জীবন জিজ্ঞাসা

জীবন জিজ্ঞাসা5%

জীবন জিজ্ঞাসা লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

জীবন জিজ্ঞাসা
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 58 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 42194 / ডাউনলোড: 4658
সাইজ সাইজ সাইজ
জীবন জিজ্ঞাসা

জীবন জিজ্ঞাসা

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

ত্রিত্ববাদী ধারণা

অপরিহার্য সত্তা সম্পর্কে অংশীবাদীদের আরেকটি ধারণা হচ্ছে পিতা , পুত্র ও আত্মা সংক্রান্ত ধারণা। বিচারবুদ্ধির বিচারে এ ধারণাটি সর্বাধিক দুর্বল। কারণ , কখনো বলা হয় যে , পবিত্র পিতা , পবিত্র পুত্র ও পবিত্র আত্মা স্বতন্ত্র , আবার কখনো বলা হয় অভিন্ন। কখনো তিনকে সমপর্যায়ভুক্ত গণ্য করা হয় , কখনোবা অপর দু জনকে পবিত্র পিতার সৃষ্টিরূপে গণ্য করা হয়।

বস্তুতঃ এ মতটি একটি গোলকধাঁধা সৃষ্টিকারী কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধ বিশ্বাসের ওপর ভিত্তিশীল , কোনোরূপ প্রকৃত দার্শনিকতার ওপর ভিত্তিশীল নয়। কারণ , অপরিহার্য সত্তাকে অনিবার্যভাবেই সত্তা ও গুণের দিক থেকে অভিন্ন ও অবিভাজ্য হতে হবে। অন্যথায় সে হবে অসম্পূর্ণ ও নির্ভরশীল সত্তা। এমনকি তাকে বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করে চিন্তা করলে সে ক্ষেত্রে সে তার অংশসমূহের ওপর এবং তার অংশসমূহ পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল হবে। এরূপ নির্ভরশীল সত্তা অপরিহার্য সত্তা হতে পারে না। অতএব , তিনে এক এবং এক তিন হতে পারে না। আর পবিত্র পুত্র ও পবিত্র আত্মা যদি পবিত্র পিতার সৃষ্টি হয়ে থাকে তো সে ক্ষেত্রে এতদুভয় হবে সম্ভব সত্তা। আর সম্ভব সত্তা অপরিহার্য সত্তা নয়।

অপরিহার্য সত্তা সকল প্রকার অপূর্ণতা ও অভাব-অভিযোগ থেকে মুক্ত। অতএব , তিনি সন্তান , স্ত্রী ও পরিবারের প্রয়োজনীয়তা থেকে মুক্ত। বিশেষ করে কোনো সম্ভব সত্তাকে তাঁর পক্ষে পুত্র হিসেবে পরিগ্রহণ করা সম্ভব নয়।

মানুষের মধ্যে যে সন্তান লাভের সহজাত আকাঙ্ক্ষা বিদ্যমান তার জন্য দায়ী তার বিভিন্ন ধরনের অপূর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা। সন্তানের মাধ্যমে তার এ অপূর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা আংশিক হলেও পূরণ হয় এবং এ কারণেই সে সন্তানের প্রয়োজন অনুভব করে। যেহেতু পরম প্রমুক্ত ও সকল পূর্ণতার পূর্ণ মাত্রায় অধিকারী অপরিহার্য সত্তার কোনোরূপ অপূর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা নেই সেহেতু তিনি সন্তান জন্মদানের বা পরিগ্রহণের প্রবণতা থেকে মুক্ত হতে বাধ্য।

অন্যদিকে যে কোনো প্রজাতির সন্তান সমপ্রজাতির হয়ে থাকে। সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যকার ব্যবধান দুই প্রজাতির মধ্যকার ব্যবধানের তুলনায় কোটি কোটি গুণ বেশী। কোনো মানুষ যদি একটি প্রস্তরকণা বা একটি মৃত পোকাকে হাতে তুলে নেয় এবং বলে যে , আমি এটাকে পুত্ররূপে পরিগ্রহণ করলাম , তাহলে তা যতোখানি পাগলামি হবে , অপরিহার্য সত্তা সর্বস্রষ্টা কর্তৃক কোনো সৃষ্টিকে - তা সে সৃষ্টি যতো উন্নত মানের ও যতখানি পূর্ণতার অধিকারীই হোক না কেন - পুত্ররূপে পরিগ্রহণের ধারণা পোষণ মানে তাঁর ওপর এর চেয়ে কোটি কোটি গুণে বেশী মাত্রার পাগলামি আরোপ বৈ নয়।

আর পুত্রকে যদি সৃষ্টিসত্তা গণ্য না করে অপরিহার্য সত্তারূপে গণ্য করা হয় সে ক্ষেত্রে তা এক অপ্রকৃত ও অসম্ভব দাবী বৈ নয়। কারণ , অপরিহার্য সত্তা সকল প্রকার পূর্ণতাবাচক গুণের পূর্ণতম মাত্রার অধিকারী হতে বাধ্য। অতএব , এরূপ সত্তা একাধিক হতে পারে না। এমনকি তর্কের খাতিরে যদি একাধিক হওয়াকে সম্ভবও গণ্য করা হয় , তো সে ক্ষেত্রে সমমর্যাদাসম্পন্ন দুই অপরিহার্য সত্তার একজনকে পিতা ও অপর জনকে পুত্র গণ্য করা যেতে পারে না। কারণ , একজনকে পিতা ও অপর জনকে পুত্র গণ্য করার পর আর তাদের সমমর্যাদা থাকে না। এমতাবস্থায় যার মর্যাদা হ্রাস পায় (পুত্র) তাকে অপরিহার্য সত্তারূপে গণ্য করা চলে না।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে , কোনো সৃষ্টির ব্যতিক্রমধর্মী সৃষ্টি ও গুণবৈশিষ্ট্যের কারণেও তাকে অপরিহার্য সত্তার সন্তান রূপে গণ্য করা যেতে পারে না। বস্তুতঃ মানুষের কাছে যা বিস্ময়কর ও ব্যতিক্রমধর্মী , সর্বশক্তিমান অপরিহার্য সত্তার কাছে তা একটি অতি সাধারণ ব্যাপার মাত্র। অবশ্য তিনি কোনো নিয়মকে সৃষ্টিলোকে কতটা কার্যকর রাখবেন তা তাঁর ইচ্ছার ব্যাপার। যদি বিস্ময়কর কিছু থেকে থাকে তো সে বিস্ময় শুধু পিতা বা মাতা বিহনে কোনো মানুষকে সৃষ্টি করা নয় , বরং পিতা-মাতা উভয় বিহনে প্রথম মানুষের সৃষ্টি। বরং এর চেয়েও বিস্ময়কর হচ্ছে শূন্য থেকে এ সৃষ্টিকর্মের সূচনাকরণ বা সৃষ্টিলোকের আদি উপকরণাদির সৃষ্টিকরণ।

বর্তমানে বস্তুবিজ্ঞানীরা যে স্টিফেন হকিং - এর মত গ্রহণ করে নিয়ে বলছেন যে , একটি আদি কণিকা ( primary particle)থেকে গোটা বিশ্বজগত সৃষ্টি হয়েছে , যদি সে ধারণাই সঠিক হয়ে থাকে তো বিবর্তনপ্রক্রিয়ায় সমগ্র বস্তুজগত এবং বিবর্তন ও বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার সমন্বয়ে প্রাণীজগতের সৃষ্টির চেয়েও কোটি কোটি গুণে বিস্ময়কর হচ্ছে শূন্য থেকে সেই আদি কণিকার সৃষ্টি। অতএব , কোনো মানুষের জন্ম বিস্ময়কর হলেই তাকে ঈশ্বরের পুত্র মনে করার যৌক্তিকতা নেই।

এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ করতে হয় যে , সাম্প্রতিককালে আবিষ্কৃত ক্লোনিং পদ্ধতি পিতা ছাড়া শুধু মাতা থেকে সন্তান জন্মদানের সম্ভাবনা প্রমাণিত করেছে। এমতাবস্থায় পিতা ছাড়া শুধু মাতা থেকে জন্মগ্রহণের সাথে ঐশ্বরিকতার অধিকারী হওয়ার কোনোই সম্পর্ক নেই।

কোরআন মজীদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মুসলমানদের কাছে হযরত ঈসা (আঃ)-এর পিতাবিহীন জন্ম ও তাঁর মাতার চারিত্রিক পবিত্রতা একটি বিতর্কাতীত বিষয়। কোরআন মজীদের বর্ণনা অনুযায়ী আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন ফেরেশতা এসে হযরত মারইয়াম (আঃ)কে তাঁর গর্ভে একজন নেককার সন্তান জন্মগ্রহণের ঐশী সিদ্ধান্তের সুসংবাদ প্রদান করেন।

সর্বশক্তিমান স্রষ্টা ক্লোনিং বা ফেরেশতার মুখাপেক্ষী নন। তিনি যা চান তা-ই করতে পারেন এবং যেভাবে চান সেভাবেই করতে পারেন। তাই মুসলমানদের কাছে এই প্রক্রিয়াগত বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হওয়া বা না হওয়ায় কিছু আসে যায় না। সর্বাবস্থায়ই তাদের কাছে হযরত ঈসা (আঃ)-এর পিতা ব্যতীতই নিষ্পাপ মাতার গর্ভে জন্মগ্রহণের বিষয়টি অকাট্য সত্য। কিন্তু এ ধরনের ব্যতিক্রমী জন্মের কারণে তাঁকে খোদার পুত্র গণ্য করার যৌক্তিকতা নেই। কারণ , একই সূত্র (কোরআন মজীদ) তাঁকে মানুষ , আল্লাহর বান্দাহ্ (দাস) ও আল্লাহর নবী বলে জানিয়েছে।

অবশ্য কোরআন মজীদের ভাষ্য অনুযায়ী তৎকালীন বনি ইসরাঈলের নিকটও প্রকৃত সত্য অজানা ছিলো না। কারণ , হযরত ঈসা (আঃ) জন্মের পর মাতৃক্রোড়ে থেকেই কথা বলেন এবং নিজেকে আল্লাহর নবী বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু এ ব্যাপারে কোরআন মজীদ ছাড়া আর কোনো প্রমাণ্য দলীল নেই। ইয়াহূদীরা জেনেশুনে স্বেচ্ছায় সত্য গোপন করেছে এবং হযরত ঈসা (আঃ)-এর জন্ম সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে। এ অপবাদ খণ্ডনের ক্ষেত্রে ইনজীলের বর্তমান সংস্করণসমূহ থেকে কোনোভাবে উপকৃত হওয়া সম্ভব নয়। কারণ , বর্তমানে ইনজীল নামে যা চালু আছে তা হচ্ছে প্রকৃত ইনজীলের (আংশিক) বাণী , হযরত ঈসা (আঃ)-এর কথা ও জীবনকাহিনী এবং সংশ্লিষ্ট লেখকদের বক্তব্যের সংমিশ্রণ। কেউ যদি রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর জীবনীগ্রন্থ রচনা করেন এবং তাতে তাঁর কিছু কথা (হাদীছে ক্বাওলী) ও কোরআন মজীদের কতক আয়াত উদ্ধৃত করেন , যেমন: যদি বলেন যে , এ ঘটনা প্রসঙ্গে আয়াত নাযিল হলো যে , ... , তাহলে কেবল ঐ গ্রন্থের সাথেই বর্তমানে প্রচলিত ইনজীলের বাকবিন্যাসের বা রচনারীতির তুলনা করা চলে। তদুপরি ইনজীলের রয়েছে ডজন ডজন সংস্করণ যা প্রমাণ করে যে , এ গ্রন্থ তার মূল রূপে বিদ্যমান নেই , বরং বিকৃত হয়ে গেছে।

এতদসত্ত্বেও প্রচলিত ইনজীলকে তর্কের খাতিরে প্রামাণ্য বলে ধরে নিলেও তা ইয়াহূদীদের দেয়া অপবাদ খণ্ডনের ক্ষেত্রে তা কাজে আসবে না। কারণ , প্রথমে প্রমাণ করতে হবে যে , হযরত ঈসা (আঃ) নবী ছিলেন। কেবল এর পরই তাঁর ওপর নাযিলকৃত আসমানী কিতাব ইনজীল (যদি প্রমাণ করা যায় যে , তা অবিকৃতভাবে বর্তমান আছে) দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে। যে ব্যক্তিকে হযরত ঈসা (আঃ)-এর নবুওয়াত (খৃস্টানদের দাবী অনুযায়ী খোদার পুত্র হওয়ার বিষয়টি) মেনে নেয়ার জন্য দাও আত দেয়া হবে তার কাছে পূর্ব থেকেই ইনজীলের কোনো মূল্য থাকতে পারে না। তার কাছে ইনজীলের মূল্য হবে হযরত ঈসা (আঃ)কে নবী হিসেবে গণ্য করার পর।

অতএব , হযরত ঈসা (আঃ)-এর প্রতি কাউকে দাও আত দিতে হলে তা দিতে হবে বিচারবুদ্ধির ভিত্তিতে। এ ক্ষেত্রে তাঁর প্রতি দাও আত দেয়ার জন্য কোরআন মজীদই হচ্ছে একমাত্র দলীল। কিন্তু যারা কোরআন মজীদকে ঐশী কিতাব হিসেবে জানে না তাদের পক্ষে হযরত ঈসা (আঃ) সম্পর্কে কোরআন মজীদের দলীল থেকে সাহায্য গ্রহণ করা সম্ভব নয়। সুতরাং যারা কোরআন মজীদের ঐশিতা সম্বন্ধে নিশ্চিত নয় তাদের কাছে হযরত ঈসা (আঃ)-এর খোদার পুত্র অথবা নবী বলে পরিগণিত হওয়া তো দূরের কথা , তাঁর জন্মের বিষয়টিই সংশয়াচ্ছন্নরূপে গণ্য হতে বাধ্য। এমতাবস্থায় এহেন ব্যক্তিকে খোদার পুত্র বলে দাবী করা কেবল বিচারবুদ্ধি বর্জনকারী কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধ দাবীদারদের পক্ষেই সম্ভব।

দেবদেবীদের ঈশ্বরের কর্মগত অংশীদার হওয়ার ধারণা

অংশীবাদী ধ্যানধারণাসমূহের মধ্যে সব শেষে যেটির ওপর আলোকপাত করতে হয় তা হচ্ছে , দেব-দেবীরা সত্তাগতভাবে ঈশ্বরের অংশীদার নয় , বরং কর্মগত দিক থেকে তাঁর অংশীদার ; তারা ঈশ্বরের বিশেষ ধরনের উন্নততম সৃষ্টি এবং স্বয়ং ঈশ্বরের পক্ষ থেকে তাদের ওপর সৃষ্টিকর্ম ও সৃষ্টিলোকের পরিচালনার বিভিন্ন দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বলতে হয় যে , অপরিহার্য সত্তা যদি একটি বিশেষ ধরনের বা প্রজাতির সৃষ্টিকে সৃষ্টি করেন এবং তাদের মাধ্যমে অন্যান্য সৃষ্টিকে সৃষ্টি করতে ও সৃষ্টিজগতের পরিচালনা ব্যবস্থা চালাতে চান , তাতে আপত্তির কিছু নেই ; এটা তিনি করতেই পারেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রে কথিত সৃষ্টি সর্বশক্তিমান অপরিহার্য সত্তার ইচ্ছার বাইরে চলার স্বাধীনতা পাবে - এটা সম্ভব নয়। এরূপ সৃষ্টি সৃষ্টিকর্তার পূর্ণ অনুগত ও সুশৃঙ্খল হতে বাধ্য। এমতাবস্থায় তারা স্বাধীন এক্তিয়ার সম্পন্ন মানুষের চেয়ে উন্নততর হতে পারে না। অতএব , মানুষ তাদের কাছে নত হতে বা তাদের উপাসনা করতে পারে না।

আমরা যদি মেনে নেই যে , সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে সৃষ্টিলোকের কাজকর্ম পরিচালনার জন্য এ ধরনের কোনো বিশেষ সৃষ্টির ওপরে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে তাহলেও , এমনকি অপরিহার্য সত্তার সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও মানুষের জন্য তাদের কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণ করা অপরিহার্য নয়। কারণ , অপরিহার্য সত্তা অনিবার্যভাবেই সকল স্থান ও কালকে আয়ত্ত করে আছেন। অতএব , তিনি সর্বত্র ও সর্বদা বিরাজমান এবং প্রতিটি সৃষ্টিরই নিকটতম অবস্থানে অবস্থান করছেন। কোনো সময় ও কোনো স্থানই তাঁর অস্তিত্ব থেকে শূন্য নয়। অন্য কথায় বলা যেতে পারে যে , গোটা সৃষ্টিলোক তাঁর ইচ্ছাশক্তিতেই অবস্থান করছে , কারণ , ইতিপূর্বেই আমরা প্রমাণ করেছি যে , সৃষ্টিকুল কেবল তাদের অস্তিত্বলাভের জন্যই অপরিহার্য সত্তার ওপর নির্ভরশীল নয় , বরং তাদের স্থিতি বা টিকে থাকার জন্যও প্রতি মুহূর্তেই তাঁর ওপর নির্ভরশীল। অতএব , তাঁর ও সৃষ্টির মধ্যে কোনোরূপ স্থানিক ও কালিক দূরত্ব নেই। সৃতরাং মানুষের আবেদন-নিবেদন তাঁর কাছে পেশ করা অন্য যে কারো কাছে পেশ করার চেয়ে সহজতর। এমতাবস্থায় , সৃষ্টিকর্তার সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার জন্য অন্য কোনো সৃষ্টির নিকট (এবং সম্ভবতঃ তার নিজের চেয়ে নিমড়বতর সৃষ্টির নিকট) মাথা নত করা নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক বৈ নয়।

কোনো মহাবিজ্ঞানী ও মহাশক্তিধর সম্রাটের কোনো প্রজা যদি তাঁর দরবারে গিয়ে তাঁর সামনে হাযির থেকে তাঁকে কুর্নিশ করা ও তাঁর কাছে আবেদন পেশের পরিবর্তে তাঁর দিকে পিঠ দিয়ে , সেখানে ঘুরে বেড়ানো কোনো কম্পিউটার-চালিত রোবটকে কুর্নিশ করে তার প্রশংসাগীতি গাইতে শুরু করে , সে ক্ষেত্রে তাকে ঐ রোবট তো কোনো উপকার করতে পারবেই না , বরং এতে সম্রাটের ক্রোধের উদ্রেক হওয়া এবং লোকটিকে দরবার থেকে বের করে দেয়ার জন্য রোবটদের প্রতি নির্দেশদানের সম্ভাবনা প্রায় সুনিশ্চিত। একজন বিজ্ঞানী-সম্রাটের সাথে আচরণের ব্যাপারটা যদি এ ধরনের হয় , তো সে ক্ষেত্রে সর্বশক্তিমান অপরিহার্য সত্তার সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ ধরনের নির্বুদ্ধিতার পরিণাম অধিকতর মারাত্মক হতে বাধ্য। অতএব , দেখা যাচ্ছে , বিচারবুদ্ধি অপরিহার্য সত্তার সাথে কোনো ধরনের অংশীবাদিতাকেই সম্ভব ও সঠিক বলে গণ্য করে না। কেবল অজ্ঞতা , অন্ধত্ব ও অসচেতনতাই অপরিহার্য সত্তার নিরঙ্কুশ একত্ব প্রত্যাখ্যান ও অংশীবাদকে গ্রহণ করতে পারে।

বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে সৃষ্টি ও ব্যবস্থাপনার প্রক্রিয়া

মানবমনে চিরন্তন প্রশ্ন: সকল অস্তিত্বের উৎস মহান সৃষ্টিকর্তা পরম জ্ঞানময় অপরিহার্য সত্তা কেন সৃষ্টিকর্মের সূচনা করলেন এবং তা কীভাবে করলেন ? কীভাবে তিনি এতো সব অকল্পনীয় সূক্ষ্মতম সৃষ্টি থেকে শুরু করে অকল্পনীয় বিশাল সৃষ্টিনিচয়কে অস্তিত্ব দান করলেন এবং কীভাবে এর ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা করছেন ? বিষয়টি কি এরূপ যে , তিনি সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার সূচনা করে দিয়েছেন , অতঃপর সব কিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলছে এবং তাঁর আর কিছুই করার নেই ? নাকি এরূপ কোনো স্বয়ংক্রিয়তার স্থান নেই , বরং প্রতি মুহূর্তে প্রতিটি সৃষ্টিই তাঁর প্রত্যক্ষ ভূমিকার দ্বারা অস্তিত্ব লাভ করছে ও সামনে এগিয়ে চলছে ? বিচারবুদ্ধি এ ক্ষেত্রে আমাদেরকে কী বলে ?

সৃষ্টিকর্ম স্রষ্টাগুণের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ

প্রথমেই প্রশ্ন জাগে , তিনি কেন সৃষ্টিকর্মের সূচনা করলেন ? পরম প্রমুক্ত অপরিহার্য সত্তা তো সকল অপূর্ণতা ও সকল প্রয়োজন থেকে মুক্ত , তাহলে তিনি সৃষ্টির সূচনা করলেন কেন ?

বিচারবুদ্ধি এ ক্ষেত্রে সহজেই যে উপসংহারে উপনীত হয় তা হচ্ছে , অনস্তিত্ব যেমন নেতিবাচক , তেমনি অস্তিত্ব হচ্ছে ইতিবাচক। পরম প্রমুক্ত অপরিহার্য সত্তা সতত বিদ্যমান ও চিরন্তন অস্তিত্বের অধিকারী। অতএব , তিনি ইতিবাচকতা ও নেতিবাচকতার মধ্যবর্তী নিরপেক্ষতা -রূপ কোনো কাল্পনিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী নন। বরং তিনি ইতিবাচক , আর সৃষ্টিকর্ম সম্পাদনও একটি ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য। আর যেহেতু তিনি সকল প্রকার ইতিবাচক গুণবৈশিষ্ট্যের পূর্ণতম মাত্রার অধিকারী , সেহেতু তিনি সৃষ্টিক্ষমতারও অধিকারী। অতএব , তাঁর এ সৃষ্টিক্ষমতার ইতিবাচক বহিঃপ্রকাশ ঘটবে - এটাই তো স্বাভাবিক। তাই সৃষ্টিকর্ম তাঁর জন্য কোনো প্রয়োজন নয় , বরং তাঁর সৃষ্টিক্ষমতার স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ।

স্বতঃস্ফূর্ততা মানে স্বয়ংক্রিয়তা নয়

অপরিহার্য সত্তার সৃষ্টিকর্ম তাঁর স্রষ্টাক্ষমতার স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ , কিন্তু এই স্বতঃস্ফূর্ততা মানে স্বয়ংক্রিয়তা হতে পারে না। কারণ , সৃষ্টিলোকের অস্তিত্বলাভ ও তা অব্যাহত থাকা এবং তার এগিয়ে চলাকে স্বয়ংক্রিয় গণ্য করার মানে হচ্ছে বিষয়টি সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার তথা নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা। এরূপ ধারণা মানে কার্যতঃ তাঁর প্রতি যান্ত্রিকতা তথা প্রকারান্তরে এক ধরনের অক্ষমতা আরোপ বৈ নয়। কিন্তু তিনি যে কোনো ধরনের অক্ষমতা থেকে প্রমুক্ত। তাই বিচারবুদ্ধির রায় হচ্ছে এই যে , সৃষ্টিলোক সর্বাবস্থায়ই তাঁর ইচ্ছাশক্তির আওতাধীন।

তিনি প্রাকৃতিক বিধানের স্রষ্টা

অনেকের ধারণা হচ্ছে এই যে , পরম প্রমুক্ত সৃষ্টিকর্তা ছোট-বড় প্রতিটি সম্ভব-অস্তিত্বের সৃষ্টি , স্থিতি ও সামনে এগিয়ে চলা সম্পর্কে প্রতি মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এরূপ ধারণা তাঁর মহাবিজ্ঞানময়তার বৈশিষ্ট্যের সাথে মোটেই সামঞ্জস্যশীল নয়। কারণ , বিচারবুদ্ধি লক্ষ্য করে যে , অধিকতর মর্যাদাবান কর্তা সব কাজ নিজে করতে সক্ষম হলেও সব কিছু নিজেই করেন না। উদাহরণস্বরূপ , এক ব্যক্তি তার শারীরিক শক্তি দ্বারা কোনো কাজ সম্পাদন করে এবং অপর এক ব্যক্তি একটি যন্ত্র তৈরী করে ও তা চালানোর জন্য চালক নিয়োগ করে একই কাজ সেই যন্ত্রের সাহায্যে সম্পাদন করে। এ ক্ষেত্রে আমরা দ্বিতীয়োক্ত ব্যক্তিকে অধিকতর মর্যাদাবান কর্তা হিসেবে গণ্য করে থাকি।

সুতরাং মহাজ্ঞানময় অপরিহার্য সত্তার জন্য সামঞ্জস্যশীল হচ্ছে এটাই যে , তিনি সৃষ্টিকরণ এবং সৃষ্টির স্থিতি ও এগিয়ে চলার জন্য নিয়মাবলী বেঁধে দেবেন , আর সব কিছু তদনুযায়ী চলতে থাকবে। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতায় এ ধরনের নিয়মাবলী প্রত্যক্ষ করি যেগুলোকে আমরা প্রাকৃতিক বিধান বলে থাকি।

তিনি স্বাধীন সৃষ্টির কাজে হস্তক্ষেপ করেন

আমরা লক্ষ্য করছি যে মহাজ্ঞানময় সৃষ্টিকর্তা তাঁর সৃষ্টিকুলের জন্য অনতিক্রম্য প্রাকৃতিক নিয়মাবলীর আওতায় তাঁর কতক সৃষ্টিকে কতক ব্যাপারে স্বাধীনতা দিয়েছেন। অর্থাৎ সৃষ্টি ও তার এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে তিনি নিজে যেমন স্বয়ংক্রিয়তার উর্ধে তেমনি তিনি তাঁর সকল সৃষ্টিকে সকল ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক বিধানের শৃঙ্খলে বেঁধে স্বয়ংক্রিয়তার অধীন করে দেন নি। সেহেতু যে সব সৃষ্টিকে তিনি কতক ব্যাপারে স্বাধীনতা দিয়েছেন তারা কীভাবে এ স্বাধীনতাকে কাজে লাগায় সে ব্যাপারে তিনি দৃষ্টি রাখবেন এবং যেখানেই সৃষ্টির ব্যক্তিক বা সামষ্টিক স্বার্থে বা গোটা সৃষ্টিলোকের সৃষ্টি-উদ্দেশ্যের বাস্তবায়নের স্বার্থে হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হবে সেখানে তিনি হস্তক্ষেপ করবেন - এটাই স্বাভাবিক।

আর এটা সুস্পষ্ট যে , সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টি রাখা ও প্রয়োজনবোধে হস্তক্ষেপ তাঁর নিজের প্রয়োজনে নয় , বরং সৃষ্টিরই প্রয়োজনে। যেহেতু তিনি সৃষ্টিকে অস্তিত্বদান করেছেন সেহেতু সৃষ্টির প্রয়োজনে ইতিবাচক হস্তক্ষেপ করবেন - এটাই তাঁর সৃষ্টিক্ষমতার দাবী এবং এ দাবী পূরণে কার্পণ্য করার মতো দুর্বলতা থেকে তিনি প্রমুক্ত।

অনবরত নব নব সৃষ্টি

যেহেতু অপরিহার্য সত্তার সৃষ্টিক্ষমতা অসীম , সেহেতু কতক সৃষ্টিকে (তার সংখ্যা যত ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়নই হোক না কেন) অস্তিত্বদান বা অস্তিত্বে আনয়নের প্রক্রিয়ার সূচনা করে দেয়ার পর তিনি আরো নতুন নতুন ধরনের সৃষ্টিকে অস্তিত্বদানের প্রক্রিয়ার সূচনা করা থেকে বিরত থাকতে পারেন না। কারণ , সে ক্ষেত্রে তা হবে তাঁর স্রষ্টাক্ষমতা কার্যতঃ স্থগিত হয়ে যাওয়ার সমতুল্য। বরং তিনি সদাসর্বদাই নতুন নতুন ধরনের সৃষ্টিকে অস্তিত্বদান ও নতুন নতুন ধরনের সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার সূচনা করবেন এটাই তাঁর অসীম সৃষ্টিক্ষমতার স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশের দাবী। তবে বলা বাহুল্য যে , এটা তাঁর জন্য অনিবার্য বা অপরিহার্য হতে পারে না। বরং এটা সম্পূর্ণরূপেই তাঁর ইচ্ছাশক্তির অধীন , আর তাঁর ইচ্ছাশক্তি তাঁর ইতিবাচক গুণাবলীরই অন্যতম।

তাহলে বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে আমরা অপরিহার্য সত্তা কর্তৃক সৃষ্টি ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কয়েকটি সত্যে উপনীত হতে পারি। এ সত্যগুলো হচ্ছে:

তিনি অসীম সৃষ্টিক্ষমতার অধিকারী এবং অনবরত সৃষ্টি করে চলেছেন।

সৃষ্টিকর্ম তাঁর সৃষ্টিক্ষমতার স্বতঃস্ফূর্ত ইতিবাচক বহিঃপ্রকাশ , কিন্তু এ স্বতঃস্ফূর্ততা মানে স্বয়ংক্রিয়তা নয় এবং তিনি এরূপ সৃষ্টি ও ব্যবস্থাপনা সম্পাদনে বাধ্য নন।

তিনি সৃষ্টিসমূহের সূচনা করেছেন এবং তার স্থিতি ও অগ্রগতির জন্য নিয়মাবলী (প্রাকৃতিক বিধিবিধান) বেঁধে দিয়েছেন। সব কিছু এ নিয়মের আওতায় চলছে।

তাঁরই নির্ধারিত প্রাকৃতিক বিধিবিধানের আওতায় তিনি কতক সৃষ্টিকে কিছুটা স্বাধীনতা দিয়েছেন এবং তাদের কর্মের প্রতি সর্বদা দৃষ্টি রাখেন ও তাদেরই প্রয়োজনে অনেক সময় তাদের কাজে হস্তক্ষেপ করেন।

সৃষ্টির কাজে স্রষ্টার হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা

এখানে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অধিকারী সৃষ্টির কাজে তাদেরই প্রয়োজনে সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে হস্তক্ষেপকরণ সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা প্রয়োজন বলে মনে হয়। কারণ , প্রশ্ন উঠতে পারে যে , পরম জ্ঞানময় সৃষ্টিকর্তা তো সৃষ্টিকর্ম সম্পাদনের সিদ্ধান্ত গ্রহণকালেই তাঁর প্রতিটি সৃষ্টির অনাগত ভবিষ্যৎ প্রয়োজন সম্পর্কে জানেন এবং সে প্রয়োজন পূরণের উপযোগী করে প্রাকৃতিক বিধিবিধান প্রণয়ন করেই সৃষ্টির সূচনা করেন। এমতাবস্থায় কী করে নতুন প্রয়োজন দেখা দিতে পারে - যা পূরণের লক্ষ্যে তাঁকে সৃষ্টির কাজে হস্তক্ষেপ করতে হবে ?

বিচারবুদ্ধির সামান্য প্রয়োগ করলেই আমরা এ প্রশ্নের জবাব পেতে পারি। আমরা বিচারবুদ্ধির দ্বারা বুঝতে পারি যে , এ সৃষ্টিলোকের সৃষ্টিনিচয় গুণগতভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত। আমাদের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার আওতাধীন সৃষ্টিনিচয়ের মধ্যে কোনো কোনো সৃষ্টি প্রাকৃতিক নিয়মের কঠিন নিগড়ে বাঁধা বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয় - যা যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এগিয়ে চলেছে এবং যার কোনোরূপ স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মশক্তি নেই। কিন্তু অপর কতক সৃষ্টি স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অধিকারী। এ সব সৃষ্টির মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতার মাত্রা ও পর্যায়ের ক্ষেত্রে পারস্পরিক পার্থক্য রয়েছে।

স্রষ্টার পক্ষ থেকে তাদেরকে ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতা প্রদানের মানেই হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা তাদের ভবিষ্যতকে , সরাসরিই হোক বা প্রাকৃতিক বিধিবিধানের দ্বারাই হোক , শতকরা একশ ভাগ অপরিবর্তনীয় করে বেঁধে দেন নি এবং স্রষ্টা তাদের জন্য যা করা ও যেমনটি হওয়া পসন্দ করেন তেমনটি হওয়া ও তা করার জন্য তাদেরকে বাধ্য করেন না। তিনি তাদেরকে কতক প্রাকৃতিক বিধিবিধানের বিরুদ্ধে (যেমন: সহজাত প্রবণতার বিরুদ্ধে) বিদ্রোহ করার ক্ষমতা ও সুযোগ দিয়েছেন। এমনকি তারা চাইলে স্রষ্টার পসন্দ-অপসন্দের বিরুদ্ধাচরণ করতে পারবে ; তিনি তাদেরকে সে সুযোগও দিয়েছেন , যদিও বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে এটা সুনিশ্চিত যে , তিনি পসন্দ করেন না যে , তারা এমনটি করুক। অর্থাৎ কতক সৃষ্টিকে তিনি যে ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতা দিয়েছেন তার দাবী মিটাতে গিয়ে তিনি তাদেরকে তাঁর পসন্দনীয় কাজ সম্পাদনে ও তাঁর অপসন্দনীয় কাজ সম্পাদন থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করেন না।

বলা বাহুল্য যে , ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতার অধিকারী এই সৃষ্টিনিচয় প্রকৃতিক বিধিবিধানে পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম না হলেও প্রাকৃতিক বিধিবিধানের স্বেচ্ছাচারী প্রয়োগ করতে পারে - যার পরিণতিতে সৃষ্টিলোকের গতিধারায় কমবেশী নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার লাভ করে। ক্ষেত্রবিশেষে এ নেতিবাচক প্রভাব এতোখানি হতে পারে যে , তা সৃষ্টিলোকের শৃঙ্খলা ও লক্ষ্যকে ব্যাহত করতে পারে বা অন্য সৃষ্টির স্বাভাবিক দাবীকে নস্যাৎ করতে পারে। এমতাবস্থায় সামগ্রিকভাবে সৃষ্টিলোকের বা তার অংশবিশেষের দাবী মিটাতে গিয়ে বা সৃষ্টিলোককে তার চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছানোর স্বার্থে তিনি ঐ সব সৃষ্টির কর্মক্ষেত্রে ইতিবাচক হস্তক্ষেপ করবেন এটাই বিচারবুদ্ধির দাবী।

বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে অপরিহার্য সত্তার একত্ব

বিচারবুদ্ধির বিশ্লেষণের চূড়ান্ত রায় হচ্ছে এই যে , আমাদের এ বিশ্বজগৎ সহ যে কোনো মাত্রার সম্ভব সকল জগতের বস্তুগত ও অবস্তুগত নির্বিশেষে সকল প্রকার সম্ভব-অস্তিত্বের আদি উৎসকে অনিবার্যভাবেই সকল পূর্ণতার অধিকারী অপরিহার্য সত্তা হতে হবে। অনিবার্যভাবেই এ অপরিহার্য সত্তাকে হতে হবে সকল প্রকার অপূর্ণতা , অভাব , দুর্বলতা ও ঘাটতি থেকে পুরোপুরি মুক্ত , নচেৎ তাঁর পক্ষে অপরিহার্য সত্তা হওয়া সম্ভব নয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে , এ অপরিহার্য সত্তা কি একজন হতে বাধ্য , নাকি একাধিক হওয়া সম্ভব ? এ ব্যাপারে বিচারবুদ্ধি কী বলে ?

এ ব্যাপারে ধর্মসমূহের নিজস্ব দাবী ও বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করতে গেলে অকাট্য সত্যে উপনীত হওয়া ও মতপার্থক্য নিরসন সম্ভব হবে না। তাই এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মানদণ্ড হিসেবে সকলের জন্য যা সমান সেই বিচারবুদ্ধির দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। অন্যদিকে মানুষের চিন্তা ও আচরণ নিয়ন্ত্রণে বিষয়টির অপরিসীম গুরুত্বের কারণে প্রশ্নটিকে অমীমাংসিতভাবেও ছেড়ে দেয়া যায় না।

আদি ঈশ্বর সৃষ্ট দেব-দেবীর ধারণা

এ প্রসঙ্গে প্রথমেই যে বিষয়টি স্মরণ করা যেতে পারে তা হচ্ছে এই যে , অংশীবাদী ধর্মগুলো বহু-ঈশ্বরবাদী যে সব মতামত উপস্থাপন করেছে তাতে সাধারণতঃ একজন আদি ঈশ্বর বা ঈশ্বরগণের ঈশ্বর (পরমেশ্বর) এবং তাঁর অধীনস্থ বা সহযোগী কতক ঈশ্বর বা দেব-দেবীর অস্তিত্ব দাবী করা হয় । কোনো কোনো মতে অবশ্য আদি ঈশ্বর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপ ধারণ করে ধরাধামে আবির্ভূত হয়েছেন বলে দাবী করা হয়।

আদি ঈশ্বরের অধীনস্থ বা তাঁর সহযোগী বহু ঈশ্বরের অস্তিত্ব সংক্রান্ত ধারণায় যে ধরনের সত্তার কথা বলা হয় , ঐ সব ধর্মমত অনুযায়ীই , সাধারণতঃ তারা আদি ঈশ্বরেরই সৃষ্টি। আর বলা বাহুল্য যে , সৃষ্টি কখনো অপরিহার্য সত্তা হতে পারে না।

সৃষ্টি যতো উন্নত মানেরই হোক , সৃষ্টি সৃষ্টিই ; তার পক্ষে অনন্যমুখাপেক্ষী পর্যায়ের স্রষ্টায় পরিণত হওয়া বা এ পর্যায়ের অন্য কোনো গুণের অধিকারী হওয়া সম্ভব নয়। কেননা , সৃষ্ট সত্তা হবার কারণে অনিবার্যভাবেই তাকে তার স্রষ্টার মুখাপেক্ষী থাকতে হচ্ছে। অতএব , তাকে স্রষ্টার ক্ষমতায় অংশীদার গণ্য করা যায় না।

একাধিক অনাদি অপরিহার্য সত্তার ধারণা

অংশীবাদী ধারণার একটি রূপ এই যে , সত্তাগতভাবেই তথা অনাদি কাল থেকেই একাধিক অপরিহার্য সত্তার অস্তিত্ব রয়েছে।

কিন্তু বিচারবুদ্ধি এটা গ্রহণ করে না। কারণ , অপরিহার্য সত্তাকে অবশ্যই সকল পূর্ণতাবাচক গুণের পূর্ণ মাত্রায় অধিকারী হতে হবে। আর এ ধরনের পূর্ণ সত্তা একাধিক হতে পারে না। কারণ , যে সব সত্তা অপূর্ণ ও সসীম সে সব সত্তার মধ্যে অস্তিত্বগত পারস্পরিক স্বাতন্ত্র্য থাকা অপরিহার্য , এর বিপরীতে নিরঙ্কুশ পূর্ণ সত্তাকে একাধিক কল্পনা করা হলে সে ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে পারস্পরিক স্বাতন্ত্র্য না-থাকা অপরিহার্য। কারণ , স্বাতন্ত্র্যের উৎসই হচ্ছে কারো মধ্যে পূর্ণতাবাচক গুণাবলীর কতক বা কোনোটি পুরোপুরি বা অংশতঃ না-থাকা - যা অন্যের মধ্যে রয়েছে। এর বিপরীতে নিরঙ্কুশ পূর্ণ সত্তা একাধিক হলে তাদের সকলেই হবে সকল দিক দিয়ে হুবহু অভিন্ন।

উদাহরণ স্বরূপ , সম্ভাব্য বৃহত্তম গোলকের চেয়ে বৃহত্তর কোনো গোলক যেমন অকল্পনীয় (কেননা , সে ক্ষেত্রে এই দ্বিতীয়োক্ত গোলকটিই হবে বৃহত্তম , প্রথমটি নয়) , তেমনি বৃহত্তম দু টি গোলকও অকল্পনীয়। কারণ , সে ক্ষেত্রে প্রথম গোলকের স্থানেই দ্বিতীয় গোলককে স্থান গ্রহণ করতে হবে এবং প্রথম গোলকটির বিলুপ্তি বা ক্ষুদ্রতর গোলকে পরিণত হওয়া ছাড়া তা সম্ভব নয়। একইভাবে , অপরিহার্য সত্তার জন্যে অপরিহার্য সকল পূর্ণতাবাচক গুণাবলীর অধিকারী ও সকল দুর্বলতার উর্ধস্থিত পরম পূর্ণ সত্তা একাধিক হওয়া অকল্পনীয়।

এরপরও যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেয়া হয় যে , এরূপ একাধিক পূর্ণ সত্তা রয়েছেন , সে ক্ষেত্রে সৃষ্টির নিকট তা অভিন্ন সত্তারূপে অনুভূত হতে বাধ্য , ঠিক যেভাবে একটি বৃত্তের ওপরে হুবহু আরেকটি বৃত্ত অঙ্কন করা হলে তা দর্শকের দৃষ্টিতে একটিমাত্র বৃত্তরূপে প্রতিভাত হতে বাধ্য।

তবে অংশীবাদীরা এ ধরনের কল্পিত ঐশ্বরিক সত্তাসমূহের ওপর সাধারণতঃ ভিন্ন ভিন্ন পূর্ণতাবাচক গুণ ও কর্মক্ষমতা আরোপ করে থাকে এবং ক্ষেত্রবিশেষে দু টি সত্তার ওপর অভিন্ন গুণ ও কর্মক্ষমতা আরোপ করলেও তাতে মাত্রাগত পার্থক্য থাকে , অর্থাৎ কল্পিত কোনো ঐশ্বরিক সত্তার মধ্যে কোনো ঐশ্বরিক গুণের প্রাধান্য থাকে এবং অন্যান্য গুণ থাকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল মাত্রায়। অনেক ক্ষেত্রে কল্পিত ঐশ্বরিক সত্তাগুলোর মধ্যকার একেকটি সত্তা স্বতন্ত্র এক বা একাধিক গুণের অধিকারী এবং অন্যান্য গুণ থেকে শূন্য বলে মনে করা হয়। এর মানে হচ্ছে , তাদের প্রত্যেকেই স্বীয় এক বা একাধিক পূর্ণতাবাচক গুণের অধিকারী হলেও অন্যান্য গুণের অধিকারী না হওয়ায় বা অন্যান্য গুণের ক্ষেত্রে পূর্ণতার অধিকারী না হওয়ায় ঐ সব ক্ষেত্রে তারা দুর্বল ও পরনির্ভরশীল। অতএব , এরূপ সত্তা অপরিহার্য সত্তা হতে পারে না।

একাধিক পূর্ণাঙ্গ ঐশ্বরিক সত্তার ধারণা

আরেকটি ধারণা হতে পারে এই যে , ঐশ্বরিক সত্তাগুলোর সকলেই পূর্ণাঙ্গ সত্তা। তবে তারা আপোসে তাদের নিজেদের মধ্যে কর্মক্ষেত্রসমূহ বণ্টন করে নিয়েছে।

কিন্তু এরূপ ধারণা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কারণ , একে তো একাধিক নিরঙ্কুশ পূর্ণ সত্তার অস্তিত্ব অসম্ভব - যা আমরা ওপরে বৃহত্তম গোলকের উদাহরণ দ্বারা প্রমাণ করেছি , দ্বিতীয়তঃ তর্কের খাতিরে এরূপ সত্তার অস্তিত্ব মেনে নিলেও স্বীকার করতে হবে যে , সর্বশক্তিমান সত্তার অনিবার্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে , এককভাবে সার্বিক কর্তৃত্ব। এ ক্ষেত্রে অন্যের সাথে কর্ম ও কর্তৃত্ব বণ্টনের জন্য তাদের কারো পক্ষেই প্রস্তুত থাকা সম্ভব হতে পারে না। বরং সে ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে সংঘাত ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব অবশ্যম্ভাবী - যার পরিণতি হচ্ছে গোটা সৃষ্টিলোকে চরম বিশৃঙ্খলা ও ধ্বংস।

দাবী করা হতে পারে যে , প্রজ্ঞাময়তার কারণে ঐশ্বরিক সত্তাগুলো পারস্পরিক সংঘাতে লিপ্ত না হয়ে আপোসে কর্ম ও কর্তৃত্ব বণ্টন করে নিয়েছে। কিন্তু কথিত এ প্রজ্ঞাময়তা হচ্ছে মানবিক প্রজ্ঞাময়তা। মানুষের জ্ঞান ও শক্তি-ক্ষমতা সীমাবদ্ধ বিধায় তাদের প্রজ্ঞা অনন্যোপায় অবস্থার প্রেক্ষিতে তাদেরকে এরূপ আপোসমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণের অনুকূলে পথনির্দেশ প্রদান করে। এমনকি মানবিক প্রজ্ঞাময়তা আপোসের কর্মনীতি নির্দেশ করলেও তার মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা সর্বময় ও সর্বব্যাপক সার্বভৌম ক্ষমতার দিকে। তবে এ প্রবণতা চরিতার্থ করার প্রচেষ্টা ঝুঁকিবহুল বলেই (যা তাদের দুর্বলতার পরিচায়ক) তারা তা থেকে বিরত থাকে। কিন্তু কখনো ঝুঁকিমুক্ততা অনুভূত হলে অতঃপর তা চরিতার্থ করার প্রচেষ্টা থেকে আর তারা বিরত থাকে না। এমতাবস্থায় সর্বশক্তিমান সত্তার পক্ষে আপোসের প্রশ্নই ওঠে না। আর আপোস করার মানে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সত্তা সর্বশক্তিমান নয় এবং সর্বশক্তিমান না হলে সে পরম পূর্ণ সত্তা হতে পারে না। কারণ , সে ক্ষেত্রে সে কমপক্ষে এই একটি গুণের বিচারে অপূর্ণ। অতএব , সে অপরিহার্য সত্তা হতে পারে না।

এ ক্ষেত্রে আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে বিভিন্ন কর্মের ও কর্মক্ষেত্রের পরস্পর-সম্পৃক্ততা। সৃষ্টি , লালন-পালন ও পরিচালনা এবং ধ্বংস ও মৃত্যু যদি বিভিন্ন ঐশ্বরিক সত্তার মধ্যে বণ্টিত হয় সে ক্ষেত্রে স্রষ্টার কর্মের ওপর অন্যদের কর্ম নির্ভরশীল হবে। স্রষ্টা সত্তা যদি সৃষ্টি না করার সিদ্ধান্ত নেয় সে ক্ষেত্রে অন্যরা অকেজো হয়ে পড়তে বাধ্য। কারণ , লালন-পালন , পরিচালনা , মৃত্যুদান ও ধ্বংসসাধন করা বা না-করার সিদ্ধান্তগ্রহণ কেবল তখনি অর্থবহ হতে পারে যখন স্রষ্টাসত্তা কোনো কিছুকে বা কাউকে সৃষ্টি করবে। স্রষ্টাসত্তা সৃষ্টি না করলে অন্যদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো তাৎপর্য থাকে না। অতএব , এহেন সত্তা অপরিহার্য সত্তা হতে পারে না। অন্যদিকে যার কেবল সৃষ্টির ক্ষমতা আছে এবং পরিচালনা ও প্রতিপালনের ক্ষমতা নেই , নিদেন পক্ষে মৃত্যুদান ও ধ্বংসসাধনের ক্ষমতা নেই , সে-ও অক্ষম ও অপূর্ণ বৈ নয়। অতএব , সে-ও অপরিহার্য সত্তা হতে পারে না।

অবতারবাদের ধারণা

অংশীবাদীদের আরেকটি ধারণা অবতারবাদের ধারণা। অর্থাৎ সর্বশক্তিমান ও সকল পূর্ণতার অধিকারী একমেবাদ্বিতীয়ম ঐশ্বরিক সত্তা তাঁর সৃষ্টির , বিশেষ করে মানুষের কল্যাণার্থে যুগে যুগে সৃষ্টির আকারে , বিশেষতঃ মানুষরূপে আবির্ভূত হন। এরূপ আবির্ভূত সত্তা হচ্ছেন ঈশ্বরের অবতার বা ছদ্মবেশী ঈশ্বর। এ মতে যে ধরনের ঐশ্বরিক সত্তার কথা বলা হয়েছে সে ধরনের সত্তাও অপরিহার্য সত্তা হতে পারে না। কারণ , অসীম কখনোই সসীম রূপ ধারণ করতে পারে না। অন্যদিকে সসীম মানেই অপূর্ণতা।

আমরা ইতিপূর্বেও যেমন উল্লেখ করেছি , সৃষ্টির কল্যাণের জন্য অসীম ও অশরীরী ঐশ্বরিক সত্তার অর্থাৎ অপরিহার্য অস্তিত্বের সসীম হবার ও শরীরী হবার প্রয়োজন নেই। এ ক্ষেত্রে তাঁর পক্ষ থেকে এক বা একাধিক আদর্শ ও অনুকরণযোগ্য সৃষ্টি উপস্থাপনই যথেষ্ট। কারণ , সৃষ্টি ও স্রষ্টার সত্তাগত ধরন ( category) ই আলাদা। তাই সৃষ্টির পূর্ণতা মানে স্রষ্টায় বা ঈশ্বরে পরিণত হওয়া নয় ; তা সম্ভবও নয়। অতএব , তার সামনে আদর্শ সৃষ্টি উপস্থাপনের জন্য এক বা একাধিক বিশেষ সৃষ্টি প্রয়োজন ; স্বয়ং ঈশ্বরের জন্য সৃষ্টি - রূপ ধারণের প্রয়োজন নেই ( এবং তা সম্ভবও নয় , কারণ , রূপ পরিবর্তনের মাধ্যমে সসীম হওয়া মানে তার স্রষ্টা ও ঐশ্বরিক সত্তা থেকে সৃষ্টিসত্তায় অধঃপতন - যার পর আর সে ঈশ্বর থাকে না )

বরং সর্বশক্তিমান স্রষ্টার পক্ষে অনুসরণীয় আদর্শ সৃষ্টি উপস্থাপন করা সম্ভব। এটা সম্ভব না হলে তা তার অপূর্ণতা ও অক্ষমতার পরিচায়ক এবং সে ক্ষেত্রে সে অপরিহার্য সত্তা হতে পারে না।

অবতারবাদ প্রমাণ করার জন্য অনেক সময় হাস্যষ্কর কূট যুক্তির অবতারণা করা হয়। বলা হয় , ঈশ্বর সব কিছু করতে সক্ষম , অতএব , তিনি সৃষ্টিরূপে আত্মপ্রকাশ করতেও সক্ষম ; তিনি এটা পারেন না বললে তাঁকে অক্ষম মনে করা হয়।

এ ধরনের বক্তব্য যুক্তিবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে প্রত্যাখ্যাত অযৌক্তিক কূটতার্কিক বক্তব্য বৈ নয়। কারণ , সক্ষমতা অক্ষমতা কেবল সে কাজের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যা সম্পাদন করা বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে সম্ভব। তেমনি অস্তিত্ব বলতে কেবল তা-ই বুঝায় যার অস্তিত্বলাভ সম্ভব ; যার অস্তিত্বলাভই অসম্ভব তেমন কিছুকে অস্তিত্বদান করতে পারা বা না-পারা কোনোটারই প্রশ্ন আসে না। বরং যা কিছু সংঘটিত হওয়া বা অস্তিত্বলাভ করা সম্ভব শুধু তা নিয়েই আলোচনা করা যেতে পারে যে , তা কি স্বতঃই অপরিহার্য অস্তিত্ব , নাকি সম্ভব অস্তিত্ব তথা অস্তিত্বলাভের জন্যে প্রয়োজনীয় শর্তাবলী পূরণ হলে অস্তিত্বলাভ করে ?

একটি বস্তু খাঁটি সোনার হতে পারে , খাঁটি রৌপ্যের হতে পারে অথবা স্বর্ণ-রৌপ্যের মিশ্রণেও তৈরী হতে পারে। কিন্তু একই সাথে তা পুরোপুরি খাঁটি স্বর্ণের হবে , আবার খাঁটি রৌপ্যেরও হবে - এটা হতে পারে না। অন্যদিকে তা যদি স্বর্ণ ও রৌপ্যের সংমিশ্রণ হয়ে থাকে তাহলে তাতে শতকরা যতো ভাগ রৌপ্য রয়েছে স্বর্ণ হিসেবে তা শতকরা ততো ভাগ অ-খাঁটি বা নিম্ন মানের স্বর্ণ। তেমনি রৌপ্য হওয়ার দৃষ্টিতে তা সাধারণ রৌপ্যের চেয়ে ততোখানি উন্নততর যতোখানি তাতে স্বর্ণ রয়েছে ; কিন্তু তাতে স্বর্ণের ভাগ থাকলেও রৌপ্য স্বর্ণ হয়ে যায় নি। অন্যদিকে যা খাঁটি স্বর্ণ তা স্বর্ণ হবার পাশাপাশি একই সাথে খাঁটি রৌপ্য হতে না পারায় তা এতে ব্যবহৃত স্বর্ণের জন্য ত্রুটি বা অসম্পূর্ণতা হিসেবে পরিগণিত হয় না।

তেমনি অপরিহার্য সত্তা ও সম্ভব সত্তা অস্তিত্বের প্রাথমিক ও মৌল বিভাজনের বিচারেই পরস্পর স্বতন্ত্র এবং যে কোনো সম্ভব সত্তাই স্বীয় অস্তিত্বলাভ ও অস্তিত্ব অব্যাহত রাখার জন্য অপরিহার্য সত্তার ওপর নির্ভরশীল। এমতাবস্থায় কোনোভাবেই অপরিহার্য সত্তার পক্ষে সম্ভব সত্তায় পরিণত হওয়া এবং সম্ভব সত্তার পক্ষে অপরিহার্য সত্তায় পরিণত হওয়া সম্ভব নয়। অতএব , অপরিহার্য সত্তার পক্ষে সসীম সৃষ্টি তথা অবতারে রূপান্তরিত হতে না পারা তাঁর অক্ষমতার পরিচায়ক নয়।

তর্কের খাতিরে যদি অবতারবাদের ধারণাকে সম্ভব বলে ধরে নেয়া হয় , তো সে ক্ষেত্রে দু টি সমস্যার উদ্ভব ঘটতে বাধ্য। প্রথমতঃ কোনো সৃষ্টি , যেমন: মনুষ্যগর্ভে জন্মগ্রহণকারী কোনো সৃষ্টি যতোই অলৌকিক কর্ম সম্পাদন করুক না কেন , সে যে স্বয়ং ঈশ্বর অর্থাৎ ঈশ্বরই যে মনুষ্যসন্তানরূপে আবির্ভূত হয়েছেন - অনেকের মনেই এ মর্মে প্রত্যয় সৃষ্টি হবে না। কারণ , অবতার না হয়েও অনেকের পক্ষে অলৌকিক কর্ম সম্পাদন করা সম্ভব , যেমন: জাদুকর বা বস্তুবিজ্ঞানে ব্যাপক ও সুগভীর জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তি।

এ ক্ষেত্রে অলৌকিকত্বের মাত্রা , ব্যাপকতা বা গভীরতা কোনো ব্যাপার নয়। কারণ , অনেক জাদুকর বা অনেক বিজ্ঞানীর মধ্যে অবশ্যই কেউ না কেউ অন্যদের তুলনায় শ্রেষ্ঠতর হবেই। এমতাবস্থায় ঈশ্বরকে অবতাররূপে আবির্ভূত হতে হলে এমনভাবে হওয়া উচিত যাতে প্রত্যেকের মনেই তাঁর ঈশ্বর হওয়া সম্পর্কে দৃঢ় প্রত্যয়ের সৃষ্টি হয় (অতঃপর কার্যতঃ কেউ তাঁকে মেনে নিক বা না-ই মেনে নিক)।

কিন্তু অবতারবাদী ধারণানুযায়ী ঈশ্বর যেভাবে অবতার হিসেবে আবির্ভূত হন তাতে বিচারবুদ্ধি এ ধরনের প্রত্যয়ের অধিকারী হতে পারে না। কারণ , মনুষ্যগর্ভে (বা অন্য কোনো প্রাণীর গর্ভে) জন্মগ্রহণজনিত সীমাবদ্ধতাই মানুষের মনে তার ঈশ্বরত্বের দাবী সম্পর্কে অবিশ্বাস সৃষ্টি করে। এমতাবস্থায় অবতারবাদের আসল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়। অর্থাৎ যে মানবকুলের শিক্ষার উদ্দেশ্যে তার অবতাররূপে আবির্ভাব সেই মানবকুলের পক্ষে তাকে অবতাররূপে গণ্য করা ও তার কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

দ্বিতীয়তঃ মানুষের জন্য কেবল একজন আদর্শ মানুষই অনুকরণীয় আদর্শ হতে পারেন , স্বয়ং ঈশ্বর নন। তাই অবতার কর্তৃক মানুষকে সুপথে আনা তো দূরের কথা , বরং এ মতবাদ মানুষের কুপথের ওপর অব্যাহত থাকার কারণস্বরূপ হয়ে থাকে। কারণ , সে ক্ষেত্রে মানুষ এ মর্মে যুক্তি খুঁজে পায় যে , সমস্ত রকমের কুপ্রবৃত্তি , কামনা-বাসনা , লোভ-লালসা ও দুর্বলতা থেকে মুক্ত স্বয়ং ঈশ্বরের পক্ষে যেভাবে পাপাচার ও অন্যায় থেকে দূরে থাকা সম্ভব , আমাদের মতো কুপ্রবৃত্তি , কামনা-বাসনা , লোভ-লালসা ও দুর্বলতার অধিকারী সৃষ্টির পক্ষে কি তা সম্ভব ? নিঃসন্দেহে সুস্থ বিচারবুদ্ধি তার এ যুক্তিকে গ্রহণ করে। ফলে অবতারবাদী ধারণা মানুষের সুপথে আসার কারণ তো হয়ই না , বরং তার পথভ্রষ্টতার কারণ হয়ে থাকে। যুগে যুগে যেখানেই অবতারবাদী ধারণা বিস্তার লাভ করেছে সেখানেই এমনটিই ঘটতে দেখা গেছে।

ঈশ্বরের গুণাবলীর স্বতন্ত্র ঐশ্বরিক সত্তার ধারণা

অংশীবাদীদের আরেকটি ধারণা হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বরের বিভিন্ন গুণকে স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা তথা স্বতন্ত্র ঐশ্বরিক সত্তা রূপে গণ্য করা (ও তদনুযায়ী আরাধনা করা)। এটাও এক বিচারবুদ্ধিপ্রত্যাখ্যাত ধারণা। কারণ , এক ব্যক্তি বহু গুণের অধিকারী হতে পারেন , কিন্তু তাই বলে তাঁকে বহু ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে না। অবশ্য ব্যক্তিকে তার নামের পরিবর্তে বিভিন্ন গুণের ভিত্তিতে সম্বোধন করা যেতে পারে , কিন্তু তা কখনোই এমনভাবে হওয়া উচিত নয় যা থেকে বিভিন্ন স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের ধারণা জন্ম নিতে পারে।

অবশ্য মানুষের বেলায় ব্যক্তির সত্তা ও গুণাবলী অবিভাজ্য নয়। এক ব্যক্তি জ্ঞানী , তবে তাকে জ্ঞানহীনরূপেও ধারণা করা যেতে পারে। যিনি একজন পিতা তাঁকে নিঃসন্তানরূপেও কল্পনা করা চলে। কিন্তু অপরিহার্য সত্তার সত্তা ও গুণাবলী অবিভাজ্য ও অযৌগ। অপরিহার্য সত্তার জন্য যে সব পূর্ণতাবাচক গুণ পূর্ণ মাত্রায় থাকা অপরিহার্য তার কোনোটি বাদ দিয়ে তাঁকে চিন্তাও করা যায় না। কারণ , তার একটিও বাদ দিলে বা একটি গুণের মাত্রা পূর্ণতম-এর চেয়ে সামান্যও কম হলে তিনি আর অপরিহার্য সত্তারূপে গণ্য হতে পারেন না। এমনকি চৈন্তিকভাবেও তাঁর সত্তা ও গুণাবলীকে বিচ্ছিন্নভাবে চিন্তা করা যায় না। অতএব , তাঁর যে কোনো গুণের প্রতিই মনোযোগ দেয়া হোক না কেন , তাঁকে অভিন্ন সত্তা হিসেবেই গণ্য করতে হবে।

যেহেতু অপরিহার্য অস্তিত্বের সত্তা ও গুণাবলী অবিভাজ্য , সেহেতু তাঁর বিভিন্ন গুণের বিভিন্ন দেবতা বা অবতার রূপে আত্মপ্রকাশ করাও অসম্ভব। কারণ , তা করতে হলে তাঁর গুণাবলীকে তাঁর সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। কিন্তু তাঁর সত্তা ও গুণাবলী অভিন্ন অর্থাৎ স্বয়ং সত্তাই গুণ এবং গুণই সত্তা বিধায় এরূপ বিচ্ছিন্নতা অসম্ভব। অবশ্য বিভিন্ন সৃষ্টির মধ্যে তিনি তাঁর বিভিন্ন গুণের প্রভাব প্রতিফলিত করতে পারেন এবং তা ঐ ক্ষেত্রে অন্যান্য সৃষ্টির জন্য অনুসরণযোগ্য আদর্শ হিসেবে গণ্য হতে পারে। কিন্তু অপরিহার্য সত্তা হচ্ছেন স্বয়ং গুণ (কারণ , তাঁর সত্তা ও গুণ অভিন্ন) ; তিনি গুণান্বিত নন। এমতাবস্থায় গুণান্বিত সত্তার মধ্যে গুণের বহিঃপ্রকাশ যতো উচ্চ মাত্রায়ই সংঘটিত হোক না কেন , সে ক্ষেত্রে ঐ সম্ভব সত্তাকে অপরিহার্য সত্তার গুণবিশেষ বলে গণ্য করা যেতে পারে না।

ঈশ্বরের গুণাবলীর দেবমূর্তি নির্মাণ

এ ক্ষেত্রে অপরিহার্য সত্তার বিভিন্ন গুণের বহিঃপ্রকাশরূপে বিভিন্ন দেবমূর্তি রচনা অধিকতর অযৌক্তিক কাজ। কারণ , প্রথমতঃ অপরিহার্য ও অশরীরী অসীম সত্তার জন্যে কোনো সসীম ও শরীরী রূপ কল্পনা করা মানে তাঁর স্বরূপ সম্বন্ধে মিথ্যা রচনা। কারণ , তিনি দর্শনযোগ্য শরীরী সত্তা নন , এমতাবস্থায় তাঁর জন্যে প্রতীক রচনা মানে মিথ্যা রচনা। প্রতীক কখনো প্রকৃত নয়। তথাপি সীমিত সম্ভব সত্তার ক্ষেত্রে প্রতীক বা রূপক প্রকৃত সত্তা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দিতে সক্ষম , কিন্তু অপরিহার্য অসীম সত্তার ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়।

কোনো ব্যক্তির মূর্তি তৈরী করা হলে সে মূর্তি ঐ ব্যক্তি নয় , তবে তা ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে একটা বাহ্যিক ধারণা দিতে সক্ষম। ফলে পরে ঐ ব্যক্তিকে দেখতে গেলে কারো পক্ষে বুঝতে পারা সম্ভব যে , এ হচ্ছে সেই ব্যক্তি যার মূর্তি সে ইতিপূর্বে দেখেছে। কিন্তু যে অসীম সত্তাকে চক্ষু ধারণ করতে পারে না তাঁর মূর্তি রচনা কেবল বিভ্রান্তই করতে পারে। কারণ , তা দর্শকের মন-মগযে এক সসীম ও দর্শনযোগ্য স্রষ্টার মিথ্যা ধারণাকেই তৈরী করে দেয়।

অন্যদিকে কোনো ব্যক্তির বিভিন্ন গুণের সাথে বিভিন্ন ব্যক্তির পরিচিতির কারণে তারা ঐ ব্যক্তির অভিন্ন মূর্তি বা ছবিকেই নিজ নিজ পরিচিত ব্যক্তি মনে করতে পারে। এতে ব্যক্তির পরিচিতি বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে অসম্পূর্ণ হলেও তার ব্যক্তিক রূপ তথা মূর্তি বা ছবি তাদের কাছে অভিন্ন। যেমন: একই ছবির ব্যক্তি কারো কাছে কবি ওমর খৈয়াম হতে পারেন , আবার কারো কাছে জোতির্বিজ্ঞানী ওমর খৈয়াম হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে দুই ব্যক্তিরই জানা অসম্পূর্ণ ও খণ্ডিত হলেও তারা যে ওমর খৈয়াম সম্পর্কে জেনেছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু দুই ব্যক্তির কাছে যদি দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তির ছবি ওমর খৈয়াম হিসেবে বিবেচিত হয় তাহলে তা যে মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। যেমন , ধরুন , কবি ওমর খৈয়ামের নাক লম্বা , কিন্তু ওমর খৈয়াম নামে একজন বিজ্ঞানী আছেন যার নাক থ্যাবড়া। এ ক্ষেত্রে দর্শক কখনোই তাদেরকে এক ব্যক্তি বলে মনে করবে না। এরপর যদি তাদের নামও আলাদা হয় , যেমন: একজনকে কবি ওমর এবং আরেক জনকে বিজ্ঞানী খৈয়াম বলা হয় , সে ক্ষেত্রে কারো পক্ষেই এ দু জনকে এক ব্যক্তি মনে করা সম্ভব হবে না।

এ কারণেই অপরিহার্য সত্তার বিভিন্ন গুণবাচক নামের বিপরীতে ভিন্ন ভিন্ন চেহারা ও আকৃতির দেবমূর্তি রচনার ফলে কার্যতঃ বিভিন্ন গুণের অধিকারী কতগুলো স্বতন্ত্র সত্তার ধারণাই মানুষের মন-মগযে স্থান লাভ করে। আর তা শুধু শরীরীকরণ বা সসীমকরণের দিক থেকেই নয় , স্বতন্ত্রীকরণের দিক থেকেও অপরিহার্য সত্তার সাথে সম্পর্কহীন। তাই তা অপরিহার্য সত্তার প্রতিনিধিত্বস্থানীয় হতে পারে না।

দ্বি-ঈশ্বরবাদী ধারণা

অপরিহার্য সত্তা সম্পর্কে অংশীবাদী ধারণাসমূহের মধ্যে আরেকটি ধারণা হচ্ছে কল্যাণের ঈশ্বর ও অকল্যাণের ঈশ্বর সংক্রান্ত ধারণা।

আমরা আগেই আলোচনা করে এ উপসংহারে উপনীত হয়েছি যে , অপরিহার্য সত্তা তাঁর সংজ্ঞা ও পূর্ণতার বিচারে একাধিক হতে পারেন না। এমতাবস্থায় তথাকথিত অকল্যাণের ঈশ্বর অপরিহার্য সত্তা হতে পারে না। কারণ , স্বয়ং অস্তিত্ব (সম্ভব ও অপরিহার্য নির্বিশেষে) হচ্ছে ইতিবাচক। প্রকৃত পক্ষে নেতিবাচক বলতে কিছু নেই ; ইতিবাচকতার অনুপস্থিতি বা ঘাটতিই হচ্ছে নেতিবাচকতা। অর্থাৎ নেতিবাচকতা অস্তিত্ব নয় , অনস্তিত্ব। এমতাবস্থায় পূর্ণতাবাচক ইতিবাচক গুণাবলীর পূর্ণতম মাত্রার অধিকারী সত্তাই হচ্ছেন অপরিহার্য সত্তা। অতএব , এমন সত্তায় কোনো পূর্ণতাবাচক গুণের অনুপস্থিতি বা ঘাটতি বা কোনোরূপ অকল্যাণ থাকতে পারে না।

অন্যদিকে কোনো সত্তার মধ্যে কোনো অকল্যাণের চরমতম রূপ প্রত্যক্ষ করা গেলে বুঝতে হবে যে , ঐ সত্তা পূর্ণতাবাচক কোনো কোনো বা কতক বা সকল গুণ থেকে শূন্য। এমতাবস্থায় সে সত্তার পক্ষে অপরিহার্য সত্তা হবার তথা ঈশ্বর হবার প্রশ্নই ওঠে না। অতএব , অকল্যাণের ঈশ্বর বলে কিছু থাকতে পারে না। এরূপ অকল্যাণের নায়ককে ঈশ্বর গণ্য করা ও তার আরাধনা করার পরিণতি হচ্ছে অকল্যাণ লাভ করা ও অকল্যাণকারীতে পরিণত হওয়া। কারণ , যে সত্তা কল্যাণগুণশূন্য সে কল্যাণগুণকে বিনষ্ট করে দিতে বাধ্য। তার কাছে অকল্যাণ থেকে মুক্তি প্রার্থনা করে লাভ নেই। কারণ , এরূপ প্রার্থনার ফলে তার মধ্যে দয়ার উদ্রেক হবে এবং সে দয়া করে অকল্যাণ থেকে রেহাই দেবে - এটা সম্ভব নয়। তার মধ্যে দয়ারূপ কল্যাণগুণের অস্তিত্ব নেই বলেই তো সে এরূপ অকল্যাণকর হয়েছে এবং অকল্যাণ ছড়িয়ে দেয়ার কাজে ব্যস্ত রয়েছে। এরূপ অকল্যাণকর (অর্থাৎ কল্যাণগুণহীন) সত্তা থেকে থাকলে সে অবশ্যই অপরিহার্য সত্তা নয়। বরং সে সম্ভব সত্তা মাত্র। অতএব , সে ঈশ্বর হতে পারে না। এমতাবস্থায় তার অকল্যাণ থেকে বাঁচার জন্যে সকল কল্যাণের উৎস অপরিহার্য সত্তার সাথেই সম্পৃক্ত হতে হবে। নিঃসন্দেহে তিনি অকল্যাণ থেকে রক্ষা করতে সক্ষম। আর রক্ষাকামীকে রক্ষায় অসমর্থ হলে তিনি হবেন অসম্পূর্ণ ও অক্ষম। ফলে তিনি অপরিহার্য সত্তা হতে পারেন না। তবে তিনি অকল্যাণ থেকে রক্ষা করবেন কি না তা স্বতন্ত্র ব্যাপার। কারণ , এ ব্যাপারে তিনি পুরোপুরি স্বাধীন। তবে তিনি পারবেন কি না তাঁর সম্পর্কে এরূপ প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই।


11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35