বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)18%

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 87 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 16610 / ডাউনলোড: 4199
সাইজ সাইজ সাইজ
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

রাসূল (সা.)-এর স্ত্রীর সংখ্যা

ইসলামের নবী (সা.) খাদিজার পর একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করেছিলেন। তাদের মধ্যে সাওদা , আয়েশা , গাজিয়া , হাফসাহ , উম্মে হাবিবা , উম্মে সালামাহ , যয়নাব বিনতে যাহেশ , যয়নাব বিনতে খুযাইমাহ , মাইমুনাহ , জুয়াইরিয়াহ , সাফিয়াহ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।

এখন যে পরিস্থিতিতে মহানবী (সা.)-কে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করতে হয়েছে , সে সম্পর্কে আলোচনা করা প্রয়োজন মনে করছি।

মূলতঃ কয়েকটি উদ্দেশ্যে মহানবী (সা.) একাধিক বিয়ে করেছিলেন:

১.অনাথ ও অসহায়ের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের আত্মসম্মান রক্ষা করার জন্যে , যারা ইতোপূর্বে সম্মান ও প্রতিপত্তির সাথে জীবন যাপন করতেন , কিন্তু স্বীয় অভিভাবককে হারানোর ফলে তাদের সম্মান প্রতিপত্তি এখন বিপর্যস্ত , মহানবী (সা.) তাদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। নতুবা তাদের গোত্র তাদেরকে ফিরিয়ে নিত এবং তাদেরকে কুফর করতে ও ইসলামের অস্বীকৃতিতে বাধ্য করত। যেমন : সাত্তদা , যার স্বামী হাবাশায় (ইথিওপিয়া) হিজরত করার পর পরলোক গমন করেছিলেন। ফলে তিনি অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছিলেন।

রাসূল (সা.) খাদিজাকে হারানোর পর বিপত্নীক ছিলেন এবং সাওদার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন।

যয়নাব বিনতে খুযাইমা ছিলেন রাসূলের অপর এক স্ত্রী। তিনি এক বিধবা রমণী ছিলেন যিনি স্বামীর মৃত্যুর পর একদিকে অভিবাবকহীন এবং অপরদিকে দারিদ্রকবলিত হয়ে পড়েছিলেন। অথচ তিনি ছিলেন দানশীলা , উদার এবং উম্মুল মাসাকীন (নিঃস্বদের মাতা) আল্লাহর রাসূল (সা.) যয়নাবের সম্মান রক্ষার্থে তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। যয়নাব বিনতে খুযাইমা রাসূলের জীবদ্দশায়ই পরলোক গমন করেন।

উম্মে সালমাও ছিলেন বয়স্কা ও অনাথ সন্তানের মাতা , ঈমানদার। তিনিও নবী (সা.)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন।

২.প্রচলিত অবস্থার পরিবর্তন ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের ভ্রান্ত রীতি-নীতির প্রাচীর চূর্ণ করে দেয়ার জন্যে তাঁর ফুফাত বোন যয়নাব বিনতে জাহাশের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন , যিনি রাসূলের পালক পুত্র যায়েদ ইবনে হারিসের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। যায়েদের সাথে যয়নাবের যে বিবাহ মহানবী (সা.)-এর নির্দেশানুসারে সম্পন্ন হয়েছিল তা স্বয়ং ইসলামের শ্রেণী বৈষম্যহীন বিশেষত্বেরই দৃষ্টান্ত। কারণ , যয়নাব ছিলেন কোরাইশ অধিপতি আবদুল মুত্তালিবের দৌহিত্রাদের মধ্যে একজন , আর যায়িদ ছিল পারিবারিক দিক থেকে কৃতদাস , যিনি রাসূল (সা.)-এর নির্দেশে মুক্তি পেয়েছিলেন।

যয়নাব যেহেতু অভিজাত পরিবারের ছিলেন , সেহেতু যায়েদের সাথে দাম্ভিকতাপূর্ণ আচরণ করত ; আর এভাবে নিজের দাম্পত্য জীবনে তিক্ততা সৃষ্টি করত এবং রাসূল (সা.) তাদেরকে শতভাবে উপদেশ দিলেও তাতে কোন ফল হয়নি। অবশেষে যায়েদ যয়নাবের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে পড়েছিল এবং তাকে তালাক দিয়েছিল।

যয়নাব তালাকপ্রাপ্তা হওয়ার পর মহানবী (সা.) মহান আল্লাহর আদেশে তাকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন , যাতে মানুষের মধ্যে প্রচলিত কুসংস্কার ও অযৌক্তিক রীতি-নীতির মূলোৎপাটিত হয়। (যেহেতু তারা পালক পূত্রকে স্বীয় প্রকৃত পুত্র বলে মনে করত এবং তার স্ত্রীকে নিজের জন্যে নিষিদ্ধ মনে করত)।৩৫

খ্রিস্টবাদী কিছু লেখক এ বিষয়টির ক্ষেত্রে (হযরতের একাধিক বিবাহ) এতটা বিচ্যুত ও কুরটনাকারী হয়েছিল যে লিখেছিল : আল্লাহর রাসূল যয়নাবের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়েছিলেন! এ বক্তব্যটি এতটা অনর্থক ও অযৌক্তিক যে তা সমস্ত নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক যুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তির পরিপন্থী। কারণ যদি নবী (সা.) কুমন্ত্রনা ও এ ধরনের ধ্যান- ধারণার বশবর্তী হতেন কিংবা যয়নাবের রূপ সৌন্দর্য এতটা মনোহারী ছিল যে , হযরতকে প্রেমাসক্ত করে ফেলেছিল যদি তাই হতো , তবে কেন যখন যয়নাব কুমারী ও বিশেষ আকর্ষণের অধিকারী ছিল আর রাসূলও (সা.) উদ্দাম যৌবনের অধিকারী ছিলেন , তখন কেন তার প্রতি আসক্ত হলেন না ; বিশেষ করে এ দৃষ্টিকোণ থেকে যে যয়নাব তো তখনও তার নিকট অপরিচিত ছিল না ? বরং রাসূলের নিকটাত্মীয়দের মধ্যেই তিনি পরিগণিত হতেন এবং পারিবারিক পরিচিতের মাধ্যমে তারা পরস্পরের সুন্দর বা কুৎসিত হওয়া সম্পর্কে অবগত ছিলেন।

৩.বন্দী ও দাসত্ব থেকে মানুষকে মুক্তি দেয়ার জন্যে ; যেমন , জুয়াইরিয়াকে তিনি বিয়ে করেছিলেন। জুয়াইরিয়া ছিলেন সম্ভ্রান্ত বনি মুসতালিক গোত্রের কন্যা , যিনি ইসলামী বাহিনীর সাথে যুদ্ধে পরাস্ত ও বন্দী হয়েছিলেন। মহানবী (সা.) হারেসের কন্যা জুবাইরিয়ার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। হারেস ছিলেন গোত্রপতি। মুসলমানরা যখন দেখল যে , বন্দীরা হযরতের আত্মীয়দের অন্তর্ভূক্ত হয়েছে , তখন তাদের (বন্দীদের) অনেককেই মুক্তি দিয়েছিলেন। ইবনে হিশামের মতে এ বিবাহের সুবাদে বনি মুসতালিকের একশতটি পরিবার মুক্তি পেয়েছিল।৩৬

৪.আরবের বৃহত্তর গোত্রের সাথে সম্পর্ক স্থাপন ও তাদের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে এবং অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সংরক্ষণ করার জন্যে নবী (সা.) আয়েশা , হাফসা , উম্মে হাবিবা , সাফিয়া ও মাইমূনার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন।

উম্মে হাবিবা ছিলেন সেই আবু সুফিয়ানের কন্যা যার বংশ (ইসলামের) রেসালতের ধারক সম্মানিত (হাশেমী) পরিবারের সাথে আপোসহীন শত্রুতা প্রদর্শন করত। তার স্বামী হাবাশে ইসলাম ত্যাগ করে খ্রিস্টান হয়েছিল এবং অতঃপর পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছিল। উম্মে হাবিবা কঠিন সঙ্কটময় অবস্থায় দিনাতিপাত করছিলেন। কারণ তিনি ছিলেন মুসলমান ; অপর দিকে তার পিতা ছিল নবী (সা.)-এর ঘোর শত্রু । ফলে তিনি তার পিতা (আবু সুফিয়ানের) নিকট আশ্রয় নিতে পারছিলেন না। সুতরাং উম্মে হাবিবা অভিভাবকহীন ও বঞ্চিত নারীদের অন্তর্ভূক্ত হয়েছিলেন।

মহানবী (সা.) বনি উমাইয়্যাদের অন্তর জয় করার জন্যে এবং সেই সাথে উম্মে হাবিবার অভিভাবকত্ব গ্রহণের জন্যে তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন।৩৭

সাফিয়া ছিলেন হাই ইবনে আখতাবের কন্যা , যিনি বনি নাযির গোত্রের প্রধান ছিলেন। ইহুদী বন্দীরা মুসলমানদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যাওয়ার পর হযরত (সা.) সাফিয়ার ব্যক্তিত্ব রক্ষা করার জন্যে তার সাথে বিবাহ বন্ধনে অবদ্ধ হলেন। আর এ প্রক্রিয়ায় বনি ইসরাইলের একটি শ্রেষ্ঠ গোত্রের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন।৩৮

বৃহত্তর গোত্র বনি মাখযুমের রমণী ছিলেন মায়মূনা , যাকে মহানবী (সা.) সপ্তম হিজরীতে বিবাহ সম্পন্ন করেন।৩৯

নবী (সা.)-এর স্ত্রীগণের মধ্যে আয়েশা ব্যতীত রাসূল (সা.)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সময় সকলেই বিধবা ছিলেন এবং তাদের মধ্যে অনেকেই যৌবনের উচ্ছলতা ও অভিলাষ হারিয়ে ছিলেন। আর এটাই এর সপক্ষে শ্রেষ্ঠ দলিল যে , রাসূল (সা.)-এর একাধিক বিবাহ বৃহত্তর কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে সম্পন্ন হয়েছিল। সুতরাং রাসূলের প্রতি কুমন্ত্রণা ইত্যাদির অপবাদ প্রদান কখনোই যৌক্তিক হতে পারে না।

নবুওয়াত লাভের পূর্বে মহানবী (সা.)-এর ব্যক্তিত্ব

পারিপার্শ্বিকতার নীতি

মনোবিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে , পরিবেশ , কোন ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের ও চিন্তা-চেতনার ভিত্তি রচনা করে এবং পারস্পরিক সামঞ্জস্য বিধান ও অনুরূপ হওয়ার নীতি অনুসরণ তারা সামাজিক রীতি প্রথার পশ্চাদ্ধাবন করে।

যদিও এ ব্যাপারে একদল চরমপন্থা অবলম্বন করেছেন এবং এ মতবাদকে একটি সার্বিক ও সর্বজনীন নীতি বলে মনে করেছেন। তারা সকল সামাজিক বিষয় ও ঘটনাকে কোন প্রকার ব্যতিক্রম ব্যতীতই এ নীতির মাধ্যমে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে প্রয়াসী হয়েছেন। তবে ব্যক্তির মন মানসিকতার উপর পরিবেশের প্রভাব অনস্বীকার্য।

অতএব , কল্যাণময় ও সংযমী পরিবেশ , সমাজের সন্তানদেরকে সংযমী ও সুশৃঙ্খল রূপে গড়ে তোলে। অপরদিকে বিচ্যুত ও কলুষিত পরিবেশ কোন না কোন ভাবে ব্যক্তিকে বিচ্যুতি ও অনাচারের দিকে ঠেলে দেয়। অতএব , যিনি স্বীয় পথকে কলুষিত পরিবেশ থেকে পৃথক করে থাকেন , নিঃসন্দেহে তিনি কোন সাধারণ ব্যক্তিত্ব নন।

ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরবের পরিবেশ

পৃথিবী , বিশেষ করে আরবভূমি তখন অজ্ঞতা ও অন্যায়ের সমুদ্রে নিমজ্জিত ছিল এবং আরবের জনগণ কুসংস্কার ও অনাচারের আগুনে জ্বলছিল। অজ্ঞতার কৃষ্ণকায় মেঘগুলো আরববাসীর জীবন-দিগন্তকে অন্ধকারে ঢেকে ফেলেছিল এবং তারা অন্ধকারের ঘনঘটায় জীবনাতিবাহিত করছিল। কতইনা সম্পদ লুটতরাজ হতো , কতইনা রক্ত অন্যায় ভাবে ঝরত।

নিকৃষ্টতম ব্যাপার ছিল , প্রাণহীন মূর্তিসমূহের উপাসনা। কুসংস্কার ও শ্রেণী বৈষম্য সমাজকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছিল। যার অস্তিত্ব সেথায় ছিলনা তা হলো ন্যায়পরায়ণতা ও নিয়ম শৃঙ্খলা । নিষ্ঠুর শক্তিধররা অন্যের শ্রম এবং বিধবা ও অনাথের ঘামের বিনিময়ে স্বীয় ধন সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলত। আর আত্মম্ভরিতা ও দাম্ভিকতা প্রদর্শন করত এবং খেঁটে খাওয়া মানুষের উপর আগ্রাসন ও নিপীড়ন চালাত।

তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যনীতি এতটা খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছিল যে , অক্ষম স্বামীর ঋণের মোকাবিলায় তারা স্ত্রীকে দায়ী মনে করতো ; আর যদি অক্ষম , অপারগ কোন স্ত্রীর নিকট ঋণ থাকত তবে তার জন্যে তার স্বামীকে গ্রেফতার করত।৪০

উৎকর্ষ ও জ্ঞানার্জনের কোন উদ্যোগ তাদের ছিলই না , বরং এর পরিবর্তে তাদের পূর্বপুরুষ ও লোক জনের সংখ্যাধিক্যের জন্যে অহঙ্কার করত । কখনো কখনো কোন গোত্রের জনবলের আধিক্য প্রমাণ করার জন্যে তারা গোরস্থানে যেয়ে কবরের সংখ্যা গণনা করে তাদের সংখ্যাধিক্য দেখাত।৪১

হিংসা বিদ্বেষ , কাম-ক্রোধ , মদ্যপান , রক্তারক্তি ছিল তাদের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা।

ইমরুল কাইস নামক এক বিখ্যাত আরব কবি , তার চাচাত বোন উনাইযার সাথে শয়তানী ও উন্মাদ প্রেম ঘটিত ঘটনাবহুল অতীত সম্পর্কে নির্লজ্জ ভাবে তার কবিতায় বর্ণনা করেছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এ কাব্যসমূহই সাহিত্য কর্মের নিদর্শন স্বরূপ কাবা ঘরের দেয়ালে টানানো হয়েছিল।

এটাই ছিল সে সমাজের জনজীবন ও আচার ব্যবহারের চিত্র , যে সমাজের অন্ধকারময় দিগন্ত থেকে ইসলামের জ্যোতি আত্মপ্রকাশ করেছিল।

নিঃসন্দেহে যিনি এহেন সমাজের রঙে রঞ্জিত না হয়ে , বরং এতে অস্বস্থি বোধ করতেন এবং এর বিরোধিতায় রত হতেন , তিনি এক মহান ও ঐশী ব্যক্তিত্বের অধিকারী। আর তিনিই জাতির নেতৃত্বের জন্যে এবং বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে মুক্তি দানের জন্যে সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত।

নবীগণ (আ.) সমাজ গঠন করতেন , সমাজের অনুসরণ করতেন না

সকলেই মূর্তিনগরের দিকে ধাবিত হতো ; কিন্তু মহানবী (সা.) কারো কাছে শিক্ষা গ্রহণ না করলেও৪২ হেরা পর্বতের পথ বেছে নিয়েছিলেন। সেথায় , শক্তি ও মর্যাদার অধিকারী বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর সম্মুখে সিজদাবনত হয়ে তাঁরই উপাসনায় আত্মনিয়োগ করতেন।৪৩

হযরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর করুণার ছোঁয়ায় শৈশব থেকেই তাঁর পথ (সঠিকরূপে) নির্বাচন করে নিয়েছিলেন এবং কোন প্রকার উৎকন্ঠা ও সন্দেহ ব্যতীতই স্বীয় গোত্রের ভ্রান্ত রীতিনীতি পরিহার করে চলতেন এবং এর বিপরীতে অবস্থান নিয়েছিলেন।৪৪

তিনি তাঁর জীবনের কোন মুহূর্তেই মূর্তি পূজা করেন নি , এমনকি ঐগুলোর নাম শুনতেও অনীহা প্রকাশ করতেন। যেমনটি ইতোপূর্বেও আমরা উল্লেখ করেছিলাম।

যখন হযরত মাত্র ১২ বছরের বালক ছিলেন এবং বোহাইরা তাঁকে দুটি কুখ্যাত মূর্তি লাত ও ওজ্জার কসম দিয়েছিল তখন তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন এবং সক্রোধে বলেছিলেন : আমি কোন কিছুকেই এ দুটির মত শত্রু মনে করি না।

তাঁর সততা ও মহত্বের খ্যাতি ছিল লোকের মুখে মুখে ; তাঁর আচার , ব্যবহার ও বিশ্বস্ততার কারণে তিনি আল আমীন উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। তাঁর এহেন কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্যের কারণেই , খাদিজা তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্য তাঁর উপর ন্যস্ত করেছিলেন।

মহানবী (সা.)-এর আচার-আচরণ এতই মনোমুকর ও সমুন্নত ছিল যে , তা সকল মানুষকে তাঁর দিকে আকর্ষণ করত।

আম্মার বলেন : নবুয়াতের পূর্বে আমি ও মুহাম্মদ (সা.) রাখালী করতাম। একদিন আমি প্রস্তাব দিলাম যে , ফাখের চারণ ভূমিতে গেলে ভাল হয়। মুহাম্মদ (সা.) আমার প্রস্তাবে সাড়া দিলেন। পরদিন সেখানে গেলাম । দেখলাম যে মুহাম্মদ (সা.) আমার পূর্বে সেখানে গিয়েছেন কিন্তু মেষগুলোকে সেখানে চরানো থেকে বিরত রাখছেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম : কেন মেষগুলোকে চরতে দিচ্ছেন না ? তিনি বললেন : যেহেতু তোমার সাথে কথা দিয়েছিলাম তাই তুমি আসার পূর্বে আমার মেষগুলো এ চারণ ভূমি থেকে আহার গ্রহণ করবে , তা পছন্দ করছিলাম না।

এভাবেই মুহম্মাদ (সা.) অন্য এক পথে নিজেকে পরিচালিত করেছিলেন এবং গোত্রের রীতিনীতির অনুগামী হন নি। আর অদৃশ্যলোকের সাহায্যে স্বীয় উৎকর্ষের পথে অগ্রসরমান ছিলেন।

আর এ জন্যেই মানুষ তাঁর প্রতি অধিক শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন এবং কোন সমস্যার সমাধানে তাঁর দেয়া সিদ্ধান্তের প্রতি অধিক গুরুত্ব প্রদান করতেন ও তাঁর অনুসরণ করতেন।

হাজারুল আসওয়াদ স্থাপনের ক্ষেত্রে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সিদ্ধান্ত

মহানবীর বয়স ছিল তখন ৩৫ বছর। কোরাইশ কাবা অর্থাৎ আল্লাহর গৃহ পুনঃনির্মাণ ও মেরামত করার জন্যে সিদ্ধান্ত নিল। যেহেতু কোরাইশের গোত্রসমূহের সকলেই এ গৃহ মেরামতকরণের মর্যাদার অধিকারী হতে চেয়েছিল , সেহেতু প্রত্যেকেই কাবার এক একটি অংশ মেরামত করার জন্যে ভাগাভাগি করে নিল।

প্রথমে ওয়ালিদ গৃহ ভাঙ্গার কাজ শুরু করল। অতঃপর অন্যরা তাকে সাহায্য করল। ফলে ইবরাহীম (আ.) কর্তৃক নির্মিত স্তম্ভগুলো দৃশ্যমান হলো। অতঃপর প্রত্যেক গোত্র কাবাগৃহের নির্দিষ্ট অংশ মেরামত করার জন্যে নির্ধারণ করে নিল। যখন কাবা গৃহের মেরামত কাজ এমন এক স্থানে পৌঁছল যেখানে হাজারুল আসওয়াদ স্থাপন করতে হবে , তখন কোরাইশের বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে তুমুল বিবাদ শুরু হলো। কারণ প্রত্যেক গোত্রই স্বহস্তে এ কর্ম সম্পাদন করতে এবং এ মর্যাদার অধিকারী হতে চাইল।

ধীরে ধীরে এ বিরোধ প্রকট হতে লাগল এবং যুদ্ধ বাঁধার পর্যায়ে পৌঁছল। আব্দুদ্দারের পুত্ররা একটি বৃহৎ পাত্র রক্তে পূর্ণ করে এবং তাতে হস্ত সমূহ নিমজ্জিত করে পরস্পরের খুনে রঞ্জিত হওয়ার জন্যে শপথ গ্রহণ করল।

এ ভয়ঙ্কর বিরোধ চার অথবা পাঁচ রাত্রি স্থায়ী হয়েছিল। অতঃপর আবু উমাইয়া কোরাইশের বয়োজ্যেষ্ঠতম ব্যক্তি বলল : আমার প্রস্তাব হলো এই যে , (আগামী কাল প্রত্যুষে) সর্বপ্রথমেই যে ব্যক্তি মসজিদের দ্বার দিয়ে প্রবেশ করবে , তাকে এ বিরোধের মীমাংসাকারী হিসেবে মেনে নিবে। তার এ প্রস্তাব সকলেই একবাক্যে গ্রহণ করল , যাতে সমস্যার সমাধান হয়।

কোরাইশ তার এ প্রস্তাব গ্রহণ করতঃ অপেক্ষা করতে লাগল যে , কে মসজিদের দ্বার দিয়ে প্রবেশ করছে। হঠাৎ দেখা গেল যে ইসলামের নবী (সা.) প্রবেশ করলেন। যখন তাদের দৃষ্টি তাঁর উপর পতিত হলো । বলল : এতো মুহাম্মদ , সে বিশ্বস্ত (আমীন) , আমরা তার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে প্রস্তুত।

মুহাম্মদ (সা.) এ ঘটনা সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। তিনি ঘটনার বিষয় সম্পর্কে অবহিত হয়ে বললেন : একটি জামা নিয়ে আস। কোরাইশরা যদিও তার উদ্দেশ্য অনুধাবন করতে পারেনি তবু দ্রুত একটি জামা নিয়ে আসল। মহানবী (সা.) ঐ জামাটিকে বিছিয়ে দিলেন এবং হাজারুল আসওয়াদকে এর মাঝে রাখলেন। অতঃপর বললেন : প্রত্যেক গোত্র এ জামার এক একটি অংশ ধর যাতে প্রত্যেকেই এ মর্যাদায় অংশীদার হতে পার। কোরাইশের প্রত্যেক গোত্র জামার চারদিকে ধরল। অতঃপর ঐ নির্দিষ্ট স্থানে বয়ে নিল , যেখানে পাথরটি স্থাপন করতে হবে। তখন হযরত মুহাম্মদ (সা.) দেখলেন যদি এর সংস্থাপনের দায়িত্ব অন্যকে দেন , তবে বিরোধ সৃষ্টি হতে পারে । তাই তিনি স্বয়ং হাজারুল আসওয়াদ তুলে নিয়ে যথাস্থানে স্থাপন করলেন। আর এ উন্নত বিচারের মাধ্যমে বিরোধ সম্পূর্ণ রূপে দূর করলেন।

এ ঘটনা রাসূল (সা.)-এর মহান সামাজিক ব্যক্তিত্বের প্রমাণবহ। আর সে সাথে সঠিক চিন্তার মাধ্যমে এক রক্তাক্ত ভয়ঙ্কর গোলযোগের রক্তপাতহীন সমাধানের ক্ষেত্রে তাঁর সঠিক সিদ্ধান্ত ও সুবিচারের প্রকাশ ঘটায়।

আর এভাবেই অনুধাবন করা যায় যে , তিনি নবুওয়াতের জন্যে এবং পবিত্র ও ঐশী বিপ্লবের ধ্বজা ধারণ করার জন্যে যোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

ওহীর অবতরণ

মুহাম্মাদ (সা.)-এর বিশ্বজনীন রেসালত

এখন পর্যন্ত আমরা মহানবী (সা.)-এর জীবনের পাতাসমূহ থেকে কিছু পাতা দেখেছি মাত্র এবং তাঁর ঘটনাবহুল জীবনের কিছু ঘটনা সেখানে আমরা পড়েছি। এবার আমরা তাঁর জীবনেতিহাসের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর ঘটনাটি সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করব।

হযরত মুহাম্মদ (সা.) চল্লিশ বছর যাবৎ এমন এক অভিভাবকহীন ও লাগামহীন জনসমাজে বসবাস করেছিলেন যেখানে সভ্যতা ও সংস্কৃতির লেশ-মাত্র ছিল না। আর সমাজের এহেন অবস্থা মহানবী (সা.)-এর কোমল হৃদয়কে ব্যথাতুর করে তুলত। মুহাম্মদ (সা.) সমাজে অজ্ঞতার তিমির ব্যতীত কিছুই দেখতে পাননি। কাবায় যেতেন , দেখতেন , খোদার পরিবর্তে তারা মূর্তি পূজা করছে ; কাবা ত্যাগ করে সমাজে আসতেন , সেখানের অবস্থা অবলোকনেও ব্যথিত হতেন ; মানুষের মাঝে যেতেন , গোত্রের নিকৃষ্ট চিন্তা-চেতনা ও রীতিনীতি দেখে হৃদয় ভারাক্রান্ত হতেন ; দরিদ্র নিপীড়িত , বঞ্চিত মানুষের অবস্থা দেখে ক্লেষ ভোগ করতেন।

নারীদের নিকৃষ্টতম সামাজিক অবস্থান , মদ , জুয়া , নরহত্যা , অনাচার ইত্যাদির বিস্তৃতিতে নিদারুণ কষ্ট অনুভব করতেন।

যখন ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন এবং মানুষের সাথে মেলামেশা করতেন , তখন মানুষের চারিত্রিক অবনতি তার কোমল হৃদয়কে ব্যথিত করত। তখন বাধ্য হয়ে বিশ্রাম ও ইবাদতের জন্যে এমন কোন স্থানে যেতেন , যেখানে তাঁর হৃদয় ক্লেশমুক্ত থাকে , তাঁর প্রাণে একটু সস্তি পেতে পারেন। এ জন্যে তিনি হেরা পর্বতে যেতেন এবং আল্লাহর রহমতের নিদর্শন ও সৃষ্টির প্রতি মনোনিবেশ করতেন।

চল্লিশ বছর বয়সে হযরত মুহাম্মদ (সা.)

মুহাম্মদ (সা.) চল্লিশতম বছরে পদার্পণ করলেন এবং ঐশী ও বিশ্বজনীন রেসালতের দায়িত্ব পালন করার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করলেন। হঠাৎ তাঁর প্রতি ওহীর ফেরেশতা জিব্রাইল অবতীর্ণ হলেন এবং বললেন : পড়! ...মুহাম্মদ (সা.) বললেন : কী পড়ব ? তিনি এক অভূতপূর্ব অনুভূতিতে নিমগ্ন হলেন। দ্বিতীয়বার একই শব্দ শুনতে পেলেন যে সুস্পষ্ট রূপে বলল : পড় , হে মুহাম্মদ!

তৃতীয়বার জিব্রাইল পুনরাবৃত্তি করে বললেন : তোমার প্রভুর নামে পাঠ কর , যিনি সৃষ্টি করেছেন , সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত পিণ্ড থেকে , পড় , এবং তোমার প্রভু সর্বাপেক্ষা দয়ালু , যে প্রভু লিখতে শিখিয়েছেন এবং মানুষ যা জানতো না , তা তাকে শিখিয়েছেন।৪৫

এক অবর্ণনীয় আনন্দ ও উৎকণ্ঠা তাঁর সমস্ত অন্তরাত্মা , তাঁর অস্তিত্বকে বিমোহিত করে তুলেছিল। কারণ এক বৃহৎ ও সমুন্নত জগতের সাথে তাঁর সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। ...ফেরেশতাদের সাথে ...জিব্রাইলের সাথে উর্ধ্বলোকের সাথে ...তাঁর আত্মা এক পবিত্র ও মহান আশ্রয়স্থলের সাথে নিবিঢ় ও সার্বক্ষণিক সম্পর্ক স্থাপন করল , তিনি স্বীয় অভ্যন্তরে নবুওয়াতের ক্ষমতা অনুভব করলেন এবং কোন প্রকার উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগের লেশমাত্র তাঁর অস্তিত্বে পরিলক্ষিত হয়নি। যা ছিল তা হলো দৃঢ়তা ও প্রশান্তি।

তাহলে মুহাম্মদ (সা.) কি হেরা পর্বতে কোন প্রশিক্ষণকাল সম্পন্ন করেছিলেন ? এটি সে প্রশ্ন , যার ইতিবাচক জবাব দিয়েছিলেন কোন কোন প্রাচ্যবিদ ও লেখক এবং বলেছিলেন : মুহাম্মদ (সা.) হেরা পর্বতের গুহায় ইঞ্জিল ও নবীগণের (আ.) বক্তব্য ও শিক্ষার উপর গভীর ভাবে গবেষণা ও পর্যালোচনা চালিয়েছিলেন এবং এ (জ্ঞান) জগতের অনেক স্বাদ আস্বাদন করেছিলেন।

এ কথার অর্থ দাঁড়ায় মুহাম্মদ (সা.) স্বশিক্ষিত কোন ব্যক্তি ছিলেন যিনি ইঞ্জিল ও তৌরাতের উপর গভীর অনুসন্ধান ও পড়াশুনার মাধ্যমে ইসলাম ধর্মকে আবিস্কার করেছিলেন!

কিন্তু এ ধারণার বিপরীতে অনেক প্রমাণ রয়েছে , এ গুলোর মধ্যে কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হলো :

যদি ইসলামের নবী (সা.) কোরআনকে ইঞ্জিল ও পূর্ববর্তী নবীগণের (আ.) শিক্ষা থেকে গ্রহণ করতেন , তবে সঙ্গত কারণেই কোরআনের বিষয়-বস্তুসমূহ ইঞ্জিল ও তৌরাতের সদৃশ হতো। অথচ কোরআনের বিষয় বস্তু তৌরাত ও ইঞ্জিল থেকে সামগ্রিক ও মৌলিক ভাবে পৃথক ও স্বতন্ত্র।

কোরআনের বক্তব্য , প্রাঞ্জল ও অভূতপূর্ব ভাষাশৈলীর সম্মুখে তদানিন্তন ও পরবর্তী যুগের খ্যাতনামা সাহিত্যিকগণও নতশির। আর এটাই প্রমাণ করে যে , ইসলামের নবী (সা.) সরাসরি বিশ্ব সৃষ্টি কর্তার সাথে সম্পর্কিত ছিলেন এবং নিঃসন্দেহে এ কথাগুলো ও বাক্যগুলো কোন পুস্তকেই বিদ্যমান ছিল না , যা থেকে নবী (সা.) উদ্ধৃতি দিবেন ও শিক্ষা নিবেন।

কোন বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে এ কথা প্রমাণিত হয় না ; বরং এ অপপ্রচারটি ছিল খ্রিস্টান পাদ্রী ও পাশ্চাত্যের উদ্দেশ্যপ্রবণ প্রাচ্যবিদদের সাজানো কথা।

যদি কোরআন বাইবেলের পুরাতন ও নতুন সংস্করণ থেকে অস্তিত্ব লাভ করত , তবে যারা কোরআনের বিরুদ্ধে কোন আয়াত উদ্ধৃতি করতে ও এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাইত , তাহলে , যে তৌরাত ও ইঞ্জিল তাদের হাতে ছিল তারা তাতে খুঁজে দেখত এবং কোন প্রকার কষ্ট ব্যতীতই স্বীয় লক্ষ্যে পৌঁছতে পারত।

সকলেই বিশ্বাস করেন যে , মুহম্মদ (সা.) (কারো নিকট) শিক্ষা গ্রহণ করেন নি।

কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি কি বিশ্বাস করবে যে , পড়াশুনা করেন নি এমন একজন ব্যক্তি , যিনি অজ্ঞ ও জ্ঞান বিজ্ঞানের পাঠ্য পুস্তক থেকে দূরে বিদ্যমান এক সমাজে বড় হয়েছেন , তিনি এক জ্ঞানগর্ভ ও বিশ্বজনীন পুস্তক উপহার দিয়েছেন ? এ ধরনের ব্যক্তি বর্গের নিকট প্রশ্ন করা উচিৎ যে , কিরূপে ইসলামের নবী (সা.) তৌরাত ও ইঞ্জিলের উপর পড়াশুনা করতেন ? যে ব্যক্তি তার সমস্ত জীবনে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যান নি , কোন শিক্ষাগুরুর নিকট শিক্ষা গ্রহণ করেন নি , কিরূপে তিনি অতীত ও ভবিষ্যতের ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে সংবাদ দিতে পারেন ?!

ওহী কী ?

যা সর্বজন স্বীকৃত তাতে বলা হয় , মহান আল্লাহ্ ও তাঁর নবী (আ.) গণের মধ্যে সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল এবং তারা সকল বাস্তবতার জ্ঞান বিশ্ব সৃষ্টির উৎস (অর্থাৎ মহান আল্লাহ্) থেকে লাভ করতেন। আর এ সম্পর্ক তাঁদের আত্মিক উৎকর্ষ ও দৃঢ়তার ফলে বিদ্যমান ছিল।

তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যে , যদি নবীগণের (আ.) সাথে এ সম্পর্ক ছিন্ন করা হয় তবে তাঁদের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। নবীগণের (আ.) সকল মর্যাদার কারণ হলো যে , তারা বিশ্ব সৃষ্টিকর্তার সাথে সম্পর্কের যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন। সুতরাং তাঁরা যা বলতেন তাতে কোন প্রকার সন্দেহ ও জটিলতা ছিলনা। বরং কী এবং কোথা থেকে এসেছে এ সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণরূপে অবহিত ছিলেন , যা কারো কারো তথাকথিত অর্ন্তদৃষ্টির (كشف ) দাবির ব্যতিক্রম যেখানে যোগ সাধনা ও অন্যান্য পদ্ধতি ও নিয়ামকের মাধ্যমে অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং এর অধিকারীদের নিকট এমন কিছু বিষয় অর্জিত হয় যে তারা জানে না কোথা থেকে এসেছে। বরং প্রায়শঃই ধারণা ও অনুমানের বশবর্তী আবার কখনোবা প্রকৃত অবস্থার ব্যতিক্রম হয়ে থাকে।

যাহোক , এ দলের (যোগী) উপর নবীগণের (আ.) শ্রেষ্ঠত্ব এতটা সুস্পষ্ট যে , কোন প্রকার ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। কারণ আল্লাহর নবীগণ (আ.) যা বলেন ও দেখেন তা-ই বাস্তব ও সত্য। এমনকি উদাহরণত এক বিন্দু পরিমাণ সন্দেহও তাদের নিকট আশ্রয় পায় না। অতএব , ওহী হলো মহান আল্লাহ্ ও নবীগণের (আ.) মধ্যে যে সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল তা-ই। আর এ সম্পর্ক কখনো কখনো জিব্রাইলের মাধ্যমে , আবার কখনো কখনো কোন প্রকার মাধ্যম ব্যতীতই সম্পন্ন হতো।

বোহাইরার সাথে হযরত মুহাম্মদের সাক্ষাৎ

যখন কোরাইশদের কাফেলা বসরার6 দিকে আসছিল তখন বোহাইরা নামক এক সন্ন্যাসী তার আশ্রম থেকে হঠাৎ দেখতে পেল যে , একটি কাফেলা আসছে যাদের মাথার উপর একখণ্ড মেঘ তাদের উপর ছায়া দিয়ে সাথে আসছে।

বোহাইরা আশ্রম থেকে বের হয়ে আসল এবং এক কোণে দাঁড়িয়ে তার সহযোগীকে বলল : তাদেরকে গিয়ে বল যে , আজ তোমরা আমাদের অতিথি। মুহাম্মদ (সা.) ব্যতীত কাফেলার সকলেই তার নিকট আসল। মুহাম্মদ (সা.) আসবাব পত্রের নিকট দাঁড়িয়েছিলেন। বোহাইরা যখন দেখল যে মেঘখণ্ড যথাস্থানে দাঁড়িয়ে আছে এবং স্থানান্তারিত হচ্ছে না , তখন বলল : তাঁকেও নিয়ে আস। যখন মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে আসা হচ্ছিল , মেঘ খণ্ডও তাঁর সাথে আসছিল। ঐ সন্ন্যাসী তাঁকে আড় চোখে ভাল করে দেখছিল। পানাহারান্তে তাঁকে বলল : আমি কিছু প্রশ্ন করব ? তোমাকে লাত , ওজ্জার7 কসম দিয়ে বলছি , আমার প্রশ্নের জবাব দাও!

মুহাম্মদ (সা.) বললেন : আমার নিকট সবচেয়ে নিকৃষ্টতম নাম হলো এ দুটি নাম যাদের কসম তুমি আমাকে দিয়েছ।

বোহাইরা বলল : তোমাকে আল্লাহর কসম দিচ্ছি , আমার প্রশ্নের জবাব দাও।

মুহাম্মদ (সা.) বললেন : তোমার প্রশ্ন বল! বোহাইরা মহানবীর (সা.) সাথে একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার সম্পন্ন করল। অতঃপর তাঁর হাতে পায়ে চুম্বন দিতে লাগল এবং বলল : যদি তোমার সময়কাল পর্যন্ত বেঁচে থাকি , তবে তোমার সাথে থেকে তোমার শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। তুমি তো বিশ্বমানবতার শ্রেষ্ঠ সন্তান...।

অতঃপর সে জিজ্ঞাসা করল যে , এ কিশোর কার সন্তান ?

কাফেলার লোকজন হযরত আবু তালিবের দিকে ইঙ্গিত করে বলল যে , তাঁর সন্তান। বোহাইরা : না , এ কিশোরের পিতা কখনোই বেঁচে থাকতে পারে না ।

হযরত আবু তালিব : হ্যাঁ , সে আমার ভাইপো। বোহাইরা : এ কিশোরের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল ও গুরুত্বপূর্ণ। আমি যা তার মধ্যে দেখতে পাই , তা যদি ইহুদীরা জানতে পারে , তবে তারা তাঁকে হত্যা করে ফেলবে ; লক্ষ্য রেখ যেন ইহুদীরা তার কোন ক্ষতি না করতে পারে। আবু তালিব : তবে সে কী করবে , আর ইহুদীদেরই বা তার সাথে কী কাজ ?

বোহাইরা : সে ভবিষ্যতে নবী হবে এবং তার নিকট ওহীর ফেরেশতা অবতীর্ণ হবে।

আবু তালিব : মহান আল্লাহ্ তাঁকে নিরাশ্রয় করবেন না (এবং শত্রু ও ইহুদীদের থেকে রক্ষা করবেন)।8

রাখালী ও মহানবী (সা.)-এর চিন্তা-চেতনা

যদিও হযরত আবু তালিব ছিলেন কোরাইশদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি , কিন্তু বিশাল পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করার মত যথেষ্ট সম্পদ তার ছিল না। স্বভাবতঃই বয়োপ্রাপ্ত যুবক হযরত মুহাম্মদ (সা.) কোন কর্মে আত্মনিয়োগ করতে এবং আপন চাচার বিরাট ব্যয়ভার লাঘব করতে চাইলেন। কিন্তু কী ধরনের পেশা তিনি নির্বাচন করবেন , যা তার মন মানসিকতার সাথে অধিক সাযুজ্যপূর্ণ হবে ?

যেহেতু মহানবী (সা.) পরবর্তীতে নবী ও শ্রেষ্ঠ নেতা হবেন এবং বলগাহারা ও গাঁড়া এক সম্প্রদায়ের সম্মুখীন হবেন। আর অন্ধকার যুগের কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাস ও ভ্রান্ত প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হবেন এবং ন্যায়পরায়ণতার সুউচ্চ মিনার ও জীবনের সঠিক নীতির ভিত্তি স্থাপন করবেন সেহেতু রাখালের পেশা গ্রহণ করাটাই অধিক যুক্তিযুক্ত মনে করেছেন।

মুহাম্মদ (সা.) তাঁর আত্মীয় স্বজন ও মক্কাবাসীদের পশু ও মেষ মক্কার আশেপাশের চারণ ভূমিতে নিয়ে যেতেন ও রক্ষণাবেক্ষণ করতেন এবং এ ভাবে যা উপার্জন করতেন , তা দিয়ে হযরত আবু তালিবকে সাহায্য করতেন।9 আর সেই সাথে শহরের কোলাহল ও যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে দূরে মরু প্রান্তরের মুক্ত পরিবেশের অবসরে নানা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন , যেগুলো পরবর্তীতে তাঁর রেসালতের প্রচারকালে সুফল প্রদান করেছিল।

যাহোক , তিনি ইতোমধ্যে দয়া , সৎকর্ম , বদান্যতা , উদারতা , প্রতিবেশী সুলভ আচরণ , সততা , বিশ্বস্ততা এবং কুপ্রবৃত্তি পরিহার ইত্যাদি সকল গুণে মানুষের শীর্ষে অবস্থান করেছিলেন। আর এ কারণেই তিনি মুহাম্মদ আমীন নামে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন।10

মহানবী (সা.)-এর সততা

যখন বয়োপ্রাপ্তির ফলে মানুষের কামনা , বাসনা ও সুপ্ত শক্তির প্রকাশ ঘটে , শিশু কিশোররা তাদের শৈশব ও কৈশর অতিক্রম করে উদ্দাম ও উদ্দীপনাময় যৌবনে পদার্পণ করে এবং নিজেকে অন্য এক জগতে খুঁজে পায় , তখন যৌবনের এ স্পর্শকাতর মুহূর্তে নানা ধরনের বিচ্যুতি , কলুষতা , অন্যায় , অনাচার , অশ্লীলতা উচ্ছৃঙ্খলতা যুবকদেরকে গ্রাস করতে আসে। আর তখন যদি যুবকদের প্রতি সঠিক লক্ষ্য না রাখা হয় কিংবা স্বয়ং যুবকরা যদি তা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা না করে তবে দুর্ভাগ্যের পর্বত পদতলে পতিত হবে যেখান থেকে পুনরায় সৌভাগ্যের রঙিন পাখিকে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীন।

মহানবী (সা.) এমন এক কলুষিত সমাজে জীবন-যাপন করতেন , যার পরিবেশ অসংখ্য চারিত্রিক অনাচার ও পাপাচারে অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল ; যুবকরা এমনকি আরবের বৃদ্ধরাও অশ্লীল ও নির্লজ্জভাবে অসততা ও যৌন অনাচারে নিমগ্ন ছিল। আর এ জন্যে অশ্লীলতার নিদর্শনস্বরূপ অলিতে গলিতে কোন কোন গৃহের উপর কালো পতাকা উত্তোলিত ছিল এবং এ প্রক্রিয়ায় উচ্ছৃলঙ্খল ব্যক্তিদেরকে অন্যায়ের পথে নিমন্ত্রণ জানাত।

মহানবী (সা.) এমন এক কলুষিত সমাজেই শৈশব থেকে যৌবনে পদার্পন বরলেন এবং পঁচিশ বছর বয়স পর্যন্ত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হলেও পরিবেশের প্রভাব তাঁর উপর পতিত হয়নি। কিঞ্চিৎ পরিমান অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মই তাঁকে করতে দেখা যায়নি। বরং শত্রু মিত্র সকলেই তাঁকে শ্রেষ্ঠ ও উত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী বলে আখ্যায়িত করেছিল।

কোরাইশ তনয়ার (হযরত খাদিজা) সাথে মহানবীর দাম্পত্য জীবনের বর্ণনা যেভাবে চিত্রিত হয়েছে তাতে তাঁর শ্রেষ্ঠ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা ফুঁটে উঠেছে। যেমন তাঁর লাজুক প্রকৃতির কথা হযরত খাদিজাকে উদ্দেশ্য করে লেখা কবিতার ভাষায় এ ভাবে বর্ণিত হয়েছে :

হে খাদিজা! তুমি পৃথিবীর মানুষের মাঝে সর্বোত্তম স্থানে পৌঁছেছো ,

আর সকলের চেয়ে সমুন্নত হয়েছো ,

অর্থাৎ তুমি সে মুহাম্মদ (সা.)-এর নৈকট্য লাভ করেছো ,

পৃথিবীর কোন নারী তাঁর মত সন্তান ভূমিষ্ঠ করেনি ; উত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য , মহত্ব ও আত্মসম্মানের মত সকল গুণ তাঁরই মাঝে সমাহার ঘটেছে। আর চিরদিন এরূপই থাকবে।11

অন্য এক কবি তার কবিতায় বলেন : যদি আহমদ (সা.)-এর সাথে সমস্ত সৃষ্টিকেও তুলনা করা হয় , তবে তিনিই হবেন সর্বশ্রেষ্ঠ। প্রকৃতই তাঁর মর্যাদা কোরাইশদের জন্যে স্পষ্ট ও তর্কাতীত ছিল।12

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রথম বিবাহ

যৌবন কাল বিভিন্ন কামনা বাসনা জাগ্রত ও জৈবিক চাহিদার বহিঃপ্রকাশ ঘটার সময়। যখন ছেলে মেয়েরা বয়সের এ বিন্দুতে পৌঁছে , তখন স্বীয় অভ্যন্তরে পরস্পরের প্রতি এক আকর্ষণ উপলব্ধি করে। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ না করবে , ততক্ষণ পর্যন্ত তারা মানসিক প্রশান্তি ও স্থিতি লাভ করতে পারে না এবং তাদের অন্তরে প্রজ্জ্বলিত অগ্নি নির্বাপিত হয় না।

অতএব , ইসলামে সঠিকভাবে এ পারস্পরিক অনুরাগ থেকে লাভবান হওয়ার জন্যে এবং যৌন আনাচার প্রতিরোধ করার জন্যে অতি গুরুত্বের সাথে যুবক-যুবতীকে দ্রুত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার নির্দেশ রয়েছে। সুতরাং ভবিষ্যতে জীবন নির্বাহের খরচের যোগান দিতে পারবে না এ আশঙ্কার অজুহাতে কেউ যেন বিবাহ থেকে দূরে না থাকে।13

কিন্তু কখনো কখনো জীবনব্যবস্থা এতটা প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হয় যে , বিবাহের প্রাথমিক শর্তসমূহ পূরণ ও জীবন নির্বাহের খরচ সংগ্রহ করতে অপারগ বলে মনে হয়। নিঃসন্দেহে এমতাবস্থায় উপযুক্ত পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্যে অপেক্ষা করতে হবে এবং বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া থেকে দূরে থাকতে হবে। আর সেই সাথে নিজেকে পূত পবিত্র রাখতে হবে ।14

মহানবী (সা.)ও 25 বছর কাল15 পর্যন্ত এমনই এক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবাহ করার সামর্থ্য তাঁর ছিল না।

অতএব , বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া থেকে দূরে থাকাটাই শ্রেয় মনে করলেন এবং অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নের জন্যে ও অনুকূল পরিস্থিতির অপেক্ষায় থাকলেন।16

হযরত খাদিজার পরামর্শ

হযরত খাদিজা ছিলেন এক ধণাঢ্য ও সম্মানিতা রমণী। তিনি তার অর্থ সম্পদ ব্যবসার জন্যে অপরের নিকট অর্পণ করতেন এবং এ কাজের বিনিময়ে তাকে পারিশ্রমিক দিতেন।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সত্যবাদিতা , একনিষ্ঠতা , মর্যাদা ও খ্যাতির কথা সমস্ত আরবে ছড়িয়ে পড়েছিল। আর এভাবে তা হযরত খাদিজার কর্ণগোচর হলে তিনি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে ব্যবসা করার চিন্তা করলেন। তিনি এ বিষয়টি মহানবীর নিকট উপস্থাপন করলেন এবং প্রস্তাব দিলেন : কিছু সম্পদ এক গোলামসহ (যার নাম মাইসারাহ বলা হয়) আপনার নিকট অর্পণ করা হবে এবং অন্যদেরকে যা পরিশোধ করা হতো তার চেয়ে অধিক আপনাকে পরিশোধ করব।

হযরত মুহাম্মদ (সা.) হযরত আবু তালিবের অবস্থা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি জানতেন যে , বার্ধক্যের কারণে বিশাল পরিবারের ভার বহন করার মত সন্তোষজনক অর্থনৈতিক অবস্থা তাঁর চাচার ছিলনা। ফলে তিনি হযরত খাদিজার প্রস্তাব গ্রহণ করলেন।17

খাদিজা কে ?

খাদিজা ছিলেন খুয়াইলিদের কন্যা , অনন্য ব্যক্তিত্ব সম্পন্না এক রমনী। তিনি রাসূলের পূর্বে দু বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর পূর্ববর্তী দু স্বামী ছিলেন মৃত আবু হালা আতিক মাখযুমী

খাদিজা তাঁর জীবনের চল্লিশ বছর অতিক্রম করলে ও তাঁর অঢেল সম্পত্তি ও জনপ্রিয়তার কারণে কোরাইশ পতিদের মধ্যে ও তদানিন্তন সময়ের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে অনেকেই তাঁর পাণি প্রার্থনা করত।

কিন্তু হযরত খাদিজা তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং বিবাহ করেন নি। কারণ তিনি জানতেন যে , হয় তারা জীবন সঙ্গী হওয়ার যোগ্যতা রাখেনা অথবা তাঁর সম্পদের লোভে তার পাণি প্রার্থনা করছে।18

শামের পথে যাত্রা

যখন কোরাইশের বাণিজ্য কাফেলা শামের পথে যাত্রা করার জন্যে প্রস্তুতি নিল এবং মহানবী (সা.)ও তাঁর সফরের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন , তখন হযরত খাদিজা তাঁর গোলাম মাইসারাকে নির্দেশ দিলেন : তুমিও মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে তাঁর খেদমতের জন্যে শামে যাও! যদিও এ ঐতিহাসিক সফরের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া এ পুস্তিকার ক্ষুদ্র পরিসরে সম্ভব নয় তথাপি এতটুকু বলা যায় যে , এ সফর ছিল অতি বরকতময় ও কল্যাণময়। এগুলোর মধ্যে ব্যবসায় প্রচুর লাভবান হওয়া , কাফেলার জন্যে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অনন্য ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটা , খ্রিস্টান পাদ্রীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ও তাঁর নবুওয়াত লাভ সম্পর্কে তার (খ্রিস্টান পাদ্রীর) ভবিষ্যদ্বাণী19 এবং এক বরকতময় দাম্পত্যজীবনের পূর্ব প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়া ইত্যাদির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

এ সফর কিছু দিন পর সম্পন্ন হলে কাফেলা শাম থেকে ফিরে আসল। মাইসারাহ এ সফরের বিভিন্ন খুঁটিনাটি দিক , তাদের অভূতপূর্ব লাভের কথা এবং এ সফরে প্রকাশিত মহানবীর মহত্ব ও বিভিন্ন কারামতের কথা কোরাইশের নন্দিতা রমণী হযরত খাদিজার কর্ণগোচর করল।20

হযরত খাদিজা এক ইহুদী আলেমের কাছ থেকে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ঐশী ব্যক্তিত্বের ও কোরাইশের অন্যতম রমণীর (খাদিজা) সাথে তাঁর বিবাহ বন্ধনে অবদ্ধ হওয়ার কথা শুনেছিল। আর এখন তার গোলামের নিকট এ সমুদয় সংবাদ শুনে শুধু যে হযরতের প্রতি প্রেমাসক্তি তাঁর হৃদয়ে লালন করতে লাগলেন , তা নয় ; বরং তাঁকে তাঁর আদর্শ স্বামী হিসাবে মনে করতে লাগলেন।21

অনুরূপ তাঁর চাচা ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের নিকট তিনি পূর্ববর্তী নবীগণের (আ.) ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আবির্ভাবের সুসংবাদ ও খাদিজা নামক রমণীর সাথে তাঁর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কথা শুনে ছিলেন।22 ফলে তাঁর আকর্ষণ আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল।

কিন্তু কিরূপে তাঁকে এ কথা জানানো যেতে পারে ? এ কর্মটি স্বয়ং তাঁর জন্যে যিনি কোরাইশের অনন্য ব্যক্তিত্ব সম্পন্না রমণী ছিলেন , সহজ ছিল না।

বিবাহের প্রস্তাব

হযরত খাদিজা তাঁর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী নাফিসার নিকট চেয়েছিলেন , সে যেন এ ব্যাপারে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে আলোচনা করে। নাফিসা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নিকট গেলেন এবং বললেন : কেন বিয়ে করছেন না ? তিনি জবাবে বললেন : আমার আর্থিক অবস্থা ও ব্যক্তিগত অবস্থা আমাকে অনুমতি দেয় না। নাফিসা বললেন : যদি এ সমস্যা দূরীভূত হয় এবং সুন্দরী , ধনবতী , সম্মানিতা ও খ্যাতিমান পরিবারের কোন কন্যা আপনার জন্যে পাওয়া যায় , তবে আপনি কি তা গ্রহণ করবেন ?

হযরত মুহাম্মদ (সা.) বললেন : এ রমণী কে , যার কথা তুমি বলছ ?

নাফিসা বলল : খাদিজা।

হযরত বললেন : এটা কিরূপে সম্ভব যে সে কোরাইশের ধনিক ও বণিক শ্রেণীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে , অথচ আমার সঙ্গে বিবাহে রাজি হবে ?!

নাফিসা বলল : হ্যাঁ , এটা সম্ভব এবং আমি তা সম্পন্ন করব।23

যখন মহানবী (সা.) পূর্ণ আস্থা স্থাপন করতে পারলেন যে , খাদিজা তাঁর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে ইচ্ছুক , তখন তিনি একথা তাঁর চাচাদের কাছে জানালেন।

তারা এ শুভসংবাদ শুনে খুবই আনন্দিত হলেন এবং অনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। অবশেষে বিশেষ বিবাহ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহ কার্য সম্পন্ন করেন।24

খাদিজা ছিলেন প্রথম নারী , যিনি মহানবী (সা.)-এর উপর ঈমান এনেছিলেন এবং তাঁর সকল সম্পদ ইসলামের প্রচারের জন্যে রাসূল (সা.)-এর হাতে অর্পণ করেন।25 মুহাম্মদ (সা.)-এর এ দাম্পত্য জীবনেই ছয়টি সন্তান লাভ করেছিলেন : কাসিম ও তাহির নামে দু পুত্র যারা শৈশবেই মৃত্যু বরণ করেন এবং রুকাইয়্যা , যয়নাব , উম্মে কুলসুম ও ফাতেমা (আ.) নামক চার কন্যা। তাদের মধ্যে হয়রত ফাতেমা (সা.) ছিলেন অন্যতম।26 খাদিজা হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর দীনের জন্যে যে ধৈর্য্য ও ত্যাগ-তিতীক্ষা প্রদর্শন করেছিলেন , তা তাঁর জীবদ্দশায়ই কেবলমাত্র হযরতের জন্যে হৃদয় গ্রাহী ছিল না , বরং তাঁর (খাদিজার) মৃত্যুর পরও যখন তাঁর কথা স্মরণ করতেন , হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে পড়তেন।27 কখনো কখনো তাঁর বিয়োগ বেদনায় অশ্রু বিসর্জন দিতেন...।

যাহোক , খাদিজার জীবনের সূর্য 65 বছর বয়সে অর্থাৎ নবুওয়াতের দশম বছরে অস্তমিত হয়েছিল। আর সেই সাথে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর গৃহে চিরদিনের জন্যে খাদিজার দ্যুতি নিভে গেল।

মহানবী (সা.)-এর একাধিক বিয়ের দর্শন ও খ্রিস্টানগণ কর্তৃক অপবাদ দানের কয়েকটি উদাহরণ :

খ্রিস্টানগণ কর্তৃক অপবাদ প্রদানের কয়েকটি দৃষ্টান্ত

অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে খ্রিস্টবাদী লেখকরা ইসলামের বিরুদ্ধে নতুন সংগ্রাম শুরু করেছিল। তারা মিথ্যা ও হঠকারিতায় পূর্ণ পুস্তকসমূহ প্রকাশ করে ইসলাম ধর্মের প্রতি মানুষের আকর্ষণ নষ্ট করতে এবং ইসলামের মহান প্রবর্তক হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি মানুষের অন্তরে বিষেদাগার করতে চেয়েছিল।28

এ কল্পকাহিনীসমূহ এবং খ্রিস্টানদের বিভিন্ন গোঁড়ামীপূর্ণ গল্প কাহিনীর প্রথম সূতিকাগার ছিল মধ্যযুগ , বিশেষ করে পঞ্চদশ শতাব্দীতে। জন অ্যান্ডার মূর ( J.A. Mure ) নামক এক ব্যক্তি মুহাম্মদের দীনের অসারতা নামক একটি পুস্তক লিখেছিল যা পরবর্তী ইসলাম বিদ্বেষী লেখকদের খোরাক যুগিয়েছিল। আর যেহেতু অন্যান্য লেখক আরবী ভাষা জানত না এবং ইসলামের উৎসসমূহ তাদের নাগালে ছিল না সেহেতু ইসলাম পরিচিতির ক্ষেত্রে তারা মূরের পুস্তক নকল বা তার সিদ্ধান্তেই তুষ্ট থেকেছিল।29

হ্যাঁ , যাদের তথাকথিত পবিত্র গ্রন্থে প্রকাশ্যে নবী (আ.) গণের উপর যৌন অনাচারের অপবাদ দেয়30 তারাই আবার আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সম্পর্কে লিখে যে , তিনি কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করেছিলেন। অর্থাৎ যেখানে তিনি তাঁর অনুসারীদেরকে কেবলমাত্র চারজন স্ত্রী রাখার অধিকার দিয়েছেন অথচ স্বয়ং তিনি একাধিক (চারের অধিক) স্ত্রীর অধিকারী ছিলেন ?!31

তারা তাদের স্থূল চিন্তায় অজ্ঞ খ্রিস্টবাদী গায়কের ভাষায় হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে কুপ্রবৃত্তির অনুসারী বলে পরিচয় করাতে চেয়েছিল , যাতে এর মাধ্যমে তার ব্যক্তিত্বহানি করতে পারে এবং ইসলামের প্রচার ও প্রসার রোধ করতে পারে।

কিন্তু তাদের এহেন অপচেষ্টা অপরাপর প্রচেষ্টার মতই অসার ও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। কারণ ন্যায়পরায়ণ খ্রিস্টীয় পণ্ডিতগণ মহানবী (সা.)-এর স্বপক্ষে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন এবং কোরআন ও হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উপর যে মানহানিকর আক্রমণ চালানো হয়েছিল তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন।

নিঃসন্দেহে এ ধরনের বানোয়াট বক্তব্য আমরা যারা নবিগণের (আ.) পবিত্রতায় বিশ্বাস করি , তাদের নিকট অবাঞ্ছিত বৈ কিছু নয়। কিন্তু যারা আমাদের এ বিশ্বাসের সাথে একমত নয় তাদের জন্যে প্রকৃত সত্য উদঘাটিত হওয়া প্রয়োজন।

ইতিহাসের বিচার

সত্যনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ ইতিহাসবেত্তাগণ , কি মুসলমান কি খ্রিস্টান তাদের গ্রন্থসমূহে লিখেছেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর বিবাহসমূহ কোন কামনার ফল ছিল না। কারণ , যদি তাই হতো , তবে 25 বছর বয়সে যখন যৌবনের উত্তাল ও উদ্দম যুবকদেরকে ষোড়শী যুবতী স্ত্রী ব্যতীত অন্য কোন চিন্তা আবিষ্ট করতে পারেনা , তখন তিনি 40 বছর বয়সের প্রৌঢ়া নারী হযরত খাদিজার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতেন না , যিনি ইতোপূর্বে ও দু জন স্বামীর সংসার করেছিলেন।

মুহাম্মদ (সা.) হযরত খাদিজার সাথে 25 বছর32 বয়স পর্যন্ত আন্তরিকতা ও আনন্দের সাথে জীবন যাপন করেছিলেন এবং যদিও আরবের কুমারী , যুবতীরা তাঁর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্যে আগ্রাহান্বিত ছিল , কিন্তু তিনি একবারের জন্যেও অন্য কোন কুমারী রমণী বিবাহ করেন নি।

নিঃসন্দেহে যদি মহানবী (সা.) কোন কামাতুর ব্যক্তি হতেন , তবে অবশ্যই এ সুদীর্ঘ সময় ধরে কুমারী ও যুবতী নারীর পাণি গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে পারতেন না।

ছিদ্রান্বেষীদের নিকট প্রশ্ন

যদি কেউ বর্ণিত ব্যক্তিদের নিকট জিজ্ঞাসা করে : কি কারণে মহানবী (সা.) যৌবনের শুরুতে এক প্রৌঢ়া স্ত্রীর সাথে সংসার করেছিলেন এবং অন্য কোন স্ত্রী গ্রহণ করেন নি , অথচ জীবনের শেষ দশ বছরে যখন তার বার্ধক্য ঘনিয়ে এসেছিল , এছাড়া অভ্যন্তরীন ও বহিঃ রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভারসাম্য রক্ষাকরণ ইত্যাদি তাঁর বিবাহের জন্যে অনুকূল ছিল না , তখন তিনি একাধিক বিবাহ করেন ?

অনাথ ও সর্বস্বহারা নারীদেরকে ভরণ পোষণ দেয়া কি স্বয়ং এক কঠিন কাজ নয় ? বিচিত্র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও মনমানসিকতার অধিকারী স্ত্রীদের সাথে জীবন যাপন করা কি আরাম-আয়েশের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ ? 50 বছরের একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্যে একজন যবুতী স্ত্রী , যে ব্যক্তির মর্যাদা ও স্থান সম্পর্কে অজ্ঞ তার সাথে জীবন যাপন করা কি কোন সহজ ব্যাপার ?33

নিঃসন্দেহে ছিদ্রান্বেষীদের নিকট এর কোন জবাব নেই। সঙ্গত কারণেই তাদেরকে স্বীকার করতে হবে যে , হযরত মুহাম্মদ (সা.) কখনোই কামাতুর ছিলেন না এবং তারা হিংসা ও বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে মহানবীর উপর এ ধরনের অপবাদ প্রদান করেছিল। আর এটা কতই না অন্যায় ও হীন কর্ম!

জন ডেভেন পোর্ট বলেন : এটা কি করে সম্ভব , যে ব্যক্তি এতটা কামাতুর সে এমন এক দেশে যেখানে একাধিক স্ত্রী থাকাটা এক সাধারণ নিয়ম বলে পরিগণিত হতো , সেখানে থেকে 25 বছর ধরে মাত্র একজন স্ত্রী নিয়েই তুষ্ট ছিলেন ?34


3

4

5

6

7

8

9

10

11