বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে নবুওয়াতে মুহাম্মাদী ( ছ্বাঃ )
মুসলমানদের দ্বারা সর্বশেষ নবী ও রাসূল হিসেবে অনুসৃত হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর ঐতিহাসিক অস্তিত্ব সম্বন্ধে সামান্যতম বিতর্কেরও অবকাশ নেই। পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণের (আঃ) অস্তিত্ব ও নবুওয়াতের বিষয়টি যেখানে ধর্মীয় সূত্রের ওপর নির্ভর করে ইতিহাসে স্থানলাভ করেছে , সেখানে হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর ঐতিহাসিক অস্তিত্ব ধর্মীয় সূত্রের ওপর নির্ভরতা ছাড়াই অকাট্যভাবে প্রমাণিত।
সপক্ষ-বিপক্ষ নির্বিশেষে কোনো ঐতিহাসিক সূত্রই হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর ঐতিহাসিক অস্তিত্ব এবং এখন থেকে চৌদ্দ শতাব্দী আগে (খৃস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর শুরুর দিকে) আরবের বুকে তাঁর নবুওয়াত-দাবী সম্বন্ধে না সন্দেহ প্রকাশ করেছে , না এ ব্যাপারে ধর্মীয় সূত্রের ওপর নির্ভর করেছে। যারা তাঁর নবুওয়াত-দাবীকে সত্য বলে স্বীকার করেন নি , তাঁরাও স্বীকার করেছেন যে , তিনি খৃস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর অষ্টম দশকের শুরু থেকে খৃস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর চতুর্থ দশকের শুরুর দিক পর্যন্ত আরব ভূমিতে জীবনযাপন করেন এবং নিজেকে নবী বলে দাবী করেন।
তিনি ছিলেন মদীনার বুকে প্রথম প্রতিষ্ঠানিক রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতিষ্ঠাতা এবং তৎকালীন বিশ্বের বৃহত্তম সাম্রাজ্যগুলোর সম্রাটদেরকে তাঁর দ্বীন গ্রহণের জন্য আহবান জানিয়ে তিনি যে সব পত্র লিখেছিলেন তা মানব জাতির ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য দলীল সমূহের অন্যতম। এ সব কারণে তাঁর ঐতিহাসিক অস্তিত্ব সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র সন্দেহ পোষণের কোনো সুযোগই নেই।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় , হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) আরবের মক্কাহ্ নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং চল্লিশ বছর বয়সে নিজেকে নবী বলে দাবী করেন। এরপর দীর্ঘ তেরো বছর যাবত নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে সেখানে নিজ ধর্মমত (ইসলাম) প্রচার করেন। অতঃপর তিনি মদীনায় গিয়ে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেন। মক্কাস্থ তাঁর প্রতিপক্ষ সহ বিভিন্ন শক্তির সাথে তাঁকে কয়েক বার যুদ্ধও করতে হয়। এছাড়া তিনি তৎকালীন হাবাশাহ্ (আবিসিনিয়া - বর্তমান ইথিওপিয়া) সম্রাট , মিসর সম্রাট , পারস্য সম্রাট ও রোম সম্রাটের নিকট পত্রসহ প্রতিনিধিদল প্রেরণ করেন। এ সবই ঐতিহাসিক ঘটনা। তাই তাঁর অস্তিত্ব ও নবুওয়াত-দাবী সম্পর্কে জানার জন্য ইতিহাসকে ধর্মীয় সূত্রের বা তাঁর অনুসারীদের ওপর নির্ভর করতে হয় নি।
তিনি কেমন মানুষ ছিলেন ? তা জানার জন্যও ইতিহাসকে ধর্মীয় সূত্র (কোরআন মজীদ) বা তাঁর অনুসারীদের (মুসলমানদের) ওপর নির্ভর করতে হয় নি।
মক্কাহ্ নগরীতে তিনি হঠাৎ করে আবির্ভূত কোনো অপরিচিত বহিরাগত বা রহস্যজনক ব্যক্তি ছিলেন না। তিনি নবুওয়াত-দাবীর পূর্বাপর মিলিয়ে তিপ্পান্ন বছর বয়স পর্যন্ত মক্কায় এবং পরবর্তী দশ বছর মদীনায় সকলের সামনে ও সকলের মধ্যে বসবাস করেন। সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান হিসেবে মক্কায় তিনি ছিলেন একজন সুপরিচিত ব্যক্তি ; তবে নবুওয়াত-দাবীর পূর্ব পর্যন্ত কোনো গুরুত্বপূর্ণ বা প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন না , বরং একজন অত্যন্ত ভালো সাধারণ মানুষ ছিলেন। চল্লিশ বছর বয়সে তিনি নবুওয়াত লাভ করেছেন বলে দাবী করেন ও গোপনে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ কিছু সংখ্যক মানুষের কাছে তা প্রকাশ করেন। এরপর তেতাল্লিশ বছর বয়স থেকে তিনি প্রকাশ্যে ও ব্যাপকভাবে তাঁর নবুওয়াত-দাবী এবং সর্বসাধারণের অংশীবাদী ধর্মমতের বিপরীতে স্বীয় একত্ববাদী ধর্মমতের প্রচার শুরু করেন।
নবুওয়াত-দাবীর পূর্বে তিনি কোনো নেতা , সমাজপতি , পুরোহিত বা ধর্মনেতা , জ্ঞানী-মনীষী , দার্শনিক , বাগ্মী , কবি-সাহিত্যিক , ভাষাবিদ বা অন্য কোনো ধরনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন না। এমনকি তিনি লেখাপড়াও জানতেন না ; তিনি ছিলেন নিরক্ষর। তাই কোনো ধর্মগ্রন্থ বা অন্য কোনো ধরনের গ্রন্থ পঠন-অধ্যয়নের সুযোগও তাঁর হয় নি।
তাঁর সময়ে মক্কাহ্বাসীদের মধ্যে লেখাপড়াজানা লোকের সংখ্যা ছিলো খুবই কম ; তাঁর নবুওয়াত-দাবী কালে এদের সংখ্যা ছিলো জনাবিশেকের মতো। তাই সে সময় কোনো লোকের লেখাপড়া জানা থাকলে তা অন্যদের জানা না থাকার প্রশ্নই ওঠে না। তিনি কোনো অসাধারণ প্রতিভাবান ব্যক্তিও ছিলেন না। বলা বাহুল্য , লেখাপড়া না জানলেও কোনো অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ব্যক্তির প্রতিভার বহিঃপ্রকাশ কোনো না কোনোভাবে ঘটেই , তাই এরূপ প্রতিভা দীর্ঘ চার দশক কাল গোপন থাকতে পারে না। তাঁর কাছ থেকে এ ধরনের কোনো প্রতিভার বহিঃপ্রকাশও ঘটে নি।
কিন্তু তিনি জ্ঞানী-গুণী , প্রতিভাবান , নেতৃস্থানীয় বা প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন না বটে , তবে তৎকালীন অংশীবাদী প্রায় অসভ্য আরবের সেই কলুষিত পরিবেশে তিনি ছিলেন একজন খুবই ভালো মানুষ। আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে সকল মানুষের কাছে তথা সুস্থ বিচারবুদ্ধির কাছে উত্তম বলে বিবেচিত গুণাবলী , যেমন: সত্যবাদিতা , আমানতদারী , পরোপকারিতা , দয়ার্দ্রতা , শান্তিপ্রিয়তা ইত্যাদির জন্য তিনি সুপরিচিত ছিলেন। অন্যদিকে মিথ্যা , পরস্ব অপহরণ , যুলুম-অত্যাচার , হত্যা , সন্ত্রাস , আমানতের খেয়ানত , ব্যভিচার , নেশাখোরী ইত্যাদি যতো রকমের খারাপ ও নিন্দনীয় কাজ তৎকালীন আরবকে , বিশেষ করে মক্কাহকে মহামারীর মতো গ্রাস করেছিলো তা বিন্দুমাত্রও তাঁকে স্পর্শ করে নি। এ কারণে তিনি মক্কাহবাসীদের সকলের কাছেই প্রিয়পাত্র ছিলেন। কিন্তু তিনি যখন তাদের অংশীবাদী ধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থাকে ভ্রান্ত বলে অভিহিত করেন এবং একত্ববাদ প্রচার করতে শুরু করেন তখন তারা তাঁর শত্রুতে পরিণত হয়। তবে শত্রুতে পরিণত হলেও তখনো তারা তাঁর সকল উত্তম গুণের ওপরই আস্থা পোষণ করতো। এ কারণেই তাদের অনেকেই দূরদেশে সফরে গমনকালে নিজ ধর্মের লোকদের কাছে স্বীয় ধনসম্পদ আমানত রেখে যেতে ভরসা না পেয়ে তাঁর নিকট আমানত রেখে যেতো। এমনকি কেবল ভিন্ন মতাবলম্বী হবার কারণে তারা যখন তাঁকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয় তখনো তাঁর নিকট তাদের মধ্যকার বহু লোকের ধনসম্পদ গচ্ছিত ছিলো এবং তিনি গোপনে মক্কাহ্ ত্যাগ করে মদীনায় চলে যাবার সময় ঐ সব ধনসম্পদ তাদের মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার দায়িত্বে অবহেলা করেন নি , বরং এ কাজের জন্যে তিনি তাঁর চাচাতো ভাই হযরত আলী (আঃ)-কে দায়িত্ব দিয়ে যান।
তিনি প্রচলিত ধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন , দেবদেবীদের অসারতার কথা বলেন , এভাবে সমাজের শত্রুতার উদ্রেক করে নিজেকে বিপদাপন্ন করেন। পার্থিব স্বার্থের পূজারী স্থিতাবস্থার সমর্থকদের দৃষ্টিতে তাঁর এ আচরণ ছিলো পাগলামি স্বরূপ। অথচ তারা জানতো যে , তিনি পাগল ছিলেন না। তিনি পাগলসুলভ কোনো আচরণই করেন নি। তিনি বরং তাদের চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণার অন্ধত্বের বিরুদ্ধে কথা বলেন। সকলকে বিচারবুদ্ধির রায় মেনে চলার আহবান জানিয়ে এবং জীবন ও জগতের মহাসত্য সম্বন্ধে বিচারবুদ্ধির অকাট্য যুক্তি উপস্থাপন করে তিনি প্রমাণ করেন যে , এই সহজ-সরল নিরক্ষর সাধারণ মানুষটি সহসাই এমন এক জ্ঞানীতে পরিণত হয়েছেন যে , তিনি ইতিহাসের সকল যুগের শ্রেষ্ঠতম দার্শনিক-মনীষীদের ও ধর্মীয় পণ্ডিতদের পর্যন্ত ছাড়িয়ে গেছেন। কিন্তু অন্যদের মতো পার্থিব স্বার্থের দিকে না তাকিয়ে সত্য প্রকাশের মাধ্যমে নিজেকে বিপদাপন্ন করার কারণে , আভিধানিক অর্থে নয় , রূপকার্থে তারা তাঁকে পাগল বলে আখ্যায়িত করে।
কিন্তু তারা যেমন জানতো , তেমনি মক্কাহর সর্ব স্তরের মানুষই জানতো যে , তিনি পাগল নন , বরং মহাসত্যের প্রকাশক। তাই ক্রমেই সমাজের মুক্তবিবেক সৎ মানুষেরা ও মযলূম লোকেরা একজন-দু’
জন করে তাঁর অনুসারী হতে থাকেন। বিশেষ করে তিনি আল্লাহর নিকট থেকে প্রাপ্ত ওয়াহী (প্রত্যাদেশ) হিসেবে দাবী করে যে সব বক্তব্য প্রকাশ করেন তার সুউচ্চ সাহিত্যিক মান , প্রাঞ্জলতা , ওজস্বিতা , মাধুর্য ও জ্ঞানগর্ভতার প্রভাবে বহু লোক তাঁর নবুওয়াতের দাবী মেনে নিয়ে তাঁর অনুসারী হয়ে যান। এমতাবস্থায়‘
পাগল’
আখ্যা কোনোই কাজ না দেয়ায় কায়েমী স্বার্থের ধারক-বাহকরা তাঁকে কবি বলে আখ্যায়িত করে। কিন্তু তারা জানতো যে , তিনি কবি নন।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে , মানব জাতির ভাষাসমূহের মধ্যে আরবী ভাষা সর্বাধিক প্রকাশক্ষমতার সম্ভাবনার অধিকারী এবং এ ক্ষেত্রে অন্য কোনো ভাষার পক্ষেই আরবী ভাষার ধারেকাছেও পৌঁছা সম্ভব নয়। সংক্ষিপ্ততম বক্তব্যে সূক্ষ্মতম ও গভীরতম তাৎপর্য প্রকাশের ক্ষমতার কারণে আরবরা তাদের ভাষাকে বলতো“
লিসানে‘
আরাবী”
(সূক্ষ্মতম ভাব প্রকাশক্ষম প্রাঞ্জল ভাষা) , আর আরব ও অনারবদের ভাষার প্রকাশক্ষমতার মধ্যকার আকাশ-পাতাল পার্থক্য বিবেচনা করে তারা অনারবদেরকে বলতো‘
আজামী (বোবা)। তারা মনে করতো , বোবা প্রাণীদের (পশু-পাখীদের) যেমন কোনো ভাষা নেই , বরং কতোগুলো ধ্বনির সাহায্যে কোনো মতে তারা নিজেদের মধ্যে ভাববিনিময় করে , ঠিক সেভাবেই অনারবদের ভাষা আদৌ ভাষা পদবাচ্য নয় ; তারা কতোগুলো শব্দ ও বাক্য দ্বারা কোনো মতে নিজেদের অপরিহার্য প্রয়োজনীয় ভাব বিনিময় করে থাকে।
বস্তুতঃ সভ্যতার আলো বিবর্জিত আরবদের গৌরব করার মতো অন্য কোনো সাংস্কৃতিক উপাদান বা সভ্যতার নিদর্শনই ছিলো না। তাদের গৌরব করার মতো একটিমাত্র সাংস্কৃতিক উপাদান ছিলো , তা হচ্ছে তাদের ভাষা। আর তৎকালে আরবী ভাষা , বিশেষ করে কবিতার ক্ষেত্রে , প্রকাশক্ষমতার শীর্ষে উপনীত হয়েছিলো। প্রতি বছর মক্কায়‘
ওকায্ মেলা’
নামে একটি মেলা অনুষ্ঠিত হতো এবং এ উপলক্ষ্যে আরব কবিদের মধ্যে কবিতা প্রতিযোগিতা হতো। এতে আরবী ভাষার শ্রেষ্ঠ কবিগণ তাঁদের কবিতা পরিবেশন করতেন এবং প্রবীণ কবি ও ভাষাবিদগণ সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সাতটি শ্রেষ্ঠতম কবিতা নির্বাচন করতেন। এ কবিতাগুলো স্বর্ণক্ষরে লিপিবদ্ধ করে কা‘
বাহ্ গৃহের দেয়ালগাত্রে ঝুলিয়ে রাখা হতো এবং এ কারণে এগুলোকে“
সাব্‘
আহ্ মু‘
আল্লাক্বাহ্”
(ঝুলন্ত সাত) বলা হতো।
কিন্তু এ সব কবিতা ইতিপূর্বে জনমনে বিস্ময়কর সম্মোহনী প্রভাব সৃষ্টি করলেও হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর নিকট নাযিলকৃত ঐশী গ্রন্থ কোরআন মজীদের আয়াত ও সূরা হিসেবে দাবী করে যে সব বক্তব্য পেশ করেন তা মানুষের হৃদয়-মনে এমনই গভীর প্রভাব সৃষ্টি করে যে , তার কাছে ঐ সব কবিতা নিস্প্রভ হয়ে পড়ে। তাছাড়া শ্রেষ্ঠতম আরবী কবিতাগুলোতে প্রাঞ্জলতা , ওজস্বিতা , ভাষার সৌন্দর্য ও ভাবের গভীরতা যতোই থাকুক না কেন , তাতে একই সাথে জ্ঞানগর্ভতা ও জীবনপথে চলার জন্য পথনির্দেশের স্থানদান সম্ভব হয় না যা কোরআন মজীদে রয়েছে।
এ কারণে আরবরা ভালোভাবেই জানতো যে , হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) কবি নন এবং কোরআন কোনো কাব্যগ্রন্থ নয়।
অন্যদিকে কোরআনের প্রভাবে যারা আকৃষ্ট হন এর প্রতি তাঁদের আকর্ষণ ছিলো এতোই গভীর ও ব্যাপক যে , তাঁরা প্রচলিত ধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থা এবং এর ধারক-বাহক সমাজপতি , ধর্মনেতা , এমনকি স্বীয় পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনকে পর্যন্ত পরিত্যাগ করে হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর দলেই শুধু ভিড়ে যান নি , বরং প্রত্যেকে নিজের জীবনের চেয়েও তাঁকে বেশী ভালোবাসতে লাগলেন।
যেহেতু জাদু-মন্ত্রের দ্বারা স্বামী-স্ত্রী , ভাই-ভাই ও স্বজনদের মধ্যে বিচ্ছেদ সৃষ্টি করা হয় , সেহেতু কোরআনের প্রভাবে আরবদের সমাজে ও পরিবারে ভাঙ্গন সৃষ্টি হওয়ায় হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর বিরোধীরা কোরআনকে জাদু ও তাঁকে জাদুকর বলে অভিহিত করাকেই যথোচিত মনে করে , যদিও তারা জানতো যে , তিনি জাদুকর নন এবং কোরআন কোনো জাদু নয়। কারণ , জাদুকরের কাজের পিছনে থাকে হীন উদ্দেশ্য। ধর্ম ও সমাজ সংস্কার , মানুষকে চিন্তা-চেতনার অন্ধত্ব থেকে মুক্ত করে বিচারবুদ্ধির আলোকোজ্জ্বল জগতে এনে স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্যে ছেড়ে দেয়ার যে মহান দায়িত্ব কোরআন পালন করছে , জাদুকর তা করে না। তেমনি স্রেফ মানসিক শক্তি বা প্রভাবসৃষ্টিকারী কিন্তু জ্ঞানমূলক বিষয়বস্তু বিহীন জাদুমন্ত্রের সাথে জ্ঞানগর্ভমূলক ও পথনির্দেশক কোরআনের আয়াত সমূহ ও সূরাকে কিছুতেই তুলনা করা চলে না। তবু অনন্যোপায় হয়ে তারা এ ভিত্তিহীন আখ্যায় তাঁকে ও কোরআনকে আখ্যায়িত করে। কিন্তু সর্বজনীনভাবে ঘৃণ্য ও নিন্দনীয় - এমন কোনো দোষ তারা তাঁর ওপর আরোপ করতে পারে নি। আর তা করলেও মানুষের কাছে সে মিথ্যা দোষারোপ গ্রহণযোগ্য হতো না। সকলের কাছে সুপরিচিত ও সর্বোত্তম বলে পরিগণিত এ মানুষটির বিরুদ্ধে যে কোনো মিথ্যা দোষারোপ করলেই যে মানুষ তা মেনে নেবে এমন ভরসা তাদের ছিলো না। বরং এতে হিতে বিপরীত হবার আশঙ্কাই ছিলো বেশী।
তৎকালীন আরব উপদ্বীপে মক্কাহর অংশীবাদীরা ছাড়াও ইয়াহূদী ও খৃস্টানদের বসবাস ছিলো। এ তিন গোষ্ঠীরই আরব উপদ্বীপের বাইরে যোগাযোগ ছিলো। তৎকালীন বিশ্বে রোম ও পারস্য সাম্রাজ্য ছিলো দু’
টি বৃহৎ শক্তি। এছাড়া মিসর ও আবিসিনিয়ায় (বর্তমান ইথিওপিয়ায়)ও দু’
টি উল্লেখযোগ্য রাষ্ট্রশক্তি ছিলো। হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) মদীনায় যাওয়ার পর সেখানে রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠা করেন এবং উপরোক্ত চারটি দেশের শাসকদের নিকটই ইসলামের দাও‘
আত দিয়ে পত্র প্রেরণ করেন।
এর আগে তিনি মক্কায় থাকাকালে তাঁর অনুসারীদের একাংশ আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন। মক্কাহর অংশীবাদীরা তাঁর বিরুদ্ধে মোকাবিলার জন্যে মিত্র সন্ধান করতে ও তাঁকে কোণঠাসা করতে আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজ্জাসীর দরবারে ও পরবর্তীকালে রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াসের দরবারে প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিলো। এ উভয় প্রতিনিধি-দলই হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর বিরুদ্ধে প্রচলিত ধর্মমতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও নতুন ধর্মমত প্রচারের অভিযোগ করে , কিন্তু সর্বজনীন দৃষ্টিতে মন্দ , দোষ বা অপরাধ বলে পরিগণিত এমন কোনো কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে পেশ করে নি , বরং সর্বজনীন দৃষ্টিতে উত্তম বলে পরিগণিত গুণাবলীতে তাঁর ভূষিত থাকার কথা তারা স্বীকার করে।
আরবের ইয়াহূদী ও খৃস্টানদেরও অনেকেই তাঁকে নবী বলে মেনে নেয় নি এবং তাদের অনেকেই পরে আরবের বাইরে চলে যায়। কিন্তু তারাও তাঁর বিরুদ্ধে কোনোরূপ দোষের কথা প্রচার করে নি। তারা তাদের নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থের ভবিষ্যদ্বাণীর ভিত্তিতে প্রতিশ্রুত নবী বা ত্রাণকর্তার আবির্ভাবের জন্য প্রতীক্ষা করছিলো। তবে তাদের ধারণা ছিলো যে , সে নবীর আবির্ভাব তাদের মধ্যেই ঘটবে। কিন্তু তা না হওয়ায় , বরং মক্কাহর ক্বুরাইশদের মধ্যে এ নবীর আবির্ভাব হওয়ায় এবং তিনি তাদের ধর্মে পুঞ্জীভূত মিথ্যা ও কুসংস্কারের বিরোধিতা করায় আরবের ইয়াহূদী ও খৃস্টানদের বেশীর ভাগই তাঁর অনুসরণ করতে আগ্রহী হয় নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপন করার মতো কোনো দোষ খুঁজে পায় নি।
মোদ্দা কথা , সপক্ষ-বিপক্ষ নির্বিশেষে ঐতিহাসিক সূত্রসমূহের মুতাওয়াতির্ বর্ণনা থেকে কয়েকটি বিষয় নিশ্চিতভাবে জানা যায়। তা হচ্ছে:
*হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব যার স্থান ও কাল সম্বন্ধে কোনোরূপ অস্পষ্টতা বা সংশয় নেই।
*জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি সমাজমানুষের মধ্যে বসবাস করেন। ফলে তাঁর জীবনের কোনো অধ্যায় বা কোনো দিকের ওপর কোনোরূপ অজ্ঞানতা , অস্পষ্টতা বা রহস্যময়তার আবরণ নেই।
*তিনি ছিলেন সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত উত্তম গুণাবলীর আধার এবং সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত মন্দ গুণাবলী থেকে মুক্ত। এ ব্যাপারে শত্রু-মিত্র কারো মধ্যে কোনোরূপ দ্বিমতের অবকাশ নেই।
*তিনি নিজেকে নবী বলে দাবী করেছিলেন।
*তিনি খুবই ভালো লোক ছিলেন , কিন্তু তিনি ছিলেন নিরক্ষর ; লেখাপড়া জানতেন না ; কোনোদিন কোনো বই-পুস্তক পড়েন নি বা কোনো শিক্ষকের নিকট শিক্ষা গ্রহণ করেন নি। নবুওয়াত দাবী করার পূর্বে তিনি কোনোরূপ জ্ঞানী-গুণী , দার্শনিক , কবি , ভাষাবিদ , ধর্মনেতা বা সমাজনেতা ছিলেন না এবং তাঁর মধ্যে কোনোরূপ বিশেষ প্রতিভা লক্ষ্য করা যায় নি। কিন্তু নবুওয়াত দাবী করার সাথে সাথে তিনি জীবন ও জগতের মহাসত্য সম্বন্ধে এবং মানব জীবনের সকল দিকের জন্য পথনির্দেশমূলক এমন সব জ্ঞানপূর্ণ ও তত্ত্বমূলক কথা বলতে শুরু করেন যা পরবর্তী কালের সকল যুগের সকল জ্ঞানী-গুণী , মনীষী ও দার্শনিকের বিস্ময় উৎপাদন করে এবং তিনি এমন ভাষায় সে বক্তব্য পেশ করেন যে , আরবী ভাষার শ্রেষ্ঠতম কবি , ভাষাবিদ ও বাক্যবাগীশগণ পর্যন্ত প্রাঞ্জলতা , ওজস্বিতা , সৌন্দর্য , ভাব ও জ্ঞানগর্ভতার বিচারে সে বক্তব্যের কাছে হার মানতে বাধ্য হন। কিন্তু এ সব কিছুর জন্য তিনি নিজের বাহাদুরী দাবী করেন নি। বরং তিনি দাবী করেন যে , এ সবই সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে তাঁকে প্রত্যাদেশ করা হয়েছে যাতে তিনি মানুষের কাছে তা পৌঁছে দেন।
তাঁর এ অবস্থা এবং তাঁর আকস্মিক পরিবর্তন পর্যালোচনা করলে বিচারবুদ্ধির পক্ষে তাঁর নবুওয়াত-দাবী মেনে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।