বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)18%

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 87 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 16418 / ডাউনলোড: 4114
সাইজ সাইজ সাইজ
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

কোরাইশ কর্তৃক লোভ প্রদর্শন

কোরাইশবর্গ মনে করেছিল যে , বস্তুগত চাওয়া পাওয়া ও দেরহাম বা দিনারের মাধ্যমে ইসলামের সম্মানিত নবীকে তাঁর কর্মকান্ড থেকে বিরত রাখতে পারবে। তাই তারা মহানবীর নিকট আসল এবং বলল : যদি অর্থ ও সম্পদ চাও তবে তোমাকে আরবের সম্পদশালী ব্যক্তিতে পরিণত করব , যদি মর্যাদা ও নেতৃত্ব চাও তবে আমরা সকলেই নিঃশর্ত ভাবে তোমার নেতৃত্ব মেনে নিতে প্রস্তুত ; যদি রাজত্ব চাও তবে আমরা তোমাকে আমাদের বাদশা হিসেবে মেনে নিব। তোমার যে অবস্থা হয় এবং যাকে তুমি ওহী বলে বর্ণনা কর যদি বল যে , তুমি এ থেকে মুক্ত হতে অক্ষম , তবে তোমার চিকিৎসার জন্যে আমরা শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক তোমার জন্য উপস্থিত করব। তবে শর্ত হলো এই যে , তোমার প্রচারকার্য থেকে বিরত হও এবং মানুষের মধ্যে এর চেয়ে বেশী বিরোধ সৃষ্টি করো না। আমাদের খোদাদের বিশ্বাসের ও পূর্ব পূরুষের চিন্তা চেতনাকে তুচ্ছ জ্ঞাপন করো না।

মহানবী (সা.) জবাবে তাদেরকে বললেন :

তোমাদের সম্পদের প্রতি না আমার কোন লোভ আছে , না পদ মর্যাদার প্রতি , না তোমাদের উপর কর্তৃত্ব করার প্রতি। মহান আল্লাহ্ আমাকে নবী হিসেবে নিযুক্ত করেছেন এবং আমার উপর কিতাব নাযিল করেছেন। আমি তাঁর পক্ষ থেকে তোমাদেরকে সুসংবাদ দান ও সতর্ক করার জন্যে আদিষ্ট হয়েছি। আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি ; যদি তোমরা আমাকে অনুসরণ কর তবে কল্যাণ লাভ করবে। আর যদি গ্রহণ না কর , তবে ততক্ষণ পর্যন্ত ধৈর্য্য ও স্থৈর্য অবলম্বন করব , যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমাদের ও আমাদের মধ্যে তাঁর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন।

অবশেষে কোরাইশের গোত্রপতিরা এ মর্মে সিদ্ধান্ত নিল যে , হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে প্রস্তাব দিবে যাতে করে তিনি তাদের খোদাদের থেকে নিস্ক্রিয় থাকেন , এতে তারাও হযরতের কাজে বাধা প্রদান করবে না। সুতরাং তারা হযরত আবু তালিবের নিকট গেল এবং তার নিকট চাইল , তিনি যাতে তাদের প্রস্তাবটি মহানবীর নিকট উপস্থাপন করেন। মহানবী (সা.) তাদেরকে জবাবে বললেন :

যা তাদের জন্য উত্তম , যাতে তাদের জন্যে কল্যাণ নিহিত , যার মাধ্যমে তারা সৌভাগ্যের অধিকারী হবে আমি কি সে কথাটি বলা থেকে বিরত থাকব ?

আবু জেহেল বলল : এক কথা তো ভাল কথা , আমরা দশটি কথা বলতেও প্রস্তুত। অতঃপর সে জিজ্ঞাসা করল সে কথাটি কী ?

মহানবী (সা.) বললেন : বল ,لا اله الا الله (আল্লাহ্ ব্যতীত কোন মা বুদ নেই রাসূল (সা.)-এর কথায় কোরাইশের গোত্রপতিরা খুব ক্ষুদ্ধ হলো এবং তারা হতাশ হয়ে পড়ল।

আবু জেহেল বলল : এ কথাটি ব্যতীত অন্য কোন কথা বল। রাসূল (সা.) দৃঢ় কণ্ঠে বললেন :

যদি সূর্যকেও আমার হাতে এনে দাও , তারপরও তোমাদের নিকট এ কথা ব্যতীত আমার আর কিছু চাওয়ার থাকবে না।

কোরাইশ গোত্রপতিরা যখন বুঝতে পারল , মহানবীর সাথে সংলাপে কোন ফল হবে না এবং লোভ দেখানো , হুমকি সত্ত্বেও তিনি যে পথ বেছে নিয়েছেন , তা থেকে বিরত হবেন না। ফলে তারা সিদ্ধান্ত নিল যে , মহানবীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

চলার পথে প্রতিবন্ধতকা এবং কুরাইশদের নির্যাতন

রাসূল (সা.) যে দিন থেকে প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করেন , সে দিন থেকেই কোরাইশরা হযরতের প্রচার কার্যকে স্থগিত করার জন্যে সকল প্রকার পন্থা কাজে লাগায়।

সাধারণ নিয়মানুযায়ী তারা প্রথমে প্রলোভন দেখিয়ে এবং পার্থিব মর্যাদা , ধনসম্পদ ইত্যাদির ওয়াদা দিয়ে শুরু করেছিল। অতঃপর এ পথে ব্যর্থ হয়ে হুমকি প্রদান এবং অত্যাচার ও নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছিল।

এভাবে হযরত মুহম্মাদ (সা.)-এর জীবনের এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। সম্মান , শ্রদ্ধা , আখলাক-চরিত্র সমাজ থেকে উঠে গিয়ে হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতায় পরিপূর্ণ হয়ে পড়েছিল। যার মাধ্যমে তারা কাপুরুষোচিত ভাবে ইসলামের প্রচার প্রসারে বাঁধ সাধন করতঃ কোরাইশ নেতাদের সম্মান অটুট রাখার চেষ্টা করেছিল।

অবশ্য এটা অস্বীকার করা যায় না যে , অজ্ঞতা এবং চিন্তার অপরিপক্কতার কারণেই তারা সত্য পথ ও রাসূল (সা.)-এর দাওয়াতের বিরোধিতা করত। তবে কোরাইশদের অত্যাচার আরো বৃদ্ধি পেয়েছিল তখন , যখন শুনেছিল যে রাসূল (সা.) তাদের কাঠ ও পাথর নির্মিত মূর্তিসমূহকে অবজ্ঞা করেন এবং বলেন : এই নিস্পাণ পাথরের টুকরার কাছে তোমরা কি চাও ?

কাষ্ঠ ও প্রস্তর নির্মিত খোদাসমূহ যা কোরাইশরা (মুশরিক) তাদের পৈত্রিক সূত্রে পেয়েছিল তার প্রতি রাসূল (সা.)-এর প্রতিবাদ তাদেরকে বেশী অসন্তুষ্ট করেছিল।

অপর দিকে নতুন নবীর আধুনিক শিক্ষা-দীক্ষা তাদের শ্রেণী বৈষম্যের স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যশীল ছিল না। কোরাইশ নেতারা এবং গোত্রপতিরা একাধারে দুর্বল শ্রেণী ও দাসদের উপর অত্যাচার চালিয়ে যেতে চেয়েছিল। সুদখোর সম্পদশালীরাও চেয়েছিল সুদ গ্রহণের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণীর লোকদের রক্তচুষে খাওয়াকে অব্যাহত রাখতে।

শক্তিশালী এবং উদ্ধত লোকেরা চেয়েছিল তলোয়ার এবং বর্শার জোরে অসহায় ও দুর্বল মানুষের সম্পদ ও সম্ভ্রম হরন করাকে অব্যাহত রাখতে। সামাজিক এ ভ্রান্ত প্রথার বিরুদ্ধে নতুন আইনের যে সংগ্রাম ইচ্ছা অথবা অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের ব্যাপক বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। কেননা এর মাধ্যমে তাদের স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটেছিল।

আধুনিক দাওয়াতের বিরোধীদের শীর্ষে ছিল নামধারী গোত্রপতিরা যেমন : আবু জেহেল , আবু সুফিয়ান , আবু লাহাব , আসওয়াদ ইবনে আবদে ইয়াগুছ , আস ইবনে ওয়ায়েল , উতবা , শাইবা , ওয়ালিদ ইবনে মুগাইরা এবং উকবা ইবনে আবি মুয়িত।

কাপুরুষোচিত অপবাদ , শারীরিক নির্যাতন কটু ভাষায় গালাগাল , অর্থনৈতিক চাপ ইত্যাদি নির্লজ্জ উপায়ে তারা রাসূল (সা.) ও তাঁর সাহায্যকারীদের বিরোধিতা করত। নিম্নে এর কিছু নমুনা তুলে ধরা হলো :

১.একদা কিছু সংখ্যক কোরাইশ নেতা তাদের চাটুকারদেরকে দুম্বার নাড়ি ভূড়ি নিয়ে রাসূল (সা.)-এর মাথা ও মুখে ফেলার নির্দেশ দেয়। তারাও তাদের পাপিষ্ঠ নেতাদের নির্দেশ অনুযায়ী এ জঘন্য কার্য সম্পাদন করে ,৫৭ আর এভাবে মহানবী (সা.)-কে ব্যথিত করে।

২ তারেক মুহারেবী বলেন : রাসূল ( সা .)- কে দেখলাম জনগণের মধ্যে উচ্চৈঃস্বরে বলছিলেন :

ياانهّا النّاس قو لوا لا اله الا الله تفلحوا

হে লোক সকল , বল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ তাহলে মুক্তি প্রাপ্ত হবে।

তিনি জনগণকে ইসলাম ও একত্ববাদের দিকে আহবান করছিলেন। আবু লাহাব রাসূল (সা.)-এর পিছন পিছন আসছিল এবং তাঁকে পাথর ছুড়ে মারছিল। এত বেশী পাথর মেরেছিল যে , রাসূল (সা.)-এর পা দিয়ে রক্ত ঝরে পড়ছিল। রাসূল (সা.) এসব উপেক্ষা করে একাধারে জনগণকে সরল পথ প্রদর্শন করে যাচ্ছিলেন। আবু লাহাবও চিৎকার দিয়ে বলছিল : লোক সকল , এ ব্যক্তি মিথ্যাবাদী। তার কথায় কর্ণপাত করো না।৫৮ রাসূল (সা.) ব্যতীত অন্যান্য নব্য মুসলমানরা ও অমানবিক নির্যাতনের শিকার হতেন।

৩.একদা রাসূল (সা.) আম্মার ইয়াসির ও তার পরিবারকে দুশমনদের হাতে নির্যাতিত হতে দেখে বললেন :

হে আম্মার পরিবার , তোমাদের প্রতি সুখবর হলো যে তোমাদের স্থান বেহেশত।৫৯ ইবনে আসির লিখেছেন যে , আম্মার ও তার পিতা-মাতা মুশরিকদের কঠোর নির্যাতনে পতিত হয়েছিল। মুশরিকরা তাদেরকে প্রচণ্ড গরম আবহাওয়ায় ঘর থেকে বের করে সূর্যের প্রচণ্ড তাপে শাস্তি দিত , যেন তারা নতুন দীন থেকে হাত গুটিয়ে নেয়।

আম্মারের মাতা সুমাইয়া হলেন ইসলামের প্রথম শহীদ। তিনি আবু জেহেলের হাতিয়ারের আঘাতে শহীদ হয়েছিলেন। আম্মারের পিতা ইয়াসিরও অবশেষে প্রচণ্ড নির্যাতনের মধ্যে শাহাদাত বরণ করেন। আম্মার নিজেও প্রচণ্ড নির্যাতনের শিকার হয় কিন্তু তাকিয়ার (স্বীয় বিশ্বাসকে গোপন করার) মাধ্যমে মৃত্যুর কবল থেকে মুক্তি পায়।

৪.বেলাল হাবশী কৃতদাস ছিলেন। তিনিও মহানবী (সা.)-এর অনুসারী ছিলেন। আর এ কারণে তার মনিব তাকে খুবই নির্যাতন করত। প্রখর রোদ্রের মধ্যে উত্তপ্ত বালির উপর শুইয়ে বুকের উপর বিরাটকায় পাথর চাপা দিয়ে রাখত। যেন এর মাধ্যমে সে রাসূলকে ত্যাগ করে মূর্তি পূজায় লিপ্ত হয়।

বেলাল সকল হুমকি এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে তাদেরকে বার বার একই জবাব দিত : আহাদ , আহাদ! অর্থাৎ (একত্ব , একত্ব) আল্লাহ্ এক এবং আমি আর কখনোই শিরক ও মূর্তি পূজায় প্রত্যাবর্তন করব না।

পরিতাপের বিষয় হলো এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে আমরা রাসূল (সা.) ও মুসলমানদের প্রতি যে নির্যাতন হয়েছেল তার বিশদ বিবরণ দিতে পারব না। মোটের উপর এ ভাবে বলা যায় যে , ইসলামের শত্রুরা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সকল পন্থাই কাজে লাগিয়েছিল। মোটামুটি ভাবে সেগুলোকে এ ভাবে তুলে ধরা যেতে পারে :

অর্থনৈতিক অবরোধ : কোরাইশরা রাসূল (সা.) ও তাঁর সাথীদের উপর এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক অবরোধ চাপিয়ে দিয়েছিল। অর্থনৈতিক চাপ এবং মুসলমানদের সাথে যে কোন প্রকার লেনদেন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা ছিল মুসলমানদের সাথে তাদের অপর এক কাপুরুষোচিত আচরণ।

মানসিক উৎপীড়ন : কোরাইশদের পক্ষ থেকে মুসলমানদের সাথে বিবাহ নিষিদ্ধ এবং যে কোন প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করার নির্দেশ। আর মহানবী (সা.)-কে জাদুকর ও মিথ্যাবাদী হিসাবে চিহ্নিত করা। এর সবই ছিল মুসলমানদের অবিচলতাকে নষ্ট করার পথে এক মনস্তাত্ত্বিক সংগ্রাম।

অত্যাচার এবং দৈহিক নির্যাতন : এটা অপর এক অমানবিক মাধ্যম যা কোরাইশরা মুসলমানদের আন্দোলনকে থামিয়ে দিতে এবং তাদের নেতাকে নির্মূল করতে ব্যবহার করেছিল।

এই কাপুরুষোচিত মাধ্যম যা ইসলামের প্রথম দিকের কিছু সংখ্যক মুসলমানের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। প্রকৃত পক্ষে ইসলামের অগ্রগতির সাথে সংগ্রাম করতে এটা ছিল আর এক পন্থা।

কোরাইশরা ইসলাম , রাসূল (সা.) এবং মুসলমানদের সাথে সংগ্রামে সকল প্রকার অমানবিক উপায় ব্যাবহার করা সত্ত্বেও ইসলাম একই ভাবে উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। হযরত মুহাম্মদ (সা.) সঠিক পথে দাওয়াত চালিয়ে যান এবং মুসলমানরাও সঠিক পথে চলতে থাকেন।

তাঁরা এ গৌরবময় পথে অসংখ্য সমস্যা , নিদারুণ যন্ত্রণা , নির্যাতন , অপ্রীতিকর যন্ত্রণা , কষ্ট , হিজরত ইত্যাদির সম্মুখীন হয় ; আর এর মাধ্যমে তাদের ঈমান ও আকিদা রক্ষা করেন।

যে লক্ষণীয় বিষয়টি ইসলামের প্রথম যুগের মুসলমানদের অবস্থা সম্পর্কে পাওয়া যায় তা হলো ইসলামের শত্রুদের অপপ্রচারের বিপরীত। ইসলামের অগ্রগতি তরবারীর জোরে হয় নি। বরং ১৩ বৎসর ধরে শত্রুর চাপে এবং বর্শার মুখে তাদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করে অগ্রগতি সাধন করেছে।

হিজরতেরঘটনা প্রবাহ

উদ্দেশ্যের পথে জন্মভূমি ত্যাগ

ইসলামের নবী (সা.) মক্কাবাসীদের বিরোধিতা এবং দলবদ্ধ হয়ে বাধা প্রদানকে তাদের কপালের দাগ থেকেই বুঝে নিয়েছিলেন যে , তারা ভ্রান্ত গোঁড়ামী , কুসংস্কার এবং মুর্খতায় নিমজ্জিত। অতি সহজে তারা এ পঙ্কিল বিশ্বাস ও অহেতুক কার্যকলাপ থেকে দূরে সরবার নয়। তাদেরকে মুক্তি দেওয়ার জন্যে ত্যাগ , কঠোর পরিশ্রম এবং ব্যাপক সংগ্রামের প্রয়োজন রয়েছে।

রাসূল (সা.) তাঁর দূরদর্শিতার মাধ্যমে এই চড়াই উৎরাই পটভূমিকে দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি তাঁর এ অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে ইসলামের ঝাণ্ডা ও প্রচারকে কাঁধে তুলে নেন এবং ধৈর্য্য ও সহনশীলতাকে তাঁর ব্রত হিসাবে গ্রহণ করেন। রাসূল (সা.) ইসলামের বিরোধীদের প্রতিবন্ধকতার সাথে মক্কায় ১৩ বৎসর সংগ্রাম করেন।৬০ কিন্তু ইসলামের শত্রুরা তাদের শয়তানী কার্যাবলী থেকে হাত গুটিয়ে নেয় নি বরং সর্বশক্তি দিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে লড়েছে। এ পরিস্থিতিতে মহানবীর বিশ্বজনীন রেসালতের দাবি ছিল এটাই যে , তিনি তার ইসলাম প্রচারের স্থান পরিবর্তন করে কোন এক উপযুক্ত ও শান্তিপূর্ণ স্থানে চলে যান।

আওস ও খাযরাজ গোত্রের ইসলাম গ্রহণ

খাযরাজ গোত্রের কিছু নেতৃবৃন্দ হজের মৌসুমে মক্কায় এসে মসজিদুল হারামে রাসূল (সা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। রাসূল (সা.) তাদেরকে শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের দীন , ইসলামে দাওয়াত করেন। তারাও যেহেতু আওস গোত্রের সাথে দীর্ঘদিনের মতপার্থক্যের কারণে অতিষ্ট হয়ে পড়েছিল , (রাসূলের এ দাওয়াতের মধ্যে) তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত বস্তুকে ফিরে পেল এবং আন্তরিক ভাবে ইসলাম গ্রহণ করল।

খাযরাজরা ফেরার সময় রাসূল (সা.)-এর কাছে একজন মোবাল্লেগ এবং পথ প্রদর্শক চাইল। রাসূল (সা.) মুসআব ইবনে উমাইরকে তাদের সাথে পাঠান এবং এরই মাধ্যমে মদীনা শহর ইসলামের উদিত সূর্যের সাথে পরিচিত হয় এবং নতুন দীনের পর্যালোচনা করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। কোরআনের আকর্ষণীয় ও নূরানী আয়াত শ্রবণের মাধ্যমে মানুষ ইসলামের দিকে সবচেয়ে বেশী আকর্ষিত হতো। মুসআব আওস ও খাযরাজ গোত্রের নেতাদের ইসলাম গ্রহণের খবর রাসূল (সা.)-কে পাঠায়। পরর্বতীতে মদীনা থেকে যারা হজ পালন করতে মক্কায় এসেছিল তারা গোপনে রাসূল (সা.)-এর সাথে দেখা করেন। মদীনার মুসলমানরা ইসলামের বৃক্ষকে ফলবান হওয়ার জন্য রাসূল (সা.)-এর সাথে বাইয়াত করেন। তারা শপথ করেন যে , যেভাবে তারা তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের সমর্থন ও প্রতিরক্ষা করে ঠিক তেমনিভাবেই রাসূল (সা.) ও ইসলামকে সমর্থন করবে।৬১

মহানবী (সা.)-কে হত্যা করার ষড়যন্ত্র

পূর্বগগন ফর্সা হওয়ার পূর্বেই কোরাইশরা মদীনাবাসী মুসলমানদের চুক্তি সম্পর্কে অবহিত হয় এবং তা নিস্ফল করতে ও রাসূল (সা.)-এর অগ্রগতিকে ব্যাহত করতে উঠে পড়ে লেগে যায়। এ কারণেই তারা দারুন নুদবায় (কোরাইশদের বৈঠক খানা) আলোচনায় বসে। আলোচনা শেষে তারা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন করে এসে সম্মিলিতভাবে রাসূল (সা.)-এর ঘরে এসে তাঁকে হত্যা করবে। যার মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াতের ভিত্তি বিধ্বস্ত হয়ে যাবে।৬২

আল্লাহ তায়ালা মহানবী (সা.)-কে দুশমনদের চক্রান্ত সম্পর্কে অবহিত করেন এবং রাত্রেই মক্কা থেকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন।৬৩

হযরত মুহাম্মদ (সা.) ওহী প্রাপ্ত হয়ে জন্মভূমি থেকে হিজরত করার সিদ্ধান্ত নেন।

আলী (আ.)-এর আত্মত্যাগ

রাসূল (সা.) আল্লাহর পক্ষ থেকে হিজরতের নির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে হযরত আলী (আ.)-কে ডাকলেন এবং সকল রহস্য খুলে বললেন। জনগণের আমানতসমূহ তাঁকে দিয়ে বললেন : এগুলোকে তাদের মালিকদেরকে বুঝিয়ে দিবে। অতঃপর বললেন : অনিবার্য কারণবশতঃ আমাকে হিজরত করতে হচ্ছে , কিন্তু তোমাকে আমার বিছানায় ঘুমাতে হবে। আলী (আ.) এক বাক্যে রাজী হয়ে গেলেন এবং রাসূলের জীবন রক্ষা করার নিমিত্তে নিশ্চিত মৃত্যুকে স্বাগত জানালেন।৬৪

হযরত আলী (আ.)-এর আত্মত্যাগ এতটা নিষ্ঠাপূর্ণ ছিল যে , মহান আল্লাহ্ কোরআনে তাঁর প্রশংসা করেছেন।৬৫ (মানুষের মধ্যে অনেকেই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভার্থে আত্ম উৎসর্গ করে থাকেন। সূরা বাকারা : ২০৭)

রাসূল (সা.) সাউর গুহায়

রাত্র গভীর হলে দুশমনরা তাদের কুঅভিপ্রায় বাস্তবায়ন করার জন্যে রাসূল (সা.)-এর গৃহের চার পাশ ঘিরে ফেলে। কিন্তু যেহেতু মহান আল্লাহ্ নিজেই রাসূল (সা.)-এর সহায়ক ছিলেন , তাকে এ বিপদ থেকেও রক্ষা করেন। রাসূল (সা.) সূরা ইয়াসীন পাঠ করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে ভিন্ন পথে মক্কার বাইরে সাউর গুহায় যান। হযরত আবু বকরও (রা .) জানতে পেরে রাসূল (সা.)-এর সাথে গেল।

কাফেররা উন্মুক্ত তলোয়ার নিয়ে রাসূল (সা.)-এর বিছানার দিকে হামলা করে কিন্তু বিস্ময়ের চোখে রাসূল (সা.)-এর বিছানায় হযরত আলীকে দেখতে পেল এবং অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞাসা করল : মুহাম্মদ কোথায় গিয়েছে ? আলী (আ.) জবাব দিলেন : আমি কি তোমাদের পক্ষ থেকে তাঁর পাহারায় নিয়েজিত ছিলাম ? তোমরা তাকে শহর থেকে বের করে দিতে চেয়েছিল , তিনিও শহর ছেড়ে চলে গেছেন।৬৬ কোরাইশরা তাদের সকল চক্রান্ত ভেস্তে যেতে দেখে তারা তাঁকে খুঁজে পেতে চতুর ও সূক্ষ এক পরিকল্পনা নিল কিন্তু তাও নিস্ফল হলো।

ইয়াসরেব (মদীনা) অভিমুখে যাত্রা

মহানবী (সা.) তিনদিন সাউর গুহায় অবস্থান করার পর ইয়াসরেব অভিমুখে রওনা হন।৬৭ সোরাকা ইবনে মালেক নামে এক ব্যক্তি মক্কা থেকে মহানবীর পিছু ধাওয়া করে কিন্তু তার ঘোড়ার পা তিন বার মাটিতে পুতে যায় এবং ঘোড়া তাকে ফেলে দেয়। ফলে সে তওবা করে ফিরে আসে।৬৮

রাসূল (সা.) ১২ই রবিউল আউয়াল কোবায় পৌঁছান৬৯ এবং কয়েক দিন সেখানে অবস্থান করেন।৭০

হযরত আবু বকর মহানবীকে পীড়াপীড়ি করতে থাকে যে চলুন মদীনায় চলে যাই । কিন্তু রাসূল (সা.) তা গ্রহণ না করে তাকে বললেন :

আলী তাঁর জীবন বাজী রেখে আমাকে রক্ষা করেছে এবং সে আমার আহলে বাইতের সর্বোত্তম ও চাচাত ভাই। আলী এখানে না পৌঁছা পর্যন্ত আমি এখান থেকে নড়ব না।৭১

রাসূল (সা.) হযরত আলীকে যে দায়িত্ব দিয়ে এসেছিলেন তা তিনি যথার্থভাবে পালন করে স্বীয় মাতা ও রাসূলের কন্যা ফাতেমাকে নিয়ে রাসূলের নিকট পৌঁছেন। কিন্তু বন্ধুর পথে উটের রশি টেনে অতিক্রম করতে তাঁর পা ক্ষত বিক্ষত হয়েছিল। ফলে তিনি অতি কষ্টে হাঁটছিলেন। রাসূল (সা.) স্নেহের সাথে হযরত আলীকে আলিঙ্গন করেন এবং তাঁর পায়ের ক্ষত স্থানে নিজের মুখের পবিত্র থুতু লাগিয়ে দিলেন। আর এর মাধ্যমে আলী (আ.) সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেন। অতঃপর একত্রে মদীনা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন।৭২

ইয়াসরেব (মদীনা) রাসূলের প্রতীক্ষায়

ইয়াসরেব অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল এবং শহরে এক বিশেষ উত্তেজনা বিরাজ করছিল। জনগণ রাসূল (সা.)-এর প্রতীক্ষায় প্রহর গুণছিল।

রাসূল (সা.) শুক্রবারে ইয়াসরেবে প্রবেশ করেন। জনগণ মরিয়া হয়ে রাসূল (সা.)-এর নূরানী চেহারার দিকে তাকিয়ে ছিল।

রাসূল (সা.) ইয়াসরেবে স্থায়ী হন এবং ন্যায়বিচার ও ঈমানের ভিত্তিতে ইসলামের মহান সংস্কৃতির ভিত্তি রচনা করেন।

রাসূল (সা.)-এর প্রবেশের পর ইয়াসরেবের নাম পরিবর্তন করে মদীনাতুন নাবী অর্থাৎ নবী (সা.)-এর শহর নাম করণ করা হয়। এ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কারণে অর্থাৎ মিথ্যার উপর সত্যের বিজয় হওয়াতে এ দিনকে ইতিহাসের সূচনা হিসাবে গণ্য করা হয়। জনগণ ইসলামের সূর্য কিরণে যেন এক নতুন জীবন ফিরে পেয়েছিল। আর জাহেলী যুগের জরাজীর্ণ এবং নষ্ট চরিত্র ও বিশ্বাস পরিবর্তন হয়ে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়।

হিজরতের শিক্ষা

মহান হিজরতের ১৪ শত বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখতে পাব যে মুসলমানরা হিজরত এবং ইসলামের ভিত্তি রচনা করতে কতই না কষ্ট সহ্য করেছিলেন।

মুসলমানরা কুরাইশদের অত্যাচার ও নির্যাতন থেকে মুক্ত হয়ে শান্তিময় স্থানে এসে নিজেদেরকে গড্ডালিকা প্রবাহে ভাসিয়ে দেন নি। বরং ইসলামী সংস্কৃতি বাস্তবায়ন ও তার সম্প্রসারণের জন্যে দিবা রাত্র পরিশ্রম করেছিলেন।

এ ত্যাগ ও কঠোর পরিশ্রমই তাদেরকে দাসত্বের শৃংখল থেকে মুক্তি দিয়েছিল এবং তাদেরকে কল্যাণ ও মহত্ব দান করেছিল।

এ স্মৃতিকে প্রতি বৎসর হিজরতের বার্ষিকী পালন করে জীবিত রাখতে হবে। যে কষ্ট ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে ইসলামের প্রথম যুগের মুসলমানরা আল্লাহর প্রতি ঈমান ও রাসূল (সা.)-এর নির্দেশ পালনের মাধ্যমে পবিত্র ইসলামী বিপ্লব অর্জন করেন ও তার উন্নতি সাধন করেন , তাকে আমাদের আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করতে হবে।

আমাদেরকে অবশ্যই এ বিষয়টিকে পরবর্তী প্রজন্মের নিকট পৌঁছে দিতে হবে যে , সে যুগের মুসলমানদের যে সম্মান ও মহত্ব ছিল তা তাদের ঈমান ও প্রচেষ্টার মধ্যেই নিহিত ছিল। আমরা যদি পুনরায় সে মর্যাদা অর্জন করতে চাই তাহলে আমাদেরকে অবশ্যই কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।

মদীনায় ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের গোড়াপত্তন

জীবন্ত সমাজ একমাত্র সমচিন্তা , আন্তরিকতা , সহমর্মিতা এবং পারস্পরিক সমন্বয়ের এরূপ সমাজেই সকলে তাদের কল্যাণ ও অগ্রগতি অর্জন করতে পারে এবং সমন্বিত ভাবে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে।

ইসলাম এরূপ সমাজ গড়ে তোলার জন্যে গোত্র , ভাষা , গায়ের রং এবং ভৌগোলিক অবস্থানের প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপই করে নি। বরং সকলকে মুসলমান , সংগতিপূর্ণ এবং সুসংহত মনে করে।৭৩ ইসলামের একমাত্র দৃষ্টি ছিল আল্লাহর প্রতি ঈমান , যা সকল সংগতি ও সুসংহতির মূল।

ইসলামী ভ্রাতৃত্ব হলো সর্বোত্তম বাক্য , যা ঐক্য ও সর্বাত্মক সংগতিকে স্পষ্ট করে। পবিত্র কোরআন সুন্দর ও স্পষ্ট ভাষায় বলছে :

) انما المومنون اخوة فاصلحوا بين اخويكم(

অর্থাৎ নিশ্চয় মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই , অতএব তোমরা তোমাদের ভ্রাতৃগণের মধ্যে সংশোধন পূর্বক শান্তি স্থাপন কর।৭৪

ইসলামে ভ্রাতৃত্ব বোধ স্থাপনে মহানবী (সা.)-এর বিরল কৃতিত্ব

মহানবী (সা.) মদীনায় প্রবেশ করে সেখানে মসজিদ তৈরী করেন - যা ছিল মুসলমানদের সদর দফতর বা ঘাঁটি নির্মানের পর সর্ব প্রথম যে মৌলিক কাজটি করেন তা হলো ইসলামী ভ্রাতৃত্ব স্থাপন। এর মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে পূর্বের চেয়ে বেশী ঐক্য ও আন্তরিকতার সৃষ্টি হয়। যদিও তারা তাদের জন্মভূমি এবং আত্মীয়-স্বজন হারিয়ে ছিলেন , কিন্তু তার পরিবর্তে তারা এমন ভাই পেয়েছিলেন যারা সার্বিক দিক থেকে অনেক বেশী বিশ্বস্ত এবং সহানুভূতিশীল ছিলেন।

যদিও প্রত্যেক মুসলমানই একে অপরের ভাই , তা সত্ত্বেও রাসূল (সা.) তাঁর অনুসারীদের মধ্যে আকদে উখুওয়াত (ভ্রাতৃত্ব বন্ধন) সৃষ্টি করেন এবং হযরত আলীকে নিজের ভাই হিসাবে গ্রহণ করে বলেন : আলী হচ্ছে আমার ভাই।৭৫

ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে সম্মানের সাথে স্মরণ করে পবিত্র কোরআন বলছে :

) و عتصموا بحبل الله جميعا و لا تفرقوا واذكروا نعمت الله عليكم اذ كنتم اعداء فالّف بين قلوبكم فاصبحتم بنعمه اخوانا و كنتم علي شفا حفرة من النار فانقذكم منها كذلك يبيّن الله لكم اياته لعلكم تهتدون(

অর্থাৎ এবং তোমরা সকলে সমবেত ভাবে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধর এবং পরস্পর বিভক্ত হয়ো না ; এবং স্মরণ কর তোমাদের উপর আল্লাহর নেয়ামতকে যখন তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে তখন তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতি সঞ্চার করলেন এবং তোমরা তারই নেয়ামতের ফলে পরস্পর ভাই ভাই হয়ে গেলে এবং তোমরা এক অগ্নিকুন্ডের কিনারায় ছিলে তখন তিনি তোমাদেরকে তা হতে রক্ষা করলেন। এভাবে আল্লাহ্ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বর্ণনা করেন যেন তোমরা হেদায়াত প্রাপ্ত হও। (সূরা আলে ইমরান : ১০৩)

বোহাইরার সাথে হযরত মুহাম্মদের সাক্ষাৎ

যখন কোরাইশদের কাফেলা বসরার6 দিকে আসছিল তখন বোহাইরা নামক এক সন্ন্যাসী তার আশ্রম থেকে হঠাৎ দেখতে পেল যে , একটি কাফেলা আসছে যাদের মাথার উপর একখণ্ড মেঘ তাদের উপর ছায়া দিয়ে সাথে আসছে।

বোহাইরা আশ্রম থেকে বের হয়ে আসল এবং এক কোণে দাঁড়িয়ে তার সহযোগীকে বলল : তাদেরকে গিয়ে বল যে , আজ তোমরা আমাদের অতিথি। মুহাম্মদ (সা.) ব্যতীত কাফেলার সকলেই তার নিকট আসল। মুহাম্মদ (সা.) আসবাব পত্রের নিকট দাঁড়িয়েছিলেন। বোহাইরা যখন দেখল যে মেঘখণ্ড যথাস্থানে দাঁড়িয়ে আছে এবং স্থানান্তারিত হচ্ছে না , তখন বলল : তাঁকেও নিয়ে আস। যখন মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে আসা হচ্ছিল , মেঘ খণ্ডও তাঁর সাথে আসছিল। ঐ সন্ন্যাসী তাঁকে আড় চোখে ভাল করে দেখছিল। পানাহারান্তে তাঁকে বলল : আমি কিছু প্রশ্ন করব ? তোমাকে লাত , ওজ্জার7 কসম দিয়ে বলছি , আমার প্রশ্নের জবাব দাও!

মুহাম্মদ (সা.) বললেন : আমার নিকট সবচেয়ে নিকৃষ্টতম নাম হলো এ দুটি নাম যাদের কসম তুমি আমাকে দিয়েছ।

বোহাইরা বলল : তোমাকে আল্লাহর কসম দিচ্ছি , আমার প্রশ্নের জবাব দাও।

মুহাম্মদ (সা.) বললেন : তোমার প্রশ্ন বল! বোহাইরা মহানবীর (সা.) সাথে একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার সম্পন্ন করল। অতঃপর তাঁর হাতে পায়ে চুম্বন দিতে লাগল এবং বলল : যদি তোমার সময়কাল পর্যন্ত বেঁচে থাকি , তবে তোমার সাথে থেকে তোমার শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। তুমি তো বিশ্বমানবতার শ্রেষ্ঠ সন্তান...।

অতঃপর সে জিজ্ঞাসা করল যে , এ কিশোর কার সন্তান ?

কাফেলার লোকজন হযরত আবু তালিবের দিকে ইঙ্গিত করে বলল যে , তাঁর সন্তান। বোহাইরা : না , এ কিশোরের পিতা কখনোই বেঁচে থাকতে পারে না ।

হযরত আবু তালিব : হ্যাঁ , সে আমার ভাইপো। বোহাইরা : এ কিশোরের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল ও গুরুত্বপূর্ণ। আমি যা তার মধ্যে দেখতে পাই , তা যদি ইহুদীরা জানতে পারে , তবে তারা তাঁকে হত্যা করে ফেলবে ; লক্ষ্য রেখ যেন ইহুদীরা তার কোন ক্ষতি না করতে পারে। আবু তালিব : তবে সে কী করবে , আর ইহুদীদেরই বা তার সাথে কী কাজ ?

বোহাইরা : সে ভবিষ্যতে নবী হবে এবং তার নিকট ওহীর ফেরেশতা অবতীর্ণ হবে।

আবু তালিব : মহান আল্লাহ্ তাঁকে নিরাশ্রয় করবেন না (এবং শত্রু ও ইহুদীদের থেকে রক্ষা করবেন)।8

রাখালী ও মহানবী (সা.)-এর চিন্তা-চেতনা

যদিও হযরত আবু তালিব ছিলেন কোরাইশদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি , কিন্তু বিশাল পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করার মত যথেষ্ট সম্পদ তার ছিল না। স্বভাবতঃই বয়োপ্রাপ্ত যুবক হযরত মুহাম্মদ (সা.) কোন কর্মে আত্মনিয়োগ করতে এবং আপন চাচার বিরাট ব্যয়ভার লাঘব করতে চাইলেন। কিন্তু কী ধরনের পেশা তিনি নির্বাচন করবেন , যা তার মন মানসিকতার সাথে অধিক সাযুজ্যপূর্ণ হবে ?

যেহেতু মহানবী (সা.) পরবর্তীতে নবী ও শ্রেষ্ঠ নেতা হবেন এবং বলগাহারা ও গাঁড়া এক সম্প্রদায়ের সম্মুখীন হবেন। আর অন্ধকার যুগের কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাস ও ভ্রান্ত প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হবেন এবং ন্যায়পরায়ণতার সুউচ্চ মিনার ও জীবনের সঠিক নীতির ভিত্তি স্থাপন করবেন সেহেতু রাখালের পেশা গ্রহণ করাটাই অধিক যুক্তিযুক্ত মনে করেছেন।

মুহাম্মদ (সা.) তাঁর আত্মীয় স্বজন ও মক্কাবাসীদের পশু ও মেষ মক্কার আশেপাশের চারণ ভূমিতে নিয়ে যেতেন ও রক্ষণাবেক্ষণ করতেন এবং এ ভাবে যা উপার্জন করতেন , তা দিয়ে হযরত আবু তালিবকে সাহায্য করতেন।9 আর সেই সাথে শহরের কোলাহল ও যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে দূরে মরু প্রান্তরের মুক্ত পরিবেশের অবসরে নানা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন , যেগুলো পরবর্তীতে তাঁর রেসালতের প্রচারকালে সুফল প্রদান করেছিল।

যাহোক , তিনি ইতোমধ্যে দয়া , সৎকর্ম , বদান্যতা , উদারতা , প্রতিবেশী সুলভ আচরণ , সততা , বিশ্বস্ততা এবং কুপ্রবৃত্তি পরিহার ইত্যাদি সকল গুণে মানুষের শীর্ষে অবস্থান করেছিলেন। আর এ কারণেই তিনি মুহাম্মদ আমীন নামে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন।10

মহানবী (সা.)-এর সততা

যখন বয়োপ্রাপ্তির ফলে মানুষের কামনা , বাসনা ও সুপ্ত শক্তির প্রকাশ ঘটে , শিশু কিশোররা তাদের শৈশব ও কৈশর অতিক্রম করে উদ্দাম ও উদ্দীপনাময় যৌবনে পদার্পণ করে এবং নিজেকে অন্য এক জগতে খুঁজে পায় , তখন যৌবনের এ স্পর্শকাতর মুহূর্তে নানা ধরনের বিচ্যুতি , কলুষতা , অন্যায় , অনাচার , অশ্লীলতা উচ্ছৃঙ্খলতা যুবকদেরকে গ্রাস করতে আসে। আর তখন যদি যুবকদের প্রতি সঠিক লক্ষ্য না রাখা হয় কিংবা স্বয়ং যুবকরা যদি তা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা না করে তবে দুর্ভাগ্যের পর্বত পদতলে পতিত হবে যেখান থেকে পুনরায় সৌভাগ্যের রঙিন পাখিকে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীন।

মহানবী (সা.) এমন এক কলুষিত সমাজে জীবন-যাপন করতেন , যার পরিবেশ অসংখ্য চারিত্রিক অনাচার ও পাপাচারে অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল ; যুবকরা এমনকি আরবের বৃদ্ধরাও অশ্লীল ও নির্লজ্জভাবে অসততা ও যৌন অনাচারে নিমগ্ন ছিল। আর এ জন্যে অশ্লীলতার নিদর্শনস্বরূপ অলিতে গলিতে কোন কোন গৃহের উপর কালো পতাকা উত্তোলিত ছিল এবং এ প্রক্রিয়ায় উচ্ছৃলঙ্খল ব্যক্তিদেরকে অন্যায়ের পথে নিমন্ত্রণ জানাত।

মহানবী (সা.) এমন এক কলুষিত সমাজেই শৈশব থেকে যৌবনে পদার্পন বরলেন এবং পঁচিশ বছর বয়স পর্যন্ত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হলেও পরিবেশের প্রভাব তাঁর উপর পতিত হয়নি। কিঞ্চিৎ পরিমান অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মই তাঁকে করতে দেখা যায়নি। বরং শত্রু মিত্র সকলেই তাঁকে শ্রেষ্ঠ ও উত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী বলে আখ্যায়িত করেছিল।

কোরাইশ তনয়ার (হযরত খাদিজা) সাথে মহানবীর দাম্পত্য জীবনের বর্ণনা যেভাবে চিত্রিত হয়েছে তাতে তাঁর শ্রেষ্ঠ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা ফুঁটে উঠেছে। যেমন তাঁর লাজুক প্রকৃতির কথা হযরত খাদিজাকে উদ্দেশ্য করে লেখা কবিতার ভাষায় এ ভাবে বর্ণিত হয়েছে :

হে খাদিজা! তুমি পৃথিবীর মানুষের মাঝে সর্বোত্তম স্থানে পৌঁছেছো ,

আর সকলের চেয়ে সমুন্নত হয়েছো ,

অর্থাৎ তুমি সে মুহাম্মদ (সা.)-এর নৈকট্য লাভ করেছো ,

পৃথিবীর কোন নারী তাঁর মত সন্তান ভূমিষ্ঠ করেনি ; উত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য , মহত্ব ও আত্মসম্মানের মত সকল গুণ তাঁরই মাঝে সমাহার ঘটেছে। আর চিরদিন এরূপই থাকবে।11

অন্য এক কবি তার কবিতায় বলেন : যদি আহমদ (সা.)-এর সাথে সমস্ত সৃষ্টিকেও তুলনা করা হয় , তবে তিনিই হবেন সর্বশ্রেষ্ঠ। প্রকৃতই তাঁর মর্যাদা কোরাইশদের জন্যে স্পষ্ট ও তর্কাতীত ছিল।12

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রথম বিবাহ

যৌবন কাল বিভিন্ন কামনা বাসনা জাগ্রত ও জৈবিক চাহিদার বহিঃপ্রকাশ ঘটার সময়। যখন ছেলে মেয়েরা বয়সের এ বিন্দুতে পৌঁছে , তখন স্বীয় অভ্যন্তরে পরস্পরের প্রতি এক আকর্ষণ উপলব্ধি করে। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ না করবে , ততক্ষণ পর্যন্ত তারা মানসিক প্রশান্তি ও স্থিতি লাভ করতে পারে না এবং তাদের অন্তরে প্রজ্জ্বলিত অগ্নি নির্বাপিত হয় না।

অতএব , ইসলামে সঠিকভাবে এ পারস্পরিক অনুরাগ থেকে লাভবান হওয়ার জন্যে এবং যৌন আনাচার প্রতিরোধ করার জন্যে অতি গুরুত্বের সাথে যুবক-যুবতীকে দ্রুত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার নির্দেশ রয়েছে। সুতরাং ভবিষ্যতে জীবন নির্বাহের খরচের যোগান দিতে পারবে না এ আশঙ্কার অজুহাতে কেউ যেন বিবাহ থেকে দূরে না থাকে।13

কিন্তু কখনো কখনো জীবনব্যবস্থা এতটা প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হয় যে , বিবাহের প্রাথমিক শর্তসমূহ পূরণ ও জীবন নির্বাহের খরচ সংগ্রহ করতে অপারগ বলে মনে হয়। নিঃসন্দেহে এমতাবস্থায় উপযুক্ত পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্যে অপেক্ষা করতে হবে এবং বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া থেকে দূরে থাকতে হবে। আর সেই সাথে নিজেকে পূত পবিত্র রাখতে হবে ।14

মহানবী (সা.)ও 25 বছর কাল15 পর্যন্ত এমনই এক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবাহ করার সামর্থ্য তাঁর ছিল না।

অতএব , বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া থেকে দূরে থাকাটাই শ্রেয় মনে করলেন এবং অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নের জন্যে ও অনুকূল পরিস্থিতির অপেক্ষায় থাকলেন।16

হযরত খাদিজার পরামর্শ

হযরত খাদিজা ছিলেন এক ধণাঢ্য ও সম্মানিতা রমণী। তিনি তার অর্থ সম্পদ ব্যবসার জন্যে অপরের নিকট অর্পণ করতেন এবং এ কাজের বিনিময়ে তাকে পারিশ্রমিক দিতেন।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সত্যবাদিতা , একনিষ্ঠতা , মর্যাদা ও খ্যাতির কথা সমস্ত আরবে ছড়িয়ে পড়েছিল। আর এভাবে তা হযরত খাদিজার কর্ণগোচর হলে তিনি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে ব্যবসা করার চিন্তা করলেন। তিনি এ বিষয়টি মহানবীর নিকট উপস্থাপন করলেন এবং প্রস্তাব দিলেন : কিছু সম্পদ এক গোলামসহ (যার নাম মাইসারাহ বলা হয়) আপনার নিকট অর্পণ করা হবে এবং অন্যদেরকে যা পরিশোধ করা হতো তার চেয়ে অধিক আপনাকে পরিশোধ করব।

হযরত মুহাম্মদ (সা.) হযরত আবু তালিবের অবস্থা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি জানতেন যে , বার্ধক্যের কারণে বিশাল পরিবারের ভার বহন করার মত সন্তোষজনক অর্থনৈতিক অবস্থা তাঁর চাচার ছিলনা। ফলে তিনি হযরত খাদিজার প্রস্তাব গ্রহণ করলেন।17

খাদিজা কে ?

খাদিজা ছিলেন খুয়াইলিদের কন্যা , অনন্য ব্যক্তিত্ব সম্পন্না এক রমনী। তিনি রাসূলের পূর্বে দু বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর পূর্ববর্তী দু স্বামী ছিলেন মৃত আবু হালা আতিক মাখযুমী

খাদিজা তাঁর জীবনের চল্লিশ বছর অতিক্রম করলে ও তাঁর অঢেল সম্পত্তি ও জনপ্রিয়তার কারণে কোরাইশ পতিদের মধ্যে ও তদানিন্তন সময়ের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে অনেকেই তাঁর পাণি প্রার্থনা করত।

কিন্তু হযরত খাদিজা তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং বিবাহ করেন নি। কারণ তিনি জানতেন যে , হয় তারা জীবন সঙ্গী হওয়ার যোগ্যতা রাখেনা অথবা তাঁর সম্পদের লোভে তার পাণি প্রার্থনা করছে।18

শামের পথে যাত্রা

যখন কোরাইশের বাণিজ্য কাফেলা শামের পথে যাত্রা করার জন্যে প্রস্তুতি নিল এবং মহানবী (সা.)ও তাঁর সফরের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন , তখন হযরত খাদিজা তাঁর গোলাম মাইসারাকে নির্দেশ দিলেন : তুমিও মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে তাঁর খেদমতের জন্যে শামে যাও! যদিও এ ঐতিহাসিক সফরের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া এ পুস্তিকার ক্ষুদ্র পরিসরে সম্ভব নয় তথাপি এতটুকু বলা যায় যে , এ সফর ছিল অতি বরকতময় ও কল্যাণময়। এগুলোর মধ্যে ব্যবসায় প্রচুর লাভবান হওয়া , কাফেলার জন্যে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অনন্য ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটা , খ্রিস্টান পাদ্রীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ও তাঁর নবুওয়াত লাভ সম্পর্কে তার (খ্রিস্টান পাদ্রীর) ভবিষ্যদ্বাণী19 এবং এক বরকতময় দাম্পত্যজীবনের পূর্ব প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়া ইত্যাদির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

এ সফর কিছু দিন পর সম্পন্ন হলে কাফেলা শাম থেকে ফিরে আসল। মাইসারাহ এ সফরের বিভিন্ন খুঁটিনাটি দিক , তাদের অভূতপূর্ব লাভের কথা এবং এ সফরে প্রকাশিত মহানবীর মহত্ব ও বিভিন্ন কারামতের কথা কোরাইশের নন্দিতা রমণী হযরত খাদিজার কর্ণগোচর করল।20

হযরত খাদিজা এক ইহুদী আলেমের কাছ থেকে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ঐশী ব্যক্তিত্বের ও কোরাইশের অন্যতম রমণীর (খাদিজা) সাথে তাঁর বিবাহ বন্ধনে অবদ্ধ হওয়ার কথা শুনেছিল। আর এখন তার গোলামের নিকট এ সমুদয় সংবাদ শুনে শুধু যে হযরতের প্রতি প্রেমাসক্তি তাঁর হৃদয়ে লালন করতে লাগলেন , তা নয় ; বরং তাঁকে তাঁর আদর্শ স্বামী হিসাবে মনে করতে লাগলেন।21

অনুরূপ তাঁর চাচা ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের নিকট তিনি পূর্ববর্তী নবীগণের (আ.) ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আবির্ভাবের সুসংবাদ ও খাদিজা নামক রমণীর সাথে তাঁর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কথা শুনে ছিলেন।22 ফলে তাঁর আকর্ষণ আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল।

কিন্তু কিরূপে তাঁকে এ কথা জানানো যেতে পারে ? এ কর্মটি স্বয়ং তাঁর জন্যে যিনি কোরাইশের অনন্য ব্যক্তিত্ব সম্পন্না রমণী ছিলেন , সহজ ছিল না।

বিবাহের প্রস্তাব

হযরত খাদিজা তাঁর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী নাফিসার নিকট চেয়েছিলেন , সে যেন এ ব্যাপারে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে আলোচনা করে। নাফিসা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নিকট গেলেন এবং বললেন : কেন বিয়ে করছেন না ? তিনি জবাবে বললেন : আমার আর্থিক অবস্থা ও ব্যক্তিগত অবস্থা আমাকে অনুমতি দেয় না। নাফিসা বললেন : যদি এ সমস্যা দূরীভূত হয় এবং সুন্দরী , ধনবতী , সম্মানিতা ও খ্যাতিমান পরিবারের কোন কন্যা আপনার জন্যে পাওয়া যায় , তবে আপনি কি তা গ্রহণ করবেন ?

হযরত মুহাম্মদ (সা.) বললেন : এ রমণী কে , যার কথা তুমি বলছ ?

নাফিসা বলল : খাদিজা।

হযরত বললেন : এটা কিরূপে সম্ভব যে সে কোরাইশের ধনিক ও বণিক শ্রেণীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে , অথচ আমার সঙ্গে বিবাহে রাজি হবে ?!

নাফিসা বলল : হ্যাঁ , এটা সম্ভব এবং আমি তা সম্পন্ন করব।23

যখন মহানবী (সা.) পূর্ণ আস্থা স্থাপন করতে পারলেন যে , খাদিজা তাঁর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে ইচ্ছুক , তখন তিনি একথা তাঁর চাচাদের কাছে জানালেন।

তারা এ শুভসংবাদ শুনে খুবই আনন্দিত হলেন এবং অনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। অবশেষে বিশেষ বিবাহ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহ কার্য সম্পন্ন করেন।24

খাদিজা ছিলেন প্রথম নারী , যিনি মহানবী (সা.)-এর উপর ঈমান এনেছিলেন এবং তাঁর সকল সম্পদ ইসলামের প্রচারের জন্যে রাসূল (সা.)-এর হাতে অর্পণ করেন।25 মুহাম্মদ (সা.)-এর এ দাম্পত্য জীবনেই ছয়টি সন্তান লাভ করেছিলেন : কাসিম ও তাহির নামে দু পুত্র যারা শৈশবেই মৃত্যু বরণ করেন এবং রুকাইয়্যা , যয়নাব , উম্মে কুলসুম ও ফাতেমা (আ.) নামক চার কন্যা। তাদের মধ্যে হয়রত ফাতেমা (সা.) ছিলেন অন্যতম।26 খাদিজা হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর দীনের জন্যে যে ধৈর্য্য ও ত্যাগ-তিতীক্ষা প্রদর্শন করেছিলেন , তা তাঁর জীবদ্দশায়ই কেবলমাত্র হযরতের জন্যে হৃদয় গ্রাহী ছিল না , বরং তাঁর (খাদিজার) মৃত্যুর পরও যখন তাঁর কথা স্মরণ করতেন , হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে পড়তেন।27 কখনো কখনো তাঁর বিয়োগ বেদনায় অশ্রু বিসর্জন দিতেন...।

যাহোক , খাদিজার জীবনের সূর্য 65 বছর বয়সে অর্থাৎ নবুওয়াতের দশম বছরে অস্তমিত হয়েছিল। আর সেই সাথে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর গৃহে চিরদিনের জন্যে খাদিজার দ্যুতি নিভে গেল।

মহানবী (সা.)-এর একাধিক বিয়ের দর্শন ও খ্রিস্টানগণ কর্তৃক অপবাদ দানের কয়েকটি উদাহরণ :

খ্রিস্টানগণ কর্তৃক অপবাদ প্রদানের কয়েকটি দৃষ্টান্ত

অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে খ্রিস্টবাদী লেখকরা ইসলামের বিরুদ্ধে নতুন সংগ্রাম শুরু করেছিল। তারা মিথ্যা ও হঠকারিতায় পূর্ণ পুস্তকসমূহ প্রকাশ করে ইসলাম ধর্মের প্রতি মানুষের আকর্ষণ নষ্ট করতে এবং ইসলামের মহান প্রবর্তক হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি মানুষের অন্তরে বিষেদাগার করতে চেয়েছিল।28

এ কল্পকাহিনীসমূহ এবং খ্রিস্টানদের বিভিন্ন গোঁড়ামীপূর্ণ গল্প কাহিনীর প্রথম সূতিকাগার ছিল মধ্যযুগ , বিশেষ করে পঞ্চদশ শতাব্দীতে। জন অ্যান্ডার মূর ( J.A. Mure ) নামক এক ব্যক্তি মুহাম্মদের দীনের অসারতা নামক একটি পুস্তক লিখেছিল যা পরবর্তী ইসলাম বিদ্বেষী লেখকদের খোরাক যুগিয়েছিল। আর যেহেতু অন্যান্য লেখক আরবী ভাষা জানত না এবং ইসলামের উৎসসমূহ তাদের নাগালে ছিল না সেহেতু ইসলাম পরিচিতির ক্ষেত্রে তারা মূরের পুস্তক নকল বা তার সিদ্ধান্তেই তুষ্ট থেকেছিল।29

হ্যাঁ , যাদের তথাকথিত পবিত্র গ্রন্থে প্রকাশ্যে নবী (আ.) গণের উপর যৌন অনাচারের অপবাদ দেয়30 তারাই আবার আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সম্পর্কে লিখে যে , তিনি কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করেছিলেন। অর্থাৎ যেখানে তিনি তাঁর অনুসারীদেরকে কেবলমাত্র চারজন স্ত্রী রাখার অধিকার দিয়েছেন অথচ স্বয়ং তিনি একাধিক (চারের অধিক) স্ত্রীর অধিকারী ছিলেন ?!31

তারা তাদের স্থূল চিন্তায় অজ্ঞ খ্রিস্টবাদী গায়কের ভাষায় হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে কুপ্রবৃত্তির অনুসারী বলে পরিচয় করাতে চেয়েছিল , যাতে এর মাধ্যমে তার ব্যক্তিত্বহানি করতে পারে এবং ইসলামের প্রচার ও প্রসার রোধ করতে পারে।

কিন্তু তাদের এহেন অপচেষ্টা অপরাপর প্রচেষ্টার মতই অসার ও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। কারণ ন্যায়পরায়ণ খ্রিস্টীয় পণ্ডিতগণ মহানবী (সা.)-এর স্বপক্ষে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন এবং কোরআন ও হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উপর যে মানহানিকর আক্রমণ চালানো হয়েছিল তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন।

নিঃসন্দেহে এ ধরনের বানোয়াট বক্তব্য আমরা যারা নবিগণের (আ.) পবিত্রতায় বিশ্বাস করি , তাদের নিকট অবাঞ্ছিত বৈ কিছু নয়। কিন্তু যারা আমাদের এ বিশ্বাসের সাথে একমত নয় তাদের জন্যে প্রকৃত সত্য উদঘাটিত হওয়া প্রয়োজন।

ইতিহাসের বিচার

সত্যনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ ইতিহাসবেত্তাগণ , কি মুসলমান কি খ্রিস্টান তাদের গ্রন্থসমূহে লিখেছেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর বিবাহসমূহ কোন কামনার ফল ছিল না। কারণ , যদি তাই হতো , তবে 25 বছর বয়সে যখন যৌবনের উত্তাল ও উদ্দম যুবকদেরকে ষোড়শী যুবতী স্ত্রী ব্যতীত অন্য কোন চিন্তা আবিষ্ট করতে পারেনা , তখন তিনি 40 বছর বয়সের প্রৌঢ়া নারী হযরত খাদিজার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতেন না , যিনি ইতোপূর্বে ও দু জন স্বামীর সংসার করেছিলেন।

মুহাম্মদ (সা.) হযরত খাদিজার সাথে 25 বছর32 বয়স পর্যন্ত আন্তরিকতা ও আনন্দের সাথে জীবন যাপন করেছিলেন এবং যদিও আরবের কুমারী , যুবতীরা তাঁর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্যে আগ্রাহান্বিত ছিল , কিন্তু তিনি একবারের জন্যেও অন্য কোন কুমারী রমণী বিবাহ করেন নি।

নিঃসন্দেহে যদি মহানবী (সা.) কোন কামাতুর ব্যক্তি হতেন , তবে অবশ্যই এ সুদীর্ঘ সময় ধরে কুমারী ও যুবতী নারীর পাণি গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে পারতেন না।

ছিদ্রান্বেষীদের নিকট প্রশ্ন

যদি কেউ বর্ণিত ব্যক্তিদের নিকট জিজ্ঞাসা করে : কি কারণে মহানবী (সা.) যৌবনের শুরুতে এক প্রৌঢ়া স্ত্রীর সাথে সংসার করেছিলেন এবং অন্য কোন স্ত্রী গ্রহণ করেন নি , অথচ জীবনের শেষ দশ বছরে যখন তার বার্ধক্য ঘনিয়ে এসেছিল , এছাড়া অভ্যন্তরীন ও বহিঃ রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভারসাম্য রক্ষাকরণ ইত্যাদি তাঁর বিবাহের জন্যে অনুকূল ছিল না , তখন তিনি একাধিক বিবাহ করেন ?

অনাথ ও সর্বস্বহারা নারীদেরকে ভরণ পোষণ দেয়া কি স্বয়ং এক কঠিন কাজ নয় ? বিচিত্র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও মনমানসিকতার অধিকারী স্ত্রীদের সাথে জীবন যাপন করা কি আরাম-আয়েশের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ ? 50 বছরের একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্যে একজন যবুতী স্ত্রী , যে ব্যক্তির মর্যাদা ও স্থান সম্পর্কে অজ্ঞ তার সাথে জীবন যাপন করা কি কোন সহজ ব্যাপার ?33

নিঃসন্দেহে ছিদ্রান্বেষীদের নিকট এর কোন জবাব নেই। সঙ্গত কারণেই তাদেরকে স্বীকার করতে হবে যে , হযরত মুহাম্মদ (সা.) কখনোই কামাতুর ছিলেন না এবং তারা হিংসা ও বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে মহানবীর উপর এ ধরনের অপবাদ প্রদান করেছিল। আর এটা কতই না অন্যায় ও হীন কর্ম!

জন ডেভেন পোর্ট বলেন : এটা কি করে সম্ভব , যে ব্যক্তি এতটা কামাতুর সে এমন এক দেশে যেখানে একাধিক স্ত্রী থাকাটা এক সাধারণ নিয়ম বলে পরিগণিত হতো , সেখানে থেকে 25 বছর ধরে মাত্র একজন স্ত্রী নিয়েই তুষ্ট ছিলেন ?34


3

4

5

6

7

8

9

10

11