একজন মুসলিম নারীর অবশ্যই যা জানা প্রয়োজন

একজন মুসলিম নারীর অবশ্যই যা জানা প্রয়োজন16%

একজন মুসলিম নারীর অবশ্যই যা জানা প্রয়োজন লেখক:
: মীর আশরাফ-উল-আলম
প্রকাশক: আল মুস্তাফা (সা.) আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, কোম-ইরান
বিভাগ: নারী বিষয়ক

একজন মুসলিম নারীর অবশ্যই যা জানা প্রয়োজন
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 87 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 43852 / ডাউনলোড: 5061
সাইজ সাইজ সাইজ
একজন মুসলিম নারীর অবশ্যই যা জানা প্রয়োজন

একজন মুসলিম নারীর অবশ্যই যা জানা প্রয়োজন

লেখক:
প্রকাশক: আল মুস্তাফা (সা.) আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, কোম-ইরান
বাংলা

1

১৮- বেপর্দা ও সঠিক পর্দা না করা নারীর মূল্য মাটির থেকেও কম :

ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন :

ﺍﻟﺬﻫﺐ ﻭ ﺍﻟﻔﻀﺔ، ﻫﻰ خیر ﻣﻦ ﺍﻟﺬﻫﺐ ﻭ ﺍﻟﻔﻀﺔ ﻭ ﺍﻣﺎ ﻃﺎﳊﺘﻬﻦ ﻓﻠﻴﺲ ﺧﻄﺮﻫﺎ ﺍﻟﺘﺮﺍﺏ، ﺍﻟﺘﺮﺍﺏ خیر ﻣﻨﻬﺎ

নারীর কোন মূল্য নেই , না ভালদের আর না মন্দদের । তবে যারা ভাল তাদের মূল্য স্বর্ণ ও রৌপ্যের সাথে তুলনা যোগ্য নয় , কেননা তারা সেগুলোর থেকেও অনেক বেশী উত্তম । আর যারা মন্দ তারা মাটির সমতূল্য নয় কেননা মাটি তাদের থেকে অনেক উত্তম ।১২৪

এই হাদীসটি এ কথাই বলতে চায় যে , নৈতিক মানদন্ডে নারীর মূল্য আছে এবং তার মর্যাদা এই পৃথিবীর কোন বস্তুর সাথে তুলনা করা সম্ভব নয় । তবে এটা তো প্রকৃতিগত ব্যাপার যে , সমাজে যে যতটা বেশী ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে ততটা বেশী নেতিবাচক ও ধ্বংসাত্মক ভূমিকাও সেই রাখতে পারে । তাই সমাজে যে যত বেশী ভাল ভুমিকা রাখতে পারবে সে ততবেশী সম্মান ও মর্যাদায় ভূষিত হবে । আর যে যত বেশী মন্দ ভূমিকা রাখবে সে ততবেশী তিরস্কৃত হবে ।

ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন : পবিত্র নারী স্বর্ণ ও রৌপ্যের থেকেও উত্তম । কেননা উত্তম সন্তান গড়ে তোলার যে দায়িত্ব নারীর উপর রয়েছে সে যদি ঐ দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবে পালন করে তবে সমাজের প্রতিটি শিশুকে বিশিষ্ট ব্যক্তি রূপে গড়ে তোলা সম্ভব যার দ্বারা এ পৃথিবীকেও পরিবর্তন করা সম্ভব । তাই যে নারী একটি শিশুকে যোগ্যভাবে গড়ে তুললো সে নারীর মূল্য স্বর্ণ ও রৌপ্যের সাথে তুলনা করা যায় না । অন্য দিকে , যদি খোদাভীতিশূন্য কোন নারী সমাজকে ফিতনা-ফ্যাসাদের দিকে নিয়ে যায় এবং সমাজের সকলকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয় তাহলে সে অন্য সকল প্রাণীর থেকে অধম । তাকে মাটি বা কোন পশুর সাথেও তুলনা করা যায় না । কেননা মাটি , প্রাণী ও গাছ-পালা তো সমাজের উপকার করে থাকে । কিন্তু যে সমাজকে নবীগণ (আ.) , সৎ মানুষ ও শহীদগণ তাদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে সাজিয়েছেন ঐ অধম নারী সে সমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে ।

১৯- বে-পর্দা ও সঠিক পর্দা না করা নারীরা হচ্ছে শয়তানের চোখের জ্যোতি :

ইবলিস সকল নবীর নিকটে যেত । তবে নবীদের মধ্যে হযরত ইয়াহিয়া (আ.)-এর কাছে বেশী যেত । একদিন তিনি তাকে প্রশ্ন করলেন যে , কিভাবে মানুষকে পথভ্রষ্ট কর ? ততক্ষণাৎ ইবলিস তার পথভ্রষ্ট করার উপকরণগুলো গুণতে শুরু করলো । তারপর তিনি তার কাছে প্রশ্ন করলেন :

এই উপকরণগুলোর মধ্যে কোনটি তোমার চোখ ও অন্তরকে আলোকিত করে ? শয়তান বলল : নারী , তারাই হচ্ছে আমার শিকারের উত্তম স্থান ও ফাঁদ স্বরূপ যখন বেশী সংখ্যায় ভাল মানুষকে পথভ্রষ্ট করতে চাই তখন নারীদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে থাকি । আর তাদের মাধ্যমেই আমার চোখ ও অন্তর আলোকিত করে থাকি ।১২৫

দ্রষ্টব্য:

১- এই হাদীস থেকে এটা বুঝা যায় যে , মানুষের দূর্ভাগ্যের কারণ হচ্ছে তাকওয়াহীন নারী । যা অতীতেও ইতিহাস সাক্ষ্য দিয়েছে ।

আর এই যে , শয়তান বলেছে : (ভাল ও উত্তম মানুষকে পথভ্রষ্ট করার জন্য নারীদেরকে ব্যবহার করে থাকি) এর দ্বারা এটা বুঝা যায় যে , তাকওয়াহীন নারী ঈমানদার ব্যক্তির জন্য বিশেষ হুমকি স্বরূপ । আর এটা মুত্তাকিদের জন্যও বিপদ সংকেত হতে পারে যাদের কিনা বিন্দু মাত্র সময়ের জন্যও আল্লাহ তা ’ য়ালার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয় না ।

বিবেকও সমাজের দৃষ্টিতে বেপর্দা ও কঠিনভাবে পর্দা না করার কঠিন পরিণতি

বে - পর্দায় থাকা বা সঠিকভাবে পর্দা না করা নারী স্বামীর অধিকারকে নষ্ট করে :

আল্লাহ্ তা ’ য়ালা শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আমাদের কাছে আমানত হিসেবে দিয়েছেন । এগুলোর প্রকৃত মালিক হচ্ছেন তিনিই । যখন কোন নারীর বিয়ে হয়ে যায় তখন তার দেহ , মন ও সাজসজ্জা সব কিছুই স্বামীর সাথে সম্পর্কিত হয়ে যায় । আর তা সর্বসাধারণের সামনে উপস্থাপন করা তার জন্য কখনই বৈধ নয় ।

রাসূল (সা.) বলেছেন :

যে নারী নিজেকে তার স্বামী ব্যতীত অন্য কারো জন্যে সুগন্ধিযুক্ত ও সাজসজ্জা করে , আল্লাহ তা ’ য়ালা তার নামাযকে ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল করেন না — যতক্ষণ পর্যন্ত না সে জানাবাতের গোসলের (শারীরিক অপবিত্রতাজনিত বিশেষ গোসল) ন্যায় গোসল করে (যদিও এটি মুস্তাহাব গোসল হিসেবে গণ্য) ।১২৬

বে-পর্দায় থাকা বা সঠিকভাবে পর্দা না করা নারী স্বামীর অন্তর জয় করতে পারে না :

যে নারীর লজ্জা যত বেশী সে তার স্বামীর উপর তত বেশী অধিকার রাখে । আর যে নারীর লজ্জা-শরমের কোন বালাই নেই এবং আল্লাহকে ভয় করে না সে তার স্বামীর আদর-ভালবাসা অর্জন করতে পারে না ।

বে - পর্দায় থাকা বা সঠিকভাবে পর্দা না করা নারীরা জ্ঞান অর্জনেও সফল নয় :

যে নারী যত বেশী শালীন , সে লেখা-পড়াতেও তত বেশী সফল । কেননা জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজন হয় স্থির মস্তিস্কের , তাই যে নারী বা মেয়ে সকল সময় নিজেকে অন্যের সামনে উপস্থাপন করার জন্য ব্যস্ত থাকে । প্রতিনিয়ত অন্যদের আকর্ষণ করার লক্ষ্যে নিজেকে বিভিন্ন রূপে সাজিয়ে থাকে । যেহেতু লেখা-পড়ায় সে ভালভাবে মনোযোগ দিতে পারে না তাই জ্ঞান অর্জনে সফল হতে পারে না ।

বে-পর্দায় থাকা বা সঠিকভাবে পর্দা না করা নারী এ অপছন্দনীয় কাজের মাধ্যমে নিজের অনেক ক্ষতি সাধন করে থাকে :

এর কারণ হলো সে তার সৌন্দর্য্যকে না - মাহরাম বা বেগানা মানুষদের সামনে উপস্থাপন করে । সে তার এ কাজের মাধ্যমে কোন হৃদয়সমূহকে আকর্ষণ করে ? অবশ্যই বলতে হয় : উক্ত কাজের মাধ্যমে সে নষ্ট যুবক , চরিত্রহীন খারাপ প্রকৃতির লোকদের হৃদয়কে আকর্ষণ করে । প্রকৃত মুসলমান ও মু মিন ব্যক্তিগণ এ সব কাজের প্রতি বীতশ্রদ্ধ । এই ধরনের ব্যক্তিদের হৃদয় কাড়াতে দুনিয়া বা আখিরাতে কোন উপকার হবে কী ? অবশ্যই বলতে হয় : দুনিয়া ও আখিরাতে এ সবের কোন মূল্য নেই । আল্লাহ্ তা য়ালা নেয়ামত হিসেবে শরীরের সুস্থতা ও সৌন্দর্য্য আমাদেরকে দিয়েছেন । আর তা আমানত হিসেবে দিয়েছেন । আমাদের কোন অধিকার নেই যে , আমাদের হৃদয় বা অন্তর যেভাবে চায় এবং যা করতে চায় তাই করবো । যেহেতু আল্লাহ তা য়ালা আমাদেরকে এত নেয়ামত দান করেছেন সেগুলোর আমানতদারীর উত্তম পন্থা হচ্ছে তাঁর সন্তুষ্টি হাসিল করবো । ঐরূপ মানুষের হৃদয় কাড়ার কোন প্রয়োজন নেই যারা নিজেদের শয়তানী ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যে নারীদেরকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে থাকে । আসলে কি এটা উচিৎ যে , নারী দুষ্ট লোকের হৃদয় হরণের মাধ্যম হবে ?

বে-পর্দায় থাকা বা সঠিকভাবে পর্দা না করা নারীরা হচ্ছে ব্যক্তিত্বহীন :

ইতিহাসের পাতায় নারী সেই প্রথম থেকেই পুরুষের পাশাপাশি তাগুতের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে । উদাহরণ স্বরূপ , আসিয়া তার স্বামী ফিরআউনের সাথে , হযরত খাদিজা (আ.) রাসূল (সা.)-এর পাশে থেকে আবু সুফিয়ানের সাথে , হযরত ফাতিমা (আ.) ইমাম আলী (আ.)-এর পাশে থেকে মুনাফিকদের সাথে , হযরত যয়নাব (আ.) তাঁর ভাই ইমাম হুসাইন (আ.) এর পাশে থেকে ইয়াযিদের সাথে ইত্যাদি । প্রকৃত পক্ষে পুরুষেরা হচ্ছে তলোয়ার চালনায় পারদর্শী আর নারীরা হচ্ছে যোদ্ধা তৈরীতে পারদর্শী । যে নারী এরূপ মর্যাদার অধিকারী , কেন সে চুপ হয়ে বসে থাকবে যখন কিনা সমাজের এক শ্রেণীর লম্পট লোক নারীদেরকে কামভাব চরিতার্থ করার উপকরণ বানানোর চেষ্টায় নিয়োজিত ।

সমাজে হয়তো এমন অনেক নারী রয়েছে যারা সঠিক শিক্ষা পায় নি , নিজেদের ব্যক্তিত্বকে সঠিকভাবে গড়ার সুযোগ তাদের হয় নি , পরিবারে আদর , ভালবাসার ঘাটতি হয়েছে কিন্তু তাই বলে তো তারা নিজেদের না পাওয়ার ব্যথা নিবারণের জন্য নিজেদেরকে অসভ্য , চরিত্রহীন ও দুষ্ট প্রকৃতির ব্যক্তিদের সামনে তুলে ধরতে পারে না । কেননা তাদের এই না পাওয়ার ব্যথা নিবারণ করা এ ধরনের শয়তানী কাজ করার মাধ্যমে সম্ভব নয় , বরং এগুলো করাতে তারা মানসিক দিক দিয়ে আরো বেশী পরিমানে হতাশা অনুভব করবে এবং শরীরিকভাবে কুৎসিত ও সমাজের দৃষ্টিতে ঘৃণার পাত্র হিসেবে চিহ্নিত হবে । আর শেষ পর্যায়ে এ কাজগুলো তাদের জন্য লজ্জা , অপমান ব্যতীত অন্য কিছুই বয়ে আনবে না ।

বে-পর্দায় থাকা ও সঠিকভাবে পর্দা না করাটা হচ্ছে এক ধরনের শিরক :

বে-পর্দা ও সঠিকভাবে পর্দা না করা নারীরা আল্লাহর উপাসনা করার স্থলে নতুন নতুন মডেল বা ফ্যাশনের উপাসনা করে থাকে , আর তা হচ্ছে এক ধরনের শিরক । যদি কোন নারীর কয়েকটি পোশাক থাকে এবং তা যদি অপচয়ের মাত্রায় না পড়ে ও তা পরলে তার স্বামী খুশি হয় তবে তা পরা অত্যন্ত পছন্দনীয় ও উত্তম ব্যাপার । তবে এরূপ যেন না হয় যে , নারীর সব সময়ের চিন্তা এ জাতীয় বিষয়কে নিয়ে আবর্তিত হবে । কেননা যদি এমন হয় যে , ফ্যাশন করার উদ্দেশ্যে স্বামীকে তা কেনার জন্য চাপ সৃষ্টি করে এবং তা কিনে দিতে ধার-দেনা করতে গিয়ে স্বামীকে লজ্জায় পড়তে হয় , তবে এটা ঐ নারীর জন্য একটি বড় ধরনের পাপ ।

বে-পর্দায় থাকা ও সঠিকভাবে পর্দা না করা নারী কোন কিছু উৎপাদন করার স্থলে খরচ করে থাকে :

বে-পর্দায় থাকা ও সঠিকভাবে পর্দা না করা নারীরা কোন কিছু উৎপাদন তো করেই না বরং খরচ করে থাকে । আর সে যে খরচ করে তাতে কোন লাভও আসে না । কিন্তু অন্য নারীরা খরচ করলেও সমাজের জন্য তা সুফল বয়ে নিয়ে আসে । যেমন উপযুক্তভাবে সন্তান লালন-পালন , সংসার চালনা , হাতের কাজ , লেখা-পড়া করা ইত্যাদি । অন্য দিকে বে-পর্দায় থাকা ও সঠিকভাবে পর্দা না করা নারীরা এ সব কিছু না করেই নিজেদের ব্যাপারে যে খরচ করে থাকে তা সমাজের তো কোন উপকারেই আসে না , বরং তা ক্ষতিকারকও বটে । কেননা তাদের ঐ নষ্ট কাজের কারণেই সমাজে ফিতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি হয় এবং তার মাধ্যমে মানুষ ধ্বংস প্রাপ্ত হয় ।

বে-পর্দা ও সঠিকভাবে হিজাব না করা নারীরা মানসিক অশান্তিতে ভোগে :

যখন কেউ নতুন নতুন পোশাক ও ফ্যাশনের পেছনে ছোটাকেই তার লক্ষ্য মনে করে তখন সে মশুধাত্র তা জোগাড় করার কাজেই ব্যস্ত থাকে । যেহেতু তা জোগাড় করা কোন সহজ ব্যাপার নয় বা কোন কোন সময় তা পাওয়াই যায় না , তখন তার মনে সব সময় অশান্তিও অস্থিরতা বিরাজ করে । এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে , সে যেন কিছু একটা হারিয়ে ফেলেছে তা আর খুঁজে পাচ্ছে না । পোশাক বা ফ্যাশনের পেছনে ছোটা এই বে-পর্দা বা সঠিকভাবে পর্দা না করা নারীদের এই ধরনের অস্থিরতা কখনোই শেষ হয় না । কেননা মানুষ সত্তাগত ভাবেই লোভী প্রকৃতির তাই যদি তার কাজের ক্ষেত্রে তাকওয়া ও ধার্মিকতা না থাকে তবে সে কখনোই কোন কিছু থেকেই যেমন পদমর্যাদা , অর্থ-বিত্ত ও কামভাব থেকে তুষ্ট হয় না । আর যতক্ষণ তারা পরিতৃপ্ত না হয় ততক্ষণ তাদের মানসিক অশান্তি অব্যাহত থাকে ।

বে-পর্দা ও সঠিকভাবে পর্দা না করা ও তাকওয়াহীন নারী দেরীতে বিয়ে করে :

যখন কোন যুবক বিয়ে করতে চায় তখন সে চিন্তা করে যে , তার এমন একজন জীবন সঙ্গী দরকার যে হবে দ্বীনদার , সুশ্রী , নৈতিকতা সম্পন্ন এবং ভদ্র পরিবারের । সাথে সাথে মেয়েটি এমন হবে যেন তার সাথে সংসার করতে পারে । যেন সে প্রতিনিয়ত তার জন্য নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি না করে । তাই মেয়ে দেখার সময় তারা তাদের মা , বড় বোন বা বয়োজ্যোষ্ঠদেরকে এ কথাগুলো বলে থাকে যাতে করে তারা যেন মেয়ের মধ্যে ঐসব বৈশিষ্ট্য গুলো খুটিয়ে দেখেন । এ থেকে এটা বুঝা যায় যে , যুবকরা বে-পর্দা ও তাকওয়াহীন নারীকে (যারা প্রতিনিয়ত সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সমস্যা সৃষ্টি করে) ঘৃণা করে থাকে ।

সুতরাং একজন বিবেক সম্পন্ন যুবক অবশ্যই বিয়ের আগে তার স্ত্রী সম্পর্কিত ব্যাপারে উক্ত বিষয়গুলো চিন্তা করে থাকে । অতএব তারা কখনোই ঐ সব নারী যারা বে-পর্দায় থাকে ও তাকওয়াহীন তাদের দিকে ফিরেও তাকায় না । যে মেয়েকে বিয়ের উদ্দেশ্যে দেখতে যাবে তার ব্যাপারে যদি জানতে পারে যে , সে মেয়ে ঐরূপ বাজে স্বভাবের তবে তাকে দেখতে যাওয়া থেকেও বিরত হয়ে যায় । এরূপ অনেক ঘটনাই আমাদের সামনে উদাহরণ হিসেবে রয়েছে , এসব কারণেই তাকওয়াহীন বেপর্দা মেয়েদের দেরিতে বিয়ে হয়ে থাকে । আর সে কারণে তারা মানসিক দিক দিয়ে অনেক কষ্টও পেয়ে থাকে । অনেক সময় এই মানসিক কষ্টের কারণে তারা শরীরিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়ে ।

যে সকল যুবক বা পুরুপ ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যদা বোধ সম্পন এবং তাদের এই ব্যক্তিত্ববোধ দৃঢ় ঈমান ও আত্মিক পবিত্রতা হতে উৎসারিত হয়েছে তারা কখনোই এটা মেনে নিতে পারে না যে , এমন মেয়ের সাথে বিয়ে করবে যারা হচ্ছে বে-পর্দা ও তাকওয়াহীন এবং যাদের বর্ণনা লোকের মুখে মুখে রয়েছে । তবে যদি কোন মেয়ের ব্যাপারে বুঝা যায় যে , সে তার অতীত বিষয়ে অনুতপ্ত সেক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্নরূপ নিতে পারে ।

বে-পর্দা ও সঠিকভাবে পর্দা না করা নারীর সংসার দ্রুত ভেঙ্গে যায় :

যদি ফ্যাশন ও আধুনিকতাই জীবনের সকল কিছুর মানদণ্ড হয়ে থাকে তবে যেহেতু তা অতি দ্রুত পুরাতন হয়ে যায় ও তার কাঙ্খিত অবস্থায় থাকে না , সেহেতু নিজের চাওয়া-পাওয়া অপূর্ণ থেকে যায় ।

যেহেতু এই ধরনের পরিবারগুলোতে জীবন সঙ্গী নির্বাচনের সময় বুদ্ধি ও বিবেকের আশ্রয় নেয়া হয় না সেহেতু উক্ত পরিবারগুলো দ্রুত নড়বড়ে হয়ে যায় এবং যে কোন সময় সংসার জীবন ধ্বংস বা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যেতে পারে । শেষ পর্যন্ত তাদের তালাক নেয়া ছাড়া অন্য কোন পথ খোলা থাকে না । আর এই অপরাধের শাস্তিভোগ করে থাকে তাদের সন্তানরা এবং সন্তানরা বড় হয়ে অধিকাংশই হয় পথভ্রষ্ট ।

বে-পর্দা ও সঠিক পর্দা না করা নারী আল্লাহর খলিফা না হয়ে মানুষের হাতের খেলার পুতুল হয়ে থাকে :

বে-পর্দা ও সঠিকভাবে পর্দা না করা নারী পৃথিবীর বুকে আল্লাহ তা ’ য়ালার খলিফা না হয়ে নিজেকে চরিত্রহীন লোকদের হাতের খেলার পুতুলে পরিণত হয় । যেখানে বলা হচ্ছে যদি কোন নারী তার সম্ভ্রম রক্ষা করে এবং লজ্জাবোধকে জীবনের মূল হিসেবে গ্রহণ করে ও তার সন্তানদেরকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলে সমাজে উপহার দেয় তবে তার এই কাজ নবীদের কাজের সমতুল্য । সুতরাং নারী নিজেকে খেলার পুতুল রূপ না দিয়ে নবীদের দায়িত্ব পালন করতে পারে।

বে-পর্দা ও সঠিকভাবে পর্দা না করা নারী অর্থহীন বিষয়ে প্রতিযোগিতা করে :

একজন নারীর পক্ষে এটা সম্ভব যে , সে জ্ঞান চর্চা , হস্তশিল্প , কারু শিল্প প্রভৃতি বিষয়ে অন্যদের সাথে প্রতিয়োগিতা করে এবং নিজে নৈতিক ও সামাজিকভাবে পরিপূর্ণতায় পৌঁছাবে , যেভাবে অনেক নারীই বর্তমানে বিভিন্ন বিষয়ে পুরুষের থেকে এগিয়ে রয়েছে । কিন্তু বে-পর্দা ও তাকওয়াহীন নারীরা আধুনিকতার নামে নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপনের লক্ষ্যে সাজসজ্জা , ফ্যাশন , প্লাস্টিক সার্জারী , ভ্রুতোলা , নখ রাখা ও তার পরিচর্যা ইত্যাদি বিষয়ে একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় । এ বস্তুগুলো সুতা , পশম ও প্লাস্টিক নির্মিত কিছু বস্তু বৈ কিছু নয় । বস্তুত ফ্যাশন , সাজসজ্জা নিয়ে প্রতিযোগিতা এসব বস্তু নিয়েই প্রতিযোগিতার শামিল যা কিছু দিন পর আবর্জনার স্তুপে পরিণত হয় ।

বে-পর্দা ও সঠিকভাবে পর্দা না করা তাকওয়াহীন নারী নিজেকে মূল্যহীন করে থাকে :

যেখানে নারীদের জন্যে লজ্জা হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং তা রক্ষা করা একান্ত জরুরী , আর তা রক্ষা করলে সকলেই তাকে মূল্য দেয় ও বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করে কিন্তু তাকওয়াহীন তা না করে নিজেকে বে- পর্দা করে অন্যের সামনে উপস্থাপন করার মাধ্যমে নিজেকে মূল্যহীন করে ফেলে ।

বেপর্দা ও সঠিক পর্দা না করা নারীরাও বেপর্দার মন্দ প্রভাবের শিকার হয় :

বেপর্দা ও তাকওয়াহীন নারীদের অশালীন ভাবভঙ্গীও বিভিন্ন শয়তানী কর্মকাণ্ডের কারণে তাদের প্রতি ঈমানহীন লোকেরা আকৃষ্ট হয়ে থাকে । সে কারণেই কখনো দেখা যায় যে , এ ধরনের নারীদের কারণে অনেক স্বামী তাদের স্ত্রীদের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে যায় । অবশেষে এই তাকওয়াহীন নারীরা একটি বা কয়েকটি পরিবার ধ্বংসের মূল কারণ হয়ে থাকে । আর এভাবেই তারা এই ন্যাক্কার জনক কাজের মাধ্যমে মহা পাপে লিপ্ত হয়ে থাকে ।

তবে অবশ্যই বলতে হয় যে , হে নারী আপনি তো এমন করলেন তবে এটাও জেনে রাখুন আপনার থেকেও অধিক সুন্দরী নারী রয়েছে এবং সে আপনার সংসার ও আপনার পরিবারেও অশান্তির সৃষ্টি করবে । প্রকৃত পক্ষে আপনি একটি পাথর ছুড়েছেন , কিন্তু পাথরটি ফিরে এসে আপনার দিকেই ফিরে আসবে । ”

পাশ্চাত্যেরন্যায় বেপর্দা ও তাকওয়াহীন নারীদের মধ্যে নৈতিক অনাচার , জুলুম এবং গর্ভপাতের মত আরো অনেক জঘন্য কাজ করার প্রবণতা বেশী দেখা যায় :

যদি কোন রাষ্ট্র ইসলামী রাষ্ট্র না হয়ে থাকে , তাহলে এমন কোন ক্ষমতা নেই যে সে রাষ্ট্রের জুলুম-অত্যাচার , খুন , রাহাজানি ইত্যাদিকে বন্ধ করতে পারে , যদিও সে রাষ্ট্র আধুনিক অস্ত্র , সামরিক ও গোয়েন্দা বিভাগের ক্ষেত্রে যত শক্তিশালীই হোক না কেন । কেননা সে রাষ্ট্রের সরকার হয়তো পুলিশ দিয়ে বাহ্যিকভাবে ঐ সবের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারে । কিন্তু কোন কিছুই করতে পারবে না । কেননা যদি পারতো তবে সারা বিশ্বে জুলুম-অত্যাচার , খুন , রাহাজানি , ইত্যাদির পরিমান এত অধিক হতো না ।

সুতরাং অবশ্যই এই বাহ্যিক শক্তির সাথে অন্য আরো একটি শক্তির সমন্বয় প্রয়োজন । যাতে করে সমাজ অবক্ষয় থেকে মুক্তি পায় । আর ঐ অন্য একটি শক্তি অবশ্যই দ্বীনের কাছ থেকে নিতে হবে । কেননা যদি প্রকৃত ধর্মীয়বোধ মানুষের অন্তরে প্রবেশ করে তবে গোপন ও প্রকাশ্যে অর্থাৎ সকল সময়ই মানুষের সাথে এ বোধের সহাবস্থান রয়েছে যা মানুষকে ভাল কাজের জন্য উৎসাহ এবং মন্দ কাজ করতে বাধা দিয়ে থাকে । এই শক্তি সেই আল্লাহ ও কিয়ামতের বিশ্বাস হতে উৎসারিত যা মিলিয়ন মিলিয়ন পুলিশের থেকেও সমাজের জন্য অনেক বেশী ফলদায়ক । তাই যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের এই বিশ্ব এই অভ্যন্তরীণ শক্তিতে পরিপূর্ণ না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত ঐ ধরনের অন্যায়-অনাচার , জুলুম-নিপীড়ন চলতেই থাকবে এমনকি বর্তমান অবস্থা থেকে আরো খারাপ দিকে চলে যেতে পারে ।

পাশ্চাত্য ও ইউরোপের দেশগুলো প্রচার প্রপাগাণ্ডার মাধ্যমে বিশ্বের অধিকাংশ জাতিকে বিশেষ করে যুবকদেরকে বুঝাতে চেষ্টা করে যে , এই পৃথিবীর মানুষদেরকে বিশেষত আমেরিকাই কেবলমাত্র সকলকে সৌভাগ্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছিয়ে দিতে পারে তারা ব্যতীত অন্য কারো এমন ক্ষমতা নেই । তাদের এই ধরনের প্রচারণার মাধ্যম হচ্ছে বিশ্বের বড় বড় সংবাদ সংস্থাগুলো যেমন , আমেরিকান সংবাদ সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) , ইউনাইটেড প্রেস (ইউপি) , ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা রয়টার , ফ্রান্সের সংবাদ সংস্থা (এফ পি) । এই সংবাদ সংস্থাগুলো গড়ে দৈনিক ৪৫ মিলিয়ন শব্দ ১১০ টি দেশে প্রেরণ করে থাকে । এই চার সংবাদ সংস্থা আনুমানিক ৫০০ টি রেডিও স্টেশন এবং টেলিভিশন সেন্টার থেকে খবর পরিবেশন করে থাকে । অন্যদিকে রাশিয়ান সংবাদ সংস্থা তাস হতেও প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ শব্দ প্রচার হচ্ছে । এর বাইরে সি এন এন ও বিবিসি তো রয়েছেই । শুধু বিবিসির কর্মচারীর সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারের অধিক । আর এই সংবাদ সংস্থাগুলো ইসলামের বিরুদ্ধে প্রচারের ক্ষেত্রে কেউ কারো থেকে কম নয় । বর্তমান সময় যেহেতু স্যাটেলাইটের যুগ তাই তারা যে কত প্রকারের খবর তাতে দিচ্ছে তা গণনার বাইরে ।

প্রকৃতপক্ষে বলতে হয় যে , বর্তমান সময়টি হচ্ছে পুরাতন সেই দাস প্রথারই ধারাবাহিকতা , তবে নতুন আঙ্গিকে । কেননা অতীতে হামলা , লুট , হত্যা , রাহাজানি ইত্যাদির মাধ্যমে শাসকরা রাজ্য শাসন করতো । বর্তমান দুনিয়া যেহেতু অগ্রগতি লাভ করেছে তাই শাসকরা সেই পুরাতন পদ্ধতিকেই নতুন আঙ্গিকে রূপ দান করে দুনিয়ার সবাইকে নিজেদের গোলাম বানানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে । কেননা উক্ত সংবাদ সংস্থাগুলো প্রতিদিন নতুন নতুন মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে দুনিয়ার সাধারণ মানুষদের চিন্তার উপর প্রভাব বিস্তার করে তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে চলেছে । আর এর মাধ্যমেই তারা তাদের ভ্রান্ত মতাদর্শগুলো এবং নষ্ট সংস্কৃতিকে মানুষের অন্তরে প্রবেশ করিয়ে থাকে । আর এই পদ্ধতিতে তারা মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলে ঐ সকল দেশসমূহের উপর অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক , সাংস্কৃতিক ও সামরিক দিক দিয়ে কর্তৃত্ব অর্জন করে থাকে । আর যখন কোন দেশ বা বিপ্লবী জাতি তাদের এই সব অপসংস্কৃতি ও অন্যায়- অত্যাচারের বিপক্ষে রুখে দাঁড়ায় তখন এই সব সংবাদ সংস্থাগুলো মিথ্যা খরব পরিবেশন করে ঐ সব দেশ ও বিপ্লবী জাতিকে বিশ্বের সামনে অপরাধী ও সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে । কিন্তু আল্লাহ্ তা ’ য়ালার একান্ত কৃপায় ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর একনিষ্ঠ প্রচেষ্টার ফসল হিসেবে ইরানে ইসলামী বিপ্লব সফল হওয়াতে শয়তান উপযুক্ত শিক্ষা পেয়েছে । কেননা আল্লাহ্ তা ’ য়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন যে , যদি মু ’ মিনগণ জিহাদের ব্যাপারে দুর্বলতার পরিচয় না দেয় এবং পবিত্র অন্তর ও খাঁটি নিয়তে শত্রুর মুকাবিলায় দাঁড়িয়ে যায় তাহলে তিনি তাদেরকে বিজয় দান করেন । আর এটাই হচ্ছে তাঁর সব সময়ের রীতি ।

পাশ্চাত্যের দেশসমূহ এই বিষয়গুলো ছাড়াও নিজেদের নষ্ট সংস্কৃতিকে বাহ্যিক চাকচিক্যের মোড়কে সাজিয়ে বিভিন্ন ভাবে প্রচার করছে যাতে করে পৃথিবীর মানুষদের বিশেষ করে যুব সমাজকে ভিন্ন পথে পরিচালিত করতে পারে । এক্ষেত্রে মূলত তারা যৌনতাকে পুঁজি করে তাদেরকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত । তাদের লক্ষ্য হলো যুবকরা যেন এ সব বিষয় নিয়েই ব্যস্ত থাকে এবং তাদের দেশের জরাজীর্ণ রাজনীতি , অর্থনীতি , সামরিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় নিয়ে চিন্তার অবকাশ না পায় এবং তা নিয়ে সোচ্চার না হয়ে ওঠে এবং আন্তর্জাতিক দুর্বৃত্ত ইউরোপ ও আমেরিকার বিরুদ্ধাচারণ না করে । তবে তারা অন্যান্য দেশগুলোকে নিজেদের আয়ত্তে আনার জন্য যে ফাঁদ পেতেছে সেই ফাঁদে তাদের দেশের মানুষ অন্য সকলের আগে পা দিয়েছে এবং ধ্বংস হওয়ার পর্যায়ে পৌঁছেছে । যদিও পাশ্চাত্য আজ বস্তুগতভাবে উন্নতি করেছে কিন্তু সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে মানুষের যে বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন তা তাদের নেই । যেমন আত্মসম্মানবোধ , পারস্পরিক সহমর্মিতা , লজ্জা , ভালবাসা , সাহসিকতা , পরিবারে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস , নারীর সতীত্ববোধ ইত্যাদি সকল মানবীয় গুণাবলী তারা হারিয়ে ফেলেছে ।

আমরা এখানে আমাদের প্রিয় দেশবাসী বিশেষ করে যুব সমাজের সামনে পাশ্চাত্যের একটি চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করবো যাতে করে তাদের প্রকৃত অবস্থা কিছুটা হলেও সবার সামনে পরিষ্কার হয়:

মানবাত্মার ব্যাধি

প্রথমে আমরা যে সকল বস্তু মানবাত্মাকে ব্যাধিগ্রস্ত করে তা সংক্ষেপে আলোচনা করব। মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে বঞ্চনা আত্মিক রোগের অন্যতম উৎস। অধিকাংশ মানসিক রোগের কারণ হলো বঞ্চনা। আপনারা জানেন ফ্রয়েড বাড়াবাড়িমূলকভাবে এ তত্ত্বের উপর নির্ভর করেছেন,বিশেষত যৌনতার বিষয়ে। যা হোক বঞ্চনা মানসিক ব্যাধির প্রধান কারণ। বঞ্চনা মানুষের মনে বিদ্বেষের সৃষ্টি করে। যখন মানুষ অন্তরে কারো প্রতি বিদ্বেষ অনুভব করে তখন তার থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে চায় এবং যতক্ষণ না তাকে হত্যা বা লাঞ্ছিত করতে পারে ততক্ষণ শান্তি লাভ করতে পারে না। এ প্রতিশোধ স্পৃহাটি কি?

হিংসুক ব্যক্তি যখন কারো ভালো বা কল্যাণ দেখে তখন তার সমগ্র কামনা হয়ে ওঠে এটা যে,ঐ ব্যক্তি থেকে এ কল্যাণ যেন দ্রুত অপসারিত হয়। নিজের বিষয়ে তখন সে আর চিন্তা করে না,বরং ঐ ব্যক্তির অমঙ্গলের চিন্তায় মগ্ন হয়। সুস্থ চিন্তার মানুষ প্রতিযোগিতা করে,হিংসা করে না। সুস্থ মানুষ সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সব সময় নিজেকে নিয়ে চিন্তা করে। সব সময় এগিয়ে থাকার চিন্তা করা সুস্থতার পরিচয়,এটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু অন্যেরা সব সময় পিছে পড়ে থাক- এ চিন্তা অসুস্থতার পরিচায়ক। হিংসুক ব্যক্তির অসুস্থতা কখনো কখনো এতটা অধিক হয় যে,নিজের একশ ভাগ ক্ষতি করেও যদি অপরের পাঁচ ভাগ ক্ষতি করা যায় তাতে সে খুশী।

হিংসা রোগের নমুনা

একটি প্রসিদ্ধ কাহিনী ইতিহাসের বইয়ে এসেছে। কোন এক খলিফার সময় একজন ব্যক্তি একদাস কিনে এনেছিল। প্রথম দিন থেকেই সে তার সঙ্গে দাসের মতো আচরণ না করে বরং সম্মানিত ব্যক্তির মতো আচরণ করত। সব সময় ভাল খাবার দিত,তার জন্য ভাল পোষাক কিনত,বিশ্রামের জন্য উত্তম উপকরণ এনে দিত। মোট কথা,তার সঙ্গে নিজের সন্তানের মত আচরণ করত। মনে হতো লালন-পালনের জন্যই তাকে আনা হযেছে। দাসটি লক্ষ্য করত তার মনিব সব সময়ই বিষন্ন ও চিন্তিত। কিন্তু তার কারণ সে জানত না। একদিন মনিব তাকে ডেকে বলল, আমি তোমাকে মুক্ত করে দিতে চাই,সে সাথে প্রচুর অর্থও দিতে চাই। কিন্তু তুমি কি জান কেন তোমাকে এত আদর ও স্নেহ করেছি? এজন্য যে,তুমি যেন আমার একটি অনুরোধ রক্ষা কর। তুমি যদি তা রক্ষা কর তবে আমার আদর-স্নেহের প্রতিদান দিলে এবং এর জন্য আরো অধিক কিছু তোমাকে আমি দেব। কিন্তু যদি তা না কর তবে আমি তোমার উপর অসন্তুষ্ট। দাস বলল, যেহেতু আপনি আমার মনিব এবং আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন,আপনি যা বলবেন আমি তা-ই করব। মনিব বলল, না,তোমাকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে,আমার ভয় হয় যদি রাজি না হও। দাস বলল, যে কোন প্রস্তাব দিন আমি রাজী হব। যখন দাস প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো তখন মনিব বলল, আমার অনুরোধ হলো একটা নির্দিষ্ট সময়ে আমি তোমাকে নির্দেশ দেব। তুমি আমার মাথা গোড়া থেকে বিচ্ছিন্ন করবে। দাস বলল, আমি তা করতে পারব না। মনিব বলল, না,অবশ্যই তোমাকে তা করতে হবে। কারণ তুমি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছ। মাঝ রাতে মনিব দাসকে ঘুম থেকে জাগিয়ে একটি ধারালো ছুরি হাতে দিয়ে তাকে নিয়ে এক প্রতিবেশীর বাড়ীর ছাদে গেল আর বলল, এখানেই আমার মস্তক বিচ্ছিন্ন কর,তারপর যেখানে ইচ্ছা চলে যাও। দাস বলল, কেন এটা করব? সে বলল, যেহেতু এই প্রতিবেশীকে আমি একেবারেই সহ্য করতে পারি না। মৃত্যু আমার কাছে বেঁচে থাকার চেয়ে উত্তম। সে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী এবং সে আমার থেকে অগ্রগামী। সব কিছুতেই সে আমার থেকে উত্তম অবস্থায় রয়েছে। আমি হিংসার আগুনেজ্বলে মরছি। আমি চাই সে খুনী বলে পরিচিত হোক ও শাস্তি ভোগ করুক। যদি এমন হয় তবেই আমি শান্তি পাব। আমার শান্তি এখানেই যে,যদি আমাকে এখানে হত্যা কর,কালকে সবাই বলবে (যেহেতু প্রতিদ্বন্দ্বীর লাশ তার বাড়ির ছাদে পাওয়া গেছে) সে-ই আমাকে হত্যা করেছে। অতঃপর তাকে বন্দীকরা হবে ও পরে প্রাণদণ্ড দেয়া হবে। আমার ইচ্ছাও পূর্ণ হবে। দাস বলল, যেহেতু তুমি এমন বোকা লোক সেহেতু কেন আমি এটা করব না। তুমি এটার জন্যই উপযুক্ত। অতঃপর সে মনিবের মাথা বিচ্ছিন্ন করল এবং টাকাগুলো নিয়ে চলে গেল। পরের দিন সবখানে খবর ছড়িয়ে পড়ল। ঐ বাড়ির মালিককে গ্রেফতার করা হলো। কিন্তু সবাই বলাবলি করতে লাগল যদি সে খুনীই হতো তবে নিজের বাড়ির ছাদে খুন করতে যাবে কেন? সম্ভবত কিছু একটা আছে। ব্যাপারটা রহস্যময়। দাসের বিবেক তাকে চিন্তায় ফেলল। অবশেষে বিচারকের কাছে গিয়ে সত্য ঘটনা বর্ণনা করে সে বলল, আমি তার ইচ্ছাতেই তাকে হত্যা করেছি। সে প্রতিহিংসায় এতটা অন্ধ হয়ে গিয়েছিল যে,মৃত্যুকে জীবনের উপর প্রাধান্য দিয়েছে। যখন প্রমাণিত হলো ঘটনা এ রকম তখন দাস এবং ঐ বাড়ির মালিক দু জনকেই মুক্তি দেয়া হলো।

সুতরাং এটা বাস্তব যে,মানুষ প্রকৃতই হিংসা রোগে অসুস্থ হয়। কোরআন বলছে,

( قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا)

সে-ই সফলকাম হলো যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করল এবং সে-ই অকৃতকার্য হলো যে তা প্রোথিত করল। কোরআনের প্রথম কর্মসূচী আত্মার পরিশুদ্ধি ও উন্নয়ন এবং হৃদয়কে মানসিক রোগ,সমস্যা,অশান্তি,অন্ধকার ও বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করা।

রূপান্তরিত মানুষ

রূপান্তরের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রূপান্তর অর্থ কি? নিশ্চয় শুনেছেন পূর্বকালে এক উম্মত ছিল যারা প্রচুর গুনাহের কারণে তৎকালীন নবীর দ্বারা অভিশপ্ত হয়ে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ অন্য এক পশুতে পরিণত হয়েছিল। যেমন বানর,শূকর,নেকড়ে বা অন্য কোন প্রাণীতে। এটাকেই রূপান্তর বলা হচ্ছে। এই রূপান্তর প্রকৃতপক্ষে কিরূপ ছিল? মানুষ কি প্রকৃতই পশুতে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। এখন এর ব্যাখ্যা করব। এটি অনস্বীকার্য যে,মানুষ দৈহিকভাবে রূপান্তরিত বা পশুতে পরিণত নাহলেও মানসিক ও আত্মিকভাবে রূপান্তরিত বা পশুতে পরিণত হয়,এমনকি কখনো কখনো এত নিকৃষ্ট প্রাণীতে পরিণত হয় যে,যার নজীর পৃথিবীতে খুজে পাওয়া বিরল। কোরআন বলছে-( بل هم أضلّ )   অর্থাৎ চতুষ্পদ জন্তু হতেও নিকৃষ্ট। এখন প্রশ্ন হলো মানুষ কি প্রকৃতই মানসিক ও আত্মিকতার দিক থেকে পশুতে পরিণত হতে পারে? উত্তর হলো,হ্যাঁ। কারণ মানুষের ব্যক্তিত্ব তার চারিত্রিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে। যদি কোন মানুষের চারিত্রিক ও আত্মিক বৈশিষ্ট্য কোন হিংস্র প্রাণীর বা চতুস্পদ পশুর মত হয় তবে সে প্রকৃতই রূপান্তরিত হয়েছে। অর্থাৎ তার আত্মা প্রকৃতই রূপান্তরিত ও পরিবর্তিত হয়ে এক পশুতে পরিণত হয়েছে। শূকরের দেহ তার আত্মার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু মানুষ দৈহিকভাবে শূকরের মত না হয়েও শূকরের সকল স্বভাব ধারণ করতে পারে। যদি কোন মানুষ এরূপ হয় তবে সে রূপান্তরিত হয়েছে। বাস্তব ও অন্তর্দৃষ্টিতে সে প্রকৃতই একটি শূকর বৈ কিছু নয়। তাই ত্রুটিযুক্ত মানুষ কখনো কখনো রূপান্তরিত মানুষে পরিণত হয়। আমরা এ সব কথা কম শুনি এবং অনেকেই মনে করেন এগুলো metaphoric বা allegory (রূপক) এবং এগুলো বিশ্বাস করতে চান না। কিন্তু এটা খুবই সত্য।

এক ব্যক্তি বর্ণনা করেছে, ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.)-এর সাথে আরাফাতের ময়দানে ছিলাম। উপর থেকে লক্ষ্য করলাম ময়দান হাজীতে পূর্ণ। ইমামকে উদ্দেশ্য করে বললাম : কি পরিমাণ হাজী এ বছর এসেছে আলহামদুলিল্লাহ্। ইমাম বললেন : চিৎকার এত বেশি,কিন্তু হাজী খুবই কম। ঐ ব্যক্তি বলেছে, তারপর জানি না ইমাম এমন দৃষ্টি শক্তি দান করলেন আমাকে এবং বললেন : লক্ষ্য কর। আমি লক্ষ্য করলাম সম্পূর্ণ ময়দান যেন পশুতে পূর্ণ- যেন পশু আলয়ের (চিড়িয়াখানা) মধ্যে সামান্য কিছু মানুষ চলাচল করছে। ইমাম বললেন : এখন দেখ বাতেন (অপ্রকাশ্য) কিরূপ! যারা অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন ও আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী তাদের নিকট এ বিষয়টি প্রদীপের মতই উজ্জ্বল। এখন যদি আধুনিক চিন্তাধারার কেউ তা অস্বীকার করতে চায় তাহলে ভুল করবে। আমাদের এখনকার সময়ও ব্যক্তি-বিশেষ ছিলেন এবং আছেন যারা মানুষের সত্তাকে অনুভব করেন এবং দেখেন।

যে মানুষ চতুষ্পদ জন্তুর মত শুধু খাওয়া,ঘুমানো,যৌন চাহিদা পূরণ ছাড়া (প্রাণীর) অন্য কোন চিন্তা করে না,তার চিন্তা শুধু এটাই যে,খাবে,ঘুমাবে আর দৈহিক আনন্দ অনুভব করবে,প্রকৃতপক্ষে তার আত্মা একটা চতুস্পদ জন্তু ছাড়া আর কিছুই নয়। তার অন্তর একটি রূপান্তরিত মানুষে পরিণত হয়েছে। যার স্বভাব রূপান্তরিত,তার মানবিক বৈশিষ্ট্য রূপান্তরিত- কিভাবে তা ব্যাখ্যা দেব। অর্থাৎ তার মনুষ্যত্ব তার নিকট থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে,ঐ স্থানে সে নিজের জন্য চতুষ্পদ ও হিংস্র পশুর চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে।

সূরা নাবায় আমরা পড়ি সে দিন যখন শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে তখন তোমরা দলে দলে আসবে। এবং আকাশকে উন্মুক্ত করা হবে ফলে তা বহু দ্বারে বিভক্ত হয়ে পড়বে। পর্বতকে বিচলিত করা হবে ফলে তা মরীচিকায় পরিণত হবে। (সূরা নাবা : ১৮-২০) কিয়ামতের দিন মানুষ দলে দলে পুনরুত্থিত ও সমবেত হবে। রাসূলগণ সব সময়ই বলেছেন,শুধু মানুষের একটি দল মানুষের চেহারায় পুনরুত্থিত হবে। কোন কোন দল পিপীলিকার মত,কোন দল সাপের মত,কোন দল নেকড়ের মত চেহারা নিয়ে হাশরের ময়দানে আবির্ভূত হবে। কেন? এটা কি সম্ভব কোন কারণ ছাড়াই মহান আল্লাহ্ মানুষকে এ রকম আকৃতিতে পুনরুত্থিত করবেন? যে ব্যক্তির পৃথিবীতে মানুষকে ক্ষত বিক্ষত করা ছাড়া কোন কাজ ছিল না,যার সকল আনন্দ অন্যদের কষ্ট দেয়ার মধ্যে নিহিত ছিল সে প্রকৃতই একটি বিষাক্ত বিচ্ছু। তাই সে সেভাবেই পুনরুত্থিত হবে। যে ব্যক্তির বাঁদরামী করাই একমাত্র স্বভাব ছিল কিয়ামতে প্রকৃতই সে বাঁদরের চেহারা নিয়ে আবিভূত হবে। এমনিভাবে যার স্বভাব কুকরের মতো সে কুকর হিসেবে পুনরুত্থিত হবে। মানুষ তার নিয়্যতের (কাজের) উপর ভিত্তি করেই পুনরুত্থিত হবে। (মুসনাদে আহমদ,২য় খণ্ড,পৃ. ৩৯২)

কিয়ামতে মানুষ তার নিয়্যত,উদ্দেশ্য,ইচ্ছা,তার স্বভাব ও তার প্রকৃত বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে পুনরুত্থিত হবে। আপনি এ পৃথিবীতে কি চেহারাতে আছেন? কি হতে চান? কি বস্তু চান? আপনার ইচ্ছাগুলো কি মানুষের চাওয়া নাকি কোন হিংস্র পশুর চাওয়া ? নাকি এক তৃণভোজীর মতো চাওয়া? যা আপনি চান আপনি তা-ই এবং সে চেহারাতেই আপনি পুনরুত্থিত হবেন যে রকম আছেন।

এটাই আমাদের আল্লাহ্ ব্যতীত সকল কিছুর উপাসনা থেকে বিরত করে। আমরা যা কিছুর উপাসনা করব তার মতোই হব। যদি টাকার উপাসনা করি,যদি অর্থ আমাদের অস্তিত্ব ও অস্তিুত্বের অংশে পরিণত হয়,এ অর্থ কিয়ামতে সে-ই উত্তপ্ত ধাতব পদার্থে পরিণত হবে। কোরআন এ পৃথিবীতে যাদের অস্তিত্ব এই ধাতব পদার্থের অস্তিুত্বের সাথে মিশে গিয়েছে এবং এই ধাতুর উপাসনা ছাড়া যার কোন কাজ নেই তাদের উদ্দেশ্যে বলেছে, এবং যারা সোনা-রূপা মজুদ করে এবং আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না,তুমি তাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দাও। সে দিন তা জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের কপালে,পার্শ্বদেশে ও তাদের পৃষ্ঠদেশে দাগ দেয়া হবে। এবং বলা হবে এটা সেই বস্তু যা তোমরা নিজেদের জন্য প্রস্তত করতে। (সূরা তাওবা : ৩৪-৩৫)

এ অর্থই সে দিন উত্তপ্ত করা হবে- তার জন্য জাহান্নামের আগুনে পরিণত হবে। এটা অন্যতম উপাদান যা মানুষকে রূপান্তরিত করে।

আমি এ বৈঠকে ত্রুটিযুক্ত ও ত্রুটিহীন মানুষের বিষয়টি সংক্ষেপে বর্ণনা করতে চাচ্ছিলাম। সমস্যাগ্রস্ত (মানসিক) মানুষ একজন ত্রুটিপূর্ণ মানুষ। যে মানুষ পৃথিবীর কোন বস্তুকে উপাসনা করে-তার দৈনন্দিন কাজে বস্তু ব্যবহারকারী নয়,বরং এর উপাসনাকারী- সে মানুষ ত্রুটিযুক্ত এবং একজন রূপান্তরিত মানুষ।

পবিত্র রমযান মাসের মানুষ গঠনের পরিকল্পনা

আসলেই পবিত্র রমযান মাসের কর্মসূচী মানুষ গঠনের পরিকল্পনার । অর্থাৎ কর্মসূচীর উদ্দেশ্য এটাই যে,এ মাসে ত্রুটিযুক্ত মানুষ নিজেকে ত্রুটিহীন মানুষে এবং ত্রুটিহীন মানুষ নিজেকে পূর্ণ মানুষে পরিণত করবে। এ পবিত্র মাসের পরিকল্পনা নাফ্স বা প্রবৃত্তির পরিশুদ্ধি,মানবীয় ত্রুটি ও অপূর্ণতার সংশোধন,প্রবৃত্তির জৈবিক তাড়নার উপর বুদ্ধিবৃত্তি,ঈমান ও ইচ্ছা শক্তির বিজয় ও নিয়ন্ত্রণ।

এর জন্য দোয়ার কর্মসূচী,সত্যের পথে ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর দিকে উড্ডয়ন,আত্মার উন্নয়নের জন্য কর্মসূচী,আত্মাকে বিকাশমান ও গতিশীল করার পরিকল্পনা দেয়া হয়েছে। যদি এমন হয় যে,পবিত্র রমযান মাস এল,মানুষ ত্রিশ দিন ক্ষুধার্ত,তৃষ্ণার্ত ও নিদ্রাহীন থাকল,উদাহরণস্বরূপ রাত্রিগুলোতে অনেক সময় জেগে থাকল,এখানে ওখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করল,তারপর ঈদ আসলো,কিন্তু রমযানের পূর্বের দিন থেকে তার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি,তাহলে ঐ রোযা তার জন্য কোন উপকারই বয়ে আনেনি। ইসলাম তো এটা চায় না যে,মানুষ এমনিই মুখ বন্ধ করে রাখবে। মানুষ মুখ বন্ধ করুক আর না করুক ইসলামের জন্য কোন পার্থক্য নেই,বরং রোযা রাখার উদ্দেশ্য হলো এটা যে,মানুষ সংশোধিত হবে। কেন হাদীসসমূহে এমন এসেছে,প্রচুর রোযাদার আছে যারা রোযা থেকে ক্ষুধা আর তৃষ্ণা ছাড়া আর কিছুই লাভ করে না,তাদের রোযা শুধু ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত থাকা ছাড়া কিছুই নয়। হালাল খাদ্য থেকে মুখ বন্ধ করার অর্থ মানুষ এ ত্রিশ দিন একনাগাড়ে অনুশীলন করবে হারাম কথা থেকে জিহ্বাকে বিরত রাখার,গীবত না করার,মিথ্যা না বলার ও গালি না দেয়ার।

রোযা যে বাতেনী,আধ্যাত্মিক ও আত্মিক তার প্রমাণ- একদিন এক রোযাদার মহিলা রাসূল(সা.)-এর নিকট আসল। রাসূল দুধ অথবা অন্য কিছু খাওয়ার জন্য তাকে অনুরোধ করলেন। তার দিকে তা এগিয়ে দিয়ে বললেন, নাও পান কর। সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমি রোযা আছি। রাসূল বললেন, তুমি রোযা রাখনি এবং এ বলে পুনরায় তাকে খেতে নির্দেশ দিলেন। মহিলা বলল, আসলেই আমি রোযা আছি। (যেহেতু তার বিবেচনায় রোযা আছে বলে মনে করল,যেমন বাহ্যিক রোযা আমার রাখি)। রাসূল বললেন, তুমি কেমন রোযা রেখেছ যে,কিছুক্ষণ পূর্বেই তোমার মুমিনভাই বা বোনের মাংস খেয়েছ (অর্থাৎ গীবত করেছ)। তুমি কি দেখতে চাও যে,মাংস খেয়েছ। ভেতর থেকে এখনই তা উল্টিয়ে ফেল। তখনই সে বমি করল ও এক টুকরা মাংস তার মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ল। মানুষ রোযা রেখে গীবত করে। ফলে যদিও তার মুখকে হালাল খাদ্য থেকে বঞ্চিত করে,কিন্তু তার আত্মার মুখকে হারাম খাদ্য দ্বারা পূর্ণ করে।

কেন আমাদের উদ্দেশ্যে এটা বলা হয়েছে যে,যদি মানুষ একটা মিথ্যা বলে তবে তার মুখের দুর্গন্ধে সপ্ত আসমান পর্যন্ত ফেরেশতারা কষ্ট পান। যেমন বলা হয় যখন মানুষ জাহান্নামে থাকবে তখন জাহান্নাম প্রচণ্ড দুগন্ধ ছড়াবে। এ দুগন্ধ প্রকৃতপক্ষে এ দুনিয়াতেই আমরা সৃষ্টি করেছি মিথ্যা কথা বলা,গালি দেয়া,অপবাদ ও পরনিন্দা চর্চার মাধ্যমে।

পরনিন্দা ও মিথ্যা অপবাদ আরোপ গীবত থেকেও খারাপ,যেহেতু পরনিন্দার মাধ্যমে যেমন মিথ্যাও বলা হয় তেমন গীবতও করা হয়। কিন্তু যে মিথ্যা বলে সে শুধু মিথ্যাই বলে,গীবত করে না। তাই পরনিন্দায় দু টি কবীরা গুনাহ এক সঙ্গে আঞ্জাম দেয়া হয়।

এটা কি উচিত,রমযান মাস শেষ হয়ে যায়,অথচ এ মাসে আমরা একে অপরের বিরুদ্ধে নিন্দা ও অপবাদ আরোপ করতে থাকি? রমযান মাস এজন্য যে,মুসলমানরা বেশি বেশি সমবেত হবে,সম্মিলিতভাবে ইবাদত করবে,মসজিদে একত্র হবে। এজন্য নয় যে,একে অপরকে দূরে সরানোর জন্য এ মাসকে ব্যবহার করবে।

و لا حول و لا قوّة ألا بلله العلی العظیم

মানবিক মূল্যবোধের বিকাশের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনীয়তা

وَإِذِ ابْتَلَى إِبْرَاهِيمَ رَبُّهُ بِكَلِمَاتٍ فَأَتَمَّهُنَّ قَالَ إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامًا قَالَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِي قَالَ لَا يَنَالُ عَهْدِي الظَّالِمِينَ

প্রত্যেক অস্তিত্বশীল বস্তু বা প্রাণীর পূর্ণতার সঙ্গে অন্য অস্তিত্বশীল বস্তু বা প্রাণীর পূর্ণতার পার্থক্য রয়েছে। যেমন পূর্ণ মানুষ এবং পূর্ণ ফেরেশতা এক নয়। যদি কোন ফেরেশতা,ফেরেশতা হওয়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পর্যায়ে বা সম্ভাব্য পূর্ণতার শেষ প্রান্তে পৌছায়,তা মানুষের মানুষ হওয়ার ক্ষেত্রে পূর্ণতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছানো থেকে ভিন্ন।

মানুষের পূর্ণতার সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীর পূর্ণতার পার্থক্যের কারণ

যিনি আমাদের ফেরেশতাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানিয়েছেন তিনি (আল্লাহ্) বলেছেন,ফেরেশতারা এমন এক সৃষ্টি যারা নিখাদ আকল দিয়ে সৃষ্ট হয়েছেন,তাদের সৃষ্টির মূল কেবল চিন্তা ও বিবেচনা ছাড়া কিছুই নয় অর্থাৎ পার্থিব,জৈবিক চাহিদা,উত্তেজনা,উগ্রতা এগুলোর অস্তিত্ব নেই। অন্যদিকে অন্যান্য জীব শুধু শারীরিক এবং কোরআন যাকে রূহ বলছে তা থেকে বঞ্চিত। শুধু মানুষই একমাত্র সৃষ্টি যে ফেরেশতাদের যা আছে তা লাভ করেছে আবার অন্যান্য সৃষ্টির যা আছে তারও সে অধিকারী। সে যেমন স্বর্গীয় তেমন পার্থিব। সে যেমন সর্বোচ্চ সৃষ্টি তেমনি সর্ব নিকৃষ্টও হতে পারে। এরই ব্যাখ্যায় উছুলে কাফীতে একটি হাদীস এসেছে এবং আহলে সুন্নাতও এর কাছাকাছি হাদীস বর্ণনা করেছে। মাওলানা রুমী তার মাসনভীতে এ হাদীস এভাবে কবিতার মাধ্যমে এনেছেন-

হাদীসে এসেছে গৌরবময় স্রষ্টা মহাজন,

সৃষ্টি জগতে করিলেন তিন রকম সৃজন।

তারপর বলছেন,এক দলকে নিখাত নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন অন্য দলকে (উদ্দেশ্য জীবজন্তু) শুধুই উত্তেজনা এবং জৈবিক চাহিদা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন,কিন্তু মানুষকে এ দু য়ের মিশ্রণে সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং পরিপূর্ণ মানুষ যেমন একটি পরিপূর্ণ পশুর থেকে ভিন্ন (উদাহরণস্বরূপ সর্বোৎকৃষ্ট ও পূর্ণতাপ্রাপ্ত একটি ঘোড়া থেকে আলাদা) তেমনি একজন পূর্ণ ফেরেশতা থেকেও ভিন্ন।

ফেরেশতা ও অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে মানুষের পাথর্ক্যের কারণ তার সত্তার উপাদান যেমন কোরআন বলছে, আমরা মানুষকে এমন বীর্য থেকে সৃষ্টি করেছি যাতে অনেক কিছুর মিশ্রণ রয়েছে। আধুনিকতার ভাষায় বললে তার জীনগুলোতে বিভিন্ন ধরনের মেধা,যোগ্যতা ও ক্ষমতার সমন্বয় হয়েছে। মানুষ এমন মর্যাদায় পৌছেছে যে,আমরা তাকে পরীক্ষার জন্য নির্বাচন করেছি। এটি অত্যন্ত.গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ মানুষ এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে,আমরা তাকে স্বাধীন করে সৃষ্টি করেছি এবং তাকে দায়িত্ব পালনের জন্য উপযুক্ত পরীক্ষা ও নম্বর প্রদানের জন্য যোগ্য মনে করেছি। ( إِنَّا خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ مِنْ نُطْفَةٍ أَمْشَاجٍ ) নিশ্চয়ই মানুষকে এমন বীর্য যা বহু গুণাবলী ও শক্তির মিশ্রণ তা থেকে সৃষ্টি করেছি। এজন্যই তাকে পরীক্ষা,পুরস্কার,শক্তি ও নম্বর প্রদান করেছি। কিন্তু অন্য কেউ যোগ্যতা রাখে না।

 ) فَجَعَلْنَاهُ سَمِيعًا بَصِيرًا إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيلَ إِمَّا شَاكِرًا وَإِمَّا كَفُورًا(

অতঃপর আমরা তাকে সম্যক শ্রবণকারী এবং দর্শনকারী করেছি। নিশ্চয় আমরা তাকে সঠিক পথ দেখিয়েছি,হয়তো সে কৃতজ্ঞ হবে,নয়তো সে অকৃতজ্ঞ হবে। (সূরা দাহর : ২-৩)

এর থেকে ভালো ও সুন্দরভাবে মানুষের স্বাধীনতা ও এখতিয়ার এবং এর মূল ভিত্তিকে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তাকে পরীক্ষার মধ্যে ফেলেছি,উত্তীর্ণের পথও তাকে বলে দিয়েছি। এখন সে নিজেই বেছে নিবে কোন্ দিকে সে যাবে।

সুতরাং কোরআনের এ বর্ণনা থেকে পরিষ্কার হয় যে,পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার কারণ এ বহুবিধ গুণাবলী ও শক্তি। তাই ফেরেশতার সঙ্গে তার পার্থক্য।

মানবাত্মার ব্যাধি

প্রথমে আমরা যে সকল বস্তু মানবাত্মাকে ব্যাধিগ্রস্ত করে তা সংক্ষেপে আলোচনা করব। মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে বঞ্চনা আত্মিক রোগের অন্যতম উৎস। অধিকাংশ মানসিক রোগের কারণ হলো বঞ্চনা। আপনারা জানেন ফ্রয়েড বাড়াবাড়িমূলকভাবে এ তত্ত্বের উপর নির্ভর করেছেন,বিশেষত যৌনতার বিষয়ে। যা হোক বঞ্চনা মানসিক ব্যাধির প্রধান কারণ। বঞ্চনা মানুষের মনে বিদ্বেষের সৃষ্টি করে। যখন মানুষ অন্তরে কারো প্রতি বিদ্বেষ অনুভব করে তখন তার থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে চায় এবং যতক্ষণ না তাকে হত্যা বা লাঞ্ছিত করতে পারে ততক্ষণ শান্তি লাভ করতে পারে না। এ প্রতিশোধ স্পৃহাটি কি?

হিংসুক ব্যক্তি যখন কারো ভালো বা কল্যাণ দেখে তখন তার সমগ্র কামনা হয়ে ওঠে এটা যে,ঐ ব্যক্তি থেকে এ কল্যাণ যেন দ্রুত অপসারিত হয়। নিজের বিষয়ে তখন সে আর চিন্তা করে না,বরং ঐ ব্যক্তির অমঙ্গলের চিন্তায় মগ্ন হয়। সুস্থ চিন্তার মানুষ প্রতিযোগিতা করে,হিংসা করে না। সুস্থ মানুষ সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সব সময় নিজেকে নিয়ে চিন্তা করে। সব সময় এগিয়ে থাকার চিন্তা করা সুস্থতার পরিচয়,এটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু অন্যেরা সব সময় পিছে পড়ে থাক- এ চিন্তা অসুস্থতার পরিচায়ক। হিংসুক ব্যক্তির অসুস্থতা কখনো কখনো এতটা অধিক হয় যে,নিজের একশ ভাগ ক্ষতি করেও যদি অপরের পাঁচ ভাগ ক্ষতি করা যায় তাতে সে খুশী।

হিংসা রোগের নমুনা

একটি প্রসিদ্ধ কাহিনী ইতিহাসের বইয়ে এসেছে। কোন এক খলিফার সময় একজন ব্যক্তি একদাস কিনে এনেছিল। প্রথম দিন থেকেই সে তার সঙ্গে দাসের মতো আচরণ না করে বরং সম্মানিত ব্যক্তির মতো আচরণ করত। সব সময় ভাল খাবার দিত,তার জন্য ভাল পোষাক কিনত,বিশ্রামের জন্য উত্তম উপকরণ এনে দিত। মোট কথা,তার সঙ্গে নিজের সন্তানের মত আচরণ করত। মনে হতো লালন-পালনের জন্যই তাকে আনা হযেছে। দাসটি লক্ষ্য করত তার মনিব সব সময়ই বিষন্ন ও চিন্তিত। কিন্তু তার কারণ সে জানত না। একদিন মনিব তাকে ডেকে বলল, আমি তোমাকে মুক্ত করে দিতে চাই,সে সাথে প্রচুর অর্থও দিতে চাই। কিন্তু তুমি কি জান কেন তোমাকে এত আদর ও স্নেহ করেছি? এজন্য যে,তুমি যেন আমার একটি অনুরোধ রক্ষা কর। তুমি যদি তা রক্ষা কর তবে আমার আদর-স্নেহের প্রতিদান দিলে এবং এর জন্য আরো অধিক কিছু তোমাকে আমি দেব। কিন্তু যদি তা না কর তবে আমি তোমার উপর অসন্তুষ্ট। দাস বলল, যেহেতু আপনি আমার মনিব এবং আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন,আপনি যা বলবেন আমি তা-ই করব। মনিব বলল, না,তোমাকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে,আমার ভয় হয় যদি রাজি না হও। দাস বলল, যে কোন প্রস্তাব দিন আমি রাজী হব। যখন দাস প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো তখন মনিব বলল, আমার অনুরোধ হলো একটা নির্দিষ্ট সময়ে আমি তোমাকে নির্দেশ দেব। তুমি আমার মাথা গোড়া থেকে বিচ্ছিন্ন করবে। দাস বলল, আমি তা করতে পারব না। মনিব বলল, না,অবশ্যই তোমাকে তা করতে হবে। কারণ তুমি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছ। মাঝ রাতে মনিব দাসকে ঘুম থেকে জাগিয়ে একটি ধারালো ছুরি হাতে দিয়ে তাকে নিয়ে এক প্রতিবেশীর বাড়ীর ছাদে গেল আর বলল, এখানেই আমার মস্তক বিচ্ছিন্ন কর,তারপর যেখানে ইচ্ছা চলে যাও। দাস বলল, কেন এটা করব? সে বলল, যেহেতু এই প্রতিবেশীকে আমি একেবারেই সহ্য করতে পারি না। মৃত্যু আমার কাছে বেঁচে থাকার চেয়ে উত্তম। সে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী এবং সে আমার থেকে অগ্রগামী। সব কিছুতেই সে আমার থেকে উত্তম অবস্থায় রয়েছে। আমি হিংসার আগুনেজ্বলে মরছি। আমি চাই সে খুনী বলে পরিচিত হোক ও শাস্তি ভোগ করুক। যদি এমন হয় তবেই আমি শান্তি পাব। আমার শান্তি এখানেই যে,যদি আমাকে এখানে হত্যা কর,কালকে সবাই বলবে (যেহেতু প্রতিদ্বন্দ্বীর লাশ তার বাড়ির ছাদে পাওয়া গেছে) সে-ই আমাকে হত্যা করেছে। অতঃপর তাকে বন্দীকরা হবে ও পরে প্রাণদণ্ড দেয়া হবে। আমার ইচ্ছাও পূর্ণ হবে। দাস বলল, যেহেতু তুমি এমন বোকা লোক সেহেতু কেন আমি এটা করব না। তুমি এটার জন্যই উপযুক্ত। অতঃপর সে মনিবের মাথা বিচ্ছিন্ন করল এবং টাকাগুলো নিয়ে চলে গেল। পরের দিন সবখানে খবর ছড়িয়ে পড়ল। ঐ বাড়ির মালিককে গ্রেফতার করা হলো। কিন্তু সবাই বলাবলি করতে লাগল যদি সে খুনীই হতো তবে নিজের বাড়ির ছাদে খুন করতে যাবে কেন? সম্ভবত কিছু একটা আছে। ব্যাপারটা রহস্যময়। দাসের বিবেক তাকে চিন্তায় ফেলল। অবশেষে বিচারকের কাছে গিয়ে সত্য ঘটনা বর্ণনা করে সে বলল, আমি তার ইচ্ছাতেই তাকে হত্যা করেছি। সে প্রতিহিংসায় এতটা অন্ধ হয়ে গিয়েছিল যে,মৃত্যুকে জীবনের উপর প্রাধান্য দিয়েছে। যখন প্রমাণিত হলো ঘটনা এ রকম তখন দাস এবং ঐ বাড়ির মালিক দু জনকেই মুক্তি দেয়া হলো।

সুতরাং এটা বাস্তব যে,মানুষ প্রকৃতই হিংসা রোগে অসুস্থ হয়। কোরআন বলছে,

( قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا)

সে-ই সফলকাম হলো যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করল এবং সে-ই অকৃতকার্য হলো যে তা প্রোথিত করল। কোরআনের প্রথম কর্মসূচী আত্মার পরিশুদ্ধি ও উন্নয়ন এবং হৃদয়কে মানসিক রোগ,সমস্যা,অশান্তি,অন্ধকার ও বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করা।

রূপান্তরিত মানুষ

রূপান্তরের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রূপান্তর অর্থ কি? নিশ্চয় শুনেছেন পূর্বকালে এক উম্মত ছিল যারা প্রচুর গুনাহের কারণে তৎকালীন নবীর দ্বারা অভিশপ্ত হয়ে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ অন্য এক পশুতে পরিণত হয়েছিল। যেমন বানর,শূকর,নেকড়ে বা অন্য কোন প্রাণীতে। এটাকেই রূপান্তর বলা হচ্ছে। এই রূপান্তর প্রকৃতপক্ষে কিরূপ ছিল? মানুষ কি প্রকৃতই পশুতে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। এখন এর ব্যাখ্যা করব। এটি অনস্বীকার্য যে,মানুষ দৈহিকভাবে রূপান্তরিত বা পশুতে পরিণত নাহলেও মানসিক ও আত্মিকভাবে রূপান্তরিত বা পশুতে পরিণত হয়,এমনকি কখনো কখনো এত নিকৃষ্ট প্রাণীতে পরিণত হয় যে,যার নজীর পৃথিবীতে খুজে পাওয়া বিরল। কোরআন বলছে-( بل هم أضلّ )   অর্থাৎ চতুষ্পদ জন্তু হতেও নিকৃষ্ট। এখন প্রশ্ন হলো মানুষ কি প্রকৃতই মানসিক ও আত্মিকতার দিক থেকে পশুতে পরিণত হতে পারে? উত্তর হলো,হ্যাঁ। কারণ মানুষের ব্যক্তিত্ব তার চারিত্রিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে। যদি কোন মানুষের চারিত্রিক ও আত্মিক বৈশিষ্ট্য কোন হিংস্র প্রাণীর বা চতুস্পদ পশুর মত হয় তবে সে প্রকৃতই রূপান্তরিত হয়েছে। অর্থাৎ তার আত্মা প্রকৃতই রূপান্তরিত ও পরিবর্তিত হয়ে এক পশুতে পরিণত হয়েছে। শূকরের দেহ তার আত্মার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু মানুষ দৈহিকভাবে শূকরের মত না হয়েও শূকরের সকল স্বভাব ধারণ করতে পারে। যদি কোন মানুষ এরূপ হয় তবে সে রূপান্তরিত হয়েছে। বাস্তব ও অন্তর্দৃষ্টিতে সে প্রকৃতই একটি শূকর বৈ কিছু নয়। তাই ত্রুটিযুক্ত মানুষ কখনো কখনো রূপান্তরিত মানুষে পরিণত হয়। আমরা এ সব কথা কম শুনি এবং অনেকেই মনে করেন এগুলো metaphoric বা allegory (রূপক) এবং এগুলো বিশ্বাস করতে চান না। কিন্তু এটা খুবই সত্য।

এক ব্যক্তি বর্ণনা করেছে, ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.)-এর সাথে আরাফাতের ময়দানে ছিলাম। উপর থেকে লক্ষ্য করলাম ময়দান হাজীতে পূর্ণ। ইমামকে উদ্দেশ্য করে বললাম : কি পরিমাণ হাজী এ বছর এসেছে আলহামদুলিল্লাহ্। ইমাম বললেন : চিৎকার এত বেশি,কিন্তু হাজী খুবই কম। ঐ ব্যক্তি বলেছে, তারপর জানি না ইমাম এমন দৃষ্টি শক্তি দান করলেন আমাকে এবং বললেন : লক্ষ্য কর। আমি লক্ষ্য করলাম সম্পূর্ণ ময়দান যেন পশুতে পূর্ণ- যেন পশু আলয়ের (চিড়িয়াখানা) মধ্যে সামান্য কিছু মানুষ চলাচল করছে। ইমাম বললেন : এখন দেখ বাতেন (অপ্রকাশ্য) কিরূপ! যারা অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন ও আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী তাদের নিকট এ বিষয়টি প্রদীপের মতই উজ্জ্বল। এখন যদি আধুনিক চিন্তাধারার কেউ তা অস্বীকার করতে চায় তাহলে ভুল করবে। আমাদের এখনকার সময়ও ব্যক্তি-বিশেষ ছিলেন এবং আছেন যারা মানুষের সত্তাকে অনুভব করেন এবং দেখেন।

যে মানুষ চতুষ্পদ জন্তুর মত শুধু খাওয়া,ঘুমানো,যৌন চাহিদা পূরণ ছাড়া (প্রাণীর) অন্য কোন চিন্তা করে না,তার চিন্তা শুধু এটাই যে,খাবে,ঘুমাবে আর দৈহিক আনন্দ অনুভব করবে,প্রকৃতপক্ষে তার আত্মা একটা চতুস্পদ জন্তু ছাড়া আর কিছুই নয়। তার অন্তর একটি রূপান্তরিত মানুষে পরিণত হয়েছে। যার স্বভাব রূপান্তরিত,তার মানবিক বৈশিষ্ট্য রূপান্তরিত- কিভাবে তা ব্যাখ্যা দেব। অর্থাৎ তার মনুষ্যত্ব তার নিকট থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে,ঐ স্থানে সে নিজের জন্য চতুষ্পদ ও হিংস্র পশুর চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে।

সূরা নাবায় আমরা পড়ি সে দিন যখন শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে তখন তোমরা দলে দলে আসবে। এবং আকাশকে উন্মুক্ত করা হবে ফলে তা বহু দ্বারে বিভক্ত হয়ে পড়বে। পর্বতকে বিচলিত করা হবে ফলে তা মরীচিকায় পরিণত হবে। (সূরা নাবা : ১৮-২০) কিয়ামতের দিন মানুষ দলে দলে পুনরুত্থিত ও সমবেত হবে। রাসূলগণ সব সময়ই বলেছেন,শুধু মানুষের একটি দল মানুষের চেহারায় পুনরুত্থিত হবে। কোন কোন দল পিপীলিকার মত,কোন দল সাপের মত,কোন দল নেকড়ের মত চেহারা নিয়ে হাশরের ময়দানে আবির্ভূত হবে। কেন? এটা কি সম্ভব কোন কারণ ছাড়াই মহান আল্লাহ্ মানুষকে এ রকম আকৃতিতে পুনরুত্থিত করবেন? যে ব্যক্তির পৃথিবীতে মানুষকে ক্ষত বিক্ষত করা ছাড়া কোন কাজ ছিল না,যার সকল আনন্দ অন্যদের কষ্ট দেয়ার মধ্যে নিহিত ছিল সে প্রকৃতই একটি বিষাক্ত বিচ্ছু। তাই সে সেভাবেই পুনরুত্থিত হবে। যে ব্যক্তির বাঁদরামী করাই একমাত্র স্বভাব ছিল কিয়ামতে প্রকৃতই সে বাঁদরের চেহারা নিয়ে আবিভূত হবে। এমনিভাবে যার স্বভাব কুকরের মতো সে কুকর হিসেবে পুনরুত্থিত হবে। মানুষ তার নিয়্যতের (কাজের) উপর ভিত্তি করেই পুনরুত্থিত হবে। (মুসনাদে আহমদ,২য় খণ্ড,পৃ. ৩৯২)

কিয়ামতে মানুষ তার নিয়্যত,উদ্দেশ্য,ইচ্ছা,তার স্বভাব ও তার প্রকৃত বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে পুনরুত্থিত হবে। আপনি এ পৃথিবীতে কি চেহারাতে আছেন? কি হতে চান? কি বস্তু চান? আপনার ইচ্ছাগুলো কি মানুষের চাওয়া নাকি কোন হিংস্র পশুর চাওয়া ? নাকি এক তৃণভোজীর মতো চাওয়া? যা আপনি চান আপনি তা-ই এবং সে চেহারাতেই আপনি পুনরুত্থিত হবেন যে রকম আছেন।

এটাই আমাদের আল্লাহ্ ব্যতীত সকল কিছুর উপাসনা থেকে বিরত করে। আমরা যা কিছুর উপাসনা করব তার মতোই হব। যদি টাকার উপাসনা করি,যদি অর্থ আমাদের অস্তিত্ব ও অস্তিুত্বের অংশে পরিণত হয়,এ অর্থ কিয়ামতে সে-ই উত্তপ্ত ধাতব পদার্থে পরিণত হবে। কোরআন এ পৃথিবীতে যাদের অস্তিত্ব এই ধাতব পদার্থের অস্তিুত্বের সাথে মিশে গিয়েছে এবং এই ধাতুর উপাসনা ছাড়া যার কোন কাজ নেই তাদের উদ্দেশ্যে বলেছে, এবং যারা সোনা-রূপা মজুদ করে এবং আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না,তুমি তাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দাও। সে দিন তা জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের কপালে,পার্শ্বদেশে ও তাদের পৃষ্ঠদেশে দাগ দেয়া হবে। এবং বলা হবে এটা সেই বস্তু যা তোমরা নিজেদের জন্য প্রস্তত করতে। (সূরা তাওবা : ৩৪-৩৫)

এ অর্থই সে দিন উত্তপ্ত করা হবে- তার জন্য জাহান্নামের আগুনে পরিণত হবে। এটা অন্যতম উপাদান যা মানুষকে রূপান্তরিত করে।

আমি এ বৈঠকে ত্রুটিযুক্ত ও ত্রুটিহীন মানুষের বিষয়টি সংক্ষেপে বর্ণনা করতে চাচ্ছিলাম। সমস্যাগ্রস্ত (মানসিক) মানুষ একজন ত্রুটিপূর্ণ মানুষ। যে মানুষ পৃথিবীর কোন বস্তুকে উপাসনা করে-তার দৈনন্দিন কাজে বস্তু ব্যবহারকারী নয়,বরং এর উপাসনাকারী- সে মানুষ ত্রুটিযুক্ত এবং একজন রূপান্তরিত মানুষ।

পবিত্র রমযান মাসের মানুষ গঠনের পরিকল্পনা

আসলেই পবিত্র রমযান মাসের কর্মসূচী মানুষ গঠনের পরিকল্পনার । অর্থাৎ কর্মসূচীর উদ্দেশ্য এটাই যে,এ মাসে ত্রুটিযুক্ত মানুষ নিজেকে ত্রুটিহীন মানুষে এবং ত্রুটিহীন মানুষ নিজেকে পূর্ণ মানুষে পরিণত করবে। এ পবিত্র মাসের পরিকল্পনা নাফ্স বা প্রবৃত্তির পরিশুদ্ধি,মানবীয় ত্রুটি ও অপূর্ণতার সংশোধন,প্রবৃত্তির জৈবিক তাড়নার উপর বুদ্ধিবৃত্তি,ঈমান ও ইচ্ছা শক্তির বিজয় ও নিয়ন্ত্রণ।

এর জন্য দোয়ার কর্মসূচী,সত্যের পথে ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর দিকে উড্ডয়ন,আত্মার উন্নয়নের জন্য কর্মসূচী,আত্মাকে বিকাশমান ও গতিশীল করার পরিকল্পনা দেয়া হয়েছে। যদি এমন হয় যে,পবিত্র রমযান মাস এল,মানুষ ত্রিশ দিন ক্ষুধার্ত,তৃষ্ণার্ত ও নিদ্রাহীন থাকল,উদাহরণস্বরূপ রাত্রিগুলোতে অনেক সময় জেগে থাকল,এখানে ওখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করল,তারপর ঈদ আসলো,কিন্তু রমযানের পূর্বের দিন থেকে তার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি,তাহলে ঐ রোযা তার জন্য কোন উপকারই বয়ে আনেনি। ইসলাম তো এটা চায় না যে,মানুষ এমনিই মুখ বন্ধ করে রাখবে। মানুষ মুখ বন্ধ করুক আর না করুক ইসলামের জন্য কোন পার্থক্য নেই,বরং রোযা রাখার উদ্দেশ্য হলো এটা যে,মানুষ সংশোধিত হবে। কেন হাদীসসমূহে এমন এসেছে,প্রচুর রোযাদার আছে যারা রোযা থেকে ক্ষুধা আর তৃষ্ণা ছাড়া আর কিছুই লাভ করে না,তাদের রোযা শুধু ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত থাকা ছাড়া কিছুই নয়। হালাল খাদ্য থেকে মুখ বন্ধ করার অর্থ মানুষ এ ত্রিশ দিন একনাগাড়ে অনুশীলন করবে হারাম কথা থেকে জিহ্বাকে বিরত রাখার,গীবত না করার,মিথ্যা না বলার ও গালি না দেয়ার।

রোযা যে বাতেনী,আধ্যাত্মিক ও আত্মিক তার প্রমাণ- একদিন এক রোযাদার মহিলা রাসূল(সা.)-এর নিকট আসল। রাসূল দুধ অথবা অন্য কিছু খাওয়ার জন্য তাকে অনুরোধ করলেন। তার দিকে তা এগিয়ে দিয়ে বললেন, নাও পান কর। সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমি রোযা আছি। রাসূল বললেন, তুমি রোযা রাখনি এবং এ বলে পুনরায় তাকে খেতে নির্দেশ দিলেন। মহিলা বলল, আসলেই আমি রোযা আছি। (যেহেতু তার বিবেচনায় রোযা আছে বলে মনে করল,যেমন বাহ্যিক রোযা আমার রাখি)। রাসূল বললেন, তুমি কেমন রোযা রেখেছ যে,কিছুক্ষণ পূর্বেই তোমার মুমিনভাই বা বোনের মাংস খেয়েছ (অর্থাৎ গীবত করেছ)। তুমি কি দেখতে চাও যে,মাংস খেয়েছ। ভেতর থেকে এখনই তা উল্টিয়ে ফেল। তখনই সে বমি করল ও এক টুকরা মাংস তার মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ল। মানুষ রোযা রেখে গীবত করে। ফলে যদিও তার মুখকে হালাল খাদ্য থেকে বঞ্চিত করে,কিন্তু তার আত্মার মুখকে হারাম খাদ্য দ্বারা পূর্ণ করে।

কেন আমাদের উদ্দেশ্যে এটা বলা হয়েছে যে,যদি মানুষ একটা মিথ্যা বলে তবে তার মুখের দুর্গন্ধে সপ্ত আসমান পর্যন্ত ফেরেশতারা কষ্ট পান। যেমন বলা হয় যখন মানুষ জাহান্নামে থাকবে তখন জাহান্নাম প্রচণ্ড দুগন্ধ ছড়াবে। এ দুগন্ধ প্রকৃতপক্ষে এ দুনিয়াতেই আমরা সৃষ্টি করেছি মিথ্যা কথা বলা,গালি দেয়া,অপবাদ ও পরনিন্দা চর্চার মাধ্যমে।

পরনিন্দা ও মিথ্যা অপবাদ আরোপ গীবত থেকেও খারাপ,যেহেতু পরনিন্দার মাধ্যমে যেমন মিথ্যাও বলা হয় তেমন গীবতও করা হয়। কিন্তু যে মিথ্যা বলে সে শুধু মিথ্যাই বলে,গীবত করে না। তাই পরনিন্দায় দু টি কবীরা গুনাহ এক সঙ্গে আঞ্জাম দেয়া হয়।

এটা কি উচিত,রমযান মাস শেষ হয়ে যায়,অথচ এ মাসে আমরা একে অপরের বিরুদ্ধে নিন্দা ও অপবাদ আরোপ করতে থাকি? রমযান মাস এজন্য যে,মুসলমানরা বেশি বেশি সমবেত হবে,সম্মিলিতভাবে ইবাদত করবে,মসজিদে একত্র হবে। এজন্য নয় যে,একে অপরকে দূরে সরানোর জন্য এ মাসকে ব্যবহার করবে।

و لا حول و لا قوّة ألا بلله العلی العظیم

মানবিক মূল্যবোধের বিকাশের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনীয়তা

وَإِذِ ابْتَلَى إِبْرَاهِيمَ رَبُّهُ بِكَلِمَاتٍ فَأَتَمَّهُنَّ قَالَ إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامًا قَالَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِي قَالَ لَا يَنَالُ عَهْدِي الظَّالِمِينَ

প্রত্যেক অস্তিত্বশীল বস্তু বা প্রাণীর পূর্ণতার সঙ্গে অন্য অস্তিত্বশীল বস্তু বা প্রাণীর পূর্ণতার পার্থক্য রয়েছে। যেমন পূর্ণ মানুষ এবং পূর্ণ ফেরেশতা এক নয়। যদি কোন ফেরেশতা,ফেরেশতা হওয়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পর্যায়ে বা সম্ভাব্য পূর্ণতার শেষ প্রান্তে পৌছায়,তা মানুষের মানুষ হওয়ার ক্ষেত্রে পূর্ণতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছানো থেকে ভিন্ন।

মানুষের পূর্ণতার সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীর পূর্ণতার পার্থক্যের কারণ

যিনি আমাদের ফেরেশতাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানিয়েছেন তিনি (আল্লাহ্) বলেছেন,ফেরেশতারা এমন এক সৃষ্টি যারা নিখাদ আকল দিয়ে সৃষ্ট হয়েছেন,তাদের সৃষ্টির মূল কেবল চিন্তা ও বিবেচনা ছাড়া কিছুই নয় অর্থাৎ পার্থিব,জৈবিক চাহিদা,উত্তেজনা,উগ্রতা এগুলোর অস্তিত্ব নেই। অন্যদিকে অন্যান্য জীব শুধু শারীরিক এবং কোরআন যাকে রূহ বলছে তা থেকে বঞ্চিত। শুধু মানুষই একমাত্র সৃষ্টি যে ফেরেশতাদের যা আছে তা লাভ করেছে আবার অন্যান্য সৃষ্টির যা আছে তারও সে অধিকারী। সে যেমন স্বর্গীয় তেমন পার্থিব। সে যেমন সর্বোচ্চ সৃষ্টি তেমনি সর্ব নিকৃষ্টও হতে পারে। এরই ব্যাখ্যায় উছুলে কাফীতে একটি হাদীস এসেছে এবং আহলে সুন্নাতও এর কাছাকাছি হাদীস বর্ণনা করেছে। মাওলানা রুমী তার মাসনভীতে এ হাদীস এভাবে কবিতার মাধ্যমে এনেছেন-

হাদীসে এসেছে গৌরবময় স্রষ্টা মহাজন,

সৃষ্টি জগতে করিলেন তিন রকম সৃজন।

তারপর বলছেন,এক দলকে নিখাত নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন অন্য দলকে (উদ্দেশ্য জীবজন্তু) শুধুই উত্তেজনা এবং জৈবিক চাহিদা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন,কিন্তু মানুষকে এ দু য়ের মিশ্রণে সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং পরিপূর্ণ মানুষ যেমন একটি পরিপূর্ণ পশুর থেকে ভিন্ন (উদাহরণস্বরূপ সর্বোৎকৃষ্ট ও পূর্ণতাপ্রাপ্ত একটি ঘোড়া থেকে আলাদা) তেমনি একজন পূর্ণ ফেরেশতা থেকেও ভিন্ন।

ফেরেশতা ও অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে মানুষের পাথর্ক্যের কারণ তার সত্তার উপাদান যেমন কোরআন বলছে, আমরা মানুষকে এমন বীর্য থেকে সৃষ্টি করেছি যাতে অনেক কিছুর মিশ্রণ রয়েছে। আধুনিকতার ভাষায় বললে তার জীনগুলোতে বিভিন্ন ধরনের মেধা,যোগ্যতা ও ক্ষমতার সমন্বয় হয়েছে। মানুষ এমন মর্যাদায় পৌছেছে যে,আমরা তাকে পরীক্ষার জন্য নির্বাচন করেছি। এটি অত্যন্ত.গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ মানুষ এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে,আমরা তাকে স্বাধীন করে সৃষ্টি করেছি এবং তাকে দায়িত্ব পালনের জন্য উপযুক্ত পরীক্ষা ও নম্বর প্রদানের জন্য যোগ্য মনে করেছি। ( إِنَّا خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ مِنْ نُطْفَةٍ أَمْشَاجٍ ) নিশ্চয়ই মানুষকে এমন বীর্য যা বহু গুণাবলী ও শক্তির মিশ্রণ তা থেকে সৃষ্টি করেছি। এজন্যই তাকে পরীক্ষা,পুরস্কার,শক্তি ও নম্বর প্রদান করেছি। কিন্তু অন্য কেউ যোগ্যতা রাখে না।

 ) فَجَعَلْنَاهُ سَمِيعًا بَصِيرًا إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيلَ إِمَّا شَاكِرًا وَإِمَّا كَفُورًا(

অতঃপর আমরা তাকে সম্যক শ্রবণকারী এবং দর্শনকারী করেছি। নিশ্চয় আমরা তাকে সঠিক পথ দেখিয়েছি,হয়তো সে কৃতজ্ঞ হবে,নয়তো সে অকৃতজ্ঞ হবে। (সূরা দাহর : ২-৩)

এর থেকে ভালো ও সুন্দরভাবে মানুষের স্বাধীনতা ও এখতিয়ার এবং এর মূল ভিত্তিকে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তাকে পরীক্ষার মধ্যে ফেলেছি,উত্তীর্ণের পথও তাকে বলে দিয়েছি। এখন সে নিজেই বেছে নিবে কোন্ দিকে সে যাবে।

সুতরাং কোরআনের এ বর্ণনা থেকে পরিষ্কার হয় যে,পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার কারণ এ বহুবিধ গুণাবলী ও শক্তি। তাই ফেরেশতার সঙ্গে তার পার্থক্য।


5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18