তারক্তিতে আরব উপদ্বীপের মানুষের জীবন বিপর্যস্ত ছিল। ...শাসক শ্রেণী ও মুনাফাখোরদের শোষণ থেকে উৎসারিত অর্থনৈতিক দুরাবস্থা জীবনের অর্থকে ব্যাহত করেছিল এবং সৌভাগ্যের দিগন্তে আঁধার নেমে এসেছিল।

সূদখোর ধনি ও বনিকশ্রেণী , যারা মক্কায় ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত ছিল অবৈধ পথে বিপুল পরিমাণ সম্পদের অধিকারী হয়েছিল। তারা সমাজের বঞ্চিত ও দুর্বল শ্রেণীর উপর শোষণ ও নিপীড়ন চালাত। প্রকৃত পক্ষে সূদ ও অন্যায়ভাবে মুনাফা অর্জনের ফলে সমাজে মানবতাবিবর্জিত শ্রেণী বৈষম্য তুঙ্গে উঠেছিল।

আরবের গোত্রগুলো অজ্ঞতাবশতঃ তদানিন্তন সময়ে প্রকৃতিপূজা ও মূর্তি পূজায় লিপ্ত ছিল এবং কাবাগৃহ আরবের মূর্তিঘরে পরিণত হয়েছিল।

আরবের প্রচলিত চারিত্রিক অবক্ষয়মূলক নিয়ম ও নিকৃষ্টতম সামাজিক কুসংস্কারের যে কোনটিই কোন একটি জাতির সমৃদ্ধির শিকড়ে কুঠারাঘাতে যথেষ্ট ছিল। ইসলাম পূর্ব আরবের মানবতাবিরোধী কর্মকান্ড ও বিচ্যুতি এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করেছিল যে , তার ফল ছিল অত্যাচার , অনাচার , খাদ্য ছিল মৃতের মাংস , শ্লোগান ছিল ভয়-ভীতি , আর যুক্তি ও দলিল ছিল তরবারি।

আরবের লোকদের এ ভ্রান্ত ধারণা ছিল যে , একমাত্র তারাই শ্রেষ্ঠ ও উন্নত যারা আরব বংশোদ্ভুত এবং আরবের রক্ত যাদের শরীরে! প্রকৃতপক্ষে বিংশ শতাব্দীর গোত্র পূজা ও আমাদের সময়ের জাতীয়তাবাদ , তদানিন্তন আরবের অন্ধকার সমাজের এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় প্রচলিত ছিল।

আরবদের নিজেদের মধ্যে অধিক ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির অধিকারী হওয়া তাদের মিথ্যা অহমিকা ও দাম্ভিকতার কারণ ছিল। এগুলোর অধিকারী হওয়া তাদের আত্মগৌরব ও গোত্রের শ্রেষ্ঠত্ব বলে পরিগণিত হতো।

অন্যায় , অত্যাচার , সন্ত্রাস , জবরদখল ও প্রতারণা ছিল ঐ সমাজের সাধারণ বৈশিষ্ট্য! আর নরহত্যা তাদের নিকট বীরত্ব বলে পরিগণিত হতো। যেহেতু কন্যা সন্তানদেরকে অবাঞ্ছিত বলে মনে করত , কিংবা জীবন নির্বাহের খরচ , দারিদ্র ও অনটনের ভয়ে ভীত ছিল , তাই নিষ্পাপ শিশু কন্যাকে তারা হত্যা করত কিংবা জীবিত সমাহিত করত। যদি কোন ব্যক্তি কোন আরবকে সংবাদ দিত যে , তার স্ত্রী কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েছে তবে ক্রোধে তার চেহারা মলিন হয়ে যেত এবং লোক চক্ষুর আড়ালে থাকত । আর মনে মনে চিন্তা করত ঐ কন্যা সন্তানকে কি করবে ; এ লাঞ্ছনা বরণ করে কন্যাকে রেখে দিবে , নাকি জীবন্ত সমাহিত করবে (এবং এ লজ্জার চিহ্ন থেকে নিজেকে পরিষ্কার করবে। কারণ কখনো কখনো কোন পরিবারে মাত্র একটি কন্যার অস্তিত্ব থাকলে ও তা ঐ পরিবারের জন্যে লজ্জার কারণ ছিল) ।1

ইমাম আলী (আ.)-এর বাণীসমৃদ্ধ অমর গ্রন্থ নাহজুল বালাগাতে তদানিন্তন আরবের সামাজিক অবস্থা এরূপে বর্ণিত হয়েছে : ... এবং তোমরা , হে আরব সম্প্রদায়! তখন নিকৃষ্টতম ধর্মের (মূর্তি পূজা) অনুসারী ছিলে এবং নিকৃষ্টতম ভূমিতে (নিস্ফলা মরু প্রান্তরে) জীবন যাপন করতে , কংকরময় ভূমিসমূহে বিষাক্ত সর্পকুল যেগুলো কোন শব্দে সন্ত্রস্ত হতো না , সেগুলোর মধ্যে জীবন যাপন করতে। ঘোলা পানি পান করতে , অখাদ্য ও শক্ত খাবার গ্রহণ করতে , পরস্পরের রক্ত ঝড়াতে , আত্মীয়-স্বজনের সম্পর্ক ছিন্ন করতে , মূর্তিসমূহ তোমাদের মাঝে স্থান করে নিয়েছিলে এবং তোমরা গুনাহ থেকে দূরে থাকতে না।

আর এরূপেই আরবের মানুষ অন্যায় ও অত্যাচারে নিমগ্ন থাকত এবং কুশিক্ষা ও অজ্ঞতার ফলে হিংস্র , লুটেরা ও কুপ্রবৃত্তি প্রবণ জনসমষ্টিতে পরিণত হয়েছিল । বিশ্বের অন্যান্য মানুষের মতই তারা কুসংস্কার ও কাল্পনিক কাহিনীসমূহকে ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেছিল।

স্পষ্টতঃই এরকম কোন সমাজের আমূল সংস্কারের জন্যে একটি মৌলিক বিপ্লব ও সার্বিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল। আর সঙ্গত কারণেই এ আন্দোলনের নেতা হবেন ঐশী ব্যক্তিত্ব। তিনি মহান আল্লাহর প্রতিনিধি হবেন , যাতে সকল প্রকার অন্যায় অত্যাচার ও লোভ-লালসা থেকে দূরে থাকতে পারেন এবং সংস্কারের নামে ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্যে নিজের বিরোধীদেরকে ধ্বংস না করেন ; বরং তাদেরকে সংশোধন করার জন্যে চেষ্টা করেন এবং কেবলমাত্র আল্লাহর পথে , মানুষের কল্যাণ ও সমাজের অগ্রগতির জন্যে কর্ম সম্পাদন করেন। কারণ , নিঃসন্দেহে যে নেতৃত্ব স্বয়ং আধ্যাত্মিকতা ও চারিত্রিক গুণ বিবর্জিত হয় এবং মানবীয় উৎকর্ষতার মাঝে স্থান না পায় , তবে সে কোন সমাজকে সংস্কার করতে পারে না কিংবা কোন জাতিকে মুক্তি দিতে পারে না। কেবলমাত্র ঐশী ব্যক্তিবর্গই মহান আল্লাহর পথনির্দেশনায় ব্যক্তিগত ও সামাজিক ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে মৌলিক পরির্বতন ও সংস্কার সাধনে সক্ষম।

এখন আমরা দেখব , নব বিশ্বের বিপ্লবের নেতা কিরূপ ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং এ বিশ্বে কী কী পরিবর্তন তিনি সাধন করেছেন।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম ও শৈশব

মক্ক নগরী অন্ধকার ও নীরবতার কোলে ঢলে পড়েছিল , জীবন ও কর্মের কোন চিহ্ন পরিদৃষ্ট হচ্ছিল না , সেথায় একমাত্র শশী , প্রতিদিনের মত কৃষ্ণকায় পর্বতের আড়াল থেকে উর্ধ্ব গগণে উঠে আলতো কিরণের ছোঁয়া অনাড়ম্বর ও সাদা মাটা কুটিরগুলোর উপর বুলিয়ে যাচ্ছিল ; কিরণ বুলিয়ে যাচ্ছিল কংকরময় শহরের গাঁয়ে।

ধীরে ধীরে রাত্রি মধ্যরেখা পেরিয়ে গেল , হৃদয়গ্রাহী সমীরণ হেজাজের কংকরময় ভূমির উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল , কিছুক্ষণের জন্যে হলেও হেজাজ বিশ্রামাগারে পরিণত হয়েছিল। আকাশের তারাগুলো তখন এ নিমন্ত্রণ সভায় উপস্থিত হয়ে এক মনোরম পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল ; আর মক্কার অধিবাসীদের সাথে স্মিত হাসি হেসে যাচ্ছিল!

এখন প্রভাত! রাত জাগা ও ঘুমভাঙ্গানিয়ারা প্রাণবন্ত ধ্বনিতে স্বর্গীয় সুরে গান গেয়ে যাচ্ছে , যেন কোন প্রেয়সীর সাথে অভিসারে মগ্ন।

মক্কার দিগন্তে শুভ্র রেখা পরিদৃষ্ট হলো কিন্তু তখনও নগরের উপর এক অপ্রকাশিত নীরবতা আচ্ছাদিত হয়েছিল ; সমস্ত শহর নিদ্রাভিভূত ; কেবলমাত্র আমিনাই জেগেছিল ; যে বেদনার অপেক্ষায় প্রহর গুণছিল সে বেদনা অনুভব করছিল। ধীরে ধীরে বেদনা প্রচণ্ড থেকে প্রচণ্ডতর হতে লাগল। হঠাৎ কয়েকজন অপরিচিত ও জ্যোতির্ময় রমনী তাঁর কক্ষে দেখতে পেলেন , তাঁদের থেকে সুগন্ধি হাওয়া ছড়িয়ে পড়ছিল। তিনি বিস্মিত ছিলেন যে তাঁরা কারা , কিরূপে এ রূদ্ধদ্বার কক্ষে প্রবেশ করলেন ?

অনতিবিলম্বে তাঁর প্রিয় নবজাতক পৃথিবীতে পদার্পণ করল। এর এ ভাবেই আমিনা কয়েক মাস অপেক্ষার পর 17ই রবিউল আউয়াল প্রভাতে তাঁর সন্তানের মুখ দেখে তৃপ্ত হলেন।

সকলেই এ ঘটনায় আনন্দিত ছিলেন। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিশিথের তিমির বিদূরিত করে আমিনার গৃহ আলোকিত করেছিলেন তখন প্রিয় পতি যুবক হযরত আবদুল্লাহ ছিল সেথায় অনুপস্থিত। কারণ শাম যাওয়ার পথে মদীনায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন এবং সেখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়েছিল ; আর সেই সাথে আমিনা চিরদিনের জন্যে একা হয়ে গেলেন।

মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন এক বিস্ময়কর নবজাতক

মুহাম্মদ (সা.) পৃথিবীতে আসলেন। আর সেই সাথে আকাশ এবং পৃথিবীতে অনেক ঘটনা ঘটেছিল। বিশেষ করে প্রাচ্যে , যা তখন সভ্যতার ধারক-বাহক বলে পরিচিত ছিল তাতে অনেক আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল।

আর এ ঘটনাগুলোই তখন , এখনকার যুগের দ্রুতকালীন প্রচার ব্যবস্থার স্থানে ছিল যা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সংবাদ দিত। যখন এ নবজাতক ঘুণে ধরা এ সমাজের কুসংস্কারাচ্ছন্ন রীতি নীতিকে উল্টে দিয়ে উন্নয়ন ও সংস্কারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিল , তখন থেকেই জাগরণ তুর্য ধ্বনিত হয়েছিল।

ইরানের সম্রাট আনুশিরের সুবিশাল প্রাসাদ যা চিরন্তন শক্তি ও দম্ভের প্রতীকরূপে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল , আর মানুষের সকল প্রত্যাশা ছিল ঐ প্রাসাদের অধিকারীর নিকটই। কিন্তু ঐ রাতে (রাসূল (সা.)-এর জন্মের রাত্রিতে) তা প্রকম্পিত হয়েছিল ও এর চৌদ্দটি দেয়ালের উপরিভাগ ধ্বসে পড়েছিল। পারস্যে সে অগ্নি কুণ্ডলী একবারেই নিভে গিয়েছিল , যা এক সহস্র বছর ধরে প্রজ্জ্বলিত ছিল।

কল্পিত ও প্রজ্জ্বলিত খোদার প্রতি অন্ধ বিশ্বাস ও ভ্রান্ত ধারণা প্রসূত ভক্তি যাদেরকে কোন প্রকার চিন্তার অবকাশ দিত না , অদ্য এ ঘটনাগুলো তাদেরকে সত্যের দিকে আহবান করেছে।

অনুরূপ , ইরানের সাভেহ প্রদেশের নদীটি শুকিয়ে যাওয়ার ফলে , তা অপর এক বৃহদাংশের অধিবাসীদেরকে রাসূল (সা.)-এর আবির্ভাব সম্পর্কে অবহিত করেছে।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দুগ্ধমাতা হালিমা

যুগ যুগ ধরে আরবের রীতি ছিল স্বীয় নবজাতককে জন্মের পর শহরের নিকটবর্তী গোত্রের কোন দুগ্ধমাতার নিকট অর্পণ করা। এর ফলে একদিকে মুক্ত প্রান্তরের মুক্ত আবহাওয়ায় লালিত-পালিত হবে , অপরদিকে শুদ্ধ ও প্রাঞ্জল আরবী ভাষায় কথা বলা শিখবে , যা তদানিন্তন সময়ের আরবের প্রধান আকর্ষণ ছিল।

উপরোল্লিখিত কারণ ব্যতীতও যেহেতু হযরতের মাতা আমিনার সন্তানকে পান করানোর জন্যে দুধ ছিল না সেহেতু হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পিতামহ ও অভিবাবক আবদুল মুত্তালিব তাঁর পুত্র আবদুল্লাহর স্মৃতিচিহ্ন প্রিয় হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সেবা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে কোন পবিত্র ও সম্মানিতা নারীর অনুসন্ধান করলেন। যথেষ্ট অনুসন্ধানের পর বনি সা দ গোত্রের (বীরত্ব ও বাকপটুতার ক্ষেত্রে যাদের সুখ্যাতি ছিল) হালিমার সন্ধান পাওয়া গেল , যিনি পবিত্র ও সম্ভ্রান্ত বলে পরিগণিত ছিলেন। অবশেষে তাকেই মহানবীর রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে নির্বাচন করা হলো।

হালিমা শিশু মুহাম্মদকে স্বীয় গোত্রে নিয়ে গেলেন এবং নিজ সন্তানের মত করে তাকে যত্ন নেয়ার চেষ্টা করতেন। বনি সা দ গোত্র দীর্ঘ দিন যাবৎ দুর্ভিক্ষে ভুগছিল। অপরদিকে শুষ্ক প্রান্তর ও মেঘহীন আকাশ তাদের দুর্দশা ও দারিদ্রের মাত্রা বৃদ্ধির কারণ হয়েছিল।

কিন্তু যে দিন থেকে মহানবী (সা.) হালিমার গৃহে পদ ধুলি দিলেন , তার সার্বিক উন্নতি ও বরকত পরিলক্ষিত হল এবং অভাব অনটনের মধ্যে যার জীবন কাটত তার জীবনে সমৃদ্ধি দেখা দিল। আর সেই সাথে তার ও তার সন্তানদের চেহারা সতেজ ও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তার দুহীন স্তন্য দুগ্ধে পরিপূর্ণ হয়ে গেল ; মেষ আর উটের চারণভূমি সুবজ ঘাসে পূর্ণ হলো। অথচ ইতোপূর্বে মানুষের জীবন যাত্রা সেখানে কঠিন হয়ে পড়েছিল।

স্বয়ং হযরত মুহাম্মদ (সা.)ও অন্য সকল শিশুর চেয়ে দৈহিকভাবে অধিক বিকাশ লাভ করেছিলেন এবং অন্যদের চেয়ে ক্ষিপ্র গতিতে চলতে পারতেন ও অন্যদের মত ভাঙ্গা-ভাঙ্গা স্বরে কথা বলতেন না। হালিমার সুখসমৃদ্ধি ও বৈভব এমন মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছিল যে , অন্যান্যরা খুব সহজেই এ সত্যটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলো এবং তা সহজেই চোখে পড়ার মত ছিল। যেমন , হালিমার স্বামী হারিস বলত : তুমি কি জান , কত ভাগ্যবান সন্তান আমাদের কপালে জুটেছে ?2

ঘটনার ঘন ঘটায় হযরত মুহাম্মদ (সা.)

মহানবীর জীবনের মাত্র ছ টি বসন্ত অতিক্রান্ত হয়েছে। মাতা আমিনা আত্মীয়- স্বজনের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্যে এবং সম্ভবতঃ স্বামী আবদুল্লাহর সমাধি জিয়ারত করার জন্যে মক্কা থেকে মহানবী (সা.)-কে সাথে নিয়ে মদীনার পথে রওয়ানা হলেন। আত্মীয়-স্বজনের সাথে সাক্ষাৎ করার পর স্বামীর কবর জিয়ারত করে ফিরে আসার পথে মক্কার অদূরে আবওয়া নামক স্থানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।

আর এ ভাবেই মুহাম্মদ (সা.) তাঁর শৈশবেই যখন পিতার অপরিসীম স্নেহ আর মায়ের দয়ার্দ্র আঁচলের প্রয়োজন ছিল , যা প্রতিটি শিশুর জন্যেই জরুরি , তা হারালেন।

মহানবী (সা.)-এর দৃষ্টান্ত মূলক বিশেষত্ব

যেমনটি আমরা ইতোপূর্বে জানতে পেরেছি যে , তাঁর জন্ম ও জন্ম পরবর্তীতে অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল , যেগুলো তার মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিত্বের প্রমাণবহ ; তেমনি শৈশবে তার আচার-ব্যবহারও তাঁকে অন্য সকল শিশু থেকে স্বতন্ত্র করেছিল। আবদুল মুত্তালিব এ বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং হযরতকে অভূতপূর্ব সম্মান প্রদর্শন করতেন।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চাচা আবু তালিব বলতেন : কখনোই মুহাম্মদ (সা.)-এর নিকট মিথ্যা শ্রবণ করিনি অযথা ও অজ্ঞতা প্রসূত কর্ম সম্পাদন করতে দেখিনি , যত্রতত্র হাঁসতেন না , অনর্থক কথা বলতেন না , অধিকাংশ সময়ই একাকী থাকতেন।

যখন মুহাম্মদের বয়স সাত বছর ছিল ইহুদীরা বলত : আমরা আমাদের কিতাবে পড়েছি যে , ইসলামের নবী হারাম দ্রব্য ও সন্দেহজনক আহার গ্রহণ থেকে দূরে থাকবেন। তবে তাঁকে পরীক্ষা করে দেখাটা ভাল। সুতরাং তারা একটি মোরগ চুরি করে হযরত আবু তালিবের জন্যে পাঠাল। যেহেতু এ ঘটনা জানতনা সকলেই তা থেকে আহার গ্রহণ করেছিলেন ; কিন্তু মুহাম্মদ (সা.) তা স্পর্শ করেও দেখেননি। তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন : ঐটি হারাম ; মহান আল্লাহ্ আমাকে হারাম থেকে রক্ষা করবেন।

অতঃপর ইহুদীরা প্রতিবেশীর মোরগ এ শর্তে নিল যে , পরবর্তীতে এর মূল্য পরিশোধ করবে এবং তা পুনরায় পাঠাল। হযরত তা-ও স্পর্শ করলেন না এবং বললেন : এ খাবার সন্দেহ জনক ইত্যাদি। তখন ইহুদীরা বলল : এ বালক উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হবে।3

কোরাইশের নেতা আবদুল মুত্তালিব হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে অন্যান্য শিশুর মত আচরণ করতেন না , বরং তাঁকে এক বিশেষ মর্যাদা ও সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতেন।

যখন আবদুল মুত্তালিবের জন্যে কা বার সন্নিকটে একটি নির্দিষ্ট স্থানের ব্যবস্থা করা হতো এবং তাঁর সন্তানগণ ঐ স্থানের পরিপার্শ্বে স্ব স্ব স্থানে আসন গ্রহণ করতেন , তখন তাঁর মর্যাদা ও সম্মানের কারণে কারো সেখানে প্রবেশ করার অনুমতি ছিল না। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সা.) ঐ মর্যাদা ও সম্মানের কারণে ঐ স্থানে প্রবেশ থেকে বঞ্চিত হতেন না এবং সরাসরি তিনি ঐ স্থানে প্রবেশ করতেন। আবদুল মুত্তালিব তাঁর সন্তানদের মধ্যে যারা তাঁকে (মহানবীকে) এ কর্ম থেকে বিরত করতে চাইত , তাদের উদ্দেশ্যে বলতেন : আমার সন্তানকে ছেড়ে দাও , আল্লাহর শপথ তিনি সুউচ্চ স্থানের অধিকারী... ।

অতঃপর হযরত মুহাম্মদ (সা.) কোরাইশ অধিপতি আবদুল মুত্তালিবের সাথে বসতেন , তাঁর সাথে কথোপকথন করতেন।4

মহানবীর শৈশব ও যৌবনের স্মৃতি কথা

কয়েকটি স্মরণীয় ঘটনা

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শৈশবকাল তাঁর অনাথ জীবনের দুঃখময় স্মৃতির মাঝে পিতামহ আবদুল মুত্তালিব ও দয়ালু চাচা আবু তালিবের আশ্রয়ে অতিবাহিত হয়েছিল। হয়তো অনাথ জীবনের এ দুঃখ বিষাদময় দিনগুলো যা মহানবীর কোমল হৃদয়কে ব্যথাতুর করে তুলেছিল , তা তাঁর মহান ব্যক্তিত্বের দৃঢ় ভিত্তির জন্যে প্রয়োজনীয় ছিল এবং প্রতিকূল ঘটনার মোকাবিলায় তাঁর ধৈর্য ও স্থৈর্যের ক্ষেত্রে শিক্ষারূপে ছিল। আর এ প্রক্রিয়ায় পরবর্তীতে রেসালতের গুরুদায়িত্ব অর্পন জন্যে তাঁকে প্রস্তুত করেছিল।

মহানবী (সা.) একটু একটু করে বড় হতে লাগলেন এবং যৌবনে পদার্পণ করলেন যা মানুষের জন্যে কামনা বাসনা ও শক্তি মত্তার প্রস্ফুটন কাল। যদিও তিনি মায়ের আদর আর পিতার স্নেহ থেকে বঞ্চিত ছিলেন কিন্তু হযরত আবু তালিব নৈতিক দায়িত্ববোধের কারণে ও আবদুল মুত্তালিবের আদেশক্রমে তাঁকে রক্ষণাবেক্ষণ ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে সকল কর্তব্য সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছিলেন। প্রকৃত পক্ষে হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর জন্যে তিনটি বিষয় ছিল : পুত্র , ভাই আবদুল্লাহ্ ও পিতা আবদুল মুত্তালিবের স্মৃতি চিহ্ন। আর এ জন্যে তিনি (মহানবী) তার পারিবারিক সদস্য বলে পরিগণিত হতেন। তার অন্যান্য সন্তানের মতই মহানবী (সা.) একই দস্তরখানায় বসতেন এবং তারই গৃহে মাথা গুজেছিলেন। আবু তালিব (আ.) হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্যে ছিলেন এক দয়ালু পিতা এক বিশ্বস্ত চাচা ও এক আন্তরিক অভিবাবক। আর এ চাচা ভাইপো পরস্পর পরস্পরের প্রতি এতটা নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত ছিলেন যেন তাদের জীবন ও আত্মার রজ্জু একই সূত্রে গ্রথিত ছিল । তাদের এ নিবিড় সম্পর্কের কারণেই হযরত আবু তালিব কখনোই তাঁকে নিজ থেকে দূরে রাখতেন না এবং তাঁকে সাথে নিয়েই আরবদের সাধারণ বাজারসমূহ যেমন , উকাজ , মুজনাহ ও যিল মাজাযে আসা যাওয়া করতেন। এমন কি মক্কার কাফেলার সাথে যখন শামে (সিরিয়ায়) ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্যে যেতে চাইলেন , তখনও তাঁর বিরহ সহ্য করতে পারছিলেন না। ফলে তাঁকে সাথে নিয়েই শামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। মহানবী (সা.) উটের পিঠে আরোহন করে ইয়াসরেব ও শামের সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করলেন।5