স্রষ্টার কর্মের সাথে কালের সম্পর্ক
আমরা যখন বলি যে , পরম জ্ঞানময় অপরিহার্য সত্তা সব সময় সৃষ্টি ও পরিচালনা করে চলেছেন তখন এ প্রসঙ্গে একটি কালগত প্রশ্ন উঠতে পারে। কারণ ,‘
সব সময়’
মানে অতীত , বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। কিন্তু অনাদি ও অনন্ত অপরিহার্য সত্তা কালের উর্ধে। অর্থাৎ তাঁর জন্য কাল প্রযোজ্য নয়। তাই প্রশ্ন উঠতে পারে যে , এমতাবস্থায় তিনি ছিলেন , আছেন ও থাকবেন অথবা তিনি সৃষ্টির সূচনা করেছেন , এখনো সৃষ্টি ও পরিচালনা করছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন - এ জাতীয় কথা দ্বারা কি তাঁর সম্পর্কে কালগত সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয় না ?
এর জবাব হচ্ছে , প্রকৃত পক্ষে এ জাতীয় ক্রিয়ার ব্যবহার করা হয় সৃষ্টির কালগত সীমাবদ্ধতার কারণে। যেহেতু সৃষ্টিসমূহ কালের গর্ভে অস্তিত্ব লাভ করে ও এগিয়ে চলে সেহেতু কালভিত্তিক ক্রিয়াপদ ব্যবহার ব্যতিরেকে কোনো কার্য সৃষ্টিকুলের জন্য অনুধাবনযোগ্য নয়।
বস্তুতঃ কাল ও স্থান হচ্ছে এক ব্যাপকতর সৃষ্টি - যার গর্ভে সকল সৃষ্টিকে সৃষ্টি ও অগ্রগতি প্রদান করা হয়েছে। তবে এই স্থান ও কালের আপেক্ষিকতা রয়েছে - যা বর্তমান যুগের বিজ্ঞান , বিশেষতঃ কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান স্বীকার করছে। এই আপেক্ষিকতা বস্তুগত ও অবস্তুগত অনেক কিছুর সাথে সংশ্লিষ্ট। অতএব , সামগ্রিকভাবে কাল-কে কোনো একটি সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডে এবং স্থানকেও কোনো একটি সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডে পরিমাপ করা সম্ভব বলে মনে করা উচিত হবে না।
অতএব , প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এই যে , একটি সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডের দৃষ্টিতে বা বিচারে কালের ও স্থানের যে ধারণা আমরা লাভ করি তার গর্ভে বিভিন্ন মানদণ্ডের অনেক কাল ও স্থান রয়েছে। আবার এ বৃহৎ কাল ও স্থানের ন্যায় অনেকগুলো বৃহৎ কাল ও স্থান একটি বৃহত্তর কাল ও স্থানের গর্ভে রয়েছে। এভাবে শেষ পর্যন্ত একটি সর্বব্যাপক কাল ও স্থান রয়েছে - অপরিহার্য সত্তা যাকে সৃষ্টি করে সকল সৃষ্টিকে তার গর্ভে স্থান দিয়েছেন। বলা বাহুল্য যে , নিম্নতর কাল ও স্থান দ্বারা উর্ধতর কাল ও স্থান প্রভাবিত হয় না। অতএব , উচ্চতর কাল ও স্থানের আওতাভুক্ত পর্যবেক্ষক নিম্নতর কাল ও স্থানকে পর্যবেক্ষণ করলে তার দ্বারা নিজে প্রভাবিত হয় না। এভাবে শেষ পর্যন্ত সর্বব্যাপক স্থান-কালেরও উর্ধে যে সত্তা তিনি সকল কাল ও স্থানেরই পর্যবেক্ষক , কিন্তু কোনো কাল ও স্থানই তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
সৃষ্টিসত্তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দু
’
টি মাত্রা
( Dimension)হচ্ছে কাল ও স্থান। কালের স্বরূপ ও আপেক্ষিকতা অনুধাবন অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার এবং এ কারণে এর আপেক্ষিকতা সম্পর্কে অভিজ্ঞতাজাত উদাহণ দেয়াও প্রায় অসম্ভব। কারণ
,
অনেকে কর্তাভেদে অভিন্ন কালের বিভিন্ন অনুভূতি ও বিভিন্ন কর্মের
( Object)ওপর অভিন্ন কালের বিভিন্ন প্রভাবকে কালের আপেক্ষিকতার প্রমাণ হিসেবে গণ্য করলেও প্রকৃত পক্ষে কালের
‘
অনুভূতির
’
ও
‘
প্রভাবের
’
আপেক্ষিকতা কালের আপেক্ষিকতা প্রমাণ করতে সক্ষম নয়। তবে স্থানের আপেক্ষিকতা বোধগম্য বিষয় বটে।
বিষয়টিকে অপেক্ষাকৃত সহজবোধগম্য করার জন্য একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। বলা বাহুল্য যে , অপরিহার্য সত্তা স্রষ্টা , তাঁর বৈশিষ্ট্য ও তাঁর কাজ অনুধাবনের জন্য সৃষ্টি সম্পর্কিত উদাহরণ হচ্ছে দুর্বল উদাহরণ - যাতে প্রকৃত সত্য প্রতিফলিত হয় না , তবে প্রকৃত সত্যের কাছাকাছি পৌঁছা যায় ও মোটামুটি ধারণা লাভ করা যায়। এ কারণেই কেবল বিষয়টিকে সহজবোধগম্য করার লক্ষ্যে আমরা এ ধরনের দুর্বল উদাহরণের আশ্রয় নিতে পারি ।
কাল ও স্থানের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত একটি বিষয় হচ্ছে গতি। তাই এই গতি থেকেই বিষয়টি মোটামুটি বুঝা যেতে পারে। কাল ও স্থানের আওতাধীন প্রতিটি সৃষ্টিই কোনো না কোনোভাবে গতিশীল অবস্থায় রয়েছে। তবে প্রকৃত ব্যাপার হলো এ সৃষ্টিলোকে বহু ধরনের গতি রয়েছে। কিন্তু সকল গতি সকল সৃষ্টির ওপর প্রভাব বিস্তার করে না। যেমন: পরমাণুর অভ্যন্তরে প্রচণ্ড গতি রয়েছে , কিন্তু এ গতি অণুর গতিকে প্রভাবিত করে না। আবার স্বয়ং অণু গতিশীল , কিন্তু বহু অণু সমন্বয়ে গঠিত কোনো বস্তুর গতিকে অণুর গতি প্রভাবিত করতে পারে না।
এবার আরেকটি সহজবোধ্য দৃষ্টান্তে আসা যাক। একটি লোক একটি চলমান জাহাযের ডেকের ওপর একদিক থেকে আরেক দিকে হেঁটে যাচ্ছে , আর তার গায়ের ওপর , ধরুন , তার পিঠের ওপর , একটি পিঁপড়া একদিক থেকে আরেক দিকে হেঁটে যাচ্ছে।
এখানে পিঁপড়ার গতি দ্বারা লোকটির গতি প্রভাবিত হচ্ছে না , কিন্তু লোকটির হাঁটার কারণে পিঁপড়াটি দু’
টি গতির অধিকারী হচ্ছে। অন্যদিকে জাহাযটি গতিশীল , ফলে পিঁপড়ার তিনটি , লোকটির দু’
টি ও জাহাযের একটি গতি রয়েছে। এভাবে পৃথিবী , সৌরলোক , ছায়াপথ ও অসংখ্য ছায়াপথ সম্বলিত বৃহত্তর জগৎ এবং তদুর্ধ জগৎসমূহের গতি বিবেচনায় আনলে গতির সংখ্যা নিম্নতর পর্যায়ে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং উর্ধতর পর্যায়ে ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকবে। অতঃপর আমরা উপনীত হবো গোটা সৃষ্টিলোকরূপ এককের স্রষ্টার কাছে যিনি গতির সম্পূর্ণ উর্ধে।
উপরোক্ত উদাহরণ থেকে যে কোনো সৃষ্টির গতির ও সেই সাথে স্থানগত অবস্থানের বহুত্ব ও আপেক্ষিকতা প্রমাণিত হয়।
একইভাবে তিনি কাল ও স্থানেরও উর্ধে। কিন্তু তিনি কাল
,
স্থান ও গতির
[
প্রকৃত পক্ষে এ তিনটি হচ্ছে একটি অভিন্ন সৃষ্টির তিনটি মাত্রা
( Dimension)মাত্র
]
স্রষ্টা ও পর্যবেক্ষক। এমতাবস্থায়
সৃষ্টি ও পরিচালনার তিনটি কাল হচ্ছে সৃষ্টির অবস্থান থেকে উদ্ভূত
,
স্রষ্টার অবস্থান থেকে নয়। কারণ
,
তাঁর জন্য কাল বলতে কিছু নেই। বরং তাঁর কাছে সব কিছু সদা বর্তমান।
[
বস্তুত
:
আমরা আমাদের জন্য তিনটি কালের প্রবক্তা হলেও প্রকৃত পক্ষে সৃষ্টির কাল মাত্র দু
’
টি
-
অতীত
ও ভবিষ্যৎ
;
সৃষ্টির জন্য বর্তমান মানে হচ্ছে অতীত ও ভবিষ্যতের দুই প্রান্তিক কাল
-
বিন্দুর মিলনস্থল মাত্র। আর স্রষ্টা কালোর্ধ বিধায় সদা বর্তমান।
]
অপরিহার্য সত্তার সৃষ্টিকরণের তাৎপর্য
ওপরের আলোচনা থেকে এ বিষয়টিও সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে , অপরিহার্য সত্তার সৃষ্টিকরণরূপ কর্মের তাৎপর্য হচ্ছে তাঁর সৃষ্টিক্ষমতা ও সৃষ্টি-ইচ্ছার সাথে (যা তাঁর সত্তা থেকে স্বতন্ত্র কোনো গুণ নয় , বরং তাঁর সত্তাই) সৃষ্টির সম্পর্ক , যা সৃষ্টির কালগত বৈশিষ্ট্যের বিচারে অতীত ও ভবিষ্যৎ বলে প্রতিভাত হয়। তেমনি সৃষ্টির সাথে সম্পর্কের কারণেও কখনো তা প্রাকৃতিক বিধানরূপে , কখনো অবিলম্বে কার্যকরযোগ্য ইচ্ছারূপে , কখনো বিলম্বে কার্যকরযোগ্য ইচ্ছারূপে , কখনো বিলম্বে কার্যকরযোগ্য সিদ্ধান্তরূপে , কখনো প্রাকৃতিক বিধানে হস্তক্ষেপরূপে , কখনো কতক সৃষ্টির ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতা রূপে এবং কখনো ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতার অধিকারী সৃষ্টির কর্মে হস্তক্ষেপরূপে প্রতিভাত হয়।
অন্যদিকে যা কিছুকে আমরা প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যতিক্রম বলে মনে করি তা-ও ব্যতিক্রম নয়। বরং তা-ও স্রষ্টা কর্তৃক নির্ধারিত ভিন্ন এক ধরনের বিধান বটে , যদিও তা সচরাচর আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে থেকে যায় বিধায় আমাদের জ্ঞান তার স্বরূপ ধরতে পারে না। অন্যথায় মহাবিজ্ঞানময় অপরিহার্য সত্তার সৃষ্টিকরণ ও পরিচালনা ব্যবস্থায় ইতিবাচক নিয়মাবলী বহির্ভূত কোনো কিছু বিচারবুদ্ধির কাছে বোধগম্য হতে পারে না।