জীবন জিজ্ঞাসা

জীবন জিজ্ঞাসা5%

জীবন জিজ্ঞাসা লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

জীবন জিজ্ঞাসা
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 58 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 42135 / ডাউনলোড: 4647
সাইজ সাইজ সাইজ
জীবন জিজ্ঞাসা

জীবন জিজ্ঞাসা

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

নবীর পাপমুক্ততা

কোনো ব্যক্তিকে নবী হিসেবে চিনতে পারার জন্য তাঁর মধ্যে অপর যে বৈশিষ্ট্যটি পাওয়া অপরিহার্য তা হচ্ছে , তাঁর গোটা জীবনই পাপমুক্ত হতে হবে।

নবুওয়াত দাবী করার পূর্বেই হোক বা পরেই হোক , যে ব্যক্তি সর্বজনীনভাবে বিচারবুদ্ধি কর্তৃক পাপ বা অপরাধ বা অন্যায় হিসেবে পরিগণিত কোনো কাজে কখনো লিপ্ত ছিলো , সুস্থ বিচারবুদ্ধির রায় অনুযায়ী সে ব্যক্তি নবী হতে পারে না। কারণ , এরূপ ক্ষেত্রে তার পাপ , অপরাধ বা অন্যায় কাজ সম্পর্কে অবগত ব্যক্তির পক্ষে তাকে নবী হিসেবে মনে করা সম্ভব হবে না। ফলে সে নবুওয়াতের দাবীদার ব্যক্তিকে ও তার দাবীকে প্রত্যাখ্যান করলে সৃষ্টিকর্তা ঐ ব্যক্তিকে নবীকে প্রত্যাখ্যান করা র অপরাধে অপরাধী বলে গণ্য করবেন না - এটা বিচারবুদ্ধির এক অকাট্য রায়। আর লোকেরা যদি নবীকে নবী হিসেবে চিনতেই না পারে , বরং তাঁর নবুওয়াত-দাবীর ব্যাপারে যুক্তিসঙ্গত কারণে সন্দেহ-সংশয়ে নিপতিত হয় তাহলে সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে নবী প্রেরণের লক্ষ্যই অনর্জিত থেকে যাবে।

এ কারণে বিচারবুদ্ধির রায় হচ্ছে , সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার জন্য এটা অপরিহার্য যে , তিনি কোনো পাপমুক্ত ব্যক্তিকে নবী হিসেবে মনোনীত করবেন অথবা যাকে নবী হিসেবে মনোনীত করবেন তাঁকে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পাপ থেকে রক্ষা করবেন। মানুষকে বিভ্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য এটা অপরিহার্য।

বলা বাহুল্য যে , এখানে পাপ বলতে আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের দৃষ্টিতে যা অন্যায় বা অপরাধ তা-ই বিবেচ্য ; যে কাজের অন্যায় বা অপরাধ হওয়া বা না-হওয়া সম্পর্কে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে বিতর্ক আছে তা এখানে বিবেচ্য নয়। তাই মিথ্যাচার , হত্যা , ধর্ষণ , ব্যভিচার , চুরি-ডাকাতি , ধোঁকা-প্রতারণা , বিশ্বাসঘাতকতা , অন্যের সম্পদ জবর দখল ও আত্মসাত , আমানতের খেয়ানত , যুলুম-অত্যাচার , নির্যাতন ইত্যাদি অন্যায় কাজ কখনোই একজন নবীকে স্পর্শ করতে পারে না। তেমনি তাঁর জীবনকে - নবুওয়াত-দাবীর পূর্বেও - দ্বিত্ববাদী , ত্রিত্ববাদী বা বহুত্ববাদী ধারণা ও কার্যকলাপ স্পর্শ করতে পারে না।

এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে , বিচারবুদ্ধি সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব ও একত্ব সম্বন্ধে নিশ্চিত হবার পর তাঁর নিকট জবাবদিহিতার অনুভূতি ও তাঁর পক্ষ থেকে পথনির্দেশের প্রয়োজনীয়তাবোধের কারণেই নবীর সন্ধান করে থাকে। এ পথের শুরুর দিকেই , একত্ববাদে উপনীত হতে গিয়েই সে দ্বিত্ববাদ , ত্রিত্ববাদ , বহুত্ববাদ ও অবতারবাদ ইত্যাদিকে প্রত্যাখ্যান করে। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের বিচারবুদ্ধির ওপরে বিভিন্ন ধরনের ভ্রমাত্মক যুক্তি , চিন্তা ও অন্ধ বিশ্বাসের আবরণ পড়তে পারে এবং এর ফলে তার অন্তরে বিচারবুদ্ধির রায় হাল্কা ও অগভীর হয়ে পড়তে পারে বা সে গতানুগতিকতার বিরোধী বিচারবুদ্ধির রায়কে স্বীয় মস্তিষ্কে পোষণ করতে ও লোকদের সামনে প্রকাশ করতে ভয় পেতে পারে ও সে কারণে তা জোর করে চাপা দিতে পারে ; অতঃপর নবী বা নবীর পক্ষ থেকে কেউ এসে তাকে সত্যকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে তার বিচারবুদ্ধির রায়কেই সুতীক্ষ্ণ করার চেষ্টা করতে পারেন।

অন্য কথায় , নবীর মূল কাজই হচ্ছে জীবন ও জগতের মহাসত্য সম্বন্ধে এবং নিজের , অন্যদের ও স্রষ্টার প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য তথা ঔচিত্য-অনৌচিত্য সম্বন্ধে মানুষের বিচারবুদ্ধির রায়কে শানিত করা ; বিতর্কিত বিষয়াদিতে সঠিক ফয়সালা এ দায়িত্বেরই সম্প্রসারণ মাত্র। এমতাবস্থায় চিন্তা বা কর্মের দিক থেকে বা উভয় দিক থেকেই কখনো না কখনো দ্বিত্ববাদ , ত্রিত্ববাদ , বহুত্ববাদ বা অবতারবাদে বিশ্বাসী ছিলো , অথবা সর্বজনস্বীকৃত কোনো অন্যায় বা পাপ কাজে কখনো না কখনো নিশ্চিতভাবেই লিপ্ত ছিলো - এমন ব্যক্তিকে বিচারবুদ্ধির পক্ষে স্রষ্টার পক্ষ থেকে মনোনীত নবী হিসেবে মেনে নেয়া সম্ভব হতে পারে না।

দ্বিতীয়তঃ এরূপ অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে , স্রষ্টার পক্ষে কি নবীর দায়িত্ব দেয়ার জন্য কোনো তাওহীদবাদী পাপমুক্ত মানুষ গড়ে তোলা অসম্ভব যে , কখনো না কখনো অংশীবাদে বা সর্বজনস্বীকৃত অন্যায় বা পাপে লিপ্ত ছিলো এমন একজন লোককে নবুওয়াতের দায়িত্ব দেবেন ?

তৃতীয়তঃ এরূপ পরিস্থিতি ভণ্ড নবীর আবির্ভাবের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরী করে দেয়। কারণ , নবুওয়াতের মর্যাদার পার্থিব সম্মান লাভ অথবা মানুষকে বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে যে কোনো পাপাচারী লোকের পক্ষে নবী সেজে বসা সম্ভব। এ অবস্থায় এরূপ ব্যক্তি দাবী করতে পারে যে , সে আগে অংশীবাদী বা পাপকর্মে লিপ্ত হয়ে থাকলেও সৃষ্টিকর্তা অনুগ্রহ করে তাকে নবী পদে অভিষিক্ত করেছেন এবং এ দায়িত্বে অভিষিক্ত হবার পর থেকে আর সে অংশীবাদ বা পাপ কর্মে লিপ্ত হয় নি।

চতুর্থতঃ এরূপ অবস্থায় যে কারো বিচারবুদ্ধি একজন প্রকৃত নবীকে ভণ্ড নবী মনে করে প্রত্যাখ্যান করতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে এ প্রত্যাখ্যানের জন্য তাকে অপরাধী গণ্য করা যাবে না। কারণ , এমনকি একজন অংশীবাদী বা পাপকর্মে লিপ্ত ব্যক্তি কর্তৃকও কাউকে নবী হিসেবে গ্রহণ করতে হলে তা বিচারবুদ্ধির রায়ের ভিত্তিতেই করতে হবে ; এর কোনো বিকল্প নেই। এমতাবস্থায় বিচারবুদ্ধিই যদি কাউকে ভণ্ড নবী বলে রায় দেয় তখন তাকে নবী হিসেবে গ্রহণ করা কারো জন্যই অপরিহার্য হতে পারে না।

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে , অংশীবাদী বা কখনো না কখনো সর্বজনস্বীকৃত অন্যায় বা পাপ কর্ম সম্পাদনকারী ব্যক্তিকে নবুওয়াত প্রদান করা হলে নবী প্রেরণের মূল উদ্দেশ্যই ভণ্ডুল হয়ে যায়। অতএব , এ ব্যাপারে বিতর্কের অবকাশ নেই যে , একজন নবীকে তাঁর জীবনের নবুওয়াত দাবী করার পূর্ববর্তী অধ্যায়েও তাওহীদবাদী (একত্ববাদী) ও পাপমুক্ত হতে হবে।

এছাড়া যিনি নবী হবেন তাঁর জন্য তাঁর জীবনের নবুওয়াত দাবী করার পূর্ববর্তী অধ্যায়েও মনবতাবোধ , দয়ার্দ্রতা , সদাচরণ , পরোপকার , সাহসিকতা , নিঃস্বার্থপরতা , লোভহীনতা ইত্যাদি সদগুণের অধিকারী হওয়াও অপরিহার্য যাতে তাঁর নবী হওয়ার ব্যাপারে মানুষের মনে সহজেই আস্থার সৃষ্টি হতে পারে।

তবে মনে রাখা দরকার যে , নবীর পাপমুক্ততার বিষয়টি এমন নয় যে , নবীর মধ্যে পাপে লিপ্ত হবার ক্ষমতাই থাকবে না। বরং মানুষ হিসেবে প্রাপ্ত স্বাধীনতার বিচারে নবী ও অন্য মানুষের মধ্যে পাপে লিপ্ত হবার ক্ষমতার ব্যাপারে কোনোই পার্থক্য থাকা সম্ভব নয়। কারণ , কোনো মানুষের পাপে লিপ্ত হবার ক্ষমতা কেড়ে নিলে সে আর মানুষ থাকবে না ; ফেরেশতার সমপর্যায়ভুক্ত হবে। আর বলা বাহুল্য যে , এরূপ ব্যক্তি মানুষের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ হতে পারে না। কারণ , সে ক্ষেত্রে মানুষের জন্য এ যুক্তি তৈরী হয়ে যায় যে , নবীর মধ্যে তো পাপের ক্ষমতাই নেই , তাই সে পাপ করে না ; আমাদের মধ্যে পাপে লিপ্ত হবার ক্ষমতা রয়েছে , তাই আমাদের পক্ষে পাপে লিপ্ত হওয়াই স্বাভাবিক।

বরং নবীর পাপমুক্ততার বিষয়টি সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে স্বাভাবিক মানবিক কার্যকারণের মধ্য দিয়ে নিশ্চিতকরণই স্বাভাবিক ও সর্বজনীন বিচারবুদ্ধির নিকট গ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ জন্মগতভাবে রক্তধারার পবিত্রতা ও সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক নবীরূপে মনোনীত ব্যক্তি হিসেবে এ মর্যাদার সাথে সাংঘর্ষিক চিন্তা , কথা ও কাজ পরিহারের স্বাভাবিক প্রবণতার কারণে নবীর মধ্যে শুরু থেকেই এমন একটি রুচিবোধ ও চরিত্র গড়ে ওঠে যার ফলে ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও পাপ কর্মের প্রতি তাঁর মধ্যে কোনোরূপ আগ্রহ সৃষ্টি হয় না , বরং ঘৃণা সৃষ্টি হয়। উদাহরণস্বরূপ , মানুষ পায়খানা-পেশাব ভক্ষণ ও পান করতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও কারো মধ্যে এর আগ্রহ সৃষ্টি হয় না (ব্যতিক্রম হিসেবে কদাচিৎ বহু কোটি মানুষের মধ্যে দু একটি চরম বিকৃতরুচি ব্যক্তিকে এ কাজ করতে দেখা গেলেও) , বরং সকল মানুষই এর প্রতি ঘৃণা বোধ করে থাকে। নবীর মধ্যে এই রূচিবোধই সর্বোচ্চ পর্যায়ের হয়ে থাকে যার ফলে সকল পাপ ও নোংরা কাজের প্রতি তাঁর মধ্যে ঘৃণা জন্ম নিয়ে থাকে।

এ প্রসঙ্গে আরো দু একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো পরিস্কার হতে পারে। যেমন: একটি অবুঝ শিশু একটি ফণা-তোলা সাপের বা একটি প্রদীপের শিখার সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে তা ধরার জন্য আগ্রহী হতে পারে , কিন্তু কোনো বুদ্ধিমান মানুষ এ কাজে অগ্রসর হবে না বা আগ্রহ অনুভব করবে না। কারণ , শিশু সাপের সৌন্দর্য দেখলেও বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এ সৌন্দর্যের আড়ালে সাক্ষাৎ মৃত্যু বা চরম যন্ত্রণা দেখে শিউরে ওঠে। তেমনি সংশ্লিষ্ট বস্তুর প্রকৃত অবস্থা সম্বন্ধে অজ্ঞ একজন লোক বিদ্যুতবাহী তার স্পর্শ করতে বা পানি মনে করে এসিড পান করতে দ্বিধা করবে না এবং পিপাসার্ত অবস্থায় জানা না থাকার কারণে বিষমিশ্রিত শরবত পান করতে আগ্রহ অনুভব করবে। কিন্তু যার সংশ্লিষ্ট বস্তুর প্রকৃত অবস্থা জানা আছে সে সযত্নে এ সব থেকে দূরে থাকবে ; পিপাসায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হলেও জানা অবস্থায় কিছুতেই সে এসিড বা বিষমিশ্রিত শরবত পান করবে না। ঠিক এভাবেই নবীর দৃষ্টিতে যে কোনো পাপকাজের ভয়াবহ পরিণাম সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে বিধায় তিনি এ থেকে দূরে থাকবেন এবং এর প্রতি কখনোই আগ্রহ অনুভব করবেন না - এটাই বিচারবুদ্ধির দাবী।

অনেক সময় কোনো কোনো নবী সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে বা এমনকি ধর্মগ্রন্থে এমন সব বর্ণনা পাওয়া যায় যা থেকে মনে হয় যে , তাঁরা কখনো কখনো পাপকার্যে লিপ্ত হয়েছিলেন। কিন্তু যেহেতু বিচারবুদ্ধি নবীর পাপে লিপ্ত হবার বিষয়টি গ্রহণ করে না , সেহেতু এ ক্ষেত্রে তিনটি অবস্থা হতে পারে। তা হচ্ছে , হয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আদৌ নবী ছিলেন না , অথবা সংশ্লিষ্ট বর্ণনাটি মিথ্যা বা বিকৃত , নয়তো বর্ণনাটির সঠিক তাৎপর্য গ্রহণ করা হয় নি।

নবী হচ্ছেন মানুষের কাছে স্রষ্টার পথনির্দেশ পৌঁছাবার প্রত্যক্ষ মাধ্যম এবং পূর্ণ শর্তাবলী বিশিষ্ট প্রতিনিধি , আর মানুষের জন্য স্রষ্টার মনোনীত নেতা ও শাসক। এ পদ মানুষের মধ্যকার সর্বোত্তম মর্যাদাপূর্ণ পদ। তাই যুগে যুগে সত্য নবী ছাড়াও বহু মিথ্যা নবীরও আবির্ভাব ঘটেছে । এরূপ ভণ্ড-প্রতারক ব্যক্তিরা স্বীয় প্রতারণার চক্রের সদস্যদের দ্বারা পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা মু জিযাহও প্রচার করে থাকে। তাই নবুওয়াতের দাবীদার কোনো ব্যক্তির জীবন সম্বন্ধে ব্যাপক ও গভীরভাবে অনুসন্ধান চালানো প্রয়োজন। অনুসন্ধানে তার জীবনে কখনো কোনো পাপকর্ম অকাট্যভাবে প্রমাণিত হলে সে ব্যক্তি যে নবী নয় , বরং নবী হওয়ার মিথ্যা দাবীদার , অথবা সে নিজে দাবী না করলেও স্বার্থান্বেষীরা তাকে তথাকথিত নবী বানিয়েছে - তাতে সন্দেহ নেই।

অন্যদিকে বিচারবুদ্ধি বলে , ভণ্ড-প্রতারক পাপাচারীরা কোনো কোনো নবীর বা অনেক নবীর বা নবীদের (আঃ) নামে পাপকর্মের মিথ্যা কাহিনী তৈরী করে থাকতে পারে। দু ধরনের লোকেরা এ কাজ করে থাকতে পারে। প্রথমতঃ কোনো নবীর বা নবীদের (আঃ) বিরোধীরা - যাদের উদ্দেশ্য ছিলো সংশ্লিষ্ট নবী বা নবীদের (আঃ) সম্বন্ধে মানুষকে বিভ্রান্ত করা এবং তাঁর বা তাঁদের ওপর অনাস্থা সৃষ্টি করা । দ্বিতীয়তঃ কোনো নবীর বা নবীদের (আঃ) অনুসারী হবার দাবীদার পাপাচারী লোকেরা যারা নিজেদের পাপকর্মের সপক্ষে সাফাই ও অজুহাত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নবীর বা নবীদের (আঃ) নামে মিথ্যা রচনা করেছে।

কোনো বা কোনো কোনো ধর্মের মূল ধর্মীয় সূত্র থেকে কোনো বা কোনো কোনো নবীর দ্বারা পাপকর্ম সম্পাদিত হয়েছিলো বলে ধারণা পাওয়া গেলে সে ব্যাপারে বিচারবুদ্ধি তিনটি কারণ খুঁজে পায়। প্রথমতঃ সূত্রটি অকাট্যভাবে গ্রহণযোগ্য না হতে পারে। অর্থাৎ সূত্রটিকে যে বা যার সাথে সম্পর্কযুক্ত বলে দাবী করা হয় তা তাঁর বা তাঁদের সাথে সম্পর্কিত না-ও হতে পারে এবং তাঁর বা তাঁদের নামে অন্য কারো রচিত হতে পারে। বিশেষ করে তাঁর বা তাঁদের থেকে শুরু করে প্রতিটি স্তরের বর্ণনাকারীদের ঐতিহাসিকতা ও ন্যায়নিষ্ঠতার অকাট্যতা এবং প্রতি স্তরে তাঁদের সংখ্যা বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে মিথ্যা রচিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যানের জন্য যথেষ্ট বলে পরিগণিত না-ও হতে পারে। ফলে এরূপ সূত্রে কোনো নবী বা নবীদের (আঃ) দ্বারা পাপকার্য সম্পাদনের বর্ণনা বিচারবুদ্ধির নিকট মোটেই গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয় না।

দ্বিতীয়তঃ ধর্মীয় সূত্রটি উপরোক্ত মানদণ্ডে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ থেকে উৎসারিত বলে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হলে এবং সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের গ্রহণযোগ্যতাও বিচারবুদ্ধির আদালতে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হলে সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সূত্রে কোনো বা কোনো কোনো নবীর (আঃ) পাপকর্মে লিপ্ত থাকার কথা উল্লিখিত পাওয়া গেলে তার দু টি অবস্থা হতে পারে। প্রথমতঃ পাঠকের নিকট পাপকর্মের যে সংজ্ঞা বা সীমারেখা রয়েছে তা বিচারবুদ্ধির নিকট সর্বজনীন ও অকাট্যভাবে গ্রহণযোগ্য না-ও হতে পারে। অর্থাৎ নবীর বা নবীদের যে কাজের উল্লেখ দেখে পাঠক তাকে পাপকর্ম বলে মনে করতে পারেন , তা হয়তো আদৌ পাপকর্ম নয়। অর্থাৎ যে কাজের পাপ হওয়ার বিষয়টি বিতর্কিত পাঠক তাকেই অকাট্যভাবে পাপ বলে মনে করে নিয়েছেন। দ্বিতীয়তঃ পাঠক সংশ্লিষ্ট ধর্মীয় সূত্রের অর্থ গ্রহণে ভুল করে থাকতে পারেন। এ প্রসঙ্গে দু একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো পরিস্কার হবে।

গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় সূত্র তাওরাত ও কোরআন মজীদে প্রথম মানুষের নাম আদম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা বাহুল্য যে , প্রথম মানুষ হিসেবে তিনি নবীও ছিলেন বটে। তাওরাত ও কোরআনে বলা হয়েছে যে , সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ ভুলে গিয়ে তিনি ও তাঁর স্ত্রী নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করেন। অনেকেই এটিকে মানুষের প্রথম পাপ বলে মনে করে। (শুধু তা-ই নয় , অনেকেই মনে করে যে , এ পাপের কারণেই তাঁকে সস্ত্রীক বেহেশত থেকে বের করে দেয়া হয় ; নইলে মানব প্রজাতি আজো বেহেশতেই থাকতো , যদিও কোরআনে বলা হয়েছে যে , পৃথিবীর বুকে সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধির দায়িত্ব পালনের জন্যই তাঁকে সৃষ্টি করা হয়েছিলো।) কিন্তু ঐ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ সর্বজনীনভাবে বিচারবুদ্ধির নিকট অন্যায় বা পাপ বলে পরিগণিত কাজসমূহের (যার অনেকগুলোর কথাই আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি) অন্তর্ভুক্ত ছিলো না। দ্বিতীয়তঃ উক্ত উভয় সূত্র থেকেই সুস্পষ্ট যে , তখন পর্যন্ত সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে হযরত আদম (আঃ)-কে কোনোরূপ ধর্মীয় বিধিবিধান প্রদান করা হয় নি। ফলে বিচারবুদ্ধি কেবল এটাই বলে না যে , ঐ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করার ফলে সর্বজনীনভাবে পাপ বা অন্যায় বলে পরিগণিত কোনো কাজ সম্পাদিত হয় নি , বরং এ-ও বলে যে , এর দ্বারা সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে প্রদত্ত কোনো বিশেষ বিধান ও লঙ্ঘিত হয় নি। বরং এ ছিলো মানুষকে প্রদত্ত স্বাধীনতা মানুষ কীভাবে প্রয়োগ করতে পারে তার একটি পরীক্ষা মাত্র। পূর্ব-অভিজ্ঞতাবিহীন হযরত আদম ও হযরত হাওয়া (আঃ) কৌতুহলবশে ও শয়তানের দ্বারা প্রতারিত হয়ে ভুলবশতঃ উক্ত বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করেন , যদিও এ ভুল কাজ করার কারণে তাঁরা কিছু না কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাছাড়া এ-ও হতে পারে যে , তখনো তাঁরা শর ঈ দায়িত্ব-কর্তব্য প্রযোজ্য হবার বয়সে উপনীত হন নি। অতএব , এ ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় না যে , নবী পাপকার্যে জড়িত হতে পারেন।

এবার ধর্মীয় সূত্র থেকে ভুল অর্থ গ্রহণের একটি দৃষ্টান্ত। কোরআন মজীদের বর্ণনা থেকে এরূপ তাৎপর্য গ্রহণ করা হয়েছে যে , হযরত ইবরাহীম (আঃ) প্রথমে নক্ষত্র , চন্দ্র ও সূর্যকে রব (প্রভু/ সৃষ্টিকর্তা) মনে করেছিলেন অর্থাৎ তিনি ঐ সময় সাময়িকভাবে হলেও অংশীবাদী ধারণা পোষণ করেছিলেন। কিন্তু এ ঘটনার বর্ণনাকে তার পূর্ববর্তী আয়াত সমূহের সাথে মিলিয়ে পড়লে দেখা যায় যে , ঘটনাটি তাঁর নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনের জন্য অভিষিক্ত হওয়ার পরবর্তী কালের। অতএব , সংশ্লিষ্ট অংশীবাদী কথাগুলো তাঁর নয় , বরং অন্য কারো। অর্থাৎ একজন অংশীবাদী ও হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর মধ্যকার কথোপকথনকে এক ব্যক্তির অর্থাৎ হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর একার উক্তি বলে গণ্য করায় এরূপ ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে।

নবীগণের (আঃ) পাপমুক্ততা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনার দাবীদার। এখানে বিচারবুদ্ধির আলোকে মূল বিষয়টি প্রতিপাদনের লক্ষ্যে এতোটুকু আলোচনাই যথেষ্ট বলে মনে করি।

মহাসত্যের প্রশ্নে নবীর আপোসহীনতা

নবীর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জীবন ও জগতের অস্তিত্বের পিছনে নিহিত মহাসত্য প্রশ্নে আপোসহীনতা। বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে কোনো রকম প্রলোভন , ভয়-ভীতি , এমনকি জীবনাশঙ্কার মুখেও নবী তাঁর নবুওয়াতের দাবী এবং জীবন ও জগতের অস্তিত্বের পিছনে নিহিত মহাসত্য প্রকাশ হতে বিরত থাকতে পারেন না। কারণ , তাঁকে নবী হিসেবে মনোনীত করার উদ্দেশ্যই এটা। আর মূল উদ্দেশ্য পরিত্যাগ করলে নবী আর নবী থাকেন না বা বলা যেতে পারে যে , নবী ও অ-নবীর মধ্যকার মৌলিক পার্থক্য বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাই নবী সর্বাবস্থায়ই মহাসত্য প্রকাশ ও প্রচারের কাজ অব্যাহত রাখবেন।

অবশ্য নবীর আপোসহীনতার মানে এ নয় যে , তিনি জোর করে মানুষের ওপর মহাসত্যকে চাপিয়ে দেবেন বা সদাই সত্যপ্রত্যাখ্যানকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থাকবেন। কারণ , সত্য চাপিয়ে দেয়ার বা জোর করে গ্রহণ করানোর বিষয় নয়। নবীর কাজ হচ্ছে মানুষের বিচারবুদ্ধিকে জাগ্রত করানো এবং তার সামনে মহাসত্যকে পেশ করা। বরং সষ্টার প্রতিনিধি স্বাধীনতার অধিকারী সৃষ্টি মানুষের ওপর কোনো চিন্তা ও কাজ জোর করে চাপিয়ে দেয়া মস্ত বড় অন্যায় , আর নবীর আবির্ভাবের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে এ অন্যায় চর্চার অবসান ঘটানো। অতএব , অন্যদের ওপর স্বীয় বক্তব্য চাপিয়ে দিয়ে তিনি নিজেই এ উদ্দেশ্যের বিপরীত আচরণ করতে পারেন না। এমনকি কোনো জনগোষ্ঠী তাঁকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করলে এবং সেখানে তাঁর দাওয়াত আরো বিস্তারের কোনো সম্ভাবনা না থাকলে তিনি সংঘাত এড়াতে বা স্বীয় অনুসারীদের জীবন রক্ষার্থে এবং সত্য প্রকাশ ও প্রচারের কাজ অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে দেশ ত্যাগ করে অন্য কোথাও চলে যেতে পারেন। অন্যদিকে বিচারবুদ্ধি এ-ও বলে যে , উপযুক্ত পরিবেশ পেলে তিনি স্বীয় অনুসারীদের ওপর স্বীয় শাসন-কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবেন এবং এটা তাঁর স্বাভাবিক অধিকার। আর এ কাজে কেউ বাধা দিলে ও সে ক্ষেত্রে সঙ্গতি থাকলে অথবা পরিস্থিতি বাধ্য করলে তিনি স্বীয় অনুসারীদেরকে সাথে নিয়ে সত্যকে রক্ষার জন্য যুদ্ধও করবেন। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তিনি পার্থিব স্বার্থে সত্য প্রকাশ ও প্রচারের ক্ষেত্রে কমবেশী করবেন না। এ পথে তাঁকে জীবন দিতে হলেও এ ব্যাপারে তিনি আপোস করবেন না।

কেবল প্রয়োজনেই নবী প্রেরণ

নবুওয়াত সম্বন্ধে সবশেষে যে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি বলা অপরিহার্য তা হচ্ছে , মহান প্রজ্ঞাময় স্রষ্টা কোনো বাহুল্য কাজ করতে পারেন না। অতএব , বিচারবুদ্ধির রায় হচ্ছে এই যে , অপরিহার্য প্রয়োজনীয় না হলে তিনি অযথাই কোনো নবী প্রেরণ করেন না। এখানে প্রয়োজন মানে মানুষের প্রয়োজন। অর্থাৎ মানব জাতির নিকট তাঁর প্রেরিত পথনির্দেশ পরিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ রূপে এবং অবিকৃতভাবে বিদ্যমান থাকলে তিনি এরপরও নতুন করে নবী ও পথনির্দেশ পাঠাবেন - এটা বিচারবুদ্ধির নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। তাই এরূপ পরিস্থিতিতে কেউ নবুওয়াত লাভের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ দাবী করলে তার সে দাবী বিবেচনাযোগ্য নয়।

অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়া মানুষের উন্নতির কারণ

বস্তুতঃ মানব প্রজাতির অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে , প্রাকৃতিক , প্রাণীজ ও মানব-জাত অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়া অসংখ্য বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কারণ হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। মানুষ এ সব প্রতিক্রিয়া থেকে বাঁচার পথ খুঁজতে গিয়ে চিন্তা-গবেষণা করেছে এবং এমন সব বিস্ময়কর আবিষ্কার-উদ্ভাবন করেছে যা মানবসভ্যতার সৃষ্টি করেছে এবং তাকে এগিয়ে নিয়েছে। আর সৃষ্টিলোকের চূড়ান্ত লক্ষ্যের বাস্তবায়নের জন্য যে সব ঘটনা সংঘটিত হওয়া প্রয়োজন তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি মানুষ সৃষ্টিলোকে নিহিত সকল প্রাকৃতিক বিধিবিধান উদ্ঘাটন করবে ও নিজেদের কল্যাণের জন্য তা কাজে লাগাবে। কিন্তু কথিত অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়াসমূহ না থাকলে মানুষ আবিষ্কার-উদ্ভাবনে অনুপ্রাণিত হতো না।

অবশ্য প্রাকৃতিক জগতে , বিশেষতঃ প্রাণীজগতে এমন অনেক উপায়-উপকরণ পরিলক্ষিত হয় যার মধ্যে দৃশ্যতঃ অকল্যাণ ছাড়া কোনোরূপ কল্যাণ নিহিত নেই। মানুষ মনে করে , এ সব সৃষ্টি না থাকলেই বা কী অসুবিধা ছিলো ?

আসলে বাহ্যতঃ অকল্যাণকর হিসেবে পরিদৃষ্ট সৃষ্টিসমূহের মধ্যেও যে কল্যাণ নিহিত নেই এরূপ মনে করা ঠিক নয়। কারণ , ইতিমধ্যেই বিভিন্ন বাহ্যিক ক্ষতিকর উপাদান বা প্রাণী থেকে এমন সব কল্যাণকর উপাদান আবিষ্কৃত হয়েছে যা মানুষ পূর্বে কল্পনাও করতে পারতো না। উদাহরণ স্বরূপ , সাপের ন্যায় মারাত্মক প্রাণঘাতী প্রাণীর বিষ মানুষের বিরাট কল্যাণ সাধনে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে সম ওযনের স্বর্ণের তুলনায় বিষের দাম কয়েক গুণ বেশী দেখা যায়।

ক্ষতিকারকতা আপেক্ষিক

এমতাবস্থায় এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই যে , সৃষ্টিকুলের সকল সৃষ্টির মধ্যেই কল্যাণকারিতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাহ্যতঃ ক্ষতিকারক যা পরিলক্ষিত হয় তার ক্ষতিকারকতাও আপেক্ষিক। প্রথমতঃ অনেক প্রাণীর ক্ষতিকারকতা তাদের আত্মরক্ষার স্বার্থে অপরিহার্য। যেমন: সাপের বিষ এবং বাঘ ও সিংহের দন্ত-নখর তাদের আত্মরক্ষার জন্য যরূরী। দ্বিতীয়তঃ এক সৃষ্টির ক্ষতিকারকতা কেবল অন্য সৃষ্টির সংস্পর্শেই অর্থাৎ পারস্পরিক সংঘাতের পরিস্থিতিতেই প্রকাশ পায়। অন্যথায় প্রতিটি সৃষ্টিই তার তার নিজস্ব অবস্থানে সুন্দর। একটি সাপকে বা একটি সিংহকে তাদের নিজস্ব অবস্থানে রেখে পর্যবেক্ষণ করলে তার সৌন্দর্য ও তার সৃষ্টিতে সৃষ্টিকর্তার চমৎকার সৃষ্টিকুশলতাই ধরা পড়বে । তেমনি একটি কাঁটাগাছকে তার নিজস্ব অবস্থানে রেখে দেখলে তাকেও সুন্দর ও সুকৌশল সৃষ্টি রূপে দেখা যাবে।

এরপর আসে মানুষের মধ্যকার অবাঞ্ছিত দিকসমূহের কথা। ইতিপূর্বেই আমরা উল্লেখ করেছি যে , প্রাণীকুল , বিশেষতঃ মানুষ কমবেশী স্বাধীনতার অধিকারী। আর এদের স্বাধীনতার মধ্যে পারস্পরিক সংঘাতও অনিবার্য।

ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের নেতিবাচক ব্যবহার

প্রাণী হিসেবে অপরিহার্য স্বাধীনতার অতিরিক্ত মানুষের রয়েছে আরেক ধরনের স্বাধীনতা যাকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি নামে অভিহিত করা যায়। অর্থাৎ তার ইচ্ছাশক্তি অন্যান্য প্রাণীর ইচ্ছাশক্তির ন্যায় শুধু সহজাত প্রবণতা তথা আত্মরক্ষার তাগিদ থেকেই উদ্ভূত নয় , বরং সৃষ্টির সেরা হিসেবে তার মধ্যে রয়েছে ধরণীর বুকে স্বীয় নেতৃত্ব , কর্তৃত্ব , আধিপত্য , শ্রেষ্ঠত্ব ও মালিকানা প্রতিষ্ঠার প্রবণতা। এ প্রবণতা থেকে উদ্ভূত বিশেষ ধরনের ইচ্ছা ও তা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালানো তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

মানুষের এ বিশেষ ইচ্ছাশক্তি ও ক্ষমতা খারাপ কিছু তো নয়ই , বরং এ হচ্ছে তার এক বিরাট ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এ বৈশিষ্ট্যকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার না করে নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করার ফলে অবাঞ্ছিত অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। এ ক্ষতিকারকতা রোধ করতে হলে হয় তাকে এ ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করতে হতো , অথবা এ ক্ষমতার অপব্যবহারপ্রবণতা থেকে তাকে মুক্ত রাখতে হতো। কিন্তু তাহলে তার পরিণতি কী হতো ?

প্রাণী হিসেবে প্রদত্ত স্বাধীনতার পাশাপাশি মানুষকে প্রদত্ত ম্বাধীন ইচ্ছাশক্তি তাকে দেয়া না হলে মানুষ মানুষ হতো না ; স্রেফ একটি উন্নত স্তরের প্রাণীপ্রজাতি হতো। সে ক্ষেত্রে তার দ্বারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ ও সভ্যতার সৃষ্টি হতো না। অন্যদিকে তাকে সৃজনক্ষমতা প্রদান করার পাশাপাশি তার অপব্যবহার করার ক্ষমতা বিলুপ্ত করে দেয়া হলে কার্যতঃ সে ফেরেশতার কাছাকাছি কোনো প্রাণীতে পরিণত হতো , মানুষ হতো না এবং মানুষের মধ্যে সৃষ্টিকর্তার সকল গুণের (সীমিত মাত্রায় হলেও) যে সমাহার দেখা যাচ্ছে তথা সে যেভাবে সৃষ্টিকর্তার প্রতিচ্ছবি বা প্রতিনিধি রূপে আবির্ভূত হয়েছে তার মধ্যে এ বৈশিষ্ট্যের পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটতো না। অন্য কথায় , তার মধ্যে সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিক্ষমতার যে সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তা ঘটতো না। কারণ , সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিক্ষমতার সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ মানে হচ্ছে তাঁর গুণাবলীর অনুরূপ গুণাবলী সম্পন্ন সৃষ্টির উদ্ভব ঘটানো , যদিও সৃষ্টি ও সসীম হবার কারণে এ সৃষ্টির মধ্যে তাঁর সে গুণাবলীর বহিঃপ্রকাশ ঘটবে সীমিত পরিমাণে। সে সীমা কতখানি তা বড় কথা নয় , তবে সৃষ্টির মাঝে স্রষ্টার গুণাবলী সর্বোচ্চ যে মাত্রায় দেয়া সম্ভব তিনি তাকে তা সে মাত্রায়ই প্রদান করবেন এটাই স্বাভাবিক , অন্যথায় এ সৃষ্টি না সর্বোত্তম হবে , না তাঁর প্রতিচ্ছবি বা প্রতিনিধি হবে।

মানুষকে সৃষ্টিকর্তার সকল গুণ সম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রায় প্রদানের মানেই হচ্ছে তাকে শুধু সৃষ্টির ক্ষমতাই দেয়া হবে না , বরং ধ্বংসের ক্ষমতাও দেয়া হবে , যদিও উভয়ই সীমিত পরিমাণে ; এ সীমা কতোখানি তা বড় কথা নয় , তবে সম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রায় হওয়াই স্বাভাবিক। আর এ ধরনের গুণাবলীর অধিকারী হওয়ার মানেই হচ্ছে মানুষ সৃষ্টিলোকের ওপর স্বাধীনভাবে তার ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটাবে। এ ক্ষেত্রে তার ইচ্ছাকে শুধু কল্যাণ-ইচ্ছার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেয়া হলে বা অকল্যাণ-ইচ্ছা দেয়া সত্ত্বেও তার বাস্তবায়ন অসম্ভব করে দেয়া হলে তার মানে হতো তার স্বাধীনতাকে প্রায় বিলুপ্ত করে দেয়া তথা তাকে সম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রায় স্রষ্টার সকল গুণ না দেয়া। আর তাহলে সে সৃষ্টিকর্তার সম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রার বহিঃপ্রকাশ বা তাঁর সম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রার প্রতিনিধি হতো না। সে অবস্থায় সৃষ্টিকর্তার গুণাবলী বহুলাংশে অপ্রকাশিত থেকে যেতো।

মূলতঃ প্রতিনিধিত্বের শর্তই হচ্ছে প্রতিনিধিকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। তাকে প্রদত্ত এ স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করবে দু টি জিনিস: প্রথমতঃ প্রাকৃতিক বিধিবিধান , দ্বিতীয়তঃ নৈতিক বিধিবিধান তথা ঔচিত্য-অনৌচিত্যবোধ। মানুষের ইচ্ছা ও শক্তির নিয়ন্ত্রণকারী এ দু টি জিনিস। প্রাকৃতিক বিধিবিধানকে লঙ্ঘন করার সাধ্য মানুষের নেই। (অবশ্য অজ্ঞাত কোনো প্রাকৃতিক বিধান আবিষ্কার করে তার প্রয়োগের মাধ্যমে পূর্ব থেকে জ্ঞাত প্রাকৃতিক বিধিবিধানের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তিলাভ সম্ভব হতে পারে। এরূপ হলে প্রকৃত পক্ষে তাকে প্রাকৃতিক বিধানের লঙ্ঘন বলে গণ্য করা চলে না।) কিন্তু নৈতিক বিধিবিধান লঙ্ঘনের সুযোগ তার রয়েছে।

তবে যে মানুষ স্বীয় স্বরূপ তথা সে যে মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধিত্ব করছে - এ সত্য যথাযথভাবে উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে তার পক্ষে নৈতিক বিধান লঙ্ঘন করা সম্ভব নয়। যে সৃষ্টি প্রকৃতই সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধি সে জ্ঞানের আলোয় এতোখানি উদ্ভাসিত যে , নৈতিক বিধান লঙ্ঘনের বর্তমান (ইহজাগতিক) ও ভবিষ্যৎ (পরজাগতিক) প্রতিক্রিয়া তার সামনে দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট থাকে। ফলে স্বাধীনতা থাকা সত্ত্বেও তার পক্ষে নৈতিক বিধান লঙ্ঘন করা সম্ভব নয়।

পিতামাতার কারণে সন্তানের দুর্ভাগ্য কেন ?

সবশেষে আরো একটি প্রশ্নের জবাব দেয়া প্রয়োজন বলে মনে হয়। তা হচ্ছে , অনেক ক্ষেত্রেই পিতামাতার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের পরিণামে সন্তান সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের অধিকারী হয়। ধনীর সন্তান ধনী , গরীবের সন্তান গরীব হয়। অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন রোগগ্রস্ত পিতা বা মাতার সন্তান জন্মগতভাবে রোগগ্রস্ত হয়ে থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে , এ ক্ষেত্রে একজনের কর্মফল আরেক জন ভোগ করবে কেন ?

আসলে কয়েকটি বিষয়ে সচেতনতার অভাব থেকে এ প্রশ্নের উদয় হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রথমেই প্রশ্ন জাগে , সুখ-দুঃখের স্বরূপ কি মানুষ উদ্ঘাটন করতে পেরেছে ? সুখ-দুঃখ ও সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য প্রতিটি মানুষের বর্তমান , অতীত ও সম্ভাব্য বা প্রার্থিত ভবিষ্যৎ অবস্থার মধ্যে তুলনার ওপর নির্ভরশীল। প্রকৃত পক্ষে বিষয়টি আপেক্ষিক। সে কী আছে , কী চায় এবং কী হলো - এ তিনের সমন্বয় হচ্ছে তার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য নির্ণয়ের প্রকৃত মানদণ্ড।

তাই প্রশ্ন করতে হয় , জন্মগতভাবে বাঞ্ছিত বৈশিষ্ট্যাবলীর অধিকারী তথা সুন্দর , স্বাস্থ্যবান , শক্তিশালী , শক্তিক্ষমতার অধিকারী ও প্রভূত ধনসম্পদের মালিক মাত্রই কি ভাগ্যবান ? তাদের প্রত্যেকেই কি সুখী ? তাদের সকলেই কি শান্তির অধিকারী ?

নিঃসন্দেহে উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর ক্ষেত্রে একই শ্রেণীর সকলের জবাব এক নয়।

তেমনি জন্মগতভাবে অবাঞ্ছিত বৈশিষ্ট্যাবলীর অধিকারী তথা অসুন্দর , স্বাস্থ্যহীন , দুর্বল , শক্তিক্ষমতাহীন ও দরিদ্র বস্তিবাসীমাত্রই কি দুঃখী ? এ প্রশ্নের জবাবও একই শ্রেণীর সকল বস্তিবাসীর ক্ষেত্রে অভিন্ন নয়। আর এদের মধ্যে যদি কেউ নিজেকে দুঃখী বলে অনুভব না করে তাহলে তাকে ভাগ্যহীন বলা চলে কি ?

অনুরূপভাবে একই ব্যক্তির সকল সময়ের অবস্থা এক নয়। একই ধনী ব্যক্তি যেমন কখনো সুখী , কখনো অসুখী , তেমনি একই বস্তিবাসী ব্যক্তি কখনো সুখী , কখনো অসুখী।

সুখ-দুঃখ ও সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্যের বাহ্যিক ও পার্থিব মানদণ্ড যদি চূড়ান্ত হতো তাহলে রাজপুত্র স্বেচ্ছায় সিংহাসন ত্যাগ করে ফকীর-দরবেশ হয়ে যেতো না , ধনী যাত্রীর ভুল করে ফেলে যাওয়া লক্ষ টাকা গরীব রিকশাওয়ালা ফেরত দিতে যেতো না , দেশ বা ধর্মের জন্য বা মানবতার জন্য কেউ প্রাণ উৎসর্গ করতো না।

এখানে মনে রাখার দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে এই যে , প্রতিটি ব্যক্তি যেমন একেকটি একক সত্তা তেমনি সে তার পরিবার , সমাজ , দেশ ও বিশ্বের এবং সর্বোপরি গোটা সৃষ্টিলোকের সত্তারও অবিচ্ছেদ্য অংশবিশেষ বটে।

সন্তান নিঃসন্দেহে পিতামাতার সত্তার অংশবিশেষ এবং পিতামাতাও সন্তানের সত্তার অংশবিশেষ। এভাবে পরস্পরের সত্তার অংশবিশেষ হওয়ার কারণেই তারা শারীরিকভাবে পরস্পর স্বাধীন সত্তা হওয়া সত্ত্বেও পরস্পরের সুখ-দুঃখ , ভালো-মন্দ ও সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য দ্বারা পারস্পরিকভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকে। এ কারণেই পিতামাতার সন্তান-জন্মলাভপূর্ব অবস্থার দ্বারা সন্তানের প্রভাবিত হওয়ার মধ্যেই তাদের পারস্পরিক প্রভাব সীমাবদ্ধ নয় , বরং সন্তানের জন্মপরবর্তী-কালীন পারস্পরিক সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্যও তাদেরকে পারস্পরিকভাবে স্পর্শ করে। অনেক সময় সন্তানের দুর্ভাগ্য স্বয়ং সন্তানের তুলনায় পিতামাতার জন্য অধিকতর যন্ত্রণাদায়ক হয়ে থাকে।

একটি জন্মান্ধ শিশু পার্থিব জগতের সৌন্দর্য কী জানে না এবং তা তাকে হাজারো ব্যাখ্যা দিয়েও বুঝানো সম্ভব নয়। তাই পার্থিব জগতের সৌন্দর্য দেখতে না পারার কারণে তার তেমন কোনো দুঃখ হবার কথা নয় , কিন্তু সন্তানের জন্মান্ধতার কষ্ট এমনই যন্ত্রণাদায়ক হয় যে , অনেক সময় পিতামাতা সন্তানের অন্ধত্ব দেখার আগে নিজেদের মৃত্যু হলো না কেন - এ মর্মে আফসোস করে থাকে।

বিষয়টি একই দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যকার সম্পর্কের সাথে তুলনীয়। একই দেহের কোনো অঙ্গ রোগাক্রান্ত হলে তা দ্বারা সুস্থ অঙ্গও প্রভাবিত হয়। এ ক্ষেত্রে যে অঙ্গের সাথে যে অঙ্গের দূরত্বগত বা কর্মগত নৈকট্য বেশী সে সব অঙ্গ পরস্পর অধিকতর প্রভাবিত হয়। তেমনি সমাজ , দেশ ও বিশ্বের সামগ্রিক পরস্থিতির ভালো-মন্দ দ্বারা ব্যক্তি প্রভাবিত হয় , কারণ , সে সমাজ , দেশ ও বিশ্বের অংশ।

চিকিৎসাযোগ্য নয় এমন কোনো ব্যাধি কোনো ব্যক্তি বিদেশ থেকে নিয়ে এলে এবং তা সমাজে সংক্রামিত হলে তাতে একজন সুস্থ মানুষের আক্রান্ত হওয়ার এবং তা থেকে আদৌ সুস্থ না হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। পিতামাতার সাথে সন্তানের সম্পর্কও তেমনি। সন্তানের জন্মগ্রহণপূর্ব তথা মাতৃগর্ভে থাকাকালীন অবস্থায় এ সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতম থাকে বিধায় সন্তানের মধ্যে পিতামাতার ভালোমন্দ বৈশিষ্ট্য স্থানান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সবচেয়ে বেশী। পিতার দেহের প্রাণবীজ থেকে মাতৃগর্ভে সন্তানের সূচনা হয় এবং মাতৃদেহের উপাদানে পরিপুষ্ট হয়ে সে একটি পরিপূর্ণ শিশুরূপে ভূমিষ্ঠ হয়। ফলে পিতামাতার বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে সর্বাধিক মাত্রায় স্থানান্তরিত হওয়াটাই স্বাভাবিক।

এ বিষয়টিকে গাছের বীজ থেকে গাছ হওয়ার সাথে তুলনা করা যায়। টক আমের আঁটি থেকে টক আমের গাছই হবে , মিষ্টি আমের গাছ হবে না। অন্যদিকে যে মাটিতে এ আঁটি বপন করা হয়েছে তার প্রভাবও গাছ ও তার ফলে বিস্তার লাভ করবে। বলা হয় , ছাতকের কমলার বীজ দার্জিলিং-এ লাগালে তাতে ছাতকের কমলা পাওয়া যাবে না , তেমনি হুবহু দার্জিলিং-এর কমলাও পাওয়া যাবে না , বরং ছাতক ও দার্জিলিং উভয় জাতের কমলাগাছের কমলা থেকে তার বৈশিষ্ট্য কিছুটা স্বতন্ত্র হবে। এর বিপরীত করা হলেও তার ফল হবে প্রায় অনুরূপ। তবে বীজ থেকে চারা গজানোর পর সে চারা তুলে নিয়ে তৃতীয় কোন জায়গায় লাগালে এর বৈশিষ্ট্য হবে আরো ভিন্ন ধরনের। অর্থাৎ সে ক্ষেত্রে বীজ , জন্মকালীন পরিপুষ্টি ও জন্মপরবর্তী পরিপুষ্টি তিনটিই প্রভাবশালী হবে এবং মিশ্র ফলাফল প্রদান করবে।

তেমনি পোকায় ধরা , ত্রুটিপূর্ণ ও দুর্বল বীজ থেকে সৃষ্ট গাছ এবং দূষিত মাটিতে বপনকৃত ভালো বীজ থেকে সৃষ্ট গাছও নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে - এটাই স্বাভাবিক।

মানুষের বেলায় , একই প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী সন্তানের মধ্যে পিতা ও মাতার কাছ থেকে জন্মসূত্রে প্রাপ্ত প্রভাবের পাশাপাশি জন্মপরবর্তী পরিবেশ ও শিক্ষাও প্রভাবশালী হয়ে থাকে। তবে মানুষ তার বিচারবুদ্ধির পরিপক্বতায় উপনীত হবার পর স্বীয় চেষ্টা-সাধনা ও সংগ্রাম-সাধনার মাধ্যমে জন্ম , পরিবেশ ও শিক্ষা থেকে প্রাপ্ত অবাঞ্ছিত প্রভাব শারীরিক ও পার্থিব ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও এবং নৈতিক ক্ষেত্রে পুরোপুরি কাটিয়ে ঊঠতে পারে।

তৃতীয়তঃ সৃষ্টির সাফল্য ও ব্যর্থতার মানদণ্ড হচ্ছে সে জন্মগতভাবে যে সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে তার বিকাশ ও পূর্ণতায় উপনীত হওয়া বা না-হওয়াতে , অন্যের অনুরূপ হওয়া বা না-হওয়াতে নয়। বিড়ালের জন্য পরিপূর্ণ বিড়াল হওয়াতেই সার্থকতা , বাঘ হতে না পারা তার জন্য ব্যর্থতা নয়। একই প্রজাতির বিভিন্ন সদস্যের ক্ষেত্রেও তা-ই। অন্যদিকে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে মূল পার্থক্য তার বিচারবুদ্ধি ও ঐশী গুণাবলী , অতএব , তার সাফল্য ও ব্যর্থতার মানদণ্ড হচ্ছে এ গুণাবলীর বিকাশ ও ব্যবহার। এতে যে সফল , সে-ই প্রকৃত সফল এবং এতে যে ব্যর্থ সে-ই প্রকৃত ব্যর্থ।

অন্যদিকে পার্থিব ও অপার্থিব মিলিয়ে ব্যক্তির আশা-আকাঙ্ক্ষা ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে স্বতন্ত্র। তাই দেখা যায় যে , এক ব্যক্তি যা পাওয়ার জন্য লালায়িত এবং না পাওয়ার দুঃখে বুক ফেটে মারা যাবার উপক্রম , আরেক ব্যক্তি তা-ই অবজ্ঞাভরে পরিহার করছে। অতএব , সাফল্য-ব্যর্থতার অন্যতম ব্যক্তিগত মানদণ্ড এই আশা-আকাঙ্ক্ষও বটে , তবে কারো ব্যক্তিগত মানদণ্ড প্রকৃত বিচারে যথার্থ হতে পারে এবং কারো মানদণ্ড অযথার্থও হতে পারে। এ মানদণ্ডের যথার্থতা-অযথার্থতা নির্ণীত হবে অপার্থিব মানবিক মানদণ্ডের সাথে তুলনা করে। কারণ , এটাই মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মাঝে পার্থক্য নির্দেশ করে।

মানুষ অভিজ্ঞতা থেকে জানতে পারছে যে , বস্তুজগতের সাফল্য ও ব্যর্থতা এবং সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য একদিকে যেমন বিভিন্ন প্রাকৃতিক , অপ্রাকৃতিক ও মানবিক কারণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত , তেমনি মরণশীল মানুষের জন্য তা খুবই অস্থায়ী। অন্যদিকে মানুষ অবস্তুগত যা কিছু অর্জন করে তা বস্তুজগতের কারণাদির প্রভাবে তার হাতছাড়া হয় না এবং তা চিরস্থায়ী। তাই তার উচিত মানবিক ও আত্মিক সম্পদ অর্জনকেই সাফল্য ও ব্যর্থতার মানদণ্ড হিসেবে গণ্য করা এবং পার্থিব জীবন ও উপায়-উপকরণকে এ লক্ষ্যে উপনীত হবার মাধ্যমরূপে ব্যবহার করা।

মোদ্দা কথা , সৃষ্টিলোকে যা কিছু অবাঞ্ছিত উপাদান ও কারণ বলে মনে হয় তা মোটেই অযথা , বা অবাঞ্ছিত , বা অকল্যাণকর নয়। বরং সামগ্রিক ও চূড়ান্ত বিচারে সব কিছুতেই কল্যাণ নিহিত রয়েছে।

আমি কেন তুমি হলাম না ?!

এ প্রসঙ্গে আনুষঙ্গিক হিসেবে আরো একটি বিষয়ের ওপরে সংক্ষেপে হলেও আলোকপাত করা প্রয়োজন বলে মনে হয়। তা হচ্ছে , অনেক সময় অপূর্ণতার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতে দেখা যায়। যেমন: বলা হয় , সৃষ্টিকর্তা অমুককে বিকলাঙ্গ করে সৃষ্টি করলেন কেন ? আমি কেন সুন্দর চেহারার অধিকারী হলাম না ? তিনি কেন আমাকে ধনীর ঘরে পাঠালেন না অর্থাৎ আমি কেন ধনীর সন্তান হলাম না ? আমার মেধা-প্রতিভা অমুকের তুলনায় কম হলো কেন ? এ পরিবারে জন্ম নেয়ার কারণেই আমি দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছি। ইত্যাদি।

এসব অভিযোগের জবাবে যা বলতে হয় তা হচ্ছে , সৃষ্টিপ্রকৃতিতে অপূর্ণতা বলতে স্বতন্ত্র কিছু নেই , বরং পূর্ণতার অভাব বা ঘাটতিই অপূর্ণতা। আর পূর্ণতার অভাব বা ঘাটতি সৃষ্টিজগতের কার্যকারণ থেকেই উদ্ভূত হয় ; সৃষ্টিকর্তা পরিকল্পিতভাবে কারো মধ্যে ঘাটতি সৃষ্টি করে দেন না বা কাউকে পূর্ণতা থেকে বঞ্চিত করেন না। বিশেষ করে মানুষের ক্ষেত্রে এই অপূর্ণতা বা ঘাটতি অজ্ঞতা বা ভুল পদক্ষেপ থেকে উদ্ভূত হয়।

ওপরে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , কোনো বীজে ত্রুটি থাকলে বা ত্রুটিপূর্ণ মাটিতে বীজ বপন করা হলে অথবা পরিবেশগত অবনতি ঘটলে একটি বীজ থেকে ত্রুটিপূর্ণ গাছ জন্ম নিতে পারে এবং তা স্বাভাবিক পরিবৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত হতে পারে ও স্বাভাবিক ফল প্রদানে অসমর্থ হতে পারে। অনুরূপভাবে পিতার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন প্রাণবীজে বা মাতার ডিম্বে বা শরীরে ত্রুটি থাকলে অথবা পারিপার্শ্বিক ত্রুটির কারণে (যেমন: হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা নিক্ষেপ-পরবর্তীকালে সেখানকার বেঁচে থাকা বাসিন্দাদের মধ্যে ঘটেছে) বিকলাঙ্গ সন্তান জন্ম নিতে পারে। অতএব , এ জন্য সৃষ্টিকর্তাকে দোষারোপ করা ঠিক নয়।

সুন্দর চেহারার অধিকারী বা ধনীর সন্তান হওয়ার বিষয়টিও অনুরূপ। বিষয়টি নিম্নোক্ত উদাহরণের সাহায্যে অপেক্ষাকৃত সহজে বুঝা যেতে পারে।

-এর যে প্রাণবীজ -এর গর্ভে মানবশিশুতে পরিণত হয়েছে তা-ই রূপে জন্মগ্রহণ করেছে এবং উক্ত প্রাণবীজ ও গর্ভধারিনীর গর্ভকালীন অবস্থার ফলে যে ধরনের শিশু তৈরী হওয়া সম্ভব সে শিশুরূপেই ভূমিষ্ঠ হয়েছে। যে সময়ে -এর -বীজ দ্বারা -এর গর্ভসঞ্চার হয়ে -এর ভ্রূণ তৈরী হয়েছে সে সময় তা না হয়ে অন্য সময় হলে -এর অন্য কোনো বীজ দ্বারা -এর গর্ভসঞ্চার হলে তাতে -এর জন্ম হতো না , বরং -এর জন্ম হতো এবং হয়তোবা বীজ অথবা গর্ভকালীন অবস্থার পার্থক্যের কারণে সুন্দর চেহারা নিয়ে জন্মগ্রহণ করতো। অর্থাৎ -এর পক্ষে যা হওয়া সম্ভব ছিলো সে তা-ই হয়েছে , -এর পক্ষে হওয়া সম্ভব ছিলো না , কারণ উভয়ই স্বতন্ত্র।

ওপরের উদাহরণের -এর পক্ষে ধনীর সন্তান বা নামীদামী লোকের সন্তান হওয়ার বিষয়টিও অনুরূপ , বরং এর অসম্ভাব্যতা অধিকতর সুস্পষ্ট। কারণ , দরিদ্র -এর -প্রাণবীজ থেকে -এর জন্ম হয়েছে এবং ধনী -এর -প্রাণবীজ থেকে -এর জন্ম হয়েছে। এখন -এর পক্ষে কী করে হওয়া বা -এর সন্তান হওয়া সম্ভব হতো ?

অনুরূপভাবে -এর প্রাণবীজ দ্বারা -এর পরিবর্তে গর্ভবতী হলে সে সন্তান হতো না। এমনকি যদি ধরে নেয়া হয় যে , -এর -প্রাণবীজ থেকেই গর্ভবতী হয়েছে তথাপি সে সন্তান হতো না। কারণ , বৃক্ষের বৈশিষ্ট্য বিনির্মাণে বীজের ভূমিকা মুখ্য হলেও মাটির ভূমিকা উপেক্ষণীয় নয় , যে কারণে ছাতকের কমলার বীজ দার্জিলিং-এ লাগালে তাতে না ছাতকের কমলা হয় , না দার্জিলিং-এর , বরং তৃতীয় ধরনের কমলা হয়ে থাকে। অতএব , -প্রাণবীজ থেকে -এর পরিবর্তে -এর গর্ভে সন্তান হলে সে বর্তমান থেকে ভিন্ন এক ব্যক্তিরূপে জন্ম নিতো , এমনকি তার নাম রাখা হলেও।

আর -এর গর্ভে -এর -প্রাণবীজের পরিবর্তে -এর কোনো প্রাণবীজ থেকে গর্ভসঞ্চার হলে তা থেকে -এর জন্মগ্রহণের তো দূরতম সম্ভাবনাও থাকে না। কারণ , সন্তানের ব্যক্তিসত্তা নির্ধারণের মূল উপাদান হচ্ছে প্রাণবীজ ; ল্যাংরা আমের বীজ থেকে ল্যাংরা আম এবং ফজলী আমের বীজ থেকে ফজলী আম জন্ম নেবে ; মাটির অভিন্নতা একটিকে আরেকটিতে পরিবর্তিত করে দেয় না , যদিও মাটির পরিবর্তনে একই বীজের গাছের বৈশিষ্ট্যে অনেকখানি পার্থক্য হয়ে থাকে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে , যারা অসুন্দর , হীনস্বাস্থ্য , দুর্বল , বিকলাঙ্গ , ক্ষমতাহীন বা নিঃস্ব হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছে তাদের পক্ষে অন্য কেউ হয়ে জন্মগ্রহণ করা সম্ভব ছিলো না। অবশ্য তার জন্ম না হওয়া সম্ভব ছিলো , (কারণ , সে একজন সম্ভব অস্তিত্ব)। কিন্তু বিষয়টি তার পিতামাতার ওপর নির্ভরশীল এবং তার জন্মের জন্য তার পিতামাতার দায়িত্বহীন ইচ্ছা অথবা দায়িত্বহীন ইচ্ছা না থাকা সাপেক্ষে অজ্ঞতাই দায়ী।

আর ক্ষেত্রবিশেষে (যেমন: বিকলাঙ্গতা বা জন্মগত ব্যাধির ক্ষেত্রে) এ ধরনের সন্তানের জন্মগ্রহণের কারণে স্বয়ং সন্তানটির মনঃকষ্টের পরিমাণের চেয়ে তার পিতামাত্রার মনঃকষ্টের পরিমাণ অনেক গুণে বেশী হয়ে থাকে এবং ক্ষেত্রবিশেষে (যেমন: দারিদ্র্য ও অসৌন্দর্যের ক্ষেত্রে) সন্তানটি তার জন্মগ্রহণকে সম্ভাব্য জন্ম না নেয়ার ওপর অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। কোনো দরিদ্রসন্তানকে যদি জানানো হয় যে , দারিদ্র্যজনিত কারণে তার পিতামাতাকে কেউ এ সন্তানটি গর্ভে থাকাকালে গর্ভপাত ঘটানোর পরামর্শ দিয়েছিলো তখন ঐ পরামর্শদাতার প্রতি সন্তানটি সন্তুষ্ট হয় , নাকি অসন্তুষ্ট হয় তা লক্ষণীয়। নিঃসন্দেহে সে তার জন্ম না নেয়ার কথাটি কিছুতেই মেনে নিতে পারে না।


14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35