বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)9%

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 87 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 16419 / ডাউনলোড: 4114
সাইজ সাইজ সাইজ
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য

সমাজে নৈতিক চরিত্রের (আখলাকের) প্রয়োজনীয়তা

জ্ঞান ও শিল্পের যত বিকাশ ঘটবে নৈতিক চরিত্রের প্রয়োজনীয়তা ততই বৃদ্ধি পাবে। এর সমন্তরালে রাসূল (সা.)-এর নির্দেশাবলীকে বাস্তবায়ন করা একান্ত জরুরী। কেননা জ্ঞান ও শিল্পের বিশ্ব শুধুমাত্র যন্ত্রপাতি এবং উপায় উপকরণকে মানুষের কাছে পৌছে দিচ্ছে। কিন্তু তা থেকে অন্যায় সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ রোধের কোন নিশ্চয়তা দিতে পারছে না।

অপরাধ , অত্যাচার , দুর্নীতি , খুন , দুষ্কর্ম , আত্মহত্যা ইত্যাদির বিস্তৃতি এই সত্যের জ্বলন্ত প্রমাণ। নৈতিক চরিত্র যা আল্লাহর রাসূলগণের একটি বিশেষ দিক , যদি তা সমাজে প্রতিষ্ঠা না পায় তাহলে জ্ঞান ও বিজ্ঞান মানুষের কল্যাণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবেনা। বরং স্বৈরাচারীরা জ্ঞান বিজ্ঞানকে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থে কাজে লাগাচ্ছে এবং কোটি কোটি মানুষকে গৃহহীন করছে। যেমনটি আমাদের চোখের সামনে ঘটছে! তারা দুর্বল রাষ্ট্র সমূহের অধিকারকে পদদলিত করছে এবং তাদেরকে রক্তাক্ত করছে।

শুধুমাত্র প্রকৃত নৈতিক চরিত্রই মানুষের ঔদ্ধত্য মনোভাব , প্রবৃত্তির তান্ডব এবং পাপাচার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আর এর মাধ্যমেই জ্ঞান-বিজ্ঞানকে সার্বিক শান্তির পথে এবং শান্তিপূর্ণ জীবনের পথে পরিচালিত করতে পারে , যা হলো প্রকৃত ঈমান আর তার উৎস হলো মহান আল্লাহ তায়ালা ।

নবিগণের নৈতিক শিক্ষা ও তাঁদের আচরণই হলো উত্তম উপায় , যা মানুষকে এক আদর্শ জীবন দান করতে পারে। নৈতিক চরিত্র প্রতিটি মানুষের জন্য একান্ত প্রয়োজন আর তা ব্যক্তি জীবনেই হোক অথবা সামাজিক জীবনে। তবে সমাজের নেতৃত্ব ও হেদায়েত যাদের উপর অর্পিত হয়েছে তাঁদের জন্য (নৈতিক চরিত্র) অতি জরুরী। কেননা

প্রথমতঃ যিনি সমাজের শিক্ষক তাঁকে অবশ্যই নৈতিক চরিত্রের আদর্শ এবং মনুষ্য বৈশিষ্ট্যে উৎকৃষ্ট হতে হবে। তাহলেই তিনি অন্যদের অন্তর থেকে নৈতিক কলুষতাকে ধুয়ে ফেলতে পারবেন।

আর যদি তিনি নিজেই এ মূল্যবান সম্পদ (চরিত্র) থেকে বঞ্চিত হন , কখনোই পরিপূর্ণ সাফল্য অর্জন করতে পারবেন না।

দ্বিতীয়তঃ সমাজকে হেদায়াত করার দায়িত্ব এতই কঠিন যে , নৈতিক চরিত্র সম্পন্ন ব্যক্তি ব্যতীত তা বহন করতে পারবে না। এ কারণেই আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবিগণকে এমন ব্যক্তিদের মধ্য হতে নির্বাচন করেছেন যারা ছিলেন সমুন্নত ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন , সহিষ্ণু এবং সকল প্রকার নৈতিক চরিত্রের অধিকারী। আর এ চরিত্র নামক অস্ত্রের মাধ্যমেই তারা বিশৃঙ্ক্ষলায় নিমজ্জিত সমাজসমূহে পরিবর্তন সাধন করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং কলুষিত ও বঞ্চিত জনগণকে মুক্তি দিয়েছিলেন।

পবিত্র কোরআনে রাসূল (সা.) সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে :

) فبما رحمة من الله لنت لهم و لو كنت فظا عليظ القلب لا نفضوا من حولك(

অর্থাৎ আল্লাহর দয়ায় তুমি তাদের প্রতি কোমল হৃদয় হয়েছিলে ; যদি তুমি রূঢ় ও কঠোর চিত্ত হতে তবে তারা তোমার নিকট হতে সরে পড়ত ১২৫

মহানবী (সা.)-এর উত্তম চরিত্রই ইসলামের পবিত্র বিপ্লবের ঢেউয়ের মাধ্যমে সর্ব প্রথম আরব সমাজে অতঃপর সমগ্র বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে। আর এই মহান আধ্যাত্মিক বিপ্লবের মাধ্যমে বিক্ষিপ্ততা ঐক্যে রূপান্তরিত হয়। বেপরোয়া (বেহায়াপনা) সচ্চরিত্রতায় রূপান্তরিত হয়। বেকারত্ব শ্রমে রূপান্তরিত হয়। স্বার্থপরতা সমষ্টির হিতাকাঙ্ক্ষায় রূপান্তরিত হয়। অহংকার , বিনয় ও ভালবাসায় রূপান্তরিত হয়। আর এর মাধ্যমে এমন সকল ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠে ছিল যারা সর্বকালের জন্য নৈতিক চরিত্রের আদর্শ হিসাবে পরিগণিত হয়ে আসছেন। রাসূল (সা.)-এর চরিত্র এতই উত্তম ও মূল্যবান ছিল যে , আল্লাহ তায়ালা তাঁকে মহান চরিত্র বলে উল্লেখ করেছেন :

) وانّك لعلي خلق عظيم(

তুমি অবশ্যই মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত ১২৬

সর্বসাধারণের মধ্যে মহানবী (সা.)

ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মহান রেসালত ও নেতৃত্বের মর্যাদার অধিকারী। কিন্তু সমাজে তাঁর জীবনযাপন ও ওঠা-বসা এতই সাধারণ ছিল যে , যদি সাহাবাদের সাথে একত্রে বসে থাকতেন ; অপরিচিত কেউ সেখানে উপস্থিত হলে প্রশ্ন করতে বাধ্য হতো যে , আপনাদের মধ্যে কে মুহাম্মদ (সা.)।১২৭

দুনিয়া তাঁকে অহংকারী করতে পারেনি এবং তিনি দুনিয়ার বাহ্যিক চাকচিক্যে কখনও আকৃষ্ট হননি। বরং সচ্চরিত্র এবং সংযমী দৃষ্টিতে সেদিকে দৃষ্টিপাত করতেন।১২৮

রাসূল (সা.) সর্বদা সংক্ষেপে অথচ গভীর তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলতেন এবং কখনোই অন্যের কথার মধ্যে কথা বলতেন না।১২৯

কথা বলার সময় চেহারা বিকৃত করতেন না এবং কখনোই কর্কশ ও জটিল বাক্য ব্যবহার করতেন না।১৩০

যখনই শ্রোতাদের সম্মুখে দাঁড়াতেন দাম্ভিকের ন্যায় বক্র চোখে দৃষ্টিপাত করতেন না।১৩১

যখনই কোন সভায় প্রবেশ করতেন , খালি জায়গা পেলে সেখনেই বসে পড়তেন। এমনটি ছিলনা যে জলসার অগ্রভাগেই বসবেন।১৩২

কাউকে তাঁর পায়ের সামনে দাঁড়াতে দিতেন না , তবে সকলকে তিনি সম্মান দেখাতেন। কিন্তু পরহেজগারদেরকে তিনি বেশি সম্মান করতেন।১৩৩

মহানবী (সা.) শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যেই ক্রোধান্বিত হতেন এবং তাঁর জন্যেই সন্তুষ্ট হতেন। যখন সওয়ার অবস্থায় থাকতেন কাউকে তাঁর সাথে হেঁটে আসার অনুমতি দিতেন না। চাইলে তাকেও সওয়ার করিয়ে নিতেন আর তা না হলে একটি নির্দিষ্ট স্থানে সাক্ষাতের কথা দিতেন এবং একা যেতেন।

সমষ্টিগতভাবে সফরে গেলে , নিজের কাজ নিজেই করতেন এবং কখনোই কারো বোঝা হতেন না। এক সফরে সাহাবারা বললেন : আমরাই সকল কাজ করব। রাসূল (সা.) বললেন : আমার এবং তোমাদের মধ্যে কোন পার্থক্য থাক তা আমি পছন্দ করিনা। কেননা আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাকে অন্যদের থেকে ভিন্ন দেখতে পছন্দ করেন না। অতঃপর উঠে গেলেন এবং কাঠ সংগ্রহ করলেন।১৩৪

- চুক্তির ক্ষেত্রে সর্বদা বিশ্বস্ততার পরিচয় দিতেন।

- আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করতেন এবং বিনা কারণে তাদের পক্ষপাতিত্ব করতেন না।

- কাউকে অন্যের বিরুদ্ধে বলার অনুমতি দিতেন না। বলতেন : আমি জনগণের সাথে পবিত্র হৃদয়ে কথা বলতে পছন্দ করি।

- রাসূল (সা.) লজ্জার দিক থেকে ছিলেন নজীর বিহীন।

- সহনশীল ও মহানুভব ছিলেন।১৩৫

আনাস ইবনে মালেক (যিনি মহানবীর খাদেম ছিলেন) বলেন :

রাসূল সেহেরী ও ইফতারীর জন্য দুধ সংগ্রহ করতাম। এক রাত্রে রাসূল (সা.)-এর ফিরতে দেরী হতে দেখে মনে করলাম তিনি নিমন্ত্রণে গিয়েছেন এবং সেখানে ইফতার করেছেন আর এই মনে করে দুধটা পান করে নিলাম। কিছুক্ষণ পরই রাসূল (সা.) ফিরে এলেন তার সাথিদের কাছে জিজ্ঞাসা করলাম : রাসূল (সা.) ইফতার করেছেন ? বলল : না।

রাসূল (সা.) যখন ঘটনাটি জানতে পারলেন আমাকে কিছুই বললেন না এবং ক্ষুধা অবস্থায় হাসি মুখে রাত্রি কাটালেন এবং ঐ অবস্থায় রোযা রাখলেন।১৩৬

রাসূল (সা.) নামাজ ও ইবাদত খুব বেশি পছন্দ করতেন কিন্তু যদি লোকজন কোন কাজে আসত তিনি নামাজ সংক্ষিপ্ত করতেন এবং তাদের কার্য সম্পাদন করতেন। তিনি জনগণের প্রয়োজন মিটাতে কোন প্রকার অসম্মতি জানাতেন না।

সকলকেই সম্মান করতেন। ফযিলত ও মর্যাদাকে তিনি ঈমান ও আমলের মধ্যে নিহিত মনে করেন। ধন-দৌলত এবং পার্থিব পদের তোয়াককা করতেন না।

দাসদের সাথে সদয় আচরণ করতেন এবং তাদের সমস্যা সমাধানে সদা সচেষ্ট ছিলেন।১৩৭

মহানবী (সা.)-এর মহত্ব ও মহানুভবতা

যদি কেউ তাঁকে অসম্মান করত তিনি তার প্রতিশোধ নিতেন না। অন্যদের ভুল ও দুর্ব্যবহারকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতেন। তাদের অত্যাচার ও নিপীড়নের বিপরীতে ক্ষমা মহানুভবতা এবং বদান্যতা প্রকাশ করতেন।১৩৮

কুরাইশদের শত অত্যাচার ও নিপীড়ন সহ্য করে ও তিনি মক্কা বিজয়ের পর তাদেরকে ক্ষমা করেছিলেন এবং মুক্তি দিয়েছিলেন।১৩৯

ওহুদের যুদ্ধে ওয়াহশী নামক এক ব্যক্তি রাসূল (সা.)-এর চাচা হযরত হামজাকে শহীদ করেছিল কিন্তু তিনি তাকে ক্ষমা করেছিলেন। অনুরূপভাবে আবু সুফিয়ান ও হিন্দা যারা রাসূল (সা.)-এর প্রতি চরম অবিচার করেছিল তাদেরকেও ক্ষমা করেছিলেন এবং কখনোই প্রতিশোধের চিন্তায় ছিলেন না।১৪০ তবে তিনি এতবেশি দয়াশীল ও ক্ষমাশীল হওয়া সত্ত্বেও যদি কখনো কেউ ইসলামের সীমারেখাকে অতিক্রম করত কোনরূপ নমনীয়তা দেখাতেন না। বরং আল্লাহর বিধান জারি করতেন এবং কারো মধ্যস্থতাকে গ্রহণ করতেন না।

যখন জানতে পারলেন ফাতিমাহ মাখযুমী চুরি করেছে ওসমান বিন যাইদের মধ্যস্থতায় কর্ণপাত করলেন না। বললেন : পূর্ববর্তী গোষ্ঠীসমূহের ধ্বংস ও বিলুপ্তি এ কারণে হয়েছিল যে , তারা সমাজের উচ্চ শ্রেণীর লোকদের উপর শরীয়তের হুকুম জারী করত না। আল্লাহর শপথ! যদি আমার কন্যা ফাতেমা যাহরা এহেন কর্ম করত আমি তার হাত কেটে ফেলতাম।১৪১

মহানবী (সা.) ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা

ইসলামের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) খুব বেশি আতর পছন্দ করতেন।১৪২ তিনি এর পিছনে খাদ্যের চেয়ে বেশি খরচ করতেন।১৪৩ তিনি যে রাস্তা দিয়ে যেতেন তাঁর আতরের সুগন্ধ ছড়িয়ে যেত। পরর্বতীতে কেউ ঐ রাস্তা দিয়ে গেলে বুঝতে পারত যে , রাসূল (সা.) এ পথ দিয়ে গিয়েছেন।১৪৪

রাসূল (সা.) বেশি বেশি মেসওয়াক করতেন।১৪৫ খাবার খাওয়ার পূর্বে ও পরে তার হস্ত মোবারক ধৌত করতেন।১৪৬ ঘর থেকে বাইরে বেরোবার সময় আয়না অথবা পানিতে চেহারা দেখতেন এবং পরিপাটি হয়ে বের হতেন।১৪৭

মহানবী (সা.)-এর ধার্মিকতা ও ইবাদত

প্রিয় নবী (সা.) নামাযকে খুব বেশি ভালবাসতেন এবং গভীর রাত্রে কয়েকবার করে উঠে মেসওয়াক করে নামায পড়তেন।১৪৮ তাঁর প্রভুর প্রার্থনায় এমন ভাবে মশগুল হতেন যে , দীর্ঘসময় ইবাদতে দাঁড়িয়ে থাকতেন। ফলে তাঁর পা ফুলে যেত।১৪৯

তিনি আসমান যমিন , সূর্য দেখে তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতেন এবং বিশেষ করে এ সমস্তও সৃষ্টিকর্তার মর্যাদার বহিঃপ্রকাশ বলে এর প্রতি মনোযোগ দিতেন। তিনি এত বেশি ধর্মপ্রাণ ছিলেন যে , কখনোই দুনিয়ার বাহ্যিক রূপের প্রতি আকৃষ্ট হতেন না।

মহনবী (সা.) সকল চারিত্রিক গুণাবলীতে ছিলেন দৃষ্টান্ত স্বরূপ। তাঁর ধরণ ও পুত পবিত্র চরিত্রকে এই সামান্য লেখনিতে ব্যাপক ভাবে তুলে ধরা অসম্ভব। আমরা যা করতে পারি তা হলো , তাঁর নুরানী চেহারার এক ছায়ামূর্তি গড়তে। যার মাধ্যমে মুসলমানরা (যারা নিজেদেরকে ইসলামের অনুসারী মনে করে) রাসূল (সা.)-এর স্বভাব-চরিত্রকে তাঁদের আদর্শ হিসাবে মনে করেন এবং তাঁর থেকে জীবন-যাপন প্রণালী এবং সঠিক চারিত্রিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন।

যেমনটি পবিত্র কোরআনেও বর্ণিত হয়েছে :

) لقد كان لكم في رسرل الله اسوة حسنة(

নিশ্চয় তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে উৎকৃষ্টতম আদর্শ রয়েছে। ১৫০

আল্লাহর সালাম বর্ষিত হোক তাঁর উপর যিনি ছিলেন উত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ। ফেরেশতা এবং পবিত্র ব্যক্তিদের দরুদ তাঁর উপর বর্ষিত হোক। আমাদের ও আপনাদের সবার দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক তাঁর উপর।

রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারী ও খেলাফত

প্রতিটি মানব সমাজই সমাজের অগ্রগতির জন্য এক নেতা ও অভিভাবকত্বের প্রয়োজনীয়তাকে অনুধাবন করে। আর একারণেই কোন রাষ্ট্রনায়ক মারা গেলে জনগণ আর এক রাষ্ট্রনায়কের প্রয়োজনীয়তাকে অনুধাবন করে , যিনি শাসন ভার নিজ হাতে তুলে নিবেন। কেউই রাজি নন যে সমাজ শাসক ও অভিভাবকহীন থাকুক। কেননা আপনারা জানেন যে সমাজের কাঠামো ভেঙ্গে পড়বে এবং তা বিশৃঙ্ক্ষলা কবলিত হবে।

ইসলামী সমাজ নিজেও এক বৃহৎ মানব সমাজ হিসাবে এ বিষয়টিকে অনুভব করে এবং জানে যে রাসূল (সা.)-এর তিরোধানের পর ইসলাম নেতা বা শাসক চায় যার মাধ্যমে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠিত থাকবে ।

কিন্তু যেহেতু এ প্রয়োজনীয়তার বিভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রতিটি গোষ্ঠীই রাষ্ট্রনায়কের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে নিজেস্ব মতামত রাখেন এবং সে উদ্দেশ্য মোতাবেক বিচার করেন। সে কারণেই কিছু সংখ্যক মুসলমানরা মনে করেন যে , রাষ্ট্রনায়কের দায়িত্ব কেবল মাত্র রাষ্ট্র গঠন করাই। মনে করেন যে , রাসূল (সা.)-এর খেলাফত ও উত্তরাধিকারী নির্বাচনযোগ্য এবং মুসলমানরা নিজেরাই তাদের পছন্দনীয় ব্যক্তিকে রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারী হিসাবে নির্বাচন করতে পারেন।

এর বিপরীতে শিয়া মাযহাবের অনুসারীরা তাত্ত্বিক , দার্শনিক যুক্তির ভিত্তিতে এবং কোরআনের আয়াত ও অসংখ্য হাদীসের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে এ বিষয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন। তারা শাসন কর্তা এবং রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারীর উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনীয়তাকে মানুষের সার্বিক পরিপূর্ণতা হিসেবে মনে করেন এবং বলেন : যে রাষ্ট্রনায়ক এ গুরুদায়িত্ব পালন করতে পারবেন , তিনি হলেন স্বয়ং আল্লাহ্ কর্তৃক নির্বাচিত। তিনি নবিগণের ন্যায় জনগণের পার্থিব ও আধ্যাত্মিক চাহিদাকে সম্পূর্ণরূপে চিহ্নিত করে আল্লাহর প্রকৃত হুকুম অনুসারে তার সমাধান করবেন। আর এর মাধ্যমেই মানুষের প্রকৃত পরিপূর্ণতার এবং সর্বজঈন কল্যাণের পথ সুগম করতে সক্ষম হবেন।

এখন শিয়াদের দৃষ্টিতে রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারীর প্রকৃত উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনীয়তা বিশ্লেষণ করা হবে যার মাধ্যমে এ ব্যাপারটি সুস্পষ্ট হবে যে , কেন রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারী থাকা প্রয়োজন ?

রাসূল (সা.) এর উত্তরাধিকারী থাকার প্রয়োজনীয়তা ও উদ্দেশ্য নবী প্রেরণের উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনীয়তারই অনুরূপ। অথবা এর মাধ্যমেই ঐ মূল উদ্দেশ্যের সফলতা অর্জিত হয়। সার্বিক হেদায়াতের স্থির ও অনিবার্য কারণ অনুযায়ী সৃষ্টির প্রতিটি অস্তিত্বের জন্য অস্তিত্বের পথে তার পরিপূর্ণতার সকল মাধ্যম ও বিদ্যমান , যার মাধ্যমে তার শ্রেণী ও প্রকৃতি অনুযায়ী পূর্ণতা ও কল্যাণের দিকে দিক নির্দেশিত হয়।

মনুষ্য শ্রেণী ও এ বিশ্বজগতের একটি অস্তিত্ব এবং এই চিরন্তন নিয়মের অর্ন্তভূক্ত। অবশ্যই মানুষ সৃষ্টির নিয়মানুযায়ী যা মানুষের পার্থিব ও আত্মিক , শারীরিক ও মানসিক চাহিদানুযায়ী এবং কোন প্রকার ব্যক্তি স্বার্থ ও বিভ্রান্তির ঊর্ধ্বে সুসজ্জিত হয়েছে তার দ্বারা হেদায়াত প্রাপ্ত হবে। আর এর মাধ্যমেই মানুষের ইহ ও পারলৌকিক কল্যাণ নিশ্চিত হয়।

এ কর্মসূচী অনুধাবন করা আকল বা বুদ্ধিবৃত্তির পক্ষে সম্ভব নয়। কেননা মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি বিচ্যুতি , ভ্রান্ত চিন্তা এবং আবেগ থেকে মুক্ত নয়। আর তা এক সার্বিক কর্ম এবং পরিপূর্ণ কর্মসূচী সরবরাহ করতে সক্ষম নয়। বরং অবশ্যই এক নবীর প্রয়োজন যিনি ওহীর মাধ্যমে ঐ পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচী আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত হবেন এবং সামান্যতম বিচ্যুতি ও ভ্রান্তি ছাড়াই মানুষকে তা শিক্ষা দিবেন। আর এর মাধ্যমেই প্রতিটি মানুষের জন্য কল্যাণের পথ সুগম হবে।

এটা স্পষ্ট যে , এই দলিল যেমন জনগণের মধ্যে নবীর প্রয়োজনীয়তাকে প্রমাণিত করে , তেমনি নবীর প্রতিনিধি বা ইমাম হিসাবে এক ব্যক্তির অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তাকেও প্রমাণ করে। যিনি নিখুঁত এ কর্মসূচীকে রক্ষা করবেন এবং কোন প্রকার হ্রাস বৃদ্ধি ছাড়াই তা জনগণকে শিক্ষা দিবেন। তাছাড়া নিজের সঠিক ও সুন্দর আচার-ব্যবহারের মাধ্যমে জনগণকে প্রকৃত পরিপূর্ণতা ও কল্যাণের দিকে পরিচালিত করবেন। কেননা ইহা ব্যতীত মানুষ তার প্রকৃত পরিপূর্ণতায় উন্নীত হতে পারে না। পারেনা তার আল্লাহ্ প্রদত্ত সুপ্ত প্রতিভাকে প্রস্ফুটিত করতে। পরিশেষে এই প্রতিভাসমূহ অব্যবহৃত থেকে যায় এবং অহেতুক হয়ে পড়ে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা এমনটি কখনোই করবেন না। কেননা এটা সঠিক নয় যে , তিনি উৎকর্ষ ও পরিপূর্ণতার প্রতিভা মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করবেন অথচ তা থেকে উপকৃত হওয়ার পন্থা বলে দিবেন না।

ইবনে সিনা তার শাফা নামক গ্রন্থে লিখেছেন : যে খোদা মানুষের ভ্রূ এবং পায়ের নিচের গর্ত যা আপাত দৃষ্টিতে ততটা প্রয়োজনীয় মনে হয় না সৃষ্টি করতে অবহেলা করেননি। এটা হতেই পারেনা যে , তিনি সমাজকে নেতা এবং পথ প্রদর্শক ছাড়াই রেখে দিবেন যা না হলে মানুষ প্রকৃত কল্যাণে উপনীত হতে পারে না।১৫১

একারণেই শিয়ারা বলেন : গায়েবী মদদ অব্যাহত রয়েছে এবং ঐশী জগৎ মর্তজগতের মধ্যে সার্বক্ষণিক সংযোগ বিদ্যমান রয়েছে।

এ যুক্তির মাধ্যমে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে , রাসূল (সা.)-এর উত্তরধিকারী অবশ্যই আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত হতে হবে এবং সর্বপ্রকার গোনাহ ও ত্রুটি থেকে পবিত্র ও মাসুম হতে হবে। যে আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত নয় সে প্রচুর সমস্যার সম্মুখীন হবে এবং সে ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত নয়। ফলে সে মানুষের সঠিক কল্যাণকে চিহ্নিত করতে , প্রকৃত ও সম্পূর্ণ সুরক্ষিত দীন মানুষকে শিক্ষাদিতে অপারগ হয়ে পড়বে , যার মাধ্যমে জনগণ প্রকৃত কল্যাণ লাভ করতে পারে এবং পরিপূর্ণতা অর্জন করতে পারে।১৫২

মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে বলেছেন : মুসলমানদের কর্তব্য হচ্ছে জীবনের সকল বিষয়ে আল্লাহর নির্বাচিত বান্দাগণের অনুসরণ করবে।

) يا ايها الذين امنوا اطيعوا الله واطيعوالرسول واولي الامر منكم(

অর্থাৎ হে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর এবং আনুগত্য কর এই রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা আদেশ দেয়ার অধিকারী (উলিল আমর)১৫৩

এটা স্পষ্ট যে , উলিল আমর যাদের আনুগত্যকে আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলের আনুগত্যের ন্যায় অনিবার্য করেছেন এবং সকল বিষয়ে তাদের আনুগত্য করার নির্দেশ দিচ্ছেন। তাঁরা হলেন আল্লাহর সেই মনোনীত বান্দাগণ যাদের মধ্যে ভুল-ত্রুটি এবং ব্যক্তি স্বার্থের কোন স্থান নেই। তাঁরাই মানুষকে সত্যের দিকে পথ প্রদর্শন করেন। তারা নয় যারা অবিরাম তাদের কথাবার্তা এবং চাল-চলনে হাজারও ভুল করে। তাদের অনুসরণের মাধ্যমে মানুষ হেদায়াত প্রাপ্ত হয়না এবং প্রকৃত পূর্ণতা অর্জন করতে পারে না।১৫৪

রাসূল (সা.) কি তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছিলেন ?

যে রাসূল (সা.) ইসলামকে তাঁর প্রাণের চেয়েও প্রিয় মনে করতেন এবং সকলের চেয়ে ভাল করে জানতেন যে , প্রকৃত ইসলামকে অবশ্যই মনুষ্যজগতে টিকে থাকতে হবে।

কাজেই এটা কল্পনাও করা যায় না যে , তিনি আল্লাহর মনোনীত নিজের প্রকৃত উত্তরাধিকারীকে পরিচয় না করিয়েই মৃত্যুবরণ করবেন। প্রিয় নবী (সা.) তাঁর রেসালতের শুরু থেকেই এ বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। তিনি বিভিন্ন স্থানে তাঁর প্রকৃত উত্তরাধিকারীকে স্পষ্ট ভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।

যে কেউ রাসূলের বাণীসমূহের উপর চিন্তা করলেই বুঝতে পারবে যে , রাসূল (সা.)-এর দৃষ্টি আলী (আ.) ও তাঁর পবিত্র বংশধরের প্রতি ছিল। আর এ বিষয়ে তিনি অন্য কারো উপর দৃষ্টি দেননি।

এখন এ বিষয়ে বর্ণিত রাসূল (সা.)-এর কিছু বাণীর প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব :

১.রাসূল (সা.) ইসলাম প্রচারের প্রথম দিকেই তাঁর আত্মীয়-স্বজনকে মক্কায় একত্রিত করে (দাওয়াতে যুল আশিরাহ) বলেছিলেন : আলী হচ্ছে আমার ওয়াসী এবং উত্তরাধিকারী , অবশ্যই তার অনুসরণ করবে।১৫৫

২.শিয়া এবং সুন্নী পণ্ডিতগণ উভয়েই বর্ণনা করেছেন যে , রাসূল (সা.) জনসম্মুখে কয়েক বার বলেছেন : আমি দুটি অতি মূল্যবান এবং ভারী বস্তু তোমাদের মধ্যে রেখে যাচ্ছি। যদি তোমরা এদের পরস্পরকে দৃঢ় ভাবে আঁকড়ে ধর তাহলে কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না। প্রথমটি হলো আল্লাহর কিতাব কোরআন আর দ্বিতীয়টি হলো আমার ইতরাত ও আহলে বাইত।

কখনোই যেন তোমরা এ দুটি থেকে পিছনে পড়না অথবা অগ্রগামী হয়োনা , কেননা এর মাধ্যমে তোমরা বিপথগামী হয়ে পড়বে।১৫৬

৩.আহলে সুন্নাতের বিশিষ্ট আলেম আহমাদ ইবনে হাম্বল বর্ণনা করেন , রাসূল (সা.) আলীকে বলেছেন : তুমি আমার পর আমার পক্ষ থেকে প্রত্যেক মুমিনের প্রতি বেলায়াতের অধিকারী।১৫৭

৪.পণ্ডিতগণ এবং হাদীস বিশারদগণ সকলেই বর্ণনা করেছেন যে , রাসূল (সা.) তাঁর বিদায় হজ্জে গাদীরে খুম নামক স্থানে লক্ষাধিক মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন : আমার মৃত্যু নিকটে এবং অতি শীঘ্রই আমি তোমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিতে যাচ্ছি। অতঃপর আলী (আ.)-এর দুই হাত উঁচু করে বললেন : আমি যার মাওলা আলীও তাঁর মাওলা।১৫৮

৫.বহু সংখ্যক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে , রাসূল (সা.) বলেছেন : আমার উত্তরাধিকারীরা কুরাইশদের মধ্য থেকে হবে এবং তাদের সংখ্যা ১২ জন। এমনকি কিছু কিছু হাদীসে ইমামগণের বৈশিষ্ট্য এবং তাদের নামও বর্ণিত হয়েছে।

উপরোল্লিখিত উদাহরণসমূহ যার কিছু কিছু রাসূল (সা.) তাঁর মৃত্যুর সময় অথবা জীবনের শেষ বয়সে জনগণের কাছে বলেছেন। এগুলো থেকে স্পষ্ট ভাবে প্রমাণিত হয় যে , রাসূল (সা.)-এর পর কোন মহান ব্যক্তিত্ব মুসলমানদের কর্তৃত্বকে হাতে তুলে নিবেন।


2

3

4

5

6

7

8

9

10

11