জীবন জিজ্ঞাসা

জীবন জিজ্ঞাসা5%

জীবন জিজ্ঞাসা লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

জীবন জিজ্ঞাসা
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 58 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 42138 / ডাউনলোড: 4648
সাইজ সাইজ সাইজ
জীবন জিজ্ঞাসা

জীবন জিজ্ঞাসা

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে মৃত্যুপারের জীবন

মানুষের সামনে বিরাজমান একটি বড় ধরনের জীবনজিজ্ঞাসা হচ্ছে এই যে , মৃত্যুতেই কি প্রাণশীল সৃষ্টির জীবনের সমাপ্তি , নাকি মৃত্যুর পরেও কোনো ধরনের জীবনের অস্তিত্ব রয়েছে ?

এ হচ্ছে এমন একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা যার অভ্রান্ত জবাব না পাওয়া পর্যন্ত কোনো সুস্থ বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ শান্ত হয়ে বসে থাকতে পারে না।

মানুষ হচ্ছে জ্ঞানপিপাসু সৃষ্টি। তাই কোনো প্রশ্নের জবাব উদ্ঘাটন না করে প্রশ্নটিকে পাশে সরিয়ে রেখে নিশ্চিন্ত থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু প্রশ্নটি যদি নেহায়েত জ্ঞানগত অর্থাৎ তথ্য সংক্রান্ত না হয়ে তার নিজের ভালো-মন্দের সাথে জড়িত হয় তাহলে তার জবাব খুঁজে পাওয়া তার জন্য একান্তই অপরিহার্য হয়ে ওঠে।

মৃত্যুর পরে কোনো জীবন থাকা-নাথাকার ওপর মানুষের জীবনের কর্মনীতি বহুলাংশে নির্ভর করে। বিশেষ করে সে জীবনপথে চলতে গিয়ে এমন অনেক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় যখন তার শরীরের চাহিদা ও বিচারবুদ্ধির রায় পরস্পর বিপরীত দিকে ধাবিত হয়। সে যখন অত্যন্ত ক্ষুধার্ত অবস্থায় অন্যের মালিকানাধীন প্রহরাবিহীন ফল-বাগানের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে তখন পাকা ফল দেখে তার ক্ষুন্নিবৃত্তির খুবই ইচ্ছা হয় । কিন্তু তার বিচারবুদ্ধি বলে , চুরি করা অন্যায় ; চুরি করো না। এমতাবস্থায় , মৃত্যুর পরে যদি আর কোনো জীবন না থাকে তাহলে কেবল অন্যায় বলেই চুরি থেকে বিরত থাকা এবং ক্ষুধার কষ্ট সহ্য করার কোনো অর্থ হয় না। শুধু তা-ই নয় , বরং এরূপ অবস্থায় ন্যায়-অন্যায় সংক্রান্ত ধারণা ও নৈতিক বোধ অর্থহীন বলে মনে হবে। তাই সে অবলীলাক্রমে অন্যের বাগানের ফল বিনানুমতিতে ভক্ষণ করে ক্ষুন্নিবৃত্তি করবে। এ অবস্থায় পারিপার্শ্বিকতা থেকে বিপদাশঙ্কা না থাকলে কোনো নৈতিক বোধই তাকে এ কাজ থেকে বিরত রাখতে পারবে না।

কিন্তু যে ব্যক্তি মনে করে যে , মৃত্যুতেই জীবনের সমাপ্তি নয় , বরং মৃত্যু হচ্ছে জীবনেরই ধারাবাহিকতার একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ও অপর একটি অধ্যায়ের সূচনা , সে অবশ্যই পার্থিব জীবনের কাজকর্মের মৃত্যুপরবর্তী জীবনে শুভাশুভ প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনার কারণে সতর্কতার কর্মনীতি অনুসরণ করবে। অর্থাৎ সে তার বিচারবুদ্ধির ন্যায়-অন্যায় সংক্রান্ত রায়ের অনুসরণ করবে , এতে তার যতোই না কষ্ট হোক। বিষয়টি চরম পিপাসার্ত অবস্থায় , বিষমেশানো বলে জানা থাকা , এমনকি বিষমেশানো হবার সন্দেহযুক্ত পানি বর্জনের সাথে তুলনীয়।

মৃত্যুর ওপারে জীবন আছে কিনা এ প্রশ্নের জবাব প্রথমতঃ এই ন্যায়-অন্যায় ও নৈতিকতা বোধের মধ্যেই নিহিত দেখতে পাওয়া যায়। মৃত্যুতেই জীবনের সমাপ্তি ঘটলে ন্যায়-অন্যায় ও নৈতিকতার বোধ একটি অর্থহীন বিষয়ে পরিণত হয়। শুধু তা-ই নয় , এরূপ হলে এ জীবন ও জগতের পিছনে কোনো সৃষ্টিকর্তা আছেন কিনা তার জবাব সন্ধানও অর্থহীন ও অযথা কাজে পরিণত হতে বাধ্য। কারণ , সৃষ্টিকর্তা যদি থাকেনও , যেহেতু এ পার্থিব জীবনে সরাসরি তাঁর নিকট জবাবদিহি করতে হচ্ছে না , এমতাবস্থায় যদি মৃত্যুতেই জীবনের শেষ হয়ে যায় এবং মৃত্যুর পরে সৃষ্টিকর্তার নিকট জবাবদিহি করার সম্ভাবনা না থাকে তাহলে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব থাকা-নাথাকায় কোনোই পার্থক্য ঘটে না।

এরূপ হলে অর্থাৎ মৃত্যুর ওপারে কোনো জীবন না থাকলে এ জীবনে নীতি-নৈতিকতা ও বিবেকবোধ অনুসরণের কোনো প্রয়োজনই থাকে না , বরং এ জীবনে নিরাপত্তা ও সতর্কতার নীতি অনুসরণই যথেষ্ট। অর্থাৎ মানুষ কেবল এ জন্য চুরি থেকে বিরত থাকবে যে , চুরি করলে এবং সংশ্লিষ্ট জিনিসের মালিক তা জানতে পারলে তার সাথে সংঘাত হবে এবং পারস্পরিক স্বার্থে সহযোগিতার নীতি অনুসরণে অন্যরাও মালিকের পাশে এসে দাঁড়াবে ও চোরকে শাস্তি দেবে। কিন্তু তার বিচারবুদ্ধি চুরিকে অন্যায় বলবে না এবং চুরি প্রকাশ পেলে সে বিব্রত বা লজ্জা বোধ করবে না। বরং বিব্রতবোধ করা ও লজ্জা পাওয়ার ন্যায় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোই তার মধ্য থেকে উঠে যাবে। এমতাবস্থায় ঝুঁকি না থাকলে স্বীয় প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে , শুধু প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে কেন , বরং অপরিহার্য প্রয়োজন না থাকলেও কেবল অতিরিক্ত আরাম-আয়েশ লাভ ও অনেক বেশী ধন-সম্পদের মালিক হবার জন্যে , সে অবশ্যই চুরি করবে।

কিন্তু আমরা দেখতে পাই , বিচারবুদ্ধি চুরিকে অন্যায় বলে রায় দেয় এবং চুরি প্রকাশ পেলে , এমনকি শাস্তির ঝুঁকি না থাকলেও মানুষ লজ্জা পায় ও বিব্রত বোধ করে। অন্যদিকে আমরা দেখতে পাই , বিচারবুদ্ধি যতো কাজকে অন্যায় বলে রায় দেয় তার সবগুলোর প্রতিফল পার্থিব জীবনে প্রকাশ পায় না এবং যেগুলোর প্রতিফল প্রকাশ পায় তা-ও সাধারণতঃ পূর্ণ মাত্রায় প্রকাশ পায় না। তেমনি বিচারবুদ্ধি যতো কাজকে ভালো ও উচিত বলে রায় দেয় পার্থিব জীবনে তার সবগুলোর প্রতিফল প্রকাশ পায় না এবং যে সব কাজের প্রতিফল প্রকাশ পায় তা-ও সাধারণতঃ পূর্ণ মাত্রায় প্রকাশ পায় না। এমতাবস্থায় এটাই মানবমনের আকাঙ্ক্ষা তথা মানবপ্রকৃতির দাবী যে , এ পার্থিব জীবনে না হলেও , মৃত্যুর পরে হলেও ন্যায়-অন্যায় ও ভালো-মন্দের শুভাশুভ প্রতিফল প্রকাশিত হোক।

মৃত্যুর পরে যদি কোনো জীবন না-ই থাকবে তাহলে মানুষের মধ্যে ভালো-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায়ের অনুভূতি না থাকাই উচিত ছিলো , অথবা এরূপ অনুভূতি থাকার পাশাপাশি এ পার্থিব জীবনে তার পূর্ণ প্রতিফল প্রকাশ পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকা উচিত ছিলো। কিন্তু বাস্তবে যখন এর কোনোটাই হয় নি তখন মৃত্যুর পরে ন্যায়-অন্যায় ও ভালো-মন্দের শুভাশুভ প্রতিফল প্রকাশ পাওয়া অপরিহার্য। যদি তা না হয় , তাহলে বলতে হবে যে , স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির প্রতি অন্যায় করেছেন বা তার সাথে প্রতারণা করেছেন অথবা তিনি বুঝতে পারেন নি যে , তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্যে কী ধরনের অনুভূতি দিয়েছেন ও সৃষ্টির সহজাত অনুভূতির দাবী পূরণের জন্য কী করা উচিত ছিলো।

বলা বাহুল্য যে , কোনো স্রষ্টার মধ্যে এরূপ বৈশিষ্ট্য থাকা মানে হচ্ছে সে স্রষ্টা দুর্বল ও অপূর্ণ। পরম পূর্ণতার অধিকারী অপরিহার্য সত্তা এ ধরনের দুর্বলতা ও অপূর্ণতা থেকে প্রমুক্ত। অতএব , এতে সন্দেহের অবকাশ নেই যে , ভালো-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায়ের অনুভূতি এবং পার্থিব জীবনে এর ফলাফল পুরোপুরি প্রকাশ না পাওয়ার অনিবার্য দাবী হচ্ছে , মুত্যুর পরে এ পার্থিব জগতে অপ্রকাশিত ফলাফল প্রকাশ পাওয়া ও অপূর্ণভাবে প্রকাশিত ফলাফল পরিপূর্ণরূপে প্রকাশ পাওয়া।

মৃত্যুতেই প্রাণশীল সৃষ্টির অস্তিত্বের সমাপ্তি ঘটা অপরিহার্য সত্তা সৃষ্টিকর্তার প্রজ্ঞা ও শক্তির দাবীর বরখেলাফ। কোনো সৃষ্টির সূচনা করে তাকে পূর্ণতায় উপনীত না করে মাঝপথে সমাপ্ত করা খেয়ালী , অজ্ঞ বা অক্ষম স্রষ্টার বৈশিষ্ট্য ; পরম পূর্ণতার অধিকারী অপরিহার্য সত্তা এ ধরনের দুর্বলতা থেকে মুক্ত ।

মানুষ ও অন্যান্য প্রাণশীল সৃষ্টিকে কেন সৃষ্টি করা হয়েছে ? আমরা দেখি , মানুষ জন্মগ্রহণ করে , লালিত-পালিত হয় , বড় হয় , জ্ঞানার্জন করে , খানাপিনা করে , বিশ্রাম করে , নিদ্রা যায় , ধরণীর বুকে বিভিন্ন ধরনের কাজকর্ম করে , পরোপকার করে ইত্যাদি। কিন্তু এখানে অনেক নেতিবাচক দিক আছে। এখানে আছে ঝগড়া-ফাসাদ , যুদ্ধ-বিগ্রহ , চুরি-ডাকাতি , অন্য অনেক ধরনের অন্যায়-অপরাধ। এছাড়া আছে প্রাকৃতিক বিপর্যয় , আছে দুঃখ-কষ্ট ও লাঞ্ছনা-গঞ্জনা। তার অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ থেকে যায় , অনেক ভালো কাজ পুরষ্কারবিহীন থেকে যায়। তারপর একদিন মৃত্যু এসে তাকে গ্রাস করে। প্রশ্ন হচ্ছে , কেন তাকে সৃষ্টি করা হলো ? কেবল খাওয়া-পরা , প্রজনন ও একদিন মরে যাওয়া - এ জন্য কি ? তাকে সৃষ্টির পিছনে কি কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নেই ? তাহলে তাকে যে দুঃখ-কষ্ট ও অন্যায়-অত্যাচারের মুখোমুখি করা হলো তার উদ্দেশ্য কী ? পরম পূর্ণতার অধিকারী স্রষ্টা এরূপ অযৌক্তিক কাজ করতে পারেন কি ?

আমরা অবশ্য মৃত্যুর ওপারে কী আছে তা জানি না । অর্থাৎ আমাদের অভিজ্ঞতা বা বিচারবুদ্ধি আমাদেরকে এ ব্যাপারে নিশ্চিত জ্ঞান দিতে সক্ষম নয়। কারণ , আমাদের যাত্রা একমুখী। আমরা যারা মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়ে পার্থিব জীবনে রয়েছি তারা যেমন আর মাতৃগর্ভে ফিরে যেতে পারছি না , তেমনি যারা মৃত্যুবরণ করেছে তাদের কেউ ফিরে এসে বলতে পারছে না মৃত্যুর ওপারে কী আছে বা আদৌ কিছু আছে কিনা।

এ যেন পার্থিব জীবন সম্পর্কে মাতৃগর্ভস্থ ভ্রুণের ধারণা। ধরুন , কোনো মাতৃগর্ভে একবারে কয়েকটি ভ্রুণের সৃষ্টি হলো এবং তাদের বিকাশ হতে থাকলো। এক সময় একটি পূর্ণ বিকশিত ভ্রুণ বা শিশু মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে গেলো , আর ফিরলো না। দু ঘণ্টা পর আরো একটি ভ্রুণ বা শিশু বেরিয়ে গেলো ; সে-ও ফিরলো না। তখন সেখানে অবস্থানরত অপর একটি বা দু টি ভ্রুণ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলো: আমরা এখানে অস্তিত্বলাভ করি , পুষ্টি লাভ করি , বিকাশপ্রাপ্ত হই , তারপর এখান থেকে বেরিয়ে যাই এবং আর ফিরে আসি না ; সুতরাং এটাই সত্য যে , এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়েই আমাদের অস্তিত্বের সমাপ্তি।

মৃত্যুতে আমাদের অস্তিত্বের সমাপ্তি বলে ধারণা করা ভ্রুণের কল্পিত ধারণার সমতুল্য - যা নেহায়েতই হাস্যকর।

মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসাতেই যদি ভ্রুণের অস্তিত্বের সমাপ্তি ঘটতো তাহলে ভ্রুণের জীবন অর্থাৎ তার অস্তিত্বলাভ ও বিকাশ এবং মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসা পর্যন্তকার জীবন হতো যেমন অসম্পূর্ণ জীবন , তেমনি তা হতো অর্থহীন। পরম প্রজ্ঞাময় স্রষ্টা অর্থহীন অসম্পূর্ণ জীবন সৃষ্টি করবেন এটা ভাবাও যায় না। পার্থিব জীবনের পর মৃত্যুতে জীবনের সমাপ্তি হলে তা-ও অনুরূপ। বরং তা শুধু অর্থহীন নয় , অন্যায় বলেও মনে হয়। কারণ , একটি মানুষ কারণ ও ফলশ্রুতি বিধির এ দুনিয়ায় বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে পথ চলে যখন পঞ্চাশ , ষাট বা একশ বছরের জীবনে বেশ কিছুটা শিক্ষা গ্রহণ করেছে ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে তখন মৃত্যু এসে তাকে গ্রাস করে নিলো এবং তার অস্তিত্বকে নিশ্চিহ্ন করে দিলো। বিচারবুদ্ধি এ নিশ্চিহ্নতাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। এটা খুবই অন্যায় হবে যদি না মৃত্যুর পরেও জীবনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে , ঠিক যেভাবে ভ্রুণের মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসার পরেও জীবনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে।

তাছাড়া মানুষের সত্তার ভিতরেই জীবন বিলুপ্ত না হওয়ার ও অব্যাহত থাকার কামনা নিহিত রয়েছে। এ কামনা সর্বজনীন। মানুষের সৃষ্টিপ্রকৃতিতে যতো রকমের সহজাত কামনা-বাসনা ও চাহিদা রয়েছে তার সব কিছুই পূরণের ব্যবস্থা রয়েছে। তার ক্ষুধার জন্য খাদ্য , তৃষ্ণার জন্য পানি , দেখার জন্য সুন্দর ও মনোরম দৃশ্যাবলী , শোনার জন্য সুমিষ্ট ধ্বনি ও সুর , ঘ্রাণ নেয়ার জন্য সুগন্ধি , স্বাদ গ্রহণের জন্য সুস্বাদু উপাদান , স্পর্শ করার জন্য মোলায়েম বা আরামদায়ক বস্তু - সবই মওজূদ রয়েছে। তার মধ্যে সহজাতভাবে যতো কিছুর আশা-আকাঙ্ক্ষা ও কামনা-বাসনা আছে তার সব কিছুই পূরণের নিশ্চিত ব্যবস্থা রয়েছে। জন্মের পর বয়সের একটি সুনির্দিষ্ট স্তরে এসে পুরুষ নারীসংসর্গ কামনা করে এবং নারী পুরুষসংসর্গ কামনা করে। মহান স্রষ্টা মানুষের মধ্যে এ ধরনের কামনা সৃষ্টি করেছেন এবং তা পূরণেরও ব্যবস্থা রেখেছেন।

এ থেকে বিচারবুদ্ধি এ উপসংহারে উপনীত হয় যে , কোনো আশা-আকাঙ্ক্ষা বা কামনা-বাসনা পূরণের ব্যবস্থা না রাখলে সৃষ্টিকর্তা সে আশা-আকাঙ্ক্ষা বা কামনা-বাসনা সৃষ্টিই করতেন না। বলা বাহুল্য যে , মানবপ্রকৃতিতে নিহিত আশা-আকাঙ্ক্ষা ও কামনা-বাসনা সমূহের মধ্যে সর্বাধিক প্রবল হচ্ছে জীবন অব্যাহত রাখার আকাঙ্ক্ষা। এ আকাঙ্ক্ষা যদি অপূর্ণ থাকবে , তাহলে কেন তার মধ্যে এ আকাঙ্ক্ষা দেয়া হলো ? এরূপ হলে তা বড়ই অন্যায় হবে - যা পরম পূর্ণতার অধিকারী স্রষ্টার জন্য কল্পনাও করা যায় না।

বাস্তবেও দেখা যায় , যারা মৃত্যুতেই জীবনের সমাপ্তি বলে মনে করে তারা চরম হতাশার শিকার হয়। তাদের কাছে জীবনটা অর্থহীন বলে মনে হয়। এমনকি এ হতাশা অনেককে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে। কারণ , মৃত্যুতেই যে জীবনের সমাপ্তি সে জীবনকে বাঁচিয়ে রেখে লাভ কী ? বিলুপ্তিই যদি জীবনের পরিণতি হয় , তো খাওয়া-পরা , ভোগ-আনন্দের জন্য জীবন অব্যাহত রাখার সার্থকতা কী ?

জীবনে সুখ , আনন্দ ও ভোগ যেমন আছে , তেমনি আছে দুঃখ-কষ্ট , ব্যথা-বেদনা , অশান্তি , ঝুঁকি , নিরাপত্তাহীনতা। সামান্য ভোগ-আনন্দ লাভের জন্য এতো সব ঝক্কি পোহানোর কি কোনো মানে হয় ? কোনো কঠিন পরিস্থিতির কারণে নয় , কেবল এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণের কারণেও অনেকে আত্মহত্যা করে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ঝুঁকিবিহীন জীবনের অধিকারী লোকেরাও মৃত্যুতে জীবনের বিলুপ্তি গণ্য করায় জীবনকে অর্থহীন ও উদ্দেশ্যবিহীন অনুভব করে চরম হতাশার শিকার হয়ে আত্মহত্যার আশ্রয় নিয়ে থাকে।

বলা বাহুল্য যে , এ ধরনের আত্মহত্যাও এটাই প্রমাণ করে যে , মানবপ্রকৃতিতে জীবন অব্যাহত থাকার আকাঙ্ক্ষা বিদ্যমান। কিন্তু ভ্রান্ত শিক্ষার ফলে তার মনে মৃত্যুতে জীবনের বিলুপ্তির ধারণা গড়ে ওঠায় সে তার প্রকৃতিতে নিহিত আকাঙ্ক্ষা পূরণের পথ রুদ্ধ দেখতে পেয়ে হতাশার শিকার হয়ে আত্মহত্যা করে।

অতএব , মানবপ্রকৃতিতে নিহিত জীবনের ধারাবাহিকতার আকাঙ্ক্ষার দাবী হচ্ছে এই যে , সৃষ্টিকর্তা যখন মানুষের মাঝে এরূপ আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করেছেন তখন তিনি তা অবশ্যই পূরণ করবেন।

মানবপ্রকৃতিতে নিহিত ন্যায়নীতির অনুভূতি এবং ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষাও মৃত্যুর পরে জীবন অব্যাহত থাকার দাবীদার।

মানুষের প্রকৃতি একদিকে যেমন কোনো রকম যুলুম-অত্যাচারের শিকার হওয়া পসন্দ করে না , তেমনি ভালো কাজ ও ত্যাগ স্বীকারের বিনিময়ে শুভ প্রতিদান কামনা করে। কিন্তু কারণ ও ফলশ্রুতি বিধির আওতাধীন পার্থিব জগতে সব সময় তার প্রতিফলন ঘটে না। এখানে মানুষ তার স্বাধীনতার অপব্যবহার করে অন্যের ওপর যুলুম-অত্যাচার করে , কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই যালেম শাস্তির সম্মুখীন হয় না। ফলে মযলূম সব সময়ই যালেমের শাস্তি কামনা করতে থাকে। অন্যদিকে অনেক সময় ভালো কাজ ও ত্যাগ স্বীকারের বিনিময়ে শুভ ফল পাওয়া তো দূরের কথা , উল্টো লাঞ্ছনা-গঞ্জনার শিকার হতে হয়।

যুলুম-অত্যাচার শাস্তিবিহীন চলে যাবে এবং ভালো কাজ পুরষ্কারবিহীন থেকে যাবে - মানুষের মন এটা মানতে পারে না। সে এ কামনাই করে যে , সৃষ্টিকর্তা যেন ঘটনাবলীকে নিয়ন্ত্রণ করে এমন এক দিকে প্রবাহিত করেন যার ফলে বিলম্বে হলেও সে যেন তার ভালো কাজের শুভ প্রতিদান পায় এবং যালেম তার যুলুমের শাস্তি ভোগ করে ; সে তো প্রতিশোধ নিতে পারলো না , সৃষ্টিকর্তা যেন তার পক্ষ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করেন। কিন্তু এ আশায় আশায় তার দিন কেটে যায় , তারপর এক সময় যালেম স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করে দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়। তখন সে (মযলূম) কামনা করে , দুনিয়ার বুকে তো যালেমের শাস্তি হলো না , মৃত্যুতে যেন তার অস্তিত্বের সমাপ্তি না ঘটে ; মৃত্যুর পরে আরেক জগতে হলেও যেন সৃষ্টিকর্তা তাকে শাস্তি দেন। তেমনি যে ব্যক্তি ভালো কাজের শুভ প্রতিদান পাবার আগেই মৃত্যু এসে তাকে গ্রাস করছে , সে কামনা করে , মৃত্যুর পরে অন্য জগতে হলেও সৃষ্টিকর্তা যেন তাকে শুভ প্রতিদান প্রদান করেন। সৃষ্টিকর্তা তো সহজেই তা করতে পারেন ; তাহলে কেন করবেন না ? অবশ্যই করবেন - এটাই তার বিচারবুদ্ধিজাত প্রত্যয়।

অন্যায়ের শাস্তি ও ভালো কাজের পুরষ্কারের সুশৃঙ্খল ব্যবস্থার দৃষ্টান্ত স্বয়ং মানুষের সত্তার মধ্যেও নিহিত রয়েছে। মানুষ কোনো ভালো কাজ সম্পাদন করতে পারলে , বাইরে সে জন্য প্রশংসা ও পুরষ্কার না পেলেও , সে তার অন্তরে এক ধরনের অনাবিল আনন্দ , পরিতৃপ্তি ও প্রশান্তি অনুভব করে।

অন্যদিকে অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধ করার পর মানুষ আত্মগ্লানি অনুভব করে , যদি না তার মানবিক সত্তা পুরোপুরি বিকৃত হয়ে পশুসত্তায় বা তার চেয়েও নিকৃষ্টতর সত্তায় পরিণত হয়ে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে তার আত্মগ্লানির যন্ত্রণা এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয় যে , সে তা থেকে বাঁচার জন্য আত্মহত্যা করে।

আমরা লক্ষ্য করি যে , প্রাকৃতিক বিধিবিধান (যেমন , স্বাস্থ্যবিধি) ও সহজাত নৈতিক বিধান লঙ্ঘন ও মেনে চলার কারণে মানুষের ক্ষুদ্র দেহের ব্যবস্থাপনার মধ্যেও এক ধরনের শাস্তি ও পুরস্কারের নিখুঁত ব্যবস্থা রয়েছে। এমতাবস্থায় গোটা সৃষ্টিলোকের বিশাল ব্যবস্থাপনায় শাস্তি ও পুরস্কারের একটি নিখুঁত ব্যবস্থা থাকবে না - এটা কী করে সম্ভব ? কারণ , মানুষের সত্তায় শাস্তি ও পুরষ্কারের এক নিখুঁত ব্যবস্থা আছে বটে , তবে তাতে মানুষের ন্যায়বিচারের দাবী পুরোপুরি পূরণ হচ্ছে না।

মানুষ দেহ ও আত্মার সমন্বিত রূপ। মানুষ ভালো-মন্দ যে কাজ করে তাতে তার দেহ ও আত্মা বা ব্যক্তিসত্তা উভয়ই জড়িত। পার্থিব জীবনে মানুষ যে শাস্তি ও পুরষ্কার লাভ করে তা তার দেহ ও আত্মা উভয়ই ভোগ করে থাকে। তাই মযলূম ব্যক্তি দেহ ও মনে যে যুলুমের শিকার হয়েছে , তার প্রতিদানে যালেমের পার্থিব জীবনের মানসিক অশান্তিরূপ শাস্তিতে সে সন্তুষ্ট নয়। বিশেষ করে , পার্থিব জগতের আদালতে যখন কোনো যালেমের শাস্তি হয় তখন তা শারীরিক ও মানসিক উভয়ভাবেই হয়ে থাকে । এমতাবস্থায় তার ওপর যে ব্যক্তি যুলুম করেছে তার শাস্তি শারীরিকভাবে না হলে , কেবল মানসিক বা আত্মিকভাবে হলে মযলূম ব্যক্তি অনুভব করবে যে , তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বিশেষ করে যালেম সত্যি সত্যিই মানসিক শাস্তি ভোগ করছে কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া মযলূমের পক্ষে সম্ভব নয়। কেবল শারীরিক শাস্তি দেখেই তার পক্ষে বুঝতে পারা সম্ভব যে , যালেম মানসিক শাস্তিও ভোগ করছে। তাই পার্থিব জীবনে যালেমের শারীরিক শাস্তি না হলে মৃত্যুর পরে অন্য কোনো জগতে তার শারীরিক শাস্তি হোক - মযলূম এটাই কামনা করে।

ভালো কাজের পুরষ্কারের ক্ষেত্রেও মানুষের কামনা একই ধরনের। ভালো কাজ সম্পাদনকারীদের মধ্য থেকে কেউ কেউ যেখানে মানসিক পরিতৃপ্তি ছাড়াও পার্থিব শুভ ফলও পেয়েছে - যে শুভ ফল তাদের জন্য শারীরিক আনন্দ ছাড়াও আরো এক দফা মানসিক পরিতৃপ্তি নিয়ে এসেছে , সে ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি ভালো কাজ সম্পাদন করে কেবল মানসিক পরিতৃপ্তি পেয়েছে , পার্থিব পুরষ্কার ও তজ্জনিত শারীরিক-মানসিক পরিতৃপ্তি পায় নি , সে নিজেকে বঞ্চিত অনুভব করতে বাধ্য। সে অবশ্যই চায় , মৃত্যুর পরে অন্য জগতে হলেও , তার এ বঞ্চনার প্রতিকার হোক।

এছাড়া পার্থিব জগতের শাস্তি ও পুরষ্কার শতকরা একশ ভাগ যথাযথ হওয়া সম্ভব নয়। যে ব্যক্তি একশ জন লোককে হত্যা করেছে তাকে দুনিয়ার আদালত মাত্র একবারই মৃত্যুদণ্ড দিতে পারবে। তাই ভালো ও মন্দ কাজের যথাযথ প্রতিদান দেয়ার জন্যও আরেকটি জগত থাকা অপরিহার্য।

মানুষের সহজাত প্রবণতাসমূহের অন্যতম হচ্ছে জানার প্রবণতা , সত্য উদ্ঘাটনের প্রবণতা , জীবন ও জগতের ছোট-বড় সকল রহস্যের দ্বারোদ্ঘাটনের আকাঙ্ক্ষা। এ আকাঙ্ক্ষা দৈহিক ভোগ-আকাঙ্ক্ষার চেয়েও তীব্র ও শক্তিশালী। কিন্তু পার্থিব জগতে তার এ আকাঙ্ক্ষা বেশীর ভাগই অপূর্ণ থেকে যায়। সে চায় , সমস্ত সত্য তার নিকট প্রকাশিত হোক , সব কিছুর ওপর থেকে রহস্যের পর্দা অপসারিত হয়ে যাক । কিন্তু তা হয় না। এ কারণে তার অস্থিরতা , আফসোস ও মনঃপীড়ার অন্ত নেই।

এছাড়া জীবন ও জগতের অনেক বিষয় সম্বন্ধে মানুষের কাছে পরস্পর বিরোধী ধারণা আসে। তাই সে জানতে চায় , কোনটি সত্য ? নাকি এর কোনোটিই সত্য নয় , বরং তৃতীয় কোনো কিছু সত্য যা সকলের কাছেই অজ্ঞাত ? তার মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় , তার বন্ধু , স্বামী বা স্ত্রী তার সাথে কপটতা বা বিশ্বাসঘাতকতা করছে না তো ? সারাটি জীবন অভিনয় করে কাটিয়ে দেয় নি তো ? আহা! অমুকের অন্তরের অবস্থাটি যদি নির্ভুলভাবে পর্যবেক্ষণ করা যেতো! আপাততঃ যে সব সত্য অপ্রকাশিত বা সন্দেহের আবরণে আবৃত রয়েছে তা কি কোনোদিন প্রকাশিত হবে না ? সৃষ্টিকর্তা কি তার এ পিপাসার নিবৃত্তি করবেন না ? দৈহিক পিপাসা নিবৃত্তির ব্যবস্থা তো রয়েছে ; এ জ্ঞানপিপাসার নিবৃত্তি কি কখনোই হবে না ?

মানবমনের আকাঙ্ক্ষা , এ জীবনে তো বিতর্কের ফয়সালা হলো না ; মৃত্যুর পরে হলেও যেন এর ফয়সালা হয় এবং সে সঠিক বিষয়টি জানতে পারে। এ জীবনে জ্ঞানপিপাসার নিবৃত্তি হলো না ; মৃত্যুর পরে হলেও যেন এর নিবৃত্তি হয়। পরম ক্ষমতাবান স্রষ্টা তো তা করতে সক্ষম ; তাহলে কেন তিনি তা করবেন না ? অবশ্যই করবেন। নইলে তিনি মানবপ্রকৃতিতে এ সীমাহীন জ্ঞানপিপাসা দিলেন কেন ? এমন দুর্বার পিপাসা , যার চাপ সহ্য করা বড়ই কঠিন ; নিঃসন্দেহে তিনি তার নিবৃত্তি ঘটাবেন , নইলে এ পিপাসা দিয়ে তিনি মানুষকে কষ্ট দিতেন না।

সৃষ্টিকর্তার জ্ঞান ও স্বাধীন সৃষ্টির ভবিষ্যৎ

এখানে একটি প্রশ্ন উঠতে পারে যে , অপরিহার্য সত্তা চিরজ্ঞানময় সৃষ্টিকর্তা যেহেতু অতীত ও ভবিষ্যৎ সব কিছু জানেন সেহেতু তিনি কথিত স্বাধীন সৃষ্টির ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও জানেন। আর তিনি যা জানেন তার অন্যথা হতে পারে না। এমনকি স্রষ্টা যদি কখনো কোনো সুনির্দিষ্ট সৃষ্টিসত্তার কোনো বিশেষ কাজে হস্তক্ষেপ করেন , তো নিঃসন্দেহে তা-ও তিনি আগে থেকেই জানতেন যে , তিনি তার ঐ কাজে হস্তক্ষেপ করবেন। অতএব , তা অনিবার্য ছিলো। ফলে এখানে স্বাধীনতার কোনো স্থান নেই।

এ বিষয়টি তাক্বদীর (تقدير ) বা ভাগ্যনির্ধারণ বিষয়ক আলোচনার অন্তর্ভুক্ত যা একটি বিস্তারিত আলোচনার বিষয় এবং যে আলোচনা কেবল বিচারবুদ্ধির ভিত্তিতে করা সম্ভব নয়।3 তবে এখানে বিচারবুদ্ধি ভিত্তিক আলোচনায় আমরা সংক্ষেপে এর কয়েকটি দিকের ওপরে আলোকপাত করতে পারি। প্রথমতঃ আমরা আমাদের বিচারবুদ্ধি দ্বারা অনুভব করি যে , আমরা জড় পদার্থ থেকে স্বতন্ত্র এবং প্রাণশীল সৃষ্টি হওয়ার কারণে আমাদের ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতা রয়েছে। দ্বিতীয়তঃ আমরা লক্ষ্য করি যে , মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতা প্রাণীর ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতার চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী যে কারণে অন্যান্য প্রাণীর ব্যতিক্রমে মানুষ তার সহজাত প্রবণতার বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ করতে পারে। যেমন: চরম ক্ষুধার্ত অবস্থায়ও এবং তার সামনে সুস্বাদু খাবার থাকা সত্ত্বেও ও তা খাওয়ার পথে কোনোরূপ বাধা না থাকা সত্ত্বেও সে তা খাওয়া থেকে বিরত থাকতে পারে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে , কারো ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভবিষ্যৎ-জ্ঞানের অধিকারী অপরিহার্য সত্তার জানা থাকার মানেই তো অনিবার্য হয়ে যাওয়া , এমতাবস্থায় ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতার কী মানে হতে পারে ?

এ প্রশ্নের জবাব হচ্ছে , সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি-ইচ্ছা বা নির্ধারণ বা ভবিষ্যৎ-জ্ঞান মানে এরূপ হওয়া অপরিহার্য নয় যে , অনন্ত ভবিষ্যতের ছোট-বড় প্রতিটি বিষয় তাতে অনিবার্য রূপে থাকবেই। কারণ , তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায় তাঁর অনাদিকালীন প্রথম ইচ্ছাকরণের পর সব কিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে হতেই থাকবে ; অতঃপর আর তাঁর ইচ্ছা করার মতো বা করণীয় বলতে কিছুই থাকবে না। এরূপ হলে স্বয়ং তাঁর ইচ্ছাশক্তি , সৃষ্টিক্ষমতা ও স্বাধীনতা অনিবার্যতার শিকারে পরিণত হবে - যা থেকে তিনি উর্ধে। বরং তাঁর ইচ্ছা ও সৃষ্টিসিদ্ধান্তের মধ্যে প্রত্যক্ষ কর্ম ও সৃষ্টি , প্রাকৃতিক বিধিবিধান সৃষ্টি , প্রাকৃতিক বিধানের আওতায় যান্ত্রিক কার্যক্রম , ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন সৃষ্টির মাধ্যমে পরোক্ষ কর্ম ও সৃষ্টি , তাঁর চিরন্তন নির্ধারণ এবং তাঁর উপস্থিত নিয়ন্ত্রণ সবই অন্তর্ভুক্ত রাখতে তিনি সক্ষম। আর ভবিষ্যৎ-জানা সম্পর্কে বলতে হয় যে , তিনি সৃষ্টির ভবিষ্যৎকে অংশতঃ অনিবার্য করে দিতে পারেন , অংশতঃ শর্তাধীন করে দিতে পারেন (যেমন: সে এরূপ করলে তার ফলে এই হবে , আর ঐরূপ করলে তার ফলে ঐ হবে) ও অংশতঃ পুরোপুরি অনির্ধারিত রেখে দিতে পারেন এবং সংশ্লিষ্ট সৃষ্টির ভবিষ্যৎ তাঁর জ্ঞানে এভাবেই অন্তর্ভুক্ত থাকবে - এটাই স্বাভাবিক।

বিষয়টি আরো কিছুটা সহজভাবে বুঝার জন্য বলা যেতে পারে যে , যেহেতু স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির পুরো ভবিষ্যতের দিক মনোযোগ দিলে তা অনিবার্য হয়ে যায় সেহেতু তিনি সংশ্লিষ্ট সৃষ্টির স্বাধীন ক্ষেত্রটির ভবিষ্যতের প্রতি মনোযোগ দেয়া থেকে বিরত থাকেন এবং এভাবে তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন।4

স্রষ্টার কর্মের সাথে কালের সম্পর্ক

আমরা যখন বলি যে , পরম জ্ঞানময় অপরিহার্য সত্তা সব সময় সৃষ্টি ও পরিচালনা করে চলেছেন তখন এ প্রসঙ্গে একটি কালগত প্রশ্ন উঠতে পারে। কারণ , সব সময় মানে অতীত , বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। কিন্তু অনাদি ও অনন্ত অপরিহার্য সত্তা কালের উর্ধে। অর্থাৎ তাঁর জন্য কাল প্রযোজ্য নয়। তাই প্রশ্ন উঠতে পারে যে , এমতাবস্থায় তিনি ছিলেন , আছেন ও থাকবেন অথবা তিনি সৃষ্টির সূচনা করেছেন , এখনো সৃষ্টি ও পরিচালনা করছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন - এ জাতীয় কথা দ্বারা কি তাঁর সম্পর্কে কালগত সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয় না ?

এর জবাব হচ্ছে , প্রকৃত পক্ষে এ জাতীয় ক্রিয়ার ব্যবহার করা হয় সৃষ্টির কালগত সীমাবদ্ধতার কারণে। যেহেতু সৃষ্টিসমূহ কালের গর্ভে অস্তিত্ব লাভ করে ও এগিয়ে চলে সেহেতু কালভিত্তিক ক্রিয়াপদ ব্যবহার ব্যতিরেকে কোনো কার্য সৃষ্টিকুলের জন্য অনুধাবনযোগ্য নয়।

বস্তুতঃ কাল ও স্থান হচ্ছে এক ব্যাপকতর সৃষ্টি - যার গর্ভে সকল সৃষ্টিকে সৃষ্টি ও অগ্রগতি প্রদান করা হয়েছে। তবে এই স্থান ও কালের আপেক্ষিকতা রয়েছে - যা বর্তমান যুগের বিজ্ঞান , বিশেষতঃ কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান স্বীকার করছে। এই আপেক্ষিকতা বস্তুগত ও অবস্তুগত অনেক কিছুর সাথে সংশ্লিষ্ট। অতএব , সামগ্রিকভাবে কাল-কে কোনো একটি সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডে এবং স্থানকেও কোনো একটি সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডে পরিমাপ করা সম্ভব বলে মনে করা উচিত হবে না।

অতএব , প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এই যে , একটি সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডের দৃষ্টিতে বা বিচারে কালের ও স্থানের যে ধারণা আমরা লাভ করি তার গর্ভে বিভিন্ন মানদণ্ডের অনেক কাল ও স্থান রয়েছে। আবার এ বৃহৎ কাল ও স্থানের ন্যায় অনেকগুলো বৃহৎ কাল ও স্থান একটি বৃহত্তর কাল ও স্থানের গর্ভে রয়েছে। এভাবে শেষ পর্যন্ত একটি সর্বব্যাপক কাল ও স্থান রয়েছে - অপরিহার্য সত্তা যাকে সৃষ্টি করে সকল সৃষ্টিকে তার গর্ভে স্থান দিয়েছেন। বলা বাহুল্য যে , নিম্নতর কাল ও স্থান দ্বারা উর্ধতর কাল ও স্থান প্রভাবিত হয় না। অতএব , উচ্চতর কাল ও স্থানের আওতাভুক্ত পর্যবেক্ষক নিম্নতর কাল ও স্থানকে পর্যবেক্ষণ করলে তার দ্বারা নিজে প্রভাবিত হয় না। এভাবে শেষ পর্যন্ত সর্বব্যাপক স্থান-কালেরও উর্ধে যে সত্তা তিনি সকল কাল ও স্থানেরই পর্যবেক্ষক , কিন্তু কোনো কাল ও স্থানই তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

সৃষ্টিসত্তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দু টি মাত্রা ( Dimension)হচ্ছে কাল ও স্থান। কালের স্বরূপ ও আপেক্ষিকতা অনুধাবন অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার এবং এ কারণে এর আপেক্ষিকতা সম্পর্কে অভিজ্ঞতাজাত উদাহণ দেয়াও প্রায় অসম্ভব। কারণ , অনেকে কর্তাভেদে অভিন্ন কালের বিভিন্ন অনুভূতি ও বিভিন্ন কর্মের ( Object)ওপর অভিন্ন কালের বিভিন্ন প্রভাবকে কালের আপেক্ষিকতার প্রমাণ হিসেবে গণ্য করলেও প্রকৃত পক্ষে কালের অনুভূতির প্রভাবের আপেক্ষিকতা কালের আপেক্ষিকতা প্রমাণ করতে সক্ষম নয়। তবে স্থানের আপেক্ষিকতা বোধগম্য বিষয় বটে।

বিষয়টিকে অপেক্ষাকৃত সহজবোধগম্য করার জন্য একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। বলা বাহুল্য যে , অপরিহার্য সত্তা স্রষ্টা , তাঁর বৈশিষ্ট্য ও তাঁর কাজ অনুধাবনের জন্য সৃষ্টি সম্পর্কিত উদাহরণ হচ্ছে দুর্বল উদাহরণ - যাতে প্রকৃত সত্য প্রতিফলিত হয় না , তবে প্রকৃত সত্যের কাছাকাছি পৌঁছা যায় ও মোটামুটি ধারণা লাভ করা যায়। এ কারণেই কেবল বিষয়টিকে সহজবোধগম্য করার লক্ষ্যে আমরা এ ধরনের দুর্বল উদাহরণের আশ্রয় নিতে পারি ।

কাল ও স্থানের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত একটি বিষয় হচ্ছে গতি। তাই এই গতি থেকেই বিষয়টি মোটামুটি বুঝা যেতে পারে। কাল ও স্থানের আওতাধীন প্রতিটি সৃষ্টিই কোনো না কোনোভাবে গতিশীল অবস্থায় রয়েছে। তবে প্রকৃত ব্যাপার হলো এ সৃষ্টিলোকে বহু ধরনের গতি রয়েছে। কিন্তু সকল গতি সকল সৃষ্টির ওপর প্রভাব বিস্তার করে না। যেমন: পরমাণুর অভ্যন্তরে প্রচণ্ড গতি রয়েছে , কিন্তু এ গতি অণুর গতিকে প্রভাবিত করে না। আবার স্বয়ং অণু গতিশীল , কিন্তু বহু অণু সমন্বয়ে গঠিত কোনো বস্তুর গতিকে অণুর গতি প্রভাবিত করতে পারে না।

এবার আরেকটি সহজবোধ্য দৃষ্টান্তে আসা যাক। একটি লোক একটি চলমান জাহাযের ডেকের ওপর একদিক থেকে আরেক দিকে হেঁটে যাচ্ছে , আর তার গায়ের ওপর , ধরুন , তার পিঠের ওপর , একটি পিঁপড়া একদিক থেকে আরেক দিকে হেঁটে যাচ্ছে।

এখানে পিঁপড়ার গতি দ্বারা লোকটির গতি প্রভাবিত হচ্ছে না , কিন্তু লোকটির হাঁটার কারণে পিঁপড়াটি দু টি গতির অধিকারী হচ্ছে। অন্যদিকে জাহাযটি গতিশীল , ফলে পিঁপড়ার তিনটি , লোকটির দু টি ও জাহাযের একটি গতি রয়েছে। এভাবে পৃথিবী , সৌরলোক , ছায়াপথ ও অসংখ্য ছায়াপথ সম্বলিত বৃহত্তর জগৎ এবং তদুর্ধ জগৎসমূহের গতি বিবেচনায় আনলে গতির সংখ্যা নিম্নতর পর্যায়ে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং উর্ধতর পর্যায়ে ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকবে। অতঃপর আমরা উপনীত হবো গোটা সৃষ্টিলোকরূপ এককের স্রষ্টার কাছে যিনি গতির সম্পূর্ণ উর্ধে।

উপরোক্ত উদাহরণ থেকে যে কোনো সৃষ্টির গতির ও সেই সাথে স্থানগত অবস্থানের বহুত্ব ও আপেক্ষিকতা প্রমাণিত হয়।

একইভাবে তিনি কাল ও স্থানেরও উর্ধে। কিন্তু তিনি কাল , স্থান ও গতির [ প্রকৃত পক্ষে এ তিনটি হচ্ছে একটি অভিন্ন সৃষ্টির তিনটি মাত্রা ( Dimension)মাত্র ] স্রষ্টা ও পর্যবেক্ষক। এমতাবস্থায় সৃষ্টি ও পরিচালনার তিনটি কাল হচ্ছে সৃষ্টির অবস্থান থেকে উদ্ভূত , স্রষ্টার অবস্থান থেকে নয়। কারণ , তাঁর জন্য কাল বলতে কিছু নেই। বরং তাঁর কাছে সব কিছু সদা বর্তমান। [ বস্তুত : আমরা আমাদের জন্য তিনটি কালের প্রবক্তা হলেও প্রকৃত পক্ষে সৃষ্টির কাল মাত্র দু টি - অতীত ও ভবিষ্যৎ ; সৃষ্টির জন্য বর্তমান মানে হচ্ছে অতীত ও ভবিষ্যতের দুই প্রান্তিক কাল - বিন্দুর মিলনস্থল মাত্র। আর স্রষ্টা কালোর্ধ বিধায় সদা বর্তমান। ]

অপরিহার্য সত্তার সৃষ্টিকরণের তাৎপর্য

ওপরের আলোচনা থেকে এ বিষয়টিও সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে , অপরিহার্য সত্তার সৃষ্টিকরণরূপ কর্মের তাৎপর্য হচ্ছে তাঁর সৃষ্টিক্ষমতা ও সৃষ্টি-ইচ্ছার সাথে (যা তাঁর সত্তা থেকে স্বতন্ত্র কোনো গুণ নয় , বরং তাঁর সত্তাই) সৃষ্টির সম্পর্ক , যা সৃষ্টির কালগত বৈশিষ্ট্যের বিচারে অতীত ও ভবিষ্যৎ বলে প্রতিভাত হয়। তেমনি সৃষ্টির সাথে সম্পর্কের কারণেও কখনো তা প্রাকৃতিক বিধানরূপে , কখনো অবিলম্বে কার্যকরযোগ্য ইচ্ছারূপে , কখনো বিলম্বে কার্যকরযোগ্য ইচ্ছারূপে , কখনো বিলম্বে কার্যকরযোগ্য সিদ্ধান্তরূপে , কখনো প্রাকৃতিক বিধানে হস্তক্ষেপরূপে , কখনো কতক সৃষ্টির ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতা রূপে এবং কখনো ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতার অধিকারী সৃষ্টির কর্মে হস্তক্ষেপরূপে প্রতিভাত হয়।

অন্যদিকে যা কিছুকে আমরা প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যতিক্রম বলে মনে করি তা-ও ব্যতিক্রম নয়। বরং তা-ও স্রষ্টা কর্তৃক নির্ধারিত ভিন্ন এক ধরনের বিধান বটে , যদিও তা সচরাচর আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে থেকে যায় বিধায় আমাদের জ্ঞান তার স্বরূপ ধরতে পারে না। অন্যথায় মহাবিজ্ঞানময় অপরিহার্য সত্তার সৃষ্টিকরণ ও পরিচালনা ব্যবস্থায় ইতিবাচক নিয়মাবলী বহির্ভূত কোনো কিছু বিচারবুদ্ধির কাছে বোধগম্য হতে পারে না।

সৃষ্টিলোকে অবাঞ্ছিত উপাদানসমূহের অস্তিত্বের তাৎপর্য

এ জগতের বুকে যা কিছু বিরাজমান মানুষ সে সবের মধ্য থেকে কোনো কোনো জিনিসকে তার নিজের জন্য কল্যাণকর দেখতে পায় এবং কোনো কোনো জিনিসকে অকল্যাণকর দেখতে পায়। সৃষ্টিপ্রকৃতিতে বিরাজমান প্রাণীকুল , প্রাণহীন বস্তু ও প্রাকৃতিক কারণ বা বিধিবিধান সমূহের কতককে মানুষ নিজের জন্য ক্ষতিকর , বিপজ্জনক , এমনকি প্রাণঘাতী রূপে দেখতে পায়। বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে তাকে টিকে থাকতে হয়। এ সব সংগ্রামে কখনো তার জয় হয় , কখনো পরাজয় ঘটে , এমনকি অনেক সময় তাকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয়।

অবশ্য স্বয়ং মানুষও মানুষের জন্য অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থা সৃষ্টির কারণ হয়ে থাকে। যেমন: অনেক রোগব্যাধি বংশানুক্রমে পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে প্রবাহিত হয়। পিতা-মাতার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য থেকে সন্তান-সন্ততিও সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের অধিকারী হয়। আবার মানুষ মানুষের ওপর যুলুম-অত্যাচার করে।

প্রাকৃতিক ও মানবিক নির্বিশেষে সমস্ত রকমের অবাঞ্ছিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত কার্যকারণ ও অবস্থা দর্শনে মানুষের মনে সততই এ প্রশ্ন জাগ্রত হয় যে , কেন এ সব কিছু আছে বা হচ্ছে ? সৃষ্টিকর্তা তাঁর সৃষ্টিতে এ সব অবাঞ্ছিত উপাদান , কারণ ও পরিস্থিতি রেখেছেন কী উদ্দেশ্যে ?

এ ধরনের প্রশ্ন থেকে মানুষের মনে বিভিন্ন ধরনের সংশয় জন্ম নেয়। কারো মনে হয় , এসব অসামঞ্জস্যের কারণ হয়তো এই যে , বিশ্বজগতের পিছনে আদৌ কোনো মহাজ্ঞানময় স্রষ্টার অস্তিত্ব নেই , তাই ইচ্ছাশক্তিহীন অন্ধ প্রকৃতির অন্ধ খেয়ালখুশীর পরিণতিতে এ সব কিছু ঘটছে। অন্যদিকে যারা সৃষ্টিপ্রকৃতি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং সৃষ্টিপ্রকৃতির পিছনে একজন মহাজ্ঞানময় স্রষ্টা ও পরিচালকের অস্তিত্ব অনুভব করে তাদের মধ্যেও অনেকে কথিত অসামঞ্জস্যসমূহ লক্ষ্য করে এ উপসংহারে উপনীত হয় যে , সৃষ্টিকর্তা কেবল তাঁর সৃষ্টিকরণজনিত আনন্দের (!?) জন্যই সব কিছু সৃষ্টি করেছেন ; এর পিছনে কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই এবং সৃষ্টির ভালো-মন্দ ও সুখ-দুঃখ তাঁর নিকট কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়।

মানুষের মনে এ সব সংশয়ের উদয় হয় অপরিহার্য সত্তা মহান সৃষ্টিকর্তার সঠিক পরিচয় এবং সৃষ্টিজগৎ ও তার অস্তিত্বের পিছনে নিহিত লক্ষ্য সম্বন্ধে সঠিক ধারণার অভাব থেকে।

সৃষ্টিকর্তা খামখেয়ালিপনা ও উদাসীনতা থেকে প্রমুক্ত

ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , কারণ ও ফলশ্রুতি বিধির অধীন পরিবর্তনশীল এ সৃষ্টিজগৎ এমন একজন সৃষ্টিকর্তা দাবী করে যিনি সকল প্রকার পূর্ণতাবাচক গুণের অধিকারী এবং সকল প্রকার অপূর্ণতা থেকে মুক্ত। অতএব , নিঃসন্দেহে তিনি মহাজ্ঞানময় , আর জ্ঞানময়তার দাবী হচ্ছে উদ্দেশ্যহীন কিছু না করা। খামখেয়ালিপনা ও উদাসীনতা জ্ঞানময়তা ও পূর্ণতার সাথে খাপ খায় না। আর যেহেতু তিনি সব রকমের অভাব ও প্রয়োজন থেকে মুক্ত , অতএব , তাঁর আনন্দ লাভের প্রয়োজন নেই। তাই তিনি আনন্দ লাভের জন্য অথবা উদ্দেশ্যহীনভাবে ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করবেন - এ কথা তাঁর সম্পর্কে কল্পনাও করা যায় না। অতএব , তিনি এমন কিছু করতে পারেন না যার পিছনে কোনো মহান উদ্দেশ্য নিহিত নেই বা চূড়ান্ত বিচারে যাতে সৃষ্টির জন্য কল্যাণ নিহিত নেই।

সকল সৃষ্টি অভিন্ন সৃষ্টিসত্তার অংশ

সৃষ্টিজগতে মানুষ যা কিছু অবাঞ্ছিত দেখতে পায় তার স্বরূপ অনুধাবন করতে হলে কয়েকটি বিষয়কে পটভূমি হিসেবে মনে রাখতে হবে। প্রথমতঃ সৃষ্টিলোকের প্রতিটি সৃষ্টিকে আপতঃদৃষ্টিতে পরস্পর বিচ্ছিন্ন , স্বতন্ত্র সৃষ্টি এবং স্বতন্ত্র উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের অধিকারী বলে মনে হলেও প্রকৃত পক্ষে তা নয়। প্রতিটি সৃষ্টি ব্যক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে স্বতন্ত্র ও নিজস্ব লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের অধিকারী হওয়ার পাশাপাশি সমগ্র সৃষ্টিলোকের একটি অংশ হিসেবে তার ভিন্নতর একটি অবস্থান ও ভূমিকা রয়েছে।

গোটা সৃষ্টিলোক অভিন্ন লক্ষ্যাভিসারী

ওপরে যেমন আভাস দেয়া হয়েছে , গভীর পর্যালোচনার মাধ্যমে বিচারবুদ্ধি এ সত্যে উপনীত হয় যে , আসলে সমগ্র সৃষ্টিলোক অসংখ্য স্বতন্ত্র সত্তার সমষ্টি হওয়ার পাশাপাশি সামগ্রিকভাবে একটি স্বতন্ত্র বৃহত্তর সত্তা। আর এ কারণে প্রতিটি সৃষ্টির নিজস্ব লক্ষ্যের পাশাপাশি স্বভাবতঃই গোটা সৃষ্টিলোকের একটি স্বতন্ত্র বৃহত্তর লক্ষ্য রয়েছে। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে সহযোগিতা করা প্রতিটি সৃষ্টির দায়িত্ব ; তাকে এ জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে এবং জেনে হোক বা না জেনে হোক , সে এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নেই নিয়োজিত রয়েছে। অতএব , সমগ্র সৃষ্টিলোকের চূড়ান্ত লক্ষ্য বাস্তবায়নে তার যে ভূমিকা তা-ই তার মুখ্য ভূমিকা। সুতরাং এ ভূমিকা পালন করতে গিয়ে তার ব্যষ্টিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বা স্বার্থ উৎসর্গ করা অপরিহার্য হয়ে পড়তে পারে এবং অপরিহার্য হয়ে পড়লে তাকে তা-ই করতে হবে। কারণ , এ বৃহত্তর লক্ষ্য বাস্তবায়নে ভূমিকা পালনেই তার অস্তিত্বের সার্থকতা নিহিত।

এ প্রসঙ্গে মানবদেহের উপমা দেয়া যেতে পারে। অসংখ্য লোহিত কণিকা , শ্বেত কণিকা , মাংসকোষ ও অন্যান্য উপাদানে মানবদেহ গঠিত। এমনকি রোগব্যাধির আক্রমণ বা দুর্ঘটনা সংঘটিত না হলেও মানুষের স্বাভাবিক কর্মতৎপরতার কারণেই তার দেহের বহু লোহিত কণিকা , শ্বেত কণিকা ও মাংসকোষ প্রতিনিয়ত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে নতুন নতুন লোহিত কণিকা , শ্বেত কণিকা ও মাংসকোষ সৃষ্টি হচ্ছে। এমতাবস্থায় ধ্বংসপ্রাপ্ত লোহিত কণিকা , শ্বেত কণিকা ও মাংসকোষের ধ্বংস হওয়ার বিষয়টিকে অন্যায় বা অবিচার মনে করা সম্ভব নয়। কারণ , এ সব লোহিত কণিকা , শ্বেত কণিকা ও মাংসকোষের অস্তিত্ব মানুষেরই প্রয়োজনে । আর স্বীয় প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে পরিচালিত মানুষের কর্মতৎপরতার অনিবার্য দাবী হচ্ছে এ সব লোহিত কণিকা , শ্বেত কণিকা ও মাংসকোষের কতকের ধ্বংসপ্রাপ্তি।

এখানে অনুধাবনযোগ্য দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে এই যে , সৃষ্টিলোকের প্রাকৃতিক বিধানসমূহ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং এ সব বিধানের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে সৃষ্টিলোকে বিবর্তন সংঘটিত হচ্ছে যা সৃষ্টিলোককে ক্রমান্বয়ে পূর্ণ থেকে পূর্ণতর অবস্থার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আর মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী যেহেতু এ প্রাকৃতিক জগতেই বসবাস করছে , সেহেতু এ থেকে তাদের ওপর ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে বাধ্য। এমতাবস্থায় সৃষ্টিলোকের চূড়ান্ত লক্ষ্যের জন্য অপরিহার্য প্রাকৃতিক বিধিবিধান ও তার ফলাফল সম্পর্কে আপত্তির কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।

অনুধাবনযোগ্য তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে , প্রাণীকুলের , বিশেষতঃ মানুষের স্বাধীনতা। সৃষ্টিলোকের প্রাকৃতিক বিধিবিধানের প্রতিক্রিয়া প্রাণহীন বস্তুনিচয়ের ওপর যা-ই হোক না কেন , সে ব্যাপারে প্রাণহীন বস্তুর ক্ষেত্রে ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন তোলা যায় না। কারণ , বোধশূন্য বস্তুর লাভ-ক্ষতির প্রশ্নই ওঠে না। এ প্রশ্ন কেবল প্রাণশীল সৃষ্টির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বস্তুতঃ প্রাকৃতিক কার্যকারণের প্রতিক্রিয়া কেবল প্রাণশীল সৃষ্টির জন্যই কল্যাণকর বা অকল্যাণকর হয়ে থাকে। অবশ্য প্রাণীকুল , বিশেষতঃ মানুষ সহজাত বা অর্জিত জ্ঞানের সহায়তায় প্রকৃতির অনেক অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। কিন্তু কারো জন্য অন্য প্রাণী বা অন্য মানুষের পক্ষ থেকে যে ক্ষতিকারকতা উদ্ভূত হয় তা সব সময় সুনির্দিষ্ট প্রাকৃতিক নিয়মের অনুবর্তী নয় এবং এ ধরনের ক্ষতিকারকতাই বিড়ম্বনার উৎস। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির কল্যাণময় লক্ষ্য থাকা সম্বন্ধে যাদের মনে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে তাদের সংশয়ের মূল কারণ এই প্রাণশীল সৃষ্টির ক্ষতিকারকতা। তাদের কথা হচ্ছে , এ সব অকল্যাণকর প্রাণশীল সৃষ্টির অথবা কোনো সৃষ্টির মধ্যকার অকল্যাণকর দিকের (যদিও কল্যাণের পাশাপাশি) কী প্রয়োজন ছিলো ?

প্রাণীকুলের স্বার্থসংঘাত স্বাধীনতার অনিবার্য দাবী

এ প্রশ্নের জবাব পেতে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। প্রথমতঃ প্রাণীকুল , বিশেষ করে মানুষের , প্রাণী বা মানুষ হবার অনিবার্য দাবী হচ্ছে , তার অস্তিত্বরক্ষা ও বিকাশের স্বার্থে তার কিছুটা স্বাধীনতা চাই। কম হোক বা বেশীই হোক , তৎপরতার স্বাধীনতা না থাকলে সে প্রাণী হিসেবেই পরিগণিত হতো না। আর স্বাধীনতার দাবী হচ্ছে , একদিকে বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে , অন্যদিকে প্রাণী ও মানুষের মধ্যে এবং মানুষের পরস্পরের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে। এ সংঘাতের প্রতিক্রিয়াও চূড়ান্ত পরিণতিতে সৃষ্টিলোকের চূড়ান্ত লক্ষ্যে উপনীত হবার পথে সহায়ক।


13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35