জীবন জিজ্ঞাসা

জীবন জিজ্ঞাসা5%

জীবন জিজ্ঞাসা লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

জীবন জিজ্ঞাসা
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 58 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 42132 / ডাউনলোড: 4647
সাইজ সাইজ সাইজ
জীবন জিজ্ঞাসা

জীবন জিজ্ঞাসা

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

অবিকৃত কোরআন

কোরআন মজীদ যে মানবিক রচনাক্ষমতার উর্ধস্থিত এক মহান গ্রন্থ তা এর যে কোনো পাঠকের নিকটই সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়তে বাধ্য। ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , অন্যান্য ধর্মগ্রন্থকে কোরআনের পাশাপাশি রেখে তুলনা করলে স্পষ্ট প্রতিভাত হবে যে , ঐ সব গ্রন্থ যে ঐশী গ্রন্থের বিকৃত রূপ শুধু তা-ই নয় , বরং ঐ সব গ্রন্থের প্রায় সবগুলোই মানুষের রচিত গ্রন্থ যাতে ঐশী গ্রন্থের কিছু উদ্ধৃতি বা বক্তব্য বা বিষয়বস্তু বিক্ষিপ্তভাবে বা মানবিক রচনাবিন্যাসে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আরো লক্ষণীয় বিষয় হলো এই যে , ঐ সব গ্রন্থ যে সব ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের ওপর অবতীর্ণ গ্রন্থ বলে দাবী করা হয় তা তাঁদের নিজেদেরও রচিত নয় , বরং পরবর্তী কালে অন্য লোকেরা রচনা করে তাঁদের নামে প্রচলন করে দিয়েছেন। এমতাবস্থায় , যুক্তির খাতিরে যদি কোরআন মজীদে সামান্য কিছুটা বিকৃতির সম্ভাবনাকে স্বীকার করেও নেয়া হয় , তথাপি বলতে হবে যে , মানুষের রচিত ঐ সব তথাকথিত ঐশী গ্রন্থের মোকাবিলায় কোরআন মজীদের অনুসরণ ছাড়া গত্যন্তর নেই।

কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে এই যে , কোরআন মজীদ যে বিকৃতি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ঐতিহাসিক ও বিচারবুদ্ধির দলীল থেকে তা অকাট্যভাবে প্রমাণিত।

এ এক বিতর্কাতীত সত্য যে , কোরআন মজীদ দীর্ঘ তেইশ বছর যাবত অল্প অল্প করে নাযিল হয়েছে এবং সাথে সাথেই , হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) কর্তৃক পূর্ব থেকে নিয়োজিত বেশ কয়েক জন লিপিকার (কাতেবে ওয়াহী) তা লিখে নিতেন। তাঁর কতক ছ্বাহাবী (সঙ্গী/ সহচর) ব্যক্তিগতভাবেও তা লিখে নিতেন এবং বিপুল সংখ্যক ছ্বাহাবী তা মুখস্ত করতেন। কোনো আয়াত বা আয়াত-সমষ্টি নাযিলের পর তা হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) কর্তৃক নির্দেশিত পরম্পরা বিন্যাসে লিপিবদ্ধ ও মুখস্ত করা হতো। আর হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) প্রতি বছর রামাযান মাসে ঐ সময় পর্যন্ত নাযিলকৃত আয়াত ও সূরা সমূহ বিন্যাস পরম্পরা অনুযায়ী ধারাবাহিকভাবে পাঠ (তেলাওয়াত) করতেন এবং ছ্বাহাবীগণ তাঁর পাঠের সাথে স্বীয় লিখিত কপি বা স্মৃতিকে মিলিয়ে নিতেন।

এভাবে দীর্ঘ তেইশ বছরে কোরআন নাযিল সমাপ্ত হয় এবং তার লিপিবদ্ধকরণ ও মুখস্তকরণও সমাপ্ত হয়। কোরআন মজীদের সর্বশেষ আয়াত নাযিল হয় হযরত মুহাম্মাদ ( ছ্বাঃ )- এর ইন্তেকালের প্রায় তি ন মাস আগে হজ্বের সময়। ফলে কোরআন মজীদের একটি আয়াতও লিপিবদ্ধতা , মুখস্তকরণ ও বিন্যাসের বাইরে থাকে নি। অতঃপর কোরআন মজীদ নিয়ে কখনোই বিতর্ক সৃষ্টি হয় নি এবং বিগত চৌদ্দশ বছর যাবত সারা বিশ্বের মুসলমানদের কাছে কোরআনের একটিই পাঠ ( text)রয়েছে। কোনোরূপ বিকৃতি বা সংযোজন - বিযোজন ঘটলে এটা সম্ভব হতো না। বস্তুতঃ কোরআন মজীদ হচ্ছে মানব জাতির ইতিহাসে সর্বোচ্চ মুতাওয়াতির্ সূত্রে বর্ণিত একমাত্র গ্রন্থ এবং এ কারণে তাতে বিকৃতির বিন্দুমাত্র সুযোগ বা সম্ভাবনা ছিলো না বা নেই।

হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর ইন্তেকালের সময় তাঁর ছ্বাহাবীর সংখ্যা ছিলো লক্ষাধিক যাদের মধ্যে বহু সংখ্যক হাফেযে কোরআন ছিলেন (কোরআন যাদের মুখস্ত ছিলো)। বেশ কয়েক জন ছ্বাহাবীর নিকট কোরআনের নিজস্ব কপি ছিলো , সেই সাথে ছিলো হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) কর্তৃক রেখে যাওয়া সরকারীভাবে লিপিবদ্ধকৃত কপি। অতঃপর প্রতিদিনই কোরআনের কপি ও হাফেযের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর ইন্তেকালের পরবর্তী এক প্রজন্মের ব্যবধানে হাফেযের সংখ্যা লাখের কোঠা ছাড়িয়ে যায়। এহেন অভিন্ন পাঠ বিশিষ্ট গ্রন্থে বিকৃতির সম্ভাবনা মেনে নিতে হলে মানুষের পক্ষে কোনো তথ্যের সত্যতাই স্বীকার করা সম্ভব নয় ।

কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও অজ্ঞতা ও অসতর্কতা বশতঃ অথবা অসদুদ্দেশ্যে কতক লোক কোরআনে বিকৃতির সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দিতে নারাজ (যদিও এ সম্ভাবনা খুবই কম বলে স্বীকার করে)। তাই এ সম্পর্কিত দু টি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা যরূরী মনে করছি।

প্রথমতঃ কতক হাদীছ থেকে এরূপ ধারণা হয় যে , প্রথম খলীফাহর খেলাফত-কালে কোরআন লিপিবদ্ধ করা হয় এবং কেউ কেউ কোরআনের আয়াত বলে দাবী করে কোনো উক্তি নিয়ে এলে তা লিপিবদ্ধ করার জন্যে দু জন সাক্ষী হাযির করার শর্তারোপ করা হয় , আর কেউ কেউ দু জন সাক্ষী হাযির করতে ব্যর্থ হওয়ায় তাঁদের আনীত উক্তি কোরআনের আয়াত হিসেবে লিপিবদ্ধ করাতে ব্যর্থ হন। পরবর্তীকালে কেউ কেউ নাকি এমন দাবী করেন যে , কোরআনের কোনো বড় সূরার কিছু অংশ লিখিত কোরআন থেকে বাদ পড়েছে। আবার একজন বরেণ্য ছ্বাহাবীর নামে এমন দাবীও করা হয়েছে যে , তাঁর মতে নাকি কোরআন মজীদের শেষ দু টি সূরা (আল্-ফালাক্ব ও আন্-নাস্) কোরআন মজীদের অংশ হিসেবে নাযিল হয় নি , বরং হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর নিকট ব্যক্তিগত দো আ হিসেবে নাযিল হয়েছিলো।

আসলে পুরো কাহিনীটিই মিথ্যা। কারণ , সংশ্লিষ্ট হাদীছ ও রেওয়াইয়াত (বর্ণনা)গুলো অন্ততঃ প্রথম স্তরে স্বল্পসংখ্যক সূত্রে বর্ণিত - হাদীছ বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে খবরে ওয়াহেদ বলা হয়। অন্যদিকে বিদ্যমান কোরআন মজীদ হচ্ছে মানবজাতির ইতিহাসে সর্বোচ্চ স্তরের মুতাওয়াতির্ বর্ণনা। বলা বাহুল্য যে , কোনো খবরে ওয়াহেদ বর্ণনার ভিত্তিতে মুতাওয়াতির্ বর্ণনায় সন্দেহ পোষণ করা বিচারবুদ্ধিবিরুদ্ধ কাজ।

তাছাড়া সংশ্লিষ্ট বর্ণনাগুলোতে বিষয়বস্তুগত অনেক দুর্বলতা নিহিত রয়েছে। যেমন:

(১) রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) যে সরকারীভাবে লিপিকারদের দ্বারা কোরআন লিপিবদ্ধ করিয়ে রেখে যান , সে ব্যাপারে বিতর্ক নেই। এমতাবস্থায় কোরআনের সে কপিকে উপেক্ষা করে প্রথম খলীফাহ্ কোরআনকে নতুন করে সংকলন করাবেন - এরূপ ধৃষ্টতা দেখানো তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তাছাড়া ছ্বাহাবীগণ রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) ও কোরআন মজীদকে যেরূপ প্রাণের চেয়ে বেশী ভালোবাসতেন তাতে এরূপ উদ্যোগকে তাঁরা মেনে নিতেন না শুধু তা-ই নয় , বরং এ অপরাধে খলীফাহকে হত্যা করতেও তাঁরা দ্বিধাবোধ করতেন না। এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হলে তা হতো একটি রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের উপযুক্ত কারণ। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বর্ণনাগুলোতে এ ব্যাপারে সামান্যতম প্রতিবাদের কথাও উল্লেখ নেই। বাস্তবে এরূপ নতুন সংকলনের কোনো ঘটনাই ঘটে নি বিধায় কোনো প্রতিবাদও ঘটে নি এবং তার উল্লেখও হয় নি।

(২) হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর ইন্তেকালের তিন মাস আগে কোরআন নাযিল সমাপ্ত হওয়া ও এ সময়ে ছ্বাহাবীদের সংখ্যা লক্ষাধিক হওয়ার ব্যাপারে বিতর্ক নেই। এমতাবস্থায় দুই জন সাক্ষী সহ মাত্র তিনজন লোকের বর্ণনা দ্বারা কোরআনের আয়াত সাব্যস্তকরণের মানদণ্ড নির্ধারণের মতো উদ্ভট কাজ কোনো ছ্বাহাবীর পক্ষে সম্ভব হতে পারে না এবং এরূপ মানদণ্ড নির্ধারণ করা হলে তা অন্য ছ্বাহাবীদের প্রতিবাদ ছাড়া পার পেয়ে যেতো না।

যেহেতু হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) প্রতি বছর রামাযান মাসে ঐ সময় পর্যন্ত নাযিলকৃত পুরো কোরআন মজীদ নামাযে তেলাওয়াত করতেন এবং মসজিদে নববীতে বিপুল সংখ্যক ছ্বাহাবী তাঁর পিছনে নামায আদায় করতেন সেহেতু তাঁর জীবনের সর্বশেষ রামাযান পর্যন্ত নাযিলকৃত আয়াত সমূহ হাজার হাজার ছ্বাহাবীর জানা ছিলো। অতঃপর মাত্র পৌনে তিন মাসের মধ্যে আয়াত নাযিল সমাপ্ত হয়ে যায় এবং তাঁর জীবনের এই শেষ দিককার সময়টিতে সব সময়ই লিপিকারগণ ছাড়াও বিরাট সংখ্যক ছ্বাহাবী তাঁর সাথে থাকতেন। আর সর্বশেষ আয়াত নাযিলের পরেও তিনি প্রায় তিন মাস বেঁচে ছিলেন। ফলে এ শেষের দিককার আয়াতগুলোও বিরাট সংখ্যক ছ্বাহাবীর জানা থাকার কথা। এমতাবস্থায় কেউ কোনো উক্তিকে কোরআন মজীদের আয়াত বলে দাবী করবে অথচ দু জন সাক্ষীও হাযির করতে পারবে না - এরূপ তথ্য অধিকতর উদ্ভট।

(৩) ছ্বাহাবীগণ কোরআন মজীদকে এতোখানি ভালবাসতেন যে , তাঁদের অনেকে কোরআনের জন্য জীবন দিয়েছেন এবং যারা বেঁচে ছিলেন তাঁদেরও অনেকেই কোরআনের প্রতি ভালোবাসার কারণে বিভিন্ন সময় নির্যাতন সহ্য করেছেন ও বিভিন্ন যুদ্ধে আহত হয়েছেন। তাই কোরআন মজীদের কোনো সূরায় সামান্যতম হ্রাসবৃদ্ধি হলেও তাঁরা তা মেনে নিতেন না , বরং এ ব্যাপারে ব্যাপক রক্তপাত সংঘটিত হতো। কোরআনে হ্রাসবৃদ্ধি তো দূরের কথা , স্বয়ং রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) কর্তৃক লিপিবদ্ধ করানো কপি বর্তমান থাকা অবস্থায় নতুন করে কোরআন লিপিবদ্ধ করার উদ্যোগকেও তাঁরা সহ্য করতেন না। বিশেষ করে ছ্বাহাবীদের মধ্যে খেলাফত নিয়ে দ্বন্দ্ব একটি ঐতিহাসিক তিক্ত সত্য ; এমতাবস্থায় প্রথম খলীফাহর বিরোধীরা এ ধরনের উদ্যোগকে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সৃষ্টির জন্য কাজে লাগাতে দ্বিধা করতেন না। কিন্তু ইতিহাসে এ ধরনের কোনো বিদ্রোহ তো দূরের কথা , এরূপ ঘটনার বিরুদ্ধে মৃদু প্রতিবাদের কথাও উল্লেখ নেই , যা থেকে প্রমাণিত হয় যে , প্রথম খলীফাহর সময় কোরআন লিপিবদ্ধ করার কোনো ঘটনাই ঘটে নি।

(৪) কেউ কেউ সংশ্লিষ্ট খবরে ওয়াহেদ হাদীছগুলোর দুর্বলতা চাপা দেয়ার লক্ষ্যে গোঁজামিলের আশ্রয় নিয়ে বলতে চান যে , হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর রেখে যাওয়া কোরআন মজীদের কপিটির পৃষ্ঠাগুলো বিভিন্ন বস্তুর ও বিভিন্ন আকৃতির ছিলো , তাই প্রথম খলীফাহ্ হয়তো একটি সুষম কপি তৈরী করতে চেয়েছিলেন [যদিও সংশ্লিষ্ট হাদীছ সমূহে তা নেই , বরং এ সব হাদীছে যুদ্ধে বিপুল সংখ্যক হাফেযে কোরআনের শহীদ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কোরআন হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে সংকলন করার কথা বলা হয়েছে]। কিন্তু এ ব্যখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ , সে ক্ষেত্রে হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর রেখে যাওয়া কপি থেকে কপি করানো হতো , লোকদের থেকে শুনে (তা-ও আবার একজন উপস্থাপক ও দু জন সাক্ষীতে সন্তুষ্ট থেকে) নয়।

বস্তুতঃ রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) যেখানে কোরআন মজীদের লিপিবদ্ধ কপি ও বহু সংখ্যক হাফেযে কোরআন ছ্বাহাবী রেখে যান এবং যার কপি ও হাফেযের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে সোয়া দু বছরে গণনাযোগ্যতার উর্ধে উঠে যায় , ঠিক সেই সময় অর্থাৎ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর ইন্তেকালের প্রায় সোয়া দু বছর পরে সংগৃহীত ও লিপিবদ্ধ খবরে ওয়াহেদ হাদীছের ভিত্তিতে কোরআন সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র সন্দেহ পোষণ করাও বিচারবুদ্ধির কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

হাদীছ সংকলনকারীগণ যতোই আন্তরিকতার সাথে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করুন না কেন , এ সংক্রান্ত হাদীছগুলো যে পূর্ববর্তী সোয়া দু বছরের মধ্যে কোনো এক সময় ইসলামের সুচতুর দুশমনদের দ্বারা অথবা হাদীছ বর্ণনার গৌরব লোভীদের দ্বারা ছ্বাহাবীদের নামে রচিত হয়েছিলো তাতে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই।

দ্বিতীয়তঃ তৃতীয় খলীফাহ্ কর্তৃক কোরআন মজীদের ত্রুটিপূর্ণ কপি নষ্ট করার ঘটনাকে হাতিয়ার বানিয়েও ইসলামের দুশমনরা কোরআনের অবিকৃত থাকা সম্বন্ধে সন্দেহ সৃষ্টি করতে চায়। কিন্তু তাদের এ সন্দেহ বিচারবুদ্ধির কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ , এটা সর্বসম্মত অভিমত যে , প্রথমে কোরআন মজীদকে আরবদের বিভিন্ন গোত্রের আঞ্চলিক উচ্চারণে তেলাওয়াতের অনুমতি দেয়া হয়। এতে কিছু শব্দের উচ্চারণে রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের উচ্চারণ থেকে পার্থক্য ঘটলেও তাতে অর্থে কোনোই পার্থক্য ঘটতো না। তবে অনেকে আঞ্চলিক উচ্চারণের ভিত্তিতে মুখস্ত করে তা অনুরূপভাবে লিপিবদ্ধও করে। কিন্তু লিখিত রূপে এ ধরনের গৌণ পার্থক্য (যাতে অর্থে পার্থক্য ঘটতো না) ভবিষ্যতে , বিশেষতঃ ইসলাম ও কোরআন অনারব এলাকায় বিস্তার লাভ করার পরে , বিভ্রান্তির কারণ হতে পারে এবং মুসলমানরা কোরআনের ব্যাপারে খুবই সংবেদনশীল ছিলেন বিধায় আঞ্চলিক উচ্চারণ ও লিপিকে স্বেচ্ছাকৃত বিকৃতি গণ্য করে পরস্পর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হতে পারেন আশঙ্কায় কোরআনের সকল কপিকে মূল কপির সাথে মিলিয়ে সংশোধন করার এবং সংশোধনযোগ্য না হলে তা নষ্ট করে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয় । এ কারণেই নির্বিশেষে ছ্বাহাবীগণ সহ সকলেই তা মেনে নেন।

বলা বাহুল্য যে , ঐ সময় হযরত আলী (আঃ) ও হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রাঃ) সহ শ্রেষ্ঠতম আলেম ও কোরআন-বিশেষজ্ঞ ছ্বাহাবীগণের প্রায় সকলেই বেঁচে ছিলেন। অতএব , তৃতীয় খলীফাহ্ কোরআন মজীদে কোনোরূপ বিকৃতি সাধন করলে কেউই , বিশেষ করে বীরত্ব ও সাহসিকতার জন্য খ্যাত এবং হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) কর্তৃক জ্ঞানের নগরী হিসেবে অভিহিত হযরত আলী (আঃ) তা মেনে নিতেন না , বরং তৃতীয় খলীফাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতেন। এমনকি পরবর্তীকালে যারা প্রশাসনিক কারণে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন ও তাঁকে হত্যা করেন তাঁরাও তাঁর বিরুদ্ধে কোরআন মজীদে বিকৃতি সাধনের কোনো অভিযোগ আনেন নি , অথচ সত্যি সত্যিই তিনি যদি কোরআন মজীদকে বিকৃত করতেন তাহলে সেটিকেই তাঁর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হিসেবে দাঁড় করানো যেতো।

এছাড়া তৃতীয় খলীফাহ্ কোরআন বিকৃত করলে যে সব ছ্বাহাবীর নিকট কোরআনের সঠিক কপি ছিলো তাঁদের অনেকেই বিদ্রোহে সাহসী না হলেও অন্ততঃ স্বীয় কপি গোপন করে রাখার চেষ্টা করতেন এবং পরবর্তীকালে উপযুক্ত সময়ে , বিশেষ করে হযরত আলী (আঃ)-এর খেলাফতকালে তা প্রকাশ করতেন। ফলে কোরআনের একাধিক সংস্করণ পাওয়া যেতো।

অতএব , তৃতীয় খলীফাহ্ কোরআন বিকৃত করেছিলেন এবং সকলে তা বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়েছিলেন এরূপ উদ্ভট চিন্তার আদৌ কোনো সারবত্তা নেই।

মানুষের জন্য সৃষ্টিকর্তার পথনির্দেশ

সৃষ্টিকর্তা বস্তুদেহধারী প্রাণী প্রজাতিসমূহের মধ্যে এক ধরনের সহজাত জ্ঞান প্রদান করেছেন যা তাদেরকে স্বীয় স্বাধীনতাকে সুনিয়ন্ত্রিত করার ও তা থেকে সর্বোচ্চ কল্যাণ হাসিলের কাজে সাহায্য করে। অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষে এক প্রাণীর কল্যাণ অন্য কোনো প্রাণীর জন্য ক্ষতির কারণ রূপে দেখা দিতে পারে। কারণ ও ফলশ্রুতি বিধির জগতে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা বিচারবুদ্ধির দ্বারা দেখতে পাই যে , প্রতিটি প্রাণীপ্রজাতির মধ্যে নিহিত সহজাত জ্ঞান ও প্রবণতা তার নিজের জন্য অবশ্যই কল্যাণকর।

এখানে একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে: একটি খরগোশের শরীর এমনভাবে তৈরী করা হয়েছে যে , তার জন্য খাদ্য হিসেবে ঘাস ও তরিতরকারী উপযোগী , মাছ-মাংস উপযোগী নয়। তাই খরগোশের মাঝে ঘাস ও তরিতরকারী খাওয়ার আগ্রহ সৃষ্টি হয় , মাছ-মাংস খাওয়ার আগ্রহ সৃষ্টি হয় না। তাই খাওয়ার জন্য ঘাস ও তরিতরকারী পাওয়া না গেলেও এবং ঐ অবস্থায় ছোট ছোট পাখী তার সামনে চরে বেড়ালেও সে পাখী খাওয়ার আগ্রহ অনুভব করে না। অন্যদিকে একটি নেকড়ের শরীর এমনভাবে তৈরী হয়েছে যে , তার জন্য খাদ্য হিসেবে মাংস উপযোগী। তাই সে খরগোশ বা খেক শিয়াল বা এরূপ অন্য কোনো দুর্বল প্রাণীকে হত্যা করে ভক্ষণ করে। এভাবে দেখা যায় যে , প্রাণীকুলের সহজাত প্রবণতা তার অস্তিত্বরক্ষা ও বিকাশের জন্য অপরিহার্য , যদিও কারো অস্তিত্বরক্ষার সহজাত প্রবণতা অন্য কারো জন্য বিনাশের কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে।

অস্তিত্বরক্ষা ও বিকাশ-বিস্তারের জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষুধা-তৃষ্ণা , যৌন কামনা ও এ ধরনের অন্যান্য সহজাত প্রবণতা মানুষের মধ্যেও রয়েছে। সৃষ্টিপ্রকৃতিতে নিহিত এ ধরনের সহজাত প্রবণতা যে সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকেই প্রদত্ত এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। আমরা দেখতে পাই , সৃষ্টির মধ্যে এসব প্রবণতা যেমন নিহিত রয়েছে তেমনি তা পূরণের ব্যবস্থাও সৃষ্টিজগতে রাখা হয়েছে। প্রাণীকুলের মধ্যে এমন কোনো সহজাত প্রয়োজন দেখা যায় না যা পূরণের ব্যবস্থা প্রকৃতিতে নিহিত রাখা হয় নি।

কিন্তু মানুষের মধ্যে আরো এক ধরনের সহজাত জ্ঞান রয়েছে। তা হচ্ছে ভালো-মন্দ , উচিত-অনুচিত ও কর্তব্য-অকর্তব্য সংক্রান্ত ধারণা। স্থান-কাল , জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র ও শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সুস্থ বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের নিকট কতগুলো কাজ ভালো ও কতগুলো কাজ মন্দ বলে পরিগণিত। যেমন: সত্য কথা বলা , পরোপকার করা , পিতামাতা ও বড়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন , ছোটদের প্রতি স্নেহ প্রদর্শন ইত্যাদি কতক কাজ অস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে সকলের নিকটই ভালো বলে পরিগণিত হয় এবং মিথ্যাচার , চুরি , ধোঁকা-প্রতারণা , নিরীহ মানুষকে হত্যা করা , দুর্বলদের ওপর যুলুম করা , বিশ্বাসঘাতকতা ইত্যাদি কতক কাজ সকলের নিকটই খারাপ , ঘৃণ্য ও পরিত্যাজ্য বলে পরিগণিত।

এমনকি যারা ভালো কাজগুলো সম্পাদন করে না তারাও সে সব কাজের ভালো হওয়ার কথা স্বীকার করে। তেমনি যে ব্যক্তি কোনো মন্দ কাজ সম্পাদন করে সে তার কাজের সপক্ষে কোনো না কোনো যুক্তি দাঁড় করালেও মূলতঃ কাজটি যে মন্দ তা সে স্বীকার করে। উদাহরণস্বরূপ , যে সেনাপতি স্বয়ং আনুগত্য-শপথ ভঙ্গ করে তথা বিশ্বাসঘাতকতা করে রাজা বা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ক্ষমতা দখল করেছে বা দখল করার চেষ্টা করছে সে-ও তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে শপথ গ্রহণকারী তার কোনো অনুগত সৈনিক শপথ ভঙ্গ করলে বা তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলে তাকে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করে। একইভাবে চোর বা ডাকাতের দলের কোনো সদস্য চুরি বা ডাকাতি করে আনা মাল থেকে চুপে চুপে কিছু সরিয়ে ফেললে তথা চুরি করলে বা সহযোগীর কাছ থেকে কোনো কিছু ছিনিয়ে নিলে সে কাজকে ঘৃণা করে ও অপরাধ বলে গণ্য করে।

যেহেতু ন্যায়-অন্যায় ও ভালো-মন্দের এ অনুভূতি কোনোরূপ শিক্ষার ওপর নির্ভরশীল নয় , সেহেতু তা যে সহজাত অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা মানুষের সৃষ্টিপ্রকৃতিতে এ পথনির্দেশ নিহিত রেখেছেন তাতে কোনোরূপ সন্দেহের অবকাশ নেই।

এ তো গেলো সর্বজনীন পথনির্দেশের কথা। এমনকি মানুষ ব্যক্তিগতভাবেও পথনির্দেশ লাভ করে থাকে। অনেক সময় মানুষ কোনো কাজ করা-নাকরার ফলাফল সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারে না। কারণ ও ফলশ্রুতি বিধির আওতাধীন এ জগতে অনেক সময় সে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে না যে , কাজটি তার জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে , নাকি অকল্যাণ। এরূপ অবস্থায় অনেক ক্ষেত্রে এমনও হতে দেখা যায় যে , সে যখন অনেক চিন্তা-ভাবনা ও বিচার-বিশ্লেষণ করেও কোনো উপসংহারে পৌঁছতে না পেরে ক্লান্ত-শ্রান্ত ও হতাশ হয়ে পড়েছে তখন সহসাই , দৃশ্যতঃ কোনোরূপ কারণ ছাড়াই , তার মন দৃঢ়তা সহকারে কোনো একদিকে ঝুঁকে পড়ে এবং কোনোরূপ দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই কাজটির শুভ বা অশুভ পরিণতি সম্বন্ধে তার অন্তরে প্রত্যয় সৃষ্টি হয়ে যায়। অতঃপর সে কাজটি সম্পাদন করে সত্যিই সুফল লাভ করে , অথবা সে তার অন্তরে জাগ্রত এ অবস্থার ভিত্তিতে যে কাজটি পরিত্যাগ করেছে সেই একই কাজ অন্য কেউ করে এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যা থেকে সুস্পষ্ট যে , সে এ কাজটি করলে সে-ও অনুরূপভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতো। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে , কাজটি করা না-করা সম্বন্ধে সৃষ্টিকর্তাই তাকে পথনির্দেশ দিয়েছিলেন। এভাবে মানুষ সামান্য চিন্তা করলেই বুঝতে পারে যে , সে শুধু তার সৃষ্টি ও অস্তিত্বরক্ষার জন্যই সৃষ্টিকর্তার মুখাপেক্ষী নয় , বরং মানুষ হিসেবে তার যে স্বাধীন চিন্তা ও কর্মের ক্ষেত্র রয়েছে সেখানেও সে সৃষ্টিকর্তার পথনির্দেশের আওতাধীন। অর্থাৎ সব সময় ও সর্বাবস্থায়ই তার ও সৃষ্টিকর্তার মধ্যে একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।


17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35