সকীফা , খেলাফত আত্মসাতের স্থান
11 হিজরীর 28 শে সফর মহানবী (সা.) ইন্তেকাল করেন। মদীনা শোকে নিমজ্জিত হয়।
কিছু সংখ্যক মুসলমান , যারা ক্ষমতালোভী এবং পদলোভী ছিল তারা উসামার বাহিনী থেকে ফিরে এসেছিল। আর এরাই মহানবী (সা.)-কে তাঁর অন্তিম ওসিয়ত লিখতে বাধা প্রদান করে। মহানবী (সা.)-এর তিরোধানের পর তারা উত্তম সুযোগ পেয়ে যায় এবং রাসূল (সা.)-এর মৃত দেহ ফেলে রেখে‘
সকীফায়ে বনি সায়েদায়’
একত্রিত হয়।
আনসাররা তাদের দলপতি সা’
দ ইবনে আবু ওবাদাকে রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারী হিসাবে নির্বাচন করতে চেয়েছিল। কিন্তু আবু বকর এবং ওমর তার বিরোধিতা করে। আবু বকর তার বক্তব্যে মুহাজিরদের মর্যাদা সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেয় এবং বলে : তারা তোমাদের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছিল এবং তারা রাসূল (সা.)-এর গোত্র (কুরাইশ) হতে। সুতরাং আমির (খলিফা) আমাদের মধ্যে হতে এবং উজির তোমাদের মধ্যে থেকে হবে। অতঃপর মুহাজিরদের মধ্য থেকে একজন বলল : তোমরা তোমাদের মধ্য থেকে একজন আমির নির্বাচন কর আর আমরা আমাদের মধ্য থেকে একজন আমির নির্বাচন করব। আবু বকর আবারো তাদেরকে বুঝালে তারা মেনে নিল যে মুহাজিরদের মধ্য থেকেই আমির নির্বাচিত হবে। অতঃপর তারা মুহাজির ও আনসারদের অনুপস্থিতিতে সকলের সাথে কোনরূপ আলোচনা এবং তাদেরকে এ ঘটনা সম্পর্কে অবগত করা ছাড়াই ইসলামের সর্বে সর্বা হয়ে পড়ে। আবু বকর এবং ওমর একে অপরকে খেলাফত গ্রহণের জন্য অনুরোধ করতে থাকে ; এমতাবস্থায় ওমর আবু বকরের হাতে বাইয়াত করে।
ওমরের পর যারা চাচ্ছিল না যে , সা’
দ ইবনে ওবাদা খলিফা হোক , তারা আবু বকরের হাতে বাইয়াত করে।
তারা একটুও চিন্তা করলনা যে , যদি ফজিলতের মানদণ্ড রাসূল (সা.)-এর নৈকট্য এবং তাঁর বংশের থেকে হওয়া , হয়ে থাকে ; তাহলে আবু বকরের চেয়ে রাসূলের নিকটতম ব্যক্তি রয়েছেন , যিনি এ কাজের জন্য সার্বিক ভাবে সকলের চেয়ে উত্তম। আকস্মিক এ নির্বাচনে সা’
দ ইবনে ওবাদা ও তাঁর সমর্থকরা হেরে যায় এবং আবু বকর ও ওমর জয়ী হয়। আরো কিছু সংখ্যক বিরোধীদেরকে জোর পূর্বক বাইয়াত করতে বাধ্য করে।
অতঃপর আবু বকর ওমর এবং তাদের সমর্থকরা সকীফা থেকে বেরিয়ে মসজিদে নববীর দিকে রওনা করে। পথিমধ্যে কাউকে দেখলে তাকে আবু বকরের সাথে বাইয়াত করতে বাধ্য করে।
বনি হাশিম এবং মুহাজির ও আনসারদের বিশিষ্ট সাহাবীগণ যেমন : রাসূল (সা.)-এর চাচা আব্বাস , যুবাইর , হাব্বাব ইবনে মুনযার , মেকদাদ , আবু যার গিফারী , সালমান ফারসী , আম্মার ইয়াসির , বারাত ইবনে আযেব , উবাই বিন কাব , উতবা ইবনে আবী লাহাব , খালেদ ইবনে সাঈদ , খুযাইমা ইবনে ছাবিত এবং ফারওয়া ইবনে আমর যারা এ বিষয়ে অবগত ছিলেন না। অকস্মাৎ জানতে পারলেন যে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। ঘটনা জানতে পেরে তাঁরা খুবই আশ্চর্য বোধ করেন
এবং বাইয়াত করেন নি। তারা চিন্তাও করতে পারেন নি যে , এত বেশি রেওয়ায়েত ও স্বয়ং রাসূল (সা.)-এর মনোনয়ন সত্ত্বেও এত শীঘ্র খেলাফত আত্মস্যাৎ করে ফেলবে এবং রাসূল (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতকে উপেক্ষা করা হবে। সংগত কারণেই সকলে এ অন্যায় এবং ষড়যন্ত্রমূলক বাইয়াতের সরাসরি প্রতিবাদ করেন।
হযরত আলী (আ.)ও আবু বকর ও ওমরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। আবু বকরের সমর্থক আবু উবাইদা বলে ,“
আলী তুমি এখনো যুবক এবং খেলাফতের জন্য যথেষ্ট অভিজ্ঞতা তোমার নেই।”
এর জবাবে আলী (আ.) বলেন : আল্লাহকে ভয় কর , রাসূল (সা.)-এর ইসলামী হুকুমাতকে তার ঘর থেকে নিজেদের ঘরে নিয়ে যেয়ো না এবং এই মর্যদার প্রকৃত অধিকারী থেকে তা আত্মসাৎ করনা। হে মুহাজিরগণ (ও আনসার) আমরাই (নবী পরিবার) এবং আমরাই এ খেলাফতের জন্য যোগ্যতম।
তবে কি কিতাব যার আয়ত্বে রয়েছে এবং আল্লাহর দীনের যে ফকীহ। আর মুসলমানদের সার্বিক ব্যবস্থপনার যে যোগ্য তিনি আমাদের মধ্য হতে নয় ? আল্লাহর শপথ! এ খেলাফত আমাদের , প্রবৃত্তির পূজারী হয়ো না। কেননা সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে।
সকীফার ঘটনার পর যখন সর্বসাধারণের কাছে বাইয়াত ঘোষণা করা হয় , আলী (আ.) প্রতিবাদের সুরে ঘর থেকে বাইরে আসেন এবং আবু বকরকে বলেন :
আমাদের ন্যায্য অধিকার থেকে আমাদেরকে বঞ্চিত করেছ এবং পরামর্শ করনি। আর সম্পূর্ণরূপে আমাদের অধিকারকে পদদলিত করেছ। আবু বকর বলল : হ্যাঁ কিন্তু ফেৎনা ও বিশৃঙ্ক্ষলা থেকে ভয় পেয়েছিলাম। এভাবে হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.) যতদিন জীবিত ছিলেন বনি হাশিমের কেউই আবু বকরের নিকট বাইয়াত করেননি।
রাসূল (সা.)-এর তিরোধানের পূর্বে ও পরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে মানুষের সামনে ষড়যন্ত্রের এক বিকট মূর্তি উপস্থিত হয়। আর এ ষড়যন্ত্রের ভিত্তি ছিল ক্ষমতা লিপ্সা এবং নেতৃত্বের লোভ। যদি তাদের কোন উদ্দেশ্যই (ক্ষমতার লোভ) না থাকবে কেন বনি হাশিম এবং রাসূল (সা.)-এর সম্মানিত সাহাবীদেরকে না জানিয়ে গোপনে সকীফায় গিয়েছিল ? যদি ধরে নেই যে , রাসূল (সা.) কাউকে খলিফা বা উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যাননি ; তাহলে কি ইসলামী বিশ্বের ভাগ্য হযরত আলী (আ.) ও তাঁর সাথিরা যেমন : বনি হাশিম এবং সম্মানিত। সাহাবারা যেমন : সালমান , আবু যার এবং মেকদাদের পরামর্শ ব্যতীতই নির্ধারিত হবে ?
তারা কি হযরত আলীর চেয়ে বড় চিন্তাবিদ ছিলেন ? রাসূল (সা.) কি হযরত আলী সম্পর্কে বলে জাননি যে :
علي
مع
الحق
والحق
مع
العلي
‘
আলী হকের সাথে আর হক আলীর সাথে।’
علي
اقضيكم
আলী তোমাদের সবার চেয়ে উত্তম বিচারক ?
انا
مد
ينة
العلم
وعلي
با
بها
আমি জ্ঞানের শহর এবং আলী তার দরজা।
হযরত আলী (আ.) কী জ্ঞান ও ফজিলতের প্রাণকেন্দ্র ছিলেন না ? তাহলে কেন তাঁর নিকট বাইয়াত করল না , এমনকি এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর সাথে পরামর্শ পর্যন্ত করতে রাজি হলো না।
হযরত আলীর বয়স কম হওয়া কি কোন অজুহাত হতে পারে! রাসূল (সা.) যোগ্যতা ও অগ্রাধিকারের মানদণ্ডকে তাকওয়া নির্ধারণ করেছেন। আর উক্ত কারণেই উসামাকে আবু বকরদের উপর অগ্রাধিকার দিয়েছেন। সুতরাং কেন হযরত আলী অন্যদের উপর প্রাধান্য পাবেন না ?
যারা এই অজুহাতে যে , আলী (আ.) ইসলামের বিভিন্ন যুদ্ধে অগণিত (কাফেরের) রক্ত ঝরিয়েছেন , তারা তাঁর নিকট নতি স্বীকার করেনি এবং তাঁর খেলাফতের অবাধ্যতা করেছে। তারা আলী (আ.) সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর সকল বাণী ও রেওয়ায়েতকে উপেক্ষা করেছে। ইসলামের নিয়ম অনুযায়ী যদি কেউ হকের কাছে নতি স্বীকার না করে তাকে বাধ্য করতে হবে , না কি সে হককে উপেক্ষা করবে!
তা ছাড়াও এ অজুহাতের যদি কোন ভিত্তি থাকত এবং তা যদি ঠিক হতো। তাহলে আল্লাহ তায়ালা হযরত আলী (আ.)-কে মনোনীত করতেন না এবং রাসূল (সা.)ও তাঁকে তাঁর উত্তরাধিকারী নির্ধারণ করতেন না।
একটি প্রশ্ন :
কিছু মুসলমান ভাই যারা ন্যায় সংগত বিচার করেন , তারা বলেন :
গাদীরের ঘটনা এবং অন্যান্য অসংখ্য দলিল প্রমাণ যা হযরত আলীর খেলাফতকে প্রমাণিত করে তা অনস্বীকার্য। কিন্তু কেন রাসূল (সা.)-এর তিরোধানের পর আলী (আ.) তাঁর ন্যায্য অধিকার রক্ষা করলেন না। অথচ তাঁর খেলাফত কালে যারা তাঁর বিরুদ্ধে উত্থান করত এবং তাঁর হুকুমতকে আত্মসাৎ করতে চাইত , তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করতেন।
উত্তর :
হযরত আলী (আ.) আবু বকরের খেলাফতকে অবৈধ মনে করতেন। আর এ কারণেই তার জুমার নামাজে এবং জামাতের নামাজে অংশ গ্রহণ করতেন না। তিনি তাঁর ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে নিতে জনগণের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। এমনকি তিনি হযরত ফাতেমা যাহরাকে নিয়ে রাত্রে আনসারদের বাড়িতে গিয়ে তাদের কাছে সাহায্য চান এবং বলেন : তোমরা আমার অধিকার ফিরিয়ে নিতে সাহায্য কর। আনসাররা জবাব দিল : আমরা আবু বকরের নিকট বাইয়াত করে ফেলেছি , এখন আর কিছু করার নেই যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।
এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে , রাসূল (সা.)-এর পর আলী (আ.) সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়ে ছিলেন এবং তাঁর কোন সাহায্যকারী ছিলনা , যাদের মাধ্যমে কিয়াম করবেন। অন্যথায় তিনি তাঁর ন্যায্য অধিকার আদায় করে ইসলামী বিশ্বের নেতৃত্ব দান করতেন। যখন জনগণ ওসমানের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তাকে হত্যা করে এবং হতবুদ্ধি হয়ে আলী (আ.)-এর দিকে বাইয়াতের হাত বাড়িয়ে দেয় , তখন আলী (আ.) বললেন : যেহেতু সাহায্যকারী পেয়েছি ইসলামী হুকুমতকে গ্রহণ করাই প্রয়োজন মনে করছি। সুতরাং ইসলামী সমাজের নেতৃত্বকে হাতে তুলে নেন এবং নেতৃত্বদান করেন।
কিন্তু রাসূল (সা.)-এর তিরোধানের পর যখন দেখলেন কোন সাহায্যকারী নেই এবং এ মুহূর্তে কিয়াম করলে অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্য বৃদ্ধি পাবে , যা ইসলামের জন্য কল্যাণকর নয়। কেননা ইসলামের শত্রুরা ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে ওৎ পেতে বসেছিল এবং ইসলাম হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল।
হযরত আলী (আ.) শুধুমাত্র ইসলামের খাতিরে কিয়াম করেননি , কেননা তিনি ইসলামকে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসতেন। তিনি চেয়েছিলেন ইসলাম শিকড় গেড়ে বসুক এবং শাখা-প্রশাখা বিস্তার লাভ করুক ও পুষ্প এবং ফল দান করুক। আলী (আ.) হলেন সেই মহান বীর যিনি সর্বদা রাসূল (সা.)-এর সাথে থেকে ইসলামের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি যুদ্ধ না করাটাকে ইসলামের জন্য কল্যাণকর মনে করেছিলেন এবং সকল তিক্ততায় ধৈর্য্য ধারণ করে ছিলেন।
আলী (আ.) কখনোই নেতৃত্বের লোভ করেন নি। অন্যথায় তিনি যে কোন উপায়ে নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করতে পারতেন। কিন্তু আমরা দেখতে পাই যখন আবু সুফিয়ান হযরত আলীকে বলেছিল :“
হাত বাড়িয়ে দিন আপনার সাথে বাইয়াত করব , আল্লাহর কসম! যদি চান তাহলে মদীনাকে অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্যে পরিপূর্ণ করে দিতে পারি। আলী (আ.) তা গ্রহণ না করে বললেন : আল্লাহর শপথ! তুমি ইসলামের শুভাকাঙ্ক্ষী নও এবং ফেৎনা ফাসাদ করাই হচ্ছে তোমার একমাত্র লক্ষ্য।
এ আলোচনায় মনোনিবেশ করার উদ্দেশ্যে এই যে , আমাদের সুন্নী ভাইয়েরা ইতিহাসের এ মহা সত্যের উপর (যা তাদেরই নির্ভরযোগ্য গ্রন্থসমূহ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে) বেশি বেশি অনুসন্ধান করবেন। যার মাধ্যমে একে অপরের সহযোগিতা এবং সহমর্মিতায় আমরা পূর্বের তিক্ততার ক্ষতিপূরণ করতে পারব এবং নিষ্ঠার সাথে বিশ্বের সকল মুসলমানদের মধ্যে প্রকৃত ঐক্য সৃষ্টির পথে সচেষ্ট হতে পারব।
ولا
حولا
ولا
قوة
الا
بالله
العلي
العظيم