একজন মুসলিম নারীর অবশ্যই যা জানা প্রয়োজন

একজন মুসলিম নারীর অবশ্যই যা জানা প্রয়োজন0%

একজন মুসলিম নারীর অবশ্যই যা জানা প্রয়োজন লেখক:
: মীর আশরাফ-উল-আলম
প্রকাশক: আল মুস্তাফা (সা.) আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, কোম-ইরান
বিভাগ: নারী বিষয়ক

একজন মুসলিম নারীর অবশ্যই যা জানা প্রয়োজন

লেখক: মীর আশরাফ-উল-আলম
: মীর আশরাফ-উল-আলম
প্রকাশক: আল মুস্তাফা (সা.) আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, কোম-ইরান
বিভাগ:

ভিজিট: 42953
ডাউনলোড: 4671

পাঠকের মতামত:

একজন মুসলিম নারীর অবশ্যই যা জানা প্রয়োজন
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 87 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 42953 / ডাউনলোড: 4671
সাইজ সাইজ সাইজ
একজন মুসলিম নারীর অবশ্যই যা জানা প্রয়োজন

একজন মুসলিম নারীর অবশ্যই যা জানা প্রয়োজন

লেখক:
প্রকাশক: আল মুস্তাফা (সা.) আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, কোম-ইরান
বাংলা

ইসলাম পূর্ব নারীগণ

ইসলামের ইতিহাসে ঈমানদার , সাহসী , জুলুম বিরোধী অনেক নারী ছিলেন , যাদের সম্পূর্ণ জীবনটাই ছিল আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গকৃত এবং আত্মত্যাগ ও শাহাদাতের চেতনাপূর্ণ তাদের সংখ্যা অনেক কিন্তু আমরা এখানে এরূপ কয়েকজনের কথা উল্লেখ করব :

1- হাযবিল নাজ্জারের (কাঠ মিস্ত্রি) স্ত্রী : এই মহিলার ঘটনাটি হচ্ছে হযরত মুসা (আ.) এর সময়কার । সে হযরত মুসা (আ.)-এর উপর ঈমান আনয়ন করে । ঘটনা বশত: সে ফেরাউনের প্রাসাদে তার কন্যার পরিচর্যার কাজে নিয়োগ প্রাপ্ত হয় । একদিন ফিরআউনের কন্যার চুল চিরুণী দিয়ে আচড়ে দেয়ার সময় তার হাত থেকে চিরুনিটি পড়ে যায় , যেহেতু সে সব সময় আল্লাহর যিকির করতো তাই চিরুনিটি পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে সে বলে উঠল : ইয়া আল্লাহ্! ফেরাউনের কন্যা তাকে জিজ্ঞাসা করলো যে , তোমার ইয়া আল্লাহ বলার উদ্দেশ্য কি আমার বাবা ?

সে বলল : না , বরং আমি এমন কাউকে উপাসনা করি যিনি তোমার বাবাকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে আবার ধ্বংসও করবেন ।

মেয়ে তার বাবাকে উক্ত ঘটনাটি বর্ণনা করলে ফেরাউন তাকে ডেকে পাঠালো । সে উপস্থিত হলে তাকে বলল : আমি যে খোদা এটা তুমি বিশ্বাস কর না ?

সে বলল : না , কখনই নয়! আমি প্রকৃত আল্লাহকে ছেড়ে তোমার উপাসনা করবো না ।

ফেরাউন এই কথায় অত্যন্ত রাগান্বিত হলো এবং সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ দিল আগুনের চুল্লী তৈরী করার এবং তা লাল রং ধারণ করলে ঐ মহিলার সব সন্তানকে আগুনের লেলিহান শিখায় ফেলে দিতে । মহিলার সব সন্তানকে তার চোখের সামনে আগুনে পুড়িয়ে মারা হল । শুধুমাত্র একটি দুধের শিশু তার কোলে অবশিষ্ট ছিল । জল্লাদ তার কোল থেকে ঐ দুধের শিশুটিকেও ছিনিয়ে নিয়ে বলল : তুই যদি মুসার দ্বীনকে অনুসরণ না করিস তাহলে তোর বাচ্চাকে বাচিয়ে রাখবো । দুধের শিশুটির অন্তর ধক-ধক করতে শুরু করলো । মহিলাটি বাহ্যিকভাবে এ কথা স্বীকার করে বলতে চাইল যে , ঠিক আছে কিন্তু হঠাৎ দুধের শিশুটি কথা বলে উঠলো । সে তার মাকে বলল : ধৈর্য ধারণ কর , তুমি সত্যের পথে আছো ।

মহিলাটি তাই করল । অবশেষে ঐ দুধের বাচ্চাটিকেও পুড়িয়ে মারা হল । তারপর তাকেও তারা পুড়িয়ে মারলো । এভাবেই এক সাহসী ও মু মিন মহিলা যতক্ষণ পর্যন্ত জীবিত ছিল বাতিলের কাছে মাথা নত করেনি , বরং বাতিলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে ।

নবী (সা.) বলেন : মি ’ রাজের রাতে একটি স্থান থেকে আকর্ষণীয় এক সুগন্ধ আমার নাকে আসছিল , আমি জিব্রাঈলকে (আ.) জিজ্ঞাসা করলাম যে , এই সুবাস কোথা থেকে আসছে ? জিব্রাঈল আমাকে উত্তরে বলল : এই গন্ধ হাযবিলের স্ত্রী ও তার সন্তানদের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া দেহের থেকে আসছে , যা এই পৃথিবীর সমান্তরাল মহাশূন্যে ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে । আর ঐ স্থান থেকে এই সুগন্ধ কিয়ামতের দিন পর্যন্ত আসতে থাকবে ।34

2- হযরত ইব্রাহীম খালিলুল্লাহ্ (আ.)-এর মা :

এই ঘটনাটি অনেকটা উপরোল্লিখিত ঘটনার মতই । নমরুদ তার অধীনস্থ জ্যোতিষীদের মাধ্যমে জানতে পেরেছিল যে , একটি শিশু জন্মলাভ করে তাকে ধ্বংস করবে । এ কারণে সে (বর্ণনামতে) 77 হাজার থেকে এক লক্ষ শিশুকে হত্যা করে । এমন এক কঠিন পরিস্থিতিতে ইব্রাহীমের (আ.) আত্মত্যাগী মা বিরলভাবে নিজেকে নমরুদের লোক-লস্কর থেকে দূরে রাখতে সক্ষম হন । তিনি প্রসব বেদনা শুরু হলে ঋতুস্রাবের বাহানায় (কারণ তখন নিয়ম ছিল যে , কোন মহিলার ঋতুস্রাব হলে তাকে শহরের বাইরে চলে যেতে হত) শহর থেকে বেরিয়ে গেলেন এবং শহর থেকে অনেক দুরে একটি পাহাড়ের গুহা খুঁজে পেলেন । সেখানেই ইব্রাহীম (আ.) ভুমিষ্ট হন । ক্লান্তিহীন পরিশ্রমী এই মা 13 বছর ধরে নমরুদের লোকজনের চোখ ফাঁকি দিয়ে , কখনো রাতে আবার কখনো প্রত্যুষে সকালে পাহাড়ের ঐ গুহার মধ্যে যেতেন তার সন্তানের সাথে দেখা করতে । এ সময় তিনি গায়েবীভাবেও সাহায্যপ্রাপ্ত হতেন । যেহেতু তিনি আল্লাহর উপর নির্ভর করেছিলেন সেহেতু আল্লাহও তাকে সাহায্য করেছেন । অবশেষে 13 বছর পরে ইব্রাহীম (আ.) খোদায়ী বিশেষ প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত হয়ে সমাজে ফিরে এলেন এবং আস্তে আস্তে মূর্তিপুজকদের সাথে মুকাবিলা করতে শুরু করলেন । আর দিনের পর দিন তিনি সফলকাম হতে থাকলেন ।35

3- হযরত আইয়্যুবের স্ত্রী :

রুহামাহ (রাহিমাহ্) ছিলেন হযরত আইয়্যূবের স্ত্রী এবং হযরত শোয়াইবের কন্যা । তিনি এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন । তার সকল সন্তান বাড়ীর ছাদের নিচে চাপা পড়ে মারা যায় , বাগ-বাগিচা আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যায় , সমস্ত সম্পত্তি এবং গৃহপালিত প্রাণী ধ্বংস হয়ে যায় । এত কিছুর পরে হযরত আইয়্যূব এক কঠিন রোগে আক্রান্ত হন । এমন পরিস্থিতিতে সবাই তাকে সান্তনা দেয়ার বদলে অপমান করলো এই বলে যে , নিঃশ্চয়ই তোমরা গোনাহ্গার ছিলে তাই আল্লাহ তোমাদেরকে এরূপ সাজা দিয়েছেন । সকলেই হযরত আইয়্যূবের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল । আর সে কারণেই তিনি শহর ছেড়ে জঙ্গলে চলে গিয়েছিলেন । অতপর আল্লাহ্ তাদেরকে উত্তম সন্তান দান করেন এবং অবস্থা পুর্বের পর্যায়ে ফিরে যায় ।36

হযরত আইয়্যূবের স্ত্রী আমাদেরকে যে শিক্ষা দেন তা হচ্ছে নিম্নরূপ :

প্রথমত : আল্লাহর নবিগণও বিভিন্ন অবস্থার মাধ্যমে পরীক্ষিত হতে পারেন ।

দ্বিতীয়ত : মু ’ মিনদের চেষ্টা করা উচিৎ এরূপ পরিস্থিতিতে ধৈয ধরে সফলতার সাথে তা থেকে বেরিয়ে আসার ।

তৃতীয়ত : উত্তম স্ত্রী সেই যে , কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও তার স্বামীকে একা ত্যাগ করে না । আর হযরত আইয়্যূবের স্ত্রী ছিলেন তেমনই এক নারী । কারণ তিনি এই কঠিন পরিস্থিতিতেও তার স্বামীকে কোন প্রকার দোষারোপ করেন নি বরং সকল সময় তার পাশে পাশে থেকেছেন এবং এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি লাভের চেষ্টা করেছেন । যদিও পুরুষের দায়িত্ব হচ্ছে হালাল রুটি- রুজীর জন্য কষ্ট করা এবং পরিবারে স্বাচ্ছন্দ আনয়ন করা ।

ইসলাম পূর্ব ইতিহাসে আরো অনেক নারীই ছিলেন যেমন : হযরত শোয়াইবের কন্যাগণ , হযরত মুসা (আ.)-এর মা ও বোন , হযরত মারিয়াম (আ.) , আসিয়া , হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর মা হাজার , নবী (সা.) -এর মা আমেনা , নবী (সা.) -এর দুধ মাতা হালিমা ও আরো অনেকে যাদের নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি ।

ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ের নারীগণ

1- হযরত খাদিজা (আ.) : হযরত খাদিজাহ্ (আ.) প্রথম পর্যায়ে খৃষ্টান ছিলেন । যেহেতু তিনি খৃষ্টানদের বিভিন্ন গ্রন্থে নবী পাক (সা.) সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন এবং অতি নিকট থেকে ঐ মহামানবকে দেখেছিলেন । তাঁর প্রতি ঈমান আনেন এবং তাঁর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । এই মহান নারী আল্লাহ তা ’ য়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সমস্ত সম্পত্তি নবীর (সা.) হাতে সমর্পন করেছিলেন । নবী (সা.) ঐ বিশাল সম্পদকে দ্বীনের প্রচার-প্রসারের কাজে খরচ করেন । হযরত খাদিজাহ্ এ সম্পর্কে বলেন : আমার সম্পত্তি থেকে শুধূমাত্র দু ’ টি ভেড়ার চামড়া অবশিষ্ট ছিল , দিনের বেলা তার উপর ভেড়ার খাবার দিতাম এবং রাতে তা বিছিয়ে শুতাম ।

তিনি শুধুমাত্র তার সম্পদকেই দ্বীনের রাস্তায় দান করেননি বরং নবীকে (সা.) জীবন দিয়েও সাহায্য করেছিলেন । তিনি রাসূলের (সা.) শত দুঃখের সাথি ও সান্ত্বনাদানকারী ছিলেন । তিনি হচ্ছেন ইতিহাসের চারজন শ্রেষ্ঠ রমনীর একজন (যারা বেহেশ্তী নারী হিসেবে পরিচিত) । রাসূলে খোদা (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় কখনই হযরত খাদিজার ভালবাসা ও ত্যাগের কথা ভুলেন নি । আর যখনই তার কথা স্মরণ করতেন তখনই তার উপর দুরুদ পড়তেন ।

2 - প্রথম শহীদ নারী সুমাইয়্যা : সুমাইয়্যা , ইয়াসিরের স্ত্রী ছিলেন । তিনি এবং তার স্বামী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল বলে তাদেরকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল এবং শত্রুপক্ষ তাদেরকে শহীদ করেছিল । তারা সুমাইয়্যাকে বলেছিল : যদি তুমি নবীর (সা.) উপর ঈমান আনা থেকে বিরত না হও তবে তোমার দুই পায়ে দড়ি বেঁধে দুই উটের সাথে বেধে দিব এবং উট দু ’ টিকে দুই দিকে তাড়িয়ে দিব , ফলে তোমার শরীর দু ’ ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে ।

সুমাইয়্যা তাদের কথায় ভয় না পাওয়ায় তারা তাদের উক্ত পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত করলো । তারা শুধু তাকেই নয় বরং তার স্বামীকেও হত্যা করলো । আম্মার ইয়াসির এই দুই মহান ব্যক্তির সন্তান জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত ইসলামের স্বার্থে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন । অবশেষে তিনিও সিফ্ফিনের যুদ্ধে ইমাম আলী (আ.)-এর সৈন্য দলের পক্ষ হয়ে মুয়া ’ বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হন ।37

3 - অন্যান্য নারীগণ : অন্যান্য মহিলাগণ যেমন , লুবাইনিহ্ , যিন্নিরিহ্ , নাহদিয়াহ্ , গাযযিয়াহ্ ও এরূপ আরো অনেকে যাদের নাম ইতিহাসে উল্লেখও হয় নি , ইসলামের প্রাথমিক যুগে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর প্রতি ঈমান আনার ফলে শত্রুর অত্যাচারে শহীদ হন ।38

4- ফাতিমা বিনতে আসাদ (হযরত আলী (আ.)-এর মা) : ফাতিমা বিনতে আসাদের জন্য এই মর্যাদাই যথেষ্ট যে , তিনি পবিত্র কা ’ বা গৃহের মধ্যে আমিরুল মু ’ মিনিন আলী (আ.) -এর মত সন্তানকে জন্মদান করেছেন । কোন মহিলাই এ মর্যাদা পায় নি এবং পাবেও না ।

যখনই নবী (সা.) ক্লান্ত থাকতেন ফাতিমা বিনতে আসাদের বাড়ীতে আসতেন বিশ্রাম নেয়ার জন্য।

যখন তিনি এ দুনিয়া থেকে চির বিদায় নিয়েছিলেন তখন নবী (সা.) কাঁদতে কাঁদতে মৃত দেহের পাশে উপস্থিত হয়ে বলেছিলেন : আল্লাহ্ তাঁকে বেহেশ্তবাসী করুন , তিনি শুধু আলীর মাতাই ছিলেন না বরং আমারও মা (সা.) ছিলেন । রাসূলে খোদা নিজের মাথার পাগড়ি ও আলখেল্লা খুলে দিয়েছিলেন তার কাফন করার জন্য । তার জানাজার নামাযে চল্লিশটি তাকবির বলেছিলেন । তারপর তিনি তার কবরে নেমে কিছু সময় সেখানে অবস্থান করেন এবং ইমাম আলী (আ.) ও ইমাম হাসানকে (আ.) অনুরূপ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন ।

আম্মার নবীকে (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন : কারো জন্যেই তো আপনি এরূপ করেন নি , ফাতিমা বিনতে আসাদের জন্য কেন এরূপ করলেন ?!

রাসূল (সা.) বললেন : তার জন্য এমনটা করাই উত্তম ছিল । কেননা তিনি নিজের সন্তানকে পেট ভরে খেতে না দিয়ে আমার পেট ভরাতেন । তার সন্তানদেরকে খালি পায়ে রাখতেন কিন্তু আমার পায়ে জুতা পরিয়ে দিতেন ।

আম্মার পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন : কেন তার নামাযে চল্লিশবার তাকবির দিলেন ?

তিনি বললেন : তার জানাজার নামাযে ফেরেশতাগণ চল্লিশ কাতারে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে নামায পড়ছিল তাই তাদের প্রত্যেকটি সারির জন্য একটি করে তাকবির বলেছি ।

আর এই যে , আমার মাথার পাগড়ি ও গায়ের আলখেল্লা দিয়েছি তাঁকে কাফন করার জন্য এটার কারণ এই যে , একদিন তাঁর সাথে আমি কিয়ামতের দিনে মানুষের বস্ত্রহীন থাকার ব্যাপারে কথা বলছিলাম , তিনি এ কথা শুনে চিৎকার করে উঠেছিলেন এবং কিয়ামাতের দিনে বস্ত্রহীন থাকার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন । তাই আমার মাথার পাগড়ি ও গায়ের আলখেল্লা দিয়ে তাকে কাফন করিয়েছি , যাতে করে কিয়ামতের দিনে তিনি বস্ত্রহীন না থাকেন আর তা যেন পচে না যায় । যেহেতু তিনি কবরের প্রশ্নের ব্যাপারে অনেক ভয় পেতেন তাই আমি তাকে কবর দেয়ার আগে কিছুক্ষণ তার মধ্যে অবস্থান করেছি । আর এই অবস্থানের ফলে আল্লাহ তার কবরকে বেহেশ্তের একটি অংশে পরিণত করছেন এবং তার কবর এখন বেহেশতের বাগানে পরিণত হয়েছে ।39

5 - চার শহীদের জননী , খানিসা : তিনি একজন অভিজ্ঞ ইসলাম প্রচারক ছিলেন । তিনি তার গোত্রের সকলকে ইসলামের পথে আনতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং অন্যদেরকেও ইসলামের প্রতি দাওয়াত দিতেন । 14 হিজরীতে সংঘটিত কাদিসিয়া যুদ্ধে তিনি তার সন্তানদেরকে ঐ যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন । তার সন্তানদের মধ্যে চারজন শহীদ হয় । তিনি তার সন্তানদের শহীদ হওয়াতে বলেন : আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া , কেননা তিনি তাদের শহীদ হওয়ার মাধ্যমে আমাকে সম্মানিত করেছেন । আরো বলেন : আমার আশা এটাই যে , আল্লাহ্ তা ’ য়ালা আমাকেও তাঁর রহমত ও কৃপা দান করে ধন্য করবেন (অর্থাৎ তাকে শহীদ হওয়ার তৌফিক দান করবেন) ।40

6 - চার শহীদের জননী , উম্মুল বানিন : উম্মুল বানিন ছিলেন ইমাম আলী (আ.)-এর একজন আল্লাহ্ প্রেমিক স্ত্রী । তিনি তার চারজন সন্তান যথাক্রমে : হযরত আব্বাস , আব্দুল্লাহ্ , জা ’ ফার ও উসমান , কারবালায় তাদের ভাই ও নেতা ইমাম হুসাইনের সাথে শাহাদাত বরণ করেন ।

যখন বাশির মদীনায় ফিরে এসে কারবালার ঘটনাকে মসজিদে নববীতে বর্ণনা করছিল তখন উম্মুল বানিন উপস্থিতদের মধ্যে থেকে সামনে (আ.) এসে বললেন : হে বাশির! আমাকে শুধু ইমাম হুসাইন সম্পর্কে বল । আর আমার চার সন্তান খোলা আকাশের নিচে ঘোড়ার পায়ের তলে পিষ্ট হয়েছে তাতে কিছু যায় আসে না , কেননা আমি তাদেরকে ইমাম হুসাইনের জন্য উৎসর্গ করেছি । যখন তিনি বাশিরের মুখে ইমাম হুসাইনের উদ্দেশ্যে শহীদ হয়ে যাওয়ার কথা শুনলেন তখন চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন : আমার অন্তরকে ক্ষত বিক্ষত করে দিয়েছে ।

ইমাম হুসাইনের প্রতি তাঁর এই ভালবাসাই তাঁকে পরিপূর্ণতায় পৌঁছিয়েছে , কেননা তিনি সন্তানদেরকে তাঁর নেতা ও দ্বীনের ইমামকে রক্ষার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন ।41

7- হযরত যয়নাব (আ.) আত্মত্যাগ,ধৈর্য ও দৃঢ়তার প্রতিচ্ছবি :

হযরত যয়নাবের মত এক মহিয়সী নারীর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আমরা কথা বলতে অক্ষম । কেননা তিনি হযরত ফাতিমার (আ.) গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁর হাতে প্রশিক্ষিত হয়েছেন , আর আলী (আ.)-এর মত পিতা ও ইমাম হাসান এবং ইমাম হুসাইনের মত ভাই যার ছিল । তবে আমরা এখানে আমাদের এই ক্ষুদ্র জ্ঞানে যতটুকু সম্ভব তাই উল্লেখ করার চেষ্টা করবো ।

যে সমস্যা ও কষ্ট তার উপর এসেছিল তা যদি কোন পাহাড়ের উপর আসতো তবে পাহাড় ঐ সমস্যা ও কষ্টের ভারে ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে যেত । এই ধরনের এক মহিয়সী নারীর ব্যক্তিত্বকে কয়েকটি দিক থেকে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন ।

ক)- নিজের ইমাম বা নেতাকে সাহায্য করা :

ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি তাকে প্রাণপণে সাহায্য করেছিলেন । ইমাম হুসাইনকে তিনি এত অধিক ভালবাসতেন যে , যখন তাঁর চাচাত ভাই আবদুল্লাহ ইবনে জা ’ ফর তাইয়ার তার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল তখন তিনি তাকে বলেছিলেন যে , আমি একটি শর্তে এ বিয়েতে রাজী হব তা হচ্ছে আমার ভাই হুসাইন যখনই কোন সফরে যাবে আমাকেও তাঁর সাথে যাওয়ার অনুমতি দিতে হবে । যেহেতু আবদুল্লাহ্ও ইমাম হুসাইন (আ.)-এর একজন ভক্ত ছিল তাই সে এ কথা মেনে নিল । হযরত যয়নাব (আ.) ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের পরে , অসুস্থ ইমাম সাজ্জাদের সেবা-শুশ্রুষা করেন । আর যতবারই শত্রুপক্ষ ইমাম সাজ্জাদকে (আ.) হত্যা করতে এসেছিল ততবারই তিনি তাঁকে আগলে রেখেছিলেন এবং শত্রুদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন : যদি তোমরা তাকে হত্যা করতে চাও তবে প্রথমে আমাকে হত্যা কর ।

সাধারণত যে পুরুষ ও নারীই বেলায়াত ও ইমামতের পক্ষে কথা বলেছে তারাই কষ্ট , লাঞ্ছনা ও অপবাদের শিকার হয়েছে । যেমন : হযরত মারিয়ামকে ঈসা (আ.)-এর জন্য ব্যভিচারের অপবাদ দেয়া হয় , হযরত আসিয়া হযরত মূসা (আ.)-কে সাহায্য করতে গিয়ে এবং তাঁর উপর ঈমান আনাতে ফিরাউনের অত্যাচারের শিকার হয়ে শহীদ হন ।

হযরত ইব্রাহীম ও হযরত মূসা (আ.)-কে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তাদের মাতাদের কত কষ্টই না পোহাতে হয়েছিল । রাসূল (সা.) কে সাহায্য করতে গিয়ে হযরত খাদিজাহ (আ.)কতই না কষ্ট পেয়েছিলেন । ইমাম আলী (আ.)-এর ইমামতের পক্ষে কথা বলার কারণে হযরত ফাতিমাকে (আ.) দরজা ও দেয়ালের মধ্যে পিষ্ট হয়ে গুরুতর আহত হয়ে জীবন দিতে হয়েছে । তদ্রূপ ইমাম হুসাইন -কে সাহায্য করতে গিয়ে 55 বছর বয়সে হযরত যয়নাবকেও নিদারুণ কষ্টের শিকার হতে হয়েছে ।

খ)- শহীদদের সন্তানদেরকে দেখা-শুনা করা :

হযরত যয়নাব (আ.) কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনার পরে , অভিভাবকহীন ছোট ছোট বাচ্চাদেরকে দেখা-শুনা করতেন । তিনি নিজে না খেয়ে তাদেরকে খাওয়াতেন । যেহেতু বাচ্চারা তাদের পিতার জন্য কান্নাকাটি করতো , তাই তিনি তাদেরকে খুব বেশী মাত্রায় আদর করতেন এবং সান্ত্বনা দিতেন । আর এ দায়িত্বটি তিনি জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত সুন্দরভাবে পালন করেছিলেন ।

গ)- ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের পর :

ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের পরে , তিনি যেখানেই যেতেন এবং যখনই সুযোগ পেতেন তখনই কারবালার শহীদদের বার্তা পৌঁছে দিতেন এবং জালিম ও অত্যাচারীর বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ করতেন । যদি হযরত যয়নাব না থাকতেন তবে ইসলামের শত্রুরা কারবালার ঘটনাকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতো । তিনি নিজের চেষ্টায় কারবালার জালিম ও অত্যাচারীদের মুখোষ উম্মোচন করেন । আর এই পরিশ্রমের ফলশ্রুতিতে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর আত্মত্যাগ চূড়ান্তে পৌঁছায় । যদি তাঁর উৎসর্গতা ও সাহসিকতা না থাকতো তাহলে শত্রুরা ইমাম সাজ্জাদ (আ.) -কে হত্যা করতো এবং ইসলামের অস্তিত্বকে বিলীন করে দিত । প্রকৃতপক্ষে ইমাম হুসাইন (আ.) শত্রুর বিরুদ্ধে কিয়াম করেছিলেন আর হযরত যয়নাব (আ.) ঐ কিয়ামের ধারাকে টিকিয়ে রেখেছিলেন ।

ঘ)- হযরত যয়নাবের সাহসিকতা :

ফাসেক , অভিশপ্ত , মদখোর ও লম্পট ইবনে যিয়াদ তার প্রাসাদে বসে ছিল এবং ইমাম হুসাইন (আ.) -এর কাটা মাথাটি তার সামনে রাখা ছিল । সে হযরত যয়নাবকে (আ.) বলল : তোমার ভাইয়ের সাথে আল্লাহ্ যা করলেন তা কেমন দেখলে ? তিনি জবাবে বললেন

ﻣﺎﺭﺍﻳﺖ ﺍﻻ جمیلا আমি সুন্দর ছাড়া অন্য কিছু দেখি নি ।42 কেননা নবীর বংশধর এমন এক পরিবার যাদের জন্য আল্লাহ শাহাদাতকে মর্যাদা স্বরূপ করেছেন । আর তাঁরা স্বেচ্ছায়ই এ পথকে বেছে নিয়েছেন ।

হযরত যয়নাব এই কথার মাধ্যমে ইবনে যিয়াদকে এমনভাবে অপমান করলেন যে , যাতে করে সে তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা নেয় ।

হযরত যয়নাব (আ.) শামে (সিরিযায়) ইয়াযিদের প্রাসাদে তাকে দারুণভাবে অপমান করলেন । তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন : তুমি মনে করছো যে , আমাদেরকে বন্দী করে তোমার সম্মান বেড়েছে , তা নয় তারপর বললেন : আমি তোমাকে অনেক নীচ ও হীন মনে করি ।43

তিনি এই কথাটি ইয়াযিদকে এমন এক সময় বললেন যখন তাঁর এবং অন্যান্য বন্দীদের নিহত হওয়ার আশংকা ছিল । এমন কথা একজন নারীর পক্ষে ইয়াযিদের মত জালিম , অত্যাচারী , মদখোর , লম্পট লোকের সামনে কথা বলা কোন সহজ ব্যাপার নয় । হযরত যায়নাব তাকে এত বড় কথা বলার অর্থ এই যে , তিনি এমন এক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলেন যা বুঝার ক্ষমতা আমাদের নেই ।

ঙ)- হযরত যয়নাবের ইবাদত :

কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনায় তার 6 জন ভাই যথা : ইমাম হুসাইন (আ.) , আব্বাস , জা ’ ফার , উসমান , আবদুল্লাহ্ ও মুহাম্মদ শহীদ হয়ে যাওয়া ছাড়াও তার দুই সন্তন আউন ও মুহাম্মদ এবং তার ভাইয়ের সন্তানগণ যথা : আলী আকবার , কাসিম , আবদুল্লাহ সহ চাচাত ভাইদের শহীদ হওয়ার ঘটনাকে স্বচক্ষে দেখেছিলেন । আর এদিকে ছোট ছোট শিশুরা উমর ইবনে সা ’ দ ও তার মত অপবিত্র লোকদের হাতে অত্যাচারিত হচ্ছিল এবং যে কোন সময় ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর শহীদ হওয়ার আশংকা ছিল এরূপ কঠিন মুসিবতের সময়ও অর্থাৎ মুহররমের 10 তারিখের দিবাগত রাতেও তিনি তাহাজ্জুতের নামায আদায় করেন ।