পবিত্র কোরআনে হিজাব
)
وَقُل لِّلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوْ آبَائِهِنَّ أَوْ آبَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ أَبْنَائِهِنَّ أَوْ أَبْنَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي أَخَوَاتِهِنَّ أَوْ نِسَائِهِنَّ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُنَّ أَوِ التَّابِعِينَ غَيْرِ أُولِي الْإِرْبَةِ مِنَ الرِّجَالِ أَوِ الطِّفْلِ الَّذِينَ لَمْ يَظْهَرُوا عَلَىٰ عَوْرَاتِ النِّسَاءِ وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِينَ مِن زِينَتِهِنَّ وَتُوبُوا إِلَى اللَّـهِ جَمِيعًا أَيُّهَ الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ(
হে নবী! ঈমানদার নারীদেরকে বলে দাও যে , তাদের চক্ষুদ্বয়কে নিচের দিকে রাখতে (না-মাহরামদের প্রতি তাকানো থেকে নিজের চোখ ফিরিয়ে রাখা) এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করতে আর কখনোই যেন তারা তাদের সৌন্দর্য্যকে প্রকাশ্যে উম্মুক্ত না করে । শুধুমাত্র ঐ পরিমান ব্যতীত যা স্বাভাবিক ভাবেই উম্মুক্ত থাকে । তাদের ওড়না যেন বুকের উপর পর্যন্ত আসে (যাতে করে ঘাড় ও বুক তা দিয়ে ঢেকে যায়) এবং তাদের সৌন্দর্য্যকে যেন উম্মুক্ত না করে , শুধুমাত্র তাদের স্বামী অথবা পিতাগণ (পিতা , দাদা , দাদার বাবা , দাদার বাবার বাবা...) অথবা স্বামীর পিতাগণ (পিতা , দাদা , দাদার বাবা , দাদার বাবার বাবা...) অথবা তাদের নিজেদের পুত্রগণ অথবা তাদের স্বামীদের অন্য স্ত্রীর পুত্রগণ অথবা নিজেদের ভ্রাতা , ভ্রাতুষ্পুত্র , ভগ্নীপুত্র , স্বজাতির নারীগণ , তাদের অধিকারভুক্ত বাঁদী অথবা নির্বোধ ব্যক্তি (অর্থাৎ এমন ব্যক্তি প্রাকৃতিক ভাবেই যার নারীর প্রতি কোন প্রকার আসক্তি থাকে না) অথবা শিশুগণ (এমন শিশু যাদের নারীদের গোপণ অঙ্গ সম্পর্কে কোন প্রকার ধারণাই নেই) ব্যতীত । আর পথ চলার সময় তারা যেন এমনভাবে পা মাটিতে না রাখে যাতে করে তাদের গোপন সৌন্দর্য্য প্রকাশ পেয়ে যায় (অর্থাৎ পায়ে নুপুর দিয়ে জোরে জোরে মাটিতে পা ফেলে হেটে যাওয়া যার শব্দ পুরুষের কানে পৌঁছায়) । হে মু ’ মিনগন! তোমাদের অতীত গোনাহর ব্যাপারে তওবা করো যাতে করে সফলতা লাভ করতে পারো ।
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُل لِّأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِن جَلَابِيبِهِنَّ ذَٰلِكَ أَدْنَىٰ أَن يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ وَكَانَ اللَّـهُ غَفُورًا رَّحِيمًا
হে নবী! তোমার স্ত্রী ও কন্যাগণকে এবং মু ’ মিনদের স্ত্রীগণকে বলে দাও যে , তারা যেন বড় ওড়না (চাদরের ন্যায়) দিয়ে নিজেদেরকে ঢেকে রাখে যাতে তাদেরকে (সম্মানিত বলে) চেনা যায় এবং নিপীড়নের শিকার না হয় । (আর যদি এখন পর্যন্ত তাদের কোন গোনাহ হয়ে থাকে তবে তাদের জানা প্রয়োজন যে) আল্লাহ্ তা ’ য়ালা সর্বদা পরম ক্ষমাশীল ও দয়াবান ।
দ্রষ্টব্য :
1- উপরোল্লিখিত দু ’ টি আয়াতে‘
খুমুর ’ ও‘
জালাবিব ’ এর মধ্যে পার্থক্য :
ক)- খুমুর হচ্ছে খিমারের বহুবচন যার প্রকৃত অর্থ হচ্ছে আবৃত হওয়া বা আবৃত থাকা ইত্যাদি । কিন্তু সাধারণত বড় ওড়নাকে বলা হয়ে থাকে যা দ্বারা নারীরা তাদের মাথা , ঘাড় , গলা ও বুক ঢেকে রাখে । আর জালাবিব হচ্ছে জিলবাবের বহুবচন যার প্রকৃত অর্থ হচ্ছে বড় চাদর অথবা ঢিলা ঢালা পোশাক বিশেষ । অবশ্য এই জিলবাবের আবার বিভিন্ন অর্থ রয়েছে এবং স্থান , কাল , পাত্র ভেদে অর্থের পরিবর্তনও হয়ে থাকে তবে যেটা পরিস্কার তা হচ্ছে এমন কিছু যার মাধ্যমে নারীরা তাদের সম্পূর্ণ শরীরকে ঢেকে রাখতে পারে ।
খ)- উস্তাদ মুতাহহারী (রহ.) এই দু ’ টির পার্থক্যের ব্যাপারে বলেছেন যে : নারীদের জন্য দু ’ ধরনের ওড়না বা চাদরের প্রচলন ছিল যার একটি হচ্ছে ছোট যাকে খুমুর বলা হয়ে থাকে এবং বাড়ীর ভিতরে পরিধানের জন্যে । আর অন্যটি হচ্ছে বড় যাকে জিলবাব বলা হয়ে থাকে এবং তা নিঃসন্দেহে বাড়ীর বাইরে পরিধানের জন্যে ব্যবহৃত হয়ে থাকে । কেননা এই জিলবাব শব্দটি বিভিন্ন রেওয়ায়েতে উক্ত অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে ।
2- নারীদের শরীর জিলবাব (বড় চাদর) দ্বারা আবৃত করার উদ্দেশ্য কী ?
উদ্দেশ্য হচ্ছে এটাই যে , এই জিলবাবের মাধ্যমে নারিগণ তাদের শরীরকে না-মাহরামের দৃষ্টি থেকে দূরে রাখতে পারে । তবে তা যেন তারা তাদের শরীরের সাথে সুন্দর করে আঁকড়ে রাখে , এমন যেন না হয় যে ; তারা বড় চাদর পরেছে ঠিকই কিন্তু শরীরের সাথে তা আঁকড়ে রাখে নি এবং বাতাসে তা এদিক ওদিক উড়ে যাচ্ছে ও তাদের শরীরের আকর্ষনীয় স্থানগুলো সহজেই নজরে পড়ছে । চাদর বা বোরকা পরাটা যদি শুধু নাম মাত্র হয়ে থাকে আর সে কারণে রাস্তা-ঘাটে তাদের সৌন্দর্য্যতা , শরীরের আকর্ষনীয় স্থান , মাথার চুল সব কিছুই প্রকাশিত হয় তবে এ ধরনের চাদর বা বোরকাপরিধানকারিনীকে দুর্বল ঈমানের অধিকারী বলা যায় ।
আবৃত করার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে যে , নারীরা তাদের চাদর বা বোরকা এমনভাবে পরবে যাতে করে তাদের সৌন্দর্য্য ও সম্পূর্ণ শরীর ঢেকে থাকে এবং অসভ্য ও ইতর প্রকৃতির পুরুষরা তাদের শরীরের উপর নজর দেয়া থেকে নিরাশ হয় । আর বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করার লক্ষ্যে নারিগণ যেন চাদর পরার পরও একটি ছোট ওড়না যা তাদের মাথা , ঘাড় , গলা ও বুকের নিচ অংশ ঢেকে যায় পরিধান করবেন । কেননা কখনো যদি ভুলবশত বাতাসে চাদরটি শরীর থেকে সরে যায় সেক্ষেত্রেও যেন তাদের সৌন্দর্য্য প্রকাশ না পায় ।
3- মাহরামদের (যাদের সাথে বিয়ে করা হারাম) সামনে সৌন্দর্য্য প্রকাশ করার ক্ষেত্রেও সীমা রয়েছে যা নিম্নলিখিত আয়াতে এসেছে । আল্লাহ সুবহানাহু তা ’ য়ালা উক্ত বিষয়ে পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন :
)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِيَسْتَأْذِنكُمُ الَّذِينَ مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ وَالَّذِينَ لَمْ يَبْلُغُوا الْحُلُمَ مِنكُمْ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ مِّن قَبْلِ صَلَاةِ الْفَجْرِ وَحِينَ تَضَعُونَ ثِيَابَكُم مِّنَ الظَّهِيرَةِ وَمِن بَعْدِ صَلَاةِ الْعِشَاءِ ثَلَاثُ عَوْرَاتٍ لَّكُمْ لَيْسَ عَلَيْكُمْ وَلَا عَلَيْهِمْ جُنَاحٌ بَعْدَهُنَّ طَوَّافُونَ عَلَيْكُم بَعْضُكُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ اللَّـهُ لَكُمُ الْآيَاتِ وَاللَّـهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ(
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের দাস-দাসীরা(ভৃত্যরা) ও (তোমাদের সন্তানদের মধ্যে) যারা এখনো বালেগ হয় নি তারা তোমাদের ঘুমানোর ঘরে প্রবেশ করার জন্য তিনটি সময়ে অনুমতি নিবে : 1- ফজরের নামাজের আগে , 2- দুপুর বেলা যখন সাধারণত পোশাক খুলে ফেল , 3- এ ’ শার নামাজের পরে । এই বিশেষ তিনটি সময় তোমাদের জন্য , কিন্তু উক্ত তিনটি সময় ব্যতীত তোমাদের উপর কোন গোনাহ্ নেই এবং তাদের উপরেও নেই যদি তারা বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করে । (কারণ) তোমাদেরকে তো একে অপরের কাছে যাতায়াত করতেই হয় এবং তখন আন্তরিকতার সাথে একে অপরকে খেদমত কর । আল্লাহ তা ’ য়ালা এরূপেই তোমাদের জন্য আয়াতসমূহকে বর্ণনা করেছেন । কেননা আল্লাহ তা ’ য়ালা হচ্ছেন সর্বজ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান ।
ফলাফল :
এটা ঠিক যে , পরিবারের সদস্যগণ সকলেই মাহরাম ও স্বাধীন , কিন্তু এই মাহরাম ও স্বাধীন থাকাটাও শর্তহীন নয় । মাহরাম ও স্বাধীন হওয়ার কারণে মা ও মেয়ে যেন সন্তানদের ও ভাইদের সামনে যে কোন পোশাক পরে আসা-যাওয়া না করে । কেননা শরীর অর্ধ প্রকাশ অথবা সম্পূর্ণ প্রকাশ এবং পা অনাবৃত থাকাটা সন্তানদের উপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে যা তাদের কুপ্রবৃত্তিকে উস্কে দিতে পারে । আর এটা বলা ঠিক হবে না যে , তারা তো বাচ্চা কিচ্ছু বোঝে না , বরং এটা অবশ্যই বলা যায় যে , তারা বেশী কৌতুহলী ও উৎসুক এবং এই পরিবেশই হয়তো তাদেরকে যৌন বিষয়ের আগ্রহী করে তুলতে পারে ।
4- যারা রাস্তা ও অলি-গলিতে নারীদের বিরক্ত করে থাকে অবশ্যই তাদের কঠিন শাস্তিপাওয়া উচিৎ , যেমনভাবে নিম্নের আয়াতে উল্লেখহয়েছে :
)
لَّئِن لَّمْ يَنتَهِ الْمُنَافِقُونَ وَالَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ وَالْمُرْجِفُونَ فِي الْمَدِينَةِ لَنُغْرِيَنَّكَ بِهِمْ ثُمَّ لَا يُجَاوِرُونَكَ فِيهَا إِلَّا قَلِيلًا(
যদি মুনাফিকরা ও যাদের অন্তরসমূহ হচ্ছে অসুস্থ এবং যারা মিথ্যা কথা ও অবাস্তব খবর মদীনায় ছড়িয়ে বেড়ায় এবং তারা যদি অপকর্ম থেকে সরে না দাঁড়ায় , তবে অবশ্যই তাদের উপর তোমাকে প্রতিপত্তি দান করবো , অতঃপর অল্প দিনের মধ্যেই তারা আর তোমার পাশে এই শহরে বাস করতে পারবে না ।
সিদ্ধান্ত :
এই আয়াতের ভাষ্য অনুযায়ী এটা পরিস্কার হয়ে যায় যে , মদীনায় তিনটি দল চক্রান্ত করতো এবং প্রতিটি দলই বিভিন্নভাবে ইসলামের উপর আঘাত হানার জন্য পরিকল্পনা করতো । এই তিনটি দল হচ্ছে যথাক্রমে :
1- মুনাফিকরা ।
2- বখাটে ও ভবঘুরেরা ।
3- আর একদল হচ্ছে যারা অবাস্তব খবর প্রচার করতো বিশেষত যখন নবী (সা.) ও তাঁর সাহাবীরা যুদ্ধে যেতেন তখন মদীনায় থাকা অন্যান্য মুসলমানদের মানসিকভাবে দুর্বল করার জন্য তারা এ কাজ করতো ।
আল্লাহ্ তা ’ য়ালা নির্দেশ দিলেন যে , উক্ত দলসমূহের সাথে যেন কঠোর আচরণ করা হয় । এ ধরনের ব্যক্তিদের জন্যে সর্বনিম্ন শাস্তি হচ্ছে তাদেরকে নির্বাসনে পাঠানো যাতে করে ইসলামী সমাজ পবিত্র থাকে । আর শাস্তির পরিমান যত কঠিন হবে ইসলামী সমাজে পবিত্রতা ও নৈতিকতা ততই বৃদ্ধি পাবে এবং এ ধরনের ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যাপারে যতই বিলম্ব করা হবে ইসলামী সমাজের জন্য তা হবে ততই ক্ষতিকর । কেননা এর ফলে ইসলামী সমাজে নৈতিক অনাচার ও পাপের পরিমান বাড়তেই থাকবে । কারণ এ ধরনের ব্যক্তিরা যখনই ইসলামী সমাজে প্রবেশের সুযোগ পায় তখনই ঐ সমাজে ফিতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টির অপচেষ্টা চালায় যাতে করে পর্যায়ক্রমে ভাল ও নীতিবান মানুষ প্রথম কাতার থেকে দূরে সরে যায় । তাকওয়া ও পরহেজগার ব্যক্তিদেরকে এ কারণেই সরিয়ে দিতে চায় যে , তারা যদি সমাজের প্রথম সারিতে অবস্থান করে তবে সে সমাজের অন্যদেরকেও তাদের মতই তৈরী করবে । প্রকৃতপক্ষে ইসলামী হুকুমত তো বিপ্লবী ও মু ’ মিন ব্যক্তিদের সহযোগিতায় টিকে থাকে । আর তারা যদি না থাকে তবে ইসলামী হুকুমত তাদের হাত ছাড়া হবে । কেননা এ ধরনের খারাপ ব্যক্তিরা শুধুমাত্র পেট পুজা ও যৌন সম্ভোগ ব্যতীত অন্য কিছুর ব্যাপারেই চিন্তা করে না । তাই ইসলামী হুকুমতকে টিকিয়ে রাখার জন্য অবশ্যই সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে সৎ ও নীতিবান মানুষের দায়িত্বশীল হওয়া বিশেষ প্রয়োজন ।