নবীর পাপমুক্ততা
কোনো ব্যক্তিকে নবী হিসেবে চিনতে পারার জন্য তাঁর মধ্যে অপর যে বৈশিষ্ট্যটি পাওয়া অপরিহার্য তা হচ্ছে , তাঁর গোটা জীবনই পাপমুক্ত হতে হবে।
নবুওয়াত দাবী করার পূর্বেই হোক বা পরেই হোক , যে ব্যক্তি সর্বজনীনভাবে বিচারবুদ্ধি কর্তৃক পাপ বা অপরাধ বা অন্যায় হিসেবে পরিগণিত কোনো কাজে কখনো লিপ্ত ছিলো , সুস্থ বিচারবুদ্ধির রায় অনুযায়ী সে ব্যক্তি নবী হতে পারে না। কারণ , এরূপ ক্ষেত্রে তার পাপ , অপরাধ বা অন্যায় কাজ সম্পর্কে অবগত ব্যক্তির পক্ষে তাকে নবী হিসেবে মনে করা সম্ভব হবে না। ফলে সে নবুওয়াতের দাবীদার ব্যক্তিকে ও তার দাবীকে প্রত্যাখ্যান করলে সৃষ্টিকর্তা ঐ ব্যক্তিকে‘
নবীকে প্রত্যাখ্যান করা’
র অপরাধে অপরাধী বলে গণ্য করবেন না - এটা বিচারবুদ্ধির এক অকাট্য রায়। আর লোকেরা যদি নবীকে নবী হিসেবে চিনতেই না পারে , বরং তাঁর নবুওয়াত-দাবীর ব্যাপারে যুক্তিসঙ্গত কারণে সন্দেহ-সংশয়ে নিপতিত হয় তাহলে সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে নবী প্রেরণের লক্ষ্যই অনর্জিত থেকে যাবে।
এ কারণে বিচারবুদ্ধির রায় হচ্ছে , সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার জন্য এটা অপরিহার্য যে , তিনি কোনো পাপমুক্ত ব্যক্তিকে নবী হিসেবে মনোনীত করবেন অথবা যাকে নবী হিসেবে মনোনীত করবেন তাঁকে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পাপ থেকে রক্ষা করবেন। মানুষকে বিভ্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য এটা অপরিহার্য।
বলা বাহুল্য যে , এখানে পাপ বলতে আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের দৃষ্টিতে যা অন্যায় বা অপরাধ তা-ই বিবেচ্য ; যে কাজের অন্যায় বা অপরাধ হওয়া বা না-হওয়া সম্পর্কে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে বিতর্ক আছে তা এখানে বিবেচ্য নয়। তাই মিথ্যাচার , হত্যা , ধর্ষণ , ব্যভিচার , চুরি-ডাকাতি , ধোঁকা-প্রতারণা , বিশ্বাসঘাতকতা , অন্যের সম্পদ জবর দখল ও আত্মসাত , আমানতের খেয়ানত , যুলুম-অত্যাচার , নির্যাতন ইত্যাদি অন্যায় কাজ কখনোই একজন নবীকে স্পর্শ করতে পারে না। তেমনি তাঁর জীবনকে - নবুওয়াত-দাবীর পূর্বেও - দ্বিত্ববাদী , ত্রিত্ববাদী বা বহুত্ববাদী ধারণা ও কার্যকলাপ স্পর্শ করতে পারে না।
এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে , বিচারবুদ্ধি সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব ও একত্ব সম্বন্ধে নিশ্চিত হবার পর তাঁর নিকট জবাবদিহিতার অনুভূতি ও তাঁর পক্ষ থেকে পথনির্দেশের প্রয়োজনীয়তাবোধের কারণেই নবীর সন্ধান করে থাকে। এ পথের শুরুর দিকেই , একত্ববাদে উপনীত হতে গিয়েই সে দ্বিত্ববাদ , ত্রিত্ববাদ , বহুত্ববাদ ও অবতারবাদ ইত্যাদিকে প্রত্যাখ্যান করে। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের বিচারবুদ্ধির ওপরে বিভিন্ন ধরনের ভ্রমাত্মক যুক্তি , চিন্তা ও অন্ধ বিশ্বাসের আবরণ পড়তে পারে এবং এর ফলে তার অন্তরে বিচারবুদ্ধির রায় হাল্কা ও অগভীর হয়ে পড়তে পারে বা সে গতানুগতিকতার বিরোধী বিচারবুদ্ধির রায়কে স্বীয় মস্তিষ্কে পোষণ করতে ও লোকদের সামনে প্রকাশ করতে ভয় পেতে পারে ও সে কারণে তা জোর করে চাপা দিতে পারে ; অতঃপর নবী বা নবীর পক্ষ থেকে কেউ এসে তাকে সত্যকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে তার বিচারবুদ্ধির রায়কেই সুতীক্ষ্ণ করার চেষ্টা করতে পারেন।
অন্য কথায় , নবীর মূল কাজই হচ্ছে জীবন ও জগতের মহাসত্য সম্বন্ধে এবং নিজের , অন্যদের ও স্রষ্টার প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য তথা ঔচিত্য-অনৌচিত্য সম্বন্ধে মানুষের বিচারবুদ্ধির রায়কে শানিত করা ; বিতর্কিত বিষয়াদিতে সঠিক ফয়সালা এ দায়িত্বেরই সম্প্রসারণ মাত্র। এমতাবস্থায় চিন্তা বা কর্মের দিক থেকে বা উভয় দিক থেকেই কখনো না কখনো দ্বিত্ববাদ , ত্রিত্ববাদ , বহুত্ববাদ বা অবতারবাদে বিশ্বাসী ছিলো , অথবা সর্বজনস্বীকৃত কোনো অন্যায় বা পাপ কাজে কখনো না কখনো নিশ্চিতভাবেই লিপ্ত ছিলো - এমন ব্যক্তিকে বিচারবুদ্ধির পক্ষে স্রষ্টার পক্ষ থেকে মনোনীত নবী হিসেবে মেনে নেয়া সম্ভব হতে পারে না।
দ্বিতীয়তঃ এরূপ অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে , স্রষ্টার পক্ষে কি নবীর দায়িত্ব দেয়ার জন্য কোনো তাওহীদবাদী পাপমুক্ত মানুষ গড়ে তোলা অসম্ভব যে , কখনো না কখনো অংশীবাদে বা সর্বজনস্বীকৃত অন্যায় বা পাপে লিপ্ত ছিলো এমন একজন লোককে নবুওয়াতের দায়িত্ব দেবেন ?
তৃতীয়তঃ এরূপ পরিস্থিতি ভণ্ড নবীর আবির্ভাবের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরী করে দেয়। কারণ , নবুওয়াতের মর্যাদার পার্থিব সম্মান লাভ অথবা মানুষকে বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে যে কোনো পাপাচারী লোকের পক্ষে নবী সেজে বসা সম্ভব। এ অবস্থায় এরূপ ব্যক্তি দাবী করতে পারে যে , সে আগে অংশীবাদী বা পাপকর্মে লিপ্ত হয়ে থাকলেও সৃষ্টিকর্তা অনুগ্রহ করে তাকে নবী পদে অভিষিক্ত করেছেন এবং এ দায়িত্বে অভিষিক্ত হবার পর থেকে আর সে অংশীবাদ বা পাপ কর্মে লিপ্ত হয় নি।
চতুর্থতঃ এরূপ অবস্থায় যে কারো বিচারবুদ্ধি একজন প্রকৃত নবীকে ভণ্ড নবী মনে করে প্রত্যাখ্যান করতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে এ প্রত্যাখ্যানের জন্য তাকে অপরাধী গণ্য করা যাবে না। কারণ , এমনকি একজন অংশীবাদী বা পাপকর্মে লিপ্ত ব্যক্তি কর্তৃকও কাউকে নবী হিসেবে গ্রহণ করতে হলে তা বিচারবুদ্ধির রায়ের ভিত্তিতেই করতে হবে ; এর কোনো বিকল্প নেই। এমতাবস্থায় বিচারবুদ্ধিই যদি কাউকে ভণ্ড নবী বলে রায় দেয় তখন তাকে নবী হিসেবে গ্রহণ করা কারো জন্যই অপরিহার্য হতে পারে না।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে , অংশীবাদী বা কখনো না কখনো সর্বজনস্বীকৃত অন্যায় বা পাপ কর্ম সম্পাদনকারী ব্যক্তিকে নবুওয়াত প্রদান করা হলে নবী প্রেরণের মূল উদ্দেশ্যই ভণ্ডুল হয়ে যায়। অতএব , এ ব্যাপারে বিতর্কের অবকাশ নেই যে , একজন নবীকে তাঁর জীবনের নবুওয়াত দাবী করার পূর্ববর্তী অধ্যায়েও তাওহীদবাদী (একত্ববাদী) ও পাপমুক্ত হতে হবে।
এছাড়া যিনি নবী হবেন তাঁর জন্য তাঁর জীবনের নবুওয়াত দাবী করার পূর্ববর্তী অধ্যায়েও মনবতাবোধ , দয়ার্দ্রতা , সদাচরণ , পরোপকার , সাহসিকতা , নিঃস্বার্থপরতা , লোভহীনতা ইত্যাদি সদগুণের অধিকারী হওয়াও অপরিহার্য যাতে তাঁর নবী হওয়ার ব্যাপারে মানুষের মনে সহজেই আস্থার সৃষ্টি হতে পারে।
তবে মনে রাখা দরকার যে , নবীর পাপমুক্ততার বিষয়টি এমন নয় যে , নবীর মধ্যে পাপে লিপ্ত হবার ক্ষমতাই থাকবে না। বরং মানুষ হিসেবে প্রাপ্ত স্বাধীনতার বিচারে নবী ও অন্য মানুষের মধ্যে পাপে লিপ্ত হবার ক্ষমতার ব্যাপারে কোনোই পার্থক্য থাকা সম্ভব নয়। কারণ , কোনো মানুষের পাপে লিপ্ত হবার ক্ষমতা কেড়ে নিলে সে আর মানুষ থাকবে না ; ফেরেশতার সমপর্যায়ভুক্ত হবে। আর বলা বাহুল্য যে , এরূপ ব্যক্তি মানুষের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ হতে পারে না। কারণ , সে ক্ষেত্রে মানুষের জন্য এ যুক্তি তৈরী হয়ে যায় যে , নবীর মধ্যে তো পাপের ক্ষমতাই নেই , তাই সে পাপ করে না ; আমাদের মধ্যে পাপে লিপ্ত হবার ক্ষমতা রয়েছে , তাই আমাদের পক্ষে পাপে লিপ্ত হওয়াই স্বাভাবিক।
বরং নবীর পাপমুক্ততার বিষয়টি সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে স্বাভাবিক মানবিক কার্যকারণের মধ্য দিয়ে নিশ্চিতকরণই স্বাভাবিক ও সর্বজনীন বিচারবুদ্ধির নিকট গ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ জন্মগতভাবে রক্তধারার পবিত্রতা ও সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক নবীরূপে মনোনীত ব্যক্তি হিসেবে এ মর্যাদার সাথে সাংঘর্ষিক চিন্তা , কথা ও কাজ পরিহারের স্বাভাবিক প্রবণতার কারণে নবীর মধ্যে শুরু থেকেই এমন একটি রুচিবোধ ও চরিত্র গড়ে ওঠে যার ফলে ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও পাপ কর্মের প্রতি তাঁর মধ্যে কোনোরূপ আগ্রহ সৃষ্টি হয় না , বরং ঘৃণা সৃষ্টি হয়। উদাহরণস্বরূপ , মানুষ পায়খানা-পেশাব ভক্ষণ ও পান করতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও কারো মধ্যে এর আগ্রহ সৃষ্টি হয় না (ব্যতিক্রম হিসেবে কদাচিৎ বহু কোটি মানুষের মধ্যে দু’
একটি চরম বিকৃতরুচি ব্যক্তিকে এ কাজ করতে দেখা গেলেও) , বরং সকল মানুষই এর প্রতি ঘৃণা বোধ করে থাকে। নবীর মধ্যে এই রূচিবোধই সর্বোচ্চ পর্যায়ের হয়ে থাকে যার ফলে সকল পাপ ও নোংরা কাজের প্রতি তাঁর মধ্যে ঘৃণা জন্ম নিয়ে থাকে।
এ প্রসঙ্গে আরো দু’
একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো পরিস্কার হতে পারে। যেমন: একটি অবুঝ শিশু একটি ফণা-তোলা সাপের বা একটি প্রদীপের শিখার সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে তা ধরার জন্য আগ্রহী হতে পারে , কিন্তু কোনো বুদ্ধিমান মানুষ এ কাজে অগ্রসর হবে না বা আগ্রহ অনুভব করবে না। কারণ , শিশু সাপের সৌন্দর্য দেখলেও বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এ সৌন্দর্যের আড়ালে সাক্ষাৎ মৃত্যু বা চরম যন্ত্রণা দেখে শিউরে ওঠে। তেমনি সংশ্লিষ্ট বস্তুর প্রকৃত অবস্থা সম্বন্ধে অজ্ঞ একজন লোক বিদ্যুতবাহী তার স্পর্শ করতে বা পানি মনে করে এসিড পান করতে দ্বিধা করবে না এবং পিপাসার্ত অবস্থায় জানা না থাকার কারণে বিষমিশ্রিত শরবত পান করতে আগ্রহ অনুভব করবে। কিন্তু যার সংশ্লিষ্ট বস্তুর প্রকৃত অবস্থা জানা আছে সে সযত্নে এ সব থেকে দূরে থাকবে ; পিপাসায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হলেও জানা অবস্থায় কিছুতেই সে এসিড বা বিষমিশ্রিত শরবত পান করবে না। ঠিক এভাবেই নবীর দৃষ্টিতে যে কোনো পাপকাজের ভয়াবহ পরিণাম সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে বিধায় তিনি এ থেকে দূরে থাকবেন এবং এর প্রতি কখনোই আগ্রহ অনুভব করবেন না - এটাই বিচারবুদ্ধির দাবী।
অনেক সময় কোনো কোনো নবী সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে বা এমনকি ধর্মগ্রন্থে এমন সব বর্ণনা পাওয়া যায় যা থেকে মনে হয় যে , তাঁরা কখনো কখনো পাপকার্যে লিপ্ত হয়েছিলেন। কিন্তু যেহেতু বিচারবুদ্ধি নবীর পাপে লিপ্ত হবার বিষয়টি গ্রহণ করে না , সেহেতু এ ক্ষেত্রে তিনটি অবস্থা হতে পারে। তা হচ্ছে , হয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আদৌ নবী ছিলেন না , অথবা সংশ্লিষ্ট বর্ণনাটি মিথ্যা বা বিকৃত , নয়তো বর্ণনাটির সঠিক তাৎপর্য গ্রহণ করা হয় নি।
নবী হচ্ছেন মানুষের কাছে স্রষ্টার পথনির্দেশ পৌঁছাবার প্রত্যক্ষ মাধ্যম এবং পূর্ণ শর্তাবলী বিশিষ্ট প্রতিনিধি , আর মানুষের জন্য স্রষ্টার মনোনীত নেতা ও শাসক। এ পদ মানুষের মধ্যকার সর্বোত্তম মর্যাদাপূর্ণ পদ। তাই যুগে যুগে সত্য নবী ছাড়াও বহু মিথ্যা নবীরও আবির্ভাব ঘটেছে । এরূপ ভণ্ড-প্রতারক ব্যক্তিরা স্বীয় প্রতারণার চক্রের সদস্যদের দ্বারা পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা মু‘
জিযাহও প্রচার করে থাকে। তাই নবুওয়াতের দাবীদার কোনো ব্যক্তির জীবন সম্বন্ধে ব্যাপক ও গভীরভাবে অনুসন্ধান চালানো প্রয়োজন। অনুসন্ধানে তার জীবনে কখনো কোনো পাপকর্ম‘
অকাট্যভাবে’
প্রমাণিত হলে সে ব্যক্তি যে নবী নয় , বরং নবী হওয়ার মিথ্যা দাবীদার , অথবা সে নিজে দাবী না করলেও স্বার্থান্বেষীরা তাকে তথাকথিত নবী বানিয়েছে - তাতে সন্দেহ নেই।
অন্যদিকে বিচারবুদ্ধি বলে , ভণ্ড-প্রতারক পাপাচারীরা কোনো কোনো নবীর বা অনেক নবীর বা নবীদের (আঃ) নামে পাপকর্মের মিথ্যা কাহিনী তৈরী করে থাকতে পারে। দু’
ধরনের লোকেরা এ কাজ করে থাকতে পারে। প্রথমতঃ কোনো নবীর বা নবীদের (আঃ) বিরোধীরা - যাদের উদ্দেশ্য ছিলো সংশ্লিষ্ট নবী বা নবীদের (আঃ) সম্বন্ধে মানুষকে বিভ্রান্ত করা এবং তাঁর বা তাঁদের ওপর অনাস্থা সৃষ্টি করা । দ্বিতীয়তঃ কোনো নবীর বা নবীদের (আঃ) অনুসারী হবার দাবীদার পাপাচারী লোকেরা যারা নিজেদের পাপকর্মের সপক্ষে সাফাই ও অজুহাত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নবীর বা নবীদের (আঃ) নামে মিথ্যা রচনা করেছে।
কোনো বা কোনো কোনো ধর্মের মূল ধর্মীয় সূত্র থেকে কোনো বা কোনো কোনো নবীর দ্বারা পাপকর্ম সম্পাদিত হয়েছিলো বলে ধারণা পাওয়া গেলে সে ব্যাপারে বিচারবুদ্ধি তিনটি কারণ খুঁজে পায়। প্রথমতঃ সূত্রটি অকাট্যভাবে গ্রহণযোগ্য না হতে পারে। অর্থাৎ সূত্রটিকে যে বা যার সাথে সম্পর্কযুক্ত বলে দাবী করা হয় তা তাঁর বা তাঁদের সাথে সম্পর্কিত না-ও হতে পারে এবং তাঁর বা তাঁদের নামে অন্য কারো রচিত হতে পারে। বিশেষ করে তাঁর বা তাঁদের থেকে শুরু করে প্রতিটি স্তরের বর্ণনাকারীদের ঐতিহাসিকতা ও ন্যায়নিষ্ঠতার অকাট্যতা এবং প্রতি স্তরে তাঁদের সংখ্যা বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে মিথ্যা রচিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যানের জন্য যথেষ্ট বলে পরিগণিত না-ও হতে পারে। ফলে এরূপ সূত্রে কোনো নবী বা নবীদের (আঃ) দ্বারা পাপকার্য সম্পাদনের বর্ণনা বিচারবুদ্ধির নিকট মোটেই গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয় না।
দ্বিতীয়তঃ ধর্মীয় সূত্রটি উপরোক্ত মানদণ্ডে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ থেকে উৎসারিত বলে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হলে এবং সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের গ্রহণযোগ্যতাও বিচারবুদ্ধির আদালতে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হলে সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সূত্রে কোনো বা কোনো কোনো নবীর (আঃ) পাপকর্মে লিপ্ত থাকার কথা উল্লিখিত পাওয়া গেলে তার দু’
টি অবস্থা হতে পারে। প্রথমতঃ পাঠকের নিকট পাপকর্মের যে সংজ্ঞা বা সীমারেখা রয়েছে তা বিচারবুদ্ধির নিকট সর্বজনীন ও অকাট্যভাবে গ্রহণযোগ্য না-ও হতে পারে। অর্থাৎ নবীর বা নবীদের যে কাজের উল্লেখ দেখে পাঠক তাকে পাপকর্ম বলে মনে করতে পারেন , তা হয়তো আদৌ পাপকর্ম নয়। অর্থাৎ যে কাজের পাপ হওয়ার বিষয়টি বিতর্কিত পাঠক তাকেই অকাট্যভাবে পাপ বলে মনে করে নিয়েছেন। দ্বিতীয়তঃ পাঠক সংশ্লিষ্ট ধর্মীয় সূত্রের অর্থ গ্রহণে ভুল করে থাকতে পারেন। এ প্রসঙ্গে দু’
একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো পরিস্কার হবে।
গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় সূত্র তাওরাত ও কোরআন মজীদে প্রথম মানুষের নাম‘
আদম’
বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা বাহুল্য যে , প্রথম মানুষ হিসেবে তিনি নবীও ছিলেন বটে। তাওরাত ও কোরআনে বলা হয়েছে যে , সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ ভুলে গিয়ে তিনি ও তাঁর স্ত্রী নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করেন। অনেকেই এটিকে মানুষের প্রথম পাপ বলে মনে করে। (শুধু তা-ই নয় , অনেকেই মনে করে যে , এ পাপের কারণেই তাঁকে সস্ত্রীক বেহেশত থেকে বের করে দেয়া হয় ; নইলে মানব প্রজাতি আজো বেহেশতেই থাকতো , যদিও কোরআনে বলা হয়েছে যে , পৃথিবীর বুকে সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধির দায়িত্ব পালনের জন্যই তাঁকে সৃষ্টি করা হয়েছিলো।) কিন্তু ঐ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ সর্বজনীনভাবে বিচারবুদ্ধির নিকট অন্যায় বা পাপ বলে পরিগণিত কাজসমূহের (যার অনেকগুলোর কথাই আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি) অন্তর্ভুক্ত ছিলো না। দ্বিতীয়তঃ উক্ত উভয় সূত্র থেকেই সুস্পষ্ট যে , তখন পর্যন্ত সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে হযরত আদম (আঃ)-কে কোনোরূপ ধর্মীয় বিধিবিধান প্রদান করা হয় নি। ফলে বিচারবুদ্ধি কেবল এটাই বলে না যে , ঐ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করার ফলে সর্বজনীনভাবে পাপ বা অন্যায় বলে পরিগণিত কোনো কাজ সম্পাদিত হয় নি , বরং এ-ও বলে যে , এর দ্বারা সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে প্রদত্ত কোনো বিশেষ‘
বিধান’
ও লঙ্ঘিত হয় নি। বরং এ ছিলো মানুষকে প্রদত্ত স্বাধীনতা মানুষ কীভাবে প্রয়োগ করতে পারে তার একটি পরীক্ষা মাত্র। পূর্ব-অভিজ্ঞতাবিহীন হযরত আদম ও হযরত হাওয়া (আঃ) কৌতুহলবশে ও শয়তানের দ্বারা প্রতারিত হয়ে ভুলবশতঃ উক্ত বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করেন , যদিও এ ভুল কাজ করার কারণে তাঁরা কিছু না কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হন।
তাছাড়া এ-ও হতে পারে যে , তখনো তাঁরা শর‘
ঈ দায়িত্ব-কর্তব্য প্রযোজ্য হবার বয়সে উপনীত হন নি। অতএব , এ ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় না যে , নবী পাপকার্যে জড়িত হতে পারেন।
এবার ধর্মীয় সূত্র থেকে ভুল অর্থ গ্রহণের একটি দৃষ্টান্ত। কোরআন মজীদের বর্ণনা থেকে এরূপ তাৎপর্য গ্রহণ করা হয়েছে যে , হযরত ইবরাহীম (আঃ) প্রথমে নক্ষত্র , চন্দ্র ও সূর্যকে‘
রব’
(প্রভু/ সৃষ্টিকর্তা) মনে করেছিলেন অর্থাৎ তিনি ঐ সময় সাময়িকভাবে হলেও অংশীবাদী ধারণা পোষণ করেছিলেন। কিন্তু এ ঘটনার বর্ণনাকে তার পূর্ববর্তী আয়াত সমূহের সাথে মিলিয়ে পড়লে দেখা যায় যে , ঘটনাটি তাঁর নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনের জন্য অভিষিক্ত হওয়ার পরবর্তী কালের। অতএব , সংশ্লিষ্ট অংশীবাদী কথাগুলো তাঁর নয় , বরং অন্য কারো। অর্থাৎ একজন অংশীবাদী ও হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর মধ্যকার কথোপকথনকে এক ব্যক্তির অর্থাৎ হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর একার উক্তি বলে গণ্য করায় এরূপ ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে।
নবীগণের (আঃ) পাপমুক্ততা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনার দাবীদার।
এখানে বিচারবুদ্ধির আলোকে মূল বিষয়টি প্রতিপাদনের লক্ষ্যে এতোটুকু আলোচনাই যথেষ্ট বলে মনে করি।
মহাসত্যের প্রশ্নে নবীর আপোসহীনতা
নবীর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জীবন ও জগতের অস্তিত্বের পিছনে নিহিত মহাসত্য প্রশ্নে আপোসহীনতা। বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে কোনো রকম প্রলোভন , ভয়-ভীতি , এমনকি জীবনাশঙ্কার মুখেও নবী তাঁর নবুওয়াতের দাবী এবং জীবন ও জগতের অস্তিত্বের পিছনে নিহিত মহাসত্য প্রকাশ হতে বিরত থাকতে পারেন না। কারণ , তাঁকে নবী হিসেবে মনোনীত করার উদ্দেশ্যই এটা। আর মূল উদ্দেশ্য পরিত্যাগ করলে নবী আর নবী থাকেন না বা বলা যেতে পারে যে , নবী ও অ-নবীর মধ্যকার মৌলিক পার্থক্য বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাই নবী সর্বাবস্থায়ই মহাসত্য প্রকাশ ও প্রচারের কাজ অব্যাহত রাখবেন।
অবশ্য নবীর আপোসহীনতার মানে এ নয় যে , তিনি জোর করে মানুষের ওপর মহাসত্যকে চাপিয়ে দেবেন বা সদাই সত্যপ্রত্যাখ্যানকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থাকবেন। কারণ , সত্য চাপিয়ে দেয়ার বা জোর করে গ্রহণ করানোর বিষয় নয়। নবীর কাজ হচ্ছে মানুষের বিচারবুদ্ধিকে জাগ্রত করানো এবং তার সামনে মহাসত্যকে পেশ করা। বরং সষ্টার প্রতিনিধি স্বাধীনতার অধিকারী সৃষ্টি মানুষের ওপর কোনো চিন্তা ও কাজ জোর করে চাপিয়ে দেয়া মস্ত বড় অন্যায় , আর নবীর আবির্ভাবের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে এ অন্যায় চর্চার অবসান ঘটানো। অতএব , অন্যদের ওপর স্বীয় বক্তব্য চাপিয়ে দিয়ে তিনি নিজেই এ উদ্দেশ্যের বিপরীত আচরণ করতে পারেন না। এমনকি কোনো জনগোষ্ঠী তাঁকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করলে এবং সেখানে তাঁর দাওয়াত আরো বিস্তারের কোনো সম্ভাবনা না থাকলে তিনি সংঘাত এড়াতে বা স্বীয় অনুসারীদের জীবন রক্ষার্থে এবং সত্য প্রকাশ ও প্রচারের কাজ অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে দেশ ত্যাগ করে অন্য কোথাও চলে যেতে পারেন। অন্যদিকে বিচারবুদ্ধি এ-ও বলে যে , উপযুক্ত পরিবেশ পেলে তিনি স্বীয় অনুসারীদের ওপর স্বীয় শাসন-কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবেন এবং এটা তাঁর স্বাভাবিক অধিকার। আর এ কাজে কেউ বাধা দিলে ও সে ক্ষেত্রে সঙ্গতি থাকলে অথবা পরিস্থিতি বাধ্য করলে তিনি স্বীয় অনুসারীদেরকে সাথে নিয়ে সত্যকে রক্ষার জন্য যুদ্ধও করবেন। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তিনি পার্থিব স্বার্থে সত্য প্রকাশ ও প্রচারের ক্ষেত্রে কমবেশী করবেন না। এ পথে তাঁকে জীবন দিতে হলেও এ ব্যাপারে তিনি আপোস করবেন না।
কেবল প্রয়োজনেই নবী প্রেরণ
নবুওয়াত সম্বন্ধে সবশেষে যে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি বলা অপরিহার্য তা হচ্ছে , মহান প্রজ্ঞাময় স্রষ্টা কোনো বাহুল্য কাজ করতে পারেন না। অতএব , বিচারবুদ্ধির রায় হচ্ছে এই যে , অপরিহার্য প্রয়োজনীয় না হলে তিনি অযথাই কোনো নবী প্রেরণ করেন না। এখানে‘
প্রয়োজন’
মানে মানুষের প্রয়োজন। অর্থাৎ মানব জাতির নিকট তাঁর প্রেরিত পথনির্দেশ পরিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ রূপে এবং অবিকৃতভাবে বিদ্যমান থাকলে তিনি এরপরও নতুন করে নবী ও পথনির্দেশ পাঠাবেন - এটা বিচারবুদ্ধির নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। তাই এরূপ পরিস্থিতিতে কেউ নবুওয়াত লাভের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ দাবী করলে তার সে দাবী বিবেচনাযোগ্য নয়।