ইসলামের দৃষ্টিতে নারীর অধিকারসমূহ
নারীর দেনমোহর :
আল্লাহ্ তা’
য়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন :
)
وَآتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً(
নারীর দেনমোহরকে যা তার উপহার স্বরূপ এবং শুধুমাত্র তারই প্রাপ্য তা তাকে দাও ।
অন্যত্র আল্লাহ তা’
য়ালা বলেছেন :
)
وَآتَيْتُمْ إِحْدَاهُنَّ قِنطَارًا فَلَا تَأْخُذُوا مِنْهُ شَيْئًا(
যদি অনেক বেশী পরিমানেও দেনমোহর হিসেবে ¯ স্ত্রীকে দিয়ে থাক তা থেকে কিয়দংশও নিও না ।
যখন ইউরোপ ও অন্যান্য দেশগুলো নারীদের কোন অধিকার দানের ব্যাপারে চিন্তাও করতো না এবং তাদের ব্যাপারে ছিল সম্পূর্ণরূপে উদাসীন তখন মহান ধর্ম ইসলাম তাদের জন্য দেনমোহরের ব্যবস্থা করে । আর এই দেনমোহরের সম্পূর্ণটাই হচ্ছে তাদের এবং তারা এ ব্যাপারে যা ভাল মনে করবে তাই করবে তাতে কেউ বাধা দিতে পারবে না ।
স্ত্রীদের দেনমোহরের উপর ইসলাম এতই গুরুত্বারোপ করেছে যে , অবশেষে এ ব্যাপারে নির্দেশ দিয়ে বলেছে : যদি কোন ব্যক্তি কোন মহিলার সাথে শুধু আক্বদ করে এবং ঐ আক্বদ আনুষ্ঠানিকতার পর্যায় পর্যন্ত না পৌঁছায় (অর্থাৎ সংসার শুরুর এবং দৈহিক সম্পর্ক হওয়ার আগেই আলাদা হয়ে যাওয়া) তথাপিও সে যেন ঐ মহিলাকে অর্ধেক দেনমোহর প্রদান করে ।
রাসূল (সা.) বলেছেন :ﻣﻦ ﻇﻠﻢ ﺍﻣﺮﺍﺓ ﻣﻬﺮﻫﺎ ﻓﻬﻮ ﻋﻨﺪ ﺍﷲ ﺯﺍﻥ
-যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর উপর দেনমোহরের ক্ষেত্রে জুলুম করে (তা না দিতে চেয়ে তার উপর অত্যাচার করে অথবা দিতে গিয়ে তাকে কষ্ট দেয়) এই ব্যক্তি আল্লাহর কাছে ব্যভিচারী হিসেবে চিহ্নিত হবে ।
জাহেলিয়াতের যুগে সমাজে একটি খারাপ অভ্যাস বিদ্যমান ছিল তা হচ্ছে মহিলাদেরকে বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করা হত যাতে করে তারা দেনমোহর ব্যতীতই তালাক নিয়ে নেয় । এটা তখনই হত যখন কোন মহিলার দেনমোহরের পরিমান অনেক বেশী থাকতো । কিন্তু ইসলাম এই ধরনের কাজকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ।
আল্লাহ্ তা’
লায়া পবিত্র কোরআনে বলেছেন :
)
وَلَا تَعْضُلُوهُنَّ لِتَذْهَبُوا بِبَعْضِ مَا آتَيْتُمُوهُنَّ إِلَّا أَن يَأْتِينَ بِفَاحِشَةٍ مُّبَيِّنَةٍ وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ فَإِن كَرِهْتُمُوهُنَّ فَعَسَىٰ أَن تَكْرَهُوا شَيْئًا وَيَجْعَلَ اللَّـهُ فِيهِ خَيْرًا كَثِيرًا(
যা তোমরা দেনমোহর হিসেবে নির্দিষ্ট করেছো তার একটি অংশকেও নিজেদের হস্তগত করার জন্য তাদের উপর অত্যাচার - জুলূম করোনা ; তবে যদি তারা প্রকাশ্যে কোন অশ্লীল কাজ করে থাকে ভিন্ন কথা এবং তাদের সাথে উপযুক্ত ব্যবহার কর । আর যদি তাদেরকে কোন কারণে অপছন্দ করো তবে সঙ্গে সঙ্গে আলাদা হয়ে যাওয়ার চিন্তা করো না , কেননা এমনও তো হতে পারে তোমরা যেটা অপছন্দ করছো আল্লাহ হয়তো তার মধ্যে অনেক ভাল কিছু নিহিত রেখেছেন ।
নারীর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব :
ইসলাম পুরুষের উপর নারীর ভরণ-পোষণকে ওয়াজিব (ফরজ) করেছে , যেমন তার খোরাক , পোশাক , থাকার ব্যবস্থা ইত্যাদি । যদি কোন নারীর অনেক সম্পদ ও নিজস্ব আয়ের উৎস থাকে তথাপিও ঐ নারীর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তার স্বামীর উপর থাকবে ।
মুহাম্মদ ইবনে মুসলিম বলেন ইমাম সাদিক (আ.)-কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে : একজন পুরুষের উপর কাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব রয়েছে ? ইমাম সাদিক (আ.) জবাবে বললেন : পিতা-মাতা , স্ত্রী ও সন্তান ।
নারীর উত্তরাধিকার :
ইসলাম নারীর জন্য সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ধারণ করেছে । যদি উত্তরাধিকারী হিসেবে একজন পুত্র ও একজন কন্যা সন্তান থাকে তবে কন্যা পুত্রের অর্ধেক সম্পত্তি পাবে । আবার কখনো কখনো মেয়েরা অর্ধেকের থেকেও বেশী পেয়ে থাকে যেমন যদি কোন মৃত পিতা অথবা মাতার একটি মাত্র সন্তান থাকে এবং ঐ সন্তান যদি মেয়ে হয় সেক্ষেত্রে চার ভাগের এক ভাগ পাবে মা অথবা বাবা আর চার ভাগের তিন ভাগ পাবে ঐ মেয়ে । আবার কখনো কখনো মেয়ে সম্পূর্ণ সম্পত্তিরই ভাগিদার হয় যেমন মৃতের মেয়ে ব্যতীত অন্য কোন উত্তরাধিকার না থাকে ।
স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকেও চার ভাগের এক ভাগ সম্পত্তি পেয়ে থাকে যদি তাদের কোন সন্তান না থেকে থাকে । আর যদি সন্তান থেকে থাকে তবে আট ভাগের এক ভাগ পাবে ।
মা আবার তার সন্তানদের কাছ থেকে ছয় ভাগের এক ভাগ সম্পত্তি পেয়ে থাকে । কোন কোন ক্ষেত্রে এর থেকেও বেশী পেয়ে থাকে ।
এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে ইসলাম নারীদের জন্য উত্তরাধিকার নির্ধারণ করেছে । নারিগণ কয়েকদিক থেকে সম্পত্তি পেয়ে থাকে যেমন : মেয়ে হিসেবে বাবার কাছ থেকে , মা হিসেবে সন্তানদের কাছ থেকে এবং স্ত্রী হিসেবে স্বামীর কাছ থেকে ।
নারীর অধিকার নিশ্চিত করা :
জাহেলিয়াতের যুগে এটা রেওয়াজ ছিল যে , শুধুমাত্র পুরুষকেই সবাই উত্তরাধিকারী হিসেবে মনে করতো । আর এটায় বিশ্বাসী ছিল যে , যারা অস্ত্র হাতে নিজের আত্ম-সম্ভ্রম রক্ষার লক্ষ্যে যুদ্ধ ও প্রতিরোধ করার ক্ষমতা রাখে তারাই হচ্ছে উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পত্তি পাওয়ার যোগ্য । আর যারা তা পারবে না তারা উত্তরাধিকারী হওয়া সত্বেও সম্পত্তি পাবে না । আর এই দলিলের ভিত্তিতে নারিগণকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতো এবং মৃতের সম্পত্তিকে পুরুষদের মধ্যে বণ্টন করে দিত । অনেক দূরের পুরুষ আত্মীয়-স্বজনও এই সম্পত্তির ভাগ পেতো । ইসলাম সম্পত্তি বণ্টনে এই ভুল প্রক্রিয়ার তীব্রভাবে বিরোধিতা করে এবং নারী ও শিশুদের যোগ্য অধিকার যা অন্যরা অন্যায়ভাবে ভোগ করছিল তাদের হাত থেকে ছিনিয়ে প্রকৃত পাওনাদারের হাতে অর্পণ করছে । এ পর্যায়ে পবিত্র কোরআন বলেছে :
)
لِّلرِّجَالِ نَصِيبٌ مِّمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ وَلِلنِّسَاءِ نَصِيبٌ مِّمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ مِمَّا قَلَّ مِنْهُ أَوْ كَثُرَ نَصِيبًا مَّفْرُوضًا(
পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনদের রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে যেমন পুরুষের অংশ রয়েছে তেমনি পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজদের রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে নারীরও অংশ রয়েছে । তা সে যতই কম বা বেশী হোক না কেন । আর এই অংশ তাদেরকে দেয়াটা হচ্ছে ওয়াজিব (ফরজ) ।
জাহেলি যুগের আরো একটি অন্যায় প্রথা ছিল যে , তখনকার পুরুষরা অসুন্দরী বয়স্ক ধনী মহিলাদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হত এবং পরবর্তীতে বিয়ের পূর্বেকার অবস্থায় রেখে দিত অর্থাৎ না তাদেরকে স্ত্রীর মর্যাদা দিত না তাদেরকে তালাক দিত । এ কাজের অর্থ হচ্ছে তারা শুধুমাত্র দিন গুনতো যে , কবে তারা মৃত্যুবরণ করবে । কারণ তারা মৃত্যুবরণ করলেই স্বামী হিসেবে তারা ঐ সম্পত্তির মালিক হয়ে যাবে । কিন্তু ইসলাম তাদের এরূপ জুলুম ও অত্যাচারমূলক কাজের নিন্দা করেছে ও তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে :
)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَحِلُّ لَكُمْ أَن تَرِثُوا النِّسَاءَ كَرْهًا(
যারা ঈমান এনেছো , তোমাদের জন্য এটা বৈধ নয় যে , জবরদস্তি করে (তাদেরকে কষ্ট দিয়ে) তাদের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে ।
কেন নারী , পরুষের অর্ধেক সম্পত্তি পাবে ?
ইমাম সাদিক (আ.)-এর কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে : কেন নারী , পুরুষের অর্ধেক সম্পত্তি পাবে ?
ইমাম এই প্রশ্নের জবাবে বললেন : এর কারণ হচ্ছে যে , জিহাদ করা , সংসার পরিচালনার খরচ এবং দিয়াহ্ ( রক্তপণ ) দেয়া নারীর উপর ওয়াজিব ( ফরজ ) নয় ।
যেভাবে ইমাম বলেছেন , জিহাদ করা নারীর উপর ওয়াজিব নয় । প্রথমত প্রয়োজনে পুরুষকে দ্বীন রক্ষার লক্ষ্যে অবশ্যই জিহাদ করতে হবে , দ্বিতীয়ত নারীর ভরণ-পোষণের খরচ স্বামীকেই বহন করতে হবে যদিও স্ত্রী অনেক ধনী হয়ে থাকে , তৃতীয়ত কখনো ভুলবশত পরিবারের কোন সদস্যের হাতে বাইরের কেউ নিহত হলে সেক্ষেত্রে পুরুষকেই ঐ হত্যা বাবদ দীয়াহ্ (রক্তপণ) প্রদান করতে হয় কিন্তু নারী এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ দায়হীন ।
চতুর্থত যখন নারী বিয়ে করে তখন সে দেনমোহর বাবদ স্বামীর পক্ষ থেকে কিছু গ্রহণ করে থাকে । এ সব কারণে বলা যায় যে , নারীরা হচ্ছে গ্রহণকারী এবং পুরষরা হচ্ছে খরচকারী । আর তাই পুরুষের সম্পত্তির অংশ নারীর দ্বিগুণ হওয়াটাই যুক্তিযুক্ত যাতে করে ভারসাম্যের সৃষ্টি হয় ।
দুধ প্রদানের অধিকার :
)
فَإِنْ أَرْضَعْنَ لَكُمْ فَآتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ(
যদি নারিগণ তোমাদের বাচ্চাকে দুধ খাওয়ায় তবে তাকে তার পারিশ্রমিক দান কর ।
.
1 .এটা ওয়াজিব বা আবশ্যকীয় নয় যে , মা বিনামূল্যে অথবা পারিশ্রমিক গ্রহণ পূর্বক তার শিশুকে দুধ প্রদান করবে । তবে এটা এই ক্ষেত্রে যে , যখন শিশুর খাদ্য শুধুমাত্র মায়ের দুধের উপর নির্ভরশীল নয় এবং শিশুকে অন্যান্য খাদ্য (অন্য দুধও) প্রদান করাও যায় তবে লক্ষ্য রাখতে হবে তাতে যেন শিশুর কোন ক্ষতি না হয় ।
2 .যখন শিশুর খাদ্য শুধুমাত্র মায়ের দুধের উপর নির্ভরশীল , সেক্ষেত্রে ওয়াজিব নয় যে , মা বিনামূল্যে অর্থাৎ কোন পারিশ্রমিক না নিয়ে শিশুকে দুধ খাওয়াবেন , বরং শিশুর অর্থ থেকে (যদি তার অর্থ থেকে থাকে) । আর যদি তার অর্থ না থাকে তবে তার পিতার কাছ থেকে পারিশ্রমিক গ্রহণ করবে ।
3 .যদি শিশু ও তার পিতা এবং তার দাদা অর্থশালী না হয় তবে সেক্ষেত্রে মা অবশ্যই শিশুকে বিনামূল্যে দুধ প্রদান করবে অথবা কোন নারীকে দুধ প্রদানের জন্য নিয়োগ করবে । তবে তাতে যেন শিশুর কোন ক্ষতি না হয় । তবে অন্য পন্থাও অবলম্বন করতে পারে যেমন গরুর দুধ অথবা গুড়ো দুধ শিশুর জন্য ব্যবহার করতে পারেন তবে সেক্ষেত্রে তার খরচের ভার মায়ের উপর পড়বে ।
4 .শিশুর দুধ প্রদানের জন্য তার মাতাই হচ্ছে সর্বাধিক উত্তম । যদিও মা বিনামূল্যে , সমমূল্য অথবা অন্যদের থেকে কম পারিশ্রমিক নিয়ে থাকেন ।
স্বামীর মৃত্যুর পরে নারী :
কোন এক সময় কোন কোন দেশে যেমন ভারতে রেওয়াজ ছিল কোন নারীর স্বামী মৃত্যুবরণ করলে ঐ নারীকে তার স্বামীর সাথে জীবিত পুড়িয়ে দেয়া হত অথবা তাকে মৃতের উত্তরাধিকার সম্পত্তি হিসেবে কোন এক অংশীদার নিজের জন্য নিয়ে যেত । ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে যে , স্বামীর মৃত্যুর পরে একটি নির্দিষ্ট সময় অপেক্ষার পর ঐ নারী পুনরায় বিয়ে করতে পারবে । হয়তো কোন কোন ক্ষেত্রে এই নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষারও প্রয়োজন নেই ।
যদি কোন নারীর স্বামীর মৃত্যু হয়ে থাকে এবং তার ছোট সন্তান থাকে তবে সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিয়ের জন্য তার সন্তান বড় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিৎ । তবে শর্ত হচ্ছে যে , এই অপেক্ষা করতে গিয়ে সে যেন কোন পাপে লিপ্ত না হয়ে যায় । কেননা দ্বিতীয় বিয়ের ফলে এটার সম্ভাবনা আছে যে , মা এবং সন্তানদের মধ্যে ভালবাসার ঘাটতি হতে পারে যা সন্তানের উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে পারে ।
হিদাদ :
যে নারীর স্বামী মৃত্যুবরণ করেছে , তার মৃত্যুর ইদ্দত পালনের জন্য ইসলাম যে সময় নির্দিষ্ট করেছে সে সময়ে ঐ নারীর সাজ-গোজ না করা ওয়াজিব , যেমন : সুরমা দেয়া , আতর দেয়া , মেহ্দী লাগানো এবং লাল , হলুদ রংয়ের পোশাক পরিধান করা , আর যা তাকে সুন্দরী করে তুলে এমন কিছু পরা । তবে এগুলো যার যার এলাকা ভিত্তিক রসম-রেওয়াজ অনুযায়ী হওয়া ভাল । আর উক্ত সময়ে সাজসজ্জা পরিহারের এ প্রথাকে হিদাদ বলা হয় ।
তবে জীবন পরিচালনার জন্যে প্রয়োজনীয় কিছু কেনা-কাটার উদ্দেশ্যে বাড়ী থেকে বের হওয়া , শরীর পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা , চুল আচড়ানো , নখ কাটা , গোসল করা , সুন্দর বাড়ীতে থাকা , পিতা-মাতাকে দেখতে যাওয়া এবং হজ্জে যাওয়াতে কোন অসুবিধা নেই । কেননা এগুলো হিদাদের আওতায় পড়বে না ।
যদি কোন নারীর স্বামীর মৃত্যু হয়ে থাকে এবং তার ছোট ছোট বাচ্চা থাকে তবে সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিয়ের জন্য তার সন্তান বড় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিৎ । তবে যদি সে বুঝতে পারে অপেক্ষার ফলে পাপে লিপ্ত হতে পারে সেক্ষেত্রে তার বিয়ে করাতে কোন অসুবিধা নেই বরং কোন কোন ক্ষেত্রে তা প্রয়োজনীয় ও ওয়াজিব হয়ে যায় ।
রাসূল (সা.) বলেছেন : কিয়ামতের দিনে তিনটি দল আল্লাহর আরশের ছায়ায় আশ্রয় পাবে যেদিন ঐ ছায়া ছাড়া অন্য কোন ছায়া থাকবে না , আর তারা হচ্ছে :
1 .যারা‘
ছেলেহ্ রাহেম’
পালন করে অর্থাৎ আত্মীয় - স্বজনদের খোজ খবর নেয় ও বিশেষ করে পিতা - মাতার দেখা - শুনা করে , তাদের আয়ু ও রিজিক বৃদ্ধি পায় ।
2 .যে নারীর স্বামী মৃত্যুবরণ করে এবং তার ছোট সন্তান থাকে আর ঐ নারী এ সন্তানদের কারণে বলে যে , আমি বিয়ে করবো না , তবে যদি তারা মারা যায় অথবা আল্লাহ তাদেরকে ধনী করে দেন তবে ভিন্ন কথা ।
3 .কেউ যদি খাবার তৈরী করে মেহমানদেরকে খেতে দেয় এবং সাথে সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে ইয়াতিম ও মিসকিনদেরও খেতে দেয় ।
(যেহেতু আমাদের এই বইয়ের বিষয়টি একটু ভিন্ন তাই নারীর অধিকার সম্পর্কে অতি সংক্ষেপে কিছু বর্ণনা করা হল । তবে এ বিষয়ে আরো বেশী জানার জন্য এই বিষয়ের উপর লিখিত বইসমূহ দেখার জন্য বিশেষ অনুরোধ রইল । )
যখন ইসলামকে অন্যান্য ধর্মের সাথে তুলনা করা হবে তখন দেখা যাবে যে , ইসলাম নারীর অধিকারের ব্যাপারে কত গুরুত্বই না দিয়েছে । আর এ কারণেই ইমাম খোমেনী (রহ.) বলেছেন : আল্লাহ জানেন , ইসলাম নারীর যতটা কল্যাণ করেছে কোন পুরুষের ততটা কল্যাণ করে নি... ।
ক)- ইসলামের প্রথম দিকে এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের পরবর্তীকালে সমাজিক ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা :
)
وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ(
ঈমানদার নারী-পুরুষ হচ্ছে একে অপরের সাহায্যকারী , (তারা একে অপরকে) ভাল কাজে উপদেশ এবং খারাপ কাজে নিষেধ করেন ।
উল্লিখিত আয়াতটি আমাদেরকে এটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে যে , ইসলাম ঈমানদার নারী-পুরুষকে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে উপস্থাপন করেছে । আর তারা অবশ্যই সামাজিক কাজ কর্মে যেমন ভালকাজের আদেশ দান ও মন্দ কাজের নিষেধ করা প্রভৃতিতে অংশগ্রহণ করবেন এবং এরূপ ঐশী দায়িত্বকে সঠিকভাবে পালন করবেন । এই বিষয়টি শুধুমাত্র পুরুষের উপর অর্পিত কোন বিষয় নয় বরং ঈমানদার নারিদেরকেও অবশ্যই এই কাজে নিয়োজিত হতে হবে । এমন কিছু বিষয়ে ইসলামের প্রাথমিক যুগের নারীগণের ভূমিকা তুলে ধারার চেষ্টা করবো ।
1.নাসিবাহ্ নামের এক নারী যিনি পরবর্তীতে‘
উম্মে আম্মারাহ্ ’ নামে প্রসিদ্ধ হয়েছিলেন , তিনি দুই শহীদের মাতাও ছিলেন । তিনি রাসূল -এর যুগে প্রতিটি যুদ্ধে (সা.) আহতদের চিকিৎসা ও তাদেরকে পানি পান করানোর কাজে নিয়োজিত থাকতেন ।
2.উম্মে সানান নবীর স্ত্রী উম্মে সালামাহর সহযোগিতায় খাইবারের যুদ্ধে আহতদের শুশ্রূযা ও পানি পৌঁছানোর কাজে সাহায্য করেছিলেন ।
3.ইমাম বাকির (আ.) বলেছেন : ওহুদের যুদ্ধে হযরত আলীর শরীরে 60 টি ক্ষতের সৃষ্টি হয় যার কারণে রাসূল (সা.) দুইজন মহিলা যথাক্রমে : উম্মে সালামাহ্ ও উম্মে আতিয়াহকে তাঁর শরীরের ঐ ক্ষতের চিকিৎসা করার জন্য দায়িত্ব দেন ।
যে সমস্ত নারী ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইসলামের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রগুলোতে ভূমিকা পালন করেছিল এবং আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়নের কাজে সাহায্য করেছিল তাদের সংখ্যা অনেক ।
ইমাম সাদিক (আ.) বলেন : ইমাম মাহ্দী (আ.) যখন আবির্ভূত হবেন তখন তাঁর সাথে 13 জন মহিলা থাকবে । প্রশ্ন করা হলো কি কারণে ? তিনি জবাবে বললেন : এই মহিলাগণ আহ্ত ব্যক্তিদের সেবা-শুশ্রূষা করার জন্য (সা.) থাকবে । যেমনভাবে রাসূল–
এর যুগে ছিল ।
খ)- রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা :
মক্কা নগরী অষ্টম হিজরীতে মহানবী (সা.) ও আলী (আ.)-এর সক্রিয় উপস্থিতিতে ইসলামের সৈন্যদের হাতে বিজিত হয় এবং মুসলমানদের (সা.) আয়ত্বে আসে । কাফেররা আত্মসর্মপন করে মহানবী (সা.)-এর কাছে হাজির হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলো । মহিলারাও বাইয়াত করার জন্য নবী এর কাছে গেল । এমন সময় এই মর্মে আয়াত নাজিল হলো যে , তাদের সঙ্গে 6 টি শর্তে বাইয়াত গ্রহণ কর ।
হে নবী! যখন নারিগণ ঈমানের সাথে বাইয়াত করার তোমার কাছে আসবে তখন নিম্নলিখিত শর্তে যথা :
1- আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক করবে না ,
2- চুরি করবে না ,
3- ব্যভিচার করবে না ,
4- নিজেদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না ,
5- অন্যকে অপবাদ দিবে না ,
6- ভাল কাজের ক্ষেত্রে তোমার নির্দেশ অমান্য করবে না , তুমি তাদের হতে বাইয়াত গ্রহণ করবে । আর তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইবে , কেননা আল্লাহ অতিশয় দয়ালু ।
যখন মহিলারা বাইয়াত করার জন্য তৈরী হল তখন উম্মে হাকিমা জিজ্ঞাসা করলো : কিভাবে বাইয়াত করবো ?
নবী (সা.) বললেন : আমি কখনই তোমাদের হাতের সাথে হাত স্পর্শ করবো না । অত:পর পানি ভর্তি একটি পাত্র আনতে বললেন এবং তার মধ্যে তিনি হাত দিয়ে তা বরকতময় করে হাত উঠিয়ে নিলেন । এরপর মহিলাদেরকে একে একে ঐ পানির মধ্যে হাত দিতে বললেন ।
গ)- ইমাম খোমেনীর দৃষ্টিতে সামাজিক ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা :
‘
আমি ইরানের বিভিন্ন শহরের যেমন কোম ও মাশহাদের নারীদের সাহসিকতা দেখে গর্ববোধ করি । আপনারা সাহসী নারীরাই এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন । আপনারাই পুরুষদেরকে সাহস যুগিয়েছিলেন । আমরা সকলেই আপনাদের সাহসিকতার কাছে কৃতজ্ঞ । ইসলাম নারীদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রেখেছে । ইসলাম নারীদের প্রতি যতটা অবদান রেখেছে তা পুরুষদের প্রতি অবদানের চেয়েও বেশী । আর এই বিপ্লবের বিজয়ের ব্যাপারেও নারীদের ভূমিকা পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশী ছিল ।
নারীরা অবশ্যই দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সক্রিয় অংশ্রগ্রহণ করবেন । আপনারা যেভাবে বিপ্লব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিলেন এবং এক্ষেত্রে অংশীদার ছিলেন তদ্রূপ এখন এই বিজয়ের সাথে অবশ্যই অনুরূপ অংশীদার থাকুন । আর এটা ভুলে যাবেন না যে , যখনই জাতির প্রয়োজন তখনই কিয়াম করবেন (দায়িত্ব পালনের জন্য বেরিয়ে আসবেন) । কেননা এই দেশটা তো আপনাদের ।
ইনশাআল্লাহ তা’
য়ালা আপনারা অবশ্যই এই দেশটিকে গড়ে তুলবেন । ইসলামের প্রাথমিক যুগে মহিলারা পুরুষের সাথে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন । আর আমরা তাদেরকে কখনো কখনো পুরুষদের মতই ভূমিকা পালন করতে দেখেছি আবার কখনো তারা পুরুষদের থেকেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন । নিজেকে , নিজের সন্তানদেরকে বিশেষ করে যুবকদেরকে উৎসর্গ করেছিলেন তাতেও তারা হতোদ্যম হন নি , বরং শক্ত হাতে শত্রুকে প্রতিরোধ করেছিলেন । আমরা তো এটাই চাই যে , নারীরা মনুষ্যত্বের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাক । আর নারীরা অবশ্যই তাদের ভাগ্য নির্ধারণী বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবেন ।
ইসলাম বিপ্লব পূর্ব প্রশাসন আমাদের সাহসী ও যোদ্ধা নারীগোষ্ঠীকে কোণ ঠাসা করে রাখতে চেয়েছিল কিন্তু আল্লাহ্ তা চান নি । তারা নারীকে পণ্যের ন্যায় ব্যবহার করতে চেয়েছিল , কিন্তু ইসলাম নারীকে পুরুষের অনুরূপ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভূমিকা পালনের অনুমতি দিয়েছে ।
শেষ কথা :
উল্লিখিত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে , রাসূল (সা.)-এর সময় নারিগণ বাইয়াতের মত একটি রাজনৈতিক বিষয়েও বিশেষ শর্তে অংশ গ্রহণ করেছিলেন । সাথে সাথে তারা যুদ্ধের ময়দানে আহতদের সেবা- শুশ্রূষা করার কাজেও অংশগ্রহণ করেছিলেন । তারা যুদ্ধে তাদের স্বামী , সন্তান-সন্ততি ও আত্মীয়-স্বজনদের শহীদ হওয়াতে গর্ববোধ করতেন । কেননা তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে , এটাই হচ্ছে আল্লাহর পথ । এমনকি তাদের স্বামী , সন্তান-সন্ততি ও আত্মীয়-স্বজনদের শহীদ হওয়ার পর তারা যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন ।
ফেরাউনের বিরুদ্ধে হযরত আসিয়ার সংগ্রাম , ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে হযরত খাদিজা (আ.)-এর সংগ্রাম , হযরত ফাতিমা (আ.)-এর ইমাম আলী (আ.)-এর বেলায়াত ও ইমামতের পক্ষে শত্রুর মুকাবিলা করা , হযরত যয়নাব (আ.)-এর ইমাম হুসাইন (আ.) -এর বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং ইয়াযিদ ও তার দোসরদের ইসলামের শত্রু হিসেবে প্রমাণ করে দেয়া , এসব কিছুই এটার প্রমাণ দেয় যে , ইসলামের পূর্বে অন্যান্য নবীদের যুগে এবং ইসলামের প্রথম যুগে নারীরা সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভূমিকা পালন করেছিল । আর ইসলাম কোন পক্ষপাতিত্ব না করেই নারী ও পুরুষ উভয়ের অধিকারের ব্যাপারে ন্যায়সঙ্গত কথা বলেছে , যা পবিত্র কোরআন , নবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের ইমামদের (আ.) হাদীসে প্রমাণিত । আর আমরা নারী ও পুরুষের মধ্যে যে বিধানগত পাথর্ক্য দেখতে পাই তা হচ্ছে তাদের সৃষ্টিগত ও প্রকৃতিগত পার্থক্যের কারণে । তাই আল্লাহ্ তা ’ য়ালা তাদের উভয়েরই কর্মক্ষেত্র ও দায়িত্বের পরিধি নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন । এই পার্থক্যের কারণে হয়তো অধিকারের ক্ষেত্রেও একে অপরের মধ্যে পার্থক্য দৃষ্টিগোচর হয়ে থাকে ।
ইমাম খোমেনী (রহ.) বলেছেন : ইসলাম নারীদেরকে পুরুষের পাশাপাশি স্থান দিয়েছে । কেননা নবী (সা.) -এর আসার আগে পর্যন্ত নারীদেরকে কোন মূল্যই দেয়া হতো না । ইসলাম নারীদেরকে ক্ষমতা দান করেছে এবং পুরুষ ও মহিলাকে একে অপরের পরিপূরক করেছে । যদিও ইসলামের দৃষ্টিতে পুরুষের জন্য নির্দিষ্ট আইন-কানুন আছে এবং মহিলাদেরও তদ্রূপ কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে , ইসলাম তাদের মধ্যে পার্থক্য করেছে ।