বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)18%

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 87 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 16704 / ডাউনলোড: 4223
সাইজ সাইজ সাইজ
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

পরিষদ এবং ইমামত ও খেলাফত

কিছু লেখক বলেন : ইমামত ও খেলাফত , কমিশন এবং অধিকাংশের ভোটের মাধ্যমে নির্ধারণ করা সম্ভব। এ ব্যাপারে কোরআনের কয়েকটি আয়াত যেখানে বলা হচ্ছে তোমাদের কার্য ক্ষেত্রে পরামর্শ কর দলিল হিসাবে ব্যবহার করেছে। তারা এরূপ মনে করে যে , নির্বাচন হলো ইসলামের একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি কিন্তু বোঝেনা যে :

১.ইমামত বিষয়টি হলো নবুওয়াতের পরিসমাপ্তির প্রধান ভিত্তি। নবুওয়াত যেমন নির্বাচনের মাধ্যমে হয়না ইমামতও তেমনি একই মর্যাদার অধিকারী এবং তা নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত হতে পারে না।

২.পরামর্শ সেখানে প্রয়োজন যেখানে স্বয়ং আল্লাহ্ এবং রাসূল (সা.)-এর পক্ষ থেকে কোন কর্তব্য নির্ধারিত হয়নি। যেমনটি আমরা লক্ষ্য করেছি যে , রাসূল (সা.) আল্লাহর পক্ষ থেকে স্পষ্ট ভাষায় নিজের উত্তরাধিকারীকে নির্ধারন করেন। এর পর আর কোন পরামর্শ বা পরিষদের কোন ধারণাই অবশিষ্ট থাকে না।

৩.যদি ধরেও নেই যে , এ ব্যাপারে পরামর্শ করা সঠিক , তাহলে রাসূল (সা.) অবশ্যই তার বৈশিষ্ট বর্ণনা করতেন এবং নির্বাচনকারী ও নির্বাচিত ব্যক্তির শর্তসমূহকে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করতেন , যার মাধ্যমে জনগণ যে ব্যাপারটি ইসলামী সমাজের অস্তিত্ব এবং উন্নতির প্রধান ভিত্তি ও দীনের অস্তিত্ব যার উপর নিহিত সে বিষয়ে সচেতন ও হুশিয়ার থাকতে পারত । কিন্তু আমরা দেখি যে , এ বিষয়ে তিনি কিছুই বলেন নি । বরং তার বিপরীত বলেছেন। যখন বনি আমের রাসূল (সা.)-এর কাছে আসল তাদের একজন রাসূলকে বলল :

যদি আমরা আপনার সাথে বাইয়াত করি , যার মাধ্যমে আল্লাহ্ আপনাকে আপনার শত্রুদের উপর বিজয়ী করবেন ; সম্ভব কী আপনার পর খেলাফত আমাদের কাছে থাকবে ? রাসূল (সা.) বললেন :

খেলাফতের বিষয়টি আল্লাহর হাতে , তিনি তা যেখানে ইচ্ছা সেখানে প্রদান করবেন।১৫৯

) الامر الي الله يضعه حيث يشاءُ(

শিয়ারা উপরোক্ত নিদর্শনসমূহের ভিত্তিতেই বিশ্বাস করে যে , রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারীরা , যাদেরকে তিনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন , তাদের সকলেই আল্লাহর মনোনীত। আরও প্রয়োজন মনে করেন যে , সকল বিষয়ে যারা প্রকৃত ও সুরক্ষিত দীনের অধিকারী তাঁদের অনুসরণ করা একান্ত জরুরী। সৌভাগ্যবশতঃ এই বিশ্বাসের ফলেই তারা মাসুম ইমামগণের সান্নিধ্যে জ্ঞান , হাকিকাত এবং ইসলামী হুকুম আহকামের বহু তথ্য একত্রিত করতে সক্ষম হন। যা জীবনের সর্বস্তরের সমস্যার জবাব দিতে পারে। আর এ দৃষ্টিকোণ থেকে শিয়া মাযহাব একটি সম্ভ্রান্ত মাযহাব হিসাবে পরিগণিত।

খেলাফতের ঐতিহাসিক পরিক্রমণের সংক্ষিপ্ত চিত্র

রাসূল (সা.) আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী প্রাপ্ত হয়েছিলেন যে , তাঁর পর আলী ইবনে আবি তালিবকে তাঁর খলিফা এবং উত্তরাধিকারী নির্ধারণ করবেন। আর এ মহান বাণীকে জনগণের নিকট পৌঁছে দিতে আদিষ্ট হন ।

ইসলাম প্রচারের শুরুতেই নিজের আত্মীয়-স্বজনকে একত্রিত করেন এবং বলেন : আলী হচ্ছে আমার ওয়াসী ও উত্তরাধিকারী। সকলের কর্তব্য হলো তাঁর অনুসরণ করা।১৬০

তাবুকের যুদ্ধে যাওয়ার প্রাক্কালে হযরত আলীকে বলেন : তোমার আর আমার সম্পর্ক হারুন এবং মূসার সম্পর্কের অনুরূপ। পার্থক্য হলো আমার পরে আর কোন নবী আসবে না। এটা উত্তম নয় কী যে আমার পর তুমি আমার উত্তরাধিকারী থাকবে।১৬১

জীবনের শেষ বছরে বিদায় হজের পর পথিমধ্যে গাদীরে খুম নামক স্থানে লক্ষাধিক জনতার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন : আমি যার মাওলা আলীও তার মাওলা এবং অভিভাবক।১৬২

অনুরূপ তাঁর শেষ জীবনে জনগণ , সাহাবা এবং বন্ধুদেরকে বলেন : আমি তোমাদের মাঝে দুটি অতি উত্তম ও মূল্যবান বস্তু রেখে যাচ্ছি। একটি আল্লাহর কিতাব অর্থাৎ কোরআন ও অপরটি আমার ইতরাত ও আহলে বাইত। যদি এ দুটিকে দৃঢ় ভাবে আঁকড়ে ধর , তাহলে কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না।১৬৩

তাছাড়া অসংখ্য রেওয়ায়েতের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে , মহানবী (সা.) এ বিষয়টিকে বর্ণনা করেছেন। আর এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন যে ইসলামী বিশ্বের নেতৃত্ব স্বাভাবিক ভাবেই আলী (আ.)-এর উপর ন্যাস্ত হবে। এমনকি এ পর্যন্তই তিনি তুষ্ট থাকেননি। তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলোতে বিভিন্ন প্রকার আকর্ষণীয় কর্মসূচী বাস্তবায়ন করেন যেন যারা ইসলামী খেলাফত লুণ্ঠনের নীল-নকশা এঁটে ছিল তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

উসামার নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনীকে রোমের দিকে প্রেরণ করেন। মদীনার সকল মুহাজির এবং আনসারদেরকে যেমন : আবু বকর , ওমর সকলকেই এ বাহিনীতে অংশ গ্রহণ করার জন্যে এবং মদীনা থেকে বেরিয়ে পড়ার আদেশ দেন। কয়েকবার তিনি এ নির্দেশ দান করেছিলেন। তাদের মধ্যে কেউ ফিরে এলে তিনি পুনরায় তাদেরকে উসামার বাহিনীতে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন।১৬৪

রাসূল (সা.) শুধুমাত্র একারণেই মৃত্যু সজ্জায় উসামার নেতৃত্বে মদীনার বাইরে সেনা বাহিনী পাঠিয়ে ছিলেন যেন মদীনা শহর সকল প্রকার বিরোধী তার উপকরণ থেকে মুক্ত থাকে এবং স্বাভাবিক ভাবেই ইসলামী বিশ্বের নেতৃত্ব আলী (আ.)-এর উপর বর্তায়। আর এ জন্যেও যে সকলেই জানুক ; নেতৃত্বের শর্ত বার্ধক্য নয় বরং যোগ্যতাই হলো এর মূল শর্ত। যেন কেউ আলী (আ.)-এর বয়স কম হওয়াটাকে খেলাফতের মর্যাদার জন্যে অজুহাত হিসাবে ব্যবহার না করে। তাছাড়া অপর একটি কারণ হলো যে , হযরত তাঁর মৃত্যু মুখে কোন প্রকার বিরোধিতা ছাড়াই ওসিয়াত করবেন এবং জনগণের সামনে খেলাফতের লিখিত দলিল রেখে যাবেন।

কিন্তু বিরোধীরা ওসামার বাহিনী থেকে পৃথক হয়ে মদীনায় ফিরে আসে। রাসূল তাঁর অন্তিম মুহূর্তে কিছু সাহাবাদেরকে বললেন : কাগজ কলম নিয়ে এস , আমি তোমাদের জন্য এমন কিছু লিখে যেতে চাই যার প্রতি অটল থাকলে কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না । কিন্তু তারা হৈ চৈ করতে লাগল এবং বলল : এই লোক প্রলাপ বলছে , আল্লাহর কিতাবই আমাদের জন্য যথেষ্ট। আর এ কথা নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দিল।

রাসূল (সা.) এ অন্যায় অভিযোগে খুবই দুঃখিত হন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে , এ পরিস্থিতিতে তার লেখা এ মতভেদকে দূরীভূত করতে পারবে না । এমনকি এ কারণে অনেকে ইসলামের মূলে আঘাত হানতে পারে। এ কারণেই তাদেরকে বললেন : তোমরা এখান থেকে বেরিয়ে যাও।১৬৫

যারা রাসূল (সা.)-কে অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত করেছিল , তারা দীনের পরিমাপক সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল। অথবা না বোঝার ভান করেছিল এবং সত্যকে মাথা পেতে নিতে চায়নি। কেননা প্রত্যেক মুসলমানই জানে যে , আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলকে সকল প্রকার ত্রুটি থেকে রক্ষা করেছেন। কখনোই এ মহান রাসূলকে প্রলাপ বলছে এ অভিযোগে অভিযুক্ত করা উচিত নয়। পবিত্র কোরআন বলছে :

) وما ينطق عن الهوا ان هوالاّ وحي يحي(

রাসূল (সা.) নিজের থেকে কিছুই বলেন না , যতক্ষণ পর্যন্ত না তার প্রতি ওহী অবতীর্ণ করা হয়।

সকীফা , খেলাফত আত্মসাতের স্থান

১১ হিজরীর ২৮ শে সফর মহানবী (সা.) ইন্তেকাল করেন। মদীনা শোকে নিমজ্জিত হয়।

কিছু সংখ্যক মুসলমান , যারা ক্ষমতালোভী এবং পদলোভী ছিল তারা উসামার বাহিনী থেকে ফিরে এসেছিল। আর এরাই মহানবী (সা.)-কে তাঁর অন্তিম ওসিয়ত লিখতে বাধা প্রদান করে। মহানবী (সা.)-এর তিরোধানের পর তারা উত্তম সুযোগ পেয়ে যায় এবং রাসূল (সা.)-এর মৃত দেহ ফেলে রেখে সকীফায়ে বনি সায়েদায় একত্রিত হয়।

আনসাররা তাদের দলপতি সা দ ইবনে আবু ওবাদাকে রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারী হিসাবে নির্বাচন করতে চেয়েছিল। কিন্তু আবু বকর এবং ওমর তার বিরোধিতা করে। আবু বকর তার বক্তব্যে মুহাজিরদের মর্যাদা সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেয় এবং বলে : তারা তোমাদের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছিল এবং তারা রাসূল (সা.)-এর গোত্র (কুরাইশ) হতে। সুতরাং আমির (খলিফা) আমাদের মধ্যে হতে এবং উজির তোমাদের মধ্যে থেকে হবে। অতঃপর মুহাজিরদের মধ্য থেকে একজন বলল : তোমরা তোমাদের মধ্য থেকে একজন আমির নির্বাচন কর আর আমরা আমাদের মধ্য থেকে একজন আমির নির্বাচন করব। আবু বকর আবারো তাদেরকে বুঝালে তারা মেনে নিল যে মুহাজিরদের মধ্য থেকেই আমির নির্বাচিত হবে। অতঃপর তারা মুহাজির ও আনসারদের অনুপস্থিতিতে সকলের সাথে কোনরূপ আলোচনা এবং তাদেরকে এ ঘটনা সম্পর্কে অবগত করা ছাড়াই ইসলামের সর্বে সর্বা হয়ে পড়ে। আবু বকর এবং ওমর একে অপরকে খেলাফত গ্রহণের জন্য অনুরোধ করতে থাকে ; এমতাবস্থায় ওমর আবু বকরের হাতে বাইয়াত করে।১৬৬ ওমরের পর যারা চাচ্ছিল না যে , সা দ ইবনে ওবাদা খলিফা হোক , তারা আবু বকরের হাতে বাইয়াত করে।১৬৭ তারা একটুও চিন্তা করলনা যে , যদি ফজিলতের মানদণ্ড রাসূল (সা.)-এর নৈকট্য এবং তাঁর বংশের থেকে হওয়া , হয়ে থাকে ; তাহলে আবু বকরের চেয়ে রাসূলের নিকটতম ব্যক্তি রয়েছেন , যিনি এ কাজের জন্য সার্বিক ভাবে সকলের চেয়ে উত্তম। আকস্মিক এ নির্বাচনে সা দ ইবনে ওবাদা ও তাঁর সমর্থকরা হেরে যায় এবং আবু বকর ও ওমর জয়ী হয়। আরো কিছু সংখ্যক বিরোধীদেরকে জোর পূর্বক বাইয়াত করতে বাধ্য করে।১৬৮ অতঃপর আবু বকর ওমর এবং তাদের সমর্থকরা সকীফা থেকে বেরিয়ে মসজিদে নববীর দিকে রওনা করে। পথিমধ্যে কাউকে দেখলে তাকে আবু বকরের সাথে বাইয়াত করতে বাধ্য করে।১৬৯

বনি হাশিম এবং মুহাজির ও আনসারদের বিশিষ্ট সাহাবীগণ যেমন : রাসূল (সা.)-এর চাচা আব্বাস , যুবাইর , হাব্বাব ইবনে মুনযার , মেকদাদ , আবু যার গিফারী , সালমান ফারসী , আম্মার ইয়াসির , বারাত ইবনে আযেব , উবাই বিন কাব , উতবা ইবনে আবী লাহাব , খালেদ ইবনে সাঈদ , খুযাইমা ইবনে ছাবিত এবং ফারওয়া ইবনে আমর যারা এ বিষয়ে অবগত ছিলেন না। অকস্মাৎ জানতে পারলেন যে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। ঘটনা জানতে পেরে তাঁরা খুবই আশ্চর্য বোধ করেন১৭০ এবং বাইয়াত করেন নি। তারা চিন্তাও করতে পারেন নি যে , এত বেশি রেওয়ায়েত ও স্বয়ং রাসূল (সা.)-এর মনোনয়ন সত্ত্বেও এত শীঘ্র খেলাফত আত্মস্যাৎ করে ফেলবে এবং রাসূল (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতকে উপেক্ষা করা হবে। সংগত কারণেই সকলে এ অন্যায় এবং ষড়যন্ত্রমূলক বাইয়াতের সরাসরি প্রতিবাদ করেন।

হযরত আলী (আ.)ও আবু বকর ও ওমরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। আবু বকরের সমর্থক আবু উবাইদা বলে , আলী তুমি এখনো যুবক এবং খেলাফতের জন্য যথেষ্ট অভিজ্ঞতা তোমার নেই। এর জবাবে আলী (আ.) বলেন : আল্লাহকে ভয় কর , রাসূল (সা.)-এর ইসলামী হুকুমাতকে তার ঘর থেকে নিজেদের ঘরে নিয়ে যেয়ো না এবং এই মর্যদার প্রকৃত অধিকারী থেকে তা আত্মসাৎ করনা। হে মুহাজিরগণ (ও আনসার) আমরাই (নবী পরিবার) এবং আমরাই এ খেলাফতের জন্য যোগ্যতম।

তবে কি কিতাব যার আয়ত্বে রয়েছে এবং আল্লাহর দীনের যে ফকীহ। আর মুসলমানদের সার্বিক ব্যবস্থপনার যে যোগ্য তিনি আমাদের মধ্য হতে নয় ? আল্লাহর শপথ! এ খেলাফত আমাদের , প্রবৃত্তির পূজারী হয়ো না। কেননা সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে।১৭১

সকীফার ঘটনার পর যখন সর্বসাধারণের কাছে বাইয়াত ঘোষণা করা হয় , আলী (আ.) প্রতিবাদের সুরে ঘর থেকে বাইরে আসেন এবং আবু বকরকে বলেন :

আমাদের ন্যায্য অধিকার থেকে আমাদেরকে বঞ্চিত করেছ এবং পরামর্শ করনি। আর সম্পূর্ণরূপে আমাদের অধিকারকে পদদলিত করেছ। আবু বকর বলল : হ্যাঁ কিন্তু ফেৎনা ও বিশৃঙ্ক্ষলা থেকে ভয় পেয়েছিলাম। এভাবে হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.) যতদিন জীবিত ছিলেন বনি হাশিমের কেউই আবু বকরের নিকট বাইয়াত করেননি।১৭২

রাসূল (সা.)-এর তিরোধানের পূর্বে ও পরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে মানুষের সামনে ষড়যন্ত্রের এক বিকট মূর্তি উপস্থিত হয়। আর এ ষড়যন্ত্রের ভিত্তি ছিল ক্ষমতা লিপ্সা এবং নেতৃত্বের লোভ। যদি তাদের কোন উদ্দেশ্যই (ক্ষমতার লোভ) না থাকবে কেন বনি হাশিম এবং রাসূল (সা.)-এর সম্মানিত সাহাবীদেরকে না জানিয়ে গোপনে সকীফায় গিয়েছিল ? যদি ধরে নেই যে , রাসূল (সা.) কাউকে খলিফা বা উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যাননি ; তাহলে কি ইসলামী বিশ্বের ভাগ্য হযরত আলী (আ.) ও তাঁর সাথিরা যেমন : বনি হাশিম এবং সম্মানিত। সাহাবারা যেমন : সালমান , আবু যার এবং মেকদাদের পরামর্শ ব্যতীতই নির্ধারিত হবে ?

তারা কি হযরত আলীর চেয়ে বড় চিন্তাবিদ ছিলেন ? রাসূল (সা.) কি হযরত আলী সম্পর্কে বলে জাননি যে :

علي مع الحق والحق مع العلي

আলী হকের সাথে আর হক আলীর সাথে। ১৭৩

علي اقضيكم

আলী তোমাদের সবার চেয়ে উত্তম বিচারক ?১৭৪

انا مد ينة العلم وعلي با بها

আমি জ্ঞানের শহর এবং আলী তার দরজা।১৭৫

হযরত আলী (আ.) কী জ্ঞান ও ফজিলতের প্রাণকেন্দ্র ছিলেন না ? তাহলে কেন তাঁর নিকট বাইয়াত করল না , এমনকি এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর সাথে পরামর্শ পর্যন্ত করতে রাজি হলো না।

হযরত আলীর বয়স কম হওয়া কি কোন অজুহাত হতে পারে! রাসূল (সা.) যোগ্যতা ও অগ্রাধিকারের মানদণ্ডকে তাকওয়া নির্ধারণ করেছেন। আর উক্ত কারণেই উসামাকে আবু বকরদের উপর অগ্রাধিকার দিয়েছেন। সুতরাং কেন হযরত আলী অন্যদের উপর প্রাধান্য পাবেন না ?

যারা এই অজুহাতে যে , আলী (আ.) ইসলামের বিভিন্ন যুদ্ধে অগণিত (কাফেরের) রক্ত ঝরিয়েছেন , তারা তাঁর নিকট নতি স্বীকার করেনি এবং তাঁর খেলাফতের অবাধ্যতা করেছে। তারা আলী (আ.) সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর সকল বাণী ও রেওয়ায়েতকে উপেক্ষা করেছে। ইসলামের নিয়ম অনুযায়ী যদি কেউ হকের কাছে নতি স্বীকার না করে তাকে বাধ্য করতে হবে , না কি সে হককে উপেক্ষা করবে!

তা ছাড়াও এ অজুহাতের যদি কোন ভিত্তি থাকত এবং তা যদি ঠিক হতো। তাহলে আল্লাহ তায়ালা হযরত আলী (আ.)-কে মনোনীত করতেন না এবং রাসূল (সা.)ও তাঁকে তাঁর উত্তরাধিকারী নির্ধারণ করতেন না।

একটি প্রশ্ন :

কিছু মুসলমান ভাই যারা ন্যায় সংগত বিচার করেন , তারা বলেন :

গাদীরের ঘটনা এবং অন্যান্য অসংখ্য দলিল প্রমাণ যা হযরত আলীর খেলাফতকে প্রমাণিত করে তা অনস্বীকার্য। কিন্তু কেন রাসূল (সা.)-এর তিরোধানের পর আলী (আ.) তাঁর ন্যায্য অধিকার রক্ষা করলেন না। অথচ তাঁর খেলাফত কালে যারা তাঁর বিরুদ্ধে উত্থান করত এবং তাঁর হুকুমতকে আত্মসাৎ করতে চাইত , তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করতেন।

উত্তর :

হযরত আলী (আ.) আবু বকরের খেলাফতকে অবৈধ মনে করতেন। আর এ কারণেই তার জুমার নামাজে এবং জামাতের নামাজে অংশ গ্রহণ করতেন না। তিনি তাঁর ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে নিতে জনগণের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। এমনকি তিনি হযরত ফাতেমা যাহরাকে নিয়ে রাত্রে আনসারদের বাড়িতে গিয়ে তাদের কাছে সাহায্য চান এবং বলেন : তোমরা আমার অধিকার ফিরিয়ে নিতে সাহায্য কর। আনসাররা জবাব দিল : আমরা আবু বকরের নিকট বাইয়াত করে ফেলেছি , এখন আর কিছু করার নেই যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।১৭৬

এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে , রাসূল (সা.)-এর পর আলী (আ.) সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়ে ছিলেন এবং তাঁর কোন সাহায্যকারী ছিলনা , যাদের মাধ্যমে কিয়াম করবেন। অন্যথায় তিনি তাঁর ন্যায্য অধিকার আদায় করে ইসলামী বিশ্বের নেতৃত্ব দান করতেন। যখন জনগণ ওসমানের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তাকে হত্যা করে এবং হতবুদ্ধি হয়ে আলী (আ.)-এর দিকে বাইয়াতের হাত বাড়িয়ে দেয় , তখন আলী (আ.) বললেন : যেহেতু সাহায্যকারী পেয়েছি ইসলামী হুকুমতকে গ্রহণ করাই প্রয়োজন মনে করছি। সুতরাং ইসলামী সমাজের নেতৃত্বকে হাতে তুলে নেন এবং নেতৃত্বদান করেন।১৭৭

কিন্তু রাসূল (সা.)-এর তিরোধানের পর যখন দেখলেন কোন সাহায্যকারী নেই এবং এ মুহূর্তে কিয়াম করলে অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্য বৃদ্ধি পাবে , যা ইসলামের জন্য কল্যাণকর নয়। কেননা ইসলামের শত্রুরা ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে ওৎ পেতে বসেছিল এবং ইসলাম হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল।

হযরত আলী (আ.) শুধুমাত্র ইসলামের খাতিরে কিয়াম করেননি , কেননা তিনি ইসলামকে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসতেন। তিনি চেয়েছিলেন ইসলাম শিকড় গেড়ে বসুক এবং শাখা-প্রশাখা বিস্তার লাভ করুক ও পুষ্প এবং ফল দান করুক। আলী (আ.) হলেন সেই মহান বীর যিনি সর্বদা রাসূল (সা.)-এর সাথে থেকে ইসলামের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি যুদ্ধ না করাটাকে ইসলামের জন্য কল্যাণকর মনে করেছিলেন এবং সকল তিক্ততায় ধৈর্য্য ধারণ করে ছিলেন।

আলী (আ.) কখনোই নেতৃত্বের লোভ করেন নি। অন্যথায় তিনি যে কোন উপায়ে নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করতে পারতেন। কিন্তু আমরা দেখতে পাই যখন আবু সুফিয়ান হযরত আলীকে বলেছিল : হাত বাড়িয়ে দিন আপনার সাথে বাইয়াত করব , আল্লাহর কসম! যদি চান তাহলে মদীনাকে অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্যে পরিপূর্ণ করে দিতে পারি। আলী (আ.) তা গ্রহণ না করে বললেন : আল্লাহর শপথ! তুমি ইসলামের শুভাকাঙ্ক্ষী নও এবং ফেৎনা ফাসাদ করাই হচ্ছে তোমার একমাত্র লক্ষ্য।১৭৮

এ আলোচনায় মনোনিবেশ করার উদ্দেশ্যে এই যে , আমাদের সুন্নী ভাইয়েরা ইতিহাসের এ মহা সত্যের উপর (যা তাদেরই নির্ভরযোগ্য গ্রন্থসমূহ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে) বেশি বেশি অনুসন্ধান করবেন। যার মাধ্যমে একে অপরের সহযোগিতা এবং সহমর্মিতায় আমরা পূর্বের তিক্ততার ক্ষতিপূরণ করতে পারব এবং নিষ্ঠার সাথে বিশ্বের সকল মুসলমানদের মধ্যে প্রকৃত ঐক্য সৃষ্টির পথে সচেষ্ট হতে পারব।

ولا حولا ولا قوة الا بالله العلي العظيم

বোহাইরার সাথে হযরত মুহাম্মদের সাক্ষাৎ

যখন কোরাইশদের কাফেলা বসরার6 দিকে আসছিল তখন বোহাইরা নামক এক সন্ন্যাসী তার আশ্রম থেকে হঠাৎ দেখতে পেল যে , একটি কাফেলা আসছে যাদের মাথার উপর একখণ্ড মেঘ তাদের উপর ছায়া দিয়ে সাথে আসছে।

বোহাইরা আশ্রম থেকে বের হয়ে আসল এবং এক কোণে দাঁড়িয়ে তার সহযোগীকে বলল : তাদেরকে গিয়ে বল যে , আজ তোমরা আমাদের অতিথি। মুহাম্মদ (সা.) ব্যতীত কাফেলার সকলেই তার নিকট আসল। মুহাম্মদ (সা.) আসবাব পত্রের নিকট দাঁড়িয়েছিলেন। বোহাইরা যখন দেখল যে মেঘখণ্ড যথাস্থানে দাঁড়িয়ে আছে এবং স্থানান্তারিত হচ্ছে না , তখন বলল : তাঁকেও নিয়ে আস। যখন মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে আসা হচ্ছিল , মেঘ খণ্ডও তাঁর সাথে আসছিল। ঐ সন্ন্যাসী তাঁকে আড় চোখে ভাল করে দেখছিল। পানাহারান্তে তাঁকে বলল : আমি কিছু প্রশ্ন করব ? তোমাকে লাত , ওজ্জার7 কসম দিয়ে বলছি , আমার প্রশ্নের জবাব দাও!

মুহাম্মদ (সা.) বললেন : আমার নিকট সবচেয়ে নিকৃষ্টতম নাম হলো এ দুটি নাম যাদের কসম তুমি আমাকে দিয়েছ।

বোহাইরা বলল : তোমাকে আল্লাহর কসম দিচ্ছি , আমার প্রশ্নের জবাব দাও।

মুহাম্মদ (সা.) বললেন : তোমার প্রশ্ন বল! বোহাইরা মহানবীর (সা.) সাথে একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার সম্পন্ন করল। অতঃপর তাঁর হাতে পায়ে চুম্বন দিতে লাগল এবং বলল : যদি তোমার সময়কাল পর্যন্ত বেঁচে থাকি , তবে তোমার সাথে থেকে তোমার শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। তুমি তো বিশ্বমানবতার শ্রেষ্ঠ সন্তান...।

অতঃপর সে জিজ্ঞাসা করল যে , এ কিশোর কার সন্তান ?

কাফেলার লোকজন হযরত আবু তালিবের দিকে ইঙ্গিত করে বলল যে , তাঁর সন্তান। বোহাইরা : না , এ কিশোরের পিতা কখনোই বেঁচে থাকতে পারে না ।

হযরত আবু তালিব : হ্যাঁ , সে আমার ভাইপো। বোহাইরা : এ কিশোরের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল ও গুরুত্বপূর্ণ। আমি যা তার মধ্যে দেখতে পাই , তা যদি ইহুদীরা জানতে পারে , তবে তারা তাঁকে হত্যা করে ফেলবে ; লক্ষ্য রেখ যেন ইহুদীরা তার কোন ক্ষতি না করতে পারে। আবু তালিব : তবে সে কী করবে , আর ইহুদীদেরই বা তার সাথে কী কাজ ?

বোহাইরা : সে ভবিষ্যতে নবী হবে এবং তার নিকট ওহীর ফেরেশতা অবতীর্ণ হবে।

আবু তালিব : মহান আল্লাহ্ তাঁকে নিরাশ্রয় করবেন না (এবং শত্রু ও ইহুদীদের থেকে রক্ষা করবেন)।8

রাখালী ও মহানবী (সা.)-এর চিন্তা-চেতনা

যদিও হযরত আবু তালিব ছিলেন কোরাইশদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি , কিন্তু বিশাল পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করার মত যথেষ্ট সম্পদ তার ছিল না। স্বভাবতঃই বয়োপ্রাপ্ত যুবক হযরত মুহাম্মদ (সা.) কোন কর্মে আত্মনিয়োগ করতে এবং আপন চাচার বিরাট ব্যয়ভার লাঘব করতে চাইলেন। কিন্তু কী ধরনের পেশা তিনি নির্বাচন করবেন , যা তার মন মানসিকতার সাথে অধিক সাযুজ্যপূর্ণ হবে ?

যেহেতু মহানবী (সা.) পরবর্তীতে নবী ও শ্রেষ্ঠ নেতা হবেন এবং বলগাহারা ও গাঁড়া এক সম্প্রদায়ের সম্মুখীন হবেন। আর অন্ধকার যুগের কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাস ও ভ্রান্ত প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হবেন এবং ন্যায়পরায়ণতার সুউচ্চ মিনার ও জীবনের সঠিক নীতির ভিত্তি স্থাপন করবেন সেহেতু রাখালের পেশা গ্রহণ করাটাই অধিক যুক্তিযুক্ত মনে করেছেন।

মুহাম্মদ (সা.) তাঁর আত্মীয় স্বজন ও মক্কাবাসীদের পশু ও মেষ মক্কার আশেপাশের চারণ ভূমিতে নিয়ে যেতেন ও রক্ষণাবেক্ষণ করতেন এবং এ ভাবে যা উপার্জন করতেন , তা দিয়ে হযরত আবু তালিবকে সাহায্য করতেন।9 আর সেই সাথে শহরের কোলাহল ও যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে দূরে মরু প্রান্তরের মুক্ত পরিবেশের অবসরে নানা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন , যেগুলো পরবর্তীতে তাঁর রেসালতের প্রচারকালে সুফল প্রদান করেছিল।

যাহোক , তিনি ইতোমধ্যে দয়া , সৎকর্ম , বদান্যতা , উদারতা , প্রতিবেশী সুলভ আচরণ , সততা , বিশ্বস্ততা এবং কুপ্রবৃত্তি পরিহার ইত্যাদি সকল গুণে মানুষের শীর্ষে অবস্থান করেছিলেন। আর এ কারণেই তিনি মুহাম্মদ আমীন নামে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন।10

মহানবী (সা.)-এর সততা

যখন বয়োপ্রাপ্তির ফলে মানুষের কামনা , বাসনা ও সুপ্ত শক্তির প্রকাশ ঘটে , শিশু কিশোররা তাদের শৈশব ও কৈশর অতিক্রম করে উদ্দাম ও উদ্দীপনাময় যৌবনে পদার্পণ করে এবং নিজেকে অন্য এক জগতে খুঁজে পায় , তখন যৌবনের এ স্পর্শকাতর মুহূর্তে নানা ধরনের বিচ্যুতি , কলুষতা , অন্যায় , অনাচার , অশ্লীলতা উচ্ছৃঙ্খলতা যুবকদেরকে গ্রাস করতে আসে। আর তখন যদি যুবকদের প্রতি সঠিক লক্ষ্য না রাখা হয় কিংবা স্বয়ং যুবকরা যদি তা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা না করে তবে দুর্ভাগ্যের পর্বত পদতলে পতিত হবে যেখান থেকে পুনরায় সৌভাগ্যের রঙিন পাখিকে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীন।

মহানবী (সা.) এমন এক কলুষিত সমাজে জীবন-যাপন করতেন , যার পরিবেশ অসংখ্য চারিত্রিক অনাচার ও পাপাচারে অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল ; যুবকরা এমনকি আরবের বৃদ্ধরাও অশ্লীল ও নির্লজ্জভাবে অসততা ও যৌন অনাচারে নিমগ্ন ছিল। আর এ জন্যে অশ্লীলতার নিদর্শনস্বরূপ অলিতে গলিতে কোন কোন গৃহের উপর কালো পতাকা উত্তোলিত ছিল এবং এ প্রক্রিয়ায় উচ্ছৃলঙ্খল ব্যক্তিদেরকে অন্যায়ের পথে নিমন্ত্রণ জানাত।

মহানবী (সা.) এমন এক কলুষিত সমাজেই শৈশব থেকে যৌবনে পদার্পন বরলেন এবং পঁচিশ বছর বয়স পর্যন্ত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হলেও পরিবেশের প্রভাব তাঁর উপর পতিত হয়নি। কিঞ্চিৎ পরিমান অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মই তাঁকে করতে দেখা যায়নি। বরং শত্রু মিত্র সকলেই তাঁকে শ্রেষ্ঠ ও উত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী বলে আখ্যায়িত করেছিল।

কোরাইশ তনয়ার (হযরত খাদিজা) সাথে মহানবীর দাম্পত্য জীবনের বর্ণনা যেভাবে চিত্রিত হয়েছে তাতে তাঁর শ্রেষ্ঠ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা ফুঁটে উঠেছে। যেমন তাঁর লাজুক প্রকৃতির কথা হযরত খাদিজাকে উদ্দেশ্য করে লেখা কবিতার ভাষায় এ ভাবে বর্ণিত হয়েছে :

হে খাদিজা! তুমি পৃথিবীর মানুষের মাঝে সর্বোত্তম স্থানে পৌঁছেছো ,

আর সকলের চেয়ে সমুন্নত হয়েছো ,

অর্থাৎ তুমি সে মুহাম্মদ (সা.)-এর নৈকট্য লাভ করেছো ,

পৃথিবীর কোন নারী তাঁর মত সন্তান ভূমিষ্ঠ করেনি ; উত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য , মহত্ব ও আত্মসম্মানের মত সকল গুণ তাঁরই মাঝে সমাহার ঘটেছে। আর চিরদিন এরূপই থাকবে।11

অন্য এক কবি তার কবিতায় বলেন : যদি আহমদ (সা.)-এর সাথে সমস্ত সৃষ্টিকেও তুলনা করা হয় , তবে তিনিই হবেন সর্বশ্রেষ্ঠ। প্রকৃতই তাঁর মর্যাদা কোরাইশদের জন্যে স্পষ্ট ও তর্কাতীত ছিল।12

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রথম বিবাহ

যৌবন কাল বিভিন্ন কামনা বাসনা জাগ্রত ও জৈবিক চাহিদার বহিঃপ্রকাশ ঘটার সময়। যখন ছেলে মেয়েরা বয়সের এ বিন্দুতে পৌঁছে , তখন স্বীয় অভ্যন্তরে পরস্পরের প্রতি এক আকর্ষণ উপলব্ধি করে। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ না করবে , ততক্ষণ পর্যন্ত তারা মানসিক প্রশান্তি ও স্থিতি লাভ করতে পারে না এবং তাদের অন্তরে প্রজ্জ্বলিত অগ্নি নির্বাপিত হয় না।

অতএব , ইসলামে সঠিকভাবে এ পারস্পরিক অনুরাগ থেকে লাভবান হওয়ার জন্যে এবং যৌন আনাচার প্রতিরোধ করার জন্যে অতি গুরুত্বের সাথে যুবক-যুবতীকে দ্রুত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার নির্দেশ রয়েছে। সুতরাং ভবিষ্যতে জীবন নির্বাহের খরচের যোগান দিতে পারবে না এ আশঙ্কার অজুহাতে কেউ যেন বিবাহ থেকে দূরে না থাকে।13

কিন্তু কখনো কখনো জীবনব্যবস্থা এতটা প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হয় যে , বিবাহের প্রাথমিক শর্তসমূহ পূরণ ও জীবন নির্বাহের খরচ সংগ্রহ করতে অপারগ বলে মনে হয়। নিঃসন্দেহে এমতাবস্থায় উপযুক্ত পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্যে অপেক্ষা করতে হবে এবং বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া থেকে দূরে থাকতে হবে। আর সেই সাথে নিজেকে পূত পবিত্র রাখতে হবে ।14

মহানবী (সা.)ও 25 বছর কাল15 পর্যন্ত এমনই এক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবাহ করার সামর্থ্য তাঁর ছিল না।

অতএব , বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া থেকে দূরে থাকাটাই শ্রেয় মনে করলেন এবং অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নের জন্যে ও অনুকূল পরিস্থিতির অপেক্ষায় থাকলেন।16

হযরত খাদিজার পরামর্শ

হযরত খাদিজা ছিলেন এক ধণাঢ্য ও সম্মানিতা রমণী। তিনি তার অর্থ সম্পদ ব্যবসার জন্যে অপরের নিকট অর্পণ করতেন এবং এ কাজের বিনিময়ে তাকে পারিশ্রমিক দিতেন।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সত্যবাদিতা , একনিষ্ঠতা , মর্যাদা ও খ্যাতির কথা সমস্ত আরবে ছড়িয়ে পড়েছিল। আর এভাবে তা হযরত খাদিজার কর্ণগোচর হলে তিনি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে ব্যবসা করার চিন্তা করলেন। তিনি এ বিষয়টি মহানবীর নিকট উপস্থাপন করলেন এবং প্রস্তাব দিলেন : কিছু সম্পদ এক গোলামসহ (যার নাম মাইসারাহ বলা হয়) আপনার নিকট অর্পণ করা হবে এবং অন্যদেরকে যা পরিশোধ করা হতো তার চেয়ে অধিক আপনাকে পরিশোধ করব।

হযরত মুহাম্মদ (সা.) হযরত আবু তালিবের অবস্থা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি জানতেন যে , বার্ধক্যের কারণে বিশাল পরিবারের ভার বহন করার মত সন্তোষজনক অর্থনৈতিক অবস্থা তাঁর চাচার ছিলনা। ফলে তিনি হযরত খাদিজার প্রস্তাব গ্রহণ করলেন।17

খাদিজা কে ?

খাদিজা ছিলেন খুয়াইলিদের কন্যা , অনন্য ব্যক্তিত্ব সম্পন্না এক রমনী। তিনি রাসূলের পূর্বে দু বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর পূর্ববর্তী দু স্বামী ছিলেন মৃত আবু হালা আতিক মাখযুমী

খাদিজা তাঁর জীবনের চল্লিশ বছর অতিক্রম করলে ও তাঁর অঢেল সম্পত্তি ও জনপ্রিয়তার কারণে কোরাইশ পতিদের মধ্যে ও তদানিন্তন সময়ের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে অনেকেই তাঁর পাণি প্রার্থনা করত।

কিন্তু হযরত খাদিজা তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং বিবাহ করেন নি। কারণ তিনি জানতেন যে , হয় তারা জীবন সঙ্গী হওয়ার যোগ্যতা রাখেনা অথবা তাঁর সম্পদের লোভে তার পাণি প্রার্থনা করছে।18

শামের পথে যাত্রা

যখন কোরাইশের বাণিজ্য কাফেলা শামের পথে যাত্রা করার জন্যে প্রস্তুতি নিল এবং মহানবী (সা.)ও তাঁর সফরের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন , তখন হযরত খাদিজা তাঁর গোলাম মাইসারাকে নির্দেশ দিলেন : তুমিও মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে তাঁর খেদমতের জন্যে শামে যাও! যদিও এ ঐতিহাসিক সফরের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া এ পুস্তিকার ক্ষুদ্র পরিসরে সম্ভব নয় তথাপি এতটুকু বলা যায় যে , এ সফর ছিল অতি বরকতময় ও কল্যাণময়। এগুলোর মধ্যে ব্যবসায় প্রচুর লাভবান হওয়া , কাফেলার জন্যে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অনন্য ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটা , খ্রিস্টান পাদ্রীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ও তাঁর নবুওয়াত লাভ সম্পর্কে তার (খ্রিস্টান পাদ্রীর) ভবিষ্যদ্বাণী19 এবং এক বরকতময় দাম্পত্যজীবনের পূর্ব প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়া ইত্যাদির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

এ সফর কিছু দিন পর সম্পন্ন হলে কাফেলা শাম থেকে ফিরে আসল। মাইসারাহ এ সফরের বিভিন্ন খুঁটিনাটি দিক , তাদের অভূতপূর্ব লাভের কথা এবং এ সফরে প্রকাশিত মহানবীর মহত্ব ও বিভিন্ন কারামতের কথা কোরাইশের নন্দিতা রমণী হযরত খাদিজার কর্ণগোচর করল।20

হযরত খাদিজা এক ইহুদী আলেমের কাছ থেকে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ঐশী ব্যক্তিত্বের ও কোরাইশের অন্যতম রমণীর (খাদিজা) সাথে তাঁর বিবাহ বন্ধনে অবদ্ধ হওয়ার কথা শুনেছিল। আর এখন তার গোলামের নিকট এ সমুদয় সংবাদ শুনে শুধু যে হযরতের প্রতি প্রেমাসক্তি তাঁর হৃদয়ে লালন করতে লাগলেন , তা নয় ; বরং তাঁকে তাঁর আদর্শ স্বামী হিসাবে মনে করতে লাগলেন।21

অনুরূপ তাঁর চাচা ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের নিকট তিনি পূর্ববর্তী নবীগণের (আ.) ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আবির্ভাবের সুসংবাদ ও খাদিজা নামক রমণীর সাথে তাঁর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কথা শুনে ছিলেন।22 ফলে তাঁর আকর্ষণ আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল।

কিন্তু কিরূপে তাঁকে এ কথা জানানো যেতে পারে ? এ কর্মটি স্বয়ং তাঁর জন্যে যিনি কোরাইশের অনন্য ব্যক্তিত্ব সম্পন্না রমণী ছিলেন , সহজ ছিল না।

বিবাহের প্রস্তাব

হযরত খাদিজা তাঁর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী নাফিসার নিকট চেয়েছিলেন , সে যেন এ ব্যাপারে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে আলোচনা করে। নাফিসা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নিকট গেলেন এবং বললেন : কেন বিয়ে করছেন না ? তিনি জবাবে বললেন : আমার আর্থিক অবস্থা ও ব্যক্তিগত অবস্থা আমাকে অনুমতি দেয় না। নাফিসা বললেন : যদি এ সমস্যা দূরীভূত হয় এবং সুন্দরী , ধনবতী , সম্মানিতা ও খ্যাতিমান পরিবারের কোন কন্যা আপনার জন্যে পাওয়া যায় , তবে আপনি কি তা গ্রহণ করবেন ?

হযরত মুহাম্মদ (সা.) বললেন : এ রমণী কে , যার কথা তুমি বলছ ?

নাফিসা বলল : খাদিজা।

হযরত বললেন : এটা কিরূপে সম্ভব যে সে কোরাইশের ধনিক ও বণিক শ্রেণীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে , অথচ আমার সঙ্গে বিবাহে রাজি হবে ?!

নাফিসা বলল : হ্যাঁ , এটা সম্ভব এবং আমি তা সম্পন্ন করব।23

যখন মহানবী (সা.) পূর্ণ আস্থা স্থাপন করতে পারলেন যে , খাদিজা তাঁর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে ইচ্ছুক , তখন তিনি একথা তাঁর চাচাদের কাছে জানালেন।

তারা এ শুভসংবাদ শুনে খুবই আনন্দিত হলেন এবং অনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। অবশেষে বিশেষ বিবাহ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহ কার্য সম্পন্ন করেন।24

খাদিজা ছিলেন প্রথম নারী , যিনি মহানবী (সা.)-এর উপর ঈমান এনেছিলেন এবং তাঁর সকল সম্পদ ইসলামের প্রচারের জন্যে রাসূল (সা.)-এর হাতে অর্পণ করেন।25 মুহাম্মদ (সা.)-এর এ দাম্পত্য জীবনেই ছয়টি সন্তান লাভ করেছিলেন : কাসিম ও তাহির নামে দু পুত্র যারা শৈশবেই মৃত্যু বরণ করেন এবং রুকাইয়্যা , যয়নাব , উম্মে কুলসুম ও ফাতেমা (আ.) নামক চার কন্যা। তাদের মধ্যে হয়রত ফাতেমা (সা.) ছিলেন অন্যতম।26 খাদিজা হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর দীনের জন্যে যে ধৈর্য্য ও ত্যাগ-তিতীক্ষা প্রদর্শন করেছিলেন , তা তাঁর জীবদ্দশায়ই কেবলমাত্র হযরতের জন্যে হৃদয় গ্রাহী ছিল না , বরং তাঁর (খাদিজার) মৃত্যুর পরও যখন তাঁর কথা স্মরণ করতেন , হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে পড়তেন।27 কখনো কখনো তাঁর বিয়োগ বেদনায় অশ্রু বিসর্জন দিতেন...।

যাহোক , খাদিজার জীবনের সূর্য 65 বছর বয়সে অর্থাৎ নবুওয়াতের দশম বছরে অস্তমিত হয়েছিল। আর সেই সাথে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর গৃহে চিরদিনের জন্যে খাদিজার দ্যুতি নিভে গেল।

মহানবী (সা.)-এর একাধিক বিয়ের দর্শন ও খ্রিস্টানগণ কর্তৃক অপবাদ দানের কয়েকটি উদাহরণ :

খ্রিস্টানগণ কর্তৃক অপবাদ প্রদানের কয়েকটি দৃষ্টান্ত

অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে খ্রিস্টবাদী লেখকরা ইসলামের বিরুদ্ধে নতুন সংগ্রাম শুরু করেছিল। তারা মিথ্যা ও হঠকারিতায় পূর্ণ পুস্তকসমূহ প্রকাশ করে ইসলাম ধর্মের প্রতি মানুষের আকর্ষণ নষ্ট করতে এবং ইসলামের মহান প্রবর্তক হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি মানুষের অন্তরে বিষেদাগার করতে চেয়েছিল।28

এ কল্পকাহিনীসমূহ এবং খ্রিস্টানদের বিভিন্ন গোঁড়ামীপূর্ণ গল্প কাহিনীর প্রথম সূতিকাগার ছিল মধ্যযুগ , বিশেষ করে পঞ্চদশ শতাব্দীতে। জন অ্যান্ডার মূর ( J.A. Mure ) নামক এক ব্যক্তি মুহাম্মদের দীনের অসারতা নামক একটি পুস্তক লিখেছিল যা পরবর্তী ইসলাম বিদ্বেষী লেখকদের খোরাক যুগিয়েছিল। আর যেহেতু অন্যান্য লেখক আরবী ভাষা জানত না এবং ইসলামের উৎসসমূহ তাদের নাগালে ছিল না সেহেতু ইসলাম পরিচিতির ক্ষেত্রে তারা মূরের পুস্তক নকল বা তার সিদ্ধান্তেই তুষ্ট থেকেছিল।29

হ্যাঁ , যাদের তথাকথিত পবিত্র গ্রন্থে প্রকাশ্যে নবী (আ.) গণের উপর যৌন অনাচারের অপবাদ দেয়30 তারাই আবার আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সম্পর্কে লিখে যে , তিনি কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করেছিলেন। অর্থাৎ যেখানে তিনি তাঁর অনুসারীদেরকে কেবলমাত্র চারজন স্ত্রী রাখার অধিকার দিয়েছেন অথচ স্বয়ং তিনি একাধিক (চারের অধিক) স্ত্রীর অধিকারী ছিলেন ?!31

তারা তাদের স্থূল চিন্তায় অজ্ঞ খ্রিস্টবাদী গায়কের ভাষায় হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে কুপ্রবৃত্তির অনুসারী বলে পরিচয় করাতে চেয়েছিল , যাতে এর মাধ্যমে তার ব্যক্তিত্বহানি করতে পারে এবং ইসলামের প্রচার ও প্রসার রোধ করতে পারে।

কিন্তু তাদের এহেন অপচেষ্টা অপরাপর প্রচেষ্টার মতই অসার ও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। কারণ ন্যায়পরায়ণ খ্রিস্টীয় পণ্ডিতগণ মহানবী (সা.)-এর স্বপক্ষে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন এবং কোরআন ও হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উপর যে মানহানিকর আক্রমণ চালানো হয়েছিল তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন।

নিঃসন্দেহে এ ধরনের বানোয়াট বক্তব্য আমরা যারা নবিগণের (আ.) পবিত্রতায় বিশ্বাস করি , তাদের নিকট অবাঞ্ছিত বৈ কিছু নয়। কিন্তু যারা আমাদের এ বিশ্বাসের সাথে একমত নয় তাদের জন্যে প্রকৃত সত্য উদঘাটিত হওয়া প্রয়োজন।

ইতিহাসের বিচার

সত্যনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ ইতিহাসবেত্তাগণ , কি মুসলমান কি খ্রিস্টান তাদের গ্রন্থসমূহে লিখেছেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর বিবাহসমূহ কোন কামনার ফল ছিল না। কারণ , যদি তাই হতো , তবে 25 বছর বয়সে যখন যৌবনের উত্তাল ও উদ্দম যুবকদেরকে ষোড়শী যুবতী স্ত্রী ব্যতীত অন্য কোন চিন্তা আবিষ্ট করতে পারেনা , তখন তিনি 40 বছর বয়সের প্রৌঢ়া নারী হযরত খাদিজার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতেন না , যিনি ইতোপূর্বে ও দু জন স্বামীর সংসার করেছিলেন।

মুহাম্মদ (সা.) হযরত খাদিজার সাথে 25 বছর32 বয়স পর্যন্ত আন্তরিকতা ও আনন্দের সাথে জীবন যাপন করেছিলেন এবং যদিও আরবের কুমারী , যুবতীরা তাঁর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্যে আগ্রাহান্বিত ছিল , কিন্তু তিনি একবারের জন্যেও অন্য কোন কুমারী রমণী বিবাহ করেন নি।

নিঃসন্দেহে যদি মহানবী (সা.) কোন কামাতুর ব্যক্তি হতেন , তবে অবশ্যই এ সুদীর্ঘ সময় ধরে কুমারী ও যুবতী নারীর পাণি গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে পারতেন না।

ছিদ্রান্বেষীদের নিকট প্রশ্ন

যদি কেউ বর্ণিত ব্যক্তিদের নিকট জিজ্ঞাসা করে : কি কারণে মহানবী (সা.) যৌবনের শুরুতে এক প্রৌঢ়া স্ত্রীর সাথে সংসার করেছিলেন এবং অন্য কোন স্ত্রী গ্রহণ করেন নি , অথচ জীবনের শেষ দশ বছরে যখন তার বার্ধক্য ঘনিয়ে এসেছিল , এছাড়া অভ্যন্তরীন ও বহিঃ রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভারসাম্য রক্ষাকরণ ইত্যাদি তাঁর বিবাহের জন্যে অনুকূল ছিল না , তখন তিনি একাধিক বিবাহ করেন ?

অনাথ ও সর্বস্বহারা নারীদেরকে ভরণ পোষণ দেয়া কি স্বয়ং এক কঠিন কাজ নয় ? বিচিত্র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও মনমানসিকতার অধিকারী স্ত্রীদের সাথে জীবন যাপন করা কি আরাম-আয়েশের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ ? 50 বছরের একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্যে একজন যবুতী স্ত্রী , যে ব্যক্তির মর্যাদা ও স্থান সম্পর্কে অজ্ঞ তার সাথে জীবন যাপন করা কি কোন সহজ ব্যাপার ?33

নিঃসন্দেহে ছিদ্রান্বেষীদের নিকট এর কোন জবাব নেই। সঙ্গত কারণেই তাদেরকে স্বীকার করতে হবে যে , হযরত মুহাম্মদ (সা.) কখনোই কামাতুর ছিলেন না এবং তারা হিংসা ও বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে মহানবীর উপর এ ধরনের অপবাদ প্রদান করেছিল। আর এটা কতই না অন্যায় ও হীন কর্ম!

জন ডেভেন পোর্ট বলেন : এটা কি করে সম্ভব , যে ব্যক্তি এতটা কামাতুর সে এমন এক দেশে যেখানে একাধিক স্ত্রী থাকাটা এক সাধারণ নিয়ম বলে পরিগণিত হতো , সেখানে থেকে 25 বছর ধরে মাত্র একজন স্ত্রী নিয়েই তুষ্ট ছিলেন ?34


3

4

5

6

7

8

9

10

11