শয়তান সম্পর্কে কিছু আলোচনা
ক)-‘
শয়তান ’ শব্দটি‘
শাতানা ’ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে । আর তার কর্তাবাচক বিশেষ্য হচ্ছে‘
শাতেন ’ অর্থাৎ দুষ্ট , অপবিত্র , নোংরা ও ইতর প্রকৃতির ।
খ)-‘
শয়তান ’ শব্দটি দ্বারা এমন এক সত্তার প্রতি ইঙ্গিত করা হয় যে , সে হচ্ছে অবাধ্য , বিদ্রোহী এবং মানুষ ছাড়াও অন্যান্য সব কিছুর সাথে সংযুক্ত করা যায় ।‘
শয়তান ’ হচ্ছে একটি সাধারণ নাম এবং‘
ইবলিস ’ হচ্ছে একটি বিশেষ নাম।
)
وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ أَبَىٰ وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ(
স্মরণ কর সেই সময়ের কথা যখন ফেরেশতাদেরকে বলেছিলাম আদমের উদ্দেশ্যে সিজদাহ্ দিতে তখন তারা সকলেই সিজদাহ্ করেছিল ; শুধুমাত্র ইবলিস এই নির্দেশ উপেক্ষা করেছিল এবং অহমিকা প্রদর্শন করেছিল । আর(এই নির্দেশের অবাধ্যতা করার কারণে) সে কাফেরদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেল ।
)
إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَن يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَن ذِكْرِ اللَّـهِ وَعَنِ الصَّلَاةِ فَهَلْ أَنتُم مُّنتَهُونَ(
শয়তান চায় শরাব (মদ) ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে এবং তোমাদেরকে আল্লাহর যিকির করা ও নামাজ থেকে বিরত রাখতে । (তোমরা কি) এসব ফ্যাসাদ ও ক্ষতিকর কর্ম থেকে ক্ষান্ত হবে ?
)
وَكَذَٰلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِينَ الْإِنسِ وَالْجِنِّ يُوحِي بَعْضُهُمْ إِلَىٰ بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُورًا وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ مَا فَعَلُوهُ فَذَرْهُمْ وَمَا يَفْتَرُونَ(
আর এরূপভাবে আমরা প্রতিটি নবীর শত্রু হিসেবে বহু শয়তান সৃষ্টি করেছি তাদের কতক হচ্ছে মানুষ আর কতক হচ্ছে জ্বিন । যাদের কতিপয় অপর কতিপয়কে ভিত্তিহীন মনভুলানো বাক্যের মাধ্যমে প্রতারণার উদ্দেশ্যে কুমন্ত্রণা দিত । আর যদি তোমার প্রতিপালক চাইতেন তবে ঐরূপ করতে পারতো না । সুতরাং তাদেরকে তাদের মিথ্যা রটনা নিয়েই থাকতে দিন !
গ)- শয়তানকে দেখা যায় না ,
)
إِنَّهُ يَرَاكُمْ هُوَ وَقَبِيلُهُ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ(
নিশ্চয়ই শয়তান ও তার দোসররা সেইস্থান থেকে তোমাদেরকে দেখতে পায় , যেখান থেকে তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না ।
ঘ)- শয়তান বিভিন্ন পথে গোমরাহ্ করার জন্য এবং ফ্যাসাদ সৃষ্টির লক্ষ্যে তোমাদের মধ্যে প্রবেশ করবে :
)
قَالَ فَبِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيمَ ﴿١٦﴾ ثُمَّ لَآتِيَنَّهُم مِّن بَيْنِ أَيْدِيهِمْ وَمِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ أَيْمَانِهِمْ وَعَن شَمَائِلِهِمْ وَلَا تَجِدُ أَكْثَرَهُمْ شَاكِرِينَ(
শয়তান আল্লাহ তা ’ য়ালাকে বলল : যেহেতু আপনি আমাকে গোমরাহ্ করেছেন সেহেতু অবশ্যই আমি তাদের (বিভ্রান্ত করার) জন্য আপনার সরল পথে বসে থাকবো । তারপর সামনে থেকে , পিছন থেকে , ডান ও বাম পাশ থেকে তাদের কাছে যাবো এবং তাদের অধিকাংশকেই আপনি কৃতজ্ঞ হিসেবে পাবেন না । (সূরা আরাফ :16-17)
এই যে শয়তান বলছে যে , সে চার পাশ থেকে আসবে ; এটা হয়তো এমন হতে পারে যে , সে মানব জাতিকে অবরোধ করবে এবং যে কোন প্রক্রিয়াতেই হোক না কেন সে তাদেরকে গোমরাহ্ করার চেষ্টা করবে । এমন ধরনের কথা তো সাধারণ মানুষও বলে থাকে যেমন , অমুক চার দিক থেকেই আটকে গেছে অথবা শত্রুর খপ্পরে পড়েছে ।
ইমাম বাকির (আ.) বলেছেন : সামনের দিক থেকে মানুষের কাছে শয়তান আসার অর্থ হচ্ছে , তাদের সামনে যে আখেরাত রয়েছে তাদের দৃষ্টিতে সামান্য ও হালকা হিসেবে তুলে ধরা । মানুষ এই আখেরাতকে মূল্যহীন ও অতি সাধারণ মনে করার কারণেই গোনাহ্তে লিপ্ত হয় । আর পিছন দিক থেকে মানুষের নিকট আসার অর্থ হচ্ছে , সম্পদ পুঞ্জীভূত করার জন্য এবং তাদের সন্তান ও উত্তরসূরীদের উছিলা দিয়ে অন্যের অধিকার না দেয়ার জন্য আহ্বান জানাবে । ডান দিক থেকে মানুষের নিকট আসার অর্থ হচ্ছে , নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়ে তাদের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি করবে এবং বাম দিক থেকে আসার অর্থ হচ্ছে , দুনিয়াবী আকাঙ্ক্ষা এবং কামভাবকে তাদের সামনে আকর্ষণীয় করে ফুটিয়ে তুলবে ।
ঙ)- উদ্ধত ও সীমালংঘনকারী মানুষ , ক্ষতিকারক প্রাণী , বিভেদ সৃষ্টিকারী সত্তা , জীবাণু , পাপাচারী নারী , মুনাফিক ও মিথ্যাবাদী ইত্যাদি বিভিন্ন অর্থে শয়তান শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে । মহানবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের নিষ্পাপ ইমামদের থেকে এরূপ অর্থে প্রচুর হাদীস বর্ণিত হয়েছে । যেমন ,
রাসূল (সা.) বলেছেন :
ﻻ ﺗﻮﻭﺍ ﻣﻨﺪﻳﻞ ﺍﻟﻠﺤﻢ ﰱ ﺍﻟﺒﻴﺖ ﻓﺎﻧﻪ ﻣﺮﺑﺾ ﺍﻟﺸﻴﻄﺎﻥ
মাংসের ব্যাগ বাড়িতে রেখোনা , কেননা তা হচ্ছে শয়তানের বসবাসের স্থান অর্থাৎ তাতে জীবাণু জন্মায় ।
ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন :
ﻻ ﺗﺪﻋﻮﺍ ﺁﻧﻴﺘﻜﻢ ﺑﻐﲑ ﻏﻄﺎﺀ ﻓﺎﻥ ﺍﻟﺸﻴﻄﺎﻥ ﺍﺫﺍ ﱂ ﺗﻐﻂ ﻟﻶﻧﻴﺔ ﺑﺰﻕ ﻭﺍﺧﺬ ﻣﺎ ﻓﻴﻬﺎ ﺷﺎﺀ
তোমাদের পাত্রগুলোকে খোলা রেখো না , যদি তা না ঢাক তবে তাতে শয়তান তার মুখের লালা লাগিয়ে দেয় (তাতে রোগ জীবাণু জন্মায় এবং তা ব্যবহারও করে) ।
ইমাম বাকির (আ.) বলেছেন :
ﺍﳕﺎ ﻗﺼﺼﺖ ﺍﻻﻇﻔﺎﺭلأنها ﻣﻘﻴﻞ ﺍﻟﺸﻴﻄﺎﻥ
তোমাদের আঙ্গুলের নখগুলোকে ছোট করে রাখ ; কেননা যদি তা বড় থাকে তবে তা হচ্ছে শয়তানের বসবাসের (ও রোগ জীবানুর জন্মানোর) স্থান ।
রাসূল ( সা .) বলেছেন :
ﻻ ﺗﺒﻴﺘﻮﺍ ﺍﻟﻘﻤﺎﻣﺔ ﰱ ﺑﻴﻮﺗﻜﻢ ﻓﺎﺧﺮﺟﻮﻫﺎ نهاراﹰ ﻣﻘﻌﺪ ﺍﻟﺸﻴﻄﺎﻥ
রাতে আবর্জনা তোমাদের ঘরে রেখোনা এবং তা দিনেই বাইরে ফেলে দিবে । কেননা তা শয়তানের বসার (রোগজীবাণু জন্মানোর) স্থান ।
রাসূল (সা.) বলেছেন :
ﻻ ﻳﻄﻮﻟﻨﺎ ﺍﺣﺪﻛﻢ ﺷﺎﺭﺑﻪ، ﻓﺎﻥ ﺍﻟﺸﻴﻄﺎﻥ ﻳﺘﺨﺬﻩ ﳐﺒﺌﺎ ﻳﺴﺘﺘﺮﺑﻪ
তোমাদের গোঁফ বড় করোনা , কেননা সেখানে শয়তান (জীবাণু) নিজের বসবাসের স্থান করে নেয় এবং সেখানে লুকিয়ে থাকে ।
রাসূল (সা.) বলেছেন :
ﺍﻥ ﺍﻟﻄﻌﺎﻡ ﺍﳊﺎﺭ ﺟﺪﺍ ﳏﻮﻕ ﺍﻟﱪﻛﺔ ﻭ ﻟﻠﺸﻴﻄﺎﻥ ﻓﻴﻪ ﺷﺮﻛﺔ
গরম খাবার সত্যই বরকত নষ্ট করে দেয় , কেননা শয়তান তাতে অংশগ্রহণ করে ।
রাসূল (সা.) বলেছেন :
ﻻ ﻳﺒﻴﱳ ﺍﺣﺪﻛﻢ ﻭﻳﺪﻩ ﻏﻤﺮﺓ ﻓﺎﻥ ﻓﻌﻞ ﻓﺎﺻﺎﺑﻪﳌﻢ ﺍﻟﺸﻴﻄﺎﻥ ﻓﻼ ﻳﻠﻮﻣﻦ ﺍﻻ ﻧﻔﺴﻪ
তৈলাক্ত হাতে রাত্রি যাপন করো না । সেক্ষেত্রে যদি শয়তান তোমাদের কোন ক্ষতি করে তবে নিজেদের ব্যতীত অন্য কাউকে তিরস্কার করো না ।
ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন :
ﺍﻟﻘﻬﻘﻬﺔ ﻣﻦ ﺍﻟﺸﻴﻄﺎﻥ
অট্টহাসি হচ্ছে শয়তানের একটি বৈশিষ্ট্য ।
ﻋﻦ ﺍﰉ ﻋﺒﺪ ﺍﷲ (ﻋﻠﻴﻪ ﺍﻟﺴﻼﻡ) : ﺍﻟﻨﻈﺮ ﺳﻬﻢ ﻣﻦ ﺳﻬﺎﻡ ﺍﺑﻠﻴﺲ ﻣﺴﻤﻮﻡ ﻭ ﻛﻢ ﻣﻦ ﻧﻈﺮﺓ ﺍﻭﺭﺛﺖ ﺣﺴﺮﺓ ﻃﻮﻳﻠﺔ
ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন : দৃষ্টি হচ্ছে শয়তানের নিক্ষিপ্ত তীরসমূহের মধ্যে একটি বিষাক্ত তীর এবং এমন অনেক দৃষ্টি রয়েছে যার পরিণতি হলো দীর্ঘ পরিতাপ ।
ﺍﻟﻨﻈﺮ ﺍﱃ ﳏﺎﺳﻦ ﺍﻟﻨﺴﺎﺀ ﺳﻬﻢ ﻣﻦ ﺳﻬﺎﻡ ﺍﺑﻠﻴﺲ ﻓﻤﻦ ﺗﺮﻛﻪ ﺍﺫﺍﻗﻪ ﺍﷲ ﻃﻌﻢ ﻋﺒﺎﺩﺓ ﺗﺴﺮﻩ
রাসূল (সা.) বলেছেন : না-মাহরাম (যে মহিলা বা পুরুষের সাথে বিবাহ করা যায়) মহিলার চুলের দিকে তাকানোটা হচ্ছে এমন এক দৃষ্টি যা শয়তানের কাছ থেকে আসা বিষাক্ত তীরের মত । যারা তাকাবে না বা দেখবে না তাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে ইবাদতে আধ্যাত্মিক স্বাদ দেয়া হবে যা তাদেরকে আনন্দিত করবে ।
হযরত আলী (আ.) বলেছেন :
ﺍﳌﻜﻮﺭ ﺷﻴﻄﺎﻥ ﰱ ﺻﻮﺭﺓ ﺍﻧﺴﺎﻥ
যে বেশী চালাকী করে , সে হচ্ছে মানুষরূপী শয়তান ।
ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন :
ﻟﻴﺲ ﻻﺑﻠﻴﺲ ﺟﻨﺪ ﺍﺷﺪ ﻣﻦ ﺍﻟﻨﺴﺎﺀ ﻭ ﺍﻟﻐﻀﺐ
‘
নারী’
ও‘
ক্রোধ’
এই দুটির মত উত্তম সৈনিক শয়তানের আর নেই ।
রাসূল (সা.) বলেছেন :
ﺍﻭﺛﻖ ﺳﻼﺡ ﺍﺑﻠﻴﺲ ﺍﻟﻨﺴﺎﺀ
শয়তানের উত্তম অস্ত্র হচ্ছে নারী ।
ফলাফল :
উপরোল্লিখিত পবিত্র আয়াতসমূহ ও আহলে বাইতের নিষ্পাপ ইমামগণের (আ.) রেওয়ায়েত থেকে আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়েছে তা নিম্নরূপ :
ক)- শয়তান এমন এক সত্তা যা দেখা যায় না কিন্তু তার নমুনা অনেক কিছুর মধ্যে পাওয়া যায় , যেমন , মিথ্যাবাদী ও মতানৈক্য সৃষ্টিকারী মানুষ , নারী , জীবাণু ইত্যাদি । মূল কথা হচ্ছে যে অপবিত্র ও দুষ্ট সত্তা মানুষকে সত্য পথ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায় এবং তার জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে সেই সত্তাকেই শয়তান বলা হয় । যদি কোন কোন নারীকে শয়তান অথবা শয়তানের বন্ধু বা সহায়তাকারী বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয় তবে তা এ কারণেই করা হয়ে থাকে যে , তাকওয়াহীন , বেপর্দা অথবা সঠিকভাবে পর্দা না করা নারী তার কথা ও আচার-আচরণের মাধ্যমে যেহেতু মানুষকে সত্য পথ থেকে দূরে সরিয়ে ফিতনা-ফ্যাসাদের দিকে নিয়ে যায় । আর যেহেতু শয়তানের উদ্দেশ্যও এর বাইরে কিছু নয় , সেহেতু এমন প্রকৃতির নারীরাই শয়তান নামক ঐ অপবিত্র ও দুষ্ট সত্তাকে তার প্রকৃত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহায়তা করে থাকে ।
খ)-যে সকল রেওয়ায়েত আবর্জনা এবং তা রাখার স্থান এবং সংরক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করেছে এবং যেসকল রেওয়ায়েত চর্বি ও জীবাণু সংক্রান্ত আলোচনা করেছে তা থেকে আমাদের কাছে এটা স্পষ্ট যে , ইসলাম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে কত গুরুত্ব দিয়েছে । যদি মুসলমানগণ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের সঠিক ব্যবহার ও নিয়ম- কানুন জানতো তবে বর্তমানে আমাদের দেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে , রাস্তা- ঘাটে , অলিতে-গলিতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার যে অভাব রয়েছে তা থাকতো না । আল্লাহ্ তা ’ য়ালা সবাইকে নবী মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.)-এর দ্বীনের বিধি- বিধান সম্পর্কে সঠিকভাবে জানার তৌফিক দান করুন ।