মানুষ বিশেষ পথনির্দেশের মুখাপেক্ষী
আমরা জানি যে , মানুষ অন্যান্য প্রাণী প্রজাতির ন্যায় বেঁচে থাকা ও বিকাশের জন্য স্রষ্টা প্রদত্ত সহজাত পথনির্দেশের অধিকারী। এছাড়াও ভালো-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায়ের জ্ঞানও সে সহজাত পথনির্দেশের মাধ্যমে পেয়ে থাকে। কিন্তু মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীপ্রজাতির মধ্যকার একটি মৌলিক পার্থক্য এই যে , তার জন্য পথনির্দেশের ক্ষেত্র ও প্রয়োজন অনেক বেশী , কিন্তু সে অনুপাতে তার প্রাপ্ত সহজাত পথনির্দেশের পরিমাণ ও মাত্রা অপেক্ষাকৃত কম। তবে সহজাত পথনির্দেশ বিহীন এই ক্ষেত্রগুলোতে পথনির্দেশ গ্রহণের জন্য তার মধ্যে বিরাট সম্ভাবনা নিহিত রাখা হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ , বাবুই পাখীর আশ্রয়ের জন্য যে ধরনের গৃহের (বাসার) প্রয়োজন সহজাতভাবেই সে তা তৈরীর জ্ঞানের অধিকারী। এ ক্ষেত্রে কোনো বাবুই পাখীই ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু মানবসন্তান সহজাতভাবে এরূপ বা অন্য কোনো ধরনের একটি শিল্পগুণ সমৃদ্ধ বাসগৃহ তৈরীর সহজাত জ্ঞানের অধিকারী নয়। তবে তার মধ্যে বিভিন্ন ও বিচিত্র ধরনের গৃহ নির্মাণের কৌশল আয়ত্ত করার সম্ভাবনা (প্রতিভা) নিহিত রয়েছে। সে গৃহনির্মাণের কৌশল শিক্ষা করে এবং বিচিত্র ধরনের গৃহ তৈরী করে ; বাবুই পাখীর মতো শুধু এক ধরনের গৃহ নির্মাণ করে না। অন্যদিকে গৃহনির্মাণ জ্ঞানের ক্ষেত্রে সব বাবুই পাখী অভিন্ন হলেও এ ক্ষেত্রে সকল মানুষ সমান নয়। বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন ধরনের গৃহ নির্মাণ করতে সক্ষম ; সকলে সকল ধরনের গৃহ নির্মাণ করতে সক্ষম নয়। অন্যান্য শিল্প ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও একই কথা।
এখানে প্রণিধানযোগ্য বিষয় এই যে , মানুষ তার মধ্যে নিহিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন শিল্প ও জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা করে এবং আগ্রহ , ঝোঁকপ্রবণতা , মনোযোগ , নিষ্ঠা ও সুযোগ-সুবিধার পার্থক্যের কারণে এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন লোকের মধ্যে পার্থক্য ঘটে থাকে। কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে , যে কোনো শিল্প বা জ্ঞানের প্রথম উদ্ভাবক অন্য কোনো মানুষের কাছ থেকে তা শিখে নি। তাহলে সে তা পেলো কোথায় ? এ ক্ষেত্রে সে দু’
টি সূত্র থেকে তা পেতে পারে: হয় বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে চিন্তাগবেষণার মাধ্যমে , নয়তো সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে প্রদত্ত পথনির্দেশের মাধ্যমে। দ্বিতীয়োক্ত ক্ষেত্রে অনেক সময় সে বুঝতেও পারে না যে , সে সৃষ্টিকর্তার নিকট থেকে পথনির্দেশ পাচ্ছে।
মানব জাতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান ও আবিষ্কার-উদ্ভাবনের সূচনার ইতিহাস হচ্ছে এরূপ যে , ব্যক্তি তা স্বপ্নে দেখেছে অথবা সহসাই তার মনে বিষয়টি খেলে গেছে - যার পিছনে কোনো পার্থিব কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এমতাবস্থায় তা যে সৃষ্টিকর্তার পথনির্দেশ তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।
এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় এই যে , এ ধরনের পথনির্দেশ সকল মানুষের কাছে আসে না। একেকটি বিষয়ের পথনির্দেশ একজন বা দু’
জন লাভ করেন এবং তারা তা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেন। এভাবে গোটা মানবজাতি তা থেকে উপকৃত হতে পারে।
বস্তুতঃ একেকটি বিষয়বস্তুর বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণেই এরূপ ঘটে থাকে। অর্থাৎ প্রতিটি মানুষের নিকট এ ধরনের পথনির্দেশ আসা যরূরী নয় ; একজনের কাছে আসা এবং অন্যদের তার কাছ থেকে শিখে নেয়াই যথেষ্ট। অন্যথায় প্রতিটি মানুষকে এ ধরনের পথনির্দেশ দেয়া হলে প্রথম মানুষ থেকে শুরু করে অনাগত ভবিষ্যতের শেষ মানুষটি পর্যন্ত প্রত্যেকের নিকটই‘
সকল’
জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আবিষ্কার-উদ্ভাবনের পথনির্দেশ আসতে হতো। তাহলে আর একে জ্ঞান-বিজ্ঞান বা আবিষ্কার-উদ্ভাবন বলা যেতো না , বরং বলতে হতো সহজাত জ্ঞান। সে ক্ষেত্রে মানবজাতির সদস্যদের মধ্যে জ্ঞানসাধনা ও অধ্যবসায় বলতে কিছু থাকতো না ; তাদের কাজের মধ্যে তেমন কোনো বৈচিত্র্যও থাকতো না। তাদের ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে তেমন কোনো গুণগত পার্থক্য থাকতো না। কারণ , সে ক্ষেত্রে , বিশেষ অর্থে মানুষ যে স্বাধীনতার অধিকারী , তার তা থাকতো না। তার স্বাধীনতা হতো পশুপাখীর স্বাধীনতার সমতুল্য। সে পরিণত হতো জৈবিক যন্ত্রে। এ অবস্থায় মেধা-প্রতিভা , জ্ঞান , জ্ঞানের বিকাশ , জ্ঞানচর্চা , অধ্যবসায় ইত্যাদি বলতে কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকতো না।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা এ উপসংহারে উপনীত হতে পারি যে , মানবপ্রজাতি যে সর্বজনীন সহজাত পথনির্দেশের অধিকারী তার বাইরে মানবজীবনের এমন সব ক্ষেত্র রয়েছে যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং যে জন্য পথনির্দেশের প্রয়োজন রয়েছে। তবে এ পথনির্দেশ সর্বজনীন হওয়া প্রয়োজন বা বাঞ্ছনীয় নয়। বরং এটাই স্বাভাবিক যে , কিছু লোক এ ধরনের পথনির্দেশ লাভ করবেন এবং অন্যদেরকে তা পৌঁছে দেবেন বা শিক্ষা দেবেন।
মানুষের জন্য এ ধরনের বিশেষ পথনির্দেশের প্রয়োজন কেবল শিল্প , বস্তুবিজ্ঞান ও তদসংক্রান্ত আবিষ্কার-উদ্ভাবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং সামাজিক , রাজনৈতিক ও নৈতিক ক্ষেত্রে এর অধিকতর প্রয়োজন। বলা চলে যে , যদিও শিল্প , বস্তুবিজ্ঞান ও তদসংক্রান্ত আবিষ্কার-উদ্ভাবন সম্পর্কিত পথনির্দেশ খুবই কাম্য , তথাপি তা না পেলেও খুব বড় ধরনের ক্ষতি নেই। কারণ , মানুষ যদি বাড়ীঘর ও সভ্যতার উপকরণ নির্মাণ করতে না জানতো , চিকিৎসা শাস্ত্রের বিকাশ ঘটাতে না পারতো , শিল্প ও কলা সৃষ্টি করতে না পারতো , বরং বনে-জঙ্গলে , পাহাড়-পর্বতে , গাছের ডালে/ নীচে/ কোটরে বা পাহাড়ের গুহায় বসবাস করতো , বুনো ফল-শাকসব্জি ও কাঁচা মাছ-মাংস খেতো এবং রোদ-বৃষ্টি , হিংস্র বন্য প্রাণী ও রোগব্যাধির কারণে স্বল্পজীবী হতো ; তাতে তার তেমন কোনো ক্ষতি হতো না। কারণ , শেষ পর্যন্ত তো তাকে মৃত্যুবরণ করতেই হয়। অতএব , তার আয়ু বিশ বছর , নাকি বিশ হাজার বছর তাতে তেমন কোনো পার্থক্য হতো না।
কিন্তু মানুষ যখন জানে যে , তার জন্য মৃত্যুর পরে এক অনন্ত জীবন অপেক্ষা করছে যেখানে তাকে ভালো-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায়ের পরিপূর্ণ প্রতিফল ভোগ করতে হবে , তখন তার জন্য সামষ্টিক জীবনে সঠিক আচরণ তথা অন্যদের অধিকার বিনষ্ট না করা , বরং তার ওপর অন্যদের যে অধিকার রয়েছে তা যথাযথভাবে আদায় করা অপরিহার্য। কিন্তু এ ব্যাপারে তার মধ্যে যে সহজাত পথনির্দেশ রয়েছে তাকে সে যথেষ্ট মনে করে না।
মানুষের এ বিশেষ পথনির্দেশের প্রয়োজনীয়তা কতোগুলো ক্ষেত্রে খুবই প্রকট হয়ে ধরা পড়ে। যেমন: মানুষের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের প্রয়োজন। প্রকৃতিতে পান ও ভক্ষণের উপযোগী অনেক কিছু রয়েছে এবং মানুষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে প্রাকৃতিক উপাদানের দ্বারা নতুন নতুন কৃত্রিম বা যৌগিক খাদ্য-পানীয় প্রস্তুত করতে পারে। কিন্তু কতক খাদ্য-পানীয় তার শরীর , মন ও চরিত্রের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে এর ক্ষতিকারকতা অত্যন্ত দেরীতে প্রকাশ পেতে পারে এবং তার প্রভাব অত্যন্ত দীর্ঘ মেয়াদী , এমনকি পুরুষানুক্রমে বিস্তৃত হতে পারে। এসব ক্ষতিকারক খাদ্য-পানীয় ব্যক্তিগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার (অভিজ্ঞতার) মাধ্যমে চিহ্নিত করা খুবই ঝুঁকিবহুল ; এমনকি ঝুঁকি নিয়েও যথাসময়ে তা চিহ্নিত করা সম্ভব না-ও হতে পারে , বরং ঐ সব বস্তু ভক্ষণের ক্ষতি প্রকাশ পেতে বিলম্ব হওয়ায় ইতিমধ্যে আরো অনেকে তা পান বা ভক্ষণ করে বসতে পারে। অতএব , এরূপ ক্ষেত্রে বিশেষ পথনির্দেশের প্রয়োজন যাতে পথনির্দেশ লাভকারী ব্যক্তি অন্যদেরকে তা পৌঁছে দিতে পারেন।
দ্বিতীয়তঃ মানুষের স্বাধীনতার দাবী হচ্ছে পথনির্দেশ লঙ্ঘনের ক্ষমতার অধিকারী হওয়া এবং তার এরূপ ক্ষমতার অধিকারী হওয়া মানে তা লঙ্ঘনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কিন্তু এ ধরনের লঙ্ঘনের প্রতিক্রিয়ায় মানুষের বিচারবুদ্ধি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে , ফলে তার মধ্যকার সহজাত পথনির্দেশ , বিশেষতঃ ন্যায়-অন্যায় ও ভালো-মন্দের অনুভূতি বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে ; অন্ততঃ দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। এ কারণে তার জন্য এমন কোনো পথনির্দেশকের প্রয়োজন যার মধ্যে কোনো অবস্থায়ই ভালো-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায়ের সহজাত অনুভূতি বিন্দু পরিমাণেও বিনষ্ট বা দুর্বল হবে না। এরূপ ব্যক্তি সৃষ্টকর্তা অপরিহার্য সত্তার কাছ থেকে পথনির্দেশ লাভ করবেন এবং তা অন্যদের নিকট পৌঁছে দেবেন।
তৃতীয়তঃ কারণ ও ফলশ্রুতি বিধির আওতাধীন জগতে মানুষ ক্ষেত্রবিশেষে এমন এমন অবস্থার সম্মুখীন হতে পারে যে , সহজাত পথনির্দেশের ভিত্তিতে সে যে সব কর্তব্যবোধ অনুভব করে তার মধ্যকার দু’
টি কর্তব্যবোধ পরস্পরের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। এমতাবস্থায় সে বুঝতে পারছে না তার করণীয় কী। উদাহরণস্বরূপ , সহজাত পথনির্দেশের মাধ্যমে সে জানে যে , মিথ্যা বলা অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ। অন্যদিকে সে এ-ও জানে যে , কোনো যালেমকে সাহায্য করা বা সরাসরি সাহায্য না করলেও যার ফলে যালেমের জন্য যুলুম করার পথ খুলে যায় এমন কাজ সম্পাদন করা মস্ত বড় অন্যায়। একই সাথে , যে কোনো মূল্যে নিজেকে যুলুম-নির্যাতন ও ক্ষতি থেকে রক্ষা করার জন্য তার মধ্যে রয়েছে দুর্বার সহজাত আকাঙ্ক্ষা। এমতাবস্থায় , ধরা যাক , এক ব্যক্তি কোনো যালেমের দ্বারা তাড়িত হয়ে এসে এই ব্যক্তির গৃহে আত্মগোপন করলো। অতঃপর অচিরেই উন্মুক্ত তলোয়ার হাতে নিয়ে একজন যালেম এসে তার কাছে জানতে চাইলো পলাতক ব্যক্তিকে দেখেছে কিনা। এ ক্ষেত্রে সে বুঝতে পারছে না , সত্য বলবে , নাকি মিথ্যা বলে মযলূম লোকটিকে বাঁচাবার চেষ্টা করবে , নাকি সত্য বলবে কিন্তু মযলূমকে যালেমের হাতে তুলে দিতে অস্বীকার করে নিজের নিরাপত্তাকে হুমকির সম্মুখীন করবে। এমতাবস্থায় সে সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে বিশেষ পথনির্দেশ কামনা করে।
চতুর্থতঃ মানুষ তার নিজের ও পারিপার্শ্বিক বিশ্বের পিছনে নিহিত বিস্ময়কর সৃষ্টিকুশলতা এবং সুশৃঙ্খল পরিচালনা লক্ষ্য করে সৃষ্টিকর্তার মহানত্ব ও মহত্ব স্মরণ করে বিস্ময়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়। সেই সাথে সে তার নিজের প্রতি স্রষ্টার সীমাহীন অনুগ্রহ দেখেও কৃতজ্ঞতায় মাথা নুইয়ে দেয়। তার মন বলে , মহান সৃষ্টিকর্তা এ বিশ্বজগৎকে উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করেন নি। নিঃসন্দেহে এর কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে। তেমনি তার মতো বিস্ময়কর ও জটিল বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন প্রাণী সৃষ্টি এবং তার প্রতি এতো দয়া-অনুগ্রহ প্রদর্শন , তার জন্মের আগে থেকেই মাতৃদুগ্ধ , স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা , খাদ্য-পানীয় , আলো-বাতাস ইত্যাদি প্রয়োজনীয় সব কিছুর ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে। এ কোনো অর্থহীন বা উদ্দেশ্যহীন কাজ হতে পারে না। পরম জ্ঞানী স্রষ্টার পক্ষ থেকে উদ্দেশ্যহীন কাজ হতে পারে না। তার মনে প্রশ্ন জাগে , কী সে উদ্দেশ্য ?
সে চিন্তা করে , স্রষ্টার সাথে তার সম্পর্ক কী ? তার নিকট স্রষ্টার কোনো দাবী আছে কি ? থাকলে কী সে দাবী ? কীভাবে সে দাবী পূরণ করতে হবে ? কীভাবে সৃষ্টিকর্তাকে সন্তুষ্ট করা যাবে ? এ জন্যও সে সৃষ্টিকর্তার নিকট থেকে পথনির্দেশ কামনা করে। সে চায় , সৃষ্টিকর্তাই তাকে তাঁর পসন্দনীয় পথ দেখিয়ে দিন।