বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)27%

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 87 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 16421 / ডাউনলোড: 4114
সাইজ সাইজ সাইজ
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

পরিষদ এবং ইমামত ও খেলাফত

কিছু লেখক বলেন : ইমামত ও খেলাফত , কমিশন এবং অধিকাংশের ভোটের মাধ্যমে নির্ধারণ করা সম্ভব। এ ব্যাপারে কোরআনের কয়েকটি আয়াত যেখানে বলা হচ্ছে তোমাদের কার্য ক্ষেত্রে পরামর্শ কর দলিল হিসাবে ব্যবহার করেছে। তারা এরূপ মনে করে যে , নির্বাচন হলো ইসলামের একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি কিন্তু বোঝেনা যে :

১.ইমামত বিষয়টি হলো নবুওয়াতের পরিসমাপ্তির প্রধান ভিত্তি। নবুওয়াত যেমন নির্বাচনের মাধ্যমে হয়না ইমামতও তেমনি একই মর্যাদার অধিকারী এবং তা নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত হতে পারে না।

২.পরামর্শ সেখানে প্রয়োজন যেখানে স্বয়ং আল্লাহ্ এবং রাসূল (সা.)-এর পক্ষ থেকে কোন কর্তব্য নির্ধারিত হয়নি। যেমনটি আমরা লক্ষ্য করেছি যে , রাসূল (সা.) আল্লাহর পক্ষ থেকে স্পষ্ট ভাষায় নিজের উত্তরাধিকারীকে নির্ধারন করেন। এর পর আর কোন পরামর্শ বা পরিষদের কোন ধারণাই অবশিষ্ট থাকে না।

৩.যদি ধরেও নেই যে , এ ব্যাপারে পরামর্শ করা সঠিক , তাহলে রাসূল (সা.) অবশ্যই তার বৈশিষ্ট বর্ণনা করতেন এবং নির্বাচনকারী ও নির্বাচিত ব্যক্তির শর্তসমূহকে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করতেন , যার মাধ্যমে জনগণ যে ব্যাপারটি ইসলামী সমাজের অস্তিত্ব এবং উন্নতির প্রধান ভিত্তি ও দীনের অস্তিত্ব যার উপর নিহিত সে বিষয়ে সচেতন ও হুশিয়ার থাকতে পারত । কিন্তু আমরা দেখি যে , এ বিষয়ে তিনি কিছুই বলেন নি । বরং তার বিপরীত বলেছেন। যখন বনি আমের রাসূল (সা.)-এর কাছে আসল তাদের একজন রাসূলকে বলল :

যদি আমরা আপনার সাথে বাইয়াত করি , যার মাধ্যমে আল্লাহ্ আপনাকে আপনার শত্রুদের উপর বিজয়ী করবেন ; সম্ভব কী আপনার পর খেলাফত আমাদের কাছে থাকবে ? রাসূল (সা.) বললেন :

খেলাফতের বিষয়টি আল্লাহর হাতে , তিনি তা যেখানে ইচ্ছা সেখানে প্রদান করবেন।১৫৯

) الامر الي الله يضعه حيث يشاءُ(

শিয়ারা উপরোক্ত নিদর্শনসমূহের ভিত্তিতেই বিশ্বাস করে যে , রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারীরা , যাদেরকে তিনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন , তাদের সকলেই আল্লাহর মনোনীত। আরও প্রয়োজন মনে করেন যে , সকল বিষয়ে যারা প্রকৃত ও সুরক্ষিত দীনের অধিকারী তাঁদের অনুসরণ করা একান্ত জরুরী। সৌভাগ্যবশতঃ এই বিশ্বাসের ফলেই তারা মাসুম ইমামগণের সান্নিধ্যে জ্ঞান , হাকিকাত এবং ইসলামী হুকুম আহকামের বহু তথ্য একত্রিত করতে সক্ষম হন। যা জীবনের সর্বস্তরের সমস্যার জবাব দিতে পারে। আর এ দৃষ্টিকোণ থেকে শিয়া মাযহাব একটি সম্ভ্রান্ত মাযহাব হিসাবে পরিগণিত।

খেলাফতের ঐতিহাসিক পরিক্রমণের সংক্ষিপ্ত চিত্র

রাসূল (সা.) আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী প্রাপ্ত হয়েছিলেন যে , তাঁর পর আলী ইবনে আবি তালিবকে তাঁর খলিফা এবং উত্তরাধিকারী নির্ধারণ করবেন। আর এ মহান বাণীকে জনগণের নিকট পৌঁছে দিতে আদিষ্ট হন ।

ইসলাম প্রচারের শুরুতেই নিজের আত্মীয়-স্বজনকে একত্রিত করেন এবং বলেন : আলী হচ্ছে আমার ওয়াসী ও উত্তরাধিকারী। সকলের কর্তব্য হলো তাঁর অনুসরণ করা।১৬০

তাবুকের যুদ্ধে যাওয়ার প্রাক্কালে হযরত আলীকে বলেন : তোমার আর আমার সম্পর্ক হারুন এবং মূসার সম্পর্কের অনুরূপ। পার্থক্য হলো আমার পরে আর কোন নবী আসবে না। এটা উত্তম নয় কী যে আমার পর তুমি আমার উত্তরাধিকারী থাকবে।১৬১

জীবনের শেষ বছরে বিদায় হজের পর পথিমধ্যে গাদীরে খুম নামক স্থানে লক্ষাধিক জনতার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন : আমি যার মাওলা আলীও তার মাওলা এবং অভিভাবক।১৬২

অনুরূপ তাঁর শেষ জীবনে জনগণ , সাহাবা এবং বন্ধুদেরকে বলেন : আমি তোমাদের মাঝে দুটি অতি উত্তম ও মূল্যবান বস্তু রেখে যাচ্ছি। একটি আল্লাহর কিতাব অর্থাৎ কোরআন ও অপরটি আমার ইতরাত ও আহলে বাইত। যদি এ দুটিকে দৃঢ় ভাবে আঁকড়ে ধর , তাহলে কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না।১৬৩

তাছাড়া অসংখ্য রেওয়ায়েতের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে , মহানবী (সা.) এ বিষয়টিকে বর্ণনা করেছেন। আর এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন যে ইসলামী বিশ্বের নেতৃত্ব স্বাভাবিক ভাবেই আলী (আ.)-এর উপর ন্যাস্ত হবে। এমনকি এ পর্যন্তই তিনি তুষ্ট থাকেননি। তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলোতে বিভিন্ন প্রকার আকর্ষণীয় কর্মসূচী বাস্তবায়ন করেন যেন যারা ইসলামী খেলাফত লুণ্ঠনের নীল-নকশা এঁটে ছিল তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

উসামার নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনীকে রোমের দিকে প্রেরণ করেন। মদীনার সকল মুহাজির এবং আনসারদেরকে যেমন : আবু বকর , ওমর সকলকেই এ বাহিনীতে অংশ গ্রহণ করার জন্যে এবং মদীনা থেকে বেরিয়ে পড়ার আদেশ দেন। কয়েকবার তিনি এ নির্দেশ দান করেছিলেন। তাদের মধ্যে কেউ ফিরে এলে তিনি পুনরায় তাদেরকে উসামার বাহিনীতে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন।১৬৪

রাসূল (সা.) শুধুমাত্র একারণেই মৃত্যু সজ্জায় উসামার নেতৃত্বে মদীনার বাইরে সেনা বাহিনী পাঠিয়ে ছিলেন যেন মদীনা শহর সকল প্রকার বিরোধী তার উপকরণ থেকে মুক্ত থাকে এবং স্বাভাবিক ভাবেই ইসলামী বিশ্বের নেতৃত্ব আলী (আ.)-এর উপর বর্তায়। আর এ জন্যেও যে সকলেই জানুক ; নেতৃত্বের শর্ত বার্ধক্য নয় বরং যোগ্যতাই হলো এর মূল শর্ত। যেন কেউ আলী (আ.)-এর বয়স কম হওয়াটাকে খেলাফতের মর্যাদার জন্যে অজুহাত হিসাবে ব্যবহার না করে। তাছাড়া অপর একটি কারণ হলো যে , হযরত তাঁর মৃত্যু মুখে কোন প্রকার বিরোধিতা ছাড়াই ওসিয়াত করবেন এবং জনগণের সামনে খেলাফতের লিখিত দলিল রেখে যাবেন।

কিন্তু বিরোধীরা ওসামার বাহিনী থেকে পৃথক হয়ে মদীনায় ফিরে আসে। রাসূল তাঁর অন্তিম মুহূর্তে কিছু সাহাবাদেরকে বললেন : কাগজ কলম নিয়ে এস , আমি তোমাদের জন্য এমন কিছু লিখে যেতে চাই যার প্রতি অটল থাকলে কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না । কিন্তু তারা হৈ চৈ করতে লাগল এবং বলল : এই লোক প্রলাপ বলছে , আল্লাহর কিতাবই আমাদের জন্য যথেষ্ট। আর এ কথা নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দিল।

রাসূল (সা.) এ অন্যায় অভিযোগে খুবই দুঃখিত হন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে , এ পরিস্থিতিতে তার লেখা এ মতভেদকে দূরীভূত করতে পারবে না । এমনকি এ কারণে অনেকে ইসলামের মূলে আঘাত হানতে পারে। এ কারণেই তাদেরকে বললেন : তোমরা এখান থেকে বেরিয়ে যাও।১৬৫

যারা রাসূল (সা.)-কে অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত করেছিল , তারা দীনের পরিমাপক সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল। অথবা না বোঝার ভান করেছিল এবং সত্যকে মাথা পেতে নিতে চায়নি। কেননা প্রত্যেক মুসলমানই জানে যে , আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলকে সকল প্রকার ত্রুটি থেকে রক্ষা করেছেন। কখনোই এ মহান রাসূলকে প্রলাপ বলছে এ অভিযোগে অভিযুক্ত করা উচিত নয়। পবিত্র কোরআন বলছে :

) وما ينطق عن الهوا ان هوالاّ وحي يحي(

রাসূল (সা.) নিজের থেকে কিছুই বলেন না , যতক্ষণ পর্যন্ত না তার প্রতি ওহী অবতীর্ণ করা হয়।

সকীফা , খেলাফত আত্মসাতের স্থান

১১ হিজরীর ২৮ শে সফর মহানবী (সা.) ইন্তেকাল করেন। মদীনা শোকে নিমজ্জিত হয়।

কিছু সংখ্যক মুসলমান , যারা ক্ষমতালোভী এবং পদলোভী ছিল তারা উসামার বাহিনী থেকে ফিরে এসেছিল। আর এরাই মহানবী (সা.)-কে তাঁর অন্তিম ওসিয়ত লিখতে বাধা প্রদান করে। মহানবী (সা.)-এর তিরোধানের পর তারা উত্তম সুযোগ পেয়ে যায় এবং রাসূল (সা.)-এর মৃত দেহ ফেলে রেখে সকীফায়ে বনি সায়েদায় একত্রিত হয়।

আনসাররা তাদের দলপতি সা দ ইবনে আবু ওবাদাকে রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারী হিসাবে নির্বাচন করতে চেয়েছিল। কিন্তু আবু বকর এবং ওমর তার বিরোধিতা করে। আবু বকর তার বক্তব্যে মুহাজিরদের মর্যাদা সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেয় এবং বলে : তারা তোমাদের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছিল এবং তারা রাসূল (সা.)-এর গোত্র (কুরাইশ) হতে। সুতরাং আমির (খলিফা) আমাদের মধ্যে হতে এবং উজির তোমাদের মধ্যে থেকে হবে। অতঃপর মুহাজিরদের মধ্য থেকে একজন বলল : তোমরা তোমাদের মধ্য থেকে একজন আমির নির্বাচন কর আর আমরা আমাদের মধ্য থেকে একজন আমির নির্বাচন করব। আবু বকর আবারো তাদেরকে বুঝালে তারা মেনে নিল যে মুহাজিরদের মধ্য থেকেই আমির নির্বাচিত হবে। অতঃপর তারা মুহাজির ও আনসারদের অনুপস্থিতিতে সকলের সাথে কোনরূপ আলোচনা এবং তাদেরকে এ ঘটনা সম্পর্কে অবগত করা ছাড়াই ইসলামের সর্বে সর্বা হয়ে পড়ে। আবু বকর এবং ওমর একে অপরকে খেলাফত গ্রহণের জন্য অনুরোধ করতে থাকে ; এমতাবস্থায় ওমর আবু বকরের হাতে বাইয়াত করে।১৬৬ ওমরের পর যারা চাচ্ছিল না যে , সা দ ইবনে ওবাদা খলিফা হোক , তারা আবু বকরের হাতে বাইয়াত করে।১৬৭ তারা একটুও চিন্তা করলনা যে , যদি ফজিলতের মানদণ্ড রাসূল (সা.)-এর নৈকট্য এবং তাঁর বংশের থেকে হওয়া , হয়ে থাকে ; তাহলে আবু বকরের চেয়ে রাসূলের নিকটতম ব্যক্তি রয়েছেন , যিনি এ কাজের জন্য সার্বিক ভাবে সকলের চেয়ে উত্তম। আকস্মিক এ নির্বাচনে সা দ ইবনে ওবাদা ও তাঁর সমর্থকরা হেরে যায় এবং আবু বকর ও ওমর জয়ী হয়। আরো কিছু সংখ্যক বিরোধীদেরকে জোর পূর্বক বাইয়াত করতে বাধ্য করে।১৬৮ অতঃপর আবু বকর ওমর এবং তাদের সমর্থকরা সকীফা থেকে বেরিয়ে মসজিদে নববীর দিকে রওনা করে। পথিমধ্যে কাউকে দেখলে তাকে আবু বকরের সাথে বাইয়াত করতে বাধ্য করে।১৬৯

বনি হাশিম এবং মুহাজির ও আনসারদের বিশিষ্ট সাহাবীগণ যেমন : রাসূল (সা.)-এর চাচা আব্বাস , যুবাইর , হাব্বাব ইবনে মুনযার , মেকদাদ , আবু যার গিফারী , সালমান ফারসী , আম্মার ইয়াসির , বারাত ইবনে আযেব , উবাই বিন কাব , উতবা ইবনে আবী লাহাব , খালেদ ইবনে সাঈদ , খুযাইমা ইবনে ছাবিত এবং ফারওয়া ইবনে আমর যারা এ বিষয়ে অবগত ছিলেন না। অকস্মাৎ জানতে পারলেন যে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। ঘটনা জানতে পেরে তাঁরা খুবই আশ্চর্য বোধ করেন১৭০ এবং বাইয়াত করেন নি। তারা চিন্তাও করতে পারেন নি যে , এত বেশি রেওয়ায়েত ও স্বয়ং রাসূল (সা.)-এর মনোনয়ন সত্ত্বেও এত শীঘ্র খেলাফত আত্মস্যাৎ করে ফেলবে এবং রাসূল (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতকে উপেক্ষা করা হবে। সংগত কারণেই সকলে এ অন্যায় এবং ষড়যন্ত্রমূলক বাইয়াতের সরাসরি প্রতিবাদ করেন।

হযরত আলী (আ.)ও আবু বকর ও ওমরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। আবু বকরের সমর্থক আবু উবাইদা বলে , আলী তুমি এখনো যুবক এবং খেলাফতের জন্য যথেষ্ট অভিজ্ঞতা তোমার নেই। এর জবাবে আলী (আ.) বলেন : আল্লাহকে ভয় কর , রাসূল (সা.)-এর ইসলামী হুকুমাতকে তার ঘর থেকে নিজেদের ঘরে নিয়ে যেয়ো না এবং এই মর্যদার প্রকৃত অধিকারী থেকে তা আত্মসাৎ করনা। হে মুহাজিরগণ (ও আনসার) আমরাই (নবী পরিবার) এবং আমরাই এ খেলাফতের জন্য যোগ্যতম।

তবে কি কিতাব যার আয়ত্বে রয়েছে এবং আল্লাহর দীনের যে ফকীহ। আর মুসলমানদের সার্বিক ব্যবস্থপনার যে যোগ্য তিনি আমাদের মধ্য হতে নয় ? আল্লাহর শপথ! এ খেলাফত আমাদের , প্রবৃত্তির পূজারী হয়ো না। কেননা সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে।১৭১

সকীফার ঘটনার পর যখন সর্বসাধারণের কাছে বাইয়াত ঘোষণা করা হয় , আলী (আ.) প্রতিবাদের সুরে ঘর থেকে বাইরে আসেন এবং আবু বকরকে বলেন :

আমাদের ন্যায্য অধিকার থেকে আমাদেরকে বঞ্চিত করেছ এবং পরামর্শ করনি। আর সম্পূর্ণরূপে আমাদের অধিকারকে পদদলিত করেছ। আবু বকর বলল : হ্যাঁ কিন্তু ফেৎনা ও বিশৃঙ্ক্ষলা থেকে ভয় পেয়েছিলাম। এভাবে হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.) যতদিন জীবিত ছিলেন বনি হাশিমের কেউই আবু বকরের নিকট বাইয়াত করেননি।১৭২

রাসূল (সা.)-এর তিরোধানের পূর্বে ও পরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে মানুষের সামনে ষড়যন্ত্রের এক বিকট মূর্তি উপস্থিত হয়। আর এ ষড়যন্ত্রের ভিত্তি ছিল ক্ষমতা লিপ্সা এবং নেতৃত্বের লোভ। যদি তাদের কোন উদ্দেশ্যই (ক্ষমতার লোভ) না থাকবে কেন বনি হাশিম এবং রাসূল (সা.)-এর সম্মানিত সাহাবীদেরকে না জানিয়ে গোপনে সকীফায় গিয়েছিল ? যদি ধরে নেই যে , রাসূল (সা.) কাউকে খলিফা বা উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যাননি ; তাহলে কি ইসলামী বিশ্বের ভাগ্য হযরত আলী (আ.) ও তাঁর সাথিরা যেমন : বনি হাশিম এবং সম্মানিত। সাহাবারা যেমন : সালমান , আবু যার এবং মেকদাদের পরামর্শ ব্যতীতই নির্ধারিত হবে ?

তারা কি হযরত আলীর চেয়ে বড় চিন্তাবিদ ছিলেন ? রাসূল (সা.) কি হযরত আলী সম্পর্কে বলে জাননি যে :

علي مع الحق والحق مع العلي

আলী হকের সাথে আর হক আলীর সাথে। ১৭৩

علي اقضيكم

আলী তোমাদের সবার চেয়ে উত্তম বিচারক ?১৭৪

انا مد ينة العلم وعلي با بها

আমি জ্ঞানের শহর এবং আলী তার দরজা।১৭৫

হযরত আলী (আ.) কী জ্ঞান ও ফজিলতের প্রাণকেন্দ্র ছিলেন না ? তাহলে কেন তাঁর নিকট বাইয়াত করল না , এমনকি এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর সাথে পরামর্শ পর্যন্ত করতে রাজি হলো না।

হযরত আলীর বয়স কম হওয়া কি কোন অজুহাত হতে পারে! রাসূল (সা.) যোগ্যতা ও অগ্রাধিকারের মানদণ্ডকে তাকওয়া নির্ধারণ করেছেন। আর উক্ত কারণেই উসামাকে আবু বকরদের উপর অগ্রাধিকার দিয়েছেন। সুতরাং কেন হযরত আলী অন্যদের উপর প্রাধান্য পাবেন না ?

যারা এই অজুহাতে যে , আলী (আ.) ইসলামের বিভিন্ন যুদ্ধে অগণিত (কাফেরের) রক্ত ঝরিয়েছেন , তারা তাঁর নিকট নতি স্বীকার করেনি এবং তাঁর খেলাফতের অবাধ্যতা করেছে। তারা আলী (আ.) সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর সকল বাণী ও রেওয়ায়েতকে উপেক্ষা করেছে। ইসলামের নিয়ম অনুযায়ী যদি কেউ হকের কাছে নতি স্বীকার না করে তাকে বাধ্য করতে হবে , না কি সে হককে উপেক্ষা করবে!

তা ছাড়াও এ অজুহাতের যদি কোন ভিত্তি থাকত এবং তা যদি ঠিক হতো। তাহলে আল্লাহ তায়ালা হযরত আলী (আ.)-কে মনোনীত করতেন না এবং রাসূল (সা.)ও তাঁকে তাঁর উত্তরাধিকারী নির্ধারণ করতেন না।

একটি প্রশ্ন :

কিছু মুসলমান ভাই যারা ন্যায় সংগত বিচার করেন , তারা বলেন :

গাদীরের ঘটনা এবং অন্যান্য অসংখ্য দলিল প্রমাণ যা হযরত আলীর খেলাফতকে প্রমাণিত করে তা অনস্বীকার্য। কিন্তু কেন রাসূল (সা.)-এর তিরোধানের পর আলী (আ.) তাঁর ন্যায্য অধিকার রক্ষা করলেন না। অথচ তাঁর খেলাফত কালে যারা তাঁর বিরুদ্ধে উত্থান করত এবং তাঁর হুকুমতকে আত্মসাৎ করতে চাইত , তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করতেন।

উত্তর :

হযরত আলী (আ.) আবু বকরের খেলাফতকে অবৈধ মনে করতেন। আর এ কারণেই তার জুমার নামাজে এবং জামাতের নামাজে অংশ গ্রহণ করতেন না। তিনি তাঁর ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে নিতে জনগণের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। এমনকি তিনি হযরত ফাতেমা যাহরাকে নিয়ে রাত্রে আনসারদের বাড়িতে গিয়ে তাদের কাছে সাহায্য চান এবং বলেন : তোমরা আমার অধিকার ফিরিয়ে নিতে সাহায্য কর। আনসাররা জবাব দিল : আমরা আবু বকরের নিকট বাইয়াত করে ফেলেছি , এখন আর কিছু করার নেই যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।১৭৬

এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে , রাসূল (সা.)-এর পর আলী (আ.) সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়ে ছিলেন এবং তাঁর কোন সাহায্যকারী ছিলনা , যাদের মাধ্যমে কিয়াম করবেন। অন্যথায় তিনি তাঁর ন্যায্য অধিকার আদায় করে ইসলামী বিশ্বের নেতৃত্ব দান করতেন। যখন জনগণ ওসমানের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তাকে হত্যা করে এবং হতবুদ্ধি হয়ে আলী (আ.)-এর দিকে বাইয়াতের হাত বাড়িয়ে দেয় , তখন আলী (আ.) বললেন : যেহেতু সাহায্যকারী পেয়েছি ইসলামী হুকুমতকে গ্রহণ করাই প্রয়োজন মনে করছি। সুতরাং ইসলামী সমাজের নেতৃত্বকে হাতে তুলে নেন এবং নেতৃত্বদান করেন।১৭৭

কিন্তু রাসূল (সা.)-এর তিরোধানের পর যখন দেখলেন কোন সাহায্যকারী নেই এবং এ মুহূর্তে কিয়াম করলে অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্য বৃদ্ধি পাবে , যা ইসলামের জন্য কল্যাণকর নয়। কেননা ইসলামের শত্রুরা ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে ওৎ পেতে বসেছিল এবং ইসলাম হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল।

হযরত আলী (আ.) শুধুমাত্র ইসলামের খাতিরে কিয়াম করেননি , কেননা তিনি ইসলামকে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসতেন। তিনি চেয়েছিলেন ইসলাম শিকড় গেড়ে বসুক এবং শাখা-প্রশাখা বিস্তার লাভ করুক ও পুষ্প এবং ফল দান করুক। আলী (আ.) হলেন সেই মহান বীর যিনি সর্বদা রাসূল (সা.)-এর সাথে থেকে ইসলামের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি যুদ্ধ না করাটাকে ইসলামের জন্য কল্যাণকর মনে করেছিলেন এবং সকল তিক্ততায় ধৈর্য্য ধারণ করে ছিলেন।

আলী (আ.) কখনোই নেতৃত্বের লোভ করেন নি। অন্যথায় তিনি যে কোন উপায়ে নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করতে পারতেন। কিন্তু আমরা দেখতে পাই যখন আবু সুফিয়ান হযরত আলীকে বলেছিল : হাত বাড়িয়ে দিন আপনার সাথে বাইয়াত করব , আল্লাহর কসম! যদি চান তাহলে মদীনাকে অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্যে পরিপূর্ণ করে দিতে পারি। আলী (আ.) তা গ্রহণ না করে বললেন : আল্লাহর শপথ! তুমি ইসলামের শুভাকাঙ্ক্ষী নও এবং ফেৎনা ফাসাদ করাই হচ্ছে তোমার একমাত্র লক্ষ্য।১৭৮

এ আলোচনায় মনোনিবেশ করার উদ্দেশ্যে এই যে , আমাদের সুন্নী ভাইয়েরা ইতিহাসের এ মহা সত্যের উপর (যা তাদেরই নির্ভরযোগ্য গ্রন্থসমূহ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে) বেশি বেশি অনুসন্ধান করবেন। যার মাধ্যমে একে অপরের সহযোগিতা এবং সহমর্মিতায় আমরা পূর্বের তিক্ততার ক্ষতিপূরণ করতে পারব এবং নিষ্ঠার সাথে বিশ্বের সকল মুসলমানদের মধ্যে প্রকৃত ঐক্য সৃষ্টির পথে সচেষ্ট হতে পারব।

ولا حولا ولا قوة الا بالله العلي العظيم

ওয়াহাবীদের উপস্থাপিত দলিলের পর্যালোচনা

প্রথম দলিল

পূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি ওয়াহাবীরা তাদের মতের সপক্ষে নিম্নোক্ত হাদীসটি উপস্থাপন করে থাকে যে,মহানবী (সা.) বলেছেন : যখন কোন ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে তখন তার সকল সৎকর্ম বন্ধ হয়ে যায় তিনটি ব্যতীত যথা সাদকায়ে জারীয়া (মসজিদ,মাদ্রাসা,স্কুল,হাসপাতাল,ইয়াতিম খানা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা),তার রেখে যাওয়া যে জ্ঞান হতে অন্যান্যরা লাভবান হয় এবং সৎকর্মশীল (নেক) সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।

তারা উপরিউক্ত হাদীসের মাধ্যমে প্রমাণ করতে চায় মৃত্যুর মাধ্যমে এ পৃথিবীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। এর ফলে তারা এ পৃথিবী হতে কোন কল্যাণ প্রাপ্ত হয় না এবং এ পৃথিবীতে তারা কোন প্রভাবও রাখতে সক্ষম নন।

আমাদের উত্তর

উপরিউক্ত হাদীসটিতে তিনটি কর্ম ব্যতীত মৃতব্যক্তি নিজের জন্য অন্য কোন কর্ম করতে পারে না বলা হয়েছে অর্থাৎ যে কর্মসমূহ মৃতব্যক্তি তার জীবদ্দশায় পরবর্তী জীবনের জন্য করতে পারত তা উল্লেখ করে বলা হয়েছে ঐ তিনটি ব্যতীত অন্য কোন কর্মের সওয়াব সে অনবরত লাভ করতে পারবে না। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে,অন্য কোন ব্যক্তি তার পক্ষে কোন কাজ করলে তা হতে সে লাভবান হবে না বরং অন্য কোন ব্যক্তি তার মৃত্যুর পর তার নিয়তে কোন সৎকর্ম করলে সে সওয়াব পেতে পারে। কারণ তা তার নিজ কর্মের উপর নির্ভরশীল নয়।৯৭

দ্বিতীয় দলিল

পবিত্র কোরআনের কোন কোন আয়াত হতে বাহ্যিকভাবে বোঝা যায় মৃতরা শুনতে পায় না। যেমন মহান আল্লাহ বলেছেন :

( فَإِنَّكَ لَا تُسْمِعُ الْمَوْتَى وَلَا تُسْمِعُ الصُّمَّ الدُّعَاءَ إِذَا وَلَّوْا مُدْبِرِينَ)

সুতরাং নিশ্চয়ই (হে নবী!) তুমি মৃতদের (যাদের অন্তর মৃত) শোনাতে সক্ষম নও এবং বধিরদের কর্ণেও তা পৌঁছাতে সক্ষম নও যখন তারা( নিজেরাই) পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে। ৯৮

অন্য আয়াতে এসেছে :

( وَمَا يَسْتَوِي الْأَحْيَاءُ وَلَا الْأَمْوَاتُ إِنَّ اللَّهَ يُسْمِعُ مَنْ يَشَاءُ وَمَا أَنْتَ بِمُسْمِعٍ مَنْ فِي الْقُبُورِ)

অবশ্যই জীবিত ও মৃত সমান নয়। নিশ্চয়ই আল্লাহ যাকে চান শোনান। তুমি যে ব্যক্তি কবরে আছে তাকে শোনাতে সক্ষম নও। ৯৯

আমাদের উত্তর

প্রথমত উপরিউক্ত আয়াতের লক্ষ্য কবরে শায়িত প্রাণহীন দেহ হতে পারে যা মাটিতে পরিণত হয়েছে ফলে কোন কিছু বুঝতে সক্ষম নয়।

দ্বিতীয়ত শুনতে সক্ষম নয় অর্থ কোন কল্যাণ অর্জনে সক্ষম নয় হতে পারে যা বধিরতার সমার্থক বলা হয়েছে। ফলে আয়াতের অর্থ দাঁড়ায় এই মুশরিক পৌত্তলিকরা কোরআনের আয়াত শোনে কিন্তু তা হতে কোন কল্যাণ লাভ করে না যেমন কবরে শায়িতরা তোমার কথা শুনে কিন্তু কোন কল্যাণ প্রাপ্ত হয় না। কারণ তাদের সময় (কল্যাণ লাভের সুযোগ) শেষ হয়ে গেছে।

ইবনে কাইয়্যেম জাওযিয়াوما أنتَ بِمُسمعٍ من فی القبور আয়াতটির তাফসীরে বলেছেন : আয়াতটির  লক্ষ্য সে সকল কাফের যাদের অন্তর মৃত,ফলে (হে নবী!) তুমি তাদের কর্ণে সত্যকে পৌঁছাতে সক্ষম নও যা হতে তারা লাভবান হতে পারে। যেমন কবরে শায়িতদের এমনভাবে শোনাতে সক্ষম নও যা হতে কল্যাণ লাভ করতে পারে।

( فَإِنَّكَ لَا تُسْمِعُ الْمَوْتَى وَلَا تُسْمِعُ الصُّمَّ الدُّعَاءَ إِذَا وَلَّوْا مُدْبِرِينَ)

ইবনে কাইয়্যেম এ আয়াতের তাফসীরে বলেছেন : তাদের শ্রবণের অক্ষমতা এ অর্থে যে,যেহেতু মুশরিকদের অন্তর মৃত সেহেতু তুমি  সত্যকে তাদের নিকট পৌঁছাতে সক্ষম নও যেমনটি মৃত ব্যক্তির ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। ১০০

হাসান ইবনে আলী সাক্কাফ আশশাফেয়ীو ما أنت بمسمعٍ من فی القبور আয়াতটির তাফসীরে বলেছেন : আয়াতটির লক্ষ্য সে সকল কাফের যারা বাতিলের পথে একগুয়েমি  প্রদর্শন করে। ফলে তোমার উপদেশ হতে লাভবান হয় না যেমন কবরে শায়িতরা তোমার উপদেশ হতে কল্যাণ পায় না। অতঃপর তিনি তাফসীরে সাবুনী থেকে বর্ণনা করেছেন যে,আয়াতটির অর্থ হল যেমনভাবে মৃত কাফিররা তোমার হেদায়েত ও আহ্বান হতে কল্যাণ প্রাপ্ত হয় না দূর্ভাগা মুশরিকরাও তেমনি তোমার সৎপথ প্রদর্শন হতে লাভবান হয় না।১০১

( إنک لا تسمع الموتی ولا تسمع الصم الدعاء)

আয়াতটির তাফসীরে তিনি বলেছেন : এর অর্থ হে নবী! যার অন্তরে বাতিলের মোহর অঙ্কিত হয়েছে তার নিকট তুমি সত্য পৌঁছাতে সক্ষম নও,কারণ তারা নিজেরাই সত্য হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।১০২

কবর জিয়ারত 

ইসলামী ইতিহাসের পরিক্রমায় মুসলমানগণ কবর জিয়ারতকে শুধু বৈধই মনে করেন নি;বরং আল্লাহর ওলীদের কবর জিয়ারতের উদ্দেশে সফরকে মুস্তাহাব জানেন এবং এ বিষয়ে তাদের মধ্যে ইজমা (শারয়ী ঐকমত্য) রয়েছে। কিন্তু প্রথমবারের মতো এ বিষয়টিকে ইবনে তাইমিয়া নিষিদ্ধ ও অবৈধ ঘোষণা করেন এবং এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে হারাম বলে ফতোয়া দেন। তার পরবর্তীকালে তার শিষ্য ও চিন্তার প্রচারকগণ এ ফতোয়ার পক্ষাবলম্বন করেন এবং তা প্রতিষ্ঠার ব্রত নেন। মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব ও তার অনুসারীরা কবর জিয়ারতকে হারাম বলে মনে করে এবং এ ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। যেহেতু এ বিষয়টির বিশেষ ধর্মীয় প্রভাব রয়েছে সেহেতু বিষয়টির বৈধতার বিষয়ে আমরা এখানে পর্যালোচনা করব।

কবর জিয়ারত সম্পর্কে ওয়াহাবীদের ফতোয়া

১। ইবনে তাইমিয়া বলেছেন, মহানবী (সা.) হতে বর্ণিত কবর জিয়ারত সম্পর্কিত সকল হাদীস শুধু জাইফই (দুর্বল) নয় বরং জাল ও বানোয়াট। ১০৩

আসকালানী ইবনে তাইমিয়া হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি একচেটিয়াভাবে নবী ও ওলীদের কবর জিয়ারতকে হারাম বলে ঘোষণা করেছেন। এমনকি নবী ও ওলীদের কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা ও এজন্য প্রস্তুতি গ্রহণকেও নিষিদ্ধ বলেছেন। ১০৪

ইবনে তাইমিয়া তাঁর আত তাওয়াসসুল ওয়াল ওয়াসিলাহ গ্রন্থে বলেছেন, কবর জিয়ারত সম্পর্কিত মহানবী (সা.) হতে বর্ণিত হাদীস দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য। এ কারণেই সিহাহ্ সিত্তাহ্  ও সুনান লেখকদের কেউই এই হাদীসগুলি বর্ণনা করেন নি। তাঁদের মধ্যে যারা জাইফ (দুর্বল) হাদীস বর্ণনায় অভ্যস্ত তাঁরাই কেবল এমন হাদীস বর্ণনা করেছেন যেমন দারে কুতনী,বাজ্জার ও অন্যান্যরা। ১০৫

তিনি অন্যত্র বলেছেন, কবর জিয়ারত সম্পর্কিত মহানবীর সকল হাদীস দুর্বলই শুধু নয় মিথ্যা ও বানোয়াটও বটে। ১০৬

২। আবদুল আজীজ ইবনে বিজবায বলেছেন, সকলের জন্য জিয়ারত বিশেষত মহানবী (সা.) ও তাঁর সঙ্গে শায়িত দুই সঙ্গীঁর (সাহাবী) কবর জিয়ারত করা মুস্তাহাব। কিন্তু জিয়ারতের নিয়ত করা এবং জিয়ারতের নিয়তে সফর ও সফরের প্রস্তুতি গ্রহণ করা বৈধ নয়। কারণ মহানবী (সা.) বলেছেন, তোমরা কবর জিয়ারত কর,কারণ তা তোমাদের আখেরাতের (ও মৃত্যুর) কথা স্মরণ করিয়ে দেয়,কিন্তু জিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা বৈধ নয়। ১০৭

৩। ওয়াহাবীদের ফতোয়া ও ধর্মীয় বিধি-বিধান সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর প্রদানের জন্য গঠিত স্থায়ী কমিটি তাদের একটি ফতোয়ায় এভাবে বলেছেন, আল্লাহর নবিগণ ও সৎকর্মশীল বান্দাসহ অন্যান্য মুসলমানের কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা বৈধ নয়। বরং তা বিদআত বলে পরিগণিত। ১০৮

উপরিউক্ত ফতোয়াসমূহ হতে বোঝা যায়,কবর জিয়ারতের বৈধতার বিষয়ে ওয়াহাবীদের মধ্যে মত পার্থক্য রয়েছে। ওয়াহাবী চিন্তাধারার পথিকৃত ইবনে তাইমিয়া সম্পূর্ণরূপে কবর জিয়ারতকে নিষিদ্ধ বলেছেন। কিন্তু একই ধারার সাম্প্রতিক আলেমগণ কবর জিয়ারতকে ঐ ক্ষেত্রে অবৈধ ও বিদআত বলেছেন যখন কেউ তার বাসস্থান হতে কবর জিয়ারতের নিয়তে বের হবে। কিন্তু যদি কেউ হজ্জ্ব করতে যেয়ে মহানবীর কবরও জিয়ারত করে আসে তবে সেক্ষেত্রে কোন অসুবিধা নেই।

পবিত্র কোরআন ও কবর জিয়ারত

পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে বর্ণিত বিবরণ হতে আল্লাহর ওলীদের কবর জিয়ারত বৈধ ও মুস্তাহাব হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করা যায়। আমরা এখানে এরূপ কয়েকটি আয়াতের প্রতি ইশারা করব।

১। মহান আল্লাহ মহানবীকে মুনাফিকদের কবরের নিকট দণ্ডায়মান হতে নিষেধ করে বলেছেন:وَ لا تقم علی قبره আপনি তাদের (মুনাফিকদের) কবরের নিকট দণ্ডায়মান হবেন না।

উপরিউক্ত আয়াতটিতে মুনাফিকদের ব্যক্তিত্ব ও মূল্যহীনতার দিকে লক্ষ্য করে তাদের মৃত্যুর পর দাফনের মুহূর্তে অথবা পরবর্তীকালে তাদের কবরের নিকট জিয়ারতের উদ্দেশ্যে দাঁড়াতে নিষেধ করা হয়েছে।

বাইদ্বাভী তাঁর আনওয়ারুত্ তানযীল ১০৯ গ্রন্থে এবং আলূসী তাঁর রুহুল মায়ানী ১১০ তাফসীরে উপরিউক্ত আয়াতের তাফসীরে বলেছেন তাদের কবরের নিকট দাঁড়ানোর অর্থ দাফনের সময় অথবা জিয়ারতের উদ্দেশ্যে।

মুনাফিক ও কাফিরের কবরের নিকট জিয়ারতের উদ্দেশ্যে দাঁড়ানো নিষিদ্ধ হওয়া হতে বোঝা যায় মুমিন ও মুসলমানের কবরের নিকট দাঁড়ানো ও তাদের জিয়ারত করা বৈধ এবং এতে কোন অসুবিধা নেই।

২। মহান আল্লাহ আসহাবে কাহফের বিষয়ে ও তাঁদের প্রতি মানুষদের সম্মান প্রদর্শনের ধরণ কী হওয়া উচিত তা নিয়ে যে দ্বন্দ্ব হয়েছে তার উল্লেখ করে বলেছেন,

( إِذْ يَتَنَازَعُونَ بَيْنَهُمْ أَمْرَهُمْ فَقَالُوا ابْنُوا عَلَيْهِمْ بُنْيَانًا رَبُّهُمْ أَعْلَمُ بِهِمْ قَالَ الَّذِينَ غَلَبُوا عَلَى أَمْرِهِمْ لَنَتَّخِذَنَّ عَلَيْهِمْ مَسْجِدًا)

যখন তারা নিজেদের মধ্যে তাদের (সম্মান প্রদর্শনের) বিষয়ে পরস্পর বিতর্কে লিপ্ত হল এবং তারা (একদল) বলেছিল : তাদের (কবরের) উপর সৌধ নির্মাণ করব। তাদের প্রতিপালক তাদের বিষয়ে অধিক অবগত। তাদের কর্তব্য বিষয়ে যাদের মত প্রবল হল তারা বলল : আমরা অবশ্যই তাদের উপর (কবরস্থানে) মসজিদ নির্মাণ করব। (সূরা কাহ্ফ : ২১)

মুফাসসিরগণ বলেছেন, অনেকের মসজিদ নির্মাণের প্রস্তাব হতে বোঝা যায় তারা মুসলমান ও একত্ববাদী ছিল। তাদের মসজিদ নির্মাণের প্রস্তাবও এ লক্ষ্যে ছিল যে,সবসময় যেন লোকজন সেখানে যায় এবং তাদের (আসহাবে কাহ্ফ)  মাজারও জিয়ারতের স্থানে পরিণত হয়।

কবর যিয়ারত সম্পর্কিত হাদীসসমূহ

মহানবী (সা.) কবর জিয়ারতের কেবল নির্দেশই দান করেন নি,বরং তিনি নিজেও কবর জিয়ারতে যেতেন যাতে করে এ বিষয়টি জায়েয ও মুস্তাহাব হওয়ার বিষয়টি ব্যবহারিক ক্ষেত্রেও প্রমাণিত হয়। আমরা তাই কবর জিয়ারতের বৈধতার বিষয়টি হাদীস এবং মহানবীর অনুসৃত কর্ম (সীরাত) উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই পর্যালোচনা করছি।

ক)হাদীসসমূহে কবর জিয়ারতের বৈধতার দলিল :  ইসলামী শরীয়তে কবর জিয়ারত বৈধ হওয়ার বিষয়টিতে তিনটি পর্যায় লক্ষণীয়।

প্রথম পর্যায় : এ পর্যায়ে পূর্ববর্তী শরিয়তের বৈধতার বিষয়টিই বহাল ছিল।

দ্বিতীয় পর্যায় : ইসলামের প্রাথমিক যুগে কোন কোন গোষ্ঠী বিশেষত আহলে কিতাবের অনুসারীদের শিরক বা অংশীবাদমিশ্রিত বিশ্বাস যা তারা তাদের মৃত ঐশী ব্যক্তিবর্গের বিষয়ে পোষণ করত (যেমন কবরের উপর সিজদা করা) রোধ করার লক্ষ্যে তৎকালীন সময়ের জন্য তা নিষিদ্ধ করা হয়।

তৃতীয় পর্যায় : এই পর্যায়ে পুনরায় কবর জিয়ারতকে বৈধ (জায়েয) করা হয়। মহানবী (সা.) বলেছেন, আমি তোমাদের জন্য কবর জিয়ারতকে নিষিদ্ধ করেছি,কিন্তু এখন হতে তা তোমাদের জন্য বৈধ করা হল তবে  জিয়ারতের সময় এমন কথা বলো না যাতে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন। ১১১

খ) মহানবী (সা.)-এর অনুসৃত কর্মপদ্ধতিতে কবর জিয়ারত:

১। বুরাইদা আসলামী মহানবী (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন যে,তিনি বলেছেন : আমি তোমাদের কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু আমাকে আমার মাতার কবর জিয়ারতের অনুমতি দেয়া হয়েছে। তোমরা তোমাদের মৃতদের কবর জিয়ারত কর। কারণ তা তোমাদের আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।১১২

২। হাকিম নিশাবুরী বুরাইদাহ হতে বর্ণনা করেছেন যে,মহানবী সহস্র ফেরেশতাসহ তাঁর মাতার কবর জিয়ারত করেন। সেদিনের ন্যায় এত অধিক ক্রন্দন করতে আমি তাঁকে কখনোই দেখি নি।১১৩

আবু হুরাইরা বলেছেন, মহানবী (সা.) তাঁর মাতার কবর জিয়ারত করার সময় এতটা ক্রন্দন করেছিলেন যে,অন্যরা তাঁর কান্নায় প্রভাবিত হয়ে কাঁদতে শুরু করেছিল। ১১৪

৩। তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ্ বলেছেন, আমরা রাসুলের সাথে শহীদদের কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদীনা হতে বের হলাম। যখন আমরা হাররে ওয়াকিম নামক স্থানে পৌঁছালাম কয়েকটি কবর লক্ষ্য করে তাঁকে বললাম : হে আল্লাহর নবী! এগুলো কি আমাদের মুসলিম ভ্রাতাদের কবর? তিনি বললেন : এ কবরগুলো আমার সাহাবীদের। যখন আমরা শহীদদের কবরের নিকট পৌঁছালাম তিনি বললেন : এ কবরগুলো আমাদের ভ্রাতৃবর্গের। ১১৫

৪। মুসলিম হযরত আয়েশা হতে বর্ণনা করেছেন যে,মহানবী (সা.) শেষ রাত্রে জান্নাতুল বাকীর গোরস্তানে যেয়ে এভাবে সালাম করতেন আস্ সালামু আলা দারে কাওমি মুমিনীন। ১১৬

৫। ইবনে আবি শাইবাহ বলেছেন, মহানবী (সা.) প্রতি বছরের শুরুতে ওহুদের শহীদদের কবরের নিকটে গিয়ে এভাবে সালাম দিতেন, আসসালামু আলাইকুম বিমা সাবারতুম ফানি মা উকবাদ্দার। ১১৭

গ)পূর্ববর্তীগণের জীবন ও কর্মধারায় কবর জিয়ারত : সাহাবী,তাবেয়ী ও ইসলামী উম্মাহর আলেমগণের জীবন ও কর্মধারায় আমরা কবর জিয়ারতের প্রচলন লক্ষ্য করি। এখানে আমরা এরূপ ব্যক্তিবর্গের এরূপ কর্মের নমুনা পেশ করছি।

১। হযরত ফাতিমাতুয যাহরা (আ.) ও কবর জিয়ারত : হাকিম নিশাবুরী তাঁর নিজস্ব সনদ সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে,তিনি মহানবীর জীবদ্দশায় প্রতি শুক্রবার হযরত হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিবের (ওহুদের যুদ্ধে শহীদ রাসূলের চাচা) কবর জিয়ারতে যেতেন। সেখানে নামাজ পড়তেন এবং ক্রন্দন করতেন।১১৮

২।খলিফা উমর ইবনে খাত্তাব এবং কবর জিয়ারত : মুহিবুদ্দিন তাবারী বর্ণনা করেছেন যে,হযরত উমর কয়েকজন সাহাবীকে সঙ্গে নিয়ে হজ্জ্বে যাওয়ার সময় পথে একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি তার কাছে সাহায্য চাইল। তিনি হজ্জ্ব হতে ফেরার সময় ঐ স্থানে পৌঁছে উপরিউক্ত ব্যক্তির খোঁজ খবর জানতে চাইলেন। তাকে বলা হলো সে মৃত্যুবরণ করেছে। এ কথা শুনে তিনি দ্রুত তার কবরের নিকট যেয়ে নামাজ পড়লেন ও সেখানে বসে ক্রন্দন করলেন।১১৯

৩।হযরত আয়েশা ও কবর জিয়ারত : ইবনে আবি মালিকা বলেছেন : একদিন হযরত আয়েশা  কবরস্থানে প্রবেশ করলেন আমি তাঁকে প্রশ্ন করলাম : কেন কবরস্থানে প্রবেশ করছেন? তিনি বললেন : আমার ভাই আবদুর রহমানের কবর জিয়ারত করতে। আমি বললাম : মহানবী (সা.) কি কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেন নি? তিনি বললেন : তিনি নিষেধ করেছিলেন,কিন্তু পরে অনুমতি দিয়েছেন।১২০

৪। হযরত আলী (আ.) ও কবর জিয়ারত : খাব্বাব ইবনে আরত প্রাথমিক মুসলমানদের একজন তিনি কুফায় বসবাসকালীন সময়ে গুরুতর অসুস্থতার কারণে হযরত আলীর সঙ্গে সিফ্ফিনের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেন নি। যখন ইমাম আলী (আ.) সিফ্ফিন হতে ফিরে এসে তাঁর মৃত্যুর সংবাদ শুনলেন তখন তাঁর কবরের নিকট গিয়ে জিয়ারত করলেন।১২১

৫।মুহাম্মদ ইবনে হানাফীয়াহ ও কবর জিয়ারত : ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.) শাহাদাত বরণের পর মুহাম্মদ ইবনে হানাফীয়াহ তাঁর কবরের নিকট পৌঁছলে তাঁর কণ্ঠরোধ হয়ে আসল। কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক হলে তিনি ইমাম হাসানের প্রশংসা করতে লাগলেন।১২২

৬।আবু খাল্লাল ও কবর জিয়ারত : স্বীয়যুগে হাম্বলী ফিকাহর ইমাম আবু খাল্লাল বলেছেন, যখনই আমি কোন সমস্যায় পড়তাম হযরত মূসা ইবনে জাফরের (আ.) নিয়ত করতাম এবং তাঁর উসিলায় আল্লাহর নিকট চাইতাম। আল্লাহর ইচ্ছায় আমার সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। ১২৩

৭।ইবনে খোজাইমা ও কবর জিয়ারত : আবু বকর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মুয়াম্মাল বলেছেন : আহলে হাদীসের ইমাম আবি বাকর ইবনে খোজাইমা,ইবনে আলী সাকতী ও স্বনামধন্য কয়েকজন আলেমের সঙ্গে হযরত আলী ইবনে মূসা আর রেজার কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। লক্ষ্য করলাম ইবনে খোজাইমা এমনভাবে আলী ইবনে মূসার কবরের প্রতি সম্মান ও বিনয় প্রদর্শন করলেন যে,আমরা হতভম্ব হলাম।১২৪

আহলে সুন্নাতের আলেমদের ফতোয়া

১। ইবনে ইদ্রিস শাফেয়ী বলেছেন : কবর জিয়ারতে কোন সমস্যা নেই। তবে জিয়ারতের মুহূর্তে এমন কিছু বলা যাবে না যাতে মহান আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন। ১২৫

২। হাকিম নিশাবুরী বলেছেন : কবর জিয়ারত মুস্তাহাব সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। ১২৬

৩। শেখ মানুসর আলী নাসেফ বলেছেন : আহলে সুন্নাতের আলেমদের দৃষ্টিতে কবর জিয়ারত করা মুস্তাহাব।১২৭

৪। ইবনে হাজম,আবু হামিদ গাজ্জালী এবং আবদুর রহমান জায়িরী হতে বর্ণিত হয়েছে তাঁরা মৃত ব্যক্তির জিয়ারতকে মুস্তাহাব মনে করতেন।১২৮

আল কোরআনের দৃষ্টিতে মহানবীর কবর জিয়ারত

মহানবীর কবর জিয়ারতের বৈধতার বিষয়টি প্রমাণকারী কয়েকটি আয়াত রয়েছে,যেমন :

( وَلَوْ أَنَّهُمْ إِذْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ جَاءُوكَ فَاسْتَغْفَرُوا اللَّهَ وَاسْتَغْفَرَ لَهُمُ الرَّسُولُ لَوَجَدُوا اللَّهَ تَوَّابًا رَحِيمًا)

আর যদি তারা (মুনাফিকরা) নিজেদের উপর জুলুম করার পর তোমার (রাসূলের) নিকট আসত এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করত সেই সাথে রাসূলও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন তবে তারা আল্লাহকে ক্ষমাকারী ও দয়াবান হিসেবে পেত। ১২৯ অবশ্য কোন কোন মুফাসসিরের মতে উপরিউক্ত আয়াত মহানবীর  জীবদ্দশার সাথে জড়িত অর্থাৎ যেসব ব্যক্তি নিজের উপর অন্যায় করার পর তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে অন্যায় (গুনাহ) স্বীকার করে তাঁকে তাদের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনার আহ্বান জানাত এবং তিনি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন তখন আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দিতেন। কিন্তু এ বিষয়টি মহানবীর  মৃত্যুর পরও প্রমাণযোগ্য।

সাবকী তাঁর শিফাউস সিকাম গ্রন্থে বলেছেন, যদিও আয়াতটি রাসূল (সা.)-এর জীবদ্দশার সাথে সম্পর্কিত তদুপরি মৃত্যুর সাথে সাথে তাঁর এ মর্যাদার পরিসমাপ্তি ঘটে নি। এ কারণে বলা যায় সকলের জন্যই আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনার এ পদ্ধতির সর্বজনীনতা রয়েছে,তাই আলেমগণ উপরিউক্ত আয়াত হতে সর্বজনীনতা বুঝে থাকেন এবং রাসূলের  কবরের নিকট উক্ত আয়াত পাঠ করা মুস্তাহাব।১৩০

সাবকীর বক্তব্যে সর্বজনীনতার যে কারণটি উল্লেখ করা হয়েছে তার ব্যাখ্যায় বলতে চাই গুনাহকারী ব্যক্তিকে রাসূলের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শটি তাঁর শাফায়াতের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং নিঃসন্দেহে তাঁর মৃত্যুর পরও গুনাহকারীদের জন্য এরূপ মাধ্যমের (স্বয়ং নবী অথবা আল্লাহর কোন ওলীর শাফায়াতের) প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাই তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কবর জিয়ারতে যাওয়া ও তাঁর মধ্যস্থতায় আল্লাহর নিকট চাওয়ায় কোন সমস্যা নেই।

সুফিয়ান ইবনে আম্বার উতবা হতে (যাঁরা উভয়েই ইমাম শাফেয়ীর হাদীসের শিক্ষক) বর্ণনা করেছেন : আমি মহানবীর কবরের নিকট বসেছিলাম এ সময় একজন বেদুইন আরব রাসূল (সা.)-এর কবরের নিকট এসে বলল : হে আল্লাহর রাসূল! আপনার উপর আমার সালাম। অতঃপর সূরা নিসার উপরিউক্ত আয়াতটি পাঠ করে বলল : হে নবী! আমি আপনার নিকট এসে আমার গুনাহর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং আল্লাহর নিকট আপনাকে শাফি (মধ্যস্থতা ও সুপারিশকারী) হিসেবে পেশ করছি। এ কথা বলে সে ক্রন্দন করতে লাগল এবং রাসূলের শানে কবিতা আবৃত্তি করল।১৩১

সামআনী একই রকম ঘটনা হযরত আলী হতে বর্ণনা করেছেন।১৩২   তিনি বলেছেন, যদি এই কর্ম সঠিক ও বৈধ না হতো তবে সাহাবিগণ,বিশেষত হযরত আলী (আ.) ঐ স্থানে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও কেন নিষেধ করলেন না?১৩৩

হাদীসের দৃষ্টিতে মহানবী (সা.)-এর কবর জিয়ারত

আহলে সুন্নাতের হাদীস গ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন করলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সহীহ্ হাদীস পাওয়া যায় যা রাসূলের কবর জিয়ারত মুস্তাহাব হওয়াকে প্রমাণ করে। এখানে এরূপ কয়েকটি হাদীসের উল্লেখ করছি।

১। দারে কুতনী সহীহ্ সূত্রে আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর হতে বর্ণনা করেছেন যে,মহানবী (সা.) বলেছেন, যে কেউ আমার কবর জিয়ারত করবে তার জন্য শাফায়াত (সুপারিশ) করা আমার জন্য আবশ্যক হবে। ১৩৪

২। দারে কুতনী সহীহ্ সূত্রে রাসূল (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন যে,তিনি বলেছেন, যে কেউ হজ্জ্ব করার পর আমার কবর জিয়ারত করতে আসবে সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করল।১৩৫

৩। বায়হাকী সহীহ্ সূত্রে আনাস ইবনে মালিক হতে বর্ণনা করেছেন,মহানবী (সা.) বলেছেন, যে কেউ দুই হারামে (মক্কা ও মদীনায়) মৃত্যুবরণ করবে সে নিরাপত্তা লাভকারীদের (আল্লাহর আজাব হতে) অন্তর্ভুক্ত হিসেবে কিয়ামত দিবসে পুনরুত্থিত হবে এবং যে কেউ আমাকে ইখলাসের সাথে (নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর উদ্দেশ্যে) জিয়ারত করবে,সে কিয়ামতের দিন আমার সাথে থাকবে। ১৩৬

৪। ইবনে আদী আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর থেকে বর্ণনা করেছেন যে,মহানবী (সা.) বলেছেন, যে কেহ আল্লাহর ঘর (কাবা) জিয়ারত করল ও হজ্জ্ব সম্পাদন করল,কিন্তু আমার কবর জিয়ারত করল না,সে আমার প্রতি অবিচার করল (অর্থাৎ আমার প্রতি দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করল না। ১৩৭

৫। আনাস ইবনে মালিক মহানবী (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন যে,তিনি বলেছেন, যে কেউ আমার মৃত্যুর পর আমাকে জিয়ারত করল সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমাকে জিয়ারত করল। যে কেউ আমার কবর জিয়ারত করল তার শাফায়াত (সুপারিশ) করা আমার জন্য কিয়ামতের দিন অপরিহার্য হয়ে পড়বে এবং কোন স্বচ্ছল ব্যক্তি ও সুস্থ ব্যক্তি আমার কবর জিয়ারত হতে বিরত থাকলে তার জন্য কিয়ামতে কোন ওজরই গৃহীত হবে না।১৩৮

ওয়াহাবীদের উপস্থাপিত দলিলের পর্যালোচনা

প্রথম দলিল

পূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি ওয়াহাবীরা তাদের মতের সপক্ষে নিম্নোক্ত হাদীসটি উপস্থাপন করে থাকে যে,মহানবী (সা.) বলেছেন : যখন কোন ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে তখন তার সকল সৎকর্ম বন্ধ হয়ে যায় তিনটি ব্যতীত যথা সাদকায়ে জারীয়া (মসজিদ,মাদ্রাসা,স্কুল,হাসপাতাল,ইয়াতিম খানা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা),তার রেখে যাওয়া যে জ্ঞান হতে অন্যান্যরা লাভবান হয় এবং সৎকর্মশীল (নেক) সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।

তারা উপরিউক্ত হাদীসের মাধ্যমে প্রমাণ করতে চায় মৃত্যুর মাধ্যমে এ পৃথিবীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। এর ফলে তারা এ পৃথিবী হতে কোন কল্যাণ প্রাপ্ত হয় না এবং এ পৃথিবীতে তারা কোন প্রভাবও রাখতে সক্ষম নন।

আমাদের উত্তর

উপরিউক্ত হাদীসটিতে তিনটি কর্ম ব্যতীত মৃতব্যক্তি নিজের জন্য অন্য কোন কর্ম করতে পারে না বলা হয়েছে অর্থাৎ যে কর্মসমূহ মৃতব্যক্তি তার জীবদ্দশায় পরবর্তী জীবনের জন্য করতে পারত তা উল্লেখ করে বলা হয়েছে ঐ তিনটি ব্যতীত অন্য কোন কর্মের সওয়াব সে অনবরত লাভ করতে পারবে না। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে,অন্য কোন ব্যক্তি তার পক্ষে কোন কাজ করলে তা হতে সে লাভবান হবে না বরং অন্য কোন ব্যক্তি তার মৃত্যুর পর তার নিয়তে কোন সৎকর্ম করলে সে সওয়াব পেতে পারে। কারণ তা তার নিজ কর্মের উপর নির্ভরশীল নয়।৯৭

দ্বিতীয় দলিল

পবিত্র কোরআনের কোন কোন আয়াত হতে বাহ্যিকভাবে বোঝা যায় মৃতরা শুনতে পায় না। যেমন মহান আল্লাহ বলেছেন :

( فَإِنَّكَ لَا تُسْمِعُ الْمَوْتَى وَلَا تُسْمِعُ الصُّمَّ الدُّعَاءَ إِذَا وَلَّوْا مُدْبِرِينَ)

সুতরাং নিশ্চয়ই (হে নবী!) তুমি মৃতদের (যাদের অন্তর মৃত) শোনাতে সক্ষম নও এবং বধিরদের কর্ণেও তা পৌঁছাতে সক্ষম নও যখন তারা( নিজেরাই) পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে। ৯৮

অন্য আয়াতে এসেছে :

( وَمَا يَسْتَوِي الْأَحْيَاءُ وَلَا الْأَمْوَاتُ إِنَّ اللَّهَ يُسْمِعُ مَنْ يَشَاءُ وَمَا أَنْتَ بِمُسْمِعٍ مَنْ فِي الْقُبُورِ)

অবশ্যই জীবিত ও মৃত সমান নয়। নিশ্চয়ই আল্লাহ যাকে চান শোনান। তুমি যে ব্যক্তি কবরে আছে তাকে শোনাতে সক্ষম নও। ৯৯

আমাদের উত্তর

প্রথমত উপরিউক্ত আয়াতের লক্ষ্য কবরে শায়িত প্রাণহীন দেহ হতে পারে যা মাটিতে পরিণত হয়েছে ফলে কোন কিছু বুঝতে সক্ষম নয়।

দ্বিতীয়ত শুনতে সক্ষম নয় অর্থ কোন কল্যাণ অর্জনে সক্ষম নয় হতে পারে যা বধিরতার সমার্থক বলা হয়েছে। ফলে আয়াতের অর্থ দাঁড়ায় এই মুশরিক পৌত্তলিকরা কোরআনের আয়াত শোনে কিন্তু তা হতে কোন কল্যাণ লাভ করে না যেমন কবরে শায়িতরা তোমার কথা শুনে কিন্তু কোন কল্যাণ প্রাপ্ত হয় না। কারণ তাদের সময় (কল্যাণ লাভের সুযোগ) শেষ হয়ে গেছে।

ইবনে কাইয়্যেম জাওযিয়াوما أنتَ بِمُسمعٍ من فی القبور আয়াতটির তাফসীরে বলেছেন : আয়াতটির  লক্ষ্য সে সকল কাফের যাদের অন্তর মৃত,ফলে (হে নবী!) তুমি তাদের কর্ণে সত্যকে পৌঁছাতে সক্ষম নও যা হতে তারা লাভবান হতে পারে। যেমন কবরে শায়িতদের এমনভাবে শোনাতে সক্ষম নও যা হতে কল্যাণ লাভ করতে পারে।

( فَإِنَّكَ لَا تُسْمِعُ الْمَوْتَى وَلَا تُسْمِعُ الصُّمَّ الدُّعَاءَ إِذَا وَلَّوْا مُدْبِرِينَ)

ইবনে কাইয়্যেম এ আয়াতের তাফসীরে বলেছেন : তাদের শ্রবণের অক্ষমতা এ অর্থে যে,যেহেতু মুশরিকদের অন্তর মৃত সেহেতু তুমি  সত্যকে তাদের নিকট পৌঁছাতে সক্ষম নও যেমনটি মৃত ব্যক্তির ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। ১০০

হাসান ইবনে আলী সাক্কাফ আশশাফেয়ীو ما أنت بمسمعٍ من فی القبور আয়াতটির তাফসীরে বলেছেন : আয়াতটির লক্ষ্য সে সকল কাফের যারা বাতিলের পথে একগুয়েমি  প্রদর্শন করে। ফলে তোমার উপদেশ হতে লাভবান হয় না যেমন কবরে শায়িতরা তোমার উপদেশ হতে কল্যাণ পায় না। অতঃপর তিনি তাফসীরে সাবুনী থেকে বর্ণনা করেছেন যে,আয়াতটির অর্থ হল যেমনভাবে মৃত কাফিররা তোমার হেদায়েত ও আহ্বান হতে কল্যাণ প্রাপ্ত হয় না দূর্ভাগা মুশরিকরাও তেমনি তোমার সৎপথ প্রদর্শন হতে লাভবান হয় না।১০১

( إنک لا تسمع الموتی ولا تسمع الصم الدعاء)

আয়াতটির তাফসীরে তিনি বলেছেন : এর অর্থ হে নবী! যার অন্তরে বাতিলের মোহর অঙ্কিত হয়েছে তার নিকট তুমি সত্য পৌঁছাতে সক্ষম নও,কারণ তারা নিজেরাই সত্য হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।১০২

কবর জিয়ারত 

ইসলামী ইতিহাসের পরিক্রমায় মুসলমানগণ কবর জিয়ারতকে শুধু বৈধই মনে করেন নি;বরং আল্লাহর ওলীদের কবর জিয়ারতের উদ্দেশে সফরকে মুস্তাহাব জানেন এবং এ বিষয়ে তাদের মধ্যে ইজমা (শারয়ী ঐকমত্য) রয়েছে। কিন্তু প্রথমবারের মতো এ বিষয়টিকে ইবনে তাইমিয়া নিষিদ্ধ ও অবৈধ ঘোষণা করেন এবং এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে হারাম বলে ফতোয়া দেন। তার পরবর্তীকালে তার শিষ্য ও চিন্তার প্রচারকগণ এ ফতোয়ার পক্ষাবলম্বন করেন এবং তা প্রতিষ্ঠার ব্রত নেন। মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব ও তার অনুসারীরা কবর জিয়ারতকে হারাম বলে মনে করে এবং এ ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। যেহেতু এ বিষয়টির বিশেষ ধর্মীয় প্রভাব রয়েছে সেহেতু বিষয়টির বৈধতার বিষয়ে আমরা এখানে পর্যালোচনা করব।

কবর জিয়ারত সম্পর্কে ওয়াহাবীদের ফতোয়া

১। ইবনে তাইমিয়া বলেছেন, মহানবী (সা.) হতে বর্ণিত কবর জিয়ারত সম্পর্কিত সকল হাদীস শুধু জাইফই (দুর্বল) নয় বরং জাল ও বানোয়াট। ১০৩

আসকালানী ইবনে তাইমিয়া হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি একচেটিয়াভাবে নবী ও ওলীদের কবর জিয়ারতকে হারাম বলে ঘোষণা করেছেন। এমনকি নবী ও ওলীদের কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা ও এজন্য প্রস্তুতি গ্রহণকেও নিষিদ্ধ বলেছেন। ১০৪

ইবনে তাইমিয়া তাঁর আত তাওয়াসসুল ওয়াল ওয়াসিলাহ গ্রন্থে বলেছেন, কবর জিয়ারত সম্পর্কিত মহানবী (সা.) হতে বর্ণিত হাদীস দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য। এ কারণেই সিহাহ্ সিত্তাহ্  ও সুনান লেখকদের কেউই এই হাদীসগুলি বর্ণনা করেন নি। তাঁদের মধ্যে যারা জাইফ (দুর্বল) হাদীস বর্ণনায় অভ্যস্ত তাঁরাই কেবল এমন হাদীস বর্ণনা করেছেন যেমন দারে কুতনী,বাজ্জার ও অন্যান্যরা। ১০৫

তিনি অন্যত্র বলেছেন, কবর জিয়ারত সম্পর্কিত মহানবীর সকল হাদীস দুর্বলই শুধু নয় মিথ্যা ও বানোয়াটও বটে। ১০৬

২। আবদুল আজীজ ইবনে বিজবায বলেছেন, সকলের জন্য জিয়ারত বিশেষত মহানবী (সা.) ও তাঁর সঙ্গে শায়িত দুই সঙ্গীঁর (সাহাবী) কবর জিয়ারত করা মুস্তাহাব। কিন্তু জিয়ারতের নিয়ত করা এবং জিয়ারতের নিয়তে সফর ও সফরের প্রস্তুতি গ্রহণ করা বৈধ নয়। কারণ মহানবী (সা.) বলেছেন, তোমরা কবর জিয়ারত কর,কারণ তা তোমাদের আখেরাতের (ও মৃত্যুর) কথা স্মরণ করিয়ে দেয়,কিন্তু জিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা বৈধ নয়। ১০৭

৩। ওয়াহাবীদের ফতোয়া ও ধর্মীয় বিধি-বিধান সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর প্রদানের জন্য গঠিত স্থায়ী কমিটি তাদের একটি ফতোয়ায় এভাবে বলেছেন, আল্লাহর নবিগণ ও সৎকর্মশীল বান্দাসহ অন্যান্য মুসলমানের কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা বৈধ নয়। বরং তা বিদআত বলে পরিগণিত। ১০৮

উপরিউক্ত ফতোয়াসমূহ হতে বোঝা যায়,কবর জিয়ারতের বৈধতার বিষয়ে ওয়াহাবীদের মধ্যে মত পার্থক্য রয়েছে। ওয়াহাবী চিন্তাধারার পথিকৃত ইবনে তাইমিয়া সম্পূর্ণরূপে কবর জিয়ারতকে নিষিদ্ধ বলেছেন। কিন্তু একই ধারার সাম্প্রতিক আলেমগণ কবর জিয়ারতকে ঐ ক্ষেত্রে অবৈধ ও বিদআত বলেছেন যখন কেউ তার বাসস্থান হতে কবর জিয়ারতের নিয়তে বের হবে। কিন্তু যদি কেউ হজ্জ্ব করতে যেয়ে মহানবীর কবরও জিয়ারত করে আসে তবে সেক্ষেত্রে কোন অসুবিধা নেই।

পবিত্র কোরআন ও কবর জিয়ারত

পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে বর্ণিত বিবরণ হতে আল্লাহর ওলীদের কবর জিয়ারত বৈধ ও মুস্তাহাব হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করা যায়। আমরা এখানে এরূপ কয়েকটি আয়াতের প্রতি ইশারা করব।

১। মহান আল্লাহ মহানবীকে মুনাফিকদের কবরের নিকট দণ্ডায়মান হতে নিষেধ করে বলেছেন:وَ لا تقم علی قبره আপনি তাদের (মুনাফিকদের) কবরের নিকট দণ্ডায়মান হবেন না।

উপরিউক্ত আয়াতটিতে মুনাফিকদের ব্যক্তিত্ব ও মূল্যহীনতার দিকে লক্ষ্য করে তাদের মৃত্যুর পর দাফনের মুহূর্তে অথবা পরবর্তীকালে তাদের কবরের নিকট জিয়ারতের উদ্দেশ্যে দাঁড়াতে নিষেধ করা হয়েছে।

বাইদ্বাভী তাঁর আনওয়ারুত্ তানযীল ১০৯ গ্রন্থে এবং আলূসী তাঁর রুহুল মায়ানী ১১০ তাফসীরে উপরিউক্ত আয়াতের তাফসীরে বলেছেন তাদের কবরের নিকট দাঁড়ানোর অর্থ দাফনের সময় অথবা জিয়ারতের উদ্দেশ্যে।

মুনাফিক ও কাফিরের কবরের নিকট জিয়ারতের উদ্দেশ্যে দাঁড়ানো নিষিদ্ধ হওয়া হতে বোঝা যায় মুমিন ও মুসলমানের কবরের নিকট দাঁড়ানো ও তাদের জিয়ারত করা বৈধ এবং এতে কোন অসুবিধা নেই।

২। মহান আল্লাহ আসহাবে কাহফের বিষয়ে ও তাঁদের প্রতি মানুষদের সম্মান প্রদর্শনের ধরণ কী হওয়া উচিত তা নিয়ে যে দ্বন্দ্ব হয়েছে তার উল্লেখ করে বলেছেন,

( إِذْ يَتَنَازَعُونَ بَيْنَهُمْ أَمْرَهُمْ فَقَالُوا ابْنُوا عَلَيْهِمْ بُنْيَانًا رَبُّهُمْ أَعْلَمُ بِهِمْ قَالَ الَّذِينَ غَلَبُوا عَلَى أَمْرِهِمْ لَنَتَّخِذَنَّ عَلَيْهِمْ مَسْجِدًا)

যখন তারা নিজেদের মধ্যে তাদের (সম্মান প্রদর্শনের) বিষয়ে পরস্পর বিতর্কে লিপ্ত হল এবং তারা (একদল) বলেছিল : তাদের (কবরের) উপর সৌধ নির্মাণ করব। তাদের প্রতিপালক তাদের বিষয়ে অধিক অবগত। তাদের কর্তব্য বিষয়ে যাদের মত প্রবল হল তারা বলল : আমরা অবশ্যই তাদের উপর (কবরস্থানে) মসজিদ নির্মাণ করব। (সূরা কাহ্ফ : ২১)

মুফাসসিরগণ বলেছেন, অনেকের মসজিদ নির্মাণের প্রস্তাব হতে বোঝা যায় তারা মুসলমান ও একত্ববাদী ছিল। তাদের মসজিদ নির্মাণের প্রস্তাবও এ লক্ষ্যে ছিল যে,সবসময় যেন লোকজন সেখানে যায় এবং তাদের (আসহাবে কাহ্ফ)  মাজারও জিয়ারতের স্থানে পরিণত হয়।

কবর যিয়ারত সম্পর্কিত হাদীসসমূহ

মহানবী (সা.) কবর জিয়ারতের কেবল নির্দেশই দান করেন নি,বরং তিনি নিজেও কবর জিয়ারতে যেতেন যাতে করে এ বিষয়টি জায়েয ও মুস্তাহাব হওয়ার বিষয়টি ব্যবহারিক ক্ষেত্রেও প্রমাণিত হয়। আমরা তাই কবর জিয়ারতের বৈধতার বিষয়টি হাদীস এবং মহানবীর অনুসৃত কর্ম (সীরাত) উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই পর্যালোচনা করছি।

ক)হাদীসসমূহে কবর জিয়ারতের বৈধতার দলিল :  ইসলামী শরীয়তে কবর জিয়ারত বৈধ হওয়ার বিষয়টিতে তিনটি পর্যায় লক্ষণীয়।

প্রথম পর্যায় : এ পর্যায়ে পূর্ববর্তী শরিয়তের বৈধতার বিষয়টিই বহাল ছিল।

দ্বিতীয় পর্যায় : ইসলামের প্রাথমিক যুগে কোন কোন গোষ্ঠী বিশেষত আহলে কিতাবের অনুসারীদের শিরক বা অংশীবাদমিশ্রিত বিশ্বাস যা তারা তাদের মৃত ঐশী ব্যক্তিবর্গের বিষয়ে পোষণ করত (যেমন কবরের উপর সিজদা করা) রোধ করার লক্ষ্যে তৎকালীন সময়ের জন্য তা নিষিদ্ধ করা হয়।

তৃতীয় পর্যায় : এই পর্যায়ে পুনরায় কবর জিয়ারতকে বৈধ (জায়েয) করা হয়। মহানবী (সা.) বলেছেন, আমি তোমাদের জন্য কবর জিয়ারতকে নিষিদ্ধ করেছি,কিন্তু এখন হতে তা তোমাদের জন্য বৈধ করা হল তবে  জিয়ারতের সময় এমন কথা বলো না যাতে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন। ১১১

খ) মহানবী (সা.)-এর অনুসৃত কর্মপদ্ধতিতে কবর জিয়ারত:

১। বুরাইদা আসলামী মহানবী (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন যে,তিনি বলেছেন : আমি তোমাদের কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু আমাকে আমার মাতার কবর জিয়ারতের অনুমতি দেয়া হয়েছে। তোমরা তোমাদের মৃতদের কবর জিয়ারত কর। কারণ তা তোমাদের আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।১১২

২। হাকিম নিশাবুরী বুরাইদাহ হতে বর্ণনা করেছেন যে,মহানবী সহস্র ফেরেশতাসহ তাঁর মাতার কবর জিয়ারত করেন। সেদিনের ন্যায় এত অধিক ক্রন্দন করতে আমি তাঁকে কখনোই দেখি নি।১১৩

আবু হুরাইরা বলেছেন, মহানবী (সা.) তাঁর মাতার কবর জিয়ারত করার সময় এতটা ক্রন্দন করেছিলেন যে,অন্যরা তাঁর কান্নায় প্রভাবিত হয়ে কাঁদতে শুরু করেছিল। ১১৪

৩। তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ্ বলেছেন, আমরা রাসুলের সাথে শহীদদের কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদীনা হতে বের হলাম। যখন আমরা হাররে ওয়াকিম নামক স্থানে পৌঁছালাম কয়েকটি কবর লক্ষ্য করে তাঁকে বললাম : হে আল্লাহর নবী! এগুলো কি আমাদের মুসলিম ভ্রাতাদের কবর? তিনি বললেন : এ কবরগুলো আমার সাহাবীদের। যখন আমরা শহীদদের কবরের নিকট পৌঁছালাম তিনি বললেন : এ কবরগুলো আমাদের ভ্রাতৃবর্গের। ১১৫

৪। মুসলিম হযরত আয়েশা হতে বর্ণনা করেছেন যে,মহানবী (সা.) শেষ রাত্রে জান্নাতুল বাকীর গোরস্তানে যেয়ে এভাবে সালাম করতেন আস্ সালামু আলা দারে কাওমি মুমিনীন। ১১৬

৫। ইবনে আবি শাইবাহ বলেছেন, মহানবী (সা.) প্রতি বছরের শুরুতে ওহুদের শহীদদের কবরের নিকটে গিয়ে এভাবে সালাম দিতেন, আসসালামু আলাইকুম বিমা সাবারতুম ফানি মা উকবাদ্দার। ১১৭

গ)পূর্ববর্তীগণের জীবন ও কর্মধারায় কবর জিয়ারত : সাহাবী,তাবেয়ী ও ইসলামী উম্মাহর আলেমগণের জীবন ও কর্মধারায় আমরা কবর জিয়ারতের প্রচলন লক্ষ্য করি। এখানে আমরা এরূপ ব্যক্তিবর্গের এরূপ কর্মের নমুনা পেশ করছি।

১। হযরত ফাতিমাতুয যাহরা (আ.) ও কবর জিয়ারত : হাকিম নিশাবুরী তাঁর নিজস্ব সনদ সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে,তিনি মহানবীর জীবদ্দশায় প্রতি শুক্রবার হযরত হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিবের (ওহুদের যুদ্ধে শহীদ রাসূলের চাচা) কবর জিয়ারতে যেতেন। সেখানে নামাজ পড়তেন এবং ক্রন্দন করতেন।১১৮

২।খলিফা উমর ইবনে খাত্তাব এবং কবর জিয়ারত : মুহিবুদ্দিন তাবারী বর্ণনা করেছেন যে,হযরত উমর কয়েকজন সাহাবীকে সঙ্গে নিয়ে হজ্জ্বে যাওয়ার সময় পথে একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি তার কাছে সাহায্য চাইল। তিনি হজ্জ্ব হতে ফেরার সময় ঐ স্থানে পৌঁছে উপরিউক্ত ব্যক্তির খোঁজ খবর জানতে চাইলেন। তাকে বলা হলো সে মৃত্যুবরণ করেছে। এ কথা শুনে তিনি দ্রুত তার কবরের নিকট যেয়ে নামাজ পড়লেন ও সেখানে বসে ক্রন্দন করলেন।১১৯

৩।হযরত আয়েশা ও কবর জিয়ারত : ইবনে আবি মালিকা বলেছেন : একদিন হযরত আয়েশা  কবরস্থানে প্রবেশ করলেন আমি তাঁকে প্রশ্ন করলাম : কেন কবরস্থানে প্রবেশ করছেন? তিনি বললেন : আমার ভাই আবদুর রহমানের কবর জিয়ারত করতে। আমি বললাম : মহানবী (সা.) কি কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেন নি? তিনি বললেন : তিনি নিষেধ করেছিলেন,কিন্তু পরে অনুমতি দিয়েছেন।১২০

৪। হযরত আলী (আ.) ও কবর জিয়ারত : খাব্বাব ইবনে আরত প্রাথমিক মুসলমানদের একজন তিনি কুফায় বসবাসকালীন সময়ে গুরুতর অসুস্থতার কারণে হযরত আলীর সঙ্গে সিফ্ফিনের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেন নি। যখন ইমাম আলী (আ.) সিফ্ফিন হতে ফিরে এসে তাঁর মৃত্যুর সংবাদ শুনলেন তখন তাঁর কবরের নিকট গিয়ে জিয়ারত করলেন।১২১

৫।মুহাম্মদ ইবনে হানাফীয়াহ ও কবর জিয়ারত : ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.) শাহাদাত বরণের পর মুহাম্মদ ইবনে হানাফীয়াহ তাঁর কবরের নিকট পৌঁছলে তাঁর কণ্ঠরোধ হয়ে আসল। কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক হলে তিনি ইমাম হাসানের প্রশংসা করতে লাগলেন।১২২

৬।আবু খাল্লাল ও কবর জিয়ারত : স্বীয়যুগে হাম্বলী ফিকাহর ইমাম আবু খাল্লাল বলেছেন, যখনই আমি কোন সমস্যায় পড়তাম হযরত মূসা ইবনে জাফরের (আ.) নিয়ত করতাম এবং তাঁর উসিলায় আল্লাহর নিকট চাইতাম। আল্লাহর ইচ্ছায় আমার সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। ১২৩

৭।ইবনে খোজাইমা ও কবর জিয়ারত : আবু বকর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মুয়াম্মাল বলেছেন : আহলে হাদীসের ইমাম আবি বাকর ইবনে খোজাইমা,ইবনে আলী সাকতী ও স্বনামধন্য কয়েকজন আলেমের সঙ্গে হযরত আলী ইবনে মূসা আর রেজার কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। লক্ষ্য করলাম ইবনে খোজাইমা এমনভাবে আলী ইবনে মূসার কবরের প্রতি সম্মান ও বিনয় প্রদর্শন করলেন যে,আমরা হতভম্ব হলাম।১২৪

আহলে সুন্নাতের আলেমদের ফতোয়া

১। ইবনে ইদ্রিস শাফেয়ী বলেছেন : কবর জিয়ারতে কোন সমস্যা নেই। তবে জিয়ারতের মুহূর্তে এমন কিছু বলা যাবে না যাতে মহান আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন। ১২৫

২। হাকিম নিশাবুরী বলেছেন : কবর জিয়ারত মুস্তাহাব সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। ১২৬

৩। শেখ মানুসর আলী নাসেফ বলেছেন : আহলে সুন্নাতের আলেমদের দৃষ্টিতে কবর জিয়ারত করা মুস্তাহাব।১২৭

৪। ইবনে হাজম,আবু হামিদ গাজ্জালী এবং আবদুর রহমান জায়িরী হতে বর্ণিত হয়েছে তাঁরা মৃত ব্যক্তির জিয়ারতকে মুস্তাহাব মনে করতেন।১২৮

আল কোরআনের দৃষ্টিতে মহানবীর কবর জিয়ারত

মহানবীর কবর জিয়ারতের বৈধতার বিষয়টি প্রমাণকারী কয়েকটি আয়াত রয়েছে,যেমন :

( وَلَوْ أَنَّهُمْ إِذْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ جَاءُوكَ فَاسْتَغْفَرُوا اللَّهَ وَاسْتَغْفَرَ لَهُمُ الرَّسُولُ لَوَجَدُوا اللَّهَ تَوَّابًا رَحِيمًا)

আর যদি তারা (মুনাফিকরা) নিজেদের উপর জুলুম করার পর তোমার (রাসূলের) নিকট আসত এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করত সেই সাথে রাসূলও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন তবে তারা আল্লাহকে ক্ষমাকারী ও দয়াবান হিসেবে পেত। ১২৯ অবশ্য কোন কোন মুফাসসিরের মতে উপরিউক্ত আয়াত মহানবীর  জীবদ্দশার সাথে জড়িত অর্থাৎ যেসব ব্যক্তি নিজের উপর অন্যায় করার পর তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে অন্যায় (গুনাহ) স্বীকার করে তাঁকে তাদের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনার আহ্বান জানাত এবং তিনি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন তখন আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দিতেন। কিন্তু এ বিষয়টি মহানবীর  মৃত্যুর পরও প্রমাণযোগ্য।

সাবকী তাঁর শিফাউস সিকাম গ্রন্থে বলেছেন, যদিও আয়াতটি রাসূল (সা.)-এর জীবদ্দশার সাথে সম্পর্কিত তদুপরি মৃত্যুর সাথে সাথে তাঁর এ মর্যাদার পরিসমাপ্তি ঘটে নি। এ কারণে বলা যায় সকলের জন্যই আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনার এ পদ্ধতির সর্বজনীনতা রয়েছে,তাই আলেমগণ উপরিউক্ত আয়াত হতে সর্বজনীনতা বুঝে থাকেন এবং রাসূলের  কবরের নিকট উক্ত আয়াত পাঠ করা মুস্তাহাব।১৩০

সাবকীর বক্তব্যে সর্বজনীনতার যে কারণটি উল্লেখ করা হয়েছে তার ব্যাখ্যায় বলতে চাই গুনাহকারী ব্যক্তিকে রাসূলের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শটি তাঁর শাফায়াতের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং নিঃসন্দেহে তাঁর মৃত্যুর পরও গুনাহকারীদের জন্য এরূপ মাধ্যমের (স্বয়ং নবী অথবা আল্লাহর কোন ওলীর শাফায়াতের) প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাই তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কবর জিয়ারতে যাওয়া ও তাঁর মধ্যস্থতায় আল্লাহর নিকট চাওয়ায় কোন সমস্যা নেই।

সুফিয়ান ইবনে আম্বার উতবা হতে (যাঁরা উভয়েই ইমাম শাফেয়ীর হাদীসের শিক্ষক) বর্ণনা করেছেন : আমি মহানবীর কবরের নিকট বসেছিলাম এ সময় একজন বেদুইন আরব রাসূল (সা.)-এর কবরের নিকট এসে বলল : হে আল্লাহর রাসূল! আপনার উপর আমার সালাম। অতঃপর সূরা নিসার উপরিউক্ত আয়াতটি পাঠ করে বলল : হে নবী! আমি আপনার নিকট এসে আমার গুনাহর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং আল্লাহর নিকট আপনাকে শাফি (মধ্যস্থতা ও সুপারিশকারী) হিসেবে পেশ করছি। এ কথা বলে সে ক্রন্দন করতে লাগল এবং রাসূলের শানে কবিতা আবৃত্তি করল।১৩১

সামআনী একই রকম ঘটনা হযরত আলী হতে বর্ণনা করেছেন।১৩২   তিনি বলেছেন, যদি এই কর্ম সঠিক ও বৈধ না হতো তবে সাহাবিগণ,বিশেষত হযরত আলী (আ.) ঐ স্থানে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও কেন নিষেধ করলেন না?১৩৩

হাদীসের দৃষ্টিতে মহানবী (সা.)-এর কবর জিয়ারত

আহলে সুন্নাতের হাদীস গ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন করলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সহীহ্ হাদীস পাওয়া যায় যা রাসূলের কবর জিয়ারত মুস্তাহাব হওয়াকে প্রমাণ করে। এখানে এরূপ কয়েকটি হাদীসের উল্লেখ করছি।

১। দারে কুতনী সহীহ্ সূত্রে আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর হতে বর্ণনা করেছেন যে,মহানবী (সা.) বলেছেন, যে কেউ আমার কবর জিয়ারত করবে তার জন্য শাফায়াত (সুপারিশ) করা আমার জন্য আবশ্যক হবে। ১৩৪

২। দারে কুতনী সহীহ্ সূত্রে রাসূল (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন যে,তিনি বলেছেন, যে কেউ হজ্জ্ব করার পর আমার কবর জিয়ারত করতে আসবে সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করল।১৩৫

৩। বায়হাকী সহীহ্ সূত্রে আনাস ইবনে মালিক হতে বর্ণনা করেছেন,মহানবী (সা.) বলেছেন, যে কেউ দুই হারামে (মক্কা ও মদীনায়) মৃত্যুবরণ করবে সে নিরাপত্তা লাভকারীদের (আল্লাহর আজাব হতে) অন্তর্ভুক্ত হিসেবে কিয়ামত দিবসে পুনরুত্থিত হবে এবং যে কেউ আমাকে ইখলাসের সাথে (নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর উদ্দেশ্যে) জিয়ারত করবে,সে কিয়ামতের দিন আমার সাথে থাকবে। ১৩৬

৪। ইবনে আদী আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর থেকে বর্ণনা করেছেন যে,মহানবী (সা.) বলেছেন, যে কেহ আল্লাহর ঘর (কাবা) জিয়ারত করল ও হজ্জ্ব সম্পাদন করল,কিন্তু আমার কবর জিয়ারত করল না,সে আমার প্রতি অবিচার করল (অর্থাৎ আমার প্রতি দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করল না। ১৩৭

৫। আনাস ইবনে মালিক মহানবী (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন যে,তিনি বলেছেন, যে কেউ আমার মৃত্যুর পর আমাকে জিয়ারত করল সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমাকে জিয়ারত করল। যে কেউ আমার কবর জিয়ারত করল তার শাফায়াত (সুপারিশ) করা আমার জন্য কিয়ামতের দিন অপরিহার্য হয়ে পড়বে এবং কোন স্বচ্ছল ব্যক্তি ও সুস্থ ব্যক্তি আমার কবর জিয়ারত হতে বিরত থাকলে তার জন্য কিয়ামতে কোন ওজরই গৃহীত হবে না।১৩৮


4

5

6

7

8

9

10

11