বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)18%

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 87 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 16703 / ডাউনলোড: 4223
সাইজ সাইজ সাইজ
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

ইসলামী ভ্রাতৃত্ব (ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের ধ্বনি)

ইসলামী ভ্রাতৃত্ব কোন আনুষ্ঠানিকতা নয় , বরং এক বাস্তবতা যা ঈমানের সাথে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত এবং তার ফল পর্যায়ক্রমে প্রকাশ লাভ করে।

ইমাম জাফর সাদেক (আ.) ইসলামী ভ্রাতৃত্বের কিছু বৈশিষ্ট্যকে এভাবে বিশ্লেষণ করেছেন :

মুমিন অপর মুমিনের ভাই এবং পথ প্রদর্শক। সে অপরের প্রতি জুলুম এবং খিয়ানত করে না। তাকে ধোকা দেয় না এবং কখনোই ওয়াদা ভঙ্গ করে না।৭৬

ইসলামী ভ্রাতৃত্বের অপর এক অবদান হলো এই যে , প্রত্যেক মুসলমান তার নিজের জন্যে যা চায় , তার ভাইয়ের জন্যে একই প্রত্যাশা করবে। তাঁকে (দীনি ভাইকে) অর্থ সম্পদ , শক্তি ও কথার মাধ্যমে সাহায্য করবে। ইসলামী ভ্রাতৃত্ব থেকে এটা আশাই করা যায় না যে , এক মুসলমান পেট ভরে খেয়ে , ভাল পোশাক পরে আনন্দে থাকবে , অথচ তার অপর মুসলমান ভাই অনাহারে বস্ত্রহীন ভাবে দিন কাটাবে।

হযরত ইমাম সাদেক (আ.) বলেছেন : যদি তোমার ভৃত্য ও সেবক থাকে অথচ তোমার ভাইয়ের না থাকে তাহলে তোমার ভৃত্যকে ঐ ভাইয়ের কাজে সাহায্যের জন্যে পাঠাও।৭৭

ইসলামী ভ্রাতৃত্ব সকল সম্পর্ক এমনকি আত্মীয়তার সম্পর্ককেও নিয়ম নীতির আওতাভূক্ত করেছে। কোরআন স্পষ্ট ভাষায় বলছে :

তুমি এমন কোন কওম পাবে না যারা আল্লাহ্ ও পরকালের উপর ঈমান রাখে , (অপরদিকে) তারা তাদেরকেও ভালবাসে যারা আল্লাহ্ এবং তার রাসূলের বিরুদ্ধাচারণ করেছে , যদিও তারা তাদের পিতৃপুরুষ অথবা তাদের সন্তান-সন্ততি অথবা তাদের ভ্রাতৃবৃন্দ অথবা তাদের গোত্র গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত হউক না কেন।

ইসলামী ভ্রাতৃত্ব সালমান ফার্সী এবং বেলাল হাবাশীকে মহানবী (সা.)-এর নিকটতম অনুসারীর অন্তর্ভূক্ত করেছে। ইসলামী ভ্রাতৃত্বের ছায়ায় চরম শত্রুতারও অবসান ঘটে। ছত্রভঙ্গ জনতা একে অপরের বন্ধুতে পরিণত হয়। এই ঐক্য এবং সংহতির কারণেই প্রত্যেক মুসলমানই এক বৃহৎ পবিরারের ন্যায় একে অপরের সুখ-দুঃখের অংশীদার।

দয়াশীল এবং পুতঃচরিত্রের অধিকারী জনগণের শ্লোগান হলো ঐক্য এবং ভ্রাতৃত্ব।

ইসলামী ভ্রাতৃত্ব প্রত্যেক মুসলমানের উপর এক দায়িত্ব সৃষ্টি করে। যার জন্যে কোন মুসলমানই নিজেকে অন্যের সমস্যা ও বিপদ থেকে পৃথক করে দেখতে পারে না। বরং সকলেই তাদের সামর্থ অনুযায়ী মুসলমানদের সমস্যা সমাধান করতে সদা সচেষ্ট।

এ দায়িত্ব দু ভাগে বিভক্ত :

প্রথম ভাগ

অর্থনৈতিক সহযোগিতা

অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে সহযোগিতা করা যেমন : সুস্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা বিধান , সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা , বাসস্থানের ব্যবস্থা এবং কর্মসংস্থান ইত্যাদি। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআন এবং মহান ইমামগণের বাণীতেও কিছু সংখ্যক মৌল কর্মসূচী উপস্থাপিত হয়েছে যেমন : যাকাত , খুমস , সদকা , দান ইত্যাদি।

দ্বিতীয় ভাগ

জ্ঞানগত এবং প্রশিক্ষণগত সহযোগিতা

দীনি প্রচার , তাবলিগ , পথ নির্দেশনা এবং উপদেশ দান করা , যে যতটুকু জানে অন্যদেরকে তা জানানো সকলের উপর একান্ত জরুরী। অন্যদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে শৈথিল্য করা চলবে না। ন্যায় কাজে আদেশ ও অন্যায় কাজে নিষেধ করতে হবে। যা প্রকৃতপক্ষে এক প্রকার হিত সাধন এবং ইসলামী ভ্রাতৃত্বের এক প্রধান দায়িত্ব। কিন্তু মুসলমানরা যদি কল্পনাপ্রসূত ভয়ের কারণে এবং অবাস্তব স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে এই মহান সুন্নাতকে পরিত্যাগ করে এবং গুনাহ থেকে নিষেধ না করে ও সৎ কাজে অনুপ্রেরণা না যোগায় , তাহলে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের প্রশিক্ষণের প্রাণ নিঃশেষিত হবে। আর এ ভাবে একটি সচেতন সমাজের সকল ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য বিদায় নিবে।

বর্তমান যুগে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের গুরুত্ব

বর্তমান যুগের মুসলমানদের জন্য ঐক্য ও সংহতির প্রযোজনীয়তা সর্ব যুগের চেয়ে বেশি। কেননা আল্লাহ্ তায়ালা ইসলামী দেশসমূহে অনেক মূল্যবান খনিজ ও অন্যান্য সম্পদ দান করেছেন , যার প্রতি অন্যদের দৃষ্টি পড়েছে এবং এ কারণে তারা মুসলমানদেরকে পরস্পর থেকে পৃথক করতে চায়।

আমাদেরকে অবশ্যই সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে এবং ইসলামী ভ্রাতৃত্বের স্থিতি যার ভিত্তি মহানবীর পবিত্র এবং শক্তিশালী হাতে স্থাপিত হয়েছে তা সহ ইসলামের সকল নিয়মের অনুসরণ করতে হবে।

মুসলমানরা যতই শক্তিশালী হোক না কেন তাদের ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। অতএব , ইসলামী ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের কর্মসূচী প্রাথমিক বিদ্যালয় সমূহের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে শিক্ষা দিতে হবে। ফলে উচ্চ পর্যায়ে প্রশিক্ষণ ও জ্ঞানগত শিক্ষার মাধ্যমে তা মজবুত হবে। তাছাড়া প্রত্যেক পিতা-মাতার দায়িত্ব হলো সন্তানদেরকে মুসলামান ভাই ভাই এবং একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসাবে গড়ে তোলা।

ইসলামে জিহাদ

রহমতের নবী (সা.)

একশো কোটির অধিক সংখ্যক মুসলমান বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে রাসূল (সা.)-এর নবুওয়াতের ১৪শ বৎসর পূর্তি (পঞ্চদশ শতাব্দীতে প্রবেশ) উপলক্ষে উৎসব পালন করেন।

এ উৎসব সেই মহতী দিনের কারণে উদযাপিত হচ্ছে যে দিন রাসূল (সা.) শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের ঝান্ডাকে কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। আর( وما ار سلنا ك الا رحمة للعا لمين ) শ্লোগান দিয়ে বিশ্ব শান্তির ভিত্তি এবং সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে শান্তির সাথে বসবাসের নিশ্চয়তা বিধান করেন।৭৮

ইসলাম শ্রেণী এবং গোত্র এবং জাতিগত বৈষম্য যা অধিকাংশ যুদ্ধ ও অঘটনের কারণ , তাকে উত্তম উপায়ে সমাধান করেছে। কিন্তু আধুনিক বিশ্ব এখন পর্যন্ত তার শিকার এবং প্রত্যহ যে কোন বাহানায় যুদ্ধ করছে।

ইসলামের শান্তিপ্রিয়তা ও ন্যায়পয়ায়ণতা এতই বেশী যে আহলে কিতাবদেরকে (ইহুদী ও খ্রিস্টান) ঐক্য ও সংহতির দিকে উদার আহবান জানিয়ে বলছে :

তুমি বল , হে আহলে কিতাব! তোমরা এমন এক কথায় আস যা আমাদের মধ্যে এবং তোমাদের মধ্যে সমান , (আর তা হলো) আমরা যেন আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত না করি। (আলে ইমরান : ৬৪)

মুসলমানরা যখন মদীনায় হিজরত করলেন এবং ইসলামের বিজয় পতাকা তাদের মাথার উপর শোভা পাচ্ছিল তখন বিরোধীরা মহানবী (সা.)-এর নিকট সন্ধি পত্র নিয়ে উপস্থিত হলো এবং মহানবী (সা.)ও তাদেরকে স্বাগত জানালেন। এ সন্ধির সাক্ষী স্বরূপ হিজরতের প্রথম বর্ষে ইহুদীদের সাথে যে সকল সন্ধি হয়েছিল তা উল্লেখ করা যেতে পারে।৭৯

ইসলাম শান্তি ও একত্রে বসবাসে আগ্রহী এবং এ ক্ষেত্রে বহু ফলপ্রসু কর্মসূচী গ্রহণ করেছে।

কিসের জন্যে জিহাদ ?

ইসলাম জীবন্ত ও বিশ্বজনীন দীন , যা পৃথিবীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রণ করেছে।

ইসলাম সাবেক রোমীয় ধর্ম , ইহুদী এবং নাজীদের মত সমাজ এবং গোত্রের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ নয় , বরং সমগ্র বিশ্বের জন্যে। মুসলমানরা ইসলামের শিক্ষার অনুসারী হিসাবে তাদের দায়িত্ব হলো , বঞ্চিত ও নিপীড়িত জনগণের মুক্তি দানে এবং শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় বিশ্বের জনগণকে জীবনের কর্মসূচী সম্পর্কে অবহিত করতে সচেষ্ট হওয়া।

ইসলামের মুজাহিদরা চিলতে পরিমাণ জমি হস্তগত করার জন্যে জিহাদ করেনি। আর এ জন্যেও জিহাদ করেনি যে এক সরকারকে বদলে ঐ স্থানে ঐ রূপ এক সরকার অথবা তার চেয়ে আরো বেশী অত্যাচারী সরকার প্রতিষ্ঠা করবে। বরং জিহাদ হলো একটি মানবপ্রেম মুখী প্রচেষ্টা যা আল্লাহর রাহে এবং মানুষের কল্যাণের জন্যে ও অসংখ্য দুর্বল মানুষকে মুক্তি দিতে সংঘটিত হয়ে থাকে যেন ফেৎনা দূরীভূত হয় এবং সর্বজনীন শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।

এই মহৎ উদ্দেশ্য এবং এ জীবন্ত শিক্ষা ব্যাপক সংখ্যক জনগণের অসচেতনতার ইতি টানবে। তাছাড়া কিছু সংখ্যক স্বার্থান্বেষী ও সুবিধাবাদী যারা অনাথদের কলিজার রক্ত চুষে স্বপ্নের জীবন গড়ে তাদের পথ বন্ধ করে দেয়।

মানুষের ফিতরাতের (সহজাত প্রবণতা ও বিবেকের) দাবী হলো আগাছা এবং সমাজের নষ্ট অংশ সমূহ কেটে ফেলতে হবে। তাহলে জনগণের মুক্তির ও কল্যাণের পথ সুগম হবে। মানব প্রেমিক , ন্যায় পরায়ণ এবং স্বাধীনচেতা মানুষেরা এরূপ সংগ্রামের প্রতি উদ্যোগী ও তার প্রশংসা করেন ।

মহান আল্লাহ্ কতইনা অপূর্ব ভাষায় বলেছেন :

এবং আল্লাহ্ যদি মানব জাতিকে , তাদের একদলকে অপর দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন তাহলে অবশ্যই পৃথিবী ফ্যাসাদপূর্ণ হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ্ সকল জগদ্বাসীর উপর অতীব অনুগ্রহশীল। (সূরা বাকারা : ২৫১)

ইসলামী আইনে জিহাদ প্রধান উদ্দেশ্য হিসাবে গৃহীত হয়নি। বরং তা সীমালংঘন ও নির্যাতন রোধের জন্যে। তাছাড়া যোগ্য মানুষদের কল্যাণের পথ সুগম করতে জিহাদকে সর্বশেষ উপায় হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আরব মুসলমানদের প্রতিনিধি ইরানের সেনাপতি রুস্তম ফারাখযাদকে বলেছিলেন :

আল্লাহ্ আমাদেরকে নির্বাচন করেছেন এই জন্যে যে , জনগণকে বান্দা পূজারী থেকে খোদা পূজারীতে , বিশ্বের বন্দিত্ব থেকে স্বাধীন ও সৌভাগ্যবান করতে এবং ভ্রান্ত দীন সমূহের অত্যাচার থেকে ন্যায় ভিত্তিক ইসলামের পথে দাওয়াত করার জন্যে। যারা আমাদের দাওয়াত গ্রহণ করবে তার দেশকে তার কাছে সপে দিয়ে চলে যাব... । ৮০

ইসলামের অগ্রগতি কি তববারীর সাহায্যে হয়েছে ?!

মুসলমানদের জিহাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এটা যে , নিজেদের ও আপামর বঞ্চিতদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা। এর মাধ্যমে তারা ইসলামের কানুন সম্পর্কে জানতে পারবে এবং ইসলামের মহত্ত্ব ও সত্যতাকে নিকট থেকে দেখবে।

মুসলমানরা কাফেরদের সাথে যুদ্ধের সময় কখনোই কাউকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করত না। তারা সন্ধি চুক্তির মাধ্যমে নিজেদের দীনে অটল থাকতে পারত। এর পরিবর্তে ইসলামী রাষ্ট্র তাদেরকে সাহায্য করত।

রাসূল (সা.) হুদাইবিয়ার সন্ধিতে অঙ্গিকার করেন যে , যদি মক্কার কোন ব্যক্তি মুসলমান হয় এবং মদীনায় মুসলমানদের নিকট চলে আসে , মুসলমানরা তাকে গ্রহণ না করে মক্কায় পাঠিয়ে দিবে।৮১ এবং তিনি সে ওয়াদা অনুযায়ী আমল করেন।৮২ যদিও পারতেন কাফেরদের কাছ থেকে অঙ্গিকার নিতে যে , যদি কোন মুসলমান ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে মক্কায় কাফেরদের নিকট যায় তাহলে তাকে মদীনায় ফিরিয়ে দিতে।

রাসূল (সা.) মক্কা বিজয়ের দিনে কুরাইশদেরকে স্বাধীন ভাবে ছেড়ে দেন এবং কাউকেই ইসলাম গ্রহণের জন্যে বাধ্য করেন নি। বরং ছেড়ে দিয়েছিলেন যেন তারা নিজেরাই সঠিক দীনকে চিনে নেয়। তাছাড়া রাসূল (সা.) মুসলমানদেরকে বলে রেখে ছিলেন যে , মক্কার দু এক জন অপরাধী ব্যতীত কাউকেই যেন হত্যা না করা হয়।৮৩ অনুরূপ যখনই কোন কাফের নিরাপত্তা চাইত , তাকে নিরাপত্তা দেওয়া হতো। যেন সে গবেষণার মাধ্যমে স্বাধীনভাবে ইসলাম গ্রহণ করতে পারে। যেমন : সাফওয়ান ইবনে উমাইয়্যা মক্কা বিজয়ের পর জেদ্দায় পালিয়ে যায়। যখন রাসূল (সা.)-এর কাছে তার জন্যে নিরাপত্তা চাইল , রাসূল (সা.) নিজের আমামা তার জন্যে পাঠিয়ে দেন , যেন এটার মাধ্যমে সে নিরাপদে থাকতে পারে এবং মক্কায় প্রবেশ করতে পারে। সাফওয়ান জেদ্দা থেকে ফিরে এসে রাসূল (সা.)-এর কাছে দুই মাস সময় চায়। রাসূল (সা.) গ্রহণ করেন এবং তাকে চার মাস সময় দেন। সে কাফের থাকা অবস্থায় রাসূল (সা.)-এর সাথে হুনাইন এবং তায়েফ যায় ও অবশেষে স্বেচ্ছায় মুসলমান হয়।৮৪ এভাবে সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে , তলোয়ারের ব্যবহার শুধুমাত্র তাদের জন্যেই , যারা সত্যকে চেনা সত্বেও তার বিরোধিতা করে এবং অন্যদের কল্যাণ ও সৌভাগ্যের পথে বাধা দান করে।

তরবারি ফেৎনাসমূহ দূরীভূত করার জন্যে বঞ্চিতদের মুক্তির জন্যে এবং মানুষের উন্নতি ও পরিপূর্ণতার জন্যে উপযুক্ত ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ইসলামের প্রথম যুগের মুসলমানদের ঈমান ও দৃঢ়তাই উত্তম দলিল যে , তরবাবির মাধ্যমে ইসলামের অগ্রগতি সাধিত হয়নি। প্রথম যুগের মুসলমানরা দীনকে এত বেশি ভালবাসত যে , সকল সমস্যার বিপরীতে অবিচল থাকতেন ; এমনকি নিজের জন্মভূমি ছেড়ে হিজরত করতেন।

বেলাল হাবাশী ইসলামের প্রথম দিকের মুসলমানদের মধ্যে একজন ছিলেন। আবু জেহেল তাকে হেজাজের গরম বালিতে ফেলে রেখে বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে রাখত এবং রৌদ্রের তাপে গরম হলে যখন সে যন্ত্রণায় চিৎকার করত তাকে বলা হতো : মুহাম্মদের খোদাকে অস্বীকার কর , কিন্তু বেলাল অনবরত বলত : আহাদ , আহাদ।৮৫ এত সকল অত্যাচার সহ্য করেও সে ইসলাম থেকে হাত গুটিয়ে নেয়নি বরং দীন ইসলামের প্রতি অটল থেকেছে।

এ অবস্থার পরও কি বলা যায় যে , ইসলামের অগ্রগতি তরবারির জোরে হয়েছে ?!

ইসলামের শত্রুরা যেহেতু ইসলামের কোন দুর্বল দিক খুঁজে পাচ্ছিল না ; তাই চেয়েছিল এভাবে ইসলামকে কলঙ্কিত করতে। কিন্তু তারা জানে না যে ইসলাম তার সহজ সরল নীতি এবং বঞ্চিত ও নিপীড়িত জনগণকে সাহায্য করার মাধ্যমে অগ্রগতি সাধন করবে।

ফরাসী ঐতিহাসিক ড. গুস্তাভলুবুন লিখেছেন : ইসলামী বিশ্বের সম্প্রসারণ যুদ্ধের মাধ্যমে যতটা না হয়েছে তার চেয়ে ঢের বেশী হয়েছে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগের মাধ্যমে।৮৬

বোহাইরার সাথে হযরত মুহাম্মদের সাক্ষাৎ

যখন কোরাইশদের কাফেলা বসরার6 দিকে আসছিল তখন বোহাইরা নামক এক সন্ন্যাসী তার আশ্রম থেকে হঠাৎ দেখতে পেল যে , একটি কাফেলা আসছে যাদের মাথার উপর একখণ্ড মেঘ তাদের উপর ছায়া দিয়ে সাথে আসছে।

বোহাইরা আশ্রম থেকে বের হয়ে আসল এবং এক কোণে দাঁড়িয়ে তার সহযোগীকে বলল : তাদেরকে গিয়ে বল যে , আজ তোমরা আমাদের অতিথি। মুহাম্মদ (সা.) ব্যতীত কাফেলার সকলেই তার নিকট আসল। মুহাম্মদ (সা.) আসবাব পত্রের নিকট দাঁড়িয়েছিলেন। বোহাইরা যখন দেখল যে মেঘখণ্ড যথাস্থানে দাঁড়িয়ে আছে এবং স্থানান্তারিত হচ্ছে না , তখন বলল : তাঁকেও নিয়ে আস। যখন মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে আসা হচ্ছিল , মেঘ খণ্ডও তাঁর সাথে আসছিল। ঐ সন্ন্যাসী তাঁকে আড় চোখে ভাল করে দেখছিল। পানাহারান্তে তাঁকে বলল : আমি কিছু প্রশ্ন করব ? তোমাকে লাত , ওজ্জার7 কসম দিয়ে বলছি , আমার প্রশ্নের জবাব দাও!

মুহাম্মদ (সা.) বললেন : আমার নিকট সবচেয়ে নিকৃষ্টতম নাম হলো এ দুটি নাম যাদের কসম তুমি আমাকে দিয়েছ।

বোহাইরা বলল : তোমাকে আল্লাহর কসম দিচ্ছি , আমার প্রশ্নের জবাব দাও।

মুহাম্মদ (সা.) বললেন : তোমার প্রশ্ন বল! বোহাইরা মহানবীর (সা.) সাথে একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার সম্পন্ন করল। অতঃপর তাঁর হাতে পায়ে চুম্বন দিতে লাগল এবং বলল : যদি তোমার সময়কাল পর্যন্ত বেঁচে থাকি , তবে তোমার সাথে থেকে তোমার শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। তুমি তো বিশ্বমানবতার শ্রেষ্ঠ সন্তান...।

অতঃপর সে জিজ্ঞাসা করল যে , এ কিশোর কার সন্তান ?

কাফেলার লোকজন হযরত আবু তালিবের দিকে ইঙ্গিত করে বলল যে , তাঁর সন্তান। বোহাইরা : না , এ কিশোরের পিতা কখনোই বেঁচে থাকতে পারে না ।

হযরত আবু তালিব : হ্যাঁ , সে আমার ভাইপো। বোহাইরা : এ কিশোরের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল ও গুরুত্বপূর্ণ। আমি যা তার মধ্যে দেখতে পাই , তা যদি ইহুদীরা জানতে পারে , তবে তারা তাঁকে হত্যা করে ফেলবে ; লক্ষ্য রেখ যেন ইহুদীরা তার কোন ক্ষতি না করতে পারে। আবু তালিব : তবে সে কী করবে , আর ইহুদীদেরই বা তার সাথে কী কাজ ?

বোহাইরা : সে ভবিষ্যতে নবী হবে এবং তার নিকট ওহীর ফেরেশতা অবতীর্ণ হবে।

আবু তালিব : মহান আল্লাহ্ তাঁকে নিরাশ্রয় করবেন না (এবং শত্রু ও ইহুদীদের থেকে রক্ষা করবেন)।8

রাখালী ও মহানবী (সা.)-এর চিন্তা-চেতনা

যদিও হযরত আবু তালিব ছিলেন কোরাইশদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি , কিন্তু বিশাল পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করার মত যথেষ্ট সম্পদ তার ছিল না। স্বভাবতঃই বয়োপ্রাপ্ত যুবক হযরত মুহাম্মদ (সা.) কোন কর্মে আত্মনিয়োগ করতে এবং আপন চাচার বিরাট ব্যয়ভার লাঘব করতে চাইলেন। কিন্তু কী ধরনের পেশা তিনি নির্বাচন করবেন , যা তার মন মানসিকতার সাথে অধিক সাযুজ্যপূর্ণ হবে ?

যেহেতু মহানবী (সা.) পরবর্তীতে নবী ও শ্রেষ্ঠ নেতা হবেন এবং বলগাহারা ও গাঁড়া এক সম্প্রদায়ের সম্মুখীন হবেন। আর অন্ধকার যুগের কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাস ও ভ্রান্ত প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হবেন এবং ন্যায়পরায়ণতার সুউচ্চ মিনার ও জীবনের সঠিক নীতির ভিত্তি স্থাপন করবেন সেহেতু রাখালের পেশা গ্রহণ করাটাই অধিক যুক্তিযুক্ত মনে করেছেন।

মুহাম্মদ (সা.) তাঁর আত্মীয় স্বজন ও মক্কাবাসীদের পশু ও মেষ মক্কার আশেপাশের চারণ ভূমিতে নিয়ে যেতেন ও রক্ষণাবেক্ষণ করতেন এবং এ ভাবে যা উপার্জন করতেন , তা দিয়ে হযরত আবু তালিবকে সাহায্য করতেন।9 আর সেই সাথে শহরের কোলাহল ও যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে দূরে মরু প্রান্তরের মুক্ত পরিবেশের অবসরে নানা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন , যেগুলো পরবর্তীতে তাঁর রেসালতের প্রচারকালে সুফল প্রদান করেছিল।

যাহোক , তিনি ইতোমধ্যে দয়া , সৎকর্ম , বদান্যতা , উদারতা , প্রতিবেশী সুলভ আচরণ , সততা , বিশ্বস্ততা এবং কুপ্রবৃত্তি পরিহার ইত্যাদি সকল গুণে মানুষের শীর্ষে অবস্থান করেছিলেন। আর এ কারণেই তিনি মুহাম্মদ আমীন নামে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন।10

মহানবী (সা.)-এর সততা

যখন বয়োপ্রাপ্তির ফলে মানুষের কামনা , বাসনা ও সুপ্ত শক্তির প্রকাশ ঘটে , শিশু কিশোররা তাদের শৈশব ও কৈশর অতিক্রম করে উদ্দাম ও উদ্দীপনাময় যৌবনে পদার্পণ করে এবং নিজেকে অন্য এক জগতে খুঁজে পায় , তখন যৌবনের এ স্পর্শকাতর মুহূর্তে নানা ধরনের বিচ্যুতি , কলুষতা , অন্যায় , অনাচার , অশ্লীলতা উচ্ছৃঙ্খলতা যুবকদেরকে গ্রাস করতে আসে। আর তখন যদি যুবকদের প্রতি সঠিক লক্ষ্য না রাখা হয় কিংবা স্বয়ং যুবকরা যদি তা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা না করে তবে দুর্ভাগ্যের পর্বত পদতলে পতিত হবে যেখান থেকে পুনরায় সৌভাগ্যের রঙিন পাখিকে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীন।

মহানবী (সা.) এমন এক কলুষিত সমাজে জীবন-যাপন করতেন , যার পরিবেশ অসংখ্য চারিত্রিক অনাচার ও পাপাচারে অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল ; যুবকরা এমনকি আরবের বৃদ্ধরাও অশ্লীল ও নির্লজ্জভাবে অসততা ও যৌন অনাচারে নিমগ্ন ছিল। আর এ জন্যে অশ্লীলতার নিদর্শনস্বরূপ অলিতে গলিতে কোন কোন গৃহের উপর কালো পতাকা উত্তোলিত ছিল এবং এ প্রক্রিয়ায় উচ্ছৃলঙ্খল ব্যক্তিদেরকে অন্যায়ের পথে নিমন্ত্রণ জানাত।

মহানবী (সা.) এমন এক কলুষিত সমাজেই শৈশব থেকে যৌবনে পদার্পন বরলেন এবং পঁচিশ বছর বয়স পর্যন্ত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হলেও পরিবেশের প্রভাব তাঁর উপর পতিত হয়নি। কিঞ্চিৎ পরিমান অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মই তাঁকে করতে দেখা যায়নি। বরং শত্রু মিত্র সকলেই তাঁকে শ্রেষ্ঠ ও উত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী বলে আখ্যায়িত করেছিল।

কোরাইশ তনয়ার (হযরত খাদিজা) সাথে মহানবীর দাম্পত্য জীবনের বর্ণনা যেভাবে চিত্রিত হয়েছে তাতে তাঁর শ্রেষ্ঠ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা ফুঁটে উঠেছে। যেমন তাঁর লাজুক প্রকৃতির কথা হযরত খাদিজাকে উদ্দেশ্য করে লেখা কবিতার ভাষায় এ ভাবে বর্ণিত হয়েছে :

হে খাদিজা! তুমি পৃথিবীর মানুষের মাঝে সর্বোত্তম স্থানে পৌঁছেছো ,

আর সকলের চেয়ে সমুন্নত হয়েছো ,

অর্থাৎ তুমি সে মুহাম্মদ (সা.)-এর নৈকট্য লাভ করেছো ,

পৃথিবীর কোন নারী তাঁর মত সন্তান ভূমিষ্ঠ করেনি ; উত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য , মহত্ব ও আত্মসম্মানের মত সকল গুণ তাঁরই মাঝে সমাহার ঘটেছে। আর চিরদিন এরূপই থাকবে।11

অন্য এক কবি তার কবিতায় বলেন : যদি আহমদ (সা.)-এর সাথে সমস্ত সৃষ্টিকেও তুলনা করা হয় , তবে তিনিই হবেন সর্বশ্রেষ্ঠ। প্রকৃতই তাঁর মর্যাদা কোরাইশদের জন্যে স্পষ্ট ও তর্কাতীত ছিল।12

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রথম বিবাহ

যৌবন কাল বিভিন্ন কামনা বাসনা জাগ্রত ও জৈবিক চাহিদার বহিঃপ্রকাশ ঘটার সময়। যখন ছেলে মেয়েরা বয়সের এ বিন্দুতে পৌঁছে , তখন স্বীয় অভ্যন্তরে পরস্পরের প্রতি এক আকর্ষণ উপলব্ধি করে। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ না করবে , ততক্ষণ পর্যন্ত তারা মানসিক প্রশান্তি ও স্থিতি লাভ করতে পারে না এবং তাদের অন্তরে প্রজ্জ্বলিত অগ্নি নির্বাপিত হয় না।

অতএব , ইসলামে সঠিকভাবে এ পারস্পরিক অনুরাগ থেকে লাভবান হওয়ার জন্যে এবং যৌন আনাচার প্রতিরোধ করার জন্যে অতি গুরুত্বের সাথে যুবক-যুবতীকে দ্রুত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার নির্দেশ রয়েছে। সুতরাং ভবিষ্যতে জীবন নির্বাহের খরচের যোগান দিতে পারবে না এ আশঙ্কার অজুহাতে কেউ যেন বিবাহ থেকে দূরে না থাকে।13

কিন্তু কখনো কখনো জীবনব্যবস্থা এতটা প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হয় যে , বিবাহের প্রাথমিক শর্তসমূহ পূরণ ও জীবন নির্বাহের খরচ সংগ্রহ করতে অপারগ বলে মনে হয়। নিঃসন্দেহে এমতাবস্থায় উপযুক্ত পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্যে অপেক্ষা করতে হবে এবং বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া থেকে দূরে থাকতে হবে। আর সেই সাথে নিজেকে পূত পবিত্র রাখতে হবে ।14

মহানবী (সা.)ও 25 বছর কাল15 পর্যন্ত এমনই এক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবাহ করার সামর্থ্য তাঁর ছিল না।

অতএব , বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া থেকে দূরে থাকাটাই শ্রেয় মনে করলেন এবং অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নের জন্যে ও অনুকূল পরিস্থিতির অপেক্ষায় থাকলেন।16

হযরত খাদিজার পরামর্শ

হযরত খাদিজা ছিলেন এক ধণাঢ্য ও সম্মানিতা রমণী। তিনি তার অর্থ সম্পদ ব্যবসার জন্যে অপরের নিকট অর্পণ করতেন এবং এ কাজের বিনিময়ে তাকে পারিশ্রমিক দিতেন।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সত্যবাদিতা , একনিষ্ঠতা , মর্যাদা ও খ্যাতির কথা সমস্ত আরবে ছড়িয়ে পড়েছিল। আর এভাবে তা হযরত খাদিজার কর্ণগোচর হলে তিনি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে ব্যবসা করার চিন্তা করলেন। তিনি এ বিষয়টি মহানবীর নিকট উপস্থাপন করলেন এবং প্রস্তাব দিলেন : কিছু সম্পদ এক গোলামসহ (যার নাম মাইসারাহ বলা হয়) আপনার নিকট অর্পণ করা হবে এবং অন্যদেরকে যা পরিশোধ করা হতো তার চেয়ে অধিক আপনাকে পরিশোধ করব।

হযরত মুহাম্মদ (সা.) হযরত আবু তালিবের অবস্থা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি জানতেন যে , বার্ধক্যের কারণে বিশাল পরিবারের ভার বহন করার মত সন্তোষজনক অর্থনৈতিক অবস্থা তাঁর চাচার ছিলনা। ফলে তিনি হযরত খাদিজার প্রস্তাব গ্রহণ করলেন।17

খাদিজা কে ?

খাদিজা ছিলেন খুয়াইলিদের কন্যা , অনন্য ব্যক্তিত্ব সম্পন্না এক রমনী। তিনি রাসূলের পূর্বে দু বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর পূর্ববর্তী দু স্বামী ছিলেন মৃত আবু হালা আতিক মাখযুমী

খাদিজা তাঁর জীবনের চল্লিশ বছর অতিক্রম করলে ও তাঁর অঢেল সম্পত্তি ও জনপ্রিয়তার কারণে কোরাইশ পতিদের মধ্যে ও তদানিন্তন সময়ের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে অনেকেই তাঁর পাণি প্রার্থনা করত।

কিন্তু হযরত খাদিজা তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং বিবাহ করেন নি। কারণ তিনি জানতেন যে , হয় তারা জীবন সঙ্গী হওয়ার যোগ্যতা রাখেনা অথবা তাঁর সম্পদের লোভে তার পাণি প্রার্থনা করছে।18

শামের পথে যাত্রা

যখন কোরাইশের বাণিজ্য কাফেলা শামের পথে যাত্রা করার জন্যে প্রস্তুতি নিল এবং মহানবী (সা.)ও তাঁর সফরের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন , তখন হযরত খাদিজা তাঁর গোলাম মাইসারাকে নির্দেশ দিলেন : তুমিও মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে তাঁর খেদমতের জন্যে শামে যাও! যদিও এ ঐতিহাসিক সফরের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া এ পুস্তিকার ক্ষুদ্র পরিসরে সম্ভব নয় তথাপি এতটুকু বলা যায় যে , এ সফর ছিল অতি বরকতময় ও কল্যাণময়। এগুলোর মধ্যে ব্যবসায় প্রচুর লাভবান হওয়া , কাফেলার জন্যে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অনন্য ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটা , খ্রিস্টান পাদ্রীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ও তাঁর নবুওয়াত লাভ সম্পর্কে তার (খ্রিস্টান পাদ্রীর) ভবিষ্যদ্বাণী19 এবং এক বরকতময় দাম্পত্যজীবনের পূর্ব প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়া ইত্যাদির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

এ সফর কিছু দিন পর সম্পন্ন হলে কাফেলা শাম থেকে ফিরে আসল। মাইসারাহ এ সফরের বিভিন্ন খুঁটিনাটি দিক , তাদের অভূতপূর্ব লাভের কথা এবং এ সফরে প্রকাশিত মহানবীর মহত্ব ও বিভিন্ন কারামতের কথা কোরাইশের নন্দিতা রমণী হযরত খাদিজার কর্ণগোচর করল।20

হযরত খাদিজা এক ইহুদী আলেমের কাছ থেকে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ঐশী ব্যক্তিত্বের ও কোরাইশের অন্যতম রমণীর (খাদিজা) সাথে তাঁর বিবাহ বন্ধনে অবদ্ধ হওয়ার কথা শুনেছিল। আর এখন তার গোলামের নিকট এ সমুদয় সংবাদ শুনে শুধু যে হযরতের প্রতি প্রেমাসক্তি তাঁর হৃদয়ে লালন করতে লাগলেন , তা নয় ; বরং তাঁকে তাঁর আদর্শ স্বামী হিসাবে মনে করতে লাগলেন।21

অনুরূপ তাঁর চাচা ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের নিকট তিনি পূর্ববর্তী নবীগণের (আ.) ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আবির্ভাবের সুসংবাদ ও খাদিজা নামক রমণীর সাথে তাঁর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কথা শুনে ছিলেন।22 ফলে তাঁর আকর্ষণ আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল।

কিন্তু কিরূপে তাঁকে এ কথা জানানো যেতে পারে ? এ কর্মটি স্বয়ং তাঁর জন্যে যিনি কোরাইশের অনন্য ব্যক্তিত্ব সম্পন্না রমণী ছিলেন , সহজ ছিল না।

বিবাহের প্রস্তাব

হযরত খাদিজা তাঁর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী নাফিসার নিকট চেয়েছিলেন , সে যেন এ ব্যাপারে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে আলোচনা করে। নাফিসা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নিকট গেলেন এবং বললেন : কেন বিয়ে করছেন না ? তিনি জবাবে বললেন : আমার আর্থিক অবস্থা ও ব্যক্তিগত অবস্থা আমাকে অনুমতি দেয় না। নাফিসা বললেন : যদি এ সমস্যা দূরীভূত হয় এবং সুন্দরী , ধনবতী , সম্মানিতা ও খ্যাতিমান পরিবারের কোন কন্যা আপনার জন্যে পাওয়া যায় , তবে আপনি কি তা গ্রহণ করবেন ?

হযরত মুহাম্মদ (সা.) বললেন : এ রমণী কে , যার কথা তুমি বলছ ?

নাফিসা বলল : খাদিজা।

হযরত বললেন : এটা কিরূপে সম্ভব যে সে কোরাইশের ধনিক ও বণিক শ্রেণীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে , অথচ আমার সঙ্গে বিবাহে রাজি হবে ?!

নাফিসা বলল : হ্যাঁ , এটা সম্ভব এবং আমি তা সম্পন্ন করব।23

যখন মহানবী (সা.) পূর্ণ আস্থা স্থাপন করতে পারলেন যে , খাদিজা তাঁর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে ইচ্ছুক , তখন তিনি একথা তাঁর চাচাদের কাছে জানালেন।

তারা এ শুভসংবাদ শুনে খুবই আনন্দিত হলেন এবং অনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। অবশেষে বিশেষ বিবাহ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহ কার্য সম্পন্ন করেন।24

খাদিজা ছিলেন প্রথম নারী , যিনি মহানবী (সা.)-এর উপর ঈমান এনেছিলেন এবং তাঁর সকল সম্পদ ইসলামের প্রচারের জন্যে রাসূল (সা.)-এর হাতে অর্পণ করেন।25 মুহাম্মদ (সা.)-এর এ দাম্পত্য জীবনেই ছয়টি সন্তান লাভ করেছিলেন : কাসিম ও তাহির নামে দু পুত্র যারা শৈশবেই মৃত্যু বরণ করেন এবং রুকাইয়্যা , যয়নাব , উম্মে কুলসুম ও ফাতেমা (আ.) নামক চার কন্যা। তাদের মধ্যে হয়রত ফাতেমা (সা.) ছিলেন অন্যতম।26 খাদিজা হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর দীনের জন্যে যে ধৈর্য্য ও ত্যাগ-তিতীক্ষা প্রদর্শন করেছিলেন , তা তাঁর জীবদ্দশায়ই কেবলমাত্র হযরতের জন্যে হৃদয় গ্রাহী ছিল না , বরং তাঁর (খাদিজার) মৃত্যুর পরও যখন তাঁর কথা স্মরণ করতেন , হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে পড়তেন।27 কখনো কখনো তাঁর বিয়োগ বেদনায় অশ্রু বিসর্জন দিতেন...।

যাহোক , খাদিজার জীবনের সূর্য 65 বছর বয়সে অর্থাৎ নবুওয়াতের দশম বছরে অস্তমিত হয়েছিল। আর সেই সাথে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর গৃহে চিরদিনের জন্যে খাদিজার দ্যুতি নিভে গেল।

মহানবী (সা.)-এর একাধিক বিয়ের দর্শন ও খ্রিস্টানগণ কর্তৃক অপবাদ দানের কয়েকটি উদাহরণ :

খ্রিস্টানগণ কর্তৃক অপবাদ প্রদানের কয়েকটি দৃষ্টান্ত

অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে খ্রিস্টবাদী লেখকরা ইসলামের বিরুদ্ধে নতুন সংগ্রাম শুরু করেছিল। তারা মিথ্যা ও হঠকারিতায় পূর্ণ পুস্তকসমূহ প্রকাশ করে ইসলাম ধর্মের প্রতি মানুষের আকর্ষণ নষ্ট করতে এবং ইসলামের মহান প্রবর্তক হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি মানুষের অন্তরে বিষেদাগার করতে চেয়েছিল।28

এ কল্পকাহিনীসমূহ এবং খ্রিস্টানদের বিভিন্ন গোঁড়ামীপূর্ণ গল্প কাহিনীর প্রথম সূতিকাগার ছিল মধ্যযুগ , বিশেষ করে পঞ্চদশ শতাব্দীতে। জন অ্যান্ডার মূর ( J.A. Mure ) নামক এক ব্যক্তি মুহাম্মদের দীনের অসারতা নামক একটি পুস্তক লিখেছিল যা পরবর্তী ইসলাম বিদ্বেষী লেখকদের খোরাক যুগিয়েছিল। আর যেহেতু অন্যান্য লেখক আরবী ভাষা জানত না এবং ইসলামের উৎসসমূহ তাদের নাগালে ছিল না সেহেতু ইসলাম পরিচিতির ক্ষেত্রে তারা মূরের পুস্তক নকল বা তার সিদ্ধান্তেই তুষ্ট থেকেছিল।29

হ্যাঁ , যাদের তথাকথিত পবিত্র গ্রন্থে প্রকাশ্যে নবী (আ.) গণের উপর যৌন অনাচারের অপবাদ দেয়30 তারাই আবার আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সম্পর্কে লিখে যে , তিনি কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করেছিলেন। অর্থাৎ যেখানে তিনি তাঁর অনুসারীদেরকে কেবলমাত্র চারজন স্ত্রী রাখার অধিকার দিয়েছেন অথচ স্বয়ং তিনি একাধিক (চারের অধিক) স্ত্রীর অধিকারী ছিলেন ?!31

তারা তাদের স্থূল চিন্তায় অজ্ঞ খ্রিস্টবাদী গায়কের ভাষায় হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে কুপ্রবৃত্তির অনুসারী বলে পরিচয় করাতে চেয়েছিল , যাতে এর মাধ্যমে তার ব্যক্তিত্বহানি করতে পারে এবং ইসলামের প্রচার ও প্রসার রোধ করতে পারে।

কিন্তু তাদের এহেন অপচেষ্টা অপরাপর প্রচেষ্টার মতই অসার ও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। কারণ ন্যায়পরায়ণ খ্রিস্টীয় পণ্ডিতগণ মহানবী (সা.)-এর স্বপক্ষে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন এবং কোরআন ও হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উপর যে মানহানিকর আক্রমণ চালানো হয়েছিল তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন।

নিঃসন্দেহে এ ধরনের বানোয়াট বক্তব্য আমরা যারা নবিগণের (আ.) পবিত্রতায় বিশ্বাস করি , তাদের নিকট অবাঞ্ছিত বৈ কিছু নয়। কিন্তু যারা আমাদের এ বিশ্বাসের সাথে একমত নয় তাদের জন্যে প্রকৃত সত্য উদঘাটিত হওয়া প্রয়োজন।

ইতিহাসের বিচার

সত্যনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ ইতিহাসবেত্তাগণ , কি মুসলমান কি খ্রিস্টান তাদের গ্রন্থসমূহে লিখেছেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর বিবাহসমূহ কোন কামনার ফল ছিল না। কারণ , যদি তাই হতো , তবে 25 বছর বয়সে যখন যৌবনের উত্তাল ও উদ্দম যুবকদেরকে ষোড়শী যুবতী স্ত্রী ব্যতীত অন্য কোন চিন্তা আবিষ্ট করতে পারেনা , তখন তিনি 40 বছর বয়সের প্রৌঢ়া নারী হযরত খাদিজার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতেন না , যিনি ইতোপূর্বে ও দু জন স্বামীর সংসার করেছিলেন।

মুহাম্মদ (সা.) হযরত খাদিজার সাথে 25 বছর32 বয়স পর্যন্ত আন্তরিকতা ও আনন্দের সাথে জীবন যাপন করেছিলেন এবং যদিও আরবের কুমারী , যুবতীরা তাঁর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্যে আগ্রাহান্বিত ছিল , কিন্তু তিনি একবারের জন্যেও অন্য কোন কুমারী রমণী বিবাহ করেন নি।

নিঃসন্দেহে যদি মহানবী (সা.) কোন কামাতুর ব্যক্তি হতেন , তবে অবশ্যই এ সুদীর্ঘ সময় ধরে কুমারী ও যুবতী নারীর পাণি গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে পারতেন না।

ছিদ্রান্বেষীদের নিকট প্রশ্ন

যদি কেউ বর্ণিত ব্যক্তিদের নিকট জিজ্ঞাসা করে : কি কারণে মহানবী (সা.) যৌবনের শুরুতে এক প্রৌঢ়া স্ত্রীর সাথে সংসার করেছিলেন এবং অন্য কোন স্ত্রী গ্রহণ করেন নি , অথচ জীবনের শেষ দশ বছরে যখন তার বার্ধক্য ঘনিয়ে এসেছিল , এছাড়া অভ্যন্তরীন ও বহিঃ রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভারসাম্য রক্ষাকরণ ইত্যাদি তাঁর বিবাহের জন্যে অনুকূল ছিল না , তখন তিনি একাধিক বিবাহ করেন ?

অনাথ ও সর্বস্বহারা নারীদেরকে ভরণ পোষণ দেয়া কি স্বয়ং এক কঠিন কাজ নয় ? বিচিত্র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও মনমানসিকতার অধিকারী স্ত্রীদের সাথে জীবন যাপন করা কি আরাম-আয়েশের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ ? 50 বছরের একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্যে একজন যবুতী স্ত্রী , যে ব্যক্তির মর্যাদা ও স্থান সম্পর্কে অজ্ঞ তার সাথে জীবন যাপন করা কি কোন সহজ ব্যাপার ?33

নিঃসন্দেহে ছিদ্রান্বেষীদের নিকট এর কোন জবাব নেই। সঙ্গত কারণেই তাদেরকে স্বীকার করতে হবে যে , হযরত মুহাম্মদ (সা.) কখনোই কামাতুর ছিলেন না এবং তারা হিংসা ও বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে মহানবীর উপর এ ধরনের অপবাদ প্রদান করেছিল। আর এটা কতই না অন্যায় ও হীন কর্ম!

জন ডেভেন পোর্ট বলেন : এটা কি করে সম্ভব , যে ব্যক্তি এতটা কামাতুর সে এমন এক দেশে যেখানে একাধিক স্ত্রী থাকাটা এক সাধারণ নিয়ম বলে পরিগণিত হতো , সেখানে থেকে 25 বছর ধরে মাত্র একজন স্ত্রী নিয়েই তুষ্ট ছিলেন ?34


3

4

5

6

7

8

9

10

11