জীবন জিজ্ঞাসা

জীবন জিজ্ঞাসা5%

জীবন জিজ্ঞাসা লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

জীবন জিজ্ঞাসা
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 58 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 42141 / ডাউনলোড: 4649
সাইজ সাইজ সাইজ
জীবন জিজ্ঞাসা

জীবন জিজ্ঞাসা

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

শ্রেষ্ঠতম ও সর্বোত্তম মানুষ

মানব জাতির ইতিহাসে হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) যে শ্রেষ্ঠতম ও সর্বোত্তম মানুষ এ সত্য তাঁর ধর্মের অনুসারী নন এমন জ্ঞানী-গুণীরাও স্বীকার করেছেন। একজন নবীর মধ্যে যে সব ইতিবাচক গুণাবলী থাকা প্রয়োজন তিনি তার সবগুলোরই পূর্ণ মাত্রায় অধিকারী ছিলেন এবং যে সব নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য থেকে একজন নবীর মুক্ত থাকা অপরিহার্য তিনি তা থেকে পুরোপুরি মুক্ত ছিলেন। এহেন ব্যক্তি যখন নিজেকে নবী বলে দাবী করেন তখন যে কোনো সত্যপন্থী সুস্থ বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ তাঁকে নবী হিসেবে স্বীকার করতে বাধ্য। পার্থিব লাভ-লোভ , পদমর্যাদা এবং পাছে লোকে কিছু বলে ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও সংস্কারের কাছে আত্মসমর্পণ করে নি এমন সুস্থ বিচারবুদ্ধি অবশ্যই তাঁকে নবী হিসেবে মেনে নেবে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে , পাশ্চাত্যের অনেক মনীষী কোরআন মজীদের জ্ঞানগর্ভতা ও সাহিত্যিক সৌন্দর্যের বিচারে এবং তাঁর জীবনাচরণ ও ঐতিহাসিক ভূমিকার কারণে হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-কে মানব জাতির ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম ও একক অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী শ্রেষ্ঠতম জ্ঞানী ও সর্বোত্তম মানুষ হিসেবে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে কার্যতঃ কোরআনকে তাঁর রচিত গ্রন্থ বলে দাবী করেছেন। অর্থাৎ তাঁরা তাঁকে নবী বলে মানতে অস্বীকার করেছেন। কিন্তু হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর নিরক্ষর অবস্থায় এরূপ মহাজ্ঞানী হওয়া কী করে সম্ভব হলো এবং দীর্ঘ চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর এ কথিত অসাধারণ প্রতিভার মোটেই বহিঃপ্রকাশ না ঘটাই বা কী করে সম্ভব হলো - তার জবাব এ সব মনীষী প্রদান করেন নি।

তার চেয়েও বড় কথা , তাঁরা যে ব্যক্তির [হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর] সর্বোত্তম গুণাবলীতে মোহিত হয়ে তাঁকে মানবজাতির ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম মানুষ বলে অভিহিত করলেন , তিনি স্বয়ং যেখানে নিজেকে নবী বলে দাবী করেছেন , সেখানে তাঁকে অসাধারণ প্রতিভা বলে অর্থাৎ নবী নন বলে অভিহিত করে কার্যতঃ তাঁকে পরোক্ষভাবে নবী হওয়ার মিথ্যা দাবীদার বলে অভিহিত করেছেন।

এভাবে উক্ত মনীষীগণ স্ববিরোধিতার আশ্রয় নিয়েছেন। কারণ , বিদ্যমান ঐতিহাসিক ও অন্যান্য তথ্য-প্রমাণাদির ভিত্তিতে তিনি প্রকৃতই মানব জাতির শ্রেষ্ঠতম ও সর্বোত্তম মানুষ বলে যদি তাঁদের প্রত্যয় জন্মে থাকে তাহলে তাঁরা তাঁর নবুওয়াত-দাবীকে শ্রদ্ধাভরে মেনে নিতে বাধ্য। আর তাঁরা যদি তাঁর নবুওয়াতের দাবীকে মিথ্যা মনে করে থাকেন (যা করলে অবশ্য তার কারণ ও প্রমাণ পেশ করা অপরিহার্য - যা তাঁরা করেন নি) তাহলে তাঁদের পক্ষ থেকে তাঁর এতো সব প্রশংসা ভণ্ডামি বৈ নয়। কারণ , কোনো ব্যক্তি নবী না হয়েও নিজেকে নবী বলে দাবী করলে তাঁকে মানবজাতির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম ও সর্বোত্তম মানুষ বলে অভিহিতকরণ এক ধরনের ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।

বস্তুতঃ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর গুণ-বৈশিষ্ট্যসমূহ ঐতিহাসিক সূত্রে এমনভাবে বর্ণিত হয়েছে যে , তা অস্বীকার করা বা এড়িয়ে যাওয়া কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। তাই এ সব মনীষী তা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছেন , কিন্তু স্বীয় অন্তরের ব্যাধিগ্রস্ততার কারণে তাঁরা তাঁকে নবী বলে স্বীকার করার পরিবর্তে অসাধারণ প্রতিভা বলে তাঁর প্রশংসাকীর্তণ করে তাঁর নবুওয়াত থেকে অন্যদের দৃষ্টিকে ফিরিয়ে রাখার অপচেষ্টা করেছেন।

প্রতিশ্রুত নবী

রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) সম্পর্কে এ পর্যন্ত যা কিছু উল্লেখ করা হলো বিচারবুদ্ধির নিকট তাঁর নবুওযাত-দাবী গ্রহণযোগ্য হবার জন্য তা-ই যথেষ্ট। তা সত্ত্বেও এতদসংক্রান্ত প্রত্যয়কে অধিকতর শক্তিশালী করার জন্য বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে প্রতিশ্রুত নবী সংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতি দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে।

কোরআন-পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থ সমূহের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা ও প্রামাণ্যতা প্রমাণ করা সম্ভব নয় - এ এক অকাট্য সত্য। এ সব ধর্মগ্রন্থ হয় পুরোপুরি মানবরচিত , নয়তো ঐশী গ্রন্থের বিকৃত ও পরিবর্তিত রূপ - এতেও সন্দেহ নেই। তবে বিকৃত ও পরিবর্তিত হলেও এ সব গ্রন্থে যে মূল গ্রন্থাবলীর কিছু কিছু বক্তব্য রয়ে গেছে তাতেও বিচারবুদ্ধি সন্দেহ পোষণ করে না। এমনকি মানবরচিত হলেও তাতে যে ঐশী গ্রন্থের কিছু কিছু বক্তব্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তাতেও সন্দেহ করার কারণ নেই। দ্বিতীয়তঃ বিচারবুদ্ধি এ-ও স্বীকার করে যে , বিকৃতির নায়করা কোনো দলীলে কেবল সেই সব বিষয়ই পরিবর্জন , বিকৃত বা সংযোজন করে থাকে যা তাদের অন্যায় স্বার্থের হেফাযতের জন্য প্রয়োজন। যা কিছু তাৎক্ষণিকভাবে তাদের স্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক নয় তা বিকৃত বা বর্জন না করাই স্বাভাবিক। এভাবে এসব গ্রন্থে অতীতের ঐশী গ্রন্থাবলীর অনেক বক্তব্য রয়ে গেছে বলে বিচারবুদ্ধি রায় প্রদান করে।

অতীতের এ সব ধর্মগ্রন্থে একটি অভিন্ন বিষয় পাওয়া যায় , তা হচ্ছে একজন প্রতিশ্রুত নবী বা ত্রাণকর্তা বা অবতার সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী। এ সব ভবিষ্যদ্বাণীতে সৃষ্টিকর্তার বিশ্বজনীন বাণী নিয়ে একজন নবী বা ত্রাণকর্তার আবির্ভাবের কথা যেমন বলা হয়েছে , তেমনি তাঁর নাম , আবির্ভাবস্থল , পরিচয়বাচক বিভিন্ন নিদর্শন , কার্যকলাপ ও তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘাত-প্রতিঘাতের কথাও বলা হয়েছে। এর সবগুলোই একমাত্র হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর সাথে মিলে যায়। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে মূল ভাষার গ্রন্থ হারিয়ে যাওয়া ও অন্য ভাষায় অনূদিত হওয়ার কারণে কতক মূল নামও হারিয়ে যায় এবং তদস্থলে অনূদিত নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। অর্থাৎ ব্যক্তি ও স্থানের নামকে গুণবাচক বিশেষ্য গণ্য করে অনুবাদ করা হয়েছে। কিন্তু এ সব নামকে আরবী ভাষায় অনুবাদ করলে মূল নাম পাওয়া যায়। শুধু তা-ই নয় , বার্নাবাসের ইনজীল্ সহ কতক গ্রন্থে এখনো সুস্পষ্ট ভাষায় মুহাম্মাদ , আহমাদ্ [হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর অপর নাম] ইত্যাদি মূল নাম বহাল দেখতে পাওয়া যায়। [বলা বাহুল্য যে , হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর জন্মের পূর্ব থেকে চলে আসা এ সব গ্রন্থ যে মুসলমানদের রচিত নয় এবং এ সব ভবিষ্যদ্বাণীর পিছনে যে মুসলমানদের কোনো কারসাজি থাকতে পারে না - সে ব্যাপারে বিতর্কের অবকাশ নেই।] এ বিষয়ে বিভিন্ন ভাষায় বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে।

এবার আমরা এ সব ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে বিচারবুদ্ধির আলোকে সাধারণভাবে পর্যালোচনা করবো। এ পর্যালোচনা এ জন্য প্রয়োজন যে , প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ সমূহের অনুসারী হবার দাবীদারগণ তাঁদের ধর্মগ্রন্থে একজন প্রতিশ্রুত নবী বা ত্রাণকর্তার আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী থাকার কথা স্বীকার করা সত্ত্বেও হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-ই যে সেই নবী বা ত্রাণকর্তা তা মেনে নিতে রাযী নন। তাঁদের এ অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা কয়েকটি সর্বজনস্বীকৃত ও অকাট্যভাবে প্রমাণিত সত্যের পুনরুল্লেখ করে অতঃপর প্রতিশ্রুত নবী বা ত্রাণকর্তার আবির্ভাব বিষয়ক প্রশ্নের সমাধান নির্দেশের চেষ্টা করবো।

এ প্রসঙ্গে অকাট্যভাবে প্রমাণিত ও সর্বজনস্বীকৃত বিষয়গুলো হচ্ছে এই:

*মুসলমানদের দ্বারা সর্বশেষ নবী ও রাসূল হিসেবে অনুসৃত হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর পূর্ববর্তী কোনো নবী প্রতিশ্রুত নবী বা প্রতিশ্রুত ত্রাণকর্তা নন। কারণ , পূর্ববর্তী প্রতিটি উল্লেখযোগ্য ধর্মগ্রন্থেই এ বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। এর মানে ঐ সব গ্রন্থ রচনাকালে বা তার পূর্বে প্রতিশ্রুত নবীর আগমন ঘটে নি।

হযরত মূসা (আঃ) উক্ত প্রতিশ্রুত নবী নন। কারণ , তিনি নিজেকে প্রতিশ্রুত নবী বলে দাবী করেন নি। বরং তাওরাতে প্রতিশ্রুত নবীর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যা তাঁর প্রতিশ্রুত নবী না হওয়ার সপক্ষে অকাট্য প্রমাণ।

হযরত ঈসা (আঃ)ও সেই প্রতিশ্রুত নবী নন। কারণ , ইয়াহূদীরা তাঁকে আদৌ নবী বলে মানে না। অতএব , তাদের কাছে তাঁর প্রতিশ্রুত নবী হবার প্রশ্নই ওঠে না। আর খৃস্টানরা তাঁকে খোদার পুত্র মনে করলেও তিনি নিজেকে প্রতিশ্রুত নবী বলে দাবী করেছেন এমন কথা খৃস্টানদের উপস্থাপিত ইনজীল্ বলে দাবীকৃত কোনো পুস্তকেই নেই , বরং এ সব পুস্তকে তাঁর পক্ষ থেকে ত্রাণকর্তা (পারাক্লিতাস্)-এর আগমনের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। তাই ইয়াহূদী ও খৃস্টান উভয় ধর্মের অনুসারীরাই প্রতিশ্রুত মেসিয়াহ্ বা পারাক্লিতাসের তথা প্রতিশ্রুত নবীর আবির্ভাবের জন্য প্রতীক্ষা করছে।

একইভাবে হিন্দু ধর্মের অনুসারীরাও কলির অবতার -এর আগমনের জন্য অপেক্ষা করছে।

*হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর আবির্ভাব ও ঐশী গ্রন্থ হিসেবে কোরআন মজীদকে পেশ করার পূর্ব পর্যন্ত বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে প্রচলিত ধর্মগ্রন্থসমূহের তিনটি নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে: (১) এ সব গ্রন্থ অবিকৃত নেই। (২) এ সব গ্রন্থে কালোত্তীর্ণ ও বিশ্বজনীন তথা সকল যুগের সকল মানুষের জন্য ব্যবহারযোগ্য বিধিবিধান ও পথনির্দেশ নেই। (৩) এ সব গ্রন্থে মানবজীবনের সকল দিকের জন্য পথনির্দেশ ও বিধিবিধান নেই। অর্থাৎ এ সব গ্রন্থ পথনির্দেশক হিসেবে অপূর্ণ।

*হযরত ঈসা (আঃ)-এর অন্তর্ধানের পর প্রায় দুই হাজার বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে একমাত্র হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) ছাড়া নবুওয়াতের গুণ-বৈশিষ্ট্যের অধিকারী নবুওয়াতের দাবীদার দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির আবির্ভাব হয় নি।

*এমতাবস্থায় হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) যদি নবী না হয়ে থাকেন তো মেনে নিতে হবে যে , সৃষ্টিকর্তা সুদীর্ঘ কাল যাবত মানব জাতিকে পথনির্দেশ ও পথনির্দেশক বিহীন অবস্থায় ফেলে রেখেছেন। মানবতা পথভ্রষ্টতার পঙ্কিলাবর্তে পড়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী হাবুডুবু খাচ্ছে , কিন্তু সৃষ্টিকর্তা তাদের প্রতি দৃষ্টি দিচ্ছেন না। তারা পথনির্দেশক ও ত্রাণকর্তার জন্য অপেক্ষা করছে , কিন্তু তিনি তাদের সে প্রয়োজন পূরণ করছেন না। তিনি যে প্রতিশ্রুত নবী ও ত্রাণকর্তা পাঠাবেন বলে কথা দিয়েছিলেন সে প্রতিশ্রুতি পূরণের প্রয়োজন অনুভব করছেন না। এ প্রতিশ্রুতি যদি আরো পরে পূরণ করা হয় , তো এ দীর্ঘ সময়ের হতভাগ্য পথভ্রষ্টদের অবস্থা কী হবে ? তাদের পথভ্রষ্টতার জন্য কে দায়ী হবে ? স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই কি দায়ী হবেন না ?

কিন্তু পরম দয়াবান ও মেহেরবান পরম জ্ঞানী সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা তথা পরম প্রমুক্ত অপরিহার্য সত্তা সম্বন্ধে এমন হীন , নীচ ও সঙ্কীর্ণ ধারণা পোষণ করা চলে কি ?

এমতাবস্থায় হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর নবুওয়াত-দাবীর বিষয়টিকে নিরপেক্ষভাবে ও বিচারবুদ্ধির আলোকে বিবেচনা করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই:

*হযরত ঈসা (আঃ)-এর অন্তর্ধানের প্রায় ৫৮০ বছরের মাথায় হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) নবুওয়াত দাবী করেন যখন হযরত ঈসা (আঃ)-এর ওপর নাযিলকৃত ঐশী গ্রন্থও (যা তখন পর্যন্ত সর্বশেষ ঐশী গ্রন্থ) ব্যাপকভাবে বিকৃত হয়েছে এবং এর অনেকগুলো ব্যাপক প্রচলিত বিকৃত সংস্করণের ভিড়ে অপেক্ষাকৃত নির্ভুল সংস্করণ পরিত্যক্ত ও বিস্মৃত হয়ে গেছে।

*একজন নবীর মধ্যে যে সব অপরিহার্য গুণ থাকা প্রয়োজন তার সবগুলোই তাঁর মধ্যে পাওয়া যায় এবং যে সব নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য থেকে নবীর মুক্ত থাকা প্রয়োজন তা থেকে তিনি মুক্ত ছিলেন।

*পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থসমূহে প্রতিশ্রুত নবী বা ত্রাণকর্তার যে নাম পাওয়া যায় (যেমন: বার্নাবাসের ইনজীলে উল্লিখিত মুহাম্মাদ আহমাদ ) তাঁর নাম-ও তা-ই , অথবা সংশ্লিষ্ট গ্রন্থে বর্ণিত নাম আরবী ভাষায় অনুবাদ করলে তাঁর নামের শব্দেই অনুবাদ করতে হয়। প্রতিশ্রুত নবীর আবির্ভাব ও তৎপরতার স্থান (যেমন: উটের দেশ , ফারান পর্বত ইত্যাদি) সংক্রান্ত এবং তাঁর জীবনে ঘটিতব্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী ইত্যাদির ভবিষ্যদ্বাণী তাঁর সাথে মিলে যায়।

*ঐশী গ্রন্থ হিসেবে তিনি যে গ্রন্থ পেশ করেছেন তা বিগত প্রায় দেড় হাজার বছর যাবত অবিকৃত রয়েছে - এ ব্যাপারে বিতর্কের অবকাশ নেই।

*তিনি নিজেকে (স্থান-কাল নির্বিশেষে তাঁর যুগ ও পরবর্তীকালীন) সকল মানুষের জন্য আল্লাহর রাসূল বলে দাবী করেছেন - যা পূর্ববর্তী কোনো নবী করেছেন বলে জানা যায় না। তিনি আরো দাবী করেছেন যে , পূর্ববর্তী গ্রন্থাবলীতে তাঁরই আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে।

*তিনি যে গ্রন্থ পেশ করেছেন তা সাহিত্যিক সৌন্দর্য ও জ্ঞানগর্ভতার বিচারে পূর্ববর্তী সকল গ্রন্থের তুলনায় শ্রেষ্ঠতর এবং মানবিক ক্ষমতার উর্ধে। এ গ্রন্থ অনুরূপ মানসম্পন্ন কোনো গ্রন্থ বা এর কোনো অধ্যায় (সূরা)-এর মানসম্পন্ন কোনো অধ্যায় রচনার জন্য সমগ্র মানব প্রজাতিকে চ্যালেঞ্জ প্রদান করেছে এবং এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রতিটি চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ এখনো বিদ্যমান রয়েছে।

*তিনি মানবজীবনের প্রতিটি দিক-বিভাগের জন্য প্রয়োজনীয় বিধিবিধান , মূলনীতি ও পথনির্দেশ প্রদান করেছেন। তিনি ঐশী গ্রন্থ হিসেবে দাবী করে যে গ্রন্থ (কোরআন) পেশ করেছেন তা মানবিক জীবনবিধানকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছে বলে তথা পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান পেশ করেছে বলে দাবী করেছে।

*কোরআন সীমাহীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের আধার। বিস্ময়কর প্রকাশকৌশলের আশ্রয় নিয়ে মধ্যম আয়তনের এ গ্রন্থে সকল জ্ঞানকে এমনভাবে নিহিত রাখা হয়েছে যে , যতো বার নতুন করে অধ্যয়ন-গবেষণা করা হচ্ছে ততোই তা থেকে নতুন নতুন জ্ঞান-উপকরণ ও দিকনির্দেশ বেরিয়ে আসছে - যা মানবিক গ্রন্থে অসম্ভব। এমন কোনো যুগজিজ্ঞাসা আজ পর্যন্ত পাওয়া যায় নি যার জবাব দানে এ গ্রন্থ ও এ নবীর রেখে যাওয়া পথনির্দেশ অপারগ হয়েছে।

*তিনি নিজেকে সর্বশেষ নবী বলে দাবী করেছেন এবং ঘোষণা করেছেন যে , তাঁর পরে আর কোনো নতুন নবীর আগমন ঘটবে না।

এ সব বিষয় বিবেচনা করার পর মুক্ত বিবেক ও সুস্থ বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন কোনো মানুষের পক্ষে হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-কে প্রতিশ্রুত নবী ও ত্রাণকর্তা বলে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানানো সম্ভব কি ? কেবল স্বার্থান্ধতাই এ সত্য মেনে নেয়া থেকে কাউকে বিরত রাখতে পারে। তাঁর এ পরিচয় জানার পরেও যারা মুখে তাঁকে অস্বীকার করছে তাদের অন্তর অবশ্যই তাঁকে সত্য বলে সাক্ষ্য দেয়। তাদের অন্তরের সাক্ষ্য ও মুখের অস্বীকৃতি উভয়ই তাদের দেহের প্রতিটি কোষে , হয়তোবা প্রতিটি পরমাণুতে , লিপিবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে যা একদিন তাদের সামনে উন্মোচিত হয়ে তাদের স্ববিরোধিতার অপরাধকে অকাট্যভাবে প্রমাণ করে দেবে।

স্রষ্টার বাইরে সৃষ্টির অস্তিত্ব নেই

এখানে প্রসঙ্গতঃ বলে রাখা প্রয়োজন যে , আমরা বাস্তব জগতে যা কিছু সৃষ্টি করি সে ক্ষেত্রে আসলে আমরা সৃষ্টি করি না , সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিতে রূপান্তর ঘটাই মাত্র। আমাদের বাস্তব সৃজনক্ষমতার প্রয়োগের বা সৃষ্টিকর্ম সম্পাদনের স্বরূপ হচ্ছে এই যে , আমরা যা কল্পনা করি তার ভিত্তিতে বাস্তব জগতে বিরাজমান সৃষ্টিতে রূপান্তর ঘটিয়ে তার (কল্পনার) অনুরূপ করি মাত্র। কিন্তু প্রকৃত সৃষ্টি তা-ই যা বিদ্যমান উপাদান ছাড়াই সৃষ্টি করা হয় অর্থাৎ শূন্য থেকে সৃষ্টি করা হয়। অতএব , আমরা যা কল্পনা করি তা-ই আমাদের প্রকৃত সৃষ্টি। এরূপ সৃষ্টি তার অস্তিত্বলাভ , স্থিতি , ধারাবাহিকতা রক্ষা , বিনাশ ও পুনঃপ্রত্যাবর্তনের জন্য তার স্রষ্টার (কল্পনাকারীর) ওপর নির্ভরশীল। স্রষ্টার অস্তিত্বের বাইরে তার স্বাধীন অস্তিত্ব অকল্পনীয়।

এ থেকে আমরা এ উপসংহারে উপনীত হতে পারি যে , সৃষ্টিমাত্রই তার অস্তিত্বলাভ , স্থিতি , ধারাবাহিকতা রক্ষা , বিনাশ ও পুনঃপ্রত্যাবর্তনের জন্য স্বীয় স্রষ্টার ওপর নির্ভরশীল। স্রষ্টার অস্তিত্বের বাইরে তার কোনো অস্তিত্ব নেই , যদিও সে স্রষ্টার অংশ নয়। পরম স্রষ্টা অপরিহার্য সত্তার সাথে তাঁর সৃষ্ট সৃষ্টিলোকের সম্পর্কও এ ধরনেরই।

পরম স্রষ্টার সৃষ্টিবৈচিত্র্য

যে স্রষ্টা সীমাহীন জ্ঞান , ইচ্ছাশক্তি ও সৃজনক্ষমতার অধিকারী সে পরম স্রষ্টার সৃষ্টি শুধু সংখ্যাগত দিক থেকে নয় , বরং গুণগত ও মাত্রাগত দিক থেকেও এতো বেশী ও এতো বৈচিত্র্যপূর্ণ হওয়াই স্বাভাবিক যা আমাদের সীমিত কল্পনাশক্তি দ্বারা কল্পনা করাও সম্ভব নয়।

ইতিপূর্বে আমরা অস্তিত্বের দার্শনিক বিভাজনের কথা উল্লেখ করেছি এবং সে ক্ষেত্রে প্রচলিত দার্শনিক বিভাজন থেকে কিছুটা (কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ) ভিন্নমত পোষণ করে এভাবে বিভাজন করেছি: অস্তিত্ব দু রকম: অপরিহার্য ও সম্ভব ; সম্ভব অস্তিত্ব হয় অবস্তুগত , নয়তো প্রায় বস্তুগত , নয়তো বস্তুগত। এখানে আরো অনেক বিভাগ চিন্তা করা যায়। যেমন: বস্তুগত সৃষ্টি দু রকমের: জড় ও প্রাণশীল। প্রাণশীল সৃষ্টি দু রকম: বদ্ধ ও মুক্ত। উদ্ভিদ হচ্ছে বদ্ধ এবং অন্যান্য প্রাণশীল সৃষ্টি মুক্ত। মুক্ত প্রাণশীল সৃষ্টি হয় স্বাধীন বিচরণক্ষমতাহীন (যেমন: লোহিত কণিকা , শ্বেত কণিকা ও রোগজীবাণু) , নয়তো স্বাধীন বিচরণক্ষমতা সম্পন্ন। শেষোক্ত গোষ্ঠী হয় পুরোপুরি সহজাত প্রবৃত্তি চালিত (যেমন: মশা-মাছি) , নয়তো বুদ্ধিমান। বুদ্ধিমান প্রাণী হয় বিচারবুদ্ধি ও কল্পনাশক্তির অধিকারী (মানুষ) , নয়তো এ ক্ষমতার অধিকারী নয়।

অবস্তুগত ও প্রায় বস্তুগত সৃষ্টির মধ্যেও নিঃসন্দেহে বহুবিধ বিভাজন সম্ভব - যে সম্পর্কে আমাদের ধারণা খুবই সীমিত। এরূপ সৃষ্টি ব্যক্তিসত্তাসম্পন্ন ও ব্যক্তিসত্তাবিহীন হতে পারে। আবার জ্যামিতিক সত্যগুলো অর্থাৎ দ্বিমাত্রিক , একমাত্রিক ও শূন্যমাত্রিক অস্তিত্ব , গাণিতিক সংখ্যা , তরঙ্গ , চৌম্বক ক্ষেত্র , মানবমস্তিষ্কের কল্পিত সৃষ্টি , সুর , সৌন্দর্য ইত্যাদি অবস্তুগত সত্যকে কোন্ পর্যায়ে ফেলা যায় সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার।

এ তো গেলো এমন সৃষ্টির কথা যা কম - বেশী আমাদের বিচারবুদ্ধির ধারণক্ষমতার আওতাভুক্ত। এর বাইরে আরো বিভিন্ন মাত্রার ( Dimension)কতো রকম সৃষ্টি রয়েছে তা আমাদের পক্ষে চিন্তা করাও সম্ভব নয়।

বন্দিত্ব নাকি স্বাধীনতা ?

পরম স্রষ্টা যেমন বস্তুগত , অবস্তুগত , প্রায় বস্তুগত ও প্রাণশীল সৃষ্টিনিচয় সৃষ্টি করেছেন , তেমনি সৃষ্টি করেছেন প্রাকৃতিক বিধিবিধান। তিনি মাধ্যাকর্ষণ ও মহাকর্ষণ শক্তি এবং মৌলিক ও যৌগিক সৃষ্টিসমূহের জন্য সুনির্দিষ্ট গঠন-ফর্মুলা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এভাবে তিনি তাঁর সৃষ্টিজগৎকে সুনিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খল করেছেন। এছাড়া তিনি প্রাণশীল সৃষ্টির জন্য সহজাত প্রবণতা সৃষ্টি করেছেন এবং কতক সৃষ্টিকে বুদ্ধিমত্তা দিয়েছেন ও জ্ঞানার্জনের যোগ্যতা দিয়েছেন। তিনি কতক প্রাণশীল সৃষ্টিকে বিচরণের স্বাধীনতা ও ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন এবং মানুষকে দিয়েছেন সর্বোচ্চ স্বাধীনতা , এমনকি প্রাকৃতিক বিধান ও সহজাত প্রবণতার বিরোধিতা বা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার স্বাধীনতা। ফলে প্রাকৃতিক বিধিবিধান ও সহজাত প্রবণতা দ্বারা অন্যান্য প্রাণীর স্বাধীনতা যতোখানি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে , মানুষের স্বাধীনতা ততোখানি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না।

কিন্তু মানুষের স্বাধীনতার স্বরূপ নিয়ে অনেকে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছেন। কেউ কেউ মানুষকে নিরঙ্কুশ স্বাধীন বলে দাবী করেছেন , কেউ কেউ তাকে স্রষ্টার ইচ্ছার ক্রীড়নক গণ্য করেছেন এবং তার স্বাধীনতাকে পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। একদল বলছেন , আমরা যখন প্রাকৃতিক বিধিবিধানের সীমাবদ্ধতা ব্যতিরেকে মানবিক ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা অনুভব করি না , বরং স্বাধীনতা অনুভব করি , তখন আমরা পুরোপুরি স্বাধীন। অপর দল বলছেন , সৃষ্টিপ্রকৃতির নিখুঁত শৃঙ্খলার মধ্যে স্বাধীনতার অবকাশ থাকতে পারে না। বরং আমরা রেকর্ডকৃত কার্টুন-চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ন্যায় পূর্বসম্পাদিত ভূমিকার পর্দায় নিক্ষিপ্ত দৃশ্যসম বৈ নই ; আগামীতে আমি কোন্ ভূমিকায় আবির্ভূত হবো তা না জানলেও এতে সন্দেহ নেই যে , পূর্বে নির্ধারিত করে রাখা দৃশ্যে ও ভূমিকায়ই আবির্ভূত হবো। তাঁরা আরো বলেন যে , ভবিষ্যৎদ্রষ্টা সৃষ্টিকর্তা তো জানেনই ভবিষ্যতে আমার ভূমিকা কী হবে , অতএব , আমার পক্ষে তার অন্যথা করা সম্ভব নয়।

এ দুই মতের ধারকরা দুই প্রান্তিকতায় পৌঁছে গেছেন ; একদেশদর্শিতার কারণে তাঁরা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন।

বাস্তবে আমরা কী অনুভব করি ? আমরা একদিকে যেমন স্বাধীনতা অনুভব করি , অন্যদিকে সীমাবদ্ধতাও অনুভব করি ; স্বাধীনতা ও সীমাবদ্ধতা কোনোটিই নিরঙ্কুশভাবে অনুভব করি না।

বিশেষ করে যারা স্বাধীনতার ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছেন তাঁরা এমন দাবীও করে থাকেন যে , আমরা যে স্বাধীনতা অনুভব করছি , আসলে আমাদেরকে এরূপ অনুভব করতে বাধ্য করা হচ্ছে। তাঁদের এ ধারণা এ কারণে গ্রহণযোগ্য নয় যে , মানুষের যদি স্বাধীনতা না-ই থাকবে অথচ তাকে স্বাধীনতা অনুভব করতে বাধ্য করা হবে , তাহলে তা হবে এক ধরনের অন্যায় ও প্রতারণা। কিন্তু পরম পূর্ণতার অধিকারী স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির সাথে অন্যায় ও প্রতারণার আশ্রয় নেবেন এরূপ দুর্বলতা থেকে তিনি প্রমুক্ত।

অন্যদিকে স্বাধীনতার অনুভূতি যেমন অকাট্য ও সর্বজনীন , স্বাধীন অনুভব করতে বাধ্য করার অনুভূতি তদ্রূপ সর্বজনীন নয়। অর্থাৎ যারা মনে করছেন যে , আসলে আমরা স্বাধীন নই , তাঁরাও নিজেদেরকে স্বাধীন অনুভব করছেন , তবে কোনো কোনো যুক্তির ভিত্তিতে স্বীয় অনুভূতির বিপরীতে ধারণা করছেন যে , আমরা যা অনুভব করছি তা ঠিক নয় , বরং আমাদেরকে এরূপ অনুভব করতে বাধ্য করা হয়েছে। এ দাবী হচ্ছে বাস্তব অনুভূতির বিপরীত জ্ঞানগত বিতর্কের দাবী মাত্র এবং তার উৎস হচ্ছে ধারণা । অতএব , এ ধারণা যেমন সর্বজনীন নয় , তেমনি তা অকাট্যও নয়। আর ধারণাজাত বিতর্কিত দাবীর ভিত্তিতে সর্বজনীন অকাট্য অনুভূতির সত্যতায় সন্দেহ পোষণ করা চলে না।

যারা স্বাধীনতার অনুভূতিকে অস্বীকার করেন তাঁদের একটি যুক্তি হচ্ছে এই যে , এটা সৃষ্টিজগতের শৃঙ্খলার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু ঝুকিপূর্ণ হলেও স্বাধীন এক্তিয়ার সম্পন্ন সৃষ্টির অস্তিত্ব তার সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিক্ষমতার ব্যাপকতাই প্রমাণ করে , যার অনুপস্থিতিতে তাঁর সৃষ্টিক্ষমতা অপেক্ষাকৃত সীমিত প্রতিভাত হতো।

মানুষের স্বাধীনতার অনুভূতি অস্বীকারকারীদের আরেকটি যুক্তি হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার ভবিষ্যৎ জ্ঞানের যুক্তি। [এ প্রসঙ্গে ইতিপূর্বে বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে সৃষ্টি ও ব্যবস্থাপনার প্রক্রিয়া শিরোনামে কিছুটা সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে।] এর জবাবে বলতে হয় যে , আমরা সৃষ্টিকর্তার ভবিষ্যৎ জ্ঞানের স্বরূপ অবগত নই। অতএব , সে যুক্তিতে আমরা আমাদের অনুভূত স্বাধীনতাকে অস্বীকার করতে পারি না।

আমরা সৃষ্টিকর্তার জ্ঞানের স্বরূপ অনুধাবনে অক্ষম , তবে এর কয়েকটি দিক আমাদের বিচারবুদ্ধির নিকট অকাট্যভাবে প্রতিভাত। যেহেতু সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকার্যক্রম মানে হচ্ছে তাঁর ইচ্ছার বাস্তবায়ন এবং তিনি যা ইচ্ছা করেন তা সংশ্লিষ্ট স্থান , কাল , পাত্রপাত্রী , অবস্থা , কারণ ও প্রক্রিয়া সহ অনিবার্য হয়ে যায় , সেহেতু তিনি যদি সমগ্র ভবিষ্যত কে একবারে ইচ্ছা করেন তাহলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটা অনিবার্য হয়ে যায়। তাহলে অতঃপর আর তাঁর কিছুই করার থাকে না এবং তাঁর অন্য সমস্ত গুণ প্রয়োগ হারিয়ে ফেলে। কারণ , তিনি যা ইচ্ছা করে রেখেছেন তার বাইরে নতুন কিছুই তিনি করবেন না। কিন্তু বিচারবুদ্ধি সৃষ্টিকর্তার সীমাহীন সৃষ্টিক্ষমতার ও সীমাহীন মাত্রার অন্যান্য গুণের প্রয়োগ হারিয়ে ফেলার ধারণা গ্রহণ করে না। কারণ , তা তাঁর এ সব গুণ ও ক্ষমতার ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করে। অতএব , সৃষ্টিক্ষমতা সহ তাঁর সকল গুণের অনবরত কার্যকরিতা অনস্বীকার্য বিষয়। এমতাবস্থায় এমন অসংখ্য ক্ষেত্র থাকতে হবে যে বিষয়ে তিনি ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোনো ধরনেরই ইচ্ছা করেন নি , যে সব ক্ষেত্র ভবিষ্যতে তাঁর ইচ্ছা করা বা না-করার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। এই ক্ষেত্রসমূহেরই একটি হতে পারে সৃষ্টির স্বাধীনতার আওতাভুক্ত ভবিষ্যৎ ক্ষেত্র। অর্থাৎ কতক ক্ষেত্রে সৃষ্টি ভবিষ্যতে কী করবে সে ব্যাপারে স্রষ্টা কোনো কিছু ইচ্ছা করা থেকে বা সেদিকে মনোযোগ (توجه ) প্রদান করা থেকে বিরত থাকতে পারেন। কারণ , তিনি সেদিকে মনোযোগ প্রদান করলে তিনি যেভাবে মনোযোগ প্রদান করবেন সেভাবে তা ঘটা অনিবার্য হয়ে যাবে। বলা বাহুল্য যে , সমগ্র ভবিষ্যতের প্রতি মনোযোগ প্রদান করতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও তিনি এভাবে কতক ক্ষেত্রকে মনোযোগের বাইরে রাখতে এবং সৃষ্টির জন্য স্বাধীনতার একটি ক্ষেত্র নিশ্চিত করতে পুরোপুরি সক্ষম।

দ্বিতীয়তঃ সৃষ্টিকর্তা যেমন কতক বিষয় সরাসরি বা কারণ ও ফলশ্রুতি বিধির দ্বারা স্থির করে দিয়েছেন তেমনি কতক বিষয় স্থির করে না দিয়ে শর্তাধীন করে দিতে পারেন , যেমন: অমুক ব্যক্তি এ কাজ করলে ফল এই হবে এবং তা না করলে বা তার পরিবর্তে অমুক কাজ করলে ফল ঐ রকম হবে। অতঃপর ব্যক্তি স্বাধীন ইচ্ছা দ্বারা যা করবে তার ফলটি অকাট্য হয়ে যাবে এবং তার বিকল্প সম্ভাবনাটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কারণ , সম্ভব অস্তিত্ব (সৃষ্টি ও কাজ উভয়ই) অস্তিত্বলাভ করার ক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে এই যে , তা অস্তিত্বলাভের পূর্ণ কারণ ঘটলে তার অস্তিত্বলাভ অনিবার্য হয়ে যায় এবং পূর্ণ কারণ না ঘটা পর্যন্ত তার অস্তিত্বলাভ অসম্ভব থাকে। এরূপ শর্তাধীন স্থিরকরণ সৃষ্টিকর্তার সৃজনক্ষমতার বৈচিত্র্যেরই পরিচায়ক।

তৃতীয়তঃ ক্ষেত্রবিশেষে স্বাধীন সৃষ্টির অতীত কার্যকলাপ ও প্রাকৃতিক বিধিবিধানের দ্বারা তার ভবিষ্যৎ এমনভাবেও নির্ধারিত হয়ে যেতে পারে যে , সে ক্ষেত্রে দ্বৈত সম্ভাবনার সুযোগ না-ও থাকতে পারে। অর্থাৎ সৃষ্টি আগে যে স্বাধীনতার অধিকারী ছিলো তা বিলুপ্ত বা সঙ্কুচিত হয়ে যেতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে স্রষ্টা নিশ্চিত জানেন যে , ঐ ব্যক্তি এ কাজ করবে ও তার ফল এরূপ হবে ; এর অন্যথা হবে না। কিন্তু স্রষ্টার এ ভবিষ্যৎজ্ঞানের কারণে এ কথা বলা চলে না যে , স্রষ্টা তাকে এ কাজে বাধ্য করেছেন। একজন শিক্ষক যদি একজন ছাত্র সম্পর্কে নিশ্চিত জানেন যে , সে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হবে , তো এ কারণে বলা চলে না যে , শিক্ষকের ঐ ছাত্র সংক্রান্ত ভবিষ্যৎজ্ঞানের কারণেই এ ছাত্রটি অকৃতকার্য হয়েছে।

অবশ্য আগেও যেমন বলা হয়েছে , মানুষের এ স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ নয়। প্রাকৃতিক বিধিবিধানের কথা বাদ দিলেও পারিবারিক , সামাজিক , সাংস্কৃতিক ও মানব-জাত অন্যান্য কার্যকারণ তার এ স্বাধীনতাকে সীমিত করে ফেলে , কিন্তু তার স্বাধীনতাকে পুরোপুরি হরণ করতে পারে না। শেষ পর্যন্ত তার জন্য স্বাধীনতার ক্ষেত্র কমবেশী থেকেই যায়। এমনকি মানুষ যখন অনন্যোপায় হয়ে আত্মহত্যা করে তখনো কার্যতঃ সে তার স্বাধীন এ্খতিয়ারকেই কাজে লাগায়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে , মানুষের স্বাধীনতার নিয়ন্ত্রণ কি কেবল প্রাকৃতিক ও মানব-জাত কার্যকারণের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে ? এখানে পরম জ্ঞানী স্রষ্টার কি করণীয় কিছু নেই ? অন্য কথায় , তিনি কি সৃষ্টির কার্যক্রমে আদৌ হস্তক্ষেপ করবেন না ? বিচারবুদ্ধি এ ব্যাপারে কী বলে ?

বস্তুতঃ স্বাধীনতা হচ্ছে পরম পূর্ণতার অধিকারী অপরিহার্য সত্তার বৈশিষ্ট্য। সেই স্বাধীনতা তিনি তাঁর সসীম অপূর্ণ সৃষ্টি মানুষকে প্রদান করেছেন। যদিও এ স্বাধীনতা ব্যবহারের জন্য মানুষকে বিচারবুদ্ধি দেয়া হয়েছে , তথাপি দুর্বল ও অপূর্ণ হবার কারণেই এ স্বাধীনতা ব্যবহার করতে গিয়ে তার ভুল হবার আশঙ্কা থেকেই যায়। তাই বিচারবুদ্ধির দাবী হচ্ছে , ক্ষেত্রবিশেষে , বিশেষ করে সমগ্র সৃষ্টিলোক বা মানবপ্রজাতির স্বার্থে অপরিহার্য হলে , তেমনি মানুষ তাঁর কাছে সাহায্য চাইলে ও তাঁর বিবেচনায় সে সাহায্য পাওয়ার উপযুক্ত হলে তিনি সৃষ্টির স্বাধীন কর্মক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করবেন। (তবে এটা করা তাঁর জন্য অপরিহার্য গণ্য করা যায় না এবং সর্বাবস্থায়ই তিনি হস্তক্ষেপ বা সাহায্য করবেন এটাও ভাবা যায় না। কারণ , তাহলে সৃষ্টির স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে।)

বিষয়টি কয়েকটি উপমার সাহায্যে সহজে বুঝা যেতে পারে।

প্রথম উপমা: একজন পিতা তাঁর শিশু সন্তানকে খেলার জন্য একটি বল দিলেন , সাথে সাথে তিনি তাকে নদীর কিনারে গিয়ে খেলতে নিষেধ করলেন। কিন্তু শিশুটি নদীর কিনারে গিয়ে খেলতে লাগলো। কারণ , তার পিতা তাকে নদীর কিনারে গিয়ে খেলতে নিষেধ করলেও তার সেখানে যাওয়া ও খেলার পথ রুদ্ধ করেন নি ; ধরুন , পিতা তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে পারতেন , কিন্তু তিনি তা করেন নি। এমতাবস্থায় খেলার সময় শিশুটির বলটি ছিটকে নদীতে পড়ে গেলো। এখন পিতা কী করবেন ? এ অবস্থায় শিশুটি পিতাকে বলটি তুলে দিতে বলতে পারে , বা না-ও বলতে পারে। উভয় অবস্থায়ই পিতা চাইলে বলটি তুলে দিতে পারেন , বা তা তুলে আনার আগেই অনেক দূরে চলে যাওয়ায় তিনি তাকে আরেকটি নতুন বল কিনে দিতে পারেন ও আগেকার ঘটনার পুনরাবৃত্তির ব্যাপারে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিতে পারেন। অবশ্য তিনি চাইলে কোনো কারণে বলটি তুলে দেয়ার চেষ্টা না-ও করতে পারেন বা নতুন বল কিনে দেয়া থেকেও বিরত থাকতে পারেন। তবে সাধারণতঃ তিনি প্রথম বারের ক্ষেত্রে বা শিশুর বয়স ও আরো কিছু বিষয় বিবেচনা করে বলটি তুলে দেন বা নতুন একটি বল কিনে দেন।

অথবা ধরুন , একটি বাড়ীর চতুর্দিকে পানিভর্তি গভীর খাদ ; পিতা শিশুকে খাদে নামতে , এমনকি তার কাছে যেতেও নিষেধ করলেন , বললেন: খাদে নামলে বা তাতে পড়ে গেলে ডুবে মরবে। কিন্তু শিশু শিশু হওয়ার কারণেই পিতার কথার গুরুত্ব বুঝলো না এবং খেলতে খেলতে খাদের কিনারে গিয়ে অসাবধানতাবশতঃ বা পা পিছলে তাতে পড়ে গেলো অথবা কৌতুহলবশে তাতে নেমে গেলো এবং ফলে সে পানিতে ডুবে গেলো। এ অবস্থায় পিতা খাদে নেমে তাকে তুলে আনলেন , ফলে সে বেঁচে গেলো , কিন্তু নাকে , কানে ও পেটে দুর্গন্ধযুক্ত পচা পানি ঢুকে যাওয়ায় সে শুধু তাৎক্ষণিক কষ্ট আর ভোগান্তির শিকারই হলো না , বরং অসুস্থ হয়ে পড়লো।

আবার এমনও হতে পারে যে , খাদটি এতোই গভীর ছিলো যে , তার তলদেশ থেকে তুলে আনতে আনতে সে মারা গেলো। হতে পারে যে , খাদটি খুব বেশী গভীর না হলেও খাদের পানি খুব বেশী দূষিত থাকায় ঐ বিষাক্ত পানি পেটে যাবার কারণেই সে মারা গেলো অথবা মারা না গেলেও সে কঠিন রোগে আক্রান্ত হলো এবং তার জীবনীশক্তি হ্রাস পেলো।

ক্ষেত্রবিশেষে খাদের মধ্যে কাঁটা বা ভাঙ্গা কাঁচ থাকতে পারে যার ফলে সে মারাত্মকভাবে আহত হতে পারে এবং বেঁচে গেলেও বিকলাঙ্গ হয়ে যেতে পারে। অবশ্য সে কষ্ট ও ভোগান্তির শিকার বা অসুস্থ বা বিকলাঙ্গ হওয়ায় অথবা মারা যাওয়ায় এ ঘটনাটা অন্য শিশুদের জন্য শিক্ষণীয় হলো।

আবার এমনও হতে পারে যে , শিশুটি এক পা খাদে ফেলতে উদ্যত হওয়ার সাথে সাথেই , অথবা এমনকি খাদের কিনারে যেতেই বাবা তাকে ধরে ফেললো ও সেখান থেকে দূরে সরিয়ে আনলো এবং এভাবে ধরে নিয়ে আসার কাজটা প্রহারসমেতও হতে পারে যাতে সে ভবিষ্যতে এ কাজের পুনরাবৃত্তি করা থেকে বিরত থাকে।

অথবা মনে করুন , কোনো জাহাযের সারেং যাত্রীদেরকে ডেকের কিনারে যেতে নিষেধ করলেন এবং বলে দিলেন যে , পানিতে হাঙ্গর ও কুমীর আছে। কিন্তু কতক যাত্রী তাঁর কথা শুনলো না। তারা ডেকের কিনারে গিয়ে দাঁড়ালো এবং তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ পানিতে পড়ে গেলো , আর ডুবুরী নেমে উদ্ধার করার আগেই তাদেরকে কুমীর এসে টেনে নিয়ে গেলো বা হাঙ্গর এসে ছিন্নভিন্ন করে ফেললো।

অথবা সাঁতার জানা এক ব্যক্তি প্রয়োজনের তাগিদে সাঁতরে নদী পাড়ি দিলো , কিন্তু কিনার থেকে পাঁচ , সাত বা দশ হাত দূরে পৌঁছতেই সাঁতরাবার শক্তি হারিয়ে ফেললো। তখন সে সাহায্য চাইতে বা না চাইতেই কিনারে থাকা লোকদের মধ্য থেকে কেউ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে তীরে তুলে আনলো। কিন্তু অপর এক ব্যক্তি ভালো সাঁতার না জানা সত্ত্বেও অন্যদের নিষেধ উপেক্ষা করে অহঙ্কার অথবা বোকামি বশতঃ এক মাইল প্রশস্ত নদী পাড়ি দিতে গিয়ে সিকি বা অর্ধ বা পৌনে এক মাইল পৌঁছার পর সাঁতরাবার শক্তি হারিয়ে ফেললো এবং লোকদের কাছে সাহায্য চাইলো , কিন্তু কেউ তাকে সাহায্য করতে গেলো না , কারণ , সে অন্যদের সদুপদেশ না শুনে নিজের জন্য বিপদ ডেকে এনেছে। তাই কেউ তাকে সাহায্যের হক্বদার মনে করে নি , অথবা সাহায্য পৌঁছার আগেই তার মারা যাওয়া নিশ্চিত জেনে তাকে উদ্ধারের চেষ্টা অর্থহীন মনে করে তারা তাকে উদ্ধারের চেষ্টা থেকে বিরত থাকলো। অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষে তার কাছাকাছি কোনো নৌকা বা স্পীড-বোট থাকলে তিরস্কার করেও তাকে দয়া দেখাতে পারে। তেমনি সে যদি নদীর তীরের খুবই কাছাকাছি এসে যায় , ধরুন বিশ গজের মধ্যে এসে যায় , সে ক্ষেত্রে তার হঠকারিতা বা বোকামির জন্য তিরস্কার করলেও কেউ দয়া করে তাকে তীরে তুলে আনতে পারে।

অবশ্য মানুষের আচরণে আমরা দেখতে পাই যে , অন্যদের পক্ষ থেকে উচ্চারিত সতর্কবাণী ও কৃত কল্যাণকামনা উপেক্ষা করে অথবা নির্বুদ্ধিতাবশতঃ যারা নিজেদেরকে বিপদে নিক্ষেপ করে তাদের সকলের ক্ষেত্রে বা একই ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রতি বারই কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে না। কারণ , সে ক্ষেত্রে সতর্কবাণী ও কল্যাণকামনা উপেক্ষা করে নিজেকে বিপদে নিক্ষেপ করতে কেউই দ্বিধা করতো না এবং এর ফলে সতর্কবাণী ও কল্যাণকামনা অর্থহীন হয়ে যেতো। অবশ্য সাহায্য চেয়ে ফরিয়াদ করলে সাহায্য লাভের সম্ভাবনা বেশী থাকে , তবে তা-ও নিশ্চিত নয়।

মোদ্দা কথা , সৃষ্টিকর্তা তাঁর এ দুর্বল সৃষ্টিকে স্বাধীনতা দেয়ার পর নিরঙ্কুশভাবে তার নিজের ওপর ছেড়ে দেবেন এবং তার প্রতি দৃষ্টি রাখবেন না ও তার কাজে ইতিবাচক হস্তক্ষেপ করবেন না - বিচারবুদ্ধি এটা মানতে পারে না। বিশেষ করে মানবপ্রকৃতি তার নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কঠিন সঙ্কটময় মুহূর্তে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে সৃষ্টিকর্তার নিকট আশ্রয় ও সাহায্য কামনা করে। এমতাবস্থায় তার প্রত্যাশা ও প্রার্থনা যদি অন্যায় , অযৌক্তিক বা অবাস্তব না হয় তাহলে সৃষ্টিকর্তা তাকে সাহায্য করবেন এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে সর্বাবস্থায়ই তিনি তাকে সাহায্য করবেন বা তার এক্তিয়ারাধীন কাজে হস্তক্ষেপ করবেনই এমনটি মনে করাও ঠিক হবে না। কারণ , তিনি সাহায্য বা হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য নন। তিনি যদি সাহায্য বা হস্তক্ষেপ করেন , তো সেটা সৃষ্টির অধিকার নয় , বরং তাঁর অনুগ্রহ।

অন্যদিকে কোনো মানুষের বা কোনো মানবগোষ্ঠীর স্বাধীনতার অপব্যবহারমূলক নেতিবাচক পদক্ষেপের উদ্যোগ যদি সমগ্র সৃষ্টিলোক বা পৃথিবী বা মানবপ্রজাতির জন্য এমনই ধ্বংসাত্মক হয় যার ফলে সৃষ্টির লক্ষ্য ব্যর্থ হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে , সে ক্ষেত্রে বিচারবুদ্ধির দাবী এটাই যে , সৃষ্টিকর্তা সেখানে হস্তক্ষেপ করবেন এবং ধ্বংসকামী ঐ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নেতিবাচক উদ্যোগকে বানচাল করে দেবেন।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে , যেহেতু সৃষ্টিকর্তা ইতিবাচক , সেহেতু সৃষ্টির কাজে তাঁর হস্তক্ষেপও সর্বাবস্থায়ই ইতিবাচক হবে , কখনোই নেতিবাচক হবে না - এটাই বিচারবুদ্ধির দাবী। অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষে সৃষ্টিকর্তার কোনো কোনো হস্তক্ষেপ আপতঃদৃষ্টিতে নেতিবাচক বলে মনে হতে পারে , কিন্তু পিতা কর্তৃক তার দুষ্ট শিশুকে প্রহার করার ন্যায় অথবা চিকিৎসক কর্তৃক কারো শরীরের পচনধরা অঙ্গ কেটে ফেলার ন্যায় উদ্দেশ্য ও পরিণামফলের বিচারে তাঁর সে দৃশ্যতঃ নেতিবাচক হস্তক্ষেপ অবশ্যই ইতিবাচক।


16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35