জীবন জিজ্ঞাসা

জীবন জিজ্ঞাসা0%

জীবন জিজ্ঞাসা লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

জীবন জিজ্ঞাসা

লেখক: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 40470
ডাউনলোড: 4219

পাঠকের মতামত:

জীবন জিজ্ঞাসা
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 58 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 40470 / ডাউনলোড: 4219
সাইজ সাইজ সাইজ
জীবন জিজ্ঞাসা

জীবন জিজ্ঞাসা

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণের দায়িত্ব কা র ?

এখানে মতপার্থক্যের বিষয়টি সম্পর্কে অত্যন্ত সংক্ষেপে বলা যেতে পারে যে , রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর ইন্তেকালের পরে তাঁর দ্বীনী ও রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বা স্থলাভিষিক্ততা তথা নেতৃত্ব ও শাসন-কর্তৃত্বের অধিকার প্রশ্নে ছ্বাহাবীগণ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যান এবং এ মতপার্থক্যের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে মুসলিম উম্মাহ্ দু টি প্রধান ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে , যদিও আরো পরে অন্য কতক বিষয়কে কেন্দ্র করে এ উভয় ধারার প্রতিটি থেকেই একাধিক উপধারার সৃষ্টি হয়।

মুসলমানদের দু টি প্রধান ধারার মধ্যকার একটি ধারার (শিয়া) বক্তব্য এই যে , নবীর অবর্তমানে তাঁর উম্মাহর পরিচালনা , নেতৃত্ব ও শাসন-কর্তৃত্বের জন্য হুবহু নবীর গুণাবলী সম্পন্ন তথা নিষ্পাপ ও নির্ভুল ঐশী নেতৃত্ব অপরিহার্য। যদিও শেষ নবীর আগমন এবং খোদায়ী ওয়াহীর পরিপূর্ণতা ও সংরক্ষণ নিশ্চিত হওয়ার পর আর নতুন কোনো ওয়াহী ও নবীর প্রয়োজন থাকছে না , কিন্তু ওয়াহী ও দ্বীনের বিধি-বিধানের সঠিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং তার ভিত্তিতে উম্মাহর পরিচালনা , নেতৃত্ব ও শাসন-কর্তৃত্বের জন্য নবীর অনুরূপ গুণাবলীর অধিকারী তথা পাপ ও ভুল থেকে সংরক্ষিত নেতৃত্ব না থাকলে এবং নেতৃত্ব নির্বাচনের দায়িত্ব মানুষের হাতে ছেড়ে দেয়া হলে ভুল ও নিম্ন মানের নেতৃত্ব নির্বাচনের আশঙ্কা থেকে যায় এবং এ ধরনের নেতৃত্ব ও শাসন-কর্তৃত্বের কারণে উম্মাহর পথভ্রষ্টতা , নিদেন পক্ষে তার মানের অধঃগমন অনিবার্য। তাই হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর স্থলাভিষিক্ততার জন্য আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে পাপ ও ভুল থেকে সংরক্ষিত নেতৃত্ব মনোনীত হওয়া অপরিহার্য।

এ মূলনীতির ভিত্তিতে এ ধারাটির দাবী হচ্ছে , আল্লাহ্ তা আলা রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর অবর্তমানে তাঁর পর্যায়ক্রমিক স্থলাভিষিক্ততা ও উম্মাহকে নেতৃত্বদানের জন্য তাঁর মাধ্যমে বারো জন ইমামকে মনোনীত ও তাঁদের নাম ঘোষণা করেছেন - যাদেরকে তিনি সকল প্রকার গুনাহ্ ও ভুলভ্রান্তি থেকে রক্ষা করেছেন। এই বারো জন ইমাম হলেন হযরত আলী (আঃ) , হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসেন (আঃ) এবং হযরত ইমাম হোসেন (আঃ)-এর নয়জন পর্যায়ক্রমিক বংশধর। এদের মধ্যে সর্বশেষ হলেন একাদশ ইমাম হাসান আসকারী (আঃ)-এর পুত্র প্রতিশ্রুত ইমাম মাহ্দী (আঃ)- যিনি হিজরী 255 সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং বর্তমানে আত্মগোপনরত আছেন । আল্লাহ্ তা আলা নিজ কুদরতে তাঁকে দীর্ঘজীবী করেছেন এবং পরে কোনো উপযুক্ত সময় তিনি আত্মপ্রকাশ ও মুসলিম উম্মাহর মধ্যে গণ-অভ্যুত্থান সৃষ্টি করে বিশ্ব ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা করবেন।

দ্বিতীয় ধারাটির (সুন্নী) মতে , যেহেতু কোরআন মজীদ ক্বিয়ামত পর্যন্তকার সকল মানুষের জন্য পরিপূর্ণ পথনির্দেশ সেহেতু হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর ইন্তেকালের পর কোরআন মজীদ ও রাসূলের (ছ্বাঃ) সুন্নাহর অনুসরণই যথেষ্ট ; আর যেহেতু কোরআন মজীদে নামোল্লেখ সহ কাউকে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে উম্মাহর ইমাম ও শাসক মনোনীত করার কথা উল্লেখ করা হয় নি , সুতরাং মুসলমানরা নিজেরাই নিজেদের নেতা ও শাসক নির্বাচিত করবে।

এর জবাবে শিয়া ধারার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে , যেহেতু মুসলমানদের প্রধান দুই ধারার বিভিন্ন হাদীছে বারো জন ইমামের কথা নাম সহ উল্লিখিত হয়েছে , বিশেষ করে মুতাওয়াতির্ হাদীছ অনুযায়ী , রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ) তাঁর ইন্তেকালের কয়েক মাস আগে হজ্ব সমাপনের পর মক্কাহর অদূরস্থ গ্বাদীরে খুম্ নামক স্থানে এক মহাসমাবেশে আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে তাঁর পরে মুসলমানদের মাওলা অর্থাৎ নেতা ও শাসক হিসেবে হযরত আলী (আঃ) কে মনোনীত করে গিয়েছেন সেহেতু তাঁদেরকে আল্লাহ্ কর্তৃক মনোনীত ইমাম হিসেবে মেনে নেয়া অপরিহার্য।

কিন্তু সুন্নী ধারা বারো জন ইমাম সংক্রান্ত হাদীছগুলোকে মুতাওয়াতির্ মনে না করায় এবং হযরত আলী (আঃ)-এর মাওলা হওয়া সংক্রান্ত হাদীছে এ শব্দটিকে বন্ধু অর্থে ব্যবহৃত বলে দাবী করে হযরত আলী (আঃ) কে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর অব্যবহিত পরবর্তী নেতা ও শাসক মনোনীতকরণ সংক্রান্ত ধারণা প্রত্যাখ্যান করে।

এর জবাবে শিয়া ধারার যুক্তি হচ্ছে এই যে , যেহেতু কোরআন মজীদে মুসলমানদেরকে পরস্পরের বন্ধু ও একটি ভ্রাতৃসম্প্রদায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে সেহেতু নতুন করে ও আলাদাভাবে হযরত আলী (আঃ) কে মুসলমানদের বন্ধু হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া - তা-ও এক বিরাট আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে - নিঃসন্দেহে একটি বাহুল্য কাজ , আর নবী-রাসূলগণ (আঃ) বাহুল্য কাজ করেন না। অতএব , রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ) উক্ত অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে হযরত আলী (আঃ) কে স্বীয় উত্তরাধিকারী এবং অব্যবহিত পরবর্তী ইমাম ও শাসক নিয়োগ করে গিয়েছেন।

রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) উত্তরাধিকারিত্ব: বিচারবুদ্ধির দাবী 11

আল্লাহ্ তা আলা যে সব মুখ্য উদ্দেশ্যে মানুষের কাছে স্বীয় বাণী সহ যুগে যুগে নবী-রাসূলগণকে (আঃ) পাঠিয়েছেন তা হচ্ছে লোকদেরকে আল্লাহ্ ও পরকাল সংক্রান্ত সঠিক ধারণার সাথে পরিচিত করা , তাদের কাছে আল্লাহর আদেশ ও নিষেধ সমূহ পৌঁছে দেয়া , আল্লাহর বাণী ও আদেশ-নিষেধের ব্যাখ্যা প্রদান , মূল বিধিবিধানের ছোটখাট শাখা-প্রশাখা প্রণয়ন , সর্বাবস্থায় স্বীয় অনুসারীদের নেতৃত্ব প্রদান এবং সম্ভবপর হলে তথা রাষ্ট্রক্ষমতা আয়ত্তাধীন হলে জনগণের ওপর শাসনক্ষমতা পরিচালনা।

পূর্ণাঙ্গ দ্বীন নাযিল হওয়ার পরে নতুন কোনো ওয়াহী নাযিলের প্রয়োজন নেই , অতএব , নতুন কোনো নবী আগমনেরও প্রয়োজন নেই। কিন্তু মওজূদ ওয়াহীর ব্যাখ্যাকরণ , মুসলমানদেরকে পথনির্দেশ প্রদান এবং তাদের ওপর শাসনকর্তৃত্ব পরিচালনার প্রয়োজনীয়তা অবশিষ্ট থেকে যায়। মূলতঃ এ সব কাজের জন্যই নবীর প্রয়োজন হতো , নইলে আল্লাহ্ তা আলা ফেরেশতার মাধ্যমে স্বীয় পরিচয় ও আদেশ-নিষেধ সম্বলিত কিতাব পাঠাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা পাঠান নি , বরং সব সময়ই তা নবী-রাসূলগণের (আঃ) মাধ্যমে পাঠিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে , নবুওয়াতের ধারাবাহিকতা সমাপ্ত হয়ে যাবার পর নবীর অবর্তমানে যিনি এ দায়িত্ব পালন করবেন তাঁর জন্য কী ধরনের গুণাবলীর অধিকারী হওয়া প্রয়োজন ?

বিচারবুদ্ধির রায় অনুযায়ী , এ কাজ সম্পাদনকারীর জন্য যে সব গুণাবলীর অধিকারী হওয়া প্রয়োজন সেগুলোকে সংক্ষেপে তিনটি গুণের মধ্যে সমন্বিত করা যায় , তা হচ্ছে: জ্ঞান , পাপমুক্ততা ও অন্তর্দৃষ্টি বা দূরদর্শিতা। অবশ্য একজন নেতার মধ্যে অন্তর্দৃষ্টি বা দূরদর্শিতা আছে কিনা তা কেবল কালের প্রবাহে উদ্ভূতব্য সঙ্কটের অবস্থাগুলোতে তাঁর দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে ধরা পড়ে ; আগেই তা জানা যায় না। কিন্তু অপর দু টি গুণ তাঁর মধ্যে আছে কিনা তা তাঁর দায়িত্বগ্রহণকালেই সুস্পষ্ট থাকা প্রয়োজন।

আমাদের এ কথার মানে হচ্ছে , নবীর স্থলাভিষিক্ত ব্যক্তির মধ্যে নবীর রেখে যাওয়া জ্ঞান পরিপূর্ণ ও উচ্চতম মাত্রায় থাকা অপরিহার্য এবং সেই সাথে তাঁর দ্বারা পাপ সংঘটিত না হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত থাকতে হবে।

ইমাম বা শাসক যদি নবীর রেখে যাওয়া পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী না হন তাহলে তিনি ভুল করবেন এবং তাঁর ভুলের দ্বারা উম্মাহকে ইহকালে ও পরকালে ক্ষতির মধ্যে নিক্ষেপ করবেন। অন্যথায় তাঁকে তাঁর চেয়ে বেশী জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিদের পরামর্শ ও পথনির্দেশের ওপর নির্ভর করতে হবে। সে ক্ষেত্রে তা হবে তাঁর দুর্বলতার পরিচায়ক। কিন্তু রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কেন্দ্র দুর্বল ও পরনির্ভরশীল হওয়া কাম্য নয়। তাছাড়া জ্ঞানের ক্ষেত্রে সর্বাগ্রগণ্য না হলে তিনি সঠিক ও ভুল পরামর্শের মধ্যে পার্থক্য করতে ও সঠিক পরামর্শ অনুসরণ করতে সক্ষম হবেন তারও নিশ্চয়তা নেই। শুধু তা-ই নয় , পদের মর্যাদা রক্ষার্থে তিনি তাঁর তুলনায় অধিকতর জ্ঞানী ব্যক্তিদের পরামর্শ গ্রহণ থেকে পুরোপুরিও বিরত থাকতে পারেন , বা সব সময় তা গ্রহণ না করে কখনো কখনো স্বীয় ভিত্তিহীন মতের অনুসরণ করতে পারেন।

অন্যদিকে ইমাম যদি পাপমুক্ত না হন তাহলে তিনি সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর আইনের সঠিক বাস্তবায়ন করবেন না , সর্বাবস্থায় ন্যায়বিচার করবেন না , পক্ষপাতিত্ব থেকে মুক্ত থাকবেন না , বায়তুল মালের (রাষ্ট্রীয় কোষাগারের) সম্পদের ন্যায়সঙ্গত বণ্টন করবেন না। মোট কথা , পাপমুক্ত না হলে তিনি ইসলামের পূর্ণাঙ্গ প্রতিচ্ছবি রূপে নিজেকে পেশ করবেন না এবং নবীর যথার্থ উত্তরাধিকারী ও স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নিজেকে অন্যদের সামনে দৃষ্টান্তে পরিণত করতে পারবেন না। ফলে তাঁর প্রশাসন যালেম , দুর্নীতিবায , চাটুকার ও স্বার্থান্বেষী আত্মসাৎকারীদের থেকে মুক্ত থাকার কোনোই নিশ্চয়তা থাকবে না ।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে , ইলমী যোগ্যতা ও পাপমুক্ততার বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কারণ , কোনো ব্যক্তি পরিপূর্ণ দ্বীনী ইলমের অধিকারী না হলে তার পক্ষে ছোট-বড় প্রতিটি ফরয ও হারাম সম্বন্ধে জানা না থাকার কারণে প্রতিটি ফরয আঞ্জাম দেয়া ও প্রতিটি হারাম থেকে বিরত থাকা সম্ভব নয়।

অবশ্য কেউ ইলমের অধিকারী হলেই গুনাহ্ থেকে মুক্ত থাকবে তার নিশ্চয়তা নেই , কিন্তু ইলমের অধিকারী না হলে গুরুদায়িত্ব কাঁধে বহনকারী ব্যক্তি কোনোভাবেই পাপমুক্ত থাকতে পারবে না।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে , আমরা যদি মেনে নেই যে , ইমামের অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর স্থলাভিষিক্তের জন্য পরিপূর্ণ দ্বীনী জ্ঞানের অধিকারী ও পাপমুক্ত হওয়া প্রয়োজন সে ক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যক্তিকে বেছে নেয়ার দায়িত্ব কার ? আল্লাহ্ই কি এ ধরনের ব্যক্তিকে মনোনীত করবেন , নাকি জনগণ তাকে বেছে নেবে ?

আমরা লোকদের জ্ঞানের অধিকারী হওয়া-নাহওয়ার বিষয়টি মোটামুটি নির্ণয় করতে পারি , কিন্তু পাপমুক্ততার ক্ষেত্রে কারো প্রকাশ্যে পাপ না করা সম্বন্ধে জানতে পারলেও তার গোপন পাপ থাকলে তা জানা কেবল আল্লাহ তা আলার পক্ষেই সম্ভব।

এমতাবস্থায় বিচারবুদ্ধির দাবী হচ্ছে এই যে , স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে এ ধরনের ব্যক্তিকে বেছে নেয়া হলে তা হবে বান্দাহদের প্রতি বিরাট অনুগ্রহ। কিন্তু আল্লাহ্ তা আলা এ ধরনের কোনো ব্যক্তিকে বেছে নিয়ে নামোল্লেখপূর্বক মনোনয়ন দিয়েছেন কিনা তা যদি আমাদের জানা না থাকে তাহলে আমাদেরকে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতে এতদসংক্রান্ত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ পথনির্দেশ কী আছে তা দেখতে হবে এবং এতদুভয়ে নিহিত ইঙ্গিত যার বেলায় প্রযোজ্য তাঁকে খুঁজে বের করে তাঁকেই আল্লাহর পসন্দনীয় ব্যক্তি মনে করে তাঁর হাতে এ দায়িত্ব সোপর্দ করতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতে পরিপূর্ণ ইলমের অধিকারী ব্যক্তির ও পাপমুক্ত ব্যক্তির কথা উল্লেখ থাকলে তা যার বেলায় প্রযোজ্য হয় তাঁকেই ইমাম ও শাসক হিসেবে বরণ করে নিতে হবে।12

যদিও বিচারবুদ্ধির উপরোক্ত রায়ের সাথে দ্বিমত করার এবং অপেক্ষাকৃত কম জ্ঞানের অধিকারী ও পাপমুক্ততার নিশ্চয়তা বিহীন ব্যক্তিকে ইমাম ও শাসকের পদে বসানোর কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকতে পারে না তথাপি এ প্রসঙ্গে উত্থাপিত একটি প্রশ্নের জবাব পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া ঠিক হবে না , যদিও বিষয়টির সম্পর্ক অংশতঃ বিচারবুদ্ধির সাথে ও অংশতঃ ঐতিহাসিক তথ্যের সাথে।

বলা হয় যে , মুসলমানরা যদি তাদের নিজেদের জন্য ইমাম ও শাসক বেছে নেয় এবং তিনি যদি ইলমী দিক থেকে সর্বাগ্রগণ্য না-ও হন এবং পাপমুক্ততার নিশ্চয়তা না থাকলেও দৃশ্যতঃ তিনি পাপাচারী না হন , আর তিনি যদি কোরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে তাদেরকে শাসন ও পরিচালনা করেন তাহলে তা-ই যথেষ্ট। অতএব , আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে কোনো ইমাম ও শাসক মনোনীত করা অপরিহার্য নয়।

এ যুক্তি এ কারণে গ্রহণযোগ্য নয় যে , উম্মাতের হেদায়াত ও পরিচালনার ক্ষেত্রে ইমাম বা শাসক কোনো প্রশ্নের বা সমস্যার সম্মুখীন হবার পর কোরআন ও সুন্নাহ্ থেকে তার জবাব বা সমাধান খুঁজে বের করবেন এবং এরপর সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের জবাব বা উদ্ভূত সমস্যার সমাধান দেবেন - এর পরিবর্তে তাঁর মস্তিষ্কে ইতিমধ্যেই মওজূদ কোরআন-সুন্নাহর জ্ঞানের দ্বারা জবাব দেবেন এটাই হওয়া উচিত। অর্থাৎ ইমাম বা শাসকের কাছে জবাব বা সমাধান পূর্ব থেকেই মওজূদ থাকতে হবে। কারণ , ক্ষেত্রবিশেষে তাঁর কাছে সমাধান খোঁজার মতো যথেষ্ট সময় না-ও থাকতে পারে।

দ্বিতীয়তঃ রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) ইন্তেকালের পর কোরআন মজীদ যেভাবে লিপিবদ্ধ আকারে হাতের কাছে ছিলো সুন্নাহ্ কখনোই সেভাবে লিপিবদ্ধ আকারে মওজূদ ছিলো না। সুন্নাহ্ অনেক বিলম্বে এমন সময়ে ও এমন অবস্থায় লিপিবদ্ধ হয়েছে যখন তাতে অনেক মিথ্যার সংমিশ্রণ ঘটেছিলো। এমনকি কোরআন মজীদ লিপিবদ্ধ আকারে মওজূদ থাকলেও কতক ক্ষেত্রে তার ব্যাখ্যা রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর কাছ থেকে জানা প্রয়োজন ছিলো। এমতাবস্থায় , ইমাম ও শাসক পদের জন্য রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর কাছ থেকে কোরআন ও সুন্নাহর পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্জনকারী ব্যক্তির কোনো বিকল্প ছিলো না।13

অবশ্য সতর্কতার নীতির দাবীও এটাই ছিলো। কারণ , আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে নেতা ও শাসক মনোনীত না হয়ে থাকলেও মুসলমানদের জন্য উচিত ছিলো সেই ব্যক্তিকে এ দায়িত্ব অর্পণ করা যার আল্লাহ্ কর্তৃক মনোনীত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত না হলেও এর সম্ভাবনা ছিলো। কারণ , হাদীছে গ্বাদীরে ব্যবহৃত মাওলা শব্দের উদ্দেশ্য যদি বন্ধু হয়ে থাকে তাহলেও অন্য কারো পরিবর্তে হযরত আলী (আঃ)কে এ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত করায় কোনো সমস্যা ছিলো না। কিন্তু এর উদ্দেশ্য যদি নেতা ও শাসক বুঝানো হয়ে থাকে তাহলে অন্যকে এ দায়িত্ব অর্পণ করা ঠিক হয় নি। আর সতর্কতার নীতির দাবী হচ্ছে দু টি পন্থার যেটিতে ঝুঁকি নেই সেটি অনুসরণ করতে হবে।

ইমাম মাহ্দী (আঃ) সম্পর্কে মতপার্থক্য

শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে সকল মুসলমানই শেষ যমানায় রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর বংশে হযরত ইমাম মাহ্দীর (আঃ) আবির্ভাব বা আত্মপ্রকাশ ও বিশ্ব ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার ধারণা পোষণ করে। কিন্তু এতদসংক্রান্ত কতক বিষয়ে উভয় ধারার মতের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।

আল্লাহ্ তা আলা কর্তৃক মনোনীত বারো জন ইমামের ধারণা পোষণকারী শিয়া ধারার মতে , হযরত ইমাম মাহ্দী (আঃ) হলেন এ বারো জন ইমামের মধ্যকার সর্বশেষ ইমাম ; তিনি এখন থেকে পৌনে বারশ বছর আগে (হিজরী 255 সালে) জন্মগ্রহণ করেছেন এবং পাঁচ বছর বয়স থেকে আত্মগোপন করে আছেন ; আল্লাহ্ তাঁকে দীর্ঘজীবী করেছেন এবং যথাযথ ক্ষেত্র প্রস্তুত হবার পর তিনি আত্মপ্রকাশ করবেন। কিন্তু সুন্নী ধারার মতে , হযরত ইমাম মাহ্দী (আঃ) এখনো জন্মগ্রহণ করেন নি।

অনেক সময় , কারো পক্ষে হাজার বছরেরও বেশীকাল আয়ুর অধিকারী হওয়া সম্ভব কিনা - এ প্রশ্ন তোলা হয়। কিন্তু বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে এ প্রশ্ন গুরুত্ব বহন করে না। কারণ , এটা সম্ভব হতেই পারে ; ইতিহাসে এর চেয়েও দীর্ঘজীবী ব্যক্তিদের কথা উল্লিখিত আছে। হযরত নূহ্ (আঃ) কমবেশী হাজার বছর বেঁচে ছিলেন। হযরত খিযির্ (আঃ) এখনো বেঁচে আছেন বলে ইসলামের সকল ধারার অনুসারীদের বিশ্বাস - যার মানে তিনি তিন হাজার বছরেরও বেশীকাল যাবত বেঁচে আছেন।

অতএব , হযরত ইমাম হাসান্ আসকারী (আঃ)-এর পুত্র ইমাম মাহ্দী কিনা - এটাই পর্যালোচনার বিষয় ; তিনি ইমাম মাহ্দী হলে আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর হাজার বছরের বেশীকাল বেঁচে থাকা ও প্রকৃত পরিচয় গোপন রেখে সমাজে অবস্থান করা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। তবে তিনিই ইমাম মাহ্দী কিনা - এটা সম্পূর্ণই সংশ্লিষ্ট হাদীছ সমূহের পর্যালোচনার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে। এ ব্যাপারে বিচারবুদ্ধি স্বাধীনভাবে কোনো রায় দিতে পারে না , সংশ্লিষ্ট হাদীছ সমূহ পর্যালোচনার কাজে সাহায্য করতে পারে মাত্র।

তবে এ ব্যাপারে বিশেষভাবে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এই যে , মুসলমানদের দু টি প্রধান ধারার মধ্যে শিয়া ধারার মতে , হযরত ইমাম মাহ্দী (আঃ) শৈশবে - পাঁচ বছর বয়সে তাঁর পিতার ইন্তেকালের সাথে সাথেই আত্মগোপন করেন এবং পরবর্তী ষাট বছর তাঁর পিতার চারজন ঘনিষ্ঠ শিষ্যের মাধ্যমে বাইরের লোকদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন এবং এদের মধ্যকার সর্বশেষ ব্যক্তির ইন্তেকালের পর তিনি স্বীয় পরিচিতি সহকারে বাইরের লোকদের সাথে আর যোগাযোগ রাখেন না যদিও তিনি সমাজে স্বীয় মতামত পেশ করে থাকেন। তাই পঁয়ষট্টি বছর বয়সের পর থেকে আত্মপ্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত তাঁর জীবনকালের ইতিহাস অজ্ঞাত রয়েছে এবং থাকবে।

আক্বীদাহ্ অনুযায়ী হযরত ইমাম মাহ্দী (আঃ) তাঁর প্রকৃত পরিচয় গোপন করে সমাজে বিচরণ করায় তাঁকে কেউ না চেনার কারণে তাঁর আনুষ্ঠানিক আবির্ভাবের পূর্বে তাঁকে গ্রহণ করা বা না করা নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দিচ্ছে না।

অন্যদিকে সুন্নী ধারার মতে , হযরত ইমাম মাহ্দী (আঃ) এখনো জন্মগ্রহণ করেন নি। কিন্তু তিনি যখন জন্মগ্রহণ করবেন তখন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নেতৃত্বের দাবীদার হবার তথা পারিভাষিক অর্থে আবির্ভাবের বা আত্মপ্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত তাঁর জীবন কেমন হবে সে সম্পর্কে এ ধারার হাদীছ সমূহে কোনো বক্তব্য নেই। এ থেকেও তাঁর আত্মগোপন -এর একটি পরোক্ষ ধারণা পাওয়া যায় , যদিও তা থেকে তাঁর জন্মকাল সম্বন্ধে কোনো ধারণা করা সম্ভব নয় ।

ইমাম মাহ্দী (আঃ) সম্পর্কে উভয় ধারার তথ্যসূত্রাদি থেকে একটি বিষয় সুস্পষ্ট যে , তাঁকে গ্রহণ করা বা না করার প্রশ্নটি তাঁর আনুষ্ঠানিক আবির্ভাবের পরেই দেখা দেবে , তার আগে নয়। আর তাঁর গুণাবলী ও আবির্ভাব-পরবর্তী কর্মতৎপরতা সম্বন্ধে উভয় ধারার বর্ণনায় উল্লেখ করার মতো বড় ধরনের কোনো পার্থক্য নেই। ফলে হযরত ইমাম মাহ্দী (আঃ) জন্মগ্রহণ করেছেন অথবা করবেন এ সম্পর্কিত মতপার্থক্যের বিষয়টি বর্তমানে কেবল তাত্ত্বিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ ; বর্তমানে বাস্তব জীবনে এ মতপার্থক্যের কোনো কার্যকরিতা নেই।