পিতামাতার কারণে সন্তানের দুর্ভাগ্য কেন ?
সবশেষে আরো একটি প্রশ্নের জবাব দেয়া প্রয়োজন বলে মনে হয়। তা হচ্ছে , অনেক ক্ষেত্রেই পিতামাতার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের পরিণামে সন্তান সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের অধিকারী হয়। ধনীর সন্তান ধনী , গরীবের সন্তান গরীব হয়। অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন রোগগ্রস্ত পিতা বা মাতার সন্তান জন্মগতভাবে রোগগ্রস্ত হয়ে থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে , এ ক্ষেত্রে একজনের কর্মফল আরেক জন ভোগ করবে কেন ?
আসলে কয়েকটি বিষয়ে সচেতনতার অভাব থেকে এ প্রশ্নের উদয় হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রথমেই প্রশ্ন জাগে , সুখ-দুঃখের স্বরূপ কি মানুষ উদ্ঘাটন করতে পেরেছে ? সুখ-দুঃখ ও সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য প্রতিটি মানুষের বর্তমান , অতীত ও সম্ভাব্য বা প্রার্থিত ভবিষ্যৎ অবস্থার মধ্যে তুলনার ওপর নির্ভরশীল। প্রকৃত পক্ষে বিষয়টি আপেক্ষিক। সে কী আছে , কী চায় এবং কী হলো - এ তিনের সমন্বয় হচ্ছে তার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য নির্ণয়ের প্রকৃত মানদণ্ড।
তাই প্রশ্ন করতে হয় , জন্মগতভাবে বাঞ্ছিত বৈশিষ্ট্যাবলীর অধিকারী তথা সুন্দর , স্বাস্থ্যবান , শক্তিশালী , শক্তিক্ষমতার অধিকারী ও প্রভূত ধনসম্পদের মালিক মাত্রই কি ভাগ্যবান ? তাদের প্রত্যেকেই কি সুখী ? তাদের সকলেই কি শান্তির অধিকারী ?
নিঃসন্দেহে উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর ক্ষেত্রে একই শ্রেণীর সকলের জবাব এক নয়।
তেমনি জন্মগতভাবে অবাঞ্ছিত বৈশিষ্ট্যাবলীর অধিকারী তথা অসুন্দর , স্বাস্থ্যহীন , দুর্বল , শক্তিক্ষমতাহীন ও দরিদ্র বস্তিবাসীমাত্রই কি দুঃখী ? এ প্রশ্নের জবাবও একই শ্রেণীর সকল বস্তিবাসীর ক্ষেত্রে অভিন্ন নয়। আর এদের মধ্যে যদি কেউ নিজেকে দুঃখী বলে অনুভব না করে তাহলে তাকে ভাগ্যহীন বলা চলে কি ?
অনুরূপভাবে একই ব্যক্তির সকল সময়ের অবস্থা এক নয়। একই ধনী ব্যক্তি যেমন কখনো সুখী , কখনো অসুখী , তেমনি একই বস্তিবাসী ব্যক্তি কখনো সুখী , কখনো অসুখী।
সুখ-দুঃখ ও সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্যের বাহ্যিক ও পার্থিব মানদণ্ড যদি চূড়ান্ত হতো তাহলে রাজপুত্র স্বেচ্ছায় সিংহাসন ত্যাগ করে ফকীর-দরবেশ হয়ে যেতো না , ধনী যাত্রীর ভুল করে ফেলে যাওয়া লক্ষ টাকা গরীব রিকশাওয়ালা ফেরত দিতে যেতো না , দেশ বা ধর্মের জন্য বা মানবতার জন্য কেউ প্রাণ উৎসর্গ করতো না।
এখানে মনে রাখার দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে এই যে , প্রতিটি ব্যক্তি যেমন একেকটি একক সত্তা তেমনি সে তার পরিবার , সমাজ , দেশ ও বিশ্বের এবং সর্বোপরি গোটা সৃষ্টিলোকের সত্তারও অবিচ্ছেদ্য অংশবিশেষ বটে।
সন্তান নিঃসন্দেহে পিতামাতার সত্তার অংশবিশেষ এবং পিতামাতাও সন্তানের সত্তার অংশবিশেষ। এভাবে পরস্পরের সত্তার অংশবিশেষ হওয়ার কারণেই তারা শারীরিকভাবে পরস্পর স্বাধীন সত্তা হওয়া সত্ত্বেও পরস্পরের সুখ-দুঃখ , ভালো-মন্দ ও সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য দ্বারা পারস্পরিকভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকে। এ কারণেই পিতামাতার সন্তান-জন্মলাভপূর্ব অবস্থার দ্বারা সন্তানের প্রভাবিত হওয়ার মধ্যেই তাদের পারস্পরিক প্রভাব সীমাবদ্ধ নয় , বরং সন্তানের জন্মপরবর্তী-কালীন পারস্পরিক সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্যও তাদেরকে পারস্পরিকভাবে স্পর্শ করে। অনেক সময় সন্তানের দুর্ভাগ্য স্বয়ং সন্তানের তুলনায় পিতামাতার জন্য অধিকতর যন্ত্রণাদায়ক হয়ে থাকে।
একটি জন্মান্ধ শিশু পার্থিব জগতের সৌন্দর্য কী জানে না এবং তা তাকে হাজারো ব্যাখ্যা দিয়েও বুঝানো সম্ভব নয়। তাই পার্থিব জগতের সৌন্দর্য দেখতে না পারার কারণে তার তেমন কোনো দুঃখ হবার কথা নয় , কিন্তু সন্তানের জন্মান্ধতার কষ্ট এমনই যন্ত্রণাদায়ক হয় যে , অনেক সময় পিতামাতা সন্তানের অন্ধত্ব দেখার আগে নিজেদের মৃত্যু হলো না কেন - এ মর্মে আফসোস করে থাকে।
বিষয়টি একই দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যকার সম্পর্কের সাথে তুলনীয়। একই দেহের কোনো অঙ্গ রোগাক্রান্ত হলে তা দ্বারা সুস্থ অঙ্গও প্রভাবিত হয়। এ ক্ষেত্রে যে অঙ্গের সাথে যে অঙ্গের দূরত্বগত বা কর্মগত নৈকট্য বেশী সে সব অঙ্গ পরস্পর অধিকতর প্রভাবিত হয়। তেমনি সমাজ , দেশ ও বিশ্বের সামগ্রিক পরস্থিতির ভালো-মন্দ দ্বারা ব্যক্তি প্রভাবিত হয় , কারণ , সে সমাজ , দেশ ও বিশ্বের অংশ।
চিকিৎসাযোগ্য নয় এমন কোনো ব্যাধি কোনো ব্যক্তি বিদেশ থেকে নিয়ে এলে এবং তা সমাজে সংক্রামিত হলে তাতে একজন সুস্থ মানুষের আক্রান্ত হওয়ার এবং তা থেকে আদৌ সুস্থ না হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। পিতামাতার সাথে সন্তানের সম্পর্কও তেমনি। সন্তানের জন্মগ্রহণপূর্ব তথা মাতৃগর্ভে থাকাকালীন অবস্থায় এ সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতম থাকে বিধায় সন্তানের মধ্যে পিতামাতার ভালোমন্দ বৈশিষ্ট্য স্থানান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সবচেয়ে বেশী। পিতার দেহের প্রাণবীজ থেকে মাতৃগর্ভে সন্তানের সূচনা হয় এবং মাতৃদেহের উপাদানে পরিপুষ্ট হয়ে সে একটি পরিপূর্ণ শিশুরূপে ভূমিষ্ঠ হয়। ফলে পিতামাতার বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে সর্বাধিক মাত্রায় স্থানান্তরিত হওয়াটাই স্বাভাবিক।
এ বিষয়টিকে গাছের বীজ থেকে গাছ হওয়ার সাথে তুলনা করা যায়। টক আমের আঁটি থেকে টক আমের গাছই হবে , মিষ্টি আমের গাছ হবে না। অন্যদিকে যে মাটিতে এ আঁটি বপন করা হয়েছে তার প্রভাবও গাছ ও তার ফলে বিস্তার লাভ করবে। বলা হয় , ছাতকের কমলার বীজ দার্জিলিং-এ লাগালে তাতে ছাতকের কমলা পাওয়া যাবে না , তেমনি হুবহু দার্জিলিং-এর কমলাও পাওয়া যাবে না , বরং ছাতক ও দার্জিলিং উভয় জাতের কমলাগাছের কমলা থেকে তার বৈশিষ্ট্য কিছুটা স্বতন্ত্র হবে। এর বিপরীত করা হলেও তার ফল হবে প্রায় অনুরূপ। তবে বীজ থেকে চারা গজানোর পর সে চারা তুলে নিয়ে তৃতীয় কোন জায়গায় লাগালে এর বৈশিষ্ট্য হবে আরো ভিন্ন ধরনের। অর্থাৎ সে ক্ষেত্রে বীজ , জন্মকালীন পরিপুষ্টি ও জন্মপরবর্তী পরিপুষ্টি তিনটিই প্রভাবশালী হবে এবং মিশ্র ফলাফল প্রদান করবে।
তেমনি পোকায় ধরা , ত্রুটিপূর্ণ ও দুর্বল বীজ থেকে সৃষ্ট গাছ এবং দূষিত মাটিতে বপনকৃত ভালো বীজ থেকে সৃষ্ট গাছও নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে - এটাই স্বাভাবিক।
মানুষের বেলায় , একই প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী সন্তানের মধ্যে পিতা ও মাতার কাছ থেকে জন্মসূত্রে প্রাপ্ত প্রভাবের পাশাপাশি জন্মপরবর্তী পরিবেশ ও শিক্ষাও প্রভাবশালী হয়ে থাকে। তবে মানুষ তার বিচারবুদ্ধির পরিপক্বতায় উপনীত হবার পর স্বীয় চেষ্টা-সাধনা ও সংগ্রাম-সাধনার মাধ্যমে জন্ম , পরিবেশ ও শিক্ষা থেকে প্রাপ্ত অবাঞ্ছিত প্রভাব শারীরিক ও পার্থিব ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও এবং নৈতিক ক্ষেত্রে পুরোপুরি কাটিয়ে ঊঠতে পারে।
তৃতীয়তঃ সৃষ্টির সাফল্য ও ব্যর্থতার মানদণ্ড হচ্ছে সে জন্মগতভাবে যে সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে তার বিকাশ ও পূর্ণতায় উপনীত হওয়া বা না-হওয়াতে , অন্যের অনুরূপ হওয়া বা না-হওয়াতে নয়। বিড়ালের জন্য পরিপূর্ণ বিড়াল হওয়াতেই সার্থকতা , বাঘ হতে না পারা তার জন্য ব্যর্থতা নয়। একই প্রজাতির বিভিন্ন সদস্যের ক্ষেত্রেও তা-ই। অন্যদিকে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে মূল পার্থক্য তার বিচারবুদ্ধি ও ঐশী গুণাবলী , অতএব , তার সাফল্য ও ব্যর্থতার মানদণ্ড হচ্ছে এ গুণাবলীর বিকাশ ও ব্যবহার। এতে যে সফল , সে-ই প্রকৃত সফল এবং এতে যে ব্যর্থ সে-ই প্রকৃত ব্যর্থ।
অন্যদিকে পার্থিব ও অপার্থিব মিলিয়ে ব্যক্তির আশা-আকাঙ্ক্ষা ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে স্বতন্ত্র। তাই দেখা যায় যে , এক ব্যক্তি যা পাওয়ার জন্য লালায়িত এবং না পাওয়ার দুঃখে বুক ফেটে মারা যাবার উপক্রম , আরেক ব্যক্তি তা-ই অবজ্ঞাভরে পরিহার করছে। অতএব , সাফল্য-ব্যর্থতার অন্যতম‘
ব্যক্তিগত’
মানদণ্ড এই আশা-আকাঙ্ক্ষও বটে , তবে কারো ব্যক্তিগত মানদণ্ড প্রকৃত বিচারে যথার্থ হতে পারে এবং কারো মানদণ্ড অযথার্থও হতে পারে। এ মানদণ্ডের যথার্থতা-অযথার্থতা নির্ণীত হবে অপার্থিব মানবিক মানদণ্ডের সাথে তুলনা করে। কারণ , এটাই মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মাঝে পার্থক্য নির্দেশ করে।
মানুষ অভিজ্ঞতা থেকে জানতে পারছে যে , বস্তুজগতের সাফল্য ও ব্যর্থতা এবং সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য একদিকে যেমন বিভিন্ন প্রাকৃতিক , অপ্রাকৃতিক ও মানবিক কারণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত , তেমনি মরণশীল মানুষের জন্য তা খুবই অস্থায়ী। অন্যদিকে মানুষ অবস্তুগত যা কিছু অর্জন করে তা বস্তুজগতের কারণাদির প্রভাবে তার হাতছাড়া হয় না এবং তা চিরস্থায়ী। তাই তার উচিত মানবিক ও আত্মিক সম্পদ অর্জনকেই সাফল্য ও ব্যর্থতার মানদণ্ড হিসেবে গণ্য করা এবং পার্থিব জীবন ও উপায়-উপকরণকে এ লক্ষ্যে উপনীত হবার মাধ্যমরূপে ব্যবহার করা।
মোদ্দা কথা , সৃষ্টিলোকে যা কিছু অবাঞ্ছিত উপাদান ও কারণ বলে মনে হয় তা মোটেই অযথা , বা অবাঞ্ছিত , বা অকল্যাণকর নয়। বরং সামগ্রিক ও চূড়ান্ত বিচারে সব কিছুতেই কল্যাণ নিহিত রয়েছে।
‘
আমি কেন তুমি হলাম না ?!’
এ প্রসঙ্গে আনুষঙ্গিক হিসেবে আরো একটি বিষয়ের ওপরে সংক্ষেপে হলেও আলোকপাত করা প্রয়োজন বলে মনে হয়। তা হচ্ছে , অনেক সময় অপূর্ণতার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতে দেখা যায়। যেমন: বলা হয় , সৃষ্টিকর্তা অমুককে বিকলাঙ্গ করে সৃষ্টি করলেন কেন ? আমি কেন সুন্দর চেহারার অধিকারী হলাম না ? তিনি কেন আমাকে ধনীর ঘরে পাঠালেন না অর্থাৎ আমি কেন ধনীর সন্তান হলাম না ? আমার মেধা-প্রতিভা অমুকের তুলনায় কম হলো কেন ? এ পরিবারে জন্ম নেয়ার কারণেই আমি দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছি। ইত্যাদি।
এসব অভিযোগের জবাবে যা বলতে হয় তা হচ্ছে , সৃষ্টিপ্রকৃতিতে অপূর্ণতা বলতে স্বতন্ত্র কিছু নেই , বরং পূর্ণতার অভাব বা ঘাটতিই অপূর্ণতা। আর পূর্ণতার অভাব বা ঘাটতি সৃষ্টিজগতের কার্যকারণ থেকেই উদ্ভূত হয় ; সৃষ্টিকর্তা পরিকল্পিতভাবে কারো মধ্যে ঘাটতি সৃষ্টি করে দেন না বা কাউকে পূর্ণতা থেকে বঞ্চিত করেন না। বিশেষ করে মানুষের ক্ষেত্রে এই অপূর্ণতা বা ঘাটতি অজ্ঞতা বা ভুল পদক্ষেপ থেকে উদ্ভূত হয়।
ওপরে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , কোনো বীজে ত্রুটি থাকলে বা ত্রুটিপূর্ণ মাটিতে বীজ বপন করা হলে অথবা পরিবেশগত অবনতি ঘটলে একটি বীজ থেকে ত্রুটিপূর্ণ গাছ জন্ম নিতে পারে এবং তা স্বাভাবিক পরিবৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত হতে পারে ও স্বাভাবিক ফল প্রদানে অসমর্থ হতে পারে। অনুরূপভাবে পিতার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন প্রাণবীজে বা মাতার ডিম্বে বা শরীরে ত্রুটি থাকলে অথবা পারিপার্শ্বিক ত্রুটির কারণে (যেমন: হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা নিক্ষেপ-পরবর্তীকালে সেখানকার বেঁচে থাকা বাসিন্দাদের মধ্যে ঘটেছে) বিকলাঙ্গ সন্তান জন্ম নিতে পারে। অতএব , এ জন্য সৃষ্টিকর্তাকে দোষারোপ করা ঠিক নয়।
সুন্দর চেহারার অধিকারী বা ধনীর সন্তান হওয়ার বিষয়টিও অনুরূপ। বিষয়টি নিম্নোক্ত উদাহরণের সাহায্যে অপেক্ষাকৃত সহজে বুঝা যেতে পারে।
‘
ক’
-এর যে প্রাণবীজ‘
খ’
-এর গর্ভে মানবশিশুতে পরিণত হয়েছে তা-ই‘
গ’
রূপে জন্মগ্রহণ করেছে এবং উক্ত প্রাণবীজ ও গর্ভধারিনীর গর্ভকালীন অবস্থার ফলে যে ধরনের শিশু তৈরী হওয়া সম্ভব‘
গ’
সে শিশুরূপেই ভূমিষ্ঠ হয়েছে। যে সময়ে‘
ক’
-এর‘
গ’
-বীজ দ্বারা‘
খ’
-এর গর্ভসঞ্চার হয়ে‘
গ’
-এর ভ্রূণ তৈরী হয়েছে সে সময় তা না হয়ে অন্য সময় হলে‘
ক’
-এর অন্য কোনো বীজ দ্বারা‘
খ’
-এর গর্ভসঞ্চার হলে তাতে‘
গ’
-এর জন্ম হতো না , বরং‘
ঘ’
-এর জন্ম হতো এবং হয়তোবা বীজ অথবা গর্ভকালীন অবস্থার পার্থক্যের কারণে‘
ঘ’
সুন্দর চেহারা নিয়ে জন্মগ্রহণ করতো। অর্থাৎ‘
গ’
-এর পক্ষে যা হওয়া সম্ভব ছিলো সে তা-ই হয়েছে ,‘
গ’
-এর পক্ষে‘
ঘ’
হওয়া সম্ভব ছিলো না , কারণ উভয়ই স্বতন্ত্র।
ওপরের উদাহরণের‘
গ’
-এর পক্ষে ধনীর সন্তান বা নামীদামী লোকের সন্তান হওয়ার বিষয়টিও অনুরূপ , বরং এর অসম্ভাব্যতা অধিকতর সুস্পষ্ট। কারণ , দরিদ্র‘
ক’
-এর‘
গ’
-প্রাণবীজ থেকে‘
গ’
-এর জন্ম হয়েছে এবং ধনী‘
ঙ’
-এর‘
চ’
-প্রাণবীজ থেকে‘
চ’
-এর জন্ম হয়েছে। এখন‘
গ’
-এর পক্ষে কী করে‘
চ’
হওয়া বা‘
ঙ’
-এর সন্তান হওয়া সম্ভব হতো ?
অনুরূপভাবে‘
ক’
-এর প্রাণবীজ দ্বারা‘
খ’
-এর পরিবর্তে‘
ছ’
গর্ভবতী হলে সে সন্তান‘
গ’
হতো না। এমনকি যদি ধরে নেয়া হয় যে ,‘
ক’
-এর‘
গ’
-প্রাণবীজ থেকেই‘
ছ’
গর্ভবতী হয়েছে তথাপি সে সন্তান‘
গ’
হতো না। কারণ , বৃক্ষের বৈশিষ্ট্য বিনির্মাণে বীজের ভূমিকা মুখ্য হলেও মাটির ভূমিকা উপেক্ষণীয় নয় , যে কারণে ছাতকের কমলার বীজ দার্জিলিং-এ লাগালে তাতে না ছাতকের কমলা হয় , না দার্জিলিং-এর , বরং তৃতীয় ধরনের কমলা হয়ে থাকে। অতএব ,‘
গ’
-প্রাণবীজ থেকে‘
খ’
-এর পরিবর্তে‘
ছ’
-এর গর্ভে সন্তান হলে সে বর্তমান‘
গ’
থেকে ভিন্ন এক ব্যক্তিরূপে জন্ম নিতো , এমনকি তার নাম‘
গ’
রাখা হলেও।
আর‘
খ’
-এর গর্ভে‘
ক’
-এর‘
গ’
-প্রাণবীজের পরিবর্তে‘
জ’
-এর কোনো প্রাণবীজ থেকে গর্ভসঞ্চার হলে তা থেকে‘
গ’
-এর জন্মগ্রহণের তো দূরতম সম্ভাবনাও থাকে না। কারণ , সন্তানের ব্যক্তিসত্তা নির্ধারণের মূল উপাদান হচ্ছে প্রাণবীজ ; ল্যাংরা আমের বীজ থেকে ল্যাংরা আম এবং ফজলী আমের বীজ থেকে ফজলী আম জন্ম নেবে ; মাটির অভিন্নতা একটিকে আরেকটিতে পরিবর্তিত করে দেয় না , যদিও মাটির পরিবর্তনে একই বীজের গাছের বৈশিষ্ট্যে অনেকখানি পার্থক্য হয়ে থাকে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে , যারা অসুন্দর , হীনস্বাস্থ্য , দুর্বল , বিকলাঙ্গ , ক্ষমতাহীন বা নিঃস্ব হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছে তাদের পক্ষে অন্য কেউ হয়ে জন্মগ্রহণ করা সম্ভব ছিলো না। অবশ্য তার জন্ম না হওয়া সম্ভব ছিলো , (কারণ , সে একজন সম্ভব অস্তিত্ব)। কিন্তু বিষয়টি তার পিতামাতার ওপর নির্ভরশীল এবং তার জন্মের জন্য তার পিতামাতার দায়িত্বহীন ইচ্ছা অথবা দায়িত্বহীন ইচ্ছা না থাকা সাপেক্ষে অজ্ঞতাই দায়ী।
আর ক্ষেত্রবিশেষে (যেমন: বিকলাঙ্গতা বা জন্মগত ব্যাধির ক্ষেত্রে) এ ধরনের সন্তানের জন্মগ্রহণের কারণে স্বয়ং সন্তানটির মনঃকষ্টের পরিমাণের চেয়ে তার পিতামাত্রার মনঃকষ্টের পরিমাণ অনেক গুণে বেশী হয়ে থাকে এবং ক্ষেত্রবিশেষে (যেমন: দারিদ্র্য ও অসৌন্দর্যের ক্ষেত্রে) সন্তানটি তার জন্মগ্রহণকে সম্ভাব্য জন্ম না নেয়ার ওপর অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। কোনো দরিদ্রসন্তানকে যদি জানানো হয় যে , দারিদ্র্যজনিত কারণে তার পিতামাতাকে কেউ এ সন্তানটি গর্ভে থাকাকালে গর্ভপাত ঘটানোর পরামর্শ দিয়েছিলো তখন ঐ পরামর্শদাতার প্রতি সন্তানটি সন্তুষ্ট হয় , নাকি অসন্তুষ্ট হয় তা লক্ষণীয়। নিঃসন্দেহে সে তার জন্ম না নেয়ার কথাটি কিছুতেই মেনে নিতে পারে না।