বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে মৃত্যুপারের জীবন
মানুষের সামনে বিরাজমান একটি বড় ধরনের জীবনজিজ্ঞাসা হচ্ছে এই যে , মৃত্যুতেই কি প্রাণশীল সৃষ্টির জীবনের সমাপ্তি , নাকি মৃত্যুর পরেও কোনো ধরনের জীবনের অস্তিত্ব রয়েছে ?
এ হচ্ছে এমন একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা যার অভ্রান্ত জবাব না পাওয়া পর্যন্ত কোনো সুস্থ বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ শান্ত হয়ে বসে থাকতে পারে না।
মানুষ হচ্ছে জ্ঞানপিপাসু সৃষ্টি। তাই কোনো প্রশ্নের জবাব উদ্ঘাটন না করে প্রশ্নটিকে পাশে সরিয়ে রেখে নিশ্চিন্ত থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু প্রশ্নটি যদি নেহায়েত জ্ঞানগত অর্থাৎ তথ্য সংক্রান্ত না হয়ে তার নিজের ভালো-মন্দের সাথে জড়িত হয় তাহলে তার জবাব খুঁজে পাওয়া তার জন্য একান্তই অপরিহার্য হয়ে ওঠে।
মৃত্যুর পরে কোনো জীবন থাকা-নাথাকার ওপর মানুষের জীবনের কর্মনীতি বহুলাংশে নির্ভর করে। বিশেষ করে সে জীবনপথে চলতে গিয়ে এমন অনেক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় যখন তার শরীরের চাহিদা ও বিচারবুদ্ধির রায় পরস্পর বিপরীত দিকে ধাবিত হয়। সে যখন অত্যন্ত ক্ষুধার্ত অবস্থায় অন্যের মালিকানাধীন প্রহরাবিহীন ফল-বাগানের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে তখন পাকা ফল দেখে তার ক্ষুন্নিবৃত্তির খুবই ইচ্ছা হয় । কিন্তু তার বিচারবুদ্ধি বলে , চুরি করা অন্যায় ; চুরি করো না। এমতাবস্থায় , মৃত্যুর পরে যদি আর কোনো জীবন না থাকে তাহলে কেবল অন্যায় বলেই চুরি থেকে বিরত থাকা এবং ক্ষুধার কষ্ট সহ্য করার কোনো অর্থ হয় না। শুধু তা-ই নয় , বরং এরূপ অবস্থায় ন্যায়-অন্যায় সংক্রান্ত ধারণা ও নৈতিক বোধ অর্থহীন বলে মনে হবে। তাই সে অবলীলাক্রমে অন্যের বাগানের ফল বিনানুমতিতে ভক্ষণ করে ক্ষুন্নিবৃত্তি করবে। এ অবস্থায় পারিপার্শ্বিকতা থেকে বিপদাশঙ্কা না থাকলে কোনো নৈতিক বোধই তাকে এ কাজ থেকে বিরত রাখতে পারবে না।
কিন্তু যে ব্যক্তি মনে করে যে , মৃত্যুতেই জীবনের সমাপ্তি নয় , বরং মৃত্যু হচ্ছে জীবনেরই ধারাবাহিকতার একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ও অপর একটি অধ্যায়ের সূচনা , সে অবশ্যই পার্থিব জীবনের কাজকর্মের মৃত্যুপরবর্তী জীবনে শুভাশুভ প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনার কারণে সতর্কতার কর্মনীতি অনুসরণ করবে। অর্থাৎ সে তার বিচারবুদ্ধির ন্যায়-অন্যায় সংক্রান্ত রায়ের অনুসরণ করবে , এতে তার যতোই না কষ্ট হোক। বিষয়টি চরম পিপাসার্ত অবস্থায় , বিষমেশানো বলে জানা থাকা , এমনকি বিষমেশানো হবার সন্দেহযুক্ত পানি বর্জনের সাথে তুলনীয়।
মৃত্যুর ওপারে জীবন আছে কিনা এ প্রশ্নের জবাব প্রথমতঃ এই ন্যায়-অন্যায় ও নৈতিকতা বোধের মধ্যেই নিহিত দেখতে পাওয়া যায়। মৃত্যুতেই জীবনের সমাপ্তি ঘটলে ন্যায়-অন্যায় ও নৈতিকতার বোধ একটি অর্থহীন বিষয়ে পরিণত হয়। শুধু তা-ই নয় , এরূপ হলে এ জীবন ও জগতের পিছনে কোনো সৃষ্টিকর্তা আছেন কিনা তার জবাব সন্ধানও অর্থহীন ও অযথা কাজে পরিণত হতে বাধ্য। কারণ , সৃষ্টিকর্তা যদি থাকেনও , যেহেতু এ পার্থিব জীবনে সরাসরি তাঁর নিকট জবাবদিহি করতে হচ্ছে না , এমতাবস্থায় যদি মৃত্যুতেই জীবনের শেষ হয়ে যায় এবং মৃত্যুর পরে সৃষ্টিকর্তার নিকট জবাবদিহি করার সম্ভাবনা না থাকে তাহলে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব থাকা-নাথাকায় কোনোই পার্থক্য ঘটে না।
এরূপ হলে অর্থাৎ মৃত্যুর ওপারে কোনো জীবন না থাকলে এ জীবনে নীতি-নৈতিকতা ও বিবেকবোধ অনুসরণের কোনো প্রয়োজনই থাকে না , বরং এ জীবনে নিরাপত্তা ও সতর্কতার নীতি অনুসরণই যথেষ্ট। অর্থাৎ মানুষ কেবল এ জন্য চুরি থেকে বিরত থাকবে যে , চুরি করলে এবং সংশ্লিষ্ট জিনিসের মালিক তা জানতে পারলে তার সাথে সংঘাত হবে এবং পারস্পরিক স্বার্থে সহযোগিতার নীতি অনুসরণে অন্যরাও মালিকের পাশে এসে দাঁড়াবে ও চোরকে শাস্তি দেবে। কিন্তু তার বিচারবুদ্ধি চুরিকে অন্যায় বলবে না এবং চুরি প্রকাশ পেলে সে বিব্রত বা লজ্জা বোধ করবে না। বরং বিব্রতবোধ করা ও লজ্জা পাওয়ার ন্যায় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোই তার মধ্য থেকে উঠে যাবে। এমতাবস্থায় ঝুঁকি না থাকলে স্বীয় প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে , শুধু প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে কেন , বরং অপরিহার্য প্রয়োজন না থাকলেও কেবল অতিরিক্ত আরাম-আয়েশ লাভ ও অনেক বেশী ধন-সম্পদের মালিক হবার জন্যে , সে অবশ্যই চুরি করবে।
কিন্তু আমরা দেখতে পাই , বিচারবুদ্ধি চুরিকে অন্যায় বলে রায় দেয় এবং চুরি প্রকাশ পেলে , এমনকি শাস্তির ঝুঁকি না থাকলেও মানুষ লজ্জা পায় ও বিব্রত বোধ করে। অন্যদিকে আমরা দেখতে পাই , বিচারবুদ্ধি যতো কাজকে অন্যায় বলে রায় দেয় তার সবগুলোর প্রতিফল পার্থিব জীবনে প্রকাশ পায় না এবং যেগুলোর প্রতিফল প্রকাশ পায় তা-ও সাধারণতঃ পূর্ণ মাত্রায় প্রকাশ পায় না। তেমনি বিচারবুদ্ধি যতো কাজকে ভালো ও উচিত বলে রায় দেয় পার্থিব জীবনে তার সবগুলোর প্রতিফল প্রকাশ পায় না এবং যে সব কাজের প্রতিফল প্রকাশ পায় তা-ও সাধারণতঃ পূর্ণ মাত্রায় প্রকাশ পায় না। এমতাবস্থায় এটাই মানবমনের আকাঙ্ক্ষা তথা মানবপ্রকৃতির দাবী যে , এ পার্থিব জীবনে না হলেও , মৃত্যুর পরে হলেও ন্যায়-অন্যায় ও ভালো-মন্দের শুভাশুভ প্রতিফল প্রকাশিত হোক।
মৃত্যুর পরে যদি কোনো জীবন না-ই থাকবে তাহলে মানুষের মধ্যে ভালো-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায়ের অনুভূতি না থাকাই উচিত ছিলো , অথবা এরূপ অনুভূতি থাকার পাশাপাশি এ পার্থিব জীবনে তার পূর্ণ প্রতিফল প্রকাশ পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকা উচিত ছিলো। কিন্তু বাস্তবে যখন এর কোনোটাই হয় নি তখন মৃত্যুর পরে ন্যায়-অন্যায় ও ভালো-মন্দের শুভাশুভ প্রতিফল প্রকাশ পাওয়া অপরিহার্য। যদি তা না হয় , তাহলে বলতে হবে যে , স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির প্রতি অন্যায় করেছেন বা তার সাথে প্রতারণা করেছেন অথবা তিনি বুঝতে পারেন নি যে , তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্যে কী ধরনের অনুভূতি দিয়েছেন ও সৃষ্টির সহজাত অনুভূতির দাবী পূরণের জন্য কী করা উচিত ছিলো।
বলা বাহুল্য যে , কোনো স্রষ্টার মধ্যে এরূপ বৈশিষ্ট্য থাকা মানে হচ্ছে সে স্রষ্টা দুর্বল ও অপূর্ণ। পরম পূর্ণতার অধিকারী অপরিহার্য সত্তা এ ধরনের দুর্বলতা ও অপূর্ণতা থেকে প্রমুক্ত। অতএব , এতে সন্দেহের অবকাশ নেই যে , ভালো-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায়ের অনুভূতি এবং পার্থিব জীবনে এর ফলাফল পুরোপুরি প্রকাশ না পাওয়ার অনিবার্য দাবী হচ্ছে , মুত্যুর পরে এ পার্থিব জগতে অপ্রকাশিত ফলাফল প্রকাশ পাওয়া ও অপূর্ণভাবে প্রকাশিত ফলাফল পরিপূর্ণরূপে প্রকাশ পাওয়া।
মৃত্যুতেই প্রাণশীল সৃষ্টির অস্তিত্বের সমাপ্তি ঘটা অপরিহার্য সত্তা সৃষ্টিকর্তার প্রজ্ঞা ও শক্তির দাবীর বরখেলাফ। কোনো সৃষ্টির সূচনা করে তাকে পূর্ণতায় উপনীত না করে মাঝপথে সমাপ্ত করা খেয়ালী , অজ্ঞ বা অক্ষম স্রষ্টার বৈশিষ্ট্য ; পরম পূর্ণতার অধিকারী অপরিহার্য সত্তা এ ধরনের দুর্বলতা থেকে মুক্ত ।
মানুষ ও অন্যান্য প্রাণশীল সৃষ্টিকে কেন সৃষ্টি করা হয়েছে ? আমরা দেখি , মানুষ জন্মগ্রহণ করে , লালিত-পালিত হয় , বড় হয় , জ্ঞানার্জন করে , খানাপিনা করে , বিশ্রাম করে , নিদ্রা যায় , ধরণীর বুকে বিভিন্ন ধরনের কাজকর্ম করে , পরোপকার করে ইত্যাদি। কিন্তু এখানে অনেক নেতিবাচক দিক আছে। এখানে আছে ঝগড়া-ফাসাদ , যুদ্ধ-বিগ্রহ , চুরি-ডাকাতি , অন্য অনেক ধরনের অন্যায়-অপরাধ। এছাড়া আছে প্রাকৃতিক বিপর্যয় , আছে দুঃখ-কষ্ট ও লাঞ্ছনা-গঞ্জনা। তার অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ থেকে যায় , অনেক ভালো কাজ পুরষ্কারবিহীন থেকে যায়। তারপর একদিন মৃত্যু এসে তাকে গ্রাস করে। প্রশ্ন হচ্ছে , কেন তাকে সৃষ্টি করা হলো ? কেবল খাওয়া-পরা , প্রজনন ও একদিন মরে যাওয়া - এ জন্য কি ? তাকে সৃষ্টির পিছনে কি কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নেই ? তাহলে তাকে যে দুঃখ-কষ্ট ও অন্যায়-অত্যাচারের মুখোমুখি করা হলো তার উদ্দেশ্য কী ? পরম পূর্ণতার অধিকারী স্রষ্টা এরূপ অযৌক্তিক কাজ করতে পারেন কি ?
আমরা অবশ্য মৃত্যুর ওপারে কী আছে তা জানি না । অর্থাৎ আমাদের অভিজ্ঞতা বা বিচারবুদ্ধি আমাদেরকে এ ব্যাপারে নিশ্চিত জ্ঞান দিতে সক্ষম নয়। কারণ , আমাদের যাত্রা একমুখী। আমরা যারা মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়ে পার্থিব জীবনে রয়েছি তারা যেমন আর মাতৃগর্ভে ফিরে যেতে পারছি না , তেমনি যারা মৃত্যুবরণ করেছে তাদের কেউ ফিরে এসে বলতে পারছে না মৃত্যুর ওপারে কী আছে বা আদৌ কিছু আছে কিনা।
এ যেন পার্থিব জীবন সম্পর্কে মাতৃগর্ভস্থ ভ্রুণের ধারণা। ধরুন , কোনো মাতৃগর্ভে একবারে কয়েকটি ভ্রুণের সৃষ্টি হলো এবং তাদের বিকাশ হতে থাকলো। এক সময় একটি পূর্ণ বিকশিত ভ্রুণ বা শিশু মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে গেলো , আর ফিরলো না। দু’
ঘণ্টা পর আরো একটি ভ্রুণ বা শিশু বেরিয়ে গেলো ; সে-ও ফিরলো না। তখন সেখানে অবস্থানরত অপর একটি বা দু’
টি ভ্রুণ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলো:“
আমরা এখানে অস্তিত্বলাভ করি , পুষ্টি লাভ করি , বিকাশপ্রাপ্ত হই , তারপর এখান থেকে বেরিয়ে যাই এবং আর ফিরে আসি না ; সুতরাং এটাই সত্য যে , এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়েই আমাদের অস্তিত্বের সমাপ্তি।”
মৃত্যুতে আমাদের অস্তিত্বের সমাপ্তি বলে ধারণা করা ভ্রুণের কল্পিত ধারণার সমতুল্য - যা নেহায়েতই হাস্যকর।
মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসাতেই যদি ভ্রুণের অস্তিত্বের সমাপ্তি ঘটতো তাহলে ভ্রুণের জীবন অর্থাৎ তার অস্তিত্বলাভ ও বিকাশ এবং মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসা পর্যন্তকার জীবন হতো যেমন অসম্পূর্ণ জীবন , তেমনি তা হতো অর্থহীন। পরম প্রজ্ঞাময় স্রষ্টা অর্থহীন অসম্পূর্ণ জীবন সৃষ্টি করবেন এটা ভাবাও যায় না। পার্থিব জীবনের পর মৃত্যুতে জীবনের সমাপ্তি হলে তা-ও অনুরূপ। বরং তা শুধু অর্থহীন নয় , অন্যায় বলেও মনে হয়। কারণ , একটি মানুষ কারণ ও ফলশ্রুতি বিধির এ দুনিয়ায় বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে পথ চলে যখন পঞ্চাশ , ষাট বা একশ’
বছরের জীবনে বেশ কিছুটা শিক্ষা গ্রহণ করেছে ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে তখন মৃত্যু এসে তাকে গ্রাস করে নিলো এবং তার অস্তিত্বকে নিশ্চিহ্ন করে দিলো। বিচারবুদ্ধি এ নিশ্চিহ্নতাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। এটা খুবই অন্যায় হবে যদি না মৃত্যুর পরেও জীবনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে , ঠিক যেভাবে ভ্রুণের মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসার পরেও জীবনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে।
তাছাড়া মানুষের সত্তার ভিতরেই জীবন বিলুপ্ত না হওয়ার ও অব্যাহত থাকার কামনা নিহিত রয়েছে। এ কামনা সর্বজনীন। মানুষের সৃষ্টিপ্রকৃতিতে যতো রকমের সহজাত কামনা-বাসনা ও চাহিদা রয়েছে তার সব কিছুই পূরণের ব্যবস্থা রয়েছে। তার ক্ষুধার জন্য খাদ্য , তৃষ্ণার জন্য পানি , দেখার জন্য সুন্দর ও মনোরম দৃশ্যাবলী , শোনার জন্য সুমিষ্ট ধ্বনি ও সুর , ঘ্রাণ নেয়ার জন্য সুগন্ধি , স্বাদ গ্রহণের জন্য সুস্বাদু উপাদান , স্পর্শ করার জন্য মোলায়েম বা আরামদায়ক বস্তু - সবই মওজূদ রয়েছে। তার মধ্যে সহজাতভাবে যতো কিছুর আশা-আকাঙ্ক্ষা ও কামনা-বাসনা আছে তার সব কিছুই পূরণের নিশ্চিত ব্যবস্থা রয়েছে। জন্মের পর বয়সের একটি সুনির্দিষ্ট স্তরে এসে পুরুষ নারীসংসর্গ কামনা করে এবং নারী পুরুষসংসর্গ কামনা করে। মহান স্রষ্টা মানুষের মধ্যে এ ধরনের কামনা সৃষ্টি করেছেন এবং তা পূরণেরও ব্যবস্থা রেখেছেন।
এ থেকে বিচারবুদ্ধি এ উপসংহারে উপনীত হয় যে , কোনো আশা-আকাঙ্ক্ষা বা কামনা-বাসনা পূরণের ব্যবস্থা না রাখলে সৃষ্টিকর্তা সে আশা-আকাঙ্ক্ষা বা কামনা-বাসনা সৃষ্টিই করতেন না। বলা বাহুল্য যে , মানবপ্রকৃতিতে নিহিত আশা-আকাঙ্ক্ষা ও কামনা-বাসনা সমূহের মধ্যে সর্বাধিক প্রবল হচ্ছে জীবন অব্যাহত রাখার আকাঙ্ক্ষা। এ আকাঙ্ক্ষা যদি অপূর্ণ থাকবে , তাহলে কেন তার মধ্যে এ আকাঙ্ক্ষা দেয়া হলো ? এরূপ হলে তা বড়ই অন্যায় হবে - যা পরম পূর্ণতার অধিকারী স্রষ্টার জন্য কল্পনাও করা যায় না।
বাস্তবেও দেখা যায় , যারা মৃত্যুতেই জীবনের সমাপ্তি বলে মনে করে তারা চরম হতাশার শিকার হয়। তাদের কাছে জীবনটা অর্থহীন বলে মনে হয়। এমনকি এ হতাশা অনেককে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে। কারণ , মৃত্যুতেই যে জীবনের সমাপ্তি সে জীবনকে বাঁচিয়ে রেখে লাভ কী ? বিলুপ্তিই যদি জীবনের পরিণতি হয় , তো খাওয়া-পরা , ভোগ-আনন্দের জন্য জীবন অব্যাহত রাখার সার্থকতা কী ?
জীবনে সুখ , আনন্দ ও ভোগ যেমন আছে , তেমনি আছে দুঃখ-কষ্ট , ব্যথা-বেদনা , অশান্তি , ঝুঁকি , নিরাপত্তাহীনতা। সামান্য ভোগ-আনন্দ লাভের জন্য এতো সব ঝক্কি পোহানোর কি কোনো মানে হয় ? কোনো কঠিন পরিস্থিতির কারণে নয় , কেবল এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণের কারণেও অনেকে আত্মহত্যা করে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ঝুঁকিবিহীন জীবনের অধিকারী লোকেরাও মৃত্যুতে জীবনের বিলুপ্তি গণ্য করায় জীবনকে অর্থহীন ও উদ্দেশ্যবিহীন অনুভব করে চরম হতাশার শিকার হয়ে আত্মহত্যার আশ্রয় নিয়ে থাকে।
বলা বাহুল্য যে , এ ধরনের আত্মহত্যাও এটাই প্রমাণ করে যে , মানবপ্রকৃতিতে জীবন অব্যাহত থাকার আকাঙ্ক্ষা বিদ্যমান। কিন্তু ভ্রান্ত শিক্ষার ফলে তার মনে মৃত্যুতে জীবনের বিলুপ্তির ধারণা গড়ে ওঠায় সে তার প্রকৃতিতে নিহিত আকাঙ্ক্ষা পূরণের পথ রুদ্ধ দেখতে পেয়ে হতাশার শিকার হয়ে আত্মহত্যা করে।
অতএব , মানবপ্রকৃতিতে নিহিত জীবনের ধারাবাহিকতার আকাঙ্ক্ষার দাবী হচ্ছে এই যে , সৃষ্টিকর্তা যখন মানুষের মাঝে এরূপ আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করেছেন তখন তিনি তা অবশ্যই পূরণ করবেন।
মানবপ্রকৃতিতে নিহিত ন্যায়নীতির অনুভূতি এবং ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষাও মৃত্যুর পরে জীবন অব্যাহত থাকার দাবীদার।
মানুষের প্রকৃতি একদিকে যেমন কোনো রকম যুলুম-অত্যাচারের শিকার হওয়া পসন্দ করে না , তেমনি ভালো কাজ ও ত্যাগ স্বীকারের বিনিময়ে শুভ প্রতিদান কামনা করে। কিন্তু কারণ ও ফলশ্রুতি বিধির আওতাধীন পার্থিব জগতে সব সময় তার প্রতিফলন ঘটে না। এখানে মানুষ তার স্বাধীনতার অপব্যবহার করে অন্যের ওপর যুলুম-অত্যাচার করে , কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই যালেম শাস্তির সম্মুখীন হয় না। ফলে মযলূম সব সময়ই যালেমের শাস্তি কামনা করতে থাকে। অন্যদিকে অনেক সময় ভালো কাজ ও ত্যাগ স্বীকারের বিনিময়ে শুভ ফল পাওয়া তো দূরের কথা , উল্টো লাঞ্ছনা-গঞ্জনার শিকার হতে হয়।
যুলুম-অত্যাচার শাস্তিবিহীন চলে যাবে এবং ভালো কাজ পুরষ্কারবিহীন থেকে যাবে - মানুষের মন এটা মানতে পারে না। সে এ কামনাই করে যে , সৃষ্টিকর্তা যেন ঘটনাবলীকে নিয়ন্ত্রণ করে এমন এক দিকে প্রবাহিত করেন যার ফলে বিলম্বে হলেও সে যেন তার ভালো কাজের শুভ প্রতিদান পায় এবং যালেম তার যুলুমের শাস্তি ভোগ করে ; সে তো প্রতিশোধ নিতে পারলো না , সৃষ্টিকর্তা যেন তার পক্ষ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করেন। কিন্তু এ আশায় আশায় তার দিন কেটে যায় , তারপর এক সময় যালেম স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করে দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়। তখন সে (মযলূম) কামনা করে , দুনিয়ার বুকে তো যালেমের শাস্তি হলো না , মৃত্যুতে যেন তার অস্তিত্বের সমাপ্তি না ঘটে ; মৃত্যুর পরে আরেক জগতে হলেও যেন সৃষ্টিকর্তা তাকে শাস্তি দেন। তেমনি যে ব্যক্তি ভালো কাজের শুভ প্রতিদান পাবার আগেই মৃত্যু এসে তাকে গ্রাস করছে , সে কামনা করে , মৃত্যুর পরে অন্য জগতে হলেও সৃষ্টিকর্তা যেন তাকে শুভ প্রতিদান প্রদান করেন। সৃষ্টিকর্তা তো সহজেই তা করতে পারেন ; তাহলে কেন করবেন না ? অবশ্যই করবেন - এটাই তার বিচারবুদ্ধিজাত প্রত্যয়।
অন্যায়ের শাস্তি ও ভালো কাজের পুরষ্কারের সুশৃঙ্খল ব্যবস্থার দৃষ্টান্ত স্বয়ং মানুষের সত্তার মধ্যেও নিহিত রয়েছে। মানুষ কোনো ভালো কাজ সম্পাদন করতে পারলে , বাইরে সে জন্য প্রশংসা ও পুরষ্কার না পেলেও , সে তার অন্তরে এক ধরনের অনাবিল আনন্দ , পরিতৃপ্তি ও প্রশান্তি অনুভব করে।
অন্যদিকে অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধ করার পর মানুষ আত্মগ্লানি অনুভব করে , যদি না তার মানবিক সত্তা পুরোপুরি বিকৃত হয়ে পশুসত্তায় বা তার চেয়েও নিকৃষ্টতর সত্তায় পরিণত হয়ে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে তার আত্মগ্লানির যন্ত্রণা এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয় যে , সে তা থেকে বাঁচার জন্য আত্মহত্যা করে।
আমরা লক্ষ্য করি যে , প্রাকৃতিক বিধিবিধান (যেমন , স্বাস্থ্যবিধি) ও সহজাত নৈতিক বিধান লঙ্ঘন ও মেনে চলার কারণে মানুষের ক্ষুদ্র দেহের ব্যবস্থাপনার মধ্যেও এক ধরনের শাস্তি ও পুরস্কারের নিখুঁত ব্যবস্থা রয়েছে। এমতাবস্থায় গোটা সৃষ্টিলোকের বিশাল ব্যবস্থাপনায় শাস্তি ও পুরস্কারের একটি নিখুঁত ব্যবস্থা থাকবে না - এটা কী করে সম্ভব ? কারণ , মানুষের সত্তায় শাস্তি ও পুরষ্কারের এক নিখুঁত ব্যবস্থা আছে বটে , তবে তাতে মানুষের ন্যায়বিচারের দাবী পুরোপুরি পূরণ হচ্ছে না।
মানুষ দেহ ও আত্মার সমন্বিত রূপ। মানুষ ভালো-মন্দ যে কাজ করে তাতে তার দেহ ও আত্মা বা ব্যক্তিসত্তা উভয়ই জড়িত। পার্থিব জীবনে মানুষ যে শাস্তি ও পুরষ্কার লাভ করে তা তার দেহ ও আত্মা উভয়ই ভোগ করে থাকে। তাই মযলূম ব্যক্তি দেহ ও মনে যে যুলুমের শিকার হয়েছে , তার প্রতিদানে যালেমের পার্থিব জীবনের মানসিক অশান্তিরূপ শাস্তিতে সে সন্তুষ্ট নয়। বিশেষ করে , পার্থিব জগতের আদালতে যখন কোনো যালেমের শাস্তি হয় তখন তা শারীরিক ও মানসিক উভয়ভাবেই হয়ে থাকে । এমতাবস্থায় তার ওপর যে ব্যক্তি যুলুম করেছে তার শাস্তি শারীরিকভাবে না হলে , কেবল মানসিক বা আত্মিকভাবে হলে মযলূম ব্যক্তি অনুভব করবে যে , তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বিশেষ করে যালেম সত্যি সত্যিই মানসিক শাস্তি ভোগ করছে কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া মযলূমের পক্ষে সম্ভব নয়। কেবল শারীরিক শাস্তি দেখেই তার পক্ষে বুঝতে পারা সম্ভব যে , যালেম মানসিক শাস্তিও ভোগ করছে। তাই পার্থিব জীবনে যালেমের শারীরিক শাস্তি না হলে মৃত্যুর পরে অন্য কোনো জগতে তার শারীরিক শাস্তি হোক - মযলূম এটাই কামনা করে।
ভালো কাজের পুরষ্কারের ক্ষেত্রেও মানুষের কামনা একই ধরনের। ভালো কাজ সম্পাদনকারীদের মধ্য থেকে কেউ কেউ যেখানে মানসিক পরিতৃপ্তি ছাড়াও পার্থিব শুভ ফলও পেয়েছে - যে শুভ ফল তাদের জন্য শারীরিক আনন্দ ছাড়াও আরো এক দফা মানসিক পরিতৃপ্তি নিয়ে এসেছে , সে ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি ভালো কাজ সম্পাদন করে কেবল মানসিক পরিতৃপ্তি পেয়েছে , পার্থিব পুরষ্কার ও তজ্জনিত শারীরিক-মানসিক পরিতৃপ্তি পায় নি , সে নিজেকে বঞ্চিত অনুভব করতে বাধ্য। সে অবশ্যই চায় , মৃত্যুর পরে অন্য জগতে হলেও , তার এ বঞ্চনার প্রতিকার হোক।
এছাড়া পার্থিব জগতের শাস্তি ও পুরষ্কার শতকরা একশ’
ভাগ যথাযথ হওয়া সম্ভব নয়। যে ব্যক্তি একশ’
জন লোককে হত্যা করেছে তাকে দুনিয়ার আদালত মাত্র একবারই মৃত্যুদণ্ড দিতে পারবে। তাই ভালো ও মন্দ কাজের‘
যথাযথ প্রতিদান’
দেয়ার জন্যও আরেকটি জগত থাকা অপরিহার্য।
মানুষের সহজাত প্রবণতাসমূহের অন্যতম হচ্ছে জানার প্রবণতা , সত্য উদ্ঘাটনের প্রবণতা , জীবন ও জগতের ছোট-বড় সকল রহস্যের দ্বারোদ্ঘাটনের আকাঙ্ক্ষা। এ আকাঙ্ক্ষা দৈহিক ভোগ-আকাঙ্ক্ষার চেয়েও তীব্র ও শক্তিশালী। কিন্তু পার্থিব জগতে তার এ আকাঙ্ক্ষা বেশীর ভাগই অপূর্ণ থেকে যায়। সে চায় , সমস্ত সত্য তার নিকট প্রকাশিত হোক , সব কিছুর ওপর থেকে রহস্যের পর্দা অপসারিত হয়ে যাক । কিন্তু তা হয় না। এ কারণে তার অস্থিরতা , আফসোস ও মনঃপীড়ার অন্ত নেই।
এছাড়া জীবন ও জগতের অনেক বিষয় সম্বন্ধে মানুষের কাছে পরস্পর বিরোধী ধারণা আসে। তাই সে জানতে চায় , কোনটি সত্য ? নাকি এর কোনোটিই সত্য নয় , বরং তৃতীয় কোনো কিছু সত্য যা সকলের কাছেই অজ্ঞাত ? তার মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় , তার বন্ধু , স্বামী বা স্ত্রী তার সাথে কপটতা বা বিশ্বাসঘাতকতা করছে না তো ? সারাটি জীবন অভিনয় করে কাটিয়ে দেয় নি তো ? আহা! অমুকের অন্তরের অবস্থাটি যদি নির্ভুলভাবে পর্যবেক্ষণ করা যেতো! আপাততঃ যে সব সত্য অপ্রকাশিত বা সন্দেহের আবরণে আবৃত রয়েছে তা কি কোনোদিন প্রকাশিত হবে না ? সৃষ্টিকর্তা কি তার এ পিপাসার নিবৃত্তি করবেন না ? দৈহিক পিপাসা নিবৃত্তির ব্যবস্থা তো রয়েছে ; এ জ্ঞানপিপাসার নিবৃত্তি কি কখনোই হবে না ?
মানবমনের আকাঙ্ক্ষা , এ জীবনে তো বিতর্কের ফয়সালা হলো না ; মৃত্যুর পরে হলেও যেন এর ফয়সালা হয় এবং সে সঠিক বিষয়টি জানতে পারে। এ জীবনে জ্ঞানপিপাসার নিবৃত্তি হলো না ; মৃত্যুর পরে হলেও যেন এর নিবৃত্তি হয়। পরম ক্ষমতাবান স্রষ্টা তো তা করতে সক্ষম ; তাহলে কেন তিনি তা করবেন না ? অবশ্যই করবেন। নইলে তিনি মানবপ্রকৃতিতে এ সীমাহীন জ্ঞানপিপাসা দিলেন কেন ? এমন দুর্বার পিপাসা , যার চাপ সহ্য করা বড়ই কঠিন ; নিঃসন্দেহে তিনি তার নিবৃত্তি ঘটাবেন , নইলে এ পিপাসা দিয়ে তিনি মানুষকে কষ্ট দিতেন না।