জীবন জিজ্ঞাসা

জীবন জিজ্ঞাসা5%

জীবন জিজ্ঞাসা লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

জীবন জিজ্ঞাসা
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 58 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 42142 / ডাউনলোড: 4650
সাইজ সাইজ সাইজ
জীবন জিজ্ঞাসা

জীবন জিজ্ঞাসা

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

স্রষ্টার বাইরে সৃষ্টির অস্তিত্ব নেই

এখানে প্রসঙ্গতঃ বলে রাখা প্রয়োজন যে , আমরা বাস্তব জগতে যা কিছু সৃষ্টি করি সে ক্ষেত্রে আসলে আমরা সৃষ্টি করি না , সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিতে রূপান্তর ঘটাই মাত্র। আমাদের বাস্তব সৃজনক্ষমতার প্রয়োগের বা সৃষ্টিকর্ম সম্পাদনের স্বরূপ হচ্ছে এই যে , আমরা যা কল্পনা করি তার ভিত্তিতে বাস্তব জগতে বিরাজমান সৃষ্টিতে রূপান্তর ঘটিয়ে তার (কল্পনার) অনুরূপ করি মাত্র। কিন্তু প্রকৃত সৃষ্টি তা-ই যা বিদ্যমান উপাদান ছাড়াই সৃষ্টি করা হয় অর্থাৎ শূন্য থেকে সৃষ্টি করা হয়। অতএব , আমরা যা কল্পনা করি তা-ই আমাদের প্রকৃত সৃষ্টি। এরূপ সৃষ্টি তার অস্তিত্বলাভ , স্থিতি , ধারাবাহিকতা রক্ষা , বিনাশ ও পুনঃপ্রত্যাবর্তনের জন্য তার স্রষ্টার (কল্পনাকারীর) ওপর নির্ভরশীল। স্রষ্টার অস্তিত্বের বাইরে তার স্বাধীন অস্তিত্ব অকল্পনীয়।

এ থেকে আমরা এ উপসংহারে উপনীত হতে পারি যে , সৃষ্টিমাত্রই তার অস্তিত্বলাভ , স্থিতি , ধারাবাহিকতা রক্ষা , বিনাশ ও পুনঃপ্রত্যাবর্তনের জন্য স্বীয় স্রষ্টার ওপর নির্ভরশীল। স্রষ্টার অস্তিত্বের বাইরে তার কোনো অস্তিত্ব নেই , যদিও সে স্রষ্টার অংশ নয়। পরম স্রষ্টা অপরিহার্য সত্তার সাথে তাঁর সৃষ্ট সৃষ্টিলোকের সম্পর্কও এ ধরনেরই।

পরম স্রষ্টার সৃষ্টিবৈচিত্র্য

যে স্রষ্টা সীমাহীন জ্ঞান , ইচ্ছাশক্তি ও সৃজনক্ষমতার অধিকারী সে পরম স্রষ্টার সৃষ্টি শুধু সংখ্যাগত দিক থেকে নয় , বরং গুণগত ও মাত্রাগত দিক থেকেও এতো বেশী ও এতো বৈচিত্র্যপূর্ণ হওয়াই স্বাভাবিক যা আমাদের সীমিত কল্পনাশক্তি দ্বারা কল্পনা করাও সম্ভব নয়।

ইতিপূর্বে আমরা অস্তিত্বের দার্শনিক বিভাজনের কথা উল্লেখ করেছি এবং সে ক্ষেত্রে প্রচলিত দার্শনিক বিভাজন থেকে কিছুটা (কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ) ভিন্নমত পোষণ করে এভাবে বিভাজন করেছি: অস্তিত্ব দু রকম: অপরিহার্য ও সম্ভব ; সম্ভব অস্তিত্ব হয় অবস্তুগত , নয়তো প্রায় বস্তুগত , নয়তো বস্তুগত। এখানে আরো অনেক বিভাগ চিন্তা করা যায়। যেমন: বস্তুগত সৃষ্টি দু রকমের: জড় ও প্রাণশীল। প্রাণশীল সৃষ্টি দু রকম: বদ্ধ ও মুক্ত। উদ্ভিদ হচ্ছে বদ্ধ এবং অন্যান্য প্রাণশীল সৃষ্টি মুক্ত। মুক্ত প্রাণশীল সৃষ্টি হয় স্বাধীন বিচরণক্ষমতাহীন (যেমন: লোহিত কণিকা , শ্বেত কণিকা ও রোগজীবাণু) , নয়তো স্বাধীন বিচরণক্ষমতা সম্পন্ন। শেষোক্ত গোষ্ঠী হয় পুরোপুরি সহজাত প্রবৃত্তি চালিত (যেমন: মশা-মাছি) , নয়তো বুদ্ধিমান। বুদ্ধিমান প্রাণী হয় বিচারবুদ্ধি ও কল্পনাশক্তির অধিকারী (মানুষ) , নয়তো এ ক্ষমতার অধিকারী নয়।

অবস্তুগত ও প্রায় বস্তুগত সৃষ্টির মধ্যেও নিঃসন্দেহে বহুবিধ বিভাজন সম্ভব - যে সম্পর্কে আমাদের ধারণা খুবই সীমিত। এরূপ সৃষ্টি ব্যক্তিসত্তাসম্পন্ন ও ব্যক্তিসত্তাবিহীন হতে পারে। আবার জ্যামিতিক সত্যগুলো অর্থাৎ দ্বিমাত্রিক , একমাত্রিক ও শূন্যমাত্রিক অস্তিত্ব , গাণিতিক সংখ্যা , তরঙ্গ , চৌম্বক ক্ষেত্র , মানবমস্তিষ্কের কল্পিত সৃষ্টি , সুর , সৌন্দর্য ইত্যাদি অবস্তুগত সত্যকে কোন্ পর্যায়ে ফেলা যায় সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার।

এ তো গেলো এমন সৃষ্টির কথা যা কম - বেশী আমাদের বিচারবুদ্ধির ধারণক্ষমতার আওতাভুক্ত। এর বাইরে আরো বিভিন্ন মাত্রার ( Dimension)কতো রকম সৃষ্টি রয়েছে তা আমাদের পক্ষে চিন্তা করাও সম্ভব নয়।

বন্দিত্ব নাকি স্বাধীনতা ?

পরম স্রষ্টা যেমন বস্তুগত , অবস্তুগত , প্রায় বস্তুগত ও প্রাণশীল সৃষ্টিনিচয় সৃষ্টি করেছেন , তেমনি সৃষ্টি করেছেন প্রাকৃতিক বিধিবিধান। তিনি মাধ্যাকর্ষণ ও মহাকর্ষণ শক্তি এবং মৌলিক ও যৌগিক সৃষ্টিসমূহের জন্য সুনির্দিষ্ট গঠন-ফর্মুলা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এভাবে তিনি তাঁর সৃষ্টিজগৎকে সুনিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খল করেছেন। এছাড়া তিনি প্রাণশীল সৃষ্টির জন্য সহজাত প্রবণতা সৃষ্টি করেছেন এবং কতক সৃষ্টিকে বুদ্ধিমত্তা দিয়েছেন ও জ্ঞানার্জনের যোগ্যতা দিয়েছেন। তিনি কতক প্রাণশীল সৃষ্টিকে বিচরণের স্বাধীনতা ও ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন এবং মানুষকে দিয়েছেন সর্বোচ্চ স্বাধীনতা , এমনকি প্রাকৃতিক বিধান ও সহজাত প্রবণতার বিরোধিতা বা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার স্বাধীনতা। ফলে প্রাকৃতিক বিধিবিধান ও সহজাত প্রবণতা দ্বারা অন্যান্য প্রাণীর স্বাধীনতা যতোখানি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে , মানুষের স্বাধীনতা ততোখানি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না।

কিন্তু মানুষের স্বাধীনতার স্বরূপ নিয়ে অনেকে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছেন। কেউ কেউ মানুষকে নিরঙ্কুশ স্বাধীন বলে দাবী করেছেন , কেউ কেউ তাকে স্রষ্টার ইচ্ছার ক্রীড়নক গণ্য করেছেন এবং তার স্বাধীনতাকে পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। একদল বলছেন , আমরা যখন প্রাকৃতিক বিধিবিধানের সীমাবদ্ধতা ব্যতিরেকে মানবিক ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা অনুভব করি না , বরং স্বাধীনতা অনুভব করি , তখন আমরা পুরোপুরি স্বাধীন। অপর দল বলছেন , সৃষ্টিপ্রকৃতির নিখুঁত শৃঙ্খলার মধ্যে স্বাধীনতার অবকাশ থাকতে পারে না। বরং আমরা রেকর্ডকৃত কার্টুন-চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ন্যায় পূর্বসম্পাদিত ভূমিকার পর্দায় নিক্ষিপ্ত দৃশ্যসম বৈ নই ; আগামীতে আমি কোন্ ভূমিকায় আবির্ভূত হবো তা না জানলেও এতে সন্দেহ নেই যে , পূর্বে নির্ধারিত করে রাখা দৃশ্যে ও ভূমিকায়ই আবির্ভূত হবো। তাঁরা আরো বলেন যে , ভবিষ্যৎদ্রষ্টা সৃষ্টিকর্তা তো জানেনই ভবিষ্যতে আমার ভূমিকা কী হবে , অতএব , আমার পক্ষে তার অন্যথা করা সম্ভব নয়।

এ দুই মতের ধারকরা দুই প্রান্তিকতায় পৌঁছে গেছেন ; একদেশদর্শিতার কারণে তাঁরা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন।

বাস্তবে আমরা কী অনুভব করি ? আমরা একদিকে যেমন স্বাধীনতা অনুভব করি , অন্যদিকে সীমাবদ্ধতাও অনুভব করি ; স্বাধীনতা ও সীমাবদ্ধতা কোনোটিই নিরঙ্কুশভাবে অনুভব করি না।

বিশেষ করে যারা স্বাধীনতার ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছেন তাঁরা এমন দাবীও করে থাকেন যে , আমরা যে স্বাধীনতা অনুভব করছি , আসলে আমাদেরকে এরূপ অনুভব করতে বাধ্য করা হচ্ছে। তাঁদের এ ধারণা এ কারণে গ্রহণযোগ্য নয় যে , মানুষের যদি স্বাধীনতা না-ই থাকবে অথচ তাকে স্বাধীনতা অনুভব করতে বাধ্য করা হবে , তাহলে তা হবে এক ধরনের অন্যায় ও প্রতারণা। কিন্তু পরম পূর্ণতার অধিকারী স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির সাথে অন্যায় ও প্রতারণার আশ্রয় নেবেন এরূপ দুর্বলতা থেকে তিনি প্রমুক্ত।

অন্যদিকে স্বাধীনতার অনুভূতি যেমন অকাট্য ও সর্বজনীন , স্বাধীন অনুভব করতে বাধ্য করার অনুভূতি তদ্রূপ সর্বজনীন নয়। অর্থাৎ যারা মনে করছেন যে , আসলে আমরা স্বাধীন নই , তাঁরাও নিজেদেরকে স্বাধীন অনুভব করছেন , তবে কোনো কোনো যুক্তির ভিত্তিতে স্বীয় অনুভূতির বিপরীতে ধারণা করছেন যে , আমরা যা অনুভব করছি তা ঠিক নয় , বরং আমাদেরকে এরূপ অনুভব করতে বাধ্য করা হয়েছে। এ দাবী হচ্ছে বাস্তব অনুভূতির বিপরীত জ্ঞানগত বিতর্কের দাবী মাত্র এবং তার উৎস হচ্ছে ধারণা । অতএব , এ ধারণা যেমন সর্বজনীন নয় , তেমনি তা অকাট্যও নয়। আর ধারণাজাত বিতর্কিত দাবীর ভিত্তিতে সর্বজনীন অকাট্য অনুভূতির সত্যতায় সন্দেহ পোষণ করা চলে না।

যারা স্বাধীনতার অনুভূতিকে অস্বীকার করেন তাঁদের একটি যুক্তি হচ্ছে এই যে , এটা সৃষ্টিজগতের শৃঙ্খলার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু ঝুকিপূর্ণ হলেও স্বাধীন এক্তিয়ার সম্পন্ন সৃষ্টির অস্তিত্ব তার সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিক্ষমতার ব্যাপকতাই প্রমাণ করে , যার অনুপস্থিতিতে তাঁর সৃষ্টিক্ষমতা অপেক্ষাকৃত সীমিত প্রতিভাত হতো।

মানুষের স্বাধীনতার অনুভূতি অস্বীকারকারীদের আরেকটি যুক্তি হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার ভবিষ্যৎ জ্ঞানের যুক্তি। [এ প্রসঙ্গে ইতিপূর্বে বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে সৃষ্টি ও ব্যবস্থাপনার প্রক্রিয়া শিরোনামে কিছুটা সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে।] এর জবাবে বলতে হয় যে , আমরা সৃষ্টিকর্তার ভবিষ্যৎ জ্ঞানের স্বরূপ অবগত নই। অতএব , সে যুক্তিতে আমরা আমাদের অনুভূত স্বাধীনতাকে অস্বীকার করতে পারি না।

আমরা সৃষ্টিকর্তার জ্ঞানের স্বরূপ অনুধাবনে অক্ষম , তবে এর কয়েকটি দিক আমাদের বিচারবুদ্ধির নিকট অকাট্যভাবে প্রতিভাত। যেহেতু সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকার্যক্রম মানে হচ্ছে তাঁর ইচ্ছার বাস্তবায়ন এবং তিনি যা ইচ্ছা করেন তা সংশ্লিষ্ট স্থান , কাল , পাত্রপাত্রী , অবস্থা , কারণ ও প্রক্রিয়া সহ অনিবার্য হয়ে যায় , সেহেতু তিনি যদি সমগ্র ভবিষ্যত কে একবারে ইচ্ছা করেন তাহলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটা অনিবার্য হয়ে যায়। তাহলে অতঃপর আর তাঁর কিছুই করার থাকে না এবং তাঁর অন্য সমস্ত গুণ প্রয়োগ হারিয়ে ফেলে। কারণ , তিনি যা ইচ্ছা করে রেখেছেন তার বাইরে নতুন কিছুই তিনি করবেন না। কিন্তু বিচারবুদ্ধি সৃষ্টিকর্তার সীমাহীন সৃষ্টিক্ষমতার ও সীমাহীন মাত্রার অন্যান্য গুণের প্রয়োগ হারিয়ে ফেলার ধারণা গ্রহণ করে না। কারণ , তা তাঁর এ সব গুণ ও ক্ষমতার ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করে। অতএব , সৃষ্টিক্ষমতা সহ তাঁর সকল গুণের অনবরত কার্যকরিতা অনস্বীকার্য বিষয়। এমতাবস্থায় এমন অসংখ্য ক্ষেত্র থাকতে হবে যে বিষয়ে তিনি ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোনো ধরনেরই ইচ্ছা করেন নি , যে সব ক্ষেত্র ভবিষ্যতে তাঁর ইচ্ছা করা বা না-করার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। এই ক্ষেত্রসমূহেরই একটি হতে পারে সৃষ্টির স্বাধীনতার আওতাভুক্ত ভবিষ্যৎ ক্ষেত্র। অর্থাৎ কতক ক্ষেত্রে সৃষ্টি ভবিষ্যতে কী করবে সে ব্যাপারে স্রষ্টা কোনো কিছু ইচ্ছা করা থেকে বা সেদিকে মনোযোগ (توجه ) প্রদান করা থেকে বিরত থাকতে পারেন। কারণ , তিনি সেদিকে মনোযোগ প্রদান করলে তিনি যেভাবে মনোযোগ প্রদান করবেন সেভাবে তা ঘটা অনিবার্য হয়ে যাবে। বলা বাহুল্য যে , সমগ্র ভবিষ্যতের প্রতি মনোযোগ প্রদান করতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও তিনি এভাবে কতক ক্ষেত্রকে মনোযোগের বাইরে রাখতে এবং সৃষ্টির জন্য স্বাধীনতার একটি ক্ষেত্র নিশ্চিত করতে পুরোপুরি সক্ষম।

দ্বিতীয়তঃ সৃষ্টিকর্তা যেমন কতক বিষয় সরাসরি বা কারণ ও ফলশ্রুতি বিধির দ্বারা স্থির করে দিয়েছেন তেমনি কতক বিষয় স্থির করে না দিয়ে শর্তাধীন করে দিতে পারেন , যেমন: অমুক ব্যক্তি এ কাজ করলে ফল এই হবে এবং তা না করলে বা তার পরিবর্তে অমুক কাজ করলে ফল ঐ রকম হবে। অতঃপর ব্যক্তি স্বাধীন ইচ্ছা দ্বারা যা করবে তার ফলটি অকাট্য হয়ে যাবে এবং তার বিকল্প সম্ভাবনাটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কারণ , সম্ভব অস্তিত্ব (সৃষ্টি ও কাজ উভয়ই) অস্তিত্বলাভ করার ক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে এই যে , তা অস্তিত্বলাভের পূর্ণ কারণ ঘটলে তার অস্তিত্বলাভ অনিবার্য হয়ে যায় এবং পূর্ণ কারণ না ঘটা পর্যন্ত তার অস্তিত্বলাভ অসম্ভব থাকে। এরূপ শর্তাধীন স্থিরকরণ সৃষ্টিকর্তার সৃজনক্ষমতার বৈচিত্র্যেরই পরিচায়ক।

তৃতীয়তঃ ক্ষেত্রবিশেষে স্বাধীন সৃষ্টির অতীত কার্যকলাপ ও প্রাকৃতিক বিধিবিধানের দ্বারা তার ভবিষ্যৎ এমনভাবেও নির্ধারিত হয়ে যেতে পারে যে , সে ক্ষেত্রে দ্বৈত সম্ভাবনার সুযোগ না-ও থাকতে পারে। অর্থাৎ সৃষ্টি আগে যে স্বাধীনতার অধিকারী ছিলো তা বিলুপ্ত বা সঙ্কুচিত হয়ে যেতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে স্রষ্টা নিশ্চিত জানেন যে , ঐ ব্যক্তি এ কাজ করবে ও তার ফল এরূপ হবে ; এর অন্যথা হবে না। কিন্তু স্রষ্টার এ ভবিষ্যৎজ্ঞানের কারণে এ কথা বলা চলে না যে , স্রষ্টা তাকে এ কাজে বাধ্য করেছেন। একজন শিক্ষক যদি একজন ছাত্র সম্পর্কে নিশ্চিত জানেন যে , সে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হবে , তো এ কারণে বলা চলে না যে , শিক্ষকের ঐ ছাত্র সংক্রান্ত ভবিষ্যৎজ্ঞানের কারণেই এ ছাত্রটি অকৃতকার্য হয়েছে।

অবশ্য আগেও যেমন বলা হয়েছে , মানুষের এ স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ নয়। প্রাকৃতিক বিধিবিধানের কথা বাদ দিলেও পারিবারিক , সামাজিক , সাংস্কৃতিক ও মানব-জাত অন্যান্য কার্যকারণ তার এ স্বাধীনতাকে সীমিত করে ফেলে , কিন্তু তার স্বাধীনতাকে পুরোপুরি হরণ করতে পারে না। শেষ পর্যন্ত তার জন্য স্বাধীনতার ক্ষেত্র কমবেশী থেকেই যায়। এমনকি মানুষ যখন অনন্যোপায় হয়ে আত্মহত্যা করে তখনো কার্যতঃ সে তার স্বাধীন এ্খতিয়ারকেই কাজে লাগায়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে , মানুষের স্বাধীনতার নিয়ন্ত্রণ কি কেবল প্রাকৃতিক ও মানব-জাত কার্যকারণের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে ? এখানে পরম জ্ঞানী স্রষ্টার কি করণীয় কিছু নেই ? অন্য কথায় , তিনি কি সৃষ্টির কার্যক্রমে আদৌ হস্তক্ষেপ করবেন না ? বিচারবুদ্ধি এ ব্যাপারে কী বলে ?

বস্তুতঃ স্বাধীনতা হচ্ছে পরম পূর্ণতার অধিকারী অপরিহার্য সত্তার বৈশিষ্ট্য। সেই স্বাধীনতা তিনি তাঁর সসীম অপূর্ণ সৃষ্টি মানুষকে প্রদান করেছেন। যদিও এ স্বাধীনতা ব্যবহারের জন্য মানুষকে বিচারবুদ্ধি দেয়া হয়েছে , তথাপি দুর্বল ও অপূর্ণ হবার কারণেই এ স্বাধীনতা ব্যবহার করতে গিয়ে তার ভুল হবার আশঙ্কা থেকেই যায়। তাই বিচারবুদ্ধির দাবী হচ্ছে , ক্ষেত্রবিশেষে , বিশেষ করে সমগ্র সৃষ্টিলোক বা মানবপ্রজাতির স্বার্থে অপরিহার্য হলে , তেমনি মানুষ তাঁর কাছে সাহায্য চাইলে ও তাঁর বিবেচনায় সে সাহায্য পাওয়ার উপযুক্ত হলে তিনি সৃষ্টির স্বাধীন কর্মক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করবেন। (তবে এটা করা তাঁর জন্য অপরিহার্য গণ্য করা যায় না এবং সর্বাবস্থায়ই তিনি হস্তক্ষেপ বা সাহায্য করবেন এটাও ভাবা যায় না। কারণ , তাহলে সৃষ্টির স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে।)

বিষয়টি কয়েকটি উপমার সাহায্যে সহজে বুঝা যেতে পারে।

প্রথম উপমা: একজন পিতা তাঁর শিশু সন্তানকে খেলার জন্য একটি বল দিলেন , সাথে সাথে তিনি তাকে নদীর কিনারে গিয়ে খেলতে নিষেধ করলেন। কিন্তু শিশুটি নদীর কিনারে গিয়ে খেলতে লাগলো। কারণ , তার পিতা তাকে নদীর কিনারে গিয়ে খেলতে নিষেধ করলেও তার সেখানে যাওয়া ও খেলার পথ রুদ্ধ করেন নি ; ধরুন , পিতা তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে পারতেন , কিন্তু তিনি তা করেন নি। এমতাবস্থায় খেলার সময় শিশুটির বলটি ছিটকে নদীতে পড়ে গেলো। এখন পিতা কী করবেন ? এ অবস্থায় শিশুটি পিতাকে বলটি তুলে দিতে বলতে পারে , বা না-ও বলতে পারে। উভয় অবস্থায়ই পিতা চাইলে বলটি তুলে দিতে পারেন , বা তা তুলে আনার আগেই অনেক দূরে চলে যাওয়ায় তিনি তাকে আরেকটি নতুন বল কিনে দিতে পারেন ও আগেকার ঘটনার পুনরাবৃত্তির ব্যাপারে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিতে পারেন। অবশ্য তিনি চাইলে কোনো কারণে বলটি তুলে দেয়ার চেষ্টা না-ও করতে পারেন বা নতুন বল কিনে দেয়া থেকেও বিরত থাকতে পারেন। তবে সাধারণতঃ তিনি প্রথম বারের ক্ষেত্রে বা শিশুর বয়স ও আরো কিছু বিষয় বিবেচনা করে বলটি তুলে দেন বা নতুন একটি বল কিনে দেন।

অথবা ধরুন , একটি বাড়ীর চতুর্দিকে পানিভর্তি গভীর খাদ ; পিতা শিশুকে খাদে নামতে , এমনকি তার কাছে যেতেও নিষেধ করলেন , বললেন: খাদে নামলে বা তাতে পড়ে গেলে ডুবে মরবে। কিন্তু শিশু শিশু হওয়ার কারণেই পিতার কথার গুরুত্ব বুঝলো না এবং খেলতে খেলতে খাদের কিনারে গিয়ে অসাবধানতাবশতঃ বা পা পিছলে তাতে পড়ে গেলো অথবা কৌতুহলবশে তাতে নেমে গেলো এবং ফলে সে পানিতে ডুবে গেলো। এ অবস্থায় পিতা খাদে নেমে তাকে তুলে আনলেন , ফলে সে বেঁচে গেলো , কিন্তু নাকে , কানে ও পেটে দুর্গন্ধযুক্ত পচা পানি ঢুকে যাওয়ায় সে শুধু তাৎক্ষণিক কষ্ট আর ভোগান্তির শিকারই হলো না , বরং অসুস্থ হয়ে পড়লো।

আবার এমনও হতে পারে যে , খাদটি এতোই গভীর ছিলো যে , তার তলদেশ থেকে তুলে আনতে আনতে সে মারা গেলো। হতে পারে যে , খাদটি খুব বেশী গভীর না হলেও খাদের পানি খুব বেশী দূষিত থাকায় ঐ বিষাক্ত পানি পেটে যাবার কারণেই সে মারা গেলো অথবা মারা না গেলেও সে কঠিন রোগে আক্রান্ত হলো এবং তার জীবনীশক্তি হ্রাস পেলো।

ক্ষেত্রবিশেষে খাদের মধ্যে কাঁটা বা ভাঙ্গা কাঁচ থাকতে পারে যার ফলে সে মারাত্মকভাবে আহত হতে পারে এবং বেঁচে গেলেও বিকলাঙ্গ হয়ে যেতে পারে। অবশ্য সে কষ্ট ও ভোগান্তির শিকার বা অসুস্থ বা বিকলাঙ্গ হওয়ায় অথবা মারা যাওয়ায় এ ঘটনাটা অন্য শিশুদের জন্য শিক্ষণীয় হলো।

আবার এমনও হতে পারে যে , শিশুটি এক পা খাদে ফেলতে উদ্যত হওয়ার সাথে সাথেই , অথবা এমনকি খাদের কিনারে যেতেই বাবা তাকে ধরে ফেললো ও সেখান থেকে দূরে সরিয়ে আনলো এবং এভাবে ধরে নিয়ে আসার কাজটা প্রহারসমেতও হতে পারে যাতে সে ভবিষ্যতে এ কাজের পুনরাবৃত্তি করা থেকে বিরত থাকে।

অথবা মনে করুন , কোনো জাহাযের সারেং যাত্রীদেরকে ডেকের কিনারে যেতে নিষেধ করলেন এবং বলে দিলেন যে , পানিতে হাঙ্গর ও কুমীর আছে। কিন্তু কতক যাত্রী তাঁর কথা শুনলো না। তারা ডেকের কিনারে গিয়ে দাঁড়ালো এবং তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ পানিতে পড়ে গেলো , আর ডুবুরী নেমে উদ্ধার করার আগেই তাদেরকে কুমীর এসে টেনে নিয়ে গেলো বা হাঙ্গর এসে ছিন্নভিন্ন করে ফেললো।

অথবা সাঁতার জানা এক ব্যক্তি প্রয়োজনের তাগিদে সাঁতরে নদী পাড়ি দিলো , কিন্তু কিনার থেকে পাঁচ , সাত বা দশ হাত দূরে পৌঁছতেই সাঁতরাবার শক্তি হারিয়ে ফেললো। তখন সে সাহায্য চাইতে বা না চাইতেই কিনারে থাকা লোকদের মধ্য থেকে কেউ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে তীরে তুলে আনলো। কিন্তু অপর এক ব্যক্তি ভালো সাঁতার না জানা সত্ত্বেও অন্যদের নিষেধ উপেক্ষা করে অহঙ্কার অথবা বোকামি বশতঃ এক মাইল প্রশস্ত নদী পাড়ি দিতে গিয়ে সিকি বা অর্ধ বা পৌনে এক মাইল পৌঁছার পর সাঁতরাবার শক্তি হারিয়ে ফেললো এবং লোকদের কাছে সাহায্য চাইলো , কিন্তু কেউ তাকে সাহায্য করতে গেলো না , কারণ , সে অন্যদের সদুপদেশ না শুনে নিজের জন্য বিপদ ডেকে এনেছে। তাই কেউ তাকে সাহায্যের হক্বদার মনে করে নি , অথবা সাহায্য পৌঁছার আগেই তার মারা যাওয়া নিশ্চিত জেনে তাকে উদ্ধারের চেষ্টা অর্থহীন মনে করে তারা তাকে উদ্ধারের চেষ্টা থেকে বিরত থাকলো। অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষে তার কাছাকাছি কোনো নৌকা বা স্পীড-বোট থাকলে তিরস্কার করেও তাকে দয়া দেখাতে পারে। তেমনি সে যদি নদীর তীরের খুবই কাছাকাছি এসে যায় , ধরুন বিশ গজের মধ্যে এসে যায় , সে ক্ষেত্রে তার হঠকারিতা বা বোকামির জন্য তিরস্কার করলেও কেউ দয়া করে তাকে তীরে তুলে আনতে পারে।

অবশ্য মানুষের আচরণে আমরা দেখতে পাই যে , অন্যদের পক্ষ থেকে উচ্চারিত সতর্কবাণী ও কৃত কল্যাণকামনা উপেক্ষা করে অথবা নির্বুদ্ধিতাবশতঃ যারা নিজেদেরকে বিপদে নিক্ষেপ করে তাদের সকলের ক্ষেত্রে বা একই ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রতি বারই কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে না। কারণ , সে ক্ষেত্রে সতর্কবাণী ও কল্যাণকামনা উপেক্ষা করে নিজেকে বিপদে নিক্ষেপ করতে কেউই দ্বিধা করতো না এবং এর ফলে সতর্কবাণী ও কল্যাণকামনা অর্থহীন হয়ে যেতো। অবশ্য সাহায্য চেয়ে ফরিয়াদ করলে সাহায্য লাভের সম্ভাবনা বেশী থাকে , তবে তা-ও নিশ্চিত নয়।

মোদ্দা কথা , সৃষ্টিকর্তা তাঁর এ দুর্বল সৃষ্টিকে স্বাধীনতা দেয়ার পর নিরঙ্কুশভাবে তার নিজের ওপর ছেড়ে দেবেন এবং তার প্রতি দৃষ্টি রাখবেন না ও তার কাজে ইতিবাচক হস্তক্ষেপ করবেন না - বিচারবুদ্ধি এটা মানতে পারে না। বিশেষ করে মানবপ্রকৃতি তার নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কঠিন সঙ্কটময় মুহূর্তে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে সৃষ্টিকর্তার নিকট আশ্রয় ও সাহায্য কামনা করে। এমতাবস্থায় তার প্রত্যাশা ও প্রার্থনা যদি অন্যায় , অযৌক্তিক বা অবাস্তব না হয় তাহলে সৃষ্টিকর্তা তাকে সাহায্য করবেন এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে সর্বাবস্থায়ই তিনি তাকে সাহায্য করবেন বা তার এক্তিয়ারাধীন কাজে হস্তক্ষেপ করবেনই এমনটি মনে করাও ঠিক হবে না। কারণ , তিনি সাহায্য বা হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য নন। তিনি যদি সাহায্য বা হস্তক্ষেপ করেন , তো সেটা সৃষ্টির অধিকার নয় , বরং তাঁর অনুগ্রহ।

অন্যদিকে কোনো মানুষের বা কোনো মানবগোষ্ঠীর স্বাধীনতার অপব্যবহারমূলক নেতিবাচক পদক্ষেপের উদ্যোগ যদি সমগ্র সৃষ্টিলোক বা পৃথিবী বা মানবপ্রজাতির জন্য এমনই ধ্বংসাত্মক হয় যার ফলে সৃষ্টির লক্ষ্য ব্যর্থ হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে , সে ক্ষেত্রে বিচারবুদ্ধির দাবী এটাই যে , সৃষ্টিকর্তা সেখানে হস্তক্ষেপ করবেন এবং ধ্বংসকামী ঐ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নেতিবাচক উদ্যোগকে বানচাল করে দেবেন।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে , যেহেতু সৃষ্টিকর্তা ইতিবাচক , সেহেতু সৃষ্টির কাজে তাঁর হস্তক্ষেপও সর্বাবস্থায়ই ইতিবাচক হবে , কখনোই নেতিবাচক হবে না - এটাই বিচারবুদ্ধির দাবী। অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষে সৃষ্টিকর্তার কোনো কোনো হস্তক্ষেপ আপতঃদৃষ্টিতে নেতিবাচক বলে মনে হতে পারে , কিন্তু পিতা কর্তৃক তার দুষ্ট শিশুকে প্রহার করার ন্যায় অথবা চিকিৎসক কর্তৃক কারো শরীরের পচনধরা অঙ্গ কেটে ফেলার ন্যায় উদ্দেশ্য ও পরিণামফলের বিচারে তাঁর সে দৃশ্যতঃ নেতিবাচক হস্তক্ষেপ অবশ্যই ইতিবাচক।

ত্রিত্ববাদী ধারণা

অপরিহার্য সত্তা সম্পর্কে অংশীবাদীদের আরেকটি ধারণা হচ্ছে পিতা , পুত্র ও আত্মা সংক্রান্ত ধারণা। বিচারবুদ্ধির বিচারে এ ধারণাটি সর্বাধিক দুর্বল। কারণ , কখনো বলা হয় যে , পবিত্র পিতা , পবিত্র পুত্র ও পবিত্র আত্মা স্বতন্ত্র , আবার কখনো বলা হয় অভিন্ন। কখনো তিনকে সমপর্যায়ভুক্ত গণ্য করা হয় , কখনোবা অপর দু জনকে পবিত্র পিতার সৃষ্টিরূপে গণ্য করা হয়।

বস্তুতঃ এ মতটি একটি গোলকধাঁধা সৃষ্টিকারী কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধ বিশ্বাসের ওপর ভিত্তিশীল , কোনোরূপ প্রকৃত দার্শনিকতার ওপর ভিত্তিশীল নয়। কারণ , অপরিহার্য সত্তাকে অনিবার্যভাবেই সত্তা ও গুণের দিক থেকে অভিন্ন ও অবিভাজ্য হতে হবে। অন্যথায় সে হবে অসম্পূর্ণ ও নির্ভরশীল সত্তা। এমনকি তাকে বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করে চিন্তা করলে সে ক্ষেত্রে সে তার অংশসমূহের ওপর এবং তার অংশসমূহ পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল হবে। এরূপ নির্ভরশীল সত্তা অপরিহার্য সত্তা হতে পারে না। অতএব , তিনে এক এবং এক তিন হতে পারে না। আর পবিত্র পুত্র ও পবিত্র আত্মা যদি পবিত্র পিতার সৃষ্টি হয়ে থাকে তো সে ক্ষেত্রে এতদুভয় হবে সম্ভব সত্তা। আর সম্ভব সত্তা অপরিহার্য সত্তা নয়।

অপরিহার্য সত্তা সকল প্রকার অপূর্ণতা ও অভাব-অভিযোগ থেকে মুক্ত। অতএব , তিনি সন্তান , স্ত্রী ও পরিবারের প্রয়োজনীয়তা থেকে মুক্ত। বিশেষ করে কোনো সম্ভব সত্তাকে তাঁর পক্ষে পুত্র হিসেবে পরিগ্রহণ করা সম্ভব নয়।

মানুষের মধ্যে যে সন্তান লাভের সহজাত আকাঙ্ক্ষা বিদ্যমান তার জন্য দায়ী তার বিভিন্ন ধরনের অপূর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা। সন্তানের মাধ্যমে তার এ অপূর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা আংশিক হলেও পূরণ হয় এবং এ কারণেই সে সন্তানের প্রয়োজন অনুভব করে। যেহেতু পরম প্রমুক্ত ও সকল পূর্ণতার পূর্ণ মাত্রায় অধিকারী অপরিহার্য সত্তার কোনোরূপ অপূর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা নেই সেহেতু তিনি সন্তান জন্মদানের বা পরিগ্রহণের প্রবণতা থেকে মুক্ত হতে বাধ্য।

অন্যদিকে যে কোনো প্রজাতির সন্তান সমপ্রজাতির হয়ে থাকে। সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যকার ব্যবধান দুই প্রজাতির মধ্যকার ব্যবধানের তুলনায় কোটি কোটি গুণ বেশী। কোনো মানুষ যদি একটি প্রস্তরকণা বা একটি মৃত পোকাকে হাতে তুলে নেয় এবং বলে যে , আমি এটাকে পুত্ররূপে পরিগ্রহণ করলাম , তাহলে তা যতোখানি পাগলামি হবে , অপরিহার্য সত্তা সর্বস্রষ্টা কর্তৃক কোনো সৃষ্টিকে - তা সে সৃষ্টি যতো উন্নত মানের ও যতখানি পূর্ণতার অধিকারীই হোক না কেন - পুত্ররূপে পরিগ্রহণের ধারণা পোষণ মানে তাঁর ওপর এর চেয়ে কোটি কোটি গুণে বেশী মাত্রার পাগলামি আরোপ বৈ নয়।

আর পুত্রকে যদি সৃষ্টিসত্তা গণ্য না করে অপরিহার্য সত্তারূপে গণ্য করা হয় সে ক্ষেত্রে তা এক অপ্রকৃত ও অসম্ভব দাবী বৈ নয়। কারণ , অপরিহার্য সত্তা সকল প্রকার পূর্ণতাবাচক গুণের পূর্ণতম মাত্রার অধিকারী হতে বাধ্য। অতএব , এরূপ সত্তা একাধিক হতে পারে না। এমনকি তর্কের খাতিরে যদি একাধিক হওয়াকে সম্ভবও গণ্য করা হয় , তো সে ক্ষেত্রে সমমর্যাদাসম্পন্ন দুই অপরিহার্য সত্তার একজনকে পিতা ও অপর জনকে পুত্র গণ্য করা যেতে পারে না। কারণ , একজনকে পিতা ও অপর জনকে পুত্র গণ্য করার পর আর তাদের সমমর্যাদা থাকে না। এমতাবস্থায় যার মর্যাদা হ্রাস পায় (পুত্র) তাকে অপরিহার্য সত্তারূপে গণ্য করা চলে না।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে , কোনো সৃষ্টির ব্যতিক্রমধর্মী সৃষ্টি ও গুণবৈশিষ্ট্যের কারণেও তাকে অপরিহার্য সত্তার সন্তান রূপে গণ্য করা যেতে পারে না। বস্তুতঃ মানুষের কাছে যা বিস্ময়কর ও ব্যতিক্রমধর্মী , সর্বশক্তিমান অপরিহার্য সত্তার কাছে তা একটি অতি সাধারণ ব্যাপার মাত্র। অবশ্য তিনি কোনো নিয়মকে সৃষ্টিলোকে কতটা কার্যকর রাখবেন তা তাঁর ইচ্ছার ব্যাপার। যদি বিস্ময়কর কিছু থেকে থাকে তো সে বিস্ময় শুধু পিতা বা মাতা বিহনে কোনো মানুষকে সৃষ্টি করা নয় , বরং পিতা-মাতা উভয় বিহনে প্রথম মানুষের সৃষ্টি। বরং এর চেয়েও বিস্ময়কর হচ্ছে শূন্য থেকে এ সৃষ্টিকর্মের সূচনাকরণ বা সৃষ্টিলোকের আদি উপকরণাদির সৃষ্টিকরণ।

বর্তমানে বস্তুবিজ্ঞানীরা যে স্টিফেন হকিং - এর মত গ্রহণ করে নিয়ে বলছেন যে , একটি আদি কণিকা ( primary particle)থেকে গোটা বিশ্বজগত সৃষ্টি হয়েছে , যদি সে ধারণাই সঠিক হয়ে থাকে তো বিবর্তনপ্রক্রিয়ায় সমগ্র বস্তুজগত এবং বিবর্তন ও বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার সমন্বয়ে প্রাণীজগতের সৃষ্টির চেয়েও কোটি কোটি গুণে বিস্ময়কর হচ্ছে শূন্য থেকে সেই আদি কণিকার সৃষ্টি। অতএব , কোনো মানুষের জন্ম বিস্ময়কর হলেই তাকে ঈশ্বরের পুত্র মনে করার যৌক্তিকতা নেই।

এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ করতে হয় যে , সাম্প্রতিককালে আবিষ্কৃত ক্লোনিং পদ্ধতি পিতা ছাড়া শুধু মাতা থেকে সন্তান জন্মদানের সম্ভাবনা প্রমাণিত করেছে। এমতাবস্থায় পিতা ছাড়া শুধু মাতা থেকে জন্মগ্রহণের সাথে ঐশ্বরিকতার অধিকারী হওয়ার কোনোই সম্পর্ক নেই।

কোরআন মজীদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মুসলমানদের কাছে হযরত ঈসা (আঃ)-এর পিতাবিহীন জন্ম ও তাঁর মাতার চারিত্রিক পবিত্রতা একটি বিতর্কাতীত বিষয়। কোরআন মজীদের বর্ণনা অনুযায়ী আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন ফেরেশতা এসে হযরত মারইয়াম (আঃ)কে তাঁর গর্ভে একজন নেককার সন্তান জন্মগ্রহণের ঐশী সিদ্ধান্তের সুসংবাদ প্রদান করেন।

সর্বশক্তিমান স্রষ্টা ক্লোনিং বা ফেরেশতার মুখাপেক্ষী নন। তিনি যা চান তা-ই করতে পারেন এবং যেভাবে চান সেভাবেই করতে পারেন। তাই মুসলমানদের কাছে এই প্রক্রিয়াগত বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হওয়া বা না হওয়ায় কিছু আসে যায় না। সর্বাবস্থায়ই তাদের কাছে হযরত ঈসা (আঃ)-এর পিতা ব্যতীতই নিষ্পাপ মাতার গর্ভে জন্মগ্রহণের বিষয়টি অকাট্য সত্য। কিন্তু এ ধরনের ব্যতিক্রমী জন্মের কারণে তাঁকে খোদার পুত্র গণ্য করার যৌক্তিকতা নেই। কারণ , একই সূত্র (কোরআন মজীদ) তাঁকে মানুষ , আল্লাহর বান্দাহ্ (দাস) ও আল্লাহর নবী বলে জানিয়েছে।

অবশ্য কোরআন মজীদের ভাষ্য অনুযায়ী তৎকালীন বনি ইসরাঈলের নিকটও প্রকৃত সত্য অজানা ছিলো না। কারণ , হযরত ঈসা (আঃ) জন্মের পর মাতৃক্রোড়ে থেকেই কথা বলেন এবং নিজেকে আল্লাহর নবী বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু এ ব্যাপারে কোরআন মজীদ ছাড়া আর কোনো প্রমাণ্য দলীল নেই। ইয়াহূদীরা জেনেশুনে স্বেচ্ছায় সত্য গোপন করেছে এবং হযরত ঈসা (আঃ)-এর জন্ম সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে। এ অপবাদ খণ্ডনের ক্ষেত্রে ইনজীলের বর্তমান সংস্করণসমূহ থেকে কোনোভাবে উপকৃত হওয়া সম্ভব নয়। কারণ , বর্তমানে ইনজীল নামে যা চালু আছে তা হচ্ছে প্রকৃত ইনজীলের (আংশিক) বাণী , হযরত ঈসা (আঃ)-এর কথা ও জীবনকাহিনী এবং সংশ্লিষ্ট লেখকদের বক্তব্যের সংমিশ্রণ। কেউ যদি রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর জীবনীগ্রন্থ রচনা করেন এবং তাতে তাঁর কিছু কথা (হাদীছে ক্বাওলী) ও কোরআন মজীদের কতক আয়াত উদ্ধৃত করেন , যেমন: যদি বলেন যে , এ ঘটনা প্রসঙ্গে আয়াত নাযিল হলো যে , ... , তাহলে কেবল ঐ গ্রন্থের সাথেই বর্তমানে প্রচলিত ইনজীলের বাকবিন্যাসের বা রচনারীতির তুলনা করা চলে। তদুপরি ইনজীলের রয়েছে ডজন ডজন সংস্করণ যা প্রমাণ করে যে , এ গ্রন্থ তার মূল রূপে বিদ্যমান নেই , বরং বিকৃত হয়ে গেছে।

এতদসত্ত্বেও প্রচলিত ইনজীলকে তর্কের খাতিরে প্রামাণ্য বলে ধরে নিলেও তা ইয়াহূদীদের দেয়া অপবাদ খণ্ডনের ক্ষেত্রে তা কাজে আসবে না। কারণ , প্রথমে প্রমাণ করতে হবে যে , হযরত ঈসা (আঃ) নবী ছিলেন। কেবল এর পরই তাঁর ওপর নাযিলকৃত আসমানী কিতাব ইনজীল (যদি প্রমাণ করা যায় যে , তা অবিকৃতভাবে বর্তমান আছে) দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে। যে ব্যক্তিকে হযরত ঈসা (আঃ)-এর নবুওয়াত (খৃস্টানদের দাবী অনুযায়ী খোদার পুত্র হওয়ার বিষয়টি) মেনে নেয়ার জন্য দাও আত দেয়া হবে তার কাছে পূর্ব থেকেই ইনজীলের কোনো মূল্য থাকতে পারে না। তার কাছে ইনজীলের মূল্য হবে হযরত ঈসা (আঃ)কে নবী হিসেবে গণ্য করার পর।

অতএব , হযরত ঈসা (আঃ)-এর প্রতি কাউকে দাও আত দিতে হলে তা দিতে হবে বিচারবুদ্ধির ভিত্তিতে। এ ক্ষেত্রে তাঁর প্রতি দাও আত দেয়ার জন্য কোরআন মজীদই হচ্ছে একমাত্র দলীল। কিন্তু যারা কোরআন মজীদকে ঐশী কিতাব হিসেবে জানে না তাদের পক্ষে হযরত ঈসা (আঃ) সম্পর্কে কোরআন মজীদের দলীল থেকে সাহায্য গ্রহণ করা সম্ভব নয়। সুতরাং যারা কোরআন মজীদের ঐশিতা সম্বন্ধে নিশ্চিত নয় তাদের কাছে হযরত ঈসা (আঃ)-এর খোদার পুত্র অথবা নবী বলে পরিগণিত হওয়া তো দূরের কথা , তাঁর জন্মের বিষয়টিই সংশয়াচ্ছন্নরূপে গণ্য হতে বাধ্য। এমতাবস্থায় এহেন ব্যক্তিকে খোদার পুত্র বলে দাবী করা কেবল বিচারবুদ্ধি বর্জনকারী কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধ দাবীদারদের পক্ষেই সম্ভব।

দেবদেবীদের ঈশ্বরের কর্মগত অংশীদার হওয়ার ধারণা

অংশীবাদী ধ্যানধারণাসমূহের মধ্যে সব শেষে যেটির ওপর আলোকপাত করতে হয় তা হচ্ছে , দেব-দেবীরা সত্তাগতভাবে ঈশ্বরের অংশীদার নয় , বরং কর্মগত দিক থেকে তাঁর অংশীদার ; তারা ঈশ্বরের বিশেষ ধরনের উন্নততম সৃষ্টি এবং স্বয়ং ঈশ্বরের পক্ষ থেকে তাদের ওপর সৃষ্টিকর্ম ও সৃষ্টিলোকের পরিচালনার বিভিন্ন দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বলতে হয় যে , অপরিহার্য সত্তা যদি একটি বিশেষ ধরনের বা প্রজাতির সৃষ্টিকে সৃষ্টি করেন এবং তাদের মাধ্যমে অন্যান্য সৃষ্টিকে সৃষ্টি করতে ও সৃষ্টিজগতের পরিচালনা ব্যবস্থা চালাতে চান , তাতে আপত্তির কিছু নেই ; এটা তিনি করতেই পারেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রে কথিত সৃষ্টি সর্বশক্তিমান অপরিহার্য সত্তার ইচ্ছার বাইরে চলার স্বাধীনতা পাবে - এটা সম্ভব নয়। এরূপ সৃষ্টি সৃষ্টিকর্তার পূর্ণ অনুগত ও সুশৃঙ্খল হতে বাধ্য। এমতাবস্থায় তারা স্বাধীন এক্তিয়ার সম্পন্ন মানুষের চেয়ে উন্নততর হতে পারে না। অতএব , মানুষ তাদের কাছে নত হতে বা তাদের উপাসনা করতে পারে না।

আমরা যদি মেনে নেই যে , সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে সৃষ্টিলোকের কাজকর্ম পরিচালনার জন্য এ ধরনের কোনো বিশেষ সৃষ্টির ওপরে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে তাহলেও , এমনকি অপরিহার্য সত্তার সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও মানুষের জন্য তাদের কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণ করা অপরিহার্য নয়। কারণ , অপরিহার্য সত্তা অনিবার্যভাবেই সকল স্থান ও কালকে আয়ত্ত করে আছেন। অতএব , তিনি সর্বত্র ও সর্বদা বিরাজমান এবং প্রতিটি সৃষ্টিরই নিকটতম অবস্থানে অবস্থান করছেন। কোনো সময় ও কোনো স্থানই তাঁর অস্তিত্ব থেকে শূন্য নয়। অন্য কথায় বলা যেতে পারে যে , গোটা সৃষ্টিলোক তাঁর ইচ্ছাশক্তিতেই অবস্থান করছে , কারণ , ইতিপূর্বেই আমরা প্রমাণ করেছি যে , সৃষ্টিকুল কেবল তাদের অস্তিত্বলাভের জন্যই অপরিহার্য সত্তার ওপর নির্ভরশীল নয় , বরং তাদের স্থিতি বা টিকে থাকার জন্যও প্রতি মুহূর্তেই তাঁর ওপর নির্ভরশীল। অতএব , তাঁর ও সৃষ্টির মধ্যে কোনোরূপ স্থানিক ও কালিক দূরত্ব নেই। সৃতরাং মানুষের আবেদন-নিবেদন তাঁর কাছে পেশ করা অন্য যে কারো কাছে পেশ করার চেয়ে সহজতর। এমতাবস্থায় , সৃষ্টিকর্তার সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার জন্য অন্য কোনো সৃষ্টির নিকট (এবং সম্ভবতঃ তার নিজের চেয়ে নিমড়বতর সৃষ্টির নিকট) মাথা নত করা নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক বৈ নয়।

কোনো মহাবিজ্ঞানী ও মহাশক্তিধর সম্রাটের কোনো প্রজা যদি তাঁর দরবারে গিয়ে তাঁর সামনে হাযির থেকে তাঁকে কুর্নিশ করা ও তাঁর কাছে আবেদন পেশের পরিবর্তে তাঁর দিকে পিঠ দিয়ে , সেখানে ঘুরে বেড়ানো কোনো কম্পিউটার-চালিত রোবটকে কুর্নিশ করে তার প্রশংসাগীতি গাইতে শুরু করে , সে ক্ষেত্রে তাকে ঐ রোবট তো কোনো উপকার করতে পারবেই না , বরং এতে সম্রাটের ক্রোধের উদ্রেক হওয়া এবং লোকটিকে দরবার থেকে বের করে দেয়ার জন্য রোবটদের প্রতি নির্দেশদানের সম্ভাবনা প্রায় সুনিশ্চিত। একজন বিজ্ঞানী-সম্রাটের সাথে আচরণের ব্যাপারটা যদি এ ধরনের হয় , তো সে ক্ষেত্রে সর্বশক্তিমান অপরিহার্য সত্তার সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ ধরনের নির্বুদ্ধিতার পরিণাম অধিকতর মারাত্মক হতে বাধ্য। অতএব , দেখা যাচ্ছে , বিচারবুদ্ধি অপরিহার্য সত্তার সাথে কোনো ধরনের অংশীবাদিতাকেই সম্ভব ও সঠিক বলে গণ্য করে না। কেবল অজ্ঞতা , অন্ধত্ব ও অসচেতনতাই অপরিহার্য সত্তার নিরঙ্কুশ একত্ব প্রত্যাখ্যান ও অংশীবাদকে গ্রহণ করতে পারে।

বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে সৃষ্টি ও ব্যবস্থাপনার প্রক্রিয়া

মানবমনে চিরন্তন প্রশ্ন: সকল অস্তিত্বের উৎস মহান সৃষ্টিকর্তা পরম জ্ঞানময় অপরিহার্য সত্তা কেন সৃষ্টিকর্মের সূচনা করলেন এবং তা কীভাবে করলেন ? কীভাবে তিনি এতো সব অকল্পনীয় সূক্ষ্মতম সৃষ্টি থেকে শুরু করে অকল্পনীয় বিশাল সৃষ্টিনিচয়কে অস্তিত্ব দান করলেন এবং কীভাবে এর ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা করছেন ? বিষয়টি কি এরূপ যে , তিনি সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার সূচনা করে দিয়েছেন , অতঃপর সব কিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলছে এবং তাঁর আর কিছুই করার নেই ? নাকি এরূপ কোনো স্বয়ংক্রিয়তার স্থান নেই , বরং প্রতি মুহূর্তে প্রতিটি সৃষ্টিই তাঁর প্রত্যক্ষ ভূমিকার দ্বারা অস্তিত্ব লাভ করছে ও সামনে এগিয়ে চলছে ? বিচারবুদ্ধি এ ক্ষেত্রে আমাদেরকে কী বলে ?

সৃষ্টিকর্ম স্রষ্টাগুণের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ

প্রথমেই প্রশ্ন জাগে , তিনি কেন সৃষ্টিকর্মের সূচনা করলেন ? পরম প্রমুক্ত অপরিহার্য সত্তা তো সকল অপূর্ণতা ও সকল প্রয়োজন থেকে মুক্ত , তাহলে তিনি সৃষ্টির সূচনা করলেন কেন ?

বিচারবুদ্ধি এ ক্ষেত্রে সহজেই যে উপসংহারে উপনীত হয় তা হচ্ছে , অনস্তিত্ব যেমন নেতিবাচক , তেমনি অস্তিত্ব হচ্ছে ইতিবাচক। পরম প্রমুক্ত অপরিহার্য সত্তা সতত বিদ্যমান ও চিরন্তন অস্তিত্বের অধিকারী। অতএব , তিনি ইতিবাচকতা ও নেতিবাচকতার মধ্যবর্তী নিরপেক্ষতা -রূপ কোনো কাল্পনিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী নন। বরং তিনি ইতিবাচক , আর সৃষ্টিকর্ম সম্পাদনও একটি ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য। আর যেহেতু তিনি সকল প্রকার ইতিবাচক গুণবৈশিষ্ট্যের পূর্ণতম মাত্রার অধিকারী , সেহেতু তিনি সৃষ্টিক্ষমতারও অধিকারী। অতএব , তাঁর এ সৃষ্টিক্ষমতার ইতিবাচক বহিঃপ্রকাশ ঘটবে - এটাই তো স্বাভাবিক। তাই সৃষ্টিকর্ম তাঁর জন্য কোনো প্রয়োজন নয় , বরং তাঁর সৃষ্টিক্ষমতার স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ।

স্বতঃস্ফূর্ততা মানে স্বয়ংক্রিয়তা নয়

অপরিহার্য সত্তার সৃষ্টিকর্ম তাঁর স্রষ্টাক্ষমতার স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ , কিন্তু এই স্বতঃস্ফূর্ততা মানে স্বয়ংক্রিয়তা হতে পারে না। কারণ , সৃষ্টিলোকের অস্তিত্বলাভ ও তা অব্যাহত থাকা এবং তার এগিয়ে চলাকে স্বয়ংক্রিয় গণ্য করার মানে হচ্ছে বিষয়টি সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার তথা নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা। এরূপ ধারণা মানে কার্যতঃ তাঁর প্রতি যান্ত্রিকতা তথা প্রকারান্তরে এক ধরনের অক্ষমতা আরোপ বৈ নয়। কিন্তু তিনি যে কোনো ধরনের অক্ষমতা থেকে প্রমুক্ত। তাই বিচারবুদ্ধির রায় হচ্ছে এই যে , সৃষ্টিলোক সর্বাবস্থায়ই তাঁর ইচ্ছাশক্তির আওতাধীন।

তিনি প্রাকৃতিক বিধানের স্রষ্টা

অনেকের ধারণা হচ্ছে এই যে , পরম প্রমুক্ত সৃষ্টিকর্তা ছোট-বড় প্রতিটি সম্ভব-অস্তিত্বের সৃষ্টি , স্থিতি ও সামনে এগিয়ে চলা সম্পর্কে প্রতি মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এরূপ ধারণা তাঁর মহাবিজ্ঞানময়তার বৈশিষ্ট্যের সাথে মোটেই সামঞ্জস্যশীল নয়। কারণ , বিচারবুদ্ধি লক্ষ্য করে যে , অধিকতর মর্যাদাবান কর্তা সব কাজ নিজে করতে সক্ষম হলেও সব কিছু নিজেই করেন না। উদাহরণস্বরূপ , এক ব্যক্তি তার শারীরিক শক্তি দ্বারা কোনো কাজ সম্পাদন করে এবং অপর এক ব্যক্তি একটি যন্ত্র তৈরী করে ও তা চালানোর জন্য চালক নিয়োগ করে একই কাজ সেই যন্ত্রের সাহায্যে সম্পাদন করে। এ ক্ষেত্রে আমরা দ্বিতীয়োক্ত ব্যক্তিকে অধিকতর মর্যাদাবান কর্তা হিসেবে গণ্য করে থাকি।

সুতরাং মহাজ্ঞানময় অপরিহার্য সত্তার জন্য সামঞ্জস্যশীল হচ্ছে এটাই যে , তিনি সৃষ্টিকরণ এবং সৃষ্টির স্থিতি ও এগিয়ে চলার জন্য নিয়মাবলী বেঁধে দেবেন , আর সব কিছু তদনুযায়ী চলতে থাকবে। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতায় এ ধরনের নিয়মাবলী প্রত্যক্ষ করি যেগুলোকে আমরা প্রাকৃতিক বিধান বলে থাকি।

তিনি স্বাধীন সৃষ্টির কাজে হস্তক্ষেপ করেন

আমরা লক্ষ্য করছি যে মহাজ্ঞানময় সৃষ্টিকর্তা তাঁর সৃষ্টিকুলের জন্য অনতিক্রম্য প্রাকৃতিক নিয়মাবলীর আওতায় তাঁর কতক সৃষ্টিকে কতক ব্যাপারে স্বাধীনতা দিয়েছেন। অর্থাৎ সৃষ্টি ও তার এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে তিনি নিজে যেমন স্বয়ংক্রিয়তার উর্ধে তেমনি তিনি তাঁর সকল সৃষ্টিকে সকল ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক বিধানের শৃঙ্খলে বেঁধে স্বয়ংক্রিয়তার অধীন করে দেন নি। সেহেতু যে সব সৃষ্টিকে তিনি কতক ব্যাপারে স্বাধীনতা দিয়েছেন তারা কীভাবে এ স্বাধীনতাকে কাজে লাগায় সে ব্যাপারে তিনি দৃষ্টি রাখবেন এবং যেখানেই সৃষ্টির ব্যক্তিক বা সামষ্টিক স্বার্থে বা গোটা সৃষ্টিলোকের সৃষ্টি-উদ্দেশ্যের বাস্তবায়নের স্বার্থে হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হবে সেখানে তিনি হস্তক্ষেপ করবেন - এটাই স্বাভাবিক।

আর এটা সুস্পষ্ট যে , সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টি রাখা ও প্রয়োজনবোধে হস্তক্ষেপ তাঁর নিজের প্রয়োজনে নয় , বরং সৃষ্টিরই প্রয়োজনে। যেহেতু তিনি সৃষ্টিকে অস্তিত্বদান করেছেন সেহেতু সৃষ্টির প্রয়োজনে ইতিবাচক হস্তক্ষেপ করবেন - এটাই তাঁর সৃষ্টিক্ষমতার দাবী এবং এ দাবী পূরণে কার্পণ্য করার মতো দুর্বলতা থেকে তিনি প্রমুক্ত।

অনবরত নব নব সৃষ্টি

যেহেতু অপরিহার্য সত্তার সৃষ্টিক্ষমতা অসীম , সেহেতু কতক সৃষ্টিকে (তার সংখ্যা যত ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়নই হোক না কেন) অস্তিত্বদান বা অস্তিত্বে আনয়নের প্রক্রিয়ার সূচনা করে দেয়ার পর তিনি আরো নতুন নতুন ধরনের সৃষ্টিকে অস্তিত্বদানের প্রক্রিয়ার সূচনা করা থেকে বিরত থাকতে পারেন না। কারণ , সে ক্ষেত্রে তা হবে তাঁর স্রষ্টাক্ষমতা কার্যতঃ স্থগিত হয়ে যাওয়ার সমতুল্য। বরং তিনি সদাসর্বদাই নতুন নতুন ধরনের সৃষ্টিকে অস্তিত্বদান ও নতুন নতুন ধরনের সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার সূচনা করবেন এটাই তাঁর অসীম সৃষ্টিক্ষমতার স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশের দাবী। তবে বলা বাহুল্য যে , এটা তাঁর জন্য অনিবার্য বা অপরিহার্য হতে পারে না। বরং এটা সম্পূর্ণরূপেই তাঁর ইচ্ছাশক্তির অধীন , আর তাঁর ইচ্ছাশক্তি তাঁর ইতিবাচক গুণাবলীরই অন্যতম।

তাহলে বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে আমরা অপরিহার্য সত্তা কর্তৃক সৃষ্টি ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কয়েকটি সত্যে উপনীত হতে পারি। এ সত্যগুলো হচ্ছে:

তিনি অসীম সৃষ্টিক্ষমতার অধিকারী এবং অনবরত সৃষ্টি করে চলেছেন।

সৃষ্টিকর্ম তাঁর সৃষ্টিক্ষমতার স্বতঃস্ফূর্ত ইতিবাচক বহিঃপ্রকাশ , কিন্তু এ স্বতঃস্ফূর্ততা মানে স্বয়ংক্রিয়তা নয় এবং তিনি এরূপ সৃষ্টি ও ব্যবস্থাপনা সম্পাদনে বাধ্য নন।

তিনি সৃষ্টিসমূহের সূচনা করেছেন এবং তার স্থিতি ও অগ্রগতির জন্য নিয়মাবলী (প্রাকৃতিক বিধিবিধান) বেঁধে দিয়েছেন। সব কিছু এ নিয়মের আওতায় চলছে।

তাঁরই নির্ধারিত প্রাকৃতিক বিধিবিধানের আওতায় তিনি কতক সৃষ্টিকে কিছুটা স্বাধীনতা দিয়েছেন এবং তাদের কর্মের প্রতি সর্বদা দৃষ্টি রাখেন ও তাদেরই প্রয়োজনে অনেক সময় তাদের কাজে হস্তক্ষেপ করেন।

সৃষ্টির কাজে স্রষ্টার হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা

এখানে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অধিকারী সৃষ্টির কাজে তাদেরই প্রয়োজনে সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে হস্তক্ষেপকরণ সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা প্রয়োজন বলে মনে হয়। কারণ , প্রশ্ন উঠতে পারে যে , পরম জ্ঞানময় সৃষ্টিকর্তা তো সৃষ্টিকর্ম সম্পাদনের সিদ্ধান্ত গ্রহণকালেই তাঁর প্রতিটি সৃষ্টির অনাগত ভবিষ্যৎ প্রয়োজন সম্পর্কে জানেন এবং সে প্রয়োজন পূরণের উপযোগী করে প্রাকৃতিক বিধিবিধান প্রণয়ন করেই সৃষ্টির সূচনা করেন। এমতাবস্থায় কী করে নতুন প্রয়োজন দেখা দিতে পারে - যা পূরণের লক্ষ্যে তাঁকে সৃষ্টির কাজে হস্তক্ষেপ করতে হবে ?

বিচারবুদ্ধির সামান্য প্রয়োগ করলেই আমরা এ প্রশ্নের জবাব পেতে পারি। আমরা বিচারবুদ্ধির দ্বারা বুঝতে পারি যে , এ সৃষ্টিলোকের সৃষ্টিনিচয় গুণগতভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত। আমাদের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার আওতাধীন সৃষ্টিনিচয়ের মধ্যে কোনো কোনো সৃষ্টি প্রাকৃতিক নিয়মের কঠিন নিগড়ে বাঁধা বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয় - যা যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এগিয়ে চলেছে এবং যার কোনোরূপ স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মশক্তি নেই। কিন্তু অপর কতক সৃষ্টি স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অধিকারী। এ সব সৃষ্টির মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতার মাত্রা ও পর্যায়ের ক্ষেত্রে পারস্পরিক পার্থক্য রয়েছে।

স্রষ্টার পক্ষ থেকে তাদেরকে ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতা প্রদানের মানেই হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা তাদের ভবিষ্যতকে , সরাসরিই হোক বা প্রাকৃতিক বিধিবিধানের দ্বারাই হোক , শতকরা একশ ভাগ অপরিবর্তনীয় করে বেঁধে দেন নি এবং স্রষ্টা তাদের জন্য যা করা ও যেমনটি হওয়া পসন্দ করেন তেমনটি হওয়া ও তা করার জন্য তাদেরকে বাধ্য করেন না। তিনি তাদেরকে কতক প্রাকৃতিক বিধিবিধানের বিরুদ্ধে (যেমন: সহজাত প্রবণতার বিরুদ্ধে) বিদ্রোহ করার ক্ষমতা ও সুযোগ দিয়েছেন। এমনকি তারা চাইলে স্রষ্টার পসন্দ-অপসন্দের বিরুদ্ধাচরণ করতে পারবে ; তিনি তাদেরকে সে সুযোগও দিয়েছেন , যদিও বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে এটা সুনিশ্চিত যে , তিনি পসন্দ করেন না যে , তারা এমনটি করুক। অর্থাৎ কতক সৃষ্টিকে তিনি যে ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতা দিয়েছেন তার দাবী মিটাতে গিয়ে তিনি তাদেরকে তাঁর পসন্দনীয় কাজ সম্পাদনে ও তাঁর অপসন্দনীয় কাজ সম্পাদন থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করেন না।

বলা বাহুল্য যে , ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতার অধিকারী এই সৃষ্টিনিচয় প্রকৃতিক বিধিবিধানে পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম না হলেও প্রাকৃতিক বিধিবিধানের স্বেচ্ছাচারী প্রয়োগ করতে পারে - যার পরিণতিতে সৃষ্টিলোকের গতিধারায় কমবেশী নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার লাভ করে। ক্ষেত্রবিশেষে এ নেতিবাচক প্রভাব এতোখানি হতে পারে যে , তা সৃষ্টিলোকের শৃঙ্খলা ও লক্ষ্যকে ব্যাহত করতে পারে বা অন্য সৃষ্টির স্বাভাবিক দাবীকে নস্যাৎ করতে পারে। এমতাবস্থায় সামগ্রিকভাবে সৃষ্টিলোকের বা তার অংশবিশেষের দাবী মিটাতে গিয়ে বা সৃষ্টিলোককে তার চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছানোর স্বার্থে তিনি ঐ সব সৃষ্টির কর্মক্ষেত্রে ইতিবাচক হস্তক্ষেপ করবেন এটাই বিচারবুদ্ধির দাবী।


12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35