মু
‘
জিযাহ্ কী ?
মু‘
জিযাহ্ হচ্ছে মানুষের জানা কারণ ও ফলশ্রুতি বিধি বহির্ভূত অলৌকিক ঘটনা যা কোনোরূপ বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া ও উপায়-উপকরণ ছাড়াই ঘটানো হয় এবং যিনি ঘটান তিনি সে ঘটনাকে স্বীয় নবুওয়াত-দাবীর সত্যতার প্রমাণ হিসেবে পেশ করে থাকেন।
সাধারণ কারণ ও ফলশ্রুতি বিধির আওতায় যে সব ঘটনা সংঘটিত হয় তা যত বড় ধরনের ঘটনাই হোক না কেন , তা মু‘
জিযাহ্ নয়। যেমন: চন্দ্রগ্রহণ , সূর্যগ্রহণ , ঝড়-বৃষ্টি , প্লাবন , ভূমিকম্প ইত্যাদি। বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্বারা হিসাব-নিকাশ করে কেউ হয়তো দাবী করতে পারে যে , সে অমুক তারিখে বা দিনে অমুক সময় সূর্যগ্রহণ ঘটাবে এবং কথিত সময়ে তা-ই ঘটলো। এটা মু‘
জিযাহ্ রূপে গণ্য হবে না। কারণ , সূর্যগ্রহণ একটি প্রাকৃতিক ঘটনা ; সে হয়তো হিসাব-নিকাশ করে এর সঠিক সময় বের করতে পেরেছিলো। তেমনি বৈজ্ঞানিক উপায়-উপকরণের দ্বারা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটানো হলে তা মু‘
জিযাহ্ নয়। যেমন: মুরগী তা দিয়ে তিন সপ্তাহে ডিম থেকে বাচ্চা ফুটায়। এমতাবস্থায় কেউ ইনকিউবেটরের সাহায্যে বা , ধরুন , কোনো রাসায়নিক উপাদান মাখিয়ে দিয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে দেখালো। এটাও মু‘
জিযাহ্ হিসেবে গণ্য হবে না।
কিন্তু কেউ যদি কোনোরূপ যন্ত্রপাতির আশ্রয় না নিয়ে এবং রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার না করে শুধু মৌখিক নির্দেশের দ্বারা মুহূর্তের মধ্যে ডিম থেকে বাচ্চা বের করে আনতে পারেন তাহলে সে কাজটি মু‘
জিযাহ্ হবার সম্ভাবনা থাকে। তেমনি কেউ যদি মাটিতে বিশেষ ধরনের সার ও ওষুধ প্রয়োগ করে খেজুর বীচি লাগিয়ে তিন বছরের পরিবর্তে তিন মাসে খেজুর ফলাতে পারে , তো তার সে কাজ মু‘
জিযাহ্ হবে না। কিন্তু কেউ যদি সাধারণ মাটিতে সাধারণ খেজুর বীচি লাগিয়ে আধ ঘণ্টার মধ্যে পাকা খেজুর সরবরাহ করতে পারেন তাহলে তা-ই হবে মু‘
জিযাহ্।
নবুওয়াতের দাবীদার ব্যক্তি স্বীয় নবুওয়াতের প্রমাণ হিসেবে সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহে ও অনুমতিক্রমে লোকদের সামনে মু‘
জিযাহ্ প্রদর্শন করেন , অথবা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই তাঁর নবুওয়াতের প্রমাণ স্বরূপ তাঁকে কেন্দ্র করে এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন। অবশ্য জাদুকররাও অনেক ধরনের অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটিয়ে থাকে । কিন্তু জাদুকরের জাদুর ও নবীর মু‘
জিযাহর উদ্দেশ্য-লক্ষ্য ও প্রদর্শনক্ষমতার উৎস সম্পূর্ণ আলাদা।
জাদুকর দীর্ঘদিনের সাধনা ও চর্চার মাধ্যমে জাদুকরী ক্ষমতা অর্জন করে থাকে এবং ভালোভাবে অনুসন্ধান করলে খুব সহজেই তার রহস্য উদ্ঘাটন ও অন্যদের পক্ষে সে কলাকৌশল আয়ত্ত করা সম্ভব। কোনো জাদুকরের পক্ষেই , কমবেশী যা-ই হোক , শিক্ষা , সাধনা ও চর্চা ব্যতিরেকে জাদু আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। সে যতো গোপনেই তা শিক্ষা করুক এবং যতো কম পরিমাণেই শিক্ষা করুক (আর পরে নিজে গোপনে ব্যাপকভাবে চর্চা করে দক্ষতা অর্জন করুক) , অন্ততঃ যে তাকে জাদু শিক্ষা দিয়েছে সেই ওস্তাদ-জাদুকরের কাছে তার জাদুকর হওয়ার বিষয়টি গোপন থাকে না। তাই তার এ কাজ যে জাদু - এ সত্যটি যে কোনো সময় ফাশ হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। তাই জাদুকর কখনো কখনো বিশেষ পরিবেশে লোকদেরকে চমকে দেয়া বা প্রতারিত করার লক্ষ্যে নিজেকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে দাবী করলেও সাধারণতঃ বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই নিজের জাদুকর পরিচয় গোপন করে না। কিন্তু নবী যে অলৌকিক ঘটনা দেখান তার পিছনে এরূপ কোনো সাধনা ও চর্চা থাকে না , বরং একমাত্র সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা ও অনুগ্রহেই তা সম্ভব হয়ে থাকে।
দ্বিতীয়তঃ জাদুকরের জাদু প্রদর্শনের পিছনে নিম্নোক্ত উদ্দেশ্যসমূহের এক বা একাধিক বা সবগুলো উদ্দেশ্যই নিহিত থাকে: (1) আনন্দ লাভ ও মানুষকে আনন্দ দান , (2) সরলমনা লোকদেরকে বোকা বানিয়ে আনন্দ লাভ , (3) মানুষকে বিভ্রান্ত করে প্রতারণা করা , (4) মানুষকে আনন্দদানের বিনিময়ে অর্থোপার্জন , (5) খ্যাতি ও সুনাম অর্জন।
সাধারণতঃ একজন ছোট জাদুকর‘
জাদুকর’
হিসেবে জীবন শুরু করে দীর্ঘ সাধনার মাধ্যমে বড় জাদুকরে পরিণত হয়ে থাকে এবং‘
বড় জাদুকর’
হিসেবে পরিচিত হওয়াই তার লক্ষ্য থাকে ও তাতেই সে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করে। সাধারণতঃ কখনোই সে নিজেকে নবী বলে দাবী করে না , বরং এরূপ দাবী করতে ভয় পায়। অন্যদিকে নবীর মু‘
জিযাহ্ প্রদর্শনের উদ্দেশ্য জাদুকরের জাদু প্রদর্শনের উদ্দেশ্যসমূহ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ; তাঁর প্রদর্শিত মু‘
জিযাহর উদ্দেশ্য মানুষকে সৃষ্টিকর্তার প্রদর্শিত পথ অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে স্বীয় নবুওয়াতের প্রতি তাদের অন্তরে আস্থা সৃষ্টি করা বা তা দৃঢ়তর করা।
পেশাদার জাদুকর ছাড়াও কোনো কোনো লোক মানসিক শক্তির উপর্যুপরি ও ব্যাপক চর্চার মাধ্যমে প্রায় জাদুকরের অনুরূপ অস্বাভাবিক কাজ সম্পাদনে সক্ষম হতে পারে। যেমন: পানির ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া বা হিংস্র প্রাণীদের অনুগত করা। আর সরাসরি কারো কাছ থেকে শিক্ষা না করার কারণে তার স্বরূপ ও চর্চার বিষয়টি গোপন রাখাও সম্ভব হতে পারে। এ ধরনের শক্তি দ্বারা অনেক সময় মানুষের চিকিৎসা করা হয় বা মন নিয়ন্ত্রণ করা হয় , যেমন হিপনোটিজম বা সম্মোহনী শক্তির দ্বারা করা হয়।
তবে এ ধরনের শক্তি কেবল দীর্ঘ সাধনা ও চর্চার মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে। অন্যদিকে , আগেই যেমন উল্লেখ করা হয়েছে যে , মু‘
জিযাহ্ কোনো চর্চার ফসল নয়। তাছাড়া এ ধরনের কাজ ও মু‘
জিযাহর মধ্যে গুণগত পার্থক্য থাকে ; মু‘
জিযাহ্ হয় অনেক উঁচু ধরনের কাজ - যা চর্চার দ্বারা অর্জন করা সম্ভব নয় , যেমন: মৃতকে জীবিতকরণ , মাটির পাখীকে প্রকৃত পাখীতে পরিণত করে আকাশে উড়িয়ে দেয়া , লাঠিকে সক্রিয় সাপে পরিণত করা , চন্দ্র দ্বিখণ্ডিতকরণ ইত্যাদি যা কোনো মানসিক শক্তির দ্বারা সম্ভব নয়।
জাদুতুল্য মানসিক শক্তির অধিকারী ব্যক্তি ও নবীর মধ্যে আরেকটি পার্থক্য এই যে , এ ধরনের ব্যক্তিরা কখনো না কখনো তাদের এ শক্তিকে স্বীয় পার্থিব স্বার্থ হাসিল , প্রতিশোধ গ্রহণ , প্রতিহিংসা চরিতার্থকরণ ও এ ধরনের অন্যান্য নেতিবাচক লক্ষ্যে বা‘
সমুন্নত নয়’
এমন ধরনের লক্ষ্যে ব্যবহার করে থাকে - যা নবীর দ্বারা কখনোই ঘটে না।
মু‘
জিযাহ্ এমন ধরনের হওয়া চাই যে , সংশ্লিষ্ট কাজটির মু‘
জিযাহ্ হওয়া সম্পর্কে তা প্রত্যক্ষকারীদের নিকট যেন কোনোরূপ অস্পষ্টতা , দুর্বোধ্যতা ও সংশয় না থাকে। এ কারণে মু‘
জিযাহ্ এমন বিষয়ের হওয়া চাই যে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সমাজে বহু বড় বড় বিশেষজ্ঞ থাকবে , কিন্তু নবুওয়াতের দাবীদার ব্যক্তি ঐ বিষয়ে এমন উন্নততম মানের কাজ সম্পাদন করবেন যা ঐ সব বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিতেও মানুষের পক্ষে সম্পাদন করা অসম্ভব। অন্যথায় যে সমাজে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ নেই সে সমাজে ঐ বিষয়ের মু‘
জিযাহ্ দেখানো হলে লোকেরা ঐ কাজটির মু‘
জিযাহ্ হওয়া সম্পর্কে সন্দিহান হতে পারে। তাদের মনে হতে পারে যে , এ ব্যক্তি এ বিষয়ে বিরাট বিশেষজ্ঞ ; এখানে এ বিষয়ের কোনো বড় বিশেষজ্ঞ নেই বলেই তাঁর বিশেষজ্ঞত্ব কেউ ধরতে পারছেন না এবং এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এ ব্যক্তি নিজেকে নবী বলে দাবী করছেন।
উপরোক্ত কারণেই , মানবজাতির ইতিহাসে নবুওয়াতের দাবীদার যে সব ব্যক্তির মু‘
জিযাহর কাহিনী নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া যায় , তাঁদের বেলায় দেখা যায় যে , তাঁদের প্রত্যেকের প্রদর্শিত মু‘
জিযাহ্ সমূহের অন্ততঃ দু’
একটি এমন , যে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সমাজে বড় বড় বিশেষজ্ঞ উপস্থিত ছিলেন।
হযরত মূসা (আঃ)-এর সময় মিসরে জাদুবিদ্যা উন্নতির চরম শিখরে উপনীত হয়েছিলো এবং তখন সে দেশে এমন সব বড় বড় জাদুকর ছিলো যাদের সেরা জাদুকর হবার ব্যাপারে সকলেরই পরিপূর্ণ আস্থা ছিলো। কিন্তু হযরত মূসা (আঃ)-এর লাঠি সাপে পরিণত হয়ে ঐ সব ওস্তাদ জাদুকরের সর্বোচ্চ মানের জাদুসমূহকে অকেজো করে দেয়। ফলে জাদুকররা বুঝতে পারে যে , মূসা (আঃ) যা নিয়ে এসেছেন তা জাদু নয়।
তেমনি হযরত ঈসা (আঃ)-এর সময়ে তাঁর আবির্ভাবস্থল ফিলিস্তিনে ও ফিলিস্তিন শাসনকারী রোমানদের মধ্যে চিকিৎসাবিজ্ঞানের চরমোন্নতি ঘটেছিলো। কিন্তু হযরত ঈসা (আঃ) তৎকালীন চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে অসম্ভব এমন কিছু কাজ সম্পাদন করেন , যেমন: তিনি কুষ্ঠরোগীদেরকে কোনোরূপ ওষুধপত্র বা অস্ত্রোপচার ছাড়াই কেবল স্পর্শ দ্বারাই সুস্থ করে দেন , মৃতকে জীবিত করেন ও মাটি দ্বারা পাখী বানিয়ে তাকে প্রাণশীল করে উড়িয়ে দেন। এ থেকে সকলের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে , তিনি কোনো উঁচু দরের চিকিৎসাবিজ্ঞানী নন , বরং তাঁর দাবী অনুযায়ী যথার্থই সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক মনোনীত নবী।
একইভাবে হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর সময় মানবজাতির শ্রেষ্ঠতম সম্ভাবনাময় ভাষা আরবী তার প্রকাশক্ষমতার চরমোৎকর্ষে উপনীত হয়েছিলো এবং ঐ সময় আরবদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম কবি ও বাচনশিল্পীর উদ্ভব ঘটেছিলো। বস্তুতঃ সংক্ষেপে ব্যাপকতম ও সূক্ষ্মতম ভাব সুন্দরতম কথার মধ্য দিয়ে প্রকাশের ক্ষেত্রে অন্যান্য ভাষা ও আরবী ভাষার মধ্যে এমনই আসমান-যমীনতুল্য পার্থক্য ছিলো যে , আরবরা নিজেদেরকে‘
আরাবী বা“
সংক্ষেপে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাব প্রকাশক প্রাঞ্জলভাষী”
ও অন্যদেরকে‘
আজামী বা বোবা/ তোৎলা বলে অভিহিত করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের অহঙ্কার প্রকাশ করতো। কিন্তু হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) যে কোরআন নিয়ে এলেন তার সামনে আরবদের শ্রেষ্ঠতম কবি ও বাচনশিল্পীগণ অক্ষম ও অসহায় হয়ে রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হন।