বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)18%

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 87 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 16425 / ডাউনলোড: 4124
সাইজ সাইজ সাইজ
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

হযরত মুহাম্মদ (সা.) সর্বশেষ নবী

ইসলামের চিরন্তনতা ও হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে নবুওয়াতের পরিসমাপ্তি

ইসলামের নবী (সা.)-এর সর্বশেষ নবী হওয়ার বিষয়টি আল্লাহর একত্বের মতই সকলের নিকট সুস্পষ্ট ও প্রমাণিত। বলতে হয় : এ ব্যাপারে সকলেই একমত।

ইসলাম ধর্ম সর্বদা নতুন এবং দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তৃতি যত বেশি হবে এর সামগ্রিকতা ততটা সুস্পষ্টতর হতে থাকবে এবং এর বিস্ময় কখনোই শেষ হবে না ।

এখন এ বিশ্বাসগত বিষয়ের বাস্তবরূপ বিশ্লেষণ করতে হবে।

প্রথমেই এক ধর্মের চিরন্তন হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ কারণসমূহ বিশ্লেষণ করব। অতঃপর ইসলামকে এ দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করব :

১.কোন ধর্মের ফেতরাতগত (মানুষের সহজাত প্রবণতার সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল) হওয়াটা ঐ ধর্মের চিরন্তনতার গুরুত্বপূর্ণ নির্বাহক। যে দীনের মূল ভিত্তি মানুষের ফেতরাত ও প্রকৃতির উপর প্রতিষ্ঠিত , সে দীন সময়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সর্বদা অগ্রসরমান হয়ে থাকে এবং কখনোই নিঃশেষ ও নিস্তব্ধ হয়ে যায় না কিংবা কখনোই নিস্ক্রিয় পুরোনো হয়ে পড়ে না।

২.যে সকল বিধি-নিষেধ স্থান ও কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় সকল প্রকার অগ্রগতির সাথেই তার সামঞ্জস্য বজায় থাকে এবং কখনোই কালের পরিক্রমণ তার উপর পরিবর্জনের রেখা টানতে পারে না।

অপরদিকে যে বিধান কোন নির্দিষ্ট বিশেষ সময় ও স্থানের জন্যে নির্দিষ্ট তা , সর্বকালের জন্যে সকল মানুষের চাহিদা মিটাতে অক্ষম। যেমন : যদি বলা হয় যে , যাতায়াতের ক্ষেত্রে মানুষ কেবলমাত্র প্রাকৃতিক বাহন যথা : ঘোড়া , উট ব্যবহার করতে পারবে , তবে এ নিয়ম কখনো অপরিবর্তিত থাকতে পারবে না এবং নিজ থেকেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কারণ নতুন নতুন প্রয়োজন দেখা দিলে মানুষ নতুন মাধ্যম ব্যবহার করবেই।

পূর্ববর্তী দীনসমূহ বিদ্যমান ও অব্যাহত না থাকার একটি কারণ হলো এটাই যে , ঐগুলো বিশেষ সময়ের ও নির্দিষ্ট কোন সমাজের জন্যে ছিল।

৩.সামগ্রিকতা : চিরন্তন দীনকে সর্বজনীন হতে হবে এবং মানবতার সকল সমস্যার সমাধান দিতে সক্ষম হতে হবে। মানবতার ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ আত্মার তৃষ্ণা এক শ্রেণীর ভ্রান্ত ও আচার সর্বস্ব অনুষ্ঠানাদি যেমন : সান্ধ্য অধিবেশন , রুটি ও মদ্য পানাহার ও গলায় ক্রুশ ঝুলানোর মাধ্যমে পিপাসা নিবারণ হয় না। কিংবা প্রকৃত প্রশান্তি লাভ করে না। বরং এক সর্বজনীন বিধি-বিধানের প্রয়োজন যা তাকে সারা জীবন পথ নির্দেশনা দিয়ে যাবে এবং তার সামাজিক সমস্যাসমূহের সমাধান দিবে।

৪.অচলাবস্থার সময় পথ নিদের্শনা : সাধারণ নিয়মগুলো কখনো কখনো পারস্পরিক বিরোধ অথবা প্রয়োজন ও বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হওয়ার কারণে , মানুষকে অচলাবস্থার সম্মুখীন করে যেখানে সে জানে না কি করতে হবে!

এ কারণে চিরন্তন দীনে সাধারণ নিয়ম-কানুন ছাড়াও অন্যান্য নিয়মও থাকতে হবে যা জরুরী অবস্থায় বা সংকটময় মুহূর্তে কী করতে হবে সে বিষয়ের ব্যাখ্যা দিবে। আর কেবলমাত্র তখনই সকল সময় বা সর্বাবস্থার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ হবে এবং সর্বদা ফলপ্রসূ হবে।

উপরোল্লিখিত বিষয়গুলো চিরন্তনতার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে পরিগণিত যেগুলো ইসলামী বিধানে বজায় থেকেছে। এখন আমরা সেগুলোকে ব্যাখ্যা করব।

ইসলাম এক চিরন্তন দীন

১.ইসলাম নীতি নির্ধারনের ক্ষেত্রে স্বয়ং মানুষের ফেতরাত ও প্রকৃতি যা সর্বদা বিদ্যমান থাকে তাকে বিবেচনা করেছে এবং এ ফেতরাতের প্রয়োজনে ইতিবাচক সারা দিয়েছে।

ইসলামের কর্মসূচী এমন ভাবে বিন্যস্ত হয়েছে যে , তাতে মানুষের সকল চাহিদা পূর্ণ হয়ে থাকে। যেমন : যৌন প্রয়োজন মিটানোর জন্যে একাধিক পদ্ধতি ও সহজ পরামর্শ দিয়েছে যেগুলোর মাধ্যমে সে তা পূরণ করতে পারে। অপরদিকে বাঁধনহারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করে যাতে এর কুপ্রভাব ও অনাচার সমাজে বিস্তৃতি লাভ করতে না পারে।

২.ইসলামের মূল বিধি-বিধানসমূহ কোন বিশেষ কালের জন্যে নির্ধারিত নয় বলে কালের পরিবর্তনে বস্তুসমূহের পূর্ণতার সাথে পরিবর্তিত হয় না। বরং সকল কাল ও অবস্থার সাথে তা সামঞ্জস্য বজায় রাখে এবং যা কিছু সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় ও কল্যাণময় তা নির্ধারণ করে।

ইসলামের জিহাদ কর্মসূচীতে কখনোই দেখা যায় না যে , কোন নির্দিষ্ট সময়ের বিদ্যমান যুদ্ধাস্ত্রের (যেমন : তরবারী দিয়ে যুদ্ধ) উপর নির্ভর করতে। বরং সামগ্রিকভাবে এ নির্দেশ দেয় যে , শত্রুদের মোকাবিলায় শক্তি সঞ্চয় কর যাতে নিজেদের অধিকার রক্ষা করতে পার এবং তাদের বিরুদ্ধে জয়ী হতে পার। এটি একটি সামগ্রিক নীতি যা সকল প্রকার অগ্রগতির সাথে সামঞ্জস্য পূর্ণ এবং সর্বকালের জন্যে দিক নির্দেশনা। অন্যান্য কর্মসূচীর ক্ষেত্রেও এরূপ অবস্থা বিদ্যমান।

৩.অচলাবস্থা ও জরুরী ক্ষেত্রে ইসলামের জরুরী আইন , অক্ষতি আইন (কায়েদায়ে লা যারার) ও অসংকীর্নতা আইন (কায়েদেয়ে লা হারায) ইত্যাদি আইন১০৯ বিদ্যামান যেগুলোর মাধ্যমে যে কোন প্রকার সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। তাছাড়া ইমাম ও মহানবী (সা.) উত্তরাধিকারী এবং ফতোয়া দানকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে অচলাবস্থার সময় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে পারেন।

৪.ইসলামের কর্মসূচী অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বিস্তৃততর। ইসলামে আইনগত , অর্থনৈতিক , সামরিক শিষ্টাচারগত ইত্যাদি বিষয়গুলো উন্নততর প্রক্রিয়ায় বর্ণিত হয়েছে। আর এ বিষয়গুলোর উপর মুসলিম পণ্ডিতগণ সহস্র সহস্র কিতাব লিখেছেন যেগুলোর উৎস ছিল কোরআন , রাসূলের এবং তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের বক্তব্যসমূহ।

উপরোক্ত বিষয়গুলোর আলোকে প্রত্যেক জ্ঞানী ব্যক্তিই অনুধাবন করতে পারে যে ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা যা সর্বদা মানুষের প্রয়োজনে ইতিবাচক সারা দিতে পারে। ফলে এমতাবস্থায় কোন নতুন দীন বা নবীর কোন প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে না।

কোরআনের দৃষ্টিতে নবুওয়াতের পরিসমাপ্তি

ইসলামের পরিপূর্ণতা ও হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে নবুওয়াতের পরিসমাপ্তি সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে বর্নিত হয়েছে। এখন আমরা এগুলোর কিছু নমুনা তুলে ধরব :

) وتمّت كلمة ربّك صدقا و عدلا لا مبدّل لكلماته وهو السّميع العليم(

সত্য ও ন্যায়ের দিক দিয়ে তোমার প্রতিপালকের বাণী সম্পূর্ণ এবং তাঁর বাক্য পরিবর্তন করবার কেউ নেই , তিনি সর্বশ্রোতা , সর্বজ্ঞ ( সূরা আনআম : ১১৫)।

) ماكان محمّد ابا احد من رجالكم ولكم رسول الله وخاتم النّبييّن(

মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যে কোন পুরুষের পিতা নয় , বরং সে আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী (সূরা আহযাব : ৪০)।

খাতাম (خاتم ) শব্দটি ت এর উপর ফাতহা (যবর )অথবা কাছরা (যের ) সহ যখন কোন বহুবচন বিশিষ্ট শব্দের সাথে যুক্ত হবে , তবে তার অর্থ হবে শেষ । তাহলে উল্লিখিত আয়াতে খাতামান্নাবিয়্যিন১১০ (خاتم النبين ) -এর অর্থ হলো আখিরান্নাবিয়্যিন (اخيرالنبين ) অর্থাৎ শেষ নবী। আর নবী শব্দটি রাসূল শব্দের চেয়ে ব্যাপক১১১ (যা রাসূলকে ও সমন্বিত করে)

অতএব , সমস্ত পয়গম্বরগণই নবী ছিলেন। সুতরাং উল্লিখিত আয়াতে যে বলা হয়েছে মুহাম্মদ খাতামান্নাবিয়্যিন অর্থাৎ মুহাম্মদ (সা.) নবীদের সর্বশেষ নবী এবং তার পর না কোন নবী আসবে , না কোন রাসূল কিংবা না কোন কিতাবের অধিকারী ; না অন্য কেউ।

) انّ هذا القران يهدي للّتي هي اقوم(

এই কোরআন সর্বশ্রেষ্ঠ পথ নির্দেশ করে। নিঃসন্দেহে এমতাবস্থায় অন্য কোন কর্মসূচীর প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে না ( সূরা ইসরা : ৯) ।

হাদীসের দৃষ্টিতে নবুওয়াতের পরিসমাপ্তি

খাতামিয়্যাতের ব্যাপারটি ইসলামী সনদসমূহে এতটা বর্ণিত হয়েছে যে , ইসলামী বিশ্বাসমূহের একটি সুস্পষ্টতর বিষয় বলে পরিগণিত হয়।

এখন আমরা এর কিছু নমুনা সূধী পাঠকবৃন্দের জন্যে তুলে ধরব :

১.স্বয়ং মহানবী (সা.) বলেন : জেনে রাখ , আমার পর কোন নবী আসবে না এবং আমার শরীয়তের পর অন্য কোন শরীয়ত নেই। (মোস্তাদরাক , ২য় খণ্ড , পৃ. ২৬২)

২.ইমাম বাকের (আ.) বলেন : মহান আল্লাহ্ তোমাদের কিতাবের মাধ্যমে সকল কিতাবকে ও তোমাদের নবীর মাধ্যমে সকল নবীর শেষ রেখা ও যবনিকা টেনেছেন (উসূলে কাফি , ১ম খণ্ড , পৃ. ১৭৭)।

৩.আলী (আ.) বলেন : মহান আল্লাহ্ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সকল রাসূলের পর পাঠিয়েছেন এবং তাঁর মাধ্যমেই ওহীর পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন (নাহজুল বালাগা )।

৪.মহানবী (সা.) আলী (আ.) বলেন : আমার সাথে তোমার সম্পর্ক মূসার সাথে হারুনের সম্পর্কের মত , পার্থক্য শুধু এটুকু যে , আমার পর কোন নবী আসবে না (কামিল , ইবনে আসির , ২য় খণ্ড , পৃ. ২৭৮)।

৫.হযরত রেযা (আ.) বলেন : হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শরীয়াত কিয়ামত পর্যন্ত বিলুপ্ত হবে না এবং অনুরূপ কিয়ামত পর্যন্ত তার পর আর কোন নবী আসবেন না (উয়ূনু আখবারুর রেযা , ২য় খণ্ড , পৃ. ৮০)।

এছাড়া অন্যান্য অসংখ্য হাদীস বিদ্যমান যেগুলো হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর খাতামিয়্যাত ও ইসলামের চিরন্তনতার এবং ইসলামের পরিপূর্ণতা ও সত্যতার প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করে।

এ দীনের বিষয়বস্তুর পূর্ণাঙ্গতা ও সমুন্নত ভাবার্থ এবং এর বিধানের বিস্তৃতি ও ব্যাপকতা , এর চিরন্তনতা ও নিত্য নতুনতার নিশ্চয়তা প্রদান করে , যার ফলে তা কিয়ামত পর্যন্ত অব্যহত থাকবে।

অতএব , কতই না উত্তম যে , সে দীন ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্যে চেষ্টা করব এবং সকলকে এ পরিপূর্ণ ও সামগ্রিক দীন থেকে লাভবান হতে আহবান করব।

হাদীসে গাদীর এবং হযরত মুহম্মদ ( সা .)- এর স্থলাভিষিক্তি

রাসূল (সা.) আল্লাহর ঘর থেকে বিদায় গ্রহণ করলেন

হিজরী সনের দশম বর্ষ এবং হজের মৌসুম। হেজাযের মরুভূমি বিশাল জনসমষ্টির সাক্ষী যাদের সকলেই একই ধ্বনি দিতে দিতে একই লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছেন।

ঐ বৎসর হজের দৃশ্যে এক অন্যরকম উদ্দীপনা এবং উত্তেজনা বিরাজ করছিল। মুসলমানেরা অধীর আগ্রহে এবং দ্রুতবেগে পথের দু ধারে বাড়ী ঘর পেরিয়ে মক্কায় উপস্থিত হচ্ছিলেন।

মক্কা মরু প্রান্তরের লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ধ্বনি কানে আসছিল। কাফেলা সমূহ পালাক্রমে শহরের নিকটবর্তী হচ্ছিল। হাজীগণ ইহরামের লেবাস পরে একই বেশে ধূলামেখে অশ্রু ঝরিয়ে আল্লাহর নিরাপদ হারামে উপস্থিত হচ্ছিলেন। আর যে গৃহ (কাবা) তৌহীদের মহান দৃষ্টান্ত হযরত ইবরাহীম (আ.) কতৃক নির্মিত তার চার পাশে তাওয়াফ করছিলেন।

ফরিদ ওয়াজদী দশম হিজরীতে অংশগ্রহণকারী হাজীদের সংখ্যা ৯০ হাজার বর্ণনা করেছেন১১২ কিন্তু কোন কোন বর্ণনায় ১২৪০০০ বলা হয়েছে।১১৩

রাসূল (সা.) দেখতে পেলেন : মসজিদুল হারাম পূর্ণ এবং সকলেই এই আয়াত অনুসারে

انّما المو منون اخوة নিশ্চয় প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তি একে অপরের ভাই ; ভ্রাতৃত্বের সাথে ফেরেশতগুণে গুণান্বিত হয়ে ইবাদতে মশগুল।

রাসূল (সা.) খুশী হলেন যে তিনি এ বৃহৎ কার্য সম্পাদন করতে পেরেছেন এবং তাঁর রেসালতের দায়িত্বকে উত্তম ভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছেন।

কিন্তু মাঝে মধ্যেই দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা তাঁর চেহারায় দৃশ্যমান হতো এবং আনন্দকে তাঁর জন্য অপ্রীতিকর করে তুলত।

তিনি ভয় পেতেন যে , তার মৃত্যুর পর হয়ত জনতার এ সমষ্টি ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়বে এবং তাদের মধ্যকার ভ্রাতৃত্ববোধ এবং ঐক্য লোপ পাবে ও পুনরায় অধঃপতিত হবে।

রাসূল (সা.) খুব ভাল করেই জানতেন যে , মুসলিম উম্মাহর জন্য এক ন্যায়পরায়ণ ও জ্ঞানী ইমামের পথ নির্দেশনা অতি জরুরী। আর এমনটি না হলে তাঁর দীর্ঘ দিনের মূল্যবান শ্রম বৃথা যাবে।

এ কারণেই মহানবী (সা.) যখনই সফর অথবা যুদ্ধের জন্যে মদীনার বাইরে যেতেন , এমনকি সে সফর সংক্ষিপ্ত হলেও তিনি বিশ্বস্ত এবং যোগ্য ব্যক্তিকে দায়িত্ব অর্পণ করতেন এবং মদীনার জনগণকে অভিভাবকহীন রেখে যেতেন না।১১৪

সুতরাং কিরূপে বিশ্বাস করা সম্ভব যে , আমাদের প্রিয় ও সদয় নবী (সা.) বিশাল মুসলিম উম্মাহকে নিজের মৃত্যুর পর অভিভাবকহীন রেখে যাবেন। আর তিনি সবার চেয়ে ভাল জানেন যে এই পদমর্যাদার যোগ্য ব্যক্তি কে এবং খেলাফতের পোশাক কোন যোগ্য ব্যক্তির মাপে কাটা ও সেলাই করা হয়েছে।

তিনি সেই ব্যক্তি যাকে বহু সংখ্যক কুরাইশ সর্দার ও রাসূল (সা.)-এর আত্মীয়দের মাঝে ইসলামের দাওয়াতের জন্য যাদেরকে একত্রিত করা হয়েছিল , তাদের মাঝে নিজের উত্তরাধিকারী হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন।১১৫

তিনি পবিত্র ও একত্ববাদী ছিলেন। তিনি বিন্দুমাত্র শিরক ও মূর্তি পূজা করেন নি।

তিনি দীনে মুবিনে ইসলামের অগ্রগতির ক্ষেত্রে ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। তাঁর জ্ঞানের ভিত্তি রাসূল (সা.)-এর জ্ঞানের উৎস থেকেই। মজলুমের ডাকে সাড়া দান তাঁর উত্তম বিচার কার্যেরই অন্তর্ভূক্ত।১১৬

তিনি সবার নিকট পরিচিত। তিনি হলেন হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (আ.)।

পবিত্র হজ পালন করে সকলে আপন শহর অভিমুখে যাত্রা করেন। হঠাৎ রাসূল (সা.) (গাদীরে খুম নামক স্থানে) সকল হাজীদেরকে যাত্রা বিরতির নির্দেশ দেন। কেননা জিবরাইল (আ.) অবতীর্ণ হলেন এবং এই আয়াতটি তাঁকে জানালেন :

) يا ايهّا الرّسول بلّغ ما انزل اليك من ربّك وان لّم تفعل فما بلّغت رسالته والله يعصمك من النّاس(

হে রাসূল! তোমার প্রভুর নিকট হইতে তোমার প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে তা (লোকদের নিকট) পৌঁছিয়ে দাও এবং যদি তুমি এরূপ না কর তাহলে তুমি তাঁর বাণী আদৌ পৌঁছালে না। নিশ্চয় আল্লাহ্ আপনাকে মানুষের কবল হতে রক্ষা করবেন (মায়েদা : ৬৭)।

যে বিষয়টি আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলকে কড়া ভাষায় খেতাব করেছিলেন , তা ছিল আলী (আ.)-এর খেলাফতকে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রচার করা। রাসূল (সা.) বিষয়টি প্রচারে বিরত থাকছিলেন , কেননা ভয় পেতেন বিষয়টি মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও ফাটলের কারণ হতে পারে। তিনি তা প্রচারের জন্য অনুকূল পরিবেশের প্রতীক্ষায় ছিলেন। আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পর তিনি অনুধাবন করলেন এখনই উপযুক্ত সময়। আর এই লক্ষ্যেই জনগণকে গাদীরে খুম নামক ধুধু মরুভূমিতে একত্রিত করলেন , যার মাধ্যমে ইসলামের প্রাণ অর্থাৎ খেলাফত ও উত্তরাধিকারের ব্যাপারটি সম্পূর্ণরূপে স্পষ্ট হয়ে যায়।

জনগণ বুঝতে পারছিলেন না যে কেন থামতে বললেন এবং কী এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ঘটেছে। কিন্তু কিছু সময় না যেতেই যোহরের নামাজের জন্য আহবান করা হলো এবং নামাজ আদায় করার পর জনগণ রাসূল (সা.)-এর আকর্ষণীয় এবং আসমানী চেহারাকে মিম্বরের উপর (যা উটের হাউদায দিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছিল) দেখতে পেলেন।

সর্বত্র নিস্তব্ধ অবস্থা বিরাজ করছিল এমন সময় রাসূল (সা.)-এর মনোরম ও অর্থবহ বাণী মরুভূমির নিস্তব্ধতার অবসান ঘটাল। আল্লাহর প্রশংসার পর নিজের আসন্ন মৃত্যুর মর্মান্তিক খবর ঘোষণা করে বললেন :

হে লোক সকল! আমি তোমাদের জন্য কেমন নবী ছিলাম ? সকলে সমস্বরে বলল : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আমাদেরকে সদুপদেশের ক্ষেত্রে কিঞ্চিত অবহেলা করেন নি। উপদেশ ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে উপেক্ষা করেন নি। আল্লাহ্ আপনাকে উত্তম পুরস্কার দান করুন (আপনি উত্তম রাসূল)। রাসূল (সা.) বললেন : আমার পর আল্লাহর কিতাব (কোরআান) ও পবিত্র মাসুমগণ (আমার আহলে বাইত) একত্রে তোমাদের পথ প্রদর্শক। তোমরা যদি এই দু টিকে দৃঢ় ও পরিপূর্ণ ভাবে আকড়ে ধর তাহলে কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না।

অতঃপর আলী (আ.)-এর হস্ত মোবারককে এমন ভাবে উচ্চে তুলে ধরলেন যে উপস্থিত সকলেই তাকে দেখতে পেলেন এবং বললেন :

লোকসকল! কোন সে ব্যক্তি যে মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের থেকে ও বেশি শ্রেয় এবং তাদের উপর বেলায়েত ও আধিপত্য রাখেন ?

জনগণ বললেন : আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলই ভাল জানেন।

রাসূল (সা.) বললেন : আল্লাহ্ হলেন আমার মাওলা (অভিভাবক) আর আমি মুমিনদের মাওলা এবং তাদের উপর তাদের নিজেদের চেয়েও বেশি অধিকার রাখি। অতঃপর বললেন : আমি যার মাওলা এবং যার প্রতি বেলায়েত ও আধিপত্ব রাখি। এই আলীও আমার পর তাদের মাওলা।

من كنت مو لاه فهذا علي مولاه

এই বাক্যটিকে তিনবার আবৃতি করলেন। সবশেষে বললেন : এখানে উপস্থিত সকলে এ সত্য অন্যদের কাছে পৌঁছে দিবে।

জনগণ তখনো বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েনি এমতাবস্থায় এ আয়াতটি অবতীর্ণ হলো :

) اليوم اكملت لكم دينكم واتممت عليكم نعمتي ورضيت لكم الا سلام دنيا(

আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামতকে (অনুগ্রহকে) সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দীনরূপে মনোনীত করলাম (মায়েদা : ৩)।

আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তরাধিকারী মনোনীত হওয়ার পর উপস্থিত জনতা মরিয়া হয়ে রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারী হযরত আলী (আ.)-কে মোবারক বাদ জানালেন।

প্রথম যে ব্যক্তি আলী (আ.)-কে মোবারকবাদ জানায় সে হলো আবু বকর , অতঃপর ওমর। তারা এই বাক্যগুলি বলছিল এবং আমিরুল মুমিনিন আলী (আ.)-এর কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিল :

بخ بخ يا علي ابن ابي طالب اصبحت موليئ و مولي كل مومنين و المومنات

শুভ হোক , হে আলী ইবনে আবি তালিব , আজ থেকে আপনি আমার এবং সকল মুসলিম নর-নারীর মাওলা বা নেতা হয়ে গেলেন।১১৭

হাদীসে গাদীরের বর্ণনাকারীগণ

প্রকৃত পক্ষে হাদীসে গাদীরের রাবীর সংখ্যা ১২০ ,০০০। কেননা রাসূল (সা.)-এর নির্দেশ অনুযায়ী সকলেই এই সফরের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসাবে এ হাদীসটি অন্যদের কাছে বর্ণনা করেন।১১৮ আর এ কারণেই মুসলমানদের সর্বস্তরে গাদীরের ঘটনাটি প্রতিবারই নতুন করে জীবিত হয়েছিল।

গাদীরে খুমের ঘটনার প্রায় ২৫ বৎসর পর অর্থাৎ যখন রাসূল (সা.)-এর অধিকাংশ সাহাবীরা ইহধাম ত্যাগ করেছিলেন এবং তাদের মধ্যে অল্প সংখ্যক জীবিত ছিলেন ; আলী (আ.) জনগণকে বললেন : আপনাদের মধ্যে যারা গাদীরে খুমে উপস্থিত ছিলেন এবং রাসূল (সা.)-এর মুখ থেকে হাদীসে গাদীর শ্রবণ করেছিলেন , সাক্ষ্য দান করুন।

ঐ বৈঠকেই ৩০ জন রাবী উঠে দাঁড়িয়ে হাদীসে গাদীর সম্পর্কে সাক্ষ্য প্রদান করেছিলেন।১১৯

মুয়াবিয়ার মৃত্যুর ১ বৎসর পূর্বে (অর্থাৎ ৫৯ হিজরীতে) ইমাম হুসাইন (আ.) বনি হাশেম , আনসার এবং সকল হাজীদেরকে মিনায় একত্রিত করে বক্তৃতার এক পর্যায়ে বললেন : আপনাদেরকে আল্লাহর শপথ করে বলছি , জানেন কি রাসূল (সা.) গাদীরে খুমে আলীকে মুসলিম উম্মাহর নেতা ঘোষণা করেছিলেন এবং উপস্থিত সকলকে তা অন্যদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন ?

সকলে বলল : জী হ্যাঁ।১২০

আহলে সুন্নাতের পণ্ডিতরা তাদের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থসমূহে রাসূল (সা.)-এর ১১০ জন সাহাবী যারা স্বয়ং মহানবীর থেকে হাদীসে গাদীর শুনেছেন এবং অন্যদের কাছে বর্ণনা করেছেন তাদের নাম উল্লেখ করেছেন।১২১ আরও কিছু পণ্ডিতগণ হাদীসে গাদীর এবং গাদীরের ঘটনা সম্পর্কে বিশেষ কিতাবও রচনা করেছেন।১২২

হাদীসে গাদীরের তাৎর্পয

স্পষ্ট দলিল দ্বারা প্রমাণিত হয় যে মাওলা এবং ওয়ালী শব্দের অর্থ হলো মুসলিম উম্মাহর উত্তরাধিকারী ও অভিভাবক এবং অন্য অর্থের সাথে সংগতি রাখে না। এখন নিম্নের বিষয়গুলির প্রতি লক্ষ্য করুন :

১.ইতোমধ্যেই আমরা জেনেছি যে , রাসূল (সা.) হাদীসে গাদীর উপস্থাপন করতে ভয় পাচ্ছিলেন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ না আসা পর্যন্ত তিনি তা ঘোষণা করেন নি।

তাহলে একথা বলা সম্ভব নয় যে হাদীসে গাদীরের উদ্দেশ্য হলো রাসূল (সা.)-এর সাথে আলী (আ.)-এর বন্ধুত্বকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া ? যদি উদ্দেশ্য তাই হতো , তাহলে তা প্রচার করাতে ভয়ের কোন কারণ ছিল না এবং তাতে মুসলমানদের ঐক্য বিনষ্ট হতো না। সুতরাং উদ্দেশ্য খেলাফত ও উত্তরাধিকারীর ব্যাপারই ছিল। আর এ ভীতি বিদ্যমান ছিল যে , এই বিষয়টি প্রচার করলে কিছু সংখ্যক স্বার্থান্বেষী ঔদ্ধ্যত্য প্রকাশ করতে পারে।

২.রাসূল (সা.) মান কুনতু মাওলা ফাহাযা আলীয়ুন মাওলা বলার পূর্বে জনগণের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি নিয়েছিলেন যে , তিনি মুমিনদের নিজেদের অপেক্ষা তাদের উপর অধিক অধিকার রাখেন এবং উম্মতের কর্ণধার। অতঃপর ঐ স্থানকে আলীর জন্যেও নির্ধারণ করলেন এবং বললেন : আমি যার মাওলা আলীও তার মাওলা।

৩.হাসসান ইবনে ছাবেত গাদীরের ঘটনাটিকে রাসূল (সা.)-এর অনুমতিক্রমে কবিতার ভাষায় বর্ণনা করেন এবং রাসূল (সা.) তাতে অনুমোদন দেন। হাসসানের কবিতায় আলী (আ.)-এর খেলাফত ও ইমামতের মর্যদাকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয়েছে কিন্তু ব্যাপক জনসমষ্টির কেউই প্রতিবাদ করেন নি যে কেন মাওলা শব্দের ভুল অর্থ করছ। বরং সকলেই তার প্রশংসা করেছিলেন এবং স্বীকৃতিদান করেছিলেন।

কবিতাটির কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি :

فقاله قم يا علي فا نّني

رضتيك من بعدي اماما وهاديا

فمن كنت مو لاه فهذ وليّه

فكونو له اتباع صر ق عوالي

অর্থাৎ রাসূল (সা.) আলীকে বললেন : ওঠ হে আলী আমার পর তুমিই হলে উম্মতের নেতা ও ইমাম। সুতরাং আমি যার মাওলা এবং যার দীনি ও ঐশী কর্ণধার এই আলীও তার মাওলা এবং অভিভাবক। অতএব , তোমরা সকলেই আলীর প্রকৃত অনুসারী হও।

৪.অনুষ্ঠান শেষে রাসূল (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে নিয়ে একটি তাঁবুর মধ্যে বসলেন এবং সকলকে এমনকি তাঁর স্ত্রীদেরকেও হযরত আলীকে অভিনন্দন জানাতে বললেন এবং তাঁর হাতে বাইয়াত করতে বললেন। আর আমিরুল মুমিনীন হিসাবে হযরত আলীকে সালাম জানাতে বললেন।১২৩ এটা স্পষ্ট যে , এ অনুষ্ঠান শুধুমাত্র তাঁর খেলাফত ও ইমামতের সাথেই সামঞ্জস্যপূর্ণ।

৫.রাসূল (সা.) দু বার বলেছিলেন :هنئوني অর্থাৎ আমাকে অভিনন্দন জানাও। কেননা আল্লাহ তায়ালা আমাকে শ্রেষ্ঠ নবী ও আমার আহলে বাইতকে উম্মতের জন্য ইমাম নির্বাচন করেছেন।১২৪

এসকল দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করার পর হাদীসে গাদীর সম্পর্কে আর কোন রূপ সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না।

শেষ নবী (ছ্বাঃ) ও কোরআন মজীদের অপরিহার্যতা

ইয়াহূদী ও খৃস্টানরা হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)কে আল্লাহর মনোনীত নবী হিসেবে ও কোরআন মজীদকে আল্লাহর প্রেরিত গ্রন্থ হিসেবে স্বীকার করে না। সেই সাথে ইয়াহূদীরা হযরত ঈসা ( আঃ)কেও নবী হিসেবে স্বীকার করে না। এ দু টি ধর্মীয় জনগোষ্ঠী নিজেদেরকে নবী-রাসূলগণের ( আঃ) ও ঐশী কিতাবের অনুসরণকারী বলে দাবী করে থাকে। কিন্তু খৃস্টানরা বিগত প্রায় দুই হাজার বছর কালের মধ্যে এবং ইয়াহূদীরা আরো বেশীকালের মধ্যে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে কোনো নবীর আগমন ও কোনো আসমানী কিতাব নাযিলের দাবী ও প্রয়োজনীয়তাকে বিবেচনায় নেয় নি।

এমতাবস্থায় ইয়াহূদী ও খৃস্টানদের জন্য বিচারবুদ্ধির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কতগুলো প্রশ্নের জবাব প্রদান করা অপরিহার্য বলে মনে করি। প্রশ্নগুলো হচ্ছে :

এক : হযরত ঈসা ( আঃ)-এর পূর্বে বা তাঁর মাধ্যমে কি নবুওয়াতের ধারাবাহিকতা পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়েছে এবং মানুষের কাছে কি ঐশী প্রত্যাদেশের সর্বশেষ ও পূর্ণাঙ্গ প্রত্যাদেশ ঐ সময়ই পৌঁছে গিয়েছিলো ? পৌঁছে গিয়ে থাকলে তা কোথায় ? ইয়াহূদীদের অনুসৃত বাইবেলের পুরাতন নিয়ম অথবা খৃস্টানদের অনুসৃত পুরাতন নিয়ম ও ইনজীল্ হিসেবে দাবীকৃত বাইবেল্-ই কি সেই পূর্ণাঙ্গ ও সর্বশেষ ঐশী কিতাব ? যদি তা-ই হয়ে থাকে তো তাহলে ঐ দুই কিতাবে নবুওয়াতের ধারাবাহিকতার সমাপ্তি ও ঐ দু টি কিতাবের পূর্ণাঙ্গ ও সর্বশেষ ঐশী কিতাব হওয়ার কথা উল্লেখ নেই কেন ? তাহলে সে গ্রন্থকে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে তার মূল ভাষায় অবিকৃত ও সংরক্ষিত রাখা হয় নি কেন ? তেমনি তা সংশ্লিষ্ট নবী বা নবীদের দ্বারা কিতাব হিসেবে সর্বজনীন বিচারবুদ্ধির কাছে প্রত্যয় সৃষ্টিকারী রূপে মুতাওয়াতির্ সূত্রে ও অকাট্য ঐতিহাসিক প্রমাণ্যতা সহকারে আমাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয় নি কেন ? বিচারবুদ্ধির দাবী অনুযায়ী এটা কি সৃষ্টিকর্তার জন্য অপরিহার্য নয় যে , নবুওয়াতের ধারার পরিসমাপ্তি ঘটানোর পর তিনি তাঁর পরিপূর্ণ পথনির্দেশকে যে কোনো প্রকার বিকৃতি ও সংশয়ের হাত থেকে রক্ষা করবেন ?

দুই : নবুওয়াতের ধারাবাহিকতা যদি শেষ হয়ে গিয়ে থাকবে এবং মানবজাতির জন্য আর কোনো নবীর প্রয়োজনীয়তা না থাকবে তাহলে শেষ নবী কে ? তিনি নিজেকে শেষ নবী হিসেবে ঘোষণা করেন নি কেন ? করে থাকলে সে ঘোষণা কোথায় ? তার প্রামাণ্যতাই বা কী ? বাইবেলের পুরাতন নিয়ম নতুন নিয়ম এ উভয় অংশের বিভিন্ন পুস্তকে যে একাধিক মহাপুরুষের আবির্ভাব সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে তা কি নবুওয়াতের ধারাবাহিকতা হযরত ঈসা ( আঃ)-এর পূর্বে বা তাঁর মাধ্যমে সমাপ্ত না হওয়ার প্রমাণ বহন করে না ? তাহলে বাইবেলের বিভিন্ন পুস্তকে যাদের আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে তা কা র বা কা দের সম্বন্ধে ? খৃস্টানদের দাবী অনুযায়ী হযরত ঈসা ( আঃ) যে পারাক্লিতাস্ -এর আগমনের অগ্রিম সুসংবাদ দিয়ে গিয়েছেন তা যদি তাঁর নিজের পুনরাগমন সম্পর্কে হয়ে থাকে (যদিও তা নয় , কারণ , তিনি আমি আসবো বলেন নি) সে ক্ষেত্রে বিগত প্রায় দুই হাজার বছরেও তিনি আসেন নি কেন ? এমতাবস্থায় এ দীর্ঘ সময়ের মানুষদের মধ্যে যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে তাদের পথভ্রষ্টাতার দায়-দায়িত্ব কা র ?

তিন : হযরত ঈসা ( আঃ)-এর পূর্বে বা তাঁর মাধ্যমে যদি নবুওয়াতের ধারাবাহিকতা শেষ না হয়ে থাকবে এবং ঐশী পথনির্দেশও যদি পূর্ণতাপ্রাপ্ত না হয়ে থাকবে , আর যে সব ঐশী পথনির্দেশ ঐ সময় পর্যন্ত অবতীর্ণ হয়েছিলো তা-ও যখন মূল ভাষায় ও অবিকৃতভাবে বর্তমান নেই এমতাবস্থায় কি বিগত প্রায় দুই হাজার বছরেও কোনো নবীর আগমন ও কোনো ঐশী কিতাব নাযিল্ হওয়া অপরিহার্য ছিলো না ?

মানুষের জন্য কোনো অবিকৃত ঐশী পথনির্দেশ মওজূদ থাকবে না অথচ সৃষ্টিকর্তা প্রায় দুই হাজার বছরেও কোনো ঐশী পথনির্দেশ সহ কোনো নবীকে পাঠাবেন না - মানুষের প্রতি এহেন নির্দয়তা প্রদর্শন করা কি পরম পূর্ণতার অধিকারী দয়াময় ও মেহেরবান সৃষ্টিকর্তার পক্ষে সম্ভব ? ঐশী কিতাব বলে দাবী করে কোরআন-পূর্ববর্তী যে সব কিতাব পেশ করা হচ্ছে সেগুলোর অবস্থা যখন (প্রামাণ্যতার অভাব , মূল ভাষায় না থাকা , হ্রাস-বৃদ্ধি ও জঘন্যতার সংমিশ্রণের কারণে) এমন যে , সেগুলোকে ঐশী কিতাব বলে এবং সেগুলোতে নবী হিসেবে উল্লেখকৃত ব্যক্তিদেরকে নবী হিসেবে প্রত্যয়ের সাথে গ্রহণ করা সুস্থ বিচারবুদ্ধির পক্ষে সম্ভব হয় না এমতাবস্থায় নতুন পথনির্দেশ সহ কোনো নতুন নবীর আগমন ছাড়া মানবতার মুক্তির কোনো পথ থাকে কি ?

অবশ্য খৃস্টানরা দাবী করে থাকে যে , খোদার পুত্র যীশূ [হযরত ঈসা ( আঃ)] তাঁর ভক্ত ও অনুসারীদের পাপের বোঝা কাঁধে তুলে নিয়ে শূলে মৃত্যুবরণ করে তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করে গিয়েছেন। কিন্তু সুস্থ বিচারবুদ্ধির কাছে তাদের এ দাবী অগ্রহণযোগ্য , কারণ , তাদের এ দাবী (খোদার পুত্র থাকা) একেশ্বরবাদবিরোধী , অংশীবাদী , অযৌক্তিক , বিচারবুদ্ধিবিরোধী কুসংস্কারাচ্ছন্ন মিথ্যা দাবী। কারণ , খোদার পুত্র থাকার যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে পারা তো দূরের কথা , তারা যেখানে যীশূ নামের কোনো ঐতিহাসিক ঐস্তিত্বকেই বিচারবুদ্ধির কাছে প্রত্যয় সৃষ্টিকারী প্রামাণ্য পন্থায় প্রমাণ করতে সক্ষম নয় , তখন তাঁর মাধ্যমে তাঁর ভক্ত-অনুসারীদের মুক্তির মতো আজগুবী দাবী কী করে বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে ? বিশেষ করে তাদের এ দাবী অত্যন্ত বিপজ্জনক দাবী। কারণ , একজন মানুষ যতোই পাপাচারে নিমজ্জিত হোক , কেবল যীশূকে খোদার পুত্র বলে অন্ধ বিশ্বাস পোষণ করলে এবং তাঁকে ভালোবাসলেই যদি মুক্তি পাওয়া যায় তাহলে দ্বীন-ধর্ম ও খোদার পক্ষ থেকে নবী প্রেরণের কোনো প্রয়োজন ও যৌক্তিকতাই থাকে না। মানুষ আক্ষরিক অর্থে এ বিশ্বাস পোষণ করলে মানুষের হাতে সমগ্র মানব প্রজাতি সহ এ পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতো।

এমতাবস্থায় বিগত প্রায় দুই হাজার বছরে অর্থাৎ খৃস্টীয় প্রথম শতাব্দীর মাঝামাঝিকালের পরে কোনো সময় যদি ঐশী পথনির্দেশ সহ কোনো নবী বা নবীগণ আগমন করে থাকেন তো তিনি বা তাঁরা কে বা কা রা এবং তাঁর বা তাঁদের আনীত ঐশী পথনির্দেশ কোথায় ?

অতএব , এটা নিঃসন্দেহ যে , হযরত ঈসা ( আঃ)-এর আগে বা তাঁর মাধ্যমে নবুওয়াত্ ও ঐশী পথনির্দেশ নাযিলের ধারা শেষ হয় নি। সুতরাং তাঁর পরে কেউ নবুওয়াতের দাবী করলে এবং ঐশী কিতাব বলে দাবী করে কোনো কিতাব পেশ করলে সে দাবী অবশ্যই পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

এ ব্যাপারে বিতর্কের অবকাশ নেই যে , হযরত ঈসা ( আঃ) আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে সমুন্নত লোকে নীত হবার (এবং খৃস্টান ও ইয়াহূদীদের মতে , নিহত হবার) পর বিগত প্রায় দু হাজার বছরে যে সব ব্যক্তি নবুওয়াতের দাবী করেছেন এবং ঐশী কিতাব হিসেবে দাবী করে নতুন কিতাব পেশ করেছেন তাঁদের মধ্যে একমাত্র হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর মধ্যে নবীর গুণাবলী পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান ছিলো এবং একমাত্র কোরআন মজীদেই পূর্ণতম ঐশী গ্রন্থের বৈশিষ্ট্যসমূহ বিদ্যমান রয়েছে।

সর্বজনস্বীকৃত অকাট্য ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) ছিলেন একজন নিরক্ষর ব্যক্তি - যিনি নবুওয়াত দাবী করার পূর্বে দীর্ঘ চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত মক্কাহর জনগণের মাঝে বসবাস করেন এবং সেখানকার সকলের কাছে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি অত্যন্ত সৎ ও উত্তম চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত থাকলেও জ্ঞানী , গুণী , দার্শনিক , সমাজসংস্কারক বা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি অথবা কবি , সাহিত্যিক , বাচনশিল্পী বা বাগ্মী কোনোটাই ছিলেন না। হঠাৎ করে চল্লিশ বছর বয়সকাল থেকে তিনি পরম জ্ঞানে পরিপূর্ণ কোরআন নামে এক কিতাব পর্যায়ক্রমিকভাবে উপস্থাপন করতে শুরু করলেন। কিন্তু তিনি নিজে এ কিতাব রচনার বাহাদুরী দাবী করলেন না , বরং এ কিতাবকে আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কিতাব হিসেবে পেশ করলেন। এ কিতাব স্বীয় ঐশিতার দাবী প্রমাণের লক্ষ্যে এই বলে চ্যালেঞ্জ প্রদান করলো যে , লোকেরা যদি এ কিতাবকে মানুষের রচিত বলে মনে করে তাহলে তারা যেন এর যে কোনো সূরাহর (এমনকি ক্ষুদ্রতম সূরাহর) সমমানসম্পন্ন একটি সূরাহ্ রচনা করে নিয়ে আসে এবং প্রয়োজনে এ কাজের জন্য দুনিয়ার সমস্ত মানুষের কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণ করে। কিন্তু মধ্যম আয়তনের এ কিতাবখানির বক্তব্যের সংক্ষিপ্ততা , রচনাশৈলী , বাগ্মিতা , জ্ঞানগর্ভতা ও পথনির্দেশ এমনই অনন্য যে , আজ পর্যন্ত সে চ্যালেঞ্জ কেউ একক বা যৌথভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয় নি।

এহেন ব্যক্তিকে নবী হিসেবে না মানা এবং এহেন কিতাবকে আল্লাহর কিতাব হিসেবে না মানা সুস্থ বিচারবুদ্ধির অধিকারী কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কেবল অন্ধ বিদ্বেষ অথবা পার্থিব লাভ-লোভ ও প্রবৃত্তির দাসত্বই এ সত্য গ্রহণ করা থেকে কাউকে বিরত রাখতে পারে।

এ মহাগ্রন্থ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)কে শেষ নবী এবং নিজেকে সমগ্র মানবজাতির জন্য অনন্তকালীন পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান ও সকল কিছুর পূর্ণ জ্ঞানের আধার (تبيانا لکل شيء ) বলে উল্লেখ করেছে। অতএব , এ গ্রন্থের নাযিল্ সমাপ্ত হওয়ার ও হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর ইন্তেকালের পরে ক্বিয়ামত পর্যন্ত আর কোনো নতুন ব্যক্তি নবুওয়াতের দায়িত্বে অভিষিক্ত হতে ও নতুন কোনো ঐশী কিতাব নাযিল্ হতে পারে না। এ কারণেই বিগত প্রায় চৌদ্দশ বছরে যে সব ব্যক্তি নবুওয়াত্ দাবী করেছে এবং ঐশী কিতাব হিসেবে দাবী করে কিতাব পেশ করেছে , এমনকি অমুসলিম মনীষীদের নিকটও তাদের সে সব দাবী আদৌ বিবেচনাযোগ্য বলে পরিগণিত হয় নি।

এ প্রসঙ্গে মীর্যা গোলাম আহমদ কাদীয়ানীকে নবী হিসেবে গ্রহণকারী নিজেদের জন্য আহমাদীয়াহ্ পরিচয় গ্রহণকারী ও মুসলিম উম্মাহর কাছে কাদীয়ানী নামে সমধিক পরিচিত ধর্মীয় গোষ্ঠীটির দাবীর অসারতার ওপর অত্যন্ত সংক্ষেপে আলোকপাত করছি।

প্রথমতঃ আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান সম্বলিত গ্রন্থ কোরআন মজীদ নাযিল্ হওয়ার পরে নতুন কোনো পথনির্দেশক ওয়াহীর ও কোনো নতুন নবীর প্রয়োজন নেই। এমতাবস্থায় কোনো নবী প্রেরণ ও কোনো পথনির্দেশক ওয়াহী নাযিল্ করা হবে একটি বাহুল্য কাজ। আর বলা বাহুল্য যে , পরম জ্ঞানময় আল্লাহ্ তা আলা কোনো বাহুল্য কাজ করার মতো দুর্বলতা থেকে মুক্ত।

উল্লেখ্য যে , এখানে ওয়াহী বলতে আমরা পারিভাষিক অর্থে যে পথনির্দেশক ওয়াহী তা-কেই বুঝাচ্ছি - যা লোকদেরকে পথনির্দেশ প্রদানের লক্ষ্যে নবী-রাসূলগণের ( আঃ) নিকট নাযিল্ হতো এবং যা তাঁদের ওপর নবুওয়াতের দায়িত্ব অর্পিত হওয়ার প্রমাণ বহন করে। এ পারিভাষিক অর্থ ছাড়া ওয়াহী শব্দের যে সব আভিধানিক অর্থ রয়েছে , যেমন : প্রাণীকুলের সহজাত প্রবণতা , প্রত্যক্ষ অনুভূতি ( intuition), স্বপ্নযোগে কোনো সত্য জানতে পারা বা কোনো সমস্যার সমাধান লাভ , হঠাৎ করেই কারো মনে কোনো কোনো সমস্যার সমাধান বা গূঢ় সত্য জাগ্রত হওয়া (ইলহাম্) ইত্যাদি - যা শুধু মু মিনের বেলায়ই ঘটে না , অনেক সময় কাফেরের বেলায়ও ঘটে থাকে - তা আমাদের এখানকার আলোচ্য বিষয় নয়।

দ্বিতীয়তঃ কাদীয়ানীরা দাবী করে যে , হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)কে যেহেতু কোরআন মজীদে খাতামুন্নাবীয়্যীন্ অর্থাৎ নবীগণের সীলমোহর বলা হয়েছে সেহেতু তাঁর মোহর ধারণ করে নতুন নবী আগমনের পথ খোলা রয়েছে। কিন্তু তাদের এ কথা দ্বারা হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর পরে নতুন কোনো নবীর আবির্ভাবের সম্ভাবনা প্রমাণিত হয় না। কারণ , হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) নবীগণের সীলমোহর - এ কথার মানে হচ্ছে , তিনি যাদেরকে নবী হিসেবে উল্লেখ করেছেন কেবল তাঁদের নবী হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত ধারণা বা ইয়াক্বীন পোষণ করতে হবে ; এদের বাইরে কারো নবুওয়াত দাবীর সত্যতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়ার কোনোই উপায় নেই।

অতএব , কোরআন মজীদে ও অকাট্যভাবে ছ্বহীহ্ হিসেবে প্রমাণিত হাদীছে যাদেরকে নবী বলে উল্লেখ করা হয়েছে তাঁরা নিঃসন্দেহে নবী। তাঁর পরে নবী হিসেবে আসবেন বলে কতক ব্যক্তির নাম-পরিচয় যদি কোরআন মজীদে উল্লেখ থাকতো বা তিনি বলে যেতেন তাহলে এ ধরনের ব্যক্তিদের আবির্ভাবের পর অবশ্যই তাদেরকে নবী বলে মানতে হতো। কিন্তু এমন কোনো নবীর আবির্ভাব সম্বন্ধে না কোরআন মজীদে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে , না হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করে যান। সুতরাং হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর পরে নতুন কোনো নবীর আবির্ভাবের প্রশ্নই ওঠে না।

কাদীয়ানীরা হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর মোহর ধারণ করে নতুন নবী আগমনের অর্থ বলে দাবী করেছে যে , নতুন নবী হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)কে নবী বলে স্বীকার করবেন। কিন্তু এটা একটা হাস্যস্কর অপযুক্তি। কারণ , এর দ্বারা নতুন নবুওয়াতের দাবীদার ব্যক্তি কর্তৃক হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর সীলমোহর ধারণ করা বুঝায় না , বরং নতুন নবুওয়াতের দাবীদার ব্যক্তি কর্তৃক হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর ওপর নবুওয়াতের স্বীকৃতিসূচক সীলমোহর প্রয়োগ করা বুঝায় - যা থেকে তিনি মুখাপেক্ষিতাহীন।

বস্তুতঃ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)কে নবী বলে স্বীকার করাই যদি কোনো ব্যক্তির নবুওয়াত-দাবীর সত্যতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট হতো তাহলে যে কোনো ভণ্ড-প্রতারকের জন্যই নবী সাজার পথ উন্মুক্ত হয়ে যেতো। কিন্তু বিচারবুদ্ধির নিকট এ ধরনের হাস্যস্কর অপযুক্তির বিন্দুমাত্র গ্রহণযোগ্যতা নেই।

মোদ্দা কথা , যেহেতু কোরআন মজীদের দাবী ও বিচারবুদ্ধির রায় অনুযায়ী হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর আবির্ভাবের পূর্বে নবুওয়াতের ধারাবাহিকতা শেষ হয় নি এবং পূর্ণাঙ্গ , সর্বশেষ ও সংরক্ষিত ঐশী গ্রন্থ নাযিল্ হয় নি , অন্যদিকে তাঁর পরে বিগত প্রায় দেড় হাজার বছরে নবুওয়াতের দাবীদার কোনো ব্যক্তির দাবী ও উপস্থাপিত গ্রন্থ সর্বজনীন বিচারবুদ্ধি ও কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে বিবেচনাযোগ্য বলে পরিগণিত হয় নি , তেমনি স্বয়ং কোরআন মজীদ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)কে সর্বশেষ নবী এবং কোরআন মজীদকে সংরক্ষিত ও পরিপূর্ণ পথনির্দেশ সম্বলিত ঐশী কিতাব হিসেবে দাবী করেছে , তেমনি কোরআনের কোনো সূরাহর সমমানসম্পন্ন কোনো নতুন সূরাহ্ রচনা কোনো মানুষ বা সকল মানুষের পক্ষেও সম্ভব হয় নি সেহেতু হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) ও কোরআন মজীদ সংক্রান্ত এ দাবী গ্রহণ করে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।

দু টি ভিত্তিহীন অভিযোগ

কোরআন-বিরোধীরা , বিশেষ করে খৃস্টান পণ্ডিত ও পাশ্চাত্য জগতের প্রাচ্যবিদগণ কোরআন মজীদের বিরুদ্ধে দু টি অভিযোগ উত্থাপন করে থাকে।

একটি অভিযোগ এই যে , কোরআন তার পূর্ববর্তী আসমানী কিতাব সমূহের তেলাওয়াত্ বাতিল করে দিয়েছে এবং ঐ সব কিতাবের কতক বিধিবিধান পরিবর্তন করে দিয়েছে। তাদের মতে , কোরআন যদি আল্লাহর কিতাবই হবে তাহলে ইতিপূর্বে আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কিতাব সমূহের তেলাওয়াত্ বাতিল ও কতক বিধান পরিবর্তন করবে কেন ? তাদের দ্বিতীয় অভিযোগ হচ্ছে , কোরআনে কতক স্ববিরোধী কথা আছে ; আল্লাহর কিতাব হলে তাতে স্ববিরোধী কথা থাকবে কেন ?

তাদের উত্থাপিত প্রথম অভিযোগের দু টি অংশ : পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের তেলাওয়াত্ বাতিল করা হলো কেন এবং কতক বিধানে পরিবর্তন সাধন করা হলো কেন ?

বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে তাদের এ অভিযোগ বিবেচনাযোগ্য নয়। কারণ , প্রথমতঃ পূর্ববর্তী ঐশী কিতাব সমূহে একদিকে যেমন ব্যাপকভাবে বিকৃতি ঘটেছে - যা তারা নিজেরাও স্বীকার করতে বাধ্য , অন্যদিকে তা মূল ভাষায় বর্তমান নেই। ক্ষেত্রবিশেষে মূল ভাষা থেকে হারিয়ে যাবার পর অন্য ভাষার অনুবাদ থেকে পুনরায় মূল ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সুতরাং মূল ভাষায় যেভাবে নাযিল্ হয়েছিলো সেভাবে না থাকায় এবং মূল ভাষায় থাকা বা না-থাকা প্রশ্নে বিতর্কের অবকাশ থাকলেও এবং কোনো কোনেটি যদি মূল ভাষায় বর্তমান থেকেও থাকে তথাপি সেগুলোতে আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কথার সাথে মানুষের কথা মিশ্রিত হওয়ার ফলে ঐ সব কিতাবের কথাগুলো আর আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কথা নেই। সুতরাং সেগুলো আর পবিত্র ঐশী বাণী হিসেবে তেলাওয়াতযোগ্য নেই।

দ্বিতীয়তঃ ঐ সব কিতাবের বিকৃতি কেবল তার পাঠ ( text)-এর পঠন - পাঠনের মধ্যেই ঘটে নি , বরং বিধি - বিধানের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। অন্যদিকে ঐ সব কিতাবের কোনোটিই স্থান ও কাল নির্বিশেষে সমগ্র মানবজাতির জন্য নাযিল্ হয় নি , বরং মানবসভ্যতার বিকাশের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর জন্য ভিন্ন ভিন্ন নবী - রাসূল প্রেরণ করা হয় এবং তাদের জন্য নাযিলকৃত কিতাব সমূহে কতক স্থায়ী বিধানের পাশাপাশি কতক বিধান শামিল করা হয়েছিলো একান্তভাবেই তাদের নিজস্ব ও সাময়িক প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে। এছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর অপরাধের শাস্তি হিসেবে বা তাদের ঈমান ও আনুগত্য পরীক্ষার লক্ষ্যেও কতক বিধান নাযিল্ করা হয়েছিলো।

বলা বাহুল্য যে , স্থান ও কাল নির্বিশেষে ক্বিয়ামত্ পর্যন্ত সমগ্র মানবজাতির জন্য অনুসরণীয় ঐশী বিধান হিসেবে সেগুলোর কোনোই কার্যকরিতা ছিলো না। অবশ্যঃ সন্দেহ নেই যে , ঐ সব গ্রন্থের সবগুলো ঐশী বিধানই স্থান-কাল ও গোষ্ঠীর জন্য নাযিলকৃত সাময়িক বিধান ছিলো না এবং যে সব স্থায়ী বিধান ছিলো তার সবগুলোই যে বিকৃত হয়ে গিয়েছিলো তা নয় ; কতক বিধান অবশ্যই অবিকৃত অবস্থায় র য়ে গিয়েছে। কিন্তু স্থান-কাল ও বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে ক্বিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় বিধান হিসেবে কেবল ঐ বিধানগুলোই যথেষ্ট ছিলো না , বরং আরো অনেক বিধানের প্রয়োজন ছিলো। এমতাবস্থায় সামগ্রিক বিধানের গ্রন্থ হিসেবে ঐ সব গ্রন্থের ব্যবহার হতো এক ধরনের জটিলতা সৃষ্টিকারী কাজ এবং নতুন নাযিলকৃত গ্রন্থের পাশাপাশি ঐ সব গ্রন্থের ব্যবহারের কোনোই উপযোগিতা ছিলো না। এ কারণেই ঐ সব গ্রন্থের স্থায়ী বিধানগুলোকে কোরআনের অন্তর্ভুক্ত করে পুনরায় নাযিল্ করা বা স্বয়ং হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর বিধানিক আচরণের মাধ্যমে অব্যাহত রাখাই (যেমন : খাৎনাহর বিধান) যথেষ্ট ছিলো। [স্মর্তব্য যে , কোরআনের ঘোষণা অনুযায়ী হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) কোরআনের বাইরে যে সব নীতিগত , আইনগত বা শিক্ষণীয় তথা নবুওয়াতের দায়িত্বসংশ্লিষ্ট যে সব কথা বলতেন তার কোনোটিই তাঁর প্রবৃত্তি থেকে বলতেন না , বরং আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত ওয়াহী হিসেবে বলতেন - যাকে ওয়াহীয়ে গ্বায়রে মাত্লূ (পঠন-অযোগ্য ওয়াহী) বলা হয়।]

পূর্ববর্তী আসমানী কিতাব সমূহে প্রদত্ত বিভিন্ন বিধিবিধান এবং সে সব কিতাবের আয়াত্ ভুলিয়ে দেয়া বা সে সবের তেলাওয়াত রহিত করে দেয়ার বিরুদ্ধে ইয়াহূদী ও খৃস্টানদের উত্থাপিত আপত্তির জবাবে আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন :

) م َا نَنْسَخْ مِنْ آيَةٍ أَوْ نُنْسِهَا نَأْتِ بِخَيْرٍ مِنْهَا أَوْ مِثْلِهَا(

আমি কোনো আয়াতকে তার চেয়ে অধিকতর উত্তম বা তার অনুরূপ (আয়াত্) আনয়ন ব্যতীত কোনো আয়াত্ রহিত করে দেই না বা ভুলিয়ে দেই না। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : 106)

এ প্রসঙ্গে আমরা ইতিপূর্বে ক্বিয়ামত পর্যন্ত স্থান-কাল নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য সর্বশেষ স্থায়ী বিধান দিতে গিয়ে পূর্ববর্তী কতক বিধিবিধানে রদবদল সাধনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছি। এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন যে , কতক বিধিবিধান হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কাজ বা বস্তুর প্রকৃতিগত অনিবার্য দাবী। এরূপ ক্ষেত্রে বিধান অপরিবর্তিত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। উদাহরণস্বরূপ , যে সব কাজ বা খাদ্য-পানীয় মানুষের জন্য শারীরিক , মানসিক , নৈতিক , চারিত্রিক বা আত্মিক ক্ষতি ডেকে আনে তা অবশ্যই হারাম হওয়া উচিত এবং এ কারণে প্রথম মানুষ হযরত আদম ( আঃ) থেকে শুরু করে শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) পর্যন্ত সকল নবী-রাসূলের ( আঃ) শরী আতেই তা হারাম ছিলো। যেমন : মিথ্যা বলা , চুরি-ডাকাতি , যেনা , নরহত্যা , মাদক দ্রব্য সেবন ইত্যাদি।

কিন্তু অন্য অনেক বিধানের ক্ষেত্রগুলো এমন যে , এ সব ক্ষেত্রে বিধানের জন্য কোনো প্রাকৃতিক মানদণ্ড নেই , ফলে স্থান-কাল নির্বিশেষে অভিন্ন বিধান হওয়া অপরিহার্য নয়। এ সব ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা আলা চাইলে কোনো বিধানকে স্থায়ীভাবেও দিতে পারেন , আবার চাইলে কোনো বিধানকে অস্থায়ীভাবেও দিতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ , ইবাদত-বন্দেগী সংক্রান্ত বিধি-বিধান - যা দ্বারা আল্লাহ্ তা আলার প্রতি বান্দাহর আনুগত্য পরীক্ষা করাই উদ্দেশ্য। যেমন : ইবাদত দৈনিক কতো বার ও কোন্ নিয়মে করতে হবে তার কোনো প্রাকৃতিক মানদণ্ড নেই ; আল্লাহ্ তা আলা যেভাবে চান বান্দাহ্কে সেভাবেই তা আঞ্জাম দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা আলা বিভিন্ন নবীর সময় বিভিন্ন ধরনের হুকুম দিলে তা তাঁর অধিকার।

অনুরূপভাবে সামাজিক বিধি-বিধান এবং অপরাধের শাস্তি বা দণ্ডবিধানেরও কোনো প্রাকৃতিক মানদণ্ড নেই। এ সব ক্ষেত্রেও আল্লাহ্ যখন যেভাবে চান হুকুম দিতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ , আল্লাহ্ তা আলা যদি যেনার শাস্তি চাবূকের একশ ঘা নির্ধারণ না করে দু বা পঞ্চাশ ঘা নির্ধারণ করে দিতেন তাহলেও কারো কিছু বলার ছিলো না।

এছাড়া আল্লাহ্ তা আলা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে পরীক্ষা করার বা শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে অস্থায়ী বিশেষ বিধান নাযিল্ করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ বানী ইসরাঈলের জন্য শনিবারের বিধান ও চর্বি ভক্ষণ হারাম করার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।


3

4

5

6

7

8

9

10

11