আহলে বাইতের (
আঃ )
ইমামগণ ও আহলে সুন্নাত
হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর পর্যায়ক্রমিক স্থলাভিষিক্ত হিসেবে আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে বারো জন মা‘
ছ্বূম্ (নিষ্পাপ ও ভুলের উর্ধে) ইমাম মনোনীত হয়েছেন - এ‘
আক্বীদাহ্ পোষণকারী শিয়া মায্হাবের অনুসারীরা চৌদ্দ জন মহান ব্যক্তিত্ব [বারো জন ইমাম , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) ও হযরত ফাতেমাহ্ (‘
আলাইহাস্ সালাম্)]কে নিষ্পাপ ও ভুলের উর্ধে বলে গণ্য করে থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে , সুন্নী মাযহাবের অনুসারীরা তাঁদেরকে কোন্ দৃষ্টিতে দেখে থাকে ?
শিয়া মায্হাবের দৃষ্টিতে যিনি ইমাম মাহ্দী (আঃ) তাঁর জন্মগ্রহণ ও বেঁচে থাকা সম্বন্ধে সুন্নী ধারার মধ্যে সংশয় রয়েছে। অন্য তেরো জন ব্যক্তিত্বকে সামগ্রিকভাবে সকল মুসলমানই ভক্তিশ্রদ্ধা করে ও ভালোবাসে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে , তাঁদের নিষ্পাপ ও ভুলের উর্ধে থাকা এবং মর্যাদা সম্বন্ধে আহলে সুন্নাতের ধারণা কী ?
হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) যে ছোট-বড় যে কোনো ধরনের গুনাহ্ ও ভুল থেকে মুক্ত ছিলেন এ ব্যাপারে শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে প্রায় সকল মুসলমানই একমত (যদিও অনেক পরবর্তীকালে সুন্নী ধারার মধ্য থেকে বিচ্ছিন্নভাবে কেউ কেউ এ ব্যাপারে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন - যার পিছনে কোনো গ্রহণযোগ্য ভিত্তি না থাকায় তা আদৌ গুরুত্ব পাবার অধিকারী নয়)।
বাকী বারো জন মহান ব্যক্তিত্ব অর্থাৎ হযরত ফাতেমাহ্ (আঃ) ও আহলে বাইতের ধারার প্রথম এগারো জন ইমাম (আঃ) সম্পর্কে শিয়া ও সুন্নী ধারণার মধ্যে যে মতপার্থক্য রয়েছে তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে তা একটি বড় ধরনের মতপার্থক্য হলেও সুন্নী সমাজের আচরণ সম্পর্কে গভীরভাবে তলিয়ে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে , এ ব্যাপারে দুই ধারার মধ্যে ব্যবধান খুবই অল্প। কারণ , শিয়া মায্হাবের অনুসারীরা যেখানে উক্ত তেরো জন ব্যক্তিত্বকে গুনাহ্ ও ভুল থেকে খোদায়ী সংরক্ষণের অধিকারী মনে করে , সেখানে সুন্নী মায্হাবের অনুসারীরা একটি মূলনীতি হিসেবে তাঁদের জন্য এ ধরনের সংরক্ষণের ধারণা পোষণ না করলেও তাঁদের কাউকেই গুনাহর কাজ বা ভুল কাজ সম্পাদনকারী বলে মনে করে না।
সুন্নী মাযহাবের অনুসারীরা তাঁদের ব্যাপারে খুবই সতর্ক ও সশ্রদ্ধ আচরণ করে থাকে এবং তাঁদেরকে নীতিগতভাবে সমালোচনার উর্ধে গণ্য করাকে অপরিহার্য মনে না করলেও কার্যতঃ তাঁদের কারো সমালোচনা করে না। অর্থাৎ সুন্নী জগৎ তাত্ত্বিকভাবে তাঁদের জন্য গুনাহ্ ও ভুল থেকে মুক্ত থাকাকে অপরিহার্য গণ্য না করলেও কার্যতঃ তাঁদেরকে গুনাহ্ ও ভুল থেকে মুক্ত গণ্য করছে এবং কেউই তাঁদের সমালোচনা করছে না।
তাদের এ সতর্ক আচরণের পিছনে নিহিত কারণ অনুসন্ধান করলে কয়েকটি প্রধান কারণ পাওয়া যায়:
প্রথমতঃ
তাঁরা হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর প্রিয়তম ব্যক্তিবর্গ ও তাঁদের বংশধর।
দ্বিতীয়তঃ
তাঁদের মধ্যকার অন্ততঃ প্রথম চার ব্যক্তি [হযরত ফাতেমাহ্‘
আলী , হাসান ও হোসেন (আঃ)] রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর আহলে বাইতের সদস্য - যে ব্যাপারে সমগ্র উম্মাহর মধ্যে ইজমা‘
রয়েছে এবং কোরআন মজীদে তাঁদের পবিত্রকরণের কথা বলা হয়েছে। আর নামাযের ভিতরে আালে মুহাম্মাদের ওপর ছ্বালাত্ প্রেরণ করা হয় - যাতে (বিশেষ করে হানাফী মায্হাবে) তাঁদেরকে আালে ইবরাহীমের সমমর্যাদা সম্পন্ন হিসেবে অর্থাৎ হযরত ইবরাহীম্ (আঃ)-এর বংশে আগত নবী-রাসূল ও ইমামগণের (আঃ) সমতুল্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
তৃতীয়তঃ
সুন্নী ধারার বিভিন্ন হাদীছে সমগ্র উম্মাহর মধ্যে ইহকালে ও পরকালে এ চার ব্যক্তির সর্বোচ্চ মর্যাদা ও তাঁদের প্রতি রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর অবারিত ভালোবাসার কথা উল্লিখিত হয়েছে এবং সেই সাথে তাঁদের প্রতি ভালোবাসা পোষণের জন্য উম্মাহর প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া হাদীছে বিশেষ করে হযরত ফাতেমাহ্ (আঃ)কে‘
বেহেশতী নারীদের নেত্রী’
এবং হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসেন (আঃ)কে‘
বেহেশতী যুবকদের নেতা’
বলে উল্লেখ করা হয়েছে - যা নিয়মিতভাবে জুমু‘
আহ্ ও ঈদের নামাযের খোত্ববায় অপরিহার্যভাবে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ) নিজেকে জ্ঞানের নগরী ও হযরত‘
আলী (আঃ)কে তার দরযা এবং‘
আলীর (আঃ) সাথে তাঁর সম্পর্ককে হযরত হারূন্ (আঃ)-এর সাথে হযরত মূসা (আঃ)-এর সম্পর্কের অনুরূপ বলে উল্লেখ করেছেন।
চতুর্থতঃ
হযরত‘
আলী (আঃ) থেকে শুরু করে হযরত ইমাম জা‘
ফার্ ছ্বাদেক্ব (আঃ) পর্যন্ত আহলে বাইতের ধারার প্রথম ছয়জন ইমাম যে দ্বীনী‘
ইলম্ ও তাক্ব্ওয়া-পরহেয্গারীর দিক থেকে নিজ নিজ যুগে উম্মাহর মধ্যে শ্রেষ্ঠতম ও যোগ্যতম ব্যক্তি ছিলেন - এটা আহলে সুন্নাতের মধ্যে একটি সর্বজনবিদিত বিষয়। অন্যদিকে পরবর্তী পাঁচজন ইমাম সম্পর্কে সুন্নী ধারার সাধারণ মানুষ তেমন কিছু না জানলেও এ ধারার ওলামায়ে কেরাম তাঁদের সম্পর্কেও যথেষ্ট ভক্তি-শ্রদ্ধা পোষণ করেন।
পঞ্চমতঃ
সুন্নী ধারার প্রধান চার মায্হাবের মধ্য থেকে প্রথম দুই মায্হাব্ যাদের নামে পরিচিত অর্থাৎ হযরত ইমাম আবূ হানীফাহ্ ও হযরত ইমাম মালেক ছিলেন হযরত ইমাম জা‘
ফার্ ছ্বাদেক্বের শিষ্য এবং হযরত ইমাম শাফে‘
ঈ ও হযরত ইমাম আহমাদ্ ইবনে হাম্বাল ছিলেন ইমাম মালেকের শিষ্য ও প্রশিষ্য। আর বিশেষভাবে ইমাম আবূ হানীফাহ্ ইমাম জা‘
ফার্ ছ্বাদেক্ব (আঃ)কে স্বীয় যুগের শ্রেষ্ঠতম আলেম হিসেবে প্রশংসা করেছেন এবং তাঁর কাছ থেকে অর্জিত‘
ইলম্-কে স্বীয় একমাত্র‘
ইলমী সম্বল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এছাড়া ইমাম শাফে‘
ঈ আহলে বাইতের প্রতি বিস্ময়করভাবে গভীর মহব্বত প্রকাশ করেছেন।
ষষ্ঠতঃ
মুতাওয়াতির্ হিসেবে পরিগণিত না হলেও সুন্নী ধারার কতক হাদীছে বারো জন ইমামের নামোল্লেখ থাকার কারণে তাঁদের আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত ইমাম হওয়ার বিষয়টিকে সুন্নী ওলামায়ে কেরাম‘
অসম্ভব’
মনে করেন না।
এক হিসেবে , আহলে বাইতের (আঃ) ধারার ইমামগণের গুনাহ্ ও ভুল হতে মুক্ত থাকা প্রশ্নে শিয়া মাযহাবের‘
আক্বীদাহর চেয়ে সুন্নী মায্হাবের ধারণা ও আচরণের বাস্তব গুরুত্ব অনেক বেশী। কারণ , সুন্নীদের আচরণ থেকে নিষ্পন্ন ধারণা অনুযায়ী তাঁরা গুনাহ্ ও ভুল থেকে খোদায়ী সংরক্ষণের অধিকারী না থাকা সত্ত্বেও নিজ নিজ গুণাবলীর কারণে গুনাহ্ ও ভুল থেকে মুক্ত ছিলেন। (কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে , তাঁদের প্রতি এতো ভক্তি-শ্রদ্ধা পোষণ সত্ত্বেও আহলে সুন্নাত্ তাঁদেরকে অনুসরণ করছে না।)
এ হচ্ছে আহলে বাইতের (আঃ) ধারার ইমামগণ সম্বন্ধে সুন্নী জগতের সাধারণ ধারণা ও আচরণ। এর পাশাপাশি সুন্নী জগতের‘
র্ইরফানী (আধ্যাত্মিক) ধারাগুলোর মধ্যে ব্যতিক্রম হিসেবে দু’
একটি বাদে প্রায় সবগুলোরই সিলসিলাহ্ (ধারাবাহিকতা) উক্ত ইমামগণের কারো না কারো মাধ্যমে ও তাঁর পূর্ববর্তীদের হয়ে হযরত‘
আলী ও হযরত ফাতেমাহ্ (আঃ)-এর মাধ্যমে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) পর্যন্ত পৌঁছেছে। অর্থাৎ সুন্নী জগতের আধ্যাত্মিক ধারাগুলো উক্ত ইমামগণের ইমামতকে রাজনৈতিক ও ফিক্ব্হী দিক থেকে বিবেচনা না করে‘
ইরফানী দিক থেকে বিবেচনা করেছে এবং তাঁদেরকে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী গণ্য করেছে।
অন্যদিকে বিরল ব্যতিক্রম বাদে সাধারণভাবে সুন্নী জগৎ প্রথম চারজন খলীফাহকে খলীফায়ে রাশেদ (সঠিক পথের অনুসারী খলীফাহ্) বলে গণ্য করে এবং তাঁদের অন্যতম হিসেবে হযরত আলী (আঃ)-কেও খলীফায়ে রাশেদ বলে গণ্য করে। এছাড়া বিরল ব্যতিক্রম বাদে তাদের প্রায় সকলেই হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসেন (আঃ)কে দ্বীনী যোগ্যতার মানদণ্ডে স্বীয় যুগে খেলাফতের একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি ও হক্বদার বলে মনে করে।
হযরত ইমাম আবূ হানীফাহ্ ও প্রথম দিকে হযরত ইমাম মালেকও উমাইয়াহ্ ও‘
আব্বাসী খলীফাদেরকে অবৈধ শাসক বলে গণ্য করতেন এবং আহলে বাইতের ধারাবাহিকতায় তাদের বিরুদ্ধে যে ক’
টি বিদ্রোহ সংঘটিত হয় সেগুলোকে বৈধ বলে ফত্ওয়া দেন এবং বিশেষ করে ইমাম আবূ হানীফাহ্ বিপ্লবীদেরকে আর্থিক সাহায্য দেন।‘
আব্বাসী খেলাফতের সাথে সহযোগিতা না করা ও তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে সমর্থন ও সহযোগিতার কারণে তাঁরা সরকারের আক্রোশের শিকার হন ; ইমাম মালেককে নির্যাতনের শিকার হতে হয় এবং ইমাম আবূ হানীফাহকে কারারূদ্ধ করে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়। অর্থাৎ হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর স্থলাভিষিক্ততার ক্ষেত্রে প্রথম তিন খলীফাহর বিষয়টির ব্যতিক্রম বাদে তাঁদের নীতিগত অবস্থান ছিলো আহলে বাইতের ইমামগণের নীতিগত অবস্থানের খুবই কাছাকাছি , বরং বলা যেতে পারে যে , অভিন্ন ।
আমাদের উপরোক্ত আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট যে , আহলে বাইতের ইমামগণের (আঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত ইমাম হওয়া প্রশ্নে সুন্নী জগতের ওলামায়ে কেরাম শতকরা একশ’
ভাগ নিশ্চিত না হলেও তাঁদের আচরণ ও এ আচরণের পিছনে নিহিত কারণগুলো থেকে প্রতীয়মান হয় যে , তাঁরা এ ব্যাপারে‘
শক্তিশালী সম্ভাবনা’
র ধারণা পোষণ করতেন ও করে থাকেন - যা ইয়াক্বীনের কাছাকাছি। অর্থাৎ আহলে বাইতের ধারাবাহিকতার ইমামগণ সম্পর্কে শিয়া ও সুন্নী‘
আক্বীদাহর মধ্যে কার্যতঃ বা আচরণগত দিক থেকে তেমন কোনো পার্থক্য নেই।
অবশ্য প্রথম তিন জন খলীফাহর মর্যাদা সম্বন্ধে দুই ধারার মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। তা হচ্ছে , সুন্নী ধারা যেখানে প্রথম চারজন খলীফাহ্কেই বৈধ ও সঠিক পথানুসারী খলীফাহ্ বলে গণ্য করে থাকে (যা নেহায়েতই ভক্তি ও ভালোবাসা থেকে উৎসারিত ধারণা - যার পিছনে কোনো অকাট্য তাত্ত্বিক ভিত্তি নেই) , সেখানে শিয়া ধারা প্রথম তিন খলীফাহকে বৈধ মনে করে না। তাদের মতে , যেহেতু হযরত আলী (আঃ) ছিলেন আল্লাহ্ তা‘
আলা কর্তৃক মনোনীত ও হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) কর্তৃক ঘোষিত প্রথম খলীফাহ্ , সেহেতু তাঁকে পাশ কাটিয়ে পর পর তিন জন যে খলীফাহ্ হয়েছিলেন তাঁদের সে খেলাফত বৈধ ছিলো না। এ ব্যাপারে শিয়াদের মধ্যকার কতক লোক অনেক সময় অত্যন্ত কঠোর মন্তব্য করে থাকে। কিন্তু এ ব্যাপারে শিয়া মাযহাবের অনুসারী সকলের আচরণ অভিন্ন নয়। যেমন: শিয়া মায্হাবের একটি শাখা যায়দী শিয়ারা প্রথম দুই খলীফাহর খেলাফতকে বৈধ গণ্য করে।
তবে প্রথম তিন খলীফাহর ব্যাপারে সাম্প্রতিককালে শিয়া মায্হাবের প্রধান উপধারা ইছ্না’
‘
আশারিয়াহ্ বা বারো ইমামী ধারার ওলামায়ে কেরামের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ একটি ভারসাম্যপূর্ণ তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন। তাঁদের মতে , আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত ইমামের কার্যতঃ খেলাফতের দায়িত্বে অধিষ্ঠানের বিষয়টি জনগণ কর্তৃক ইমামকে ইমাম হিসেবে চিনতে পারা ও বরণ করে নেয়ার ওপর নির্ভরশীল। কারণ , কারো জন্য ইমামকে ইমাম হিসেবে গ্রহণ করে নেয়া তখনই অপরিহার্য হয় যখন এ ব্যাপারে তার জন্য ইতমামে হুজ্জাত্
হয়। এ কারণেই হযরত আলী (আঃ) কেবল তখনই খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন যখন জনগণ তাঁকে এ দায়িত্বের জন্য উপযুক্ততম ব্যক্তি হিসেবে চিনতে পারে ও খলীফাহ্ হিসেবে বরণ করে নেয়। একই কারণে তিনি নিজেকে খেলাফতের হক্বদার জানা সত্ত্বেও প্রথম তিন খলীফাহর সাথে সহযোগিতা করেছেন। আর যেহেতু তিনি নিজে তাঁদেরকে মেনে নেন ও তাঁদের সাথে সহযোগিতা করেন সেহেতু শিয়াদের জন্য তাঁদের সম্পর্কে অসম্মানজনক কথা বলা ঠিক হবে না , বরং সসম্মানে‘
ইলমী আলোচনা করতে হবে। বর্তমানে শিয়াদের মধ্যে এ ধারণা পোষণকারীদের প্রভাব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অতএব , দেখা যাচ্ছে যে , ইমামত ও খেলাফত প্রশ্নে শিয়া ও সুন্নীদের মধ্যকার চৈন্তিক ও আচরণগত উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবধান যতো বেশী মনে করা হয় , আসলে ততো বেশী নয়। তবে আহলে বাইতের (আঃ) ইমামগণ সম্পর্কে সুন্নী জগতের‘
আক্বীদাহ্‘
আল্লাহ্ কর্তৃক মনোনীত নিষ্পাপ ও ভুলমুক্ত ইমাম’
-এর‘
আক্বীদাহর কাছাকাছি হওয়া সত্ত্বেও সুন্নী মায্হাব্গুলোর প্রতিষ্ঠাতাগণ সতর্কতার নীতির দাবী অনুযায়ী উক্ত ইমামগণের অনুসরণ না করে তাঁদের ধারার বাইরে কেন স্বতন্ত্র ফিক্ব্হী ধারা বা মায্হাব্ গড়ে তুললেন এটা একটা বিরাট প্রশ্ন বটে। এ প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত জবাব হচ্ছে এই যে , তাঁরা সম্ভবতঃ সমকালীন যালেম স্বৈরাচারী সরকারের যুলুম-নির্যাতন হতে নিরাপদ থাকার লক্ষ্যে এ পথ বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় যে , পরবর্তীকালে তাঁদের ধারার আলেমগণের অনেকে মায্হাবী তিক্ততা ও বিরোধ সৃষ্টির পথ বেছে নেন।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা প্রয়োজন বলে মনে হয়। তা হচ্ছে , শিয়া মায্হাবের উদ্ভব সম্পর্কে সুন্নী জগতে একটি ব্যাপক প্রচারণা হচ্ছে এই যে , শিয়া মায্হাবের উদ্ভবের সাথে আহলে বাইতের (আঃ) কোনো সম্পর্ক নেই ;‘
আবদুল্লাহ্ ইবনে সাবা’
নামে জনৈক ইয়াহূদী ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমানদের বিভক্ত করার লক্ষ্যে শিয়া মায্হাব্ গঠন করে ; তৃতীয় খলীফাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহও সে-ই সংগঠিত করেছিলো। অন্যদিকে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর আহলে বাইতের ধারার ইমামগণ (আঃ) সম্বন্ধে বলা হয় যে , তাঁরা আহলে সুন্নাতেরই বুযুর্গ ব্যক্তি ছিলেন।
এ সম্পর্কে অত্যন্ত সংক্ষেপে বলতে হয় যে ,‘
আব্দুল্লাহ্ ইবনে সাবা’
একটি কল্পিত চরিত্র। কারণ , সর্বপ্রথম মাত্র একজন বর্ণনাকারী - সাইফ্ বিন্‘
উমার্- তার কথা বলেছে। আর সাইফ্ বিন্‘
উমার্ ছিলো মিথ্যা রচনাকারী। কারণ , বহু ঐতিহাসিক ঘটনার ক্ষেত্রেই তার বর্ণনা অন্যান্য বর্ণনাকারীর বর্ণনার সাথে মিলে না। তাছাড়া‘
আব্দুল্লাহ্ ইবনে সাবা’
কে সে যে ধরনের বীর নায়ক হিসেবে চিত্রিত করেছে এবং তার নামে যে সব কাহিনী রচনা করেছে সে ধরনের বিখ্যাত‘
ঐতিহাসিক’
চরিত্র ও ঘটনার ক্ষেত্রে একজনমাত্র বর্ণনাকারীর বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়। তাছাড়া তাকে তৃতীয় খলীফাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সংগঠক বলা হয়েছে অথচ এ বিদ্রোহে অনেক শীর্ষস্থানীয় ছ্বাহাবী অংশগ্রহণ করেন এবং তার উস্কানিতে তাঁরা এতে অংশ নেন বলে দাবী করা মানে তাঁদের মর্যাদা , ব্যক্তিত্ব ও বিবেচনাকে অবমাননা করা । আরো দাবী করা হয়েছে যে , হযরত‘
আলী (আঃ) তাকে হত্যা করেন। তাহলে এরপর আর কথিত তার প্রচলিত মাযহাব টিকে থাকার কথা নয়।
দ্বিতীয়তঃ যদি মেনে নিতে হয় যে , শিয়া মায্হাবের সাথে আহলে বাইতের ইমামগণের সম্পর্ক নেই এবং তাঁরা আহলে সুন্নাতের বুযুর্গ ছিলেন তাহলে প্রশ্ন ওঠে যে , সুন্নী ধারার মধ্যে তাঁদের বিশেষ করে হযরত ইমাম জা‘
ফার্ ছ্বাদেক্ব (আঃ)-এর ফিক্বাহ্ কোথায়। অর্থাৎ আহলে বাইতের ইমামগণ আহলে সুন্নাতের বুযুর্গ ছিলেন - এ দাবী একটি গোঁজামিল ছাড়া আর কিছু নয়।