জীবন জিজ্ঞাসা

জীবন জিজ্ঞাসা8%

জীবন জিজ্ঞাসা লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

জীবন জিজ্ঞাসা
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 58 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 42139 / ডাউনলোড: 4648
সাইজ সাইজ সাইজ
জীবন জিজ্ঞাসা

জীবন জিজ্ঞাসা

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

ইজতিহাদে মতপার্থক্য ও তার ক্ষেত্র

হাদীছ সংকলনের ও হাদীছ-বর্ণনাকারীর গ্রহণযোগ্যতা ও অগ্রহণযোগ্যতা এবং হাদীছ পরীক্ষার মূলনীতি ও ইজতিহাদের মূলনীতি প্রশ্নে মতপার্থক্য সহ বিভিন্ন কারণে অনেক বিষয়ে বিভিন্ন মুজতাহিদের রায়ে বিভিন্নতা দেখা যায়।

এছাড়া যারা ইজতিহাদের বিরোধী ও শুধু কোরআন-হাদীছের অনুসরণের পক্ষপাতী এবং এ হিসেবে নিজেদেরকে হাদীছপন্থী (আহলে হাদীছ) বলে অভিহিত করে থাকে তাদের মধ্যেও একাধিক গোষ্ঠী রয়েছে , যেমন: সুন্নী ধারার হাদীছপন্থীরা আহলে হাদীছ নামে এবং শিয়া ধারার হাদীছপন্থীরা আখবারী নামে পরিচিত।

সুন্নী ধারার আহলে হাদীছ গোষ্ঠীর মধ্যে এমনও অনেকে আছে যারা আহ্কামের ক্ষেত্রে কোরআনকে বাদ দিয়ে শুধু হাদীছকেই যথেষ্ট গণ্য করে এবং কোরআনকে শুধু তেলাওয়াত করে থাকে। কারণ , তাদের কথা , হাদীছ হচ্ছে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ) কর্তৃক কোরআনের মৌখিক ও কার্যতঃ ব্যাখ্যা। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে সচেতন নয় যে , যা কিছুই রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর নামে বর্ণিত হয়েছে তার সব কিছুই সত্যি সতিই তাঁর থেকে এসেছে এমন কোনো নিশ্চয়তা দেয়ার উপায় নেই ।

এ সব গোষ্ঠীর মধ্যকার মতপার্থক্যের কারণ , ক্ষেত্র ও গুরুত্ব নির্ণয় এবং এ থেকে উদ্ভূত সমস্যা নিরসনের পন্থার ওপর সংক্ষেপে হলেও আলোকপাত করা অপরিহার্য বলে মনে হয়। আমরা ইতিপূর্বে হাদীছ গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পূর্বশর্তাবলী উল্লেখ করেছি। এখানে আরো কতোগুলো বিষয় উল্লেখ করছি।

এ প্রসঙ্গে প্রথমেই মানব জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ইসলাম প্রদত্ত বিধিবিধান সমূহের মধ্যকার প্রকৃতিগত পার্থক্যের ওপর আলোকপাত করতে হয়।

ইবাদত সংক্রান্ত বিধিবিধানের কোনো প্রাকৃতিক মানদণ্ড নেই ; এ ব্যাপারে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত এবং তাঁর অনুমোদন সাপেক্ষে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) কর্তৃক নির্ধারিত বিধিবিধানসমূহই চূড়ান্ত। কারণ , এ সব বিধিবিধানের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ্ তা আলার প্রতি বান্দাহর আনুগত্য পরীক্ষা করা। এ কারণে , যে সব আদেশ প্রদান করা হয়েছে তার পরিবর্তে যদি ভিন্ন ধরনের কোনো আদেশ দেয়া হতো তাহলে বান্দাহর জন্য তা-ই মেনে চলা অপরিহার্য হতো। তাই এ জাতীয় আদেশের পিছনে কোনো বাস্তব বা পার্থিব কারণ অনুসন্ধান করা অনুচিত। যদিও এ ধরনের কোনো কোনো বিধান পালনের পার্থিব সুফল অনুসন্ধান করলে অনেক সুফল আবিষ্কৃত হতে পারে , কিন্তু এ সব সুফলের লক্ষ্যেই এ আদেশ দেয়া হয়েছে বলে মনে করলে ভুল হবে এবং এ সব সুফল পাওয়ার উদ্দেশ্যে আদেশ পালন করলে তা ইবাদত বলে গণ্য হবে না অর্থাৎ প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ্ তা আলার আদেশ পালন করা হবে না।

কতগুলো বিধিবিধান প্রাকৃতিক মানদণ্ডের ওপর ভিত্তিশীল। যেমন: খাদ্যদ্রব্যের হালাল-হারামের বিষয়টি। মানুষের শরীর , মন , নৈতিকতা ও চরিত্রের মধ্য থেকে একটির ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়বে না এমন কোনো বস্তুকে হারাম করবেন অথবা বিরূপ প্রভাব পড়বে এমন কোনো বস্তুকে হালাল করবেন - এরূপ দুর্বলতা থেকে আল্লাহ্ তা আলা প্রমুক্ত। অতএব , সন্দেহ নেই যে , হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) পর্যন্ত এ তালিকা অভিন্ন। অবশ্য কখনো কোনো জনগোষ্ঠীর আনুগত্য পরীক্ষা করা বা কোনো অপরাধের শাস্তিস্বরূপ শুধু ঐ জনগোষ্ঠীর জন্য কোনো চিরন্তন হালাল বস্তুকে সাময়িকভাবে বা স্থায়ীভাবে হারাম করা হতে পারে , সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী ও মেয়াদের বাইরে যার কোনো কার্যকরিতা থাকে না এবং যে সম্পর্কে জানা থাকে যে , পরীক্ষা বা শাস্তির উদ্দেশ্যেই সংশ্লিষ্ট বস্তুকে হারাম করা হয়েছে।

সামাজিক বিধিবিধান। এ ক্ষেত্রে স্থান-কাল ও পরিস্থিতির পরিবর্তনশীলতার প্রেক্ষিতে আল্লাহ্ তা আলা কতক সাধারণ মূলনীতি ও কতক গুরুত্বপূর্ণ বিধান প্রদান করেছেন ; অবশিষ্ট বিষয়গুলো হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) ও তাঁর উত্তরাধিকারীদের এখতিয়ারে এবং প্রচলিত রীতিপ্রথার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। যেমন: বিবাহে দেনমোহর ও নাফাক্বাহ্ (ভরণ-পোষণ)-এর বিধান দেয়া হয়েছে , কিন্তু তার পরিমাণ রীতিপ্রথা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আর্থিক অবস্থা ও সামাজিক অবস্থানের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও প্রায় অনুরূপ অবস্থা লক্ষ্য করা যায়। যেমন: কোরআন মজীদে মীরাছ বণ্টনের সুনির্দিষ্ট বিধান দেয়া হয়েছে ও খুমস্ সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে , কিন্তু যাকাত ফরয করা হলেও তার নেছ্বাব্ ও হার নির্দিষ্ট করে দেয়া হয় নি , বরং তা হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) কর্তৃক নির্ধারিত হয়েছে।

দণ্ডবিধির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। কতক ক্ষেত্রে কোরআন মজীদে সুনির্দিষ্ট বিধান দেয়া হয়েছে এবং কতক ক্ষেত্রে বিষয়টি হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। যেমন: বিবাহিত স্বাধীন নারী-পুরুষের যেনা বা ব্যভিচারের শাস্তি হিসেবে প্রস্তরাঘাতে হত্যার বিধান কোরআন মজীদে নেই ,১৯ কিন্তু হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) যে এ শাস্তি কার্যকর করতেন সে ব্যাপারে দ্বিমত নেই।

রাজনৈতিক , কূটনৈতিক ও সামরিক বিষয়ে কতক স্থায়ী মূলনীতি প্রদান করে বাস্তব সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর বিবেচনার ওপর ছেড়ে দেয়া হয় - যা তাঁর অবর্তমানে তাঁর স্থলাভিষিক্ত ও উত্তরাধিকারীদের অধিকার।

এবার ভিন্ন এক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি দেয়া যাক। তা হচ্ছে , আল্লাহ্ তা আলা যে সব মৌলিক দায়িত্ব পালনের জন্য নবী-রাসূলগণকে (আঃ) প্রেরণ করেন তা সংক্ষেপে তিনটি: (১) মানুষের নিকট জীবন ও জগতের অন্তরালে নিহিত মহাসত্য সম্পর্কে সঠিক বিষয় তুলে ধরা ও তার প্রচার , (২) আল্লাহ্ তা আলা মানুষের জন্য যে সব কাজ অপরিহার্য কর্তব্য (ফরয) রূপে নির্ধারণ করেছেন ও যে সব কাজ নিষেধ (হারাম) করেছেন তা জানিয়ে দেয়া এবং (৩) নবীর দাও আত্ গ্রহণকারীদের নেতৃত্ব দান ও পরিচালনা।

এখানে দ্বিতীয় বিষয়টি সম্পর্কে বলতে হয় যে , ফরয ও হারাম সম্পর্কে জানানো যেহেতু নবীর মৌলিক দায়িত্ব সেহেতু নবী তাঁর অনুসারীদেরকে সর্বজনীনভাবেই তা অবগত করাবেন ; এ বিষয়ে তিনি তাঁর অল্প সংখ্যক অনুসারীকে জানাবেন তা সম্ভব নয়। অতএব , আমরা এ উপসংহারে উপনীত হতে পারি যে , চারটি সূত্রে ফরয ও হারাম প্রমাণিত হতে পারে: (১) কোরআন মজীদের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা , (২) হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর যুগ থেকে ধারাবাহিকভাবে চলে আসা উম্মাহর অভিন্ন আমল (ইজমা ), (৩) মুতাওয়াতির হাদীছ ও (৪) আক্বলের অকাট্য রায়। অর্থাৎ খবরে ওয়াহেদ হাদীছ দ্বারা ফরয বা হারাম প্রমাণিত হয় না। অবশ্য খবরে ওয়াহেদ হাদীছের অন্যবিধ গুরুত্বপূর্ণ বহু ক্ষেত্র রয়েছে , যেমন: জ্ঞান-বিজ্ঞানের তথ্য সম্বলিত হাদীছ এবং প্রায়োগিক ক্ষেত্র সংশ্লিষ্ট ছোটখাটো বা বিস্তারিত বিধান সংশ্লিষ্ট হাদীছ।

আল্লাহ্ তা আলা যা কিছু ফরয করেছেন তা সম্পাদন না করলে বান্দাহ্ অবশ্যই শাস্তিযোগ্য হবে এবং তিনি যা কিছু হারাম করেছেন সে সব কাজ সম্পাদন করলেও শাস্তিযোগ্য হবে (যদিও অন্যের অধিকার হরণ বা বিনষ্ট বা লঙ্ঘন করা ব্যতীত যে সব অপরাধ করা হয়েছে আন্তরিক অনুতাপ সহ তার পুনরাবৃত্তি থেকে বিরত থাকলে আল্লাহ্ তা আলা তার শাস্তি মওকুফ করে দেবেন)। এই ফরয ও হারাম ব্যতিরেকে মানব জীবনের বাকী সকল ক্ষেত্রে বান্দাহ্ পুরোপুরি স্বাধীন। অবশ্য এই স্বাধীন ক্ষেত্রের মধ্যে কতক কাজ ফরয না হলেও উত্তম , কল্যাণকর ও আল্লাহ্ তা আলার পসন্দনীয় ; হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) এ ধরনের কাজ সম্পাদন করতেন ও তা করার জন্য অন্যদেরকে উৎসাহিত করতেন এবং যে সব কাজ হারাম না হলেও অপসন্দনীয় ও রুচিবিগর্হিত , রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ) তা থেকে বিরত থাকতেন ও তাঁর অপসন্দ প্রকাশ করতেন। এ ধরনের বিষয়ের বেশীর ভাগই খবরে ওয়াহেদ হাদীছে পাওয়া যায়।

এই শেষোক্ত বিষয় সমূহে অর্থাৎ পসন্দনীয় ও অপসন্দনীয় বিষয়সমূহে ক্ষেত্রবিশেষে তথ্যগত মতপার্থক্য রয়েছে এবং ক্ষেত্র-বিশেষে তথ্যগত মতপার্থক্য না থাকলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ তথা হাদীছের ব্যবহারিক দিক নির্ণয়ে মতপার্থক্য হয়েছে। অর্থাৎ কোনো বিষয়কে কেউ হয়তো ফরয অর্থে গ্রহণ করেছেন , আবার কেউ পসন্দনীয় অর্থে গ্রহণ করছেন। তেমনি কোনো বিষয়কে কেউ হারাম অর্থে গ্রহণ করেছেন , আবার কেউ অপসন্দনীয় অর্থে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু সঠিক কথা হচ্ছে এই যে , বিতর্কিত মতামত দ্বারা ফরয বা হারাম নির্ধারিত হয় না। কারণ , আল্লাহ্ তা আলা বা তাঁর পক্ষ থেকে তাঁর রাসূল (ছ্বাঃ) কোনো কাজকে ফরয বা হারাম বলে নির্ধারণ করলে তা খবরে ওয়াহেদ হাদীছের মতো খুবই সীমিত সংখ্যক সূত্রের বর্ণনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো না।

কতগুলো মতপার্থক্য ঘটেছে বিস্তারিত বা বাস্তবায়নসংক্রান্ত বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে অথবা গৌণ বিষয়ে , অথবা একটি বিষয় আদৌ বিধান হিসেবে গণ্য কিনা সে ব্যাপারে। যেমন: দৈনিক পাঁচ ওয়াক্তে সতেরো রাক্ আত্ নামায ফরয হবার ব্যাপারে বিতর্ক নেই , নামাযের পূর্বপ্রস্তুতি ও নামাযের মধ্যকার ফরয কাজগুলো নিয়েও বিতর্ক নেই। কিন্তু সূরা ফাতেহার পরে একটি পুরো সূরা পড়তে হবে , নাকি আংশিক পড়লেই যথেষ্ট হবে - এ ব্যাপারে বিতর্ক আছে। এ বিতর্কই প্রমাণ করে যে , বিষয়টি ফরয সংক্রান্ত নয় , অর্থাৎ পূর্ণ সূরা পড়া অপরিহার্য নয়। কারণ , অপরিহার্য হলে স্বয়ং হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর যুগ থেকে এ ব্যাপারে মুসলমানদের ধারণা ও আমল অভিন্ন হতো এবং বিতর্কের সৃষ্টি হতো না। তেমনি নামাযের তাশাহ্হুদ্ , দরূদ ও সালামের বাক্যাবলীতে শব্দগত বিভিন্নতা দেখা যায় - যা প্রমাণ করে যে , এর মূল বিষয়টা যরূরী , তবে এর শব্দাবলীতে বিভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু প্রত্যেক রাক্ আতে সূরা ফাতেহার পূর্বে বিসমিল্লাহির্ রাহমানির রাহীম পড়তে হবে কিনা সে প্রশ্নের সমাধান আক্বলী দলীলের দ্বারা করতে হবে। তা হচ্ছে , যেহেতু সূরা তাওবাহর শুরুতে বিসমিল্লাহ্ নেই সেহেতু অন্যান্য সূরার শুরুতে যে বিসমিল্লাহ্ রয়েছে তা ঐ সব সূরার (সূরা ফাতেহাহ্ সহ) অংশ , অতএব , তা না পড়লে ঐ সব সূরা পাঠ সম্পূর্ণ হবে না।

নামাযের ভিতরে পঠনীয় তাশাহ্হুদ্ ও দরূদের পাঠে মতপার্থক্য থেকে বুঝা যায় যে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শব্দাবলী ব্যবহার করেছেন ; এ ব্যাপারে তিনি সব সময় অভিন্ন শব্দাবলী ব্যবহার করলে মতপার্থক্য হতো না। তেমনি নামাযে হাত কী অবস্থায় থাকবে তার সাথে নামাযের আদৌ কোনো সংশ্লিষ্টতা আছে বলে মনে হয় না। তাই এ ব্যাপারে তিন ধরনের মত ও আমল দেখা যায় , তবে কেউই বিষয়টিকে নামাযের অন্যতম ফরয কাজ বলে গণ্য করেন না বা তাঁদের মতের অন্যথা হলে নামায বাতিল হয়ে যাবে বলেও মনে করেন না। তা সত্ত্বেও অনেকে বিষয়টি নিয়ে বাড়াবড়ি করে থাকেন যা বিভেদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

মতপার্থক্যের কতগুলো বিষয় হচ্ছে সামাজিক , অর্থনৈতিক ও বিচার-ফয়সালা সংক্রান্ত। এ সব ক্ষেত্রে সাধারণতঃ বিভিন্ন হাদীছে প্রাপ্ত তথ্যাদির মধ্যকার পার্থক্য থেকে মতপার্থক্য ঘটেছে। যেমন: কোনো কোনো দ্রব্যে যাকাত প্রযোজ্য হওয়া বা না-হওয়া প্রশ্নে মতপার্থক্য। কিন্তু এ জাতীয় শাখাগত বিধান যেহেতু সরাসরি আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে নির্ধারিত নয় , সেহেতু নিঃসন্দেহে তা হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর এখ্তিয়ারাধীন বিষয় ছিলো। এ কারণে হয়তো তিনি বিভিন্ন সময়ে গৃহীত সিদ্ধান্তে পার্থক্য করে থাকবেন। হয়তো তিনি কোনো এক সময় একটি দ্রব্যের ওপর যাকাত আরোপ করে থাকবেন এবং অন্য এক সময় তিনি দ্রব্যটিকে যাকাত-বহির্ভূত রেখে থাকবেন। অথবা হয়তো বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় তিনি একই দ্রব্যের ক্ষেত্রে কারো কাছ থেকে যাকাত গ্রহণ করে থাকবেন এবং কাউকে ঐ বস্তুর জন্য যাকাত প্রদান থেকে রেহাই দিয়ে থাকবেন।

বলা বাহুল্য যে , আর্থ-সামাজিক বিষয়ে স্বীয় এখ্তিয়ারাধীন ক্ষেত্রে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর জন্য বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখ্তিয়ার ছিলো এবং এরূপ ক্ষেত্রে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর উত্তরাধিকারীদের জন্যও বিচার-বিবেচনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখ্তিয়ার রয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রায়োগিক ব্যাপারে , ইতিপূর্বে খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছ গ্রহণের জন্য যে সব শর্তের উল্লেখ করা হয়েছে তা পূরণ সাপেক্ষে বিভিন্ন হাদীছের মধ্য থেকে যার কাছে যেটি অধিকতর নির্ভরযোগ্য মনে হয় তিনি সেটির অনুসরণ করলে বা স্বীয় বিবেচনা অনুযায়ী নতুন সিদ্ধান্ত নিলেও অসুবিধা নেই।

আল্লাহ্ তা আলা যেভাবে ধরণীর বুকে তাঁর প্রকৃত প্রতিনিধি নবী-রাসূলগণকে (আঃ) বিধিবিধানের ক্ষেত্রে পুরোপুরি হাত-পা বেঁধে দেন নি , বরং কিছু ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখ্তিয়ার দিয়েছেন , তেমনি তিনি নবী-রাসূলগণের (আঃ) উত্তরাধিকারী ও প্রতিনিধিগণকেও পুরোপুরি হাত-পা বেঁধে দেন নি , যদিও তাঁদের স্বাধীন এখ্তিয়ারের ক্ষেত্র অবশ্যই নবী-রাসূলগণের (আঃ) স্বাধীন এখতিয়ারের ক্ষেত্রের তুলনায় অপেক্ষাকৃত সঙ্কুচিত এবং নবী-রাসূলগণের (আঃ) এখ্তিয়ার আল্লাহ্ তা আলার বিধান দ্বারা সীমাবদ্ধ হলেও তাঁদের এখ্তিয়ার একই সাথে সংশ্লিষ্ট নবীর অকাট্য ও শর ঈ বিধান দ্বারাও সীমাবদ্ধ।

কিন্তু নবীর উত্তরাধিকারী ও প্রতিনিধি যখন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়াদির আওতাভুক্ত কোনো বিষয়ে নবীর সিদ্ধান্তটিকে নীতিগত বা শর ঈ সিদ্ধান্ত নয় , বরং সমাজনেতা ও রাষ্ট্রনেতা হিসেবে তাঁর পক্ষ থেকে আর্থ-সামাজিক বা রাজনৈতিক গৌণ সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখতে পান - যা বিশেষ স্থান , কাল বা পরিস্থিতির সাথে সম্পর্কযুক্ত , সে ক্ষেত্রে তিনি যথাযথ মনে করলে স্বতন্ত্র সিদ্ধান্তও গ্রহণ করতে পারেন , যদিও নবীর সিদ্ধান্তের হুবহু অনুসরণ ও বাস্তবায়নে কোনো অসুবিধা না হলে তিনি তাকেই অগ্রাধিকার দেবেন।

এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) তাঁর পালকপুত্র হযরত যায়দ্কে (রাঃ) স্বীয় স্ত্রীকে ত্বালাক্ব দেয়া থেকে বিরত থাকতে বলেছিলেন। কিন্তু এরপরও যায়দ্ (রাঃ) স্বীয় স্ত্রীকে ত্বালাক্ব দিয়েছিলেন। কারণ , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর এ নিষেধ কোনো শর ঈ নির্দেশ ছিলো না , বরং তাঁর এ নির্দেশ ছিলো যায়দ্ (রাঃ)-এর মুরুব্বী হিসেবে তাঁর কল্যাণকামিতা। যেহেতু আল্লাহ্ তা আলা ত্বালাক্ব দানের অনুমতি দিয়েছেন , অতএব , রাসূলের (ছ্বাঃ) কথা না শুনে স্বীয় স্ত্রীকে ত্বালাক্ব দেয়ায় যায়দ্-এর কোনো গুনাহ্ হয় নি।

যদিও , কোরআন মজীদের ঘোষণা অনুযায়ী , মুসলমানদের ওপর তাদের নিজেদের চেয়েও রাসূলের (ছ্বাঃ) বেশী অধিকার রয়েছে - এ দৃষ্টিতে বলা যেতে পারে যে , যায়দের পক্ষে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর নিষেধ অমান্য করা ঠিক হয় নি। তবে দেখতে হবে যে , এ নিষেধটি কোন্ পর্যায়ের ; নিঃসন্দেহে এ নিষেধ কোনো দৃঢ় পর্যায়ের নিষেধ ছিলো না , বরং এ ছিলো যায়দ্-দম্পতির কল্যাণকামনা থেকে উদ্ভূত নছ্বীহত্ মাত্র যা মেনে নেয়া বা না নেয়ার বিষয়টি তিনি ব্যক্তি যায়দের (রাঃ) ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন।

অন্যদিকে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) একজন ছ্বাহাবীর প্রতি তাঁর কন্যাকে অপর একজন ছ্বাহাবীর (যিনি ছিলেন নিঃস্ব) সাথে বিবাহ দিতে বললে কন্যার পিতা তাতে রাযী হন নি ; এতেও ঐ ছ্বাহাবী কোনো শর ঈ আদেশ লঙ্ঘন করেন নি। কিন্তু মেনে নেয়া অপরিহার্য না হওয়া সত্ত্বেও উক্ত কন্যা কেবল হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) সন্তুষ্ট হবেন বিবেচনায় উক্ত নিঃস্ব ছ্বাহাবীকে বিবাহ করেন। তবে মুসলমানদের ওপর তাদের নিজেদের চেয়েও রাসূলের (ছ্বাঃ) যে বেশী অধিকার , রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক-সামষ্টিক ব্যাপারে তা মুসলমানদের জন্য ফরয পর্যায়ভুক্ত , একান্ত ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে নয়।

এ জাতীয় ঘটনাবলী থেকে প্রমাণিত হয় যে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর সকল আদেশ বা কাজই তাঁর উম্মাতের জন্য শর ঈ আদেশ অথবা অপরিহার্যভাবে মেনে চলার পর্যায়ের আদেশ বা অবশ্য অনুসরণীয় কাজ ছিলো না।

এ প্রসঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে , যেহেতু নবী মু মিনদের ওপর তাদের নিজেদের চেয়েও বেশী অধিকার রাখেন সেহেতু তিনি উম্মাত্ , রাষ্ট্র , সমাজ ও ব্যক্তিদের জন্য কল্যাণ বিবেচনা করলে তাদের ব্যক্তিগত অধিকারে হস্তক্ষেপ করার তথা ব্যক্তিগত অধিকারকে সঙ্কুচিত করার অধিকার রাখেন। অর্থাৎ নবী কাউকে হারাম কাজের নির্দেশ দিতে পারেন না (যা আসলে নবীর পক্ষ থেকে ঘটার প্রশ্নই ওঠে না) , কিন্তু তিনি কল্যাণ বা অপরিহার্য বিবেচনা করলে তাদেরকে হালাল থেকে বিরত রাখার অধিকার রাখেন। উদাহরণস্বরূপ , মূলগতভাবে ইসলামী শরী আতে দু জন মু মিন নর-নারীর মধ্যে বিবাহ অনুমোদিত হলেও নবী ইসলামী রাষ্ট্রের বাইরের কোনো নর-নারীর সাথে (যদিও তারা মুসলিম) ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিকদের বিবাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারেন। তবে এটা কোনো স্থায়ী শর ঈ বিধান হবে না , বরং এ হবে সাময়িক রাষ্ট্রীয় বিধান এবং তা কার্যকর রাখা যতোদিন অপরিহার্য বিবেচিত হবে ততোদিন তা কার্যকর থাকবে ; অতঃপর নবী বা তাঁর উত্তরাধিকারী প্রয়োজনবোধে তা তুলে নিতে ও পুনরায় প্রয়োজন হলে তা পুনরায় আরোপ করতে পারেন। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ , সম্পদ জাতীয়করণ বা ভূমি অধিগ্রহণ এ পর্যায়ের কাজ যে ক্ষেত্রে নবীর যেমন স্বাধীন এখ্তিয়ার রয়েছে , তেমনি নবীর উত্তরাধিকারী বা প্রতিনিধিরও স্বাধীন এখ্তিয়ার রয়েছে।

এছাড়া হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর সুন্নাত্ (তাঁর প্রবর্তিত ঐতিহ্য) নিয়েও মতপার্থক্য হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ , মুসলমান পুরুষদের দাড়ি রাখার প্রশ্নে ওলামায়ে ইসলামের মধ্যে মতৈক্য রয়েছে , কিন্তু দাড়ি ছাঁটা বা ছোট করা প্রশ্নে মতপার্থক্য রয়েছে। অতএব , সন্দেহ নেই যে , দাড়ি রাখাই সুন্নাত্ , সুনির্দিষ্ট মাপের দাড়ি রাখা সুন্নাত্ নয়। কারণ , সুনির্দিষ্ট মাপের দাড়ি রাখা সুন্নাত্ হলে এ বিষয়ে মতপার্থক্য সৃষ্টি হতো না। তেমনি কোরআন মজীদে তাক্ব্ওয়ার পোশাক পরিধান করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে , কিন্তু হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) যে লম্বা ঢোলা জামা পরিধান করতেন , তা কি তাক্ব্ওয়ার পোশাক হিসেবে পরতেন , নাকি আরবদের ঐতিহ্য ও আবহাওয়াগত কারণে পরতেন (যাতে অবশ্য তাক্ব্ওয়ার শর্তও পূরণ হতো) - এ ব্যাপারে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। যেহেতু এ ব্যাপারে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে সেহেতু আরবদের পোশাকের মতো পোশাক পরিধান করা যে সুন্নাত্ নয় তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। কারণ , তা সুন্নাত্ হলে এ ব্যাপারে মতপার্থক্য সৃষ্টি হতো না।

এ আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট যে , মতপার্থক্যের বিষয়গুলো মৌলিক বা মুখ্য নয়। তাই এ সব ক্ষেত্রে মতপার্থক্য থাকা সম্ভব হয়েছে এবং এসব বিষয়ে মতপার্থক্য থাকায় কোনো সমস্যাও নেই। সমস্যা হয় তখনই যখন এ সব বিষয়ের ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করা হয় অথবা এর ভিত্তিতে ফরয বা হারাম নির্ধারণের চেষ্টা করা হয়।

অবশ্য ইজতিহাদী মতপার্থক্যের কতগুলো বিষয় ইজতিহাদী নীতিমালা নির্ধারণে দুর্বলতা থেকে উৎসারিত। এ বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে ইজতিহাদের অব্যাহত চর্চা , মতপার্থক্যের বিষয়গুলোতে পারস্পরিক দলীল-প্রমাণকে আবেগমুক্তভাবে বিশ্লেষণ এবং ইজতিহাদী নীতিমালা ও মুজতাহিদের গুণাবলী সম্পর্কে পুনর্বিবেচনার জন্য মানসিক প্রস্তুতি অপরিহার্য। অর্থাৎ একজন মুজতাহিদের নিকট যখনই কোনো সত্য উদ্ঘাটিত হবে তখনি তা গ্রহণ করে নেয়ার জন্য তাঁর মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে। তেমনি একজন মুজতাহিদ জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাখা-প্রশাখা সমূহে , বিশেষ করে মানবিক বিজ্ঞান সমূহে যতো বেশী ব্যুৎপত্তির অধিকারী হবেন তাঁর পক্ষে বিভিন্ন সমস্যাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা ও তার সঠিক সমাধান উদ্বাবন করা ততোই সহজতর হবে।

এ কারণে , ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , একজন মুজতাহিদের জন্য কোরআন নাযিলকালীন ও জাহেলিয়্যাত্ যুগের আরবদের ভাষার ব্যাকরণগত খুটিনাটি বিষয়ের সাথে পরিচিত থাকার পাশাপাশি জ্ঞানতত্ত্ব , তাৎপর্যবিজ্ঞান , ভাষাতত্ত্ব , যুক্তিবিজ্ঞান ও দর্শনে ব্যুৎপত্তির এবং ইসলামের মৌলিক উপস্থাপনা সমূহ (তাওহীদ , আখেরাত্ ও রিসালাত্)কে বিচারবুদ্ধির আলোকে ও কোরআন মজীদের আলোকে পেশ করার যোগ্যতার অধিকারী হতে হবে। এছাড়া তাঁকে পরিবর্তনশীল চলমান জীবন ও জগতের পরিস্থিতি সম্পর্কে সদা অবহিত থাকতে হবে। তাঁকে বিভিন্ন ধারার উছূলে হাদীছ (হাদীছ শাস্ত্রের মূলনীতি) ও দেরায়াতে হাদীছ (হাদীছ পরীক্ষণ শাস্ত্র)-এর মানদণ্ড এবং উছূলে ফিক্বহ্ (ইজতিহাদের মূলনীতি) সম্পর্কে গভীর ধারণার অধিকারী হতে হবে। এভাবে তাঁকে পূর্ববর্তী হাদীছ সংগ্রাহক , হাদীছ বিশেষজ্ঞ ও মুজতাহিদগণের নির্ধারিত উছূলের ভুলত্রুটি চিহ্নিতকরণ ও সংশোধনের যোগ্যতার অধিকারী হতে হবে। কেবল তখনই তাঁর পক্ষে সকল ব্যাপারে প্রায় নির্ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছা ও মতপার্থক্য নিরসনে অবদান রাখা সম্ভব হবে।

কৃতজ্ঞতা

পুরোপুরি বিচারবুদ্ধির আলোকে জীবন ও জগতের অন্তরালে নিহিত মহাসত্য উদ্ঘাটন করে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনা সম্ভবতঃ বাংলা ভাষায় এটাই প্রথম। এ পর্যায়ে ইতিপূর্বে বাংলা ভাষায় যে সব গ্রন্থ রচিত হয়েছে তার মধ্যে পুরোপুরি সুবিন্যস্ত ও পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ , বিশেষ করে বিচারবুদ্ধির ভাবাবেগমুক্ত উপস্থাপন অত্র গ্রন্থকারের চোখে পড়ে নি। তবে বিন্যাসে দুর্বলতা , অপূর্ণাঙ্গতা ও ভাবাবেগের সংমিশ্রণ সত্ত্বেও ইতিপূর্বে এ পথে যারা অবদান রেখেছেন তাঁরা বিরাট খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। বিশেষ করে সূচনাকারীর গুরুত্ব অনেক বেশী। তাঁদের লেখা দ্বারা আমি যথেষ্ট অনুপ্রাণিত হয়েছি। অন্যদিকে আরবী ও ফার্সী ভাষায় এ বিষয়ে প্রচুর সংখ্যক সুবিন্যস্ত , পূর্ণাঙ্গ ও ভাবাবেগমুক্ত গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে । বিশেষ করে ফার্সী ভাষায় লেখা এতদসংক্রান্ত কতক গ্রন্থ লেখককে বিচারবুদ্ধির সুসংহত প্রয়োগে উদ্বুদ্ধ করেছে।

বিচারবুদ্ধির দলীল ব্যক্তিবিশেষের সম্পদ নয় , বরং সর্বজনীন সম্পদ এবং যে কেউ তা অধ্যয়ন করার পর তাকে সঠিক হিসেবে দেখতে পায় তখন তা তার নিজস্ব সম্পদে পরিণত হয়ে যায়। এ বিষয়টি অত্র গ্রন্থের ভূমিকায় উল্লেখ করেছি। তা সত্ত্বেও যে সব মনীষীর এ বিষয়ক লেখা অত্র গ্রন্থকারের বিচারবুদ্ধিকে শানিত করেছে এবং অত্র গ্রন্থ রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছে , বিচারবুদ্ধির দলীলকে দুর্বল না করার লক্ষ্যে গ্রন্থমধ্যে তাঁদের নাম তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহার না করলেও এবং ভূমিকায় তাঁদের নাম উল্লেখ না করলেও তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করাকে নিজের জন্য অপরিহার্য গণ্য করছি। তাই এখানে তাঁদের কথা স্মরণ করতে চাই।

এ ব্যাপারে সর্বপ্রথম যার কথা স্মরণ করছি তিনি হলেন আমার দ্বীনী শিক্ষক পিতৃপ্রতীম হযরত মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রঃ)। তাঁর লেখা মহাসত্যের সন্ধানে গ্রন্থ এ ব্যাপারে আমার মন-মগযকে যথষ্ট প্রভাবিত করেছে। অতঃপর স্মরণ করছি ইরানের স্বনামখ্যাত ইসলামী মনীষী হযরত আয়াতুল্লাহ্ জা ফার্ সোব্হানী , হযরত আয়াতুল্লাহ্ তাক্বী মেছ্ববাহ্ ইয়ায্দী ও হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন মোহাম্মাদ মোহাম্মাদী রেইশাহরী-কে (আল্লাহ্ তা আলা তাঁদেরকে শুভ প্রতিদান প্রদান করুন)। তাঁদের এতদ্বিষয়ক লেখা আমাকে জীবন ও জগতের অন্তরালে নিহিত মহাসত্যকে বিচারবুদ্ধির আলোকে দেখার ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছে।

এ ছাড়া কতক ক্ষেত্রে হযরত ইমাম খোমেইনী (রঃ) , শহীদ হযরত আয়াতুল্লাহ্ মোরতাযা মোতাহ্হারী (রঃ) ও হযরত আয়াতুল্লাহ্ মোহাম্মাদ তাক্বী জা ফারী (রঃ)-এর কোনো কোনো লেখা আমাকে তাৎপর্যের গভীরে প্রবেশে সহায়তা করেছে। বিশেষ করে হযরত আয়াতুল্লাহ্ মোহাম্মাদ তাক্বী জা ফারী (রঃ) বিষয়বস্তুর এতো গভীরে প্রবেশ করেছেন ও বিচারবুদ্ধির প্রয়োগকে এমনভাবে দূরতম ও সূক্ষ্মতম দুর্বলতা থেকেও মুক্ত করেছেন যে , তা আমাকে দারুণভাবে বিস্মিত ও অভিভূত করেছে। (আল্লাহ্ তা আলা এ মহান মনীষীদেরকে আলমে বারযাখের বেহেশতে সুখে-শান্তিতে রাখুন এবং শেষ বিচারে অবিনশ্বর জান্নাত্ নছ্বীব্ করুন।)

অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়া মানুষের উন্নতির কারণ

বস্তুতঃ মানব প্রজাতির অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে , প্রাকৃতিক , প্রাণীজ ও মানব-জাত অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়া অসংখ্য বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কারণ হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। মানুষ এ সব প্রতিক্রিয়া থেকে বাঁচার পথ খুঁজতে গিয়ে চিন্তা-গবেষণা করেছে এবং এমন সব বিস্ময়কর আবিষ্কার-উদ্ভাবন করেছে যা মানবসভ্যতার সৃষ্টি করেছে এবং তাকে এগিয়ে নিয়েছে। আর সৃষ্টিলোকের চূড়ান্ত লক্ষ্যের বাস্তবায়নের জন্য যে সব ঘটনা সংঘটিত হওয়া প্রয়োজন তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি মানুষ সৃষ্টিলোকে নিহিত সকল প্রাকৃতিক বিধিবিধান উদ্ঘাটন করবে ও নিজেদের কল্যাণের জন্য তা কাজে লাগাবে। কিন্তু কথিত অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়াসমূহ না থাকলে মানুষ আবিষ্কার-উদ্ভাবনে অনুপ্রাণিত হতো না।

অবশ্য প্রাকৃতিক জগতে , বিশেষতঃ প্রাণীজগতে এমন অনেক উপায়-উপকরণ পরিলক্ষিত হয় যার মধ্যে দৃশ্যতঃ অকল্যাণ ছাড়া কোনোরূপ কল্যাণ নিহিত নেই। মানুষ মনে করে , এ সব সৃষ্টি না থাকলেই বা কী অসুবিধা ছিলো ?

আসলে বাহ্যতঃ অকল্যাণকর হিসেবে পরিদৃষ্ট সৃষ্টিসমূহের মধ্যেও যে কল্যাণ নিহিত নেই এরূপ মনে করা ঠিক নয়। কারণ , ইতিমধ্যেই বিভিন্ন বাহ্যিক ক্ষতিকর উপাদান বা প্রাণী থেকে এমন সব কল্যাণকর উপাদান আবিষ্কৃত হয়েছে যা মানুষ পূর্বে কল্পনাও করতে পারতো না। উদাহরণ স্বরূপ , সাপের ন্যায় মারাত্মক প্রাণঘাতী প্রাণীর বিষ মানুষের বিরাট কল্যাণ সাধনে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে সম ওযনের স্বর্ণের তুলনায় বিষের দাম কয়েক গুণ বেশী দেখা যায়।

ক্ষতিকারকতা আপেক্ষিক

এমতাবস্থায় এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই যে , সৃষ্টিকুলের সকল সৃষ্টির মধ্যেই কল্যাণকারিতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাহ্যতঃ ক্ষতিকারক যা পরিলক্ষিত হয় তার ক্ষতিকারকতাও আপেক্ষিক। প্রথমতঃ অনেক প্রাণীর ক্ষতিকারকতা তাদের আত্মরক্ষার স্বার্থে অপরিহার্য। যেমন: সাপের বিষ এবং বাঘ ও সিংহের দন্ত-নখর তাদের আত্মরক্ষার জন্য যরূরী। দ্বিতীয়তঃ এক সৃষ্টির ক্ষতিকারকতা কেবল অন্য সৃষ্টির সংস্পর্শেই অর্থাৎ পারস্পরিক সংঘাতের পরিস্থিতিতেই প্রকাশ পায়। অন্যথায় প্রতিটি সৃষ্টিই তার তার নিজস্ব অবস্থানে সুন্দর। একটি সাপকে বা একটি সিংহকে তাদের নিজস্ব অবস্থানে রেখে পর্যবেক্ষণ করলে তার সৌন্দর্য ও তার সৃষ্টিতে সৃষ্টিকর্তার চমৎকার সৃষ্টিকুশলতাই ধরা পড়বে । তেমনি একটি কাঁটাগাছকে তার নিজস্ব অবস্থানে রেখে দেখলে তাকেও সুন্দর ও সুকৌশল সৃষ্টি রূপে দেখা যাবে।

এরপর আসে মানুষের মধ্যকার অবাঞ্ছিত দিকসমূহের কথা। ইতিপূর্বেই আমরা উল্লেখ করেছি যে , প্রাণীকুল , বিশেষতঃ মানুষ কমবেশী স্বাধীনতার অধিকারী। আর এদের স্বাধীনতার মধ্যে পারস্পরিক সংঘাতও অনিবার্য।

ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের নেতিবাচক ব্যবহার

প্রাণী হিসেবে অপরিহার্য স্বাধীনতার অতিরিক্ত মানুষের রয়েছে আরেক ধরনের স্বাধীনতা যাকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি নামে অভিহিত করা যায়। অর্থাৎ তার ইচ্ছাশক্তি অন্যান্য প্রাণীর ইচ্ছাশক্তির ন্যায় শুধু সহজাত প্রবণতা তথা আত্মরক্ষার তাগিদ থেকেই উদ্ভূত নয় , বরং সৃষ্টির সেরা হিসেবে তার মধ্যে রয়েছে ধরণীর বুকে স্বীয় নেতৃত্ব , কর্তৃত্ব , আধিপত্য , শ্রেষ্ঠত্ব ও মালিকানা প্রতিষ্ঠার প্রবণতা। এ প্রবণতা থেকে উদ্ভূত বিশেষ ধরনের ইচ্ছা ও তা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালানো তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

মানুষের এ বিশেষ ইচ্ছাশক্তি ও ক্ষমতা খারাপ কিছু তো নয়ই , বরং এ হচ্ছে তার এক বিরাট ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এ বৈশিষ্ট্যকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার না করে নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করার ফলে অবাঞ্ছিত অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। এ ক্ষতিকারকতা রোধ করতে হলে হয় তাকে এ ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করতে হতো , অথবা এ ক্ষমতার অপব্যবহারপ্রবণতা থেকে তাকে মুক্ত রাখতে হতো। কিন্তু তাহলে তার পরিণতি কী হতো ?

প্রাণী হিসেবে প্রদত্ত স্বাধীনতার পাশাপাশি মানুষকে প্রদত্ত ম্বাধীন ইচ্ছাশক্তি তাকে দেয়া না হলে মানুষ মানুষ হতো না ; স্রেফ একটি উন্নত স্তরের প্রাণীপ্রজাতি হতো। সে ক্ষেত্রে তার দ্বারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ ও সভ্যতার সৃষ্টি হতো না। অন্যদিকে তাকে সৃজনক্ষমতা প্রদান করার পাশাপাশি তার অপব্যবহার করার ক্ষমতা বিলুপ্ত করে দেয়া হলে কার্যতঃ সে ফেরেশতার কাছাকাছি কোনো প্রাণীতে পরিণত হতো , মানুষ হতো না এবং মানুষের মধ্যে সৃষ্টিকর্তার সকল গুণের (সীমিত মাত্রায় হলেও) যে সমাহার দেখা যাচ্ছে তথা সে যেভাবে সৃষ্টিকর্তার প্রতিচ্ছবি বা প্রতিনিধি রূপে আবির্ভূত হয়েছে তার মধ্যে এ বৈশিষ্ট্যের পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটতো না। অন্য কথায় , তার মধ্যে সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিক্ষমতার যে সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তা ঘটতো না। কারণ , সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিক্ষমতার সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ মানে হচ্ছে তাঁর গুণাবলীর অনুরূপ গুণাবলী সম্পন্ন সৃষ্টির উদ্ভব ঘটানো , যদিও সৃষ্টি ও সসীম হবার কারণে এ সৃষ্টির মধ্যে তাঁর সে গুণাবলীর বহিঃপ্রকাশ ঘটবে সীমিত পরিমাণে। সে সীমা কতখানি তা বড় কথা নয় , তবে সৃষ্টির মাঝে স্রষ্টার গুণাবলী সর্বোচ্চ যে মাত্রায় দেয়া সম্ভব তিনি তাকে তা সে মাত্রায়ই প্রদান করবেন এটাই স্বাভাবিক , অন্যথায় এ সৃষ্টি না সর্বোত্তম হবে , না তাঁর প্রতিচ্ছবি বা প্রতিনিধি হবে।

মানুষকে সৃষ্টিকর্তার সকল গুণ সম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রায় প্রদানের মানেই হচ্ছে তাকে শুধু সৃষ্টির ক্ষমতাই দেয়া হবে না , বরং ধ্বংসের ক্ষমতাও দেয়া হবে , যদিও উভয়ই সীমিত পরিমাণে ; এ সীমা কতোখানি তা বড় কথা নয় , তবে সম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রায় হওয়াই স্বাভাবিক। আর এ ধরনের গুণাবলীর অধিকারী হওয়ার মানেই হচ্ছে মানুষ সৃষ্টিলোকের ওপর স্বাধীনভাবে তার ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটাবে। এ ক্ষেত্রে তার ইচ্ছাকে শুধু কল্যাণ-ইচ্ছার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেয়া হলে বা অকল্যাণ-ইচ্ছা দেয়া সত্ত্বেও তার বাস্তবায়ন অসম্ভব করে দেয়া হলে তার মানে হতো তার স্বাধীনতাকে প্রায় বিলুপ্ত করে দেয়া তথা তাকে সম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রায় স্রষ্টার সকল গুণ না দেয়া। আর তাহলে সে সৃষ্টিকর্তার সম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রার বহিঃপ্রকাশ বা তাঁর সম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রার প্রতিনিধি হতো না। সে অবস্থায় সৃষ্টিকর্তার গুণাবলী বহুলাংশে অপ্রকাশিত থেকে যেতো।

মূলতঃ প্রতিনিধিত্বের শর্তই হচ্ছে প্রতিনিধিকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। তাকে প্রদত্ত এ স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করবে দু টি জিনিস: প্রথমতঃ প্রাকৃতিক বিধিবিধান , দ্বিতীয়তঃ নৈতিক বিধিবিধান তথা ঔচিত্য-অনৌচিত্যবোধ। মানুষের ইচ্ছা ও শক্তির নিয়ন্ত্রণকারী এ দু টি জিনিস। প্রাকৃতিক বিধিবিধানকে লঙ্ঘন করার সাধ্য মানুষের নেই। (অবশ্য অজ্ঞাত কোনো প্রাকৃতিক বিধান আবিষ্কার করে তার প্রয়োগের মাধ্যমে পূর্ব থেকে জ্ঞাত প্রাকৃতিক বিধিবিধানের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তিলাভ সম্ভব হতে পারে। এরূপ হলে প্রকৃত পক্ষে তাকে প্রাকৃতিক বিধানের লঙ্ঘন বলে গণ্য করা চলে না।) কিন্তু নৈতিক বিধিবিধান লঙ্ঘনের সুযোগ তার রয়েছে।

তবে যে মানুষ স্বীয় স্বরূপ তথা সে যে মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধিত্ব করছে - এ সত্য যথাযথভাবে উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে তার পক্ষে নৈতিক বিধান লঙ্ঘন করা সম্ভব নয়। যে সৃষ্টি প্রকৃতই সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধি সে জ্ঞানের আলোয় এতোখানি উদ্ভাসিত যে , নৈতিক বিধান লঙ্ঘনের বর্তমান (ইহজাগতিক) ও ভবিষ্যৎ (পরজাগতিক) প্রতিক্রিয়া তার সামনে দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট থাকে। ফলে স্বাধীনতা থাকা সত্ত্বেও তার পক্ষে নৈতিক বিধান লঙ্ঘন করা সম্ভব নয়।

পিতামাতার কারণে সন্তানের দুর্ভাগ্য কেন ?

সবশেষে আরো একটি প্রশ্নের জবাব দেয়া প্রয়োজন বলে মনে হয়। তা হচ্ছে , অনেক ক্ষেত্রেই পিতামাতার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের পরিণামে সন্তান সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের অধিকারী হয়। ধনীর সন্তান ধনী , গরীবের সন্তান গরীব হয়। অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন রোগগ্রস্ত পিতা বা মাতার সন্তান জন্মগতভাবে রোগগ্রস্ত হয়ে থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে , এ ক্ষেত্রে একজনের কর্মফল আরেক জন ভোগ করবে কেন ?

আসলে কয়েকটি বিষয়ে সচেতনতার অভাব থেকে এ প্রশ্নের উদয় হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রথমেই প্রশ্ন জাগে , সুখ-দুঃখের স্বরূপ কি মানুষ উদ্ঘাটন করতে পেরেছে ? সুখ-দুঃখ ও সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য প্রতিটি মানুষের বর্তমান , অতীত ও সম্ভাব্য বা প্রার্থিত ভবিষ্যৎ অবস্থার মধ্যে তুলনার ওপর নির্ভরশীল। প্রকৃত পক্ষে বিষয়টি আপেক্ষিক। সে কী আছে , কী চায় এবং কী হলো - এ তিনের সমন্বয় হচ্ছে তার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য নির্ণয়ের প্রকৃত মানদণ্ড।

তাই প্রশ্ন করতে হয় , জন্মগতভাবে বাঞ্ছিত বৈশিষ্ট্যাবলীর অধিকারী তথা সুন্দর , স্বাস্থ্যবান , শক্তিশালী , শক্তিক্ষমতার অধিকারী ও প্রভূত ধনসম্পদের মালিক মাত্রই কি ভাগ্যবান ? তাদের প্রত্যেকেই কি সুখী ? তাদের সকলেই কি শান্তির অধিকারী ?

নিঃসন্দেহে উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর ক্ষেত্রে একই শ্রেণীর সকলের জবাব এক নয়।

তেমনি জন্মগতভাবে অবাঞ্ছিত বৈশিষ্ট্যাবলীর অধিকারী তথা অসুন্দর , স্বাস্থ্যহীন , দুর্বল , শক্তিক্ষমতাহীন ও দরিদ্র বস্তিবাসীমাত্রই কি দুঃখী ? এ প্রশ্নের জবাবও একই শ্রেণীর সকল বস্তিবাসীর ক্ষেত্রে অভিন্ন নয়। আর এদের মধ্যে যদি কেউ নিজেকে দুঃখী বলে অনুভব না করে তাহলে তাকে ভাগ্যহীন বলা চলে কি ?

অনুরূপভাবে একই ব্যক্তির সকল সময়ের অবস্থা এক নয়। একই ধনী ব্যক্তি যেমন কখনো সুখী , কখনো অসুখী , তেমনি একই বস্তিবাসী ব্যক্তি কখনো সুখী , কখনো অসুখী।

সুখ-দুঃখ ও সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্যের বাহ্যিক ও পার্থিব মানদণ্ড যদি চূড়ান্ত হতো তাহলে রাজপুত্র স্বেচ্ছায় সিংহাসন ত্যাগ করে ফকীর-দরবেশ হয়ে যেতো না , ধনী যাত্রীর ভুল করে ফেলে যাওয়া লক্ষ টাকা গরীব রিকশাওয়ালা ফেরত দিতে যেতো না , দেশ বা ধর্মের জন্য বা মানবতার জন্য কেউ প্রাণ উৎসর্গ করতো না।

এখানে মনে রাখার দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে এই যে , প্রতিটি ব্যক্তি যেমন একেকটি একক সত্তা তেমনি সে তার পরিবার , সমাজ , দেশ ও বিশ্বের এবং সর্বোপরি গোটা সৃষ্টিলোকের সত্তারও অবিচ্ছেদ্য অংশবিশেষ বটে।

সন্তান নিঃসন্দেহে পিতামাতার সত্তার অংশবিশেষ এবং পিতামাতাও সন্তানের সত্তার অংশবিশেষ। এভাবে পরস্পরের সত্তার অংশবিশেষ হওয়ার কারণেই তারা শারীরিকভাবে পরস্পর স্বাধীন সত্তা হওয়া সত্ত্বেও পরস্পরের সুখ-দুঃখ , ভালো-মন্দ ও সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য দ্বারা পারস্পরিকভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকে। এ কারণেই পিতামাতার সন্তান-জন্মলাভপূর্ব অবস্থার দ্বারা সন্তানের প্রভাবিত হওয়ার মধ্যেই তাদের পারস্পরিক প্রভাব সীমাবদ্ধ নয় , বরং সন্তানের জন্মপরবর্তী-কালীন পারস্পরিক সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্যও তাদেরকে পারস্পরিকভাবে স্পর্শ করে। অনেক সময় সন্তানের দুর্ভাগ্য স্বয়ং সন্তানের তুলনায় পিতামাতার জন্য অধিকতর যন্ত্রণাদায়ক হয়ে থাকে।

একটি জন্মান্ধ শিশু পার্থিব জগতের সৌন্দর্য কী জানে না এবং তা তাকে হাজারো ব্যাখ্যা দিয়েও বুঝানো সম্ভব নয়। তাই পার্থিব জগতের সৌন্দর্য দেখতে না পারার কারণে তার তেমন কোনো দুঃখ হবার কথা নয় , কিন্তু সন্তানের জন্মান্ধতার কষ্ট এমনই যন্ত্রণাদায়ক হয় যে , অনেক সময় পিতামাতা সন্তানের অন্ধত্ব দেখার আগে নিজেদের মৃত্যু হলো না কেন - এ মর্মে আফসোস করে থাকে।

বিষয়টি একই দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যকার সম্পর্কের সাথে তুলনীয়। একই দেহের কোনো অঙ্গ রোগাক্রান্ত হলে তা দ্বারা সুস্থ অঙ্গও প্রভাবিত হয়। এ ক্ষেত্রে যে অঙ্গের সাথে যে অঙ্গের দূরত্বগত বা কর্মগত নৈকট্য বেশী সে সব অঙ্গ পরস্পর অধিকতর প্রভাবিত হয়। তেমনি সমাজ , দেশ ও বিশ্বের সামগ্রিক পরস্থিতির ভালো-মন্দ দ্বারা ব্যক্তি প্রভাবিত হয় , কারণ , সে সমাজ , দেশ ও বিশ্বের অংশ।

চিকিৎসাযোগ্য নয় এমন কোনো ব্যাধি কোনো ব্যক্তি বিদেশ থেকে নিয়ে এলে এবং তা সমাজে সংক্রামিত হলে তাতে একজন সুস্থ মানুষের আক্রান্ত হওয়ার এবং তা থেকে আদৌ সুস্থ না হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। পিতামাতার সাথে সন্তানের সম্পর্কও তেমনি। সন্তানের জন্মগ্রহণপূর্ব তথা মাতৃগর্ভে থাকাকালীন অবস্থায় এ সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতম থাকে বিধায় সন্তানের মধ্যে পিতামাতার ভালোমন্দ বৈশিষ্ট্য স্থানান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সবচেয়ে বেশী। পিতার দেহের প্রাণবীজ থেকে মাতৃগর্ভে সন্তানের সূচনা হয় এবং মাতৃদেহের উপাদানে পরিপুষ্ট হয়ে সে একটি পরিপূর্ণ শিশুরূপে ভূমিষ্ঠ হয়। ফলে পিতামাতার বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে সর্বাধিক মাত্রায় স্থানান্তরিত হওয়াটাই স্বাভাবিক।

এ বিষয়টিকে গাছের বীজ থেকে গাছ হওয়ার সাথে তুলনা করা যায়। টক আমের আঁটি থেকে টক আমের গাছই হবে , মিষ্টি আমের গাছ হবে না। অন্যদিকে যে মাটিতে এ আঁটি বপন করা হয়েছে তার প্রভাবও গাছ ও তার ফলে বিস্তার লাভ করবে। বলা হয় , ছাতকের কমলার বীজ দার্জিলিং-এ লাগালে তাতে ছাতকের কমলা পাওয়া যাবে না , তেমনি হুবহু দার্জিলিং-এর কমলাও পাওয়া যাবে না , বরং ছাতক ও দার্জিলিং উভয় জাতের কমলাগাছের কমলা থেকে তার বৈশিষ্ট্য কিছুটা স্বতন্ত্র হবে। এর বিপরীত করা হলেও তার ফল হবে প্রায় অনুরূপ। তবে বীজ থেকে চারা গজানোর পর সে চারা তুলে নিয়ে তৃতীয় কোন জায়গায় লাগালে এর বৈশিষ্ট্য হবে আরো ভিন্ন ধরনের। অর্থাৎ সে ক্ষেত্রে বীজ , জন্মকালীন পরিপুষ্টি ও জন্মপরবর্তী পরিপুষ্টি তিনটিই প্রভাবশালী হবে এবং মিশ্র ফলাফল প্রদান করবে।

তেমনি পোকায় ধরা , ত্রুটিপূর্ণ ও দুর্বল বীজ থেকে সৃষ্ট গাছ এবং দূষিত মাটিতে বপনকৃত ভালো বীজ থেকে সৃষ্ট গাছও নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে - এটাই স্বাভাবিক।

মানুষের বেলায় , একই প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী সন্তানের মধ্যে পিতা ও মাতার কাছ থেকে জন্মসূত্রে প্রাপ্ত প্রভাবের পাশাপাশি জন্মপরবর্তী পরিবেশ ও শিক্ষাও প্রভাবশালী হয়ে থাকে। তবে মানুষ তার বিচারবুদ্ধির পরিপক্বতায় উপনীত হবার পর স্বীয় চেষ্টা-সাধনা ও সংগ্রাম-সাধনার মাধ্যমে জন্ম , পরিবেশ ও শিক্ষা থেকে প্রাপ্ত অবাঞ্ছিত প্রভাব শারীরিক ও পার্থিব ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও এবং নৈতিক ক্ষেত্রে পুরোপুরি কাটিয়ে ঊঠতে পারে।

তৃতীয়তঃ সৃষ্টির সাফল্য ও ব্যর্থতার মানদণ্ড হচ্ছে সে জন্মগতভাবে যে সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে তার বিকাশ ও পূর্ণতায় উপনীত হওয়া বা না-হওয়াতে , অন্যের অনুরূপ হওয়া বা না-হওয়াতে নয়। বিড়ালের জন্য পরিপূর্ণ বিড়াল হওয়াতেই সার্থকতা , বাঘ হতে না পারা তার জন্য ব্যর্থতা নয়। একই প্রজাতির বিভিন্ন সদস্যের ক্ষেত্রেও তা-ই। অন্যদিকে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে মূল পার্থক্য তার বিচারবুদ্ধি ও ঐশী গুণাবলী , অতএব , তার সাফল্য ও ব্যর্থতার মানদণ্ড হচ্ছে এ গুণাবলীর বিকাশ ও ব্যবহার। এতে যে সফল , সে-ই প্রকৃত সফল এবং এতে যে ব্যর্থ সে-ই প্রকৃত ব্যর্থ।

অন্যদিকে পার্থিব ও অপার্থিব মিলিয়ে ব্যক্তির আশা-আকাঙ্ক্ষা ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে স্বতন্ত্র। তাই দেখা যায় যে , এক ব্যক্তি যা পাওয়ার জন্য লালায়িত এবং না পাওয়ার দুঃখে বুক ফেটে মারা যাবার উপক্রম , আরেক ব্যক্তি তা-ই অবজ্ঞাভরে পরিহার করছে। অতএব , সাফল্য-ব্যর্থতার অন্যতম ব্যক্তিগত মানদণ্ড এই আশা-আকাঙ্ক্ষও বটে , তবে কারো ব্যক্তিগত মানদণ্ড প্রকৃত বিচারে যথার্থ হতে পারে এবং কারো মানদণ্ড অযথার্থও হতে পারে। এ মানদণ্ডের যথার্থতা-অযথার্থতা নির্ণীত হবে অপার্থিব মানবিক মানদণ্ডের সাথে তুলনা করে। কারণ , এটাই মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মাঝে পার্থক্য নির্দেশ করে।

মানুষ অভিজ্ঞতা থেকে জানতে পারছে যে , বস্তুজগতের সাফল্য ও ব্যর্থতা এবং সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য একদিকে যেমন বিভিন্ন প্রাকৃতিক , অপ্রাকৃতিক ও মানবিক কারণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত , তেমনি মরণশীল মানুষের জন্য তা খুবই অস্থায়ী। অন্যদিকে মানুষ অবস্তুগত যা কিছু অর্জন করে তা বস্তুজগতের কারণাদির প্রভাবে তার হাতছাড়া হয় না এবং তা চিরস্থায়ী। তাই তার উচিত মানবিক ও আত্মিক সম্পদ অর্জনকেই সাফল্য ও ব্যর্থতার মানদণ্ড হিসেবে গণ্য করা এবং পার্থিব জীবন ও উপায়-উপকরণকে এ লক্ষ্যে উপনীত হবার মাধ্যমরূপে ব্যবহার করা।

মোদ্দা কথা , সৃষ্টিলোকে যা কিছু অবাঞ্ছিত উপাদান ও কারণ বলে মনে হয় তা মোটেই অযথা , বা অবাঞ্ছিত , বা অকল্যাণকর নয়। বরং সামগ্রিক ও চূড়ান্ত বিচারে সব কিছুতেই কল্যাণ নিহিত রয়েছে।

আমি কেন তুমি হলাম না ?!

এ প্রসঙ্গে আনুষঙ্গিক হিসেবে আরো একটি বিষয়ের ওপরে সংক্ষেপে হলেও আলোকপাত করা প্রয়োজন বলে মনে হয়। তা হচ্ছে , অনেক সময় অপূর্ণতার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতে দেখা যায়। যেমন: বলা হয় , সৃষ্টিকর্তা অমুককে বিকলাঙ্গ করে সৃষ্টি করলেন কেন ? আমি কেন সুন্দর চেহারার অধিকারী হলাম না ? তিনি কেন আমাকে ধনীর ঘরে পাঠালেন না অর্থাৎ আমি কেন ধনীর সন্তান হলাম না ? আমার মেধা-প্রতিভা অমুকের তুলনায় কম হলো কেন ? এ পরিবারে জন্ম নেয়ার কারণেই আমি দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছি। ইত্যাদি।

এসব অভিযোগের জবাবে যা বলতে হয় তা হচ্ছে , সৃষ্টিপ্রকৃতিতে অপূর্ণতা বলতে স্বতন্ত্র কিছু নেই , বরং পূর্ণতার অভাব বা ঘাটতিই অপূর্ণতা। আর পূর্ণতার অভাব বা ঘাটতি সৃষ্টিজগতের কার্যকারণ থেকেই উদ্ভূত হয় ; সৃষ্টিকর্তা পরিকল্পিতভাবে কারো মধ্যে ঘাটতি সৃষ্টি করে দেন না বা কাউকে পূর্ণতা থেকে বঞ্চিত করেন না। বিশেষ করে মানুষের ক্ষেত্রে এই অপূর্ণতা বা ঘাটতি অজ্ঞতা বা ভুল পদক্ষেপ থেকে উদ্ভূত হয়।

ওপরে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , কোনো বীজে ত্রুটি থাকলে বা ত্রুটিপূর্ণ মাটিতে বীজ বপন করা হলে অথবা পরিবেশগত অবনতি ঘটলে একটি বীজ থেকে ত্রুটিপূর্ণ গাছ জন্ম নিতে পারে এবং তা স্বাভাবিক পরিবৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত হতে পারে ও স্বাভাবিক ফল প্রদানে অসমর্থ হতে পারে। অনুরূপভাবে পিতার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন প্রাণবীজে বা মাতার ডিম্বে বা শরীরে ত্রুটি থাকলে অথবা পারিপার্শ্বিক ত্রুটির কারণে (যেমন: হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা নিক্ষেপ-পরবর্তীকালে সেখানকার বেঁচে থাকা বাসিন্দাদের মধ্যে ঘটেছে) বিকলাঙ্গ সন্তান জন্ম নিতে পারে। অতএব , এ জন্য সৃষ্টিকর্তাকে দোষারোপ করা ঠিক নয়।

সুন্দর চেহারার অধিকারী বা ধনীর সন্তান হওয়ার বিষয়টিও অনুরূপ। বিষয়টি নিম্নোক্ত উদাহরণের সাহায্যে অপেক্ষাকৃত সহজে বুঝা যেতে পারে।

-এর যে প্রাণবীজ -এর গর্ভে মানবশিশুতে পরিণত হয়েছে তা-ই রূপে জন্মগ্রহণ করেছে এবং উক্ত প্রাণবীজ ও গর্ভধারিনীর গর্ভকালীন অবস্থার ফলে যে ধরনের শিশু তৈরী হওয়া সম্ভব সে শিশুরূপেই ভূমিষ্ঠ হয়েছে। যে সময়ে -এর -বীজ দ্বারা -এর গর্ভসঞ্চার হয়ে -এর ভ্রূণ তৈরী হয়েছে সে সময় তা না হয়ে অন্য সময় হলে -এর অন্য কোনো বীজ দ্বারা -এর গর্ভসঞ্চার হলে তাতে -এর জন্ম হতো না , বরং -এর জন্ম হতো এবং হয়তোবা বীজ অথবা গর্ভকালীন অবস্থার পার্থক্যের কারণে সুন্দর চেহারা নিয়ে জন্মগ্রহণ করতো। অর্থাৎ -এর পক্ষে যা হওয়া সম্ভব ছিলো সে তা-ই হয়েছে , -এর পক্ষে হওয়া সম্ভব ছিলো না , কারণ উভয়ই স্বতন্ত্র।

ওপরের উদাহরণের -এর পক্ষে ধনীর সন্তান বা নামীদামী লোকের সন্তান হওয়ার বিষয়টিও অনুরূপ , বরং এর অসম্ভাব্যতা অধিকতর সুস্পষ্ট। কারণ , দরিদ্র -এর -প্রাণবীজ থেকে -এর জন্ম হয়েছে এবং ধনী -এর -প্রাণবীজ থেকে -এর জন্ম হয়েছে। এখন -এর পক্ষে কী করে হওয়া বা -এর সন্তান হওয়া সম্ভব হতো ?

অনুরূপভাবে -এর প্রাণবীজ দ্বারা -এর পরিবর্তে গর্ভবতী হলে সে সন্তান হতো না। এমনকি যদি ধরে নেয়া হয় যে , -এর -প্রাণবীজ থেকেই গর্ভবতী হয়েছে তথাপি সে সন্তান হতো না। কারণ , বৃক্ষের বৈশিষ্ট্য বিনির্মাণে বীজের ভূমিকা মুখ্য হলেও মাটির ভূমিকা উপেক্ষণীয় নয় , যে কারণে ছাতকের কমলার বীজ দার্জিলিং-এ লাগালে তাতে না ছাতকের কমলা হয় , না দার্জিলিং-এর , বরং তৃতীয় ধরনের কমলা হয়ে থাকে। অতএব , -প্রাণবীজ থেকে -এর পরিবর্তে -এর গর্ভে সন্তান হলে সে বর্তমান থেকে ভিন্ন এক ব্যক্তিরূপে জন্ম নিতো , এমনকি তার নাম রাখা হলেও।

আর -এর গর্ভে -এর -প্রাণবীজের পরিবর্তে -এর কোনো প্রাণবীজ থেকে গর্ভসঞ্চার হলে তা থেকে -এর জন্মগ্রহণের তো দূরতম সম্ভাবনাও থাকে না। কারণ , সন্তানের ব্যক্তিসত্তা নির্ধারণের মূল উপাদান হচ্ছে প্রাণবীজ ; ল্যাংরা আমের বীজ থেকে ল্যাংরা আম এবং ফজলী আমের বীজ থেকে ফজলী আম জন্ম নেবে ; মাটির অভিন্নতা একটিকে আরেকটিতে পরিবর্তিত করে দেয় না , যদিও মাটির পরিবর্তনে একই বীজের গাছের বৈশিষ্ট্যে অনেকখানি পার্থক্য হয়ে থাকে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে , যারা অসুন্দর , হীনস্বাস্থ্য , দুর্বল , বিকলাঙ্গ , ক্ষমতাহীন বা নিঃস্ব হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছে তাদের পক্ষে অন্য কেউ হয়ে জন্মগ্রহণ করা সম্ভব ছিলো না। অবশ্য তার জন্ম না হওয়া সম্ভব ছিলো , (কারণ , সে একজন সম্ভব অস্তিত্ব)। কিন্তু বিষয়টি তার পিতামাতার ওপর নির্ভরশীল এবং তার জন্মের জন্য তার পিতামাতার দায়িত্বহীন ইচ্ছা অথবা দায়িত্বহীন ইচ্ছা না থাকা সাপেক্ষে অজ্ঞতাই দায়ী।

আর ক্ষেত্রবিশেষে (যেমন: বিকলাঙ্গতা বা জন্মগত ব্যাধির ক্ষেত্রে) এ ধরনের সন্তানের জন্মগ্রহণের কারণে স্বয়ং সন্তানটির মনঃকষ্টের পরিমাণের চেয়ে তার পিতামাত্রার মনঃকষ্টের পরিমাণ অনেক গুণে বেশী হয়ে থাকে এবং ক্ষেত্রবিশেষে (যেমন: দারিদ্র্য ও অসৌন্দর্যের ক্ষেত্রে) সন্তানটি তার জন্মগ্রহণকে সম্ভাব্য জন্ম না নেয়ার ওপর অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। কোনো দরিদ্রসন্তানকে যদি জানানো হয় যে , দারিদ্র্যজনিত কারণে তার পিতামাতাকে কেউ এ সন্তানটি গর্ভে থাকাকালে গর্ভপাত ঘটানোর পরামর্শ দিয়েছিলো তখন ঐ পরামর্শদাতার প্রতি সন্তানটি সন্তুষ্ট হয় , নাকি অসন্তুষ্ট হয় তা লক্ষণীয়। নিঃসন্দেহে সে তার জন্ম না নেয়ার কথাটি কিছুতেই মেনে নিতে পারে না।

অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়া মানুষের উন্নতির কারণ

বস্তুতঃ মানব প্রজাতির অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে , প্রাকৃতিক , প্রাণীজ ও মানব-জাত অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়া অসংখ্য বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কারণ হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। মানুষ এ সব প্রতিক্রিয়া থেকে বাঁচার পথ খুঁজতে গিয়ে চিন্তা-গবেষণা করেছে এবং এমন সব বিস্ময়কর আবিষ্কার-উদ্ভাবন করেছে যা মানবসভ্যতার সৃষ্টি করেছে এবং তাকে এগিয়ে নিয়েছে। আর সৃষ্টিলোকের চূড়ান্ত লক্ষ্যের বাস্তবায়নের জন্য যে সব ঘটনা সংঘটিত হওয়া প্রয়োজন তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি মানুষ সৃষ্টিলোকে নিহিত সকল প্রাকৃতিক বিধিবিধান উদ্ঘাটন করবে ও নিজেদের কল্যাণের জন্য তা কাজে লাগাবে। কিন্তু কথিত অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়াসমূহ না থাকলে মানুষ আবিষ্কার-উদ্ভাবনে অনুপ্রাণিত হতো না।

অবশ্য প্রাকৃতিক জগতে , বিশেষতঃ প্রাণীজগতে এমন অনেক উপায়-উপকরণ পরিলক্ষিত হয় যার মধ্যে দৃশ্যতঃ অকল্যাণ ছাড়া কোনোরূপ কল্যাণ নিহিত নেই। মানুষ মনে করে , এ সব সৃষ্টি না থাকলেই বা কী অসুবিধা ছিলো ?

আসলে বাহ্যতঃ অকল্যাণকর হিসেবে পরিদৃষ্ট সৃষ্টিসমূহের মধ্যেও যে কল্যাণ নিহিত নেই এরূপ মনে করা ঠিক নয়। কারণ , ইতিমধ্যেই বিভিন্ন বাহ্যিক ক্ষতিকর উপাদান বা প্রাণী থেকে এমন সব কল্যাণকর উপাদান আবিষ্কৃত হয়েছে যা মানুষ পূর্বে কল্পনাও করতে পারতো না। উদাহরণ স্বরূপ , সাপের ন্যায় মারাত্মক প্রাণঘাতী প্রাণীর বিষ মানুষের বিরাট কল্যাণ সাধনে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে সম ওযনের স্বর্ণের তুলনায় বিষের দাম কয়েক গুণ বেশী দেখা যায়।

ক্ষতিকারকতা আপেক্ষিক

এমতাবস্থায় এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই যে , সৃষ্টিকুলের সকল সৃষ্টির মধ্যেই কল্যাণকারিতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাহ্যতঃ ক্ষতিকারক যা পরিলক্ষিত হয় তার ক্ষতিকারকতাও আপেক্ষিক। প্রথমতঃ অনেক প্রাণীর ক্ষতিকারকতা তাদের আত্মরক্ষার স্বার্থে অপরিহার্য। যেমন: সাপের বিষ এবং বাঘ ও সিংহের দন্ত-নখর তাদের আত্মরক্ষার জন্য যরূরী। দ্বিতীয়তঃ এক সৃষ্টির ক্ষতিকারকতা কেবল অন্য সৃষ্টির সংস্পর্শেই অর্থাৎ পারস্পরিক সংঘাতের পরিস্থিতিতেই প্রকাশ পায়। অন্যথায় প্রতিটি সৃষ্টিই তার তার নিজস্ব অবস্থানে সুন্দর। একটি সাপকে বা একটি সিংহকে তাদের নিজস্ব অবস্থানে রেখে পর্যবেক্ষণ করলে তার সৌন্দর্য ও তার সৃষ্টিতে সৃষ্টিকর্তার চমৎকার সৃষ্টিকুশলতাই ধরা পড়বে । তেমনি একটি কাঁটাগাছকে তার নিজস্ব অবস্থানে রেখে দেখলে তাকেও সুন্দর ও সুকৌশল সৃষ্টি রূপে দেখা যাবে।

এরপর আসে মানুষের মধ্যকার অবাঞ্ছিত দিকসমূহের কথা। ইতিপূর্বেই আমরা উল্লেখ করেছি যে , প্রাণীকুল , বিশেষতঃ মানুষ কমবেশী স্বাধীনতার অধিকারী। আর এদের স্বাধীনতার মধ্যে পারস্পরিক সংঘাতও অনিবার্য।

ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের নেতিবাচক ব্যবহার

প্রাণী হিসেবে অপরিহার্য স্বাধীনতার অতিরিক্ত মানুষের রয়েছে আরেক ধরনের স্বাধীনতা যাকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি নামে অভিহিত করা যায়। অর্থাৎ তার ইচ্ছাশক্তি অন্যান্য প্রাণীর ইচ্ছাশক্তির ন্যায় শুধু সহজাত প্রবণতা তথা আত্মরক্ষার তাগিদ থেকেই উদ্ভূত নয় , বরং সৃষ্টির সেরা হিসেবে তার মধ্যে রয়েছে ধরণীর বুকে স্বীয় নেতৃত্ব , কর্তৃত্ব , আধিপত্য , শ্রেষ্ঠত্ব ও মালিকানা প্রতিষ্ঠার প্রবণতা। এ প্রবণতা থেকে উদ্ভূত বিশেষ ধরনের ইচ্ছা ও তা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালানো তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

মানুষের এ বিশেষ ইচ্ছাশক্তি ও ক্ষমতা খারাপ কিছু তো নয়ই , বরং এ হচ্ছে তার এক বিরাট ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এ বৈশিষ্ট্যকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার না করে নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করার ফলে অবাঞ্ছিত অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। এ ক্ষতিকারকতা রোধ করতে হলে হয় তাকে এ ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করতে হতো , অথবা এ ক্ষমতার অপব্যবহারপ্রবণতা থেকে তাকে মুক্ত রাখতে হতো। কিন্তু তাহলে তার পরিণতি কী হতো ?

প্রাণী হিসেবে প্রদত্ত স্বাধীনতার পাশাপাশি মানুষকে প্রদত্ত ম্বাধীন ইচ্ছাশক্তি তাকে দেয়া না হলে মানুষ মানুষ হতো না ; স্রেফ একটি উন্নত স্তরের প্রাণীপ্রজাতি হতো। সে ক্ষেত্রে তার দ্বারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ ও সভ্যতার সৃষ্টি হতো না। অন্যদিকে তাকে সৃজনক্ষমতা প্রদান করার পাশাপাশি তার অপব্যবহার করার ক্ষমতা বিলুপ্ত করে দেয়া হলে কার্যতঃ সে ফেরেশতার কাছাকাছি কোনো প্রাণীতে পরিণত হতো , মানুষ হতো না এবং মানুষের মধ্যে সৃষ্টিকর্তার সকল গুণের (সীমিত মাত্রায় হলেও) যে সমাহার দেখা যাচ্ছে তথা সে যেভাবে সৃষ্টিকর্তার প্রতিচ্ছবি বা প্রতিনিধি রূপে আবির্ভূত হয়েছে তার মধ্যে এ বৈশিষ্ট্যের পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটতো না। অন্য কথায় , তার মধ্যে সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিক্ষমতার যে সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তা ঘটতো না। কারণ , সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিক্ষমতার সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ মানে হচ্ছে তাঁর গুণাবলীর অনুরূপ গুণাবলী সম্পন্ন সৃষ্টির উদ্ভব ঘটানো , যদিও সৃষ্টি ও সসীম হবার কারণে এ সৃষ্টির মধ্যে তাঁর সে গুণাবলীর বহিঃপ্রকাশ ঘটবে সীমিত পরিমাণে। সে সীমা কতখানি তা বড় কথা নয় , তবে সৃষ্টির মাঝে স্রষ্টার গুণাবলী সর্বোচ্চ যে মাত্রায় দেয়া সম্ভব তিনি তাকে তা সে মাত্রায়ই প্রদান করবেন এটাই স্বাভাবিক , অন্যথায় এ সৃষ্টি না সর্বোত্তম হবে , না তাঁর প্রতিচ্ছবি বা প্রতিনিধি হবে।

মানুষকে সৃষ্টিকর্তার সকল গুণ সম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রায় প্রদানের মানেই হচ্ছে তাকে শুধু সৃষ্টির ক্ষমতাই দেয়া হবে না , বরং ধ্বংসের ক্ষমতাও দেয়া হবে , যদিও উভয়ই সীমিত পরিমাণে ; এ সীমা কতোখানি তা বড় কথা নয় , তবে সম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রায় হওয়াই স্বাভাবিক। আর এ ধরনের গুণাবলীর অধিকারী হওয়ার মানেই হচ্ছে মানুষ সৃষ্টিলোকের ওপর স্বাধীনভাবে তার ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটাবে। এ ক্ষেত্রে তার ইচ্ছাকে শুধু কল্যাণ-ইচ্ছার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেয়া হলে বা অকল্যাণ-ইচ্ছা দেয়া সত্ত্বেও তার বাস্তবায়ন অসম্ভব করে দেয়া হলে তার মানে হতো তার স্বাধীনতাকে প্রায় বিলুপ্ত করে দেয়া তথা তাকে সম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রায় স্রষ্টার সকল গুণ না দেয়া। আর তাহলে সে সৃষ্টিকর্তার সম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রার বহিঃপ্রকাশ বা তাঁর সম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রার প্রতিনিধি হতো না। সে অবস্থায় সৃষ্টিকর্তার গুণাবলী বহুলাংশে অপ্রকাশিত থেকে যেতো।

মূলতঃ প্রতিনিধিত্বের শর্তই হচ্ছে প্রতিনিধিকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। তাকে প্রদত্ত এ স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করবে দু টি জিনিস: প্রথমতঃ প্রাকৃতিক বিধিবিধান , দ্বিতীয়তঃ নৈতিক বিধিবিধান তথা ঔচিত্য-অনৌচিত্যবোধ। মানুষের ইচ্ছা ও শক্তির নিয়ন্ত্রণকারী এ দু টি জিনিস। প্রাকৃতিক বিধিবিধানকে লঙ্ঘন করার সাধ্য মানুষের নেই। (অবশ্য অজ্ঞাত কোনো প্রাকৃতিক বিধান আবিষ্কার করে তার প্রয়োগের মাধ্যমে পূর্ব থেকে জ্ঞাত প্রাকৃতিক বিধিবিধানের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তিলাভ সম্ভব হতে পারে। এরূপ হলে প্রকৃত পক্ষে তাকে প্রাকৃতিক বিধানের লঙ্ঘন বলে গণ্য করা চলে না।) কিন্তু নৈতিক বিধিবিধান লঙ্ঘনের সুযোগ তার রয়েছে।

তবে যে মানুষ স্বীয় স্বরূপ তথা সে যে মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধিত্ব করছে - এ সত্য যথাযথভাবে উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে তার পক্ষে নৈতিক বিধান লঙ্ঘন করা সম্ভব নয়। যে সৃষ্টি প্রকৃতই সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধি সে জ্ঞানের আলোয় এতোখানি উদ্ভাসিত যে , নৈতিক বিধান লঙ্ঘনের বর্তমান (ইহজাগতিক) ও ভবিষ্যৎ (পরজাগতিক) প্রতিক্রিয়া তার সামনে দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট থাকে। ফলে স্বাধীনতা থাকা সত্ত্বেও তার পক্ষে নৈতিক বিধান লঙ্ঘন করা সম্ভব নয়।

পিতামাতার কারণে সন্তানের দুর্ভাগ্য কেন ?

সবশেষে আরো একটি প্রশ্নের জবাব দেয়া প্রয়োজন বলে মনে হয়। তা হচ্ছে , অনেক ক্ষেত্রেই পিতামাতার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের পরিণামে সন্তান সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের অধিকারী হয়। ধনীর সন্তান ধনী , গরীবের সন্তান গরীব হয়। অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন রোগগ্রস্ত পিতা বা মাতার সন্তান জন্মগতভাবে রোগগ্রস্ত হয়ে থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে , এ ক্ষেত্রে একজনের কর্মফল আরেক জন ভোগ করবে কেন ?

আসলে কয়েকটি বিষয়ে সচেতনতার অভাব থেকে এ প্রশ্নের উদয় হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রথমেই প্রশ্ন জাগে , সুখ-দুঃখের স্বরূপ কি মানুষ উদ্ঘাটন করতে পেরেছে ? সুখ-দুঃখ ও সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য প্রতিটি মানুষের বর্তমান , অতীত ও সম্ভাব্য বা প্রার্থিত ভবিষ্যৎ অবস্থার মধ্যে তুলনার ওপর নির্ভরশীল। প্রকৃত পক্ষে বিষয়টি আপেক্ষিক। সে কী আছে , কী চায় এবং কী হলো - এ তিনের সমন্বয় হচ্ছে তার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য নির্ণয়ের প্রকৃত মানদণ্ড।

তাই প্রশ্ন করতে হয় , জন্মগতভাবে বাঞ্ছিত বৈশিষ্ট্যাবলীর অধিকারী তথা সুন্দর , স্বাস্থ্যবান , শক্তিশালী , শক্তিক্ষমতার অধিকারী ও প্রভূত ধনসম্পদের মালিক মাত্রই কি ভাগ্যবান ? তাদের প্রত্যেকেই কি সুখী ? তাদের সকলেই কি শান্তির অধিকারী ?

নিঃসন্দেহে উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর ক্ষেত্রে একই শ্রেণীর সকলের জবাব এক নয়।

তেমনি জন্মগতভাবে অবাঞ্ছিত বৈশিষ্ট্যাবলীর অধিকারী তথা অসুন্দর , স্বাস্থ্যহীন , দুর্বল , শক্তিক্ষমতাহীন ও দরিদ্র বস্তিবাসীমাত্রই কি দুঃখী ? এ প্রশ্নের জবাবও একই শ্রেণীর সকল বস্তিবাসীর ক্ষেত্রে অভিন্ন নয়। আর এদের মধ্যে যদি কেউ নিজেকে দুঃখী বলে অনুভব না করে তাহলে তাকে ভাগ্যহীন বলা চলে কি ?

অনুরূপভাবে একই ব্যক্তির সকল সময়ের অবস্থা এক নয়। একই ধনী ব্যক্তি যেমন কখনো সুখী , কখনো অসুখী , তেমনি একই বস্তিবাসী ব্যক্তি কখনো সুখী , কখনো অসুখী।

সুখ-দুঃখ ও সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্যের বাহ্যিক ও পার্থিব মানদণ্ড যদি চূড়ান্ত হতো তাহলে রাজপুত্র স্বেচ্ছায় সিংহাসন ত্যাগ করে ফকীর-দরবেশ হয়ে যেতো না , ধনী যাত্রীর ভুল করে ফেলে যাওয়া লক্ষ টাকা গরীব রিকশাওয়ালা ফেরত দিতে যেতো না , দেশ বা ধর্মের জন্য বা মানবতার জন্য কেউ প্রাণ উৎসর্গ করতো না।

এখানে মনে রাখার দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে এই যে , প্রতিটি ব্যক্তি যেমন একেকটি একক সত্তা তেমনি সে তার পরিবার , সমাজ , দেশ ও বিশ্বের এবং সর্বোপরি গোটা সৃষ্টিলোকের সত্তারও অবিচ্ছেদ্য অংশবিশেষ বটে।

সন্তান নিঃসন্দেহে পিতামাতার সত্তার অংশবিশেষ এবং পিতামাতাও সন্তানের সত্তার অংশবিশেষ। এভাবে পরস্পরের সত্তার অংশবিশেষ হওয়ার কারণেই তারা শারীরিকভাবে পরস্পর স্বাধীন সত্তা হওয়া সত্ত্বেও পরস্পরের সুখ-দুঃখ , ভালো-মন্দ ও সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য দ্বারা পারস্পরিকভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকে। এ কারণেই পিতামাতার সন্তান-জন্মলাভপূর্ব অবস্থার দ্বারা সন্তানের প্রভাবিত হওয়ার মধ্যেই তাদের পারস্পরিক প্রভাব সীমাবদ্ধ নয় , বরং সন্তানের জন্মপরবর্তী-কালীন পারস্পরিক সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্যও তাদেরকে পারস্পরিকভাবে স্পর্শ করে। অনেক সময় সন্তানের দুর্ভাগ্য স্বয়ং সন্তানের তুলনায় পিতামাতার জন্য অধিকতর যন্ত্রণাদায়ক হয়ে থাকে।

একটি জন্মান্ধ শিশু পার্থিব জগতের সৌন্দর্য কী জানে না এবং তা তাকে হাজারো ব্যাখ্যা দিয়েও বুঝানো সম্ভব নয়। তাই পার্থিব জগতের সৌন্দর্য দেখতে না পারার কারণে তার তেমন কোনো দুঃখ হবার কথা নয় , কিন্তু সন্তানের জন্মান্ধতার কষ্ট এমনই যন্ত্রণাদায়ক হয় যে , অনেক সময় পিতামাতা সন্তানের অন্ধত্ব দেখার আগে নিজেদের মৃত্যু হলো না কেন - এ মর্মে আফসোস করে থাকে।

বিষয়টি একই দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যকার সম্পর্কের সাথে তুলনীয়। একই দেহের কোনো অঙ্গ রোগাক্রান্ত হলে তা দ্বারা সুস্থ অঙ্গও প্রভাবিত হয়। এ ক্ষেত্রে যে অঙ্গের সাথে যে অঙ্গের দূরত্বগত বা কর্মগত নৈকট্য বেশী সে সব অঙ্গ পরস্পর অধিকতর প্রভাবিত হয়। তেমনি সমাজ , দেশ ও বিশ্বের সামগ্রিক পরস্থিতির ভালো-মন্দ দ্বারা ব্যক্তি প্রভাবিত হয় , কারণ , সে সমাজ , দেশ ও বিশ্বের অংশ।

চিকিৎসাযোগ্য নয় এমন কোনো ব্যাধি কোনো ব্যক্তি বিদেশ থেকে নিয়ে এলে এবং তা সমাজে সংক্রামিত হলে তাতে একজন সুস্থ মানুষের আক্রান্ত হওয়ার এবং তা থেকে আদৌ সুস্থ না হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। পিতামাতার সাথে সন্তানের সম্পর্কও তেমনি। সন্তানের জন্মগ্রহণপূর্ব তথা মাতৃগর্ভে থাকাকালীন অবস্থায় এ সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতম থাকে বিধায় সন্তানের মধ্যে পিতামাতার ভালোমন্দ বৈশিষ্ট্য স্থানান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সবচেয়ে বেশী। পিতার দেহের প্রাণবীজ থেকে মাতৃগর্ভে সন্তানের সূচনা হয় এবং মাতৃদেহের উপাদানে পরিপুষ্ট হয়ে সে একটি পরিপূর্ণ শিশুরূপে ভূমিষ্ঠ হয়। ফলে পিতামাতার বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে সর্বাধিক মাত্রায় স্থানান্তরিত হওয়াটাই স্বাভাবিক।

এ বিষয়টিকে গাছের বীজ থেকে গাছ হওয়ার সাথে তুলনা করা যায়। টক আমের আঁটি থেকে টক আমের গাছই হবে , মিষ্টি আমের গাছ হবে না। অন্যদিকে যে মাটিতে এ আঁটি বপন করা হয়েছে তার প্রভাবও গাছ ও তার ফলে বিস্তার লাভ করবে। বলা হয় , ছাতকের কমলার বীজ দার্জিলিং-এ লাগালে তাতে ছাতকের কমলা পাওয়া যাবে না , তেমনি হুবহু দার্জিলিং-এর কমলাও পাওয়া যাবে না , বরং ছাতক ও দার্জিলিং উভয় জাতের কমলাগাছের কমলা থেকে তার বৈশিষ্ট্য কিছুটা স্বতন্ত্র হবে। এর বিপরীত করা হলেও তার ফল হবে প্রায় অনুরূপ। তবে বীজ থেকে চারা গজানোর পর সে চারা তুলে নিয়ে তৃতীয় কোন জায়গায় লাগালে এর বৈশিষ্ট্য হবে আরো ভিন্ন ধরনের। অর্থাৎ সে ক্ষেত্রে বীজ , জন্মকালীন পরিপুষ্টি ও জন্মপরবর্তী পরিপুষ্টি তিনটিই প্রভাবশালী হবে এবং মিশ্র ফলাফল প্রদান করবে।

তেমনি পোকায় ধরা , ত্রুটিপূর্ণ ও দুর্বল বীজ থেকে সৃষ্ট গাছ এবং দূষিত মাটিতে বপনকৃত ভালো বীজ থেকে সৃষ্ট গাছও নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে - এটাই স্বাভাবিক।

মানুষের বেলায় , একই প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী সন্তানের মধ্যে পিতা ও মাতার কাছ থেকে জন্মসূত্রে প্রাপ্ত প্রভাবের পাশাপাশি জন্মপরবর্তী পরিবেশ ও শিক্ষাও প্রভাবশালী হয়ে থাকে। তবে মানুষ তার বিচারবুদ্ধির পরিপক্বতায় উপনীত হবার পর স্বীয় চেষ্টা-সাধনা ও সংগ্রাম-সাধনার মাধ্যমে জন্ম , পরিবেশ ও শিক্ষা থেকে প্রাপ্ত অবাঞ্ছিত প্রভাব শারীরিক ও পার্থিব ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও এবং নৈতিক ক্ষেত্রে পুরোপুরি কাটিয়ে ঊঠতে পারে।

তৃতীয়তঃ সৃষ্টির সাফল্য ও ব্যর্থতার মানদণ্ড হচ্ছে সে জন্মগতভাবে যে সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে তার বিকাশ ও পূর্ণতায় উপনীত হওয়া বা না-হওয়াতে , অন্যের অনুরূপ হওয়া বা না-হওয়াতে নয়। বিড়ালের জন্য পরিপূর্ণ বিড়াল হওয়াতেই সার্থকতা , বাঘ হতে না পারা তার জন্য ব্যর্থতা নয়। একই প্রজাতির বিভিন্ন সদস্যের ক্ষেত্রেও তা-ই। অন্যদিকে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে মূল পার্থক্য তার বিচারবুদ্ধি ও ঐশী গুণাবলী , অতএব , তার সাফল্য ও ব্যর্থতার মানদণ্ড হচ্ছে এ গুণাবলীর বিকাশ ও ব্যবহার। এতে যে সফল , সে-ই প্রকৃত সফল এবং এতে যে ব্যর্থ সে-ই প্রকৃত ব্যর্থ।

অন্যদিকে পার্থিব ও অপার্থিব মিলিয়ে ব্যক্তির আশা-আকাঙ্ক্ষা ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে স্বতন্ত্র। তাই দেখা যায় যে , এক ব্যক্তি যা পাওয়ার জন্য লালায়িত এবং না পাওয়ার দুঃখে বুক ফেটে মারা যাবার উপক্রম , আরেক ব্যক্তি তা-ই অবজ্ঞাভরে পরিহার করছে। অতএব , সাফল্য-ব্যর্থতার অন্যতম ব্যক্তিগত মানদণ্ড এই আশা-আকাঙ্ক্ষও বটে , তবে কারো ব্যক্তিগত মানদণ্ড প্রকৃত বিচারে যথার্থ হতে পারে এবং কারো মানদণ্ড অযথার্থও হতে পারে। এ মানদণ্ডের যথার্থতা-অযথার্থতা নির্ণীত হবে অপার্থিব মানবিক মানদণ্ডের সাথে তুলনা করে। কারণ , এটাই মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মাঝে পার্থক্য নির্দেশ করে।

মানুষ অভিজ্ঞতা থেকে জানতে পারছে যে , বস্তুজগতের সাফল্য ও ব্যর্থতা এবং সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য একদিকে যেমন বিভিন্ন প্রাকৃতিক , অপ্রাকৃতিক ও মানবিক কারণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত , তেমনি মরণশীল মানুষের জন্য তা খুবই অস্থায়ী। অন্যদিকে মানুষ অবস্তুগত যা কিছু অর্জন করে তা বস্তুজগতের কারণাদির প্রভাবে তার হাতছাড়া হয় না এবং তা চিরস্থায়ী। তাই তার উচিত মানবিক ও আত্মিক সম্পদ অর্জনকেই সাফল্য ও ব্যর্থতার মানদণ্ড হিসেবে গণ্য করা এবং পার্থিব জীবন ও উপায়-উপকরণকে এ লক্ষ্যে উপনীত হবার মাধ্যমরূপে ব্যবহার করা।

মোদ্দা কথা , সৃষ্টিলোকে যা কিছু অবাঞ্ছিত উপাদান ও কারণ বলে মনে হয় তা মোটেই অযথা , বা অবাঞ্ছিত , বা অকল্যাণকর নয়। বরং সামগ্রিক ও চূড়ান্ত বিচারে সব কিছুতেই কল্যাণ নিহিত রয়েছে।

আমি কেন তুমি হলাম না ?!

এ প্রসঙ্গে আনুষঙ্গিক হিসেবে আরো একটি বিষয়ের ওপরে সংক্ষেপে হলেও আলোকপাত করা প্রয়োজন বলে মনে হয়। তা হচ্ছে , অনেক সময় অপূর্ণতার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতে দেখা যায়। যেমন: বলা হয় , সৃষ্টিকর্তা অমুককে বিকলাঙ্গ করে সৃষ্টি করলেন কেন ? আমি কেন সুন্দর চেহারার অধিকারী হলাম না ? তিনি কেন আমাকে ধনীর ঘরে পাঠালেন না অর্থাৎ আমি কেন ধনীর সন্তান হলাম না ? আমার মেধা-প্রতিভা অমুকের তুলনায় কম হলো কেন ? এ পরিবারে জন্ম নেয়ার কারণেই আমি দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছি। ইত্যাদি।

এসব অভিযোগের জবাবে যা বলতে হয় তা হচ্ছে , সৃষ্টিপ্রকৃতিতে অপূর্ণতা বলতে স্বতন্ত্র কিছু নেই , বরং পূর্ণতার অভাব বা ঘাটতিই অপূর্ণতা। আর পূর্ণতার অভাব বা ঘাটতি সৃষ্টিজগতের কার্যকারণ থেকেই উদ্ভূত হয় ; সৃষ্টিকর্তা পরিকল্পিতভাবে কারো মধ্যে ঘাটতি সৃষ্টি করে দেন না বা কাউকে পূর্ণতা থেকে বঞ্চিত করেন না। বিশেষ করে মানুষের ক্ষেত্রে এই অপূর্ণতা বা ঘাটতি অজ্ঞতা বা ভুল পদক্ষেপ থেকে উদ্ভূত হয়।

ওপরে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , কোনো বীজে ত্রুটি থাকলে বা ত্রুটিপূর্ণ মাটিতে বীজ বপন করা হলে অথবা পরিবেশগত অবনতি ঘটলে একটি বীজ থেকে ত্রুটিপূর্ণ গাছ জন্ম নিতে পারে এবং তা স্বাভাবিক পরিবৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত হতে পারে ও স্বাভাবিক ফল প্রদানে অসমর্থ হতে পারে। অনুরূপভাবে পিতার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন প্রাণবীজে বা মাতার ডিম্বে বা শরীরে ত্রুটি থাকলে অথবা পারিপার্শ্বিক ত্রুটির কারণে (যেমন: হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা নিক্ষেপ-পরবর্তীকালে সেখানকার বেঁচে থাকা বাসিন্দাদের মধ্যে ঘটেছে) বিকলাঙ্গ সন্তান জন্ম নিতে পারে। অতএব , এ জন্য সৃষ্টিকর্তাকে দোষারোপ করা ঠিক নয়।

সুন্দর চেহারার অধিকারী বা ধনীর সন্তান হওয়ার বিষয়টিও অনুরূপ। বিষয়টি নিম্নোক্ত উদাহরণের সাহায্যে অপেক্ষাকৃত সহজে বুঝা যেতে পারে।

-এর যে প্রাণবীজ -এর গর্ভে মানবশিশুতে পরিণত হয়েছে তা-ই রূপে জন্মগ্রহণ করেছে এবং উক্ত প্রাণবীজ ও গর্ভধারিনীর গর্ভকালীন অবস্থার ফলে যে ধরনের শিশু তৈরী হওয়া সম্ভব সে শিশুরূপেই ভূমিষ্ঠ হয়েছে। যে সময়ে -এর -বীজ দ্বারা -এর গর্ভসঞ্চার হয়ে -এর ভ্রূণ তৈরী হয়েছে সে সময় তা না হয়ে অন্য সময় হলে -এর অন্য কোনো বীজ দ্বারা -এর গর্ভসঞ্চার হলে তাতে -এর জন্ম হতো না , বরং -এর জন্ম হতো এবং হয়তোবা বীজ অথবা গর্ভকালীন অবস্থার পার্থক্যের কারণে সুন্দর চেহারা নিয়ে জন্মগ্রহণ করতো। অর্থাৎ -এর পক্ষে যা হওয়া সম্ভব ছিলো সে তা-ই হয়েছে , -এর পক্ষে হওয়া সম্ভব ছিলো না , কারণ উভয়ই স্বতন্ত্র।

ওপরের উদাহরণের -এর পক্ষে ধনীর সন্তান বা নামীদামী লোকের সন্তান হওয়ার বিষয়টিও অনুরূপ , বরং এর অসম্ভাব্যতা অধিকতর সুস্পষ্ট। কারণ , দরিদ্র -এর -প্রাণবীজ থেকে -এর জন্ম হয়েছে এবং ধনী -এর -প্রাণবীজ থেকে -এর জন্ম হয়েছে। এখন -এর পক্ষে কী করে হওয়া বা -এর সন্তান হওয়া সম্ভব হতো ?

অনুরূপভাবে -এর প্রাণবীজ দ্বারা -এর পরিবর্তে গর্ভবতী হলে সে সন্তান হতো না। এমনকি যদি ধরে নেয়া হয় যে , -এর -প্রাণবীজ থেকেই গর্ভবতী হয়েছে তথাপি সে সন্তান হতো না। কারণ , বৃক্ষের বৈশিষ্ট্য বিনির্মাণে বীজের ভূমিকা মুখ্য হলেও মাটির ভূমিকা উপেক্ষণীয় নয় , যে কারণে ছাতকের কমলার বীজ দার্জিলিং-এ লাগালে তাতে না ছাতকের কমলা হয় , না দার্জিলিং-এর , বরং তৃতীয় ধরনের কমলা হয়ে থাকে। অতএব , -প্রাণবীজ থেকে -এর পরিবর্তে -এর গর্ভে সন্তান হলে সে বর্তমান থেকে ভিন্ন এক ব্যক্তিরূপে জন্ম নিতো , এমনকি তার নাম রাখা হলেও।

আর -এর গর্ভে -এর -প্রাণবীজের পরিবর্তে -এর কোনো প্রাণবীজ থেকে গর্ভসঞ্চার হলে তা থেকে -এর জন্মগ্রহণের তো দূরতম সম্ভাবনাও থাকে না। কারণ , সন্তানের ব্যক্তিসত্তা নির্ধারণের মূল উপাদান হচ্ছে প্রাণবীজ ; ল্যাংরা আমের বীজ থেকে ল্যাংরা আম এবং ফজলী আমের বীজ থেকে ফজলী আম জন্ম নেবে ; মাটির অভিন্নতা একটিকে আরেকটিতে পরিবর্তিত করে দেয় না , যদিও মাটির পরিবর্তনে একই বীজের গাছের বৈশিষ্ট্যে অনেকখানি পার্থক্য হয়ে থাকে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে , যারা অসুন্দর , হীনস্বাস্থ্য , দুর্বল , বিকলাঙ্গ , ক্ষমতাহীন বা নিঃস্ব হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছে তাদের পক্ষে অন্য কেউ হয়ে জন্মগ্রহণ করা সম্ভব ছিলো না। অবশ্য তার জন্ম না হওয়া সম্ভব ছিলো , (কারণ , সে একজন সম্ভব অস্তিত্ব)। কিন্তু বিষয়টি তার পিতামাতার ওপর নির্ভরশীল এবং তার জন্মের জন্য তার পিতামাতার দায়িত্বহীন ইচ্ছা অথবা দায়িত্বহীন ইচ্ছা না থাকা সাপেক্ষে অজ্ঞতাই দায়ী।

আর ক্ষেত্রবিশেষে (যেমন: বিকলাঙ্গতা বা জন্মগত ব্যাধির ক্ষেত্রে) এ ধরনের সন্তানের জন্মগ্রহণের কারণে স্বয়ং সন্তানটির মনঃকষ্টের পরিমাণের চেয়ে তার পিতামাত্রার মনঃকষ্টের পরিমাণ অনেক গুণে বেশী হয়ে থাকে এবং ক্ষেত্রবিশেষে (যেমন: দারিদ্র্য ও অসৌন্দর্যের ক্ষেত্রে) সন্তানটি তার জন্মগ্রহণকে সম্ভাব্য জন্ম না নেয়ার ওপর অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। কোনো দরিদ্রসন্তানকে যদি জানানো হয় যে , দারিদ্র্যজনিত কারণে তার পিতামাতাকে কেউ এ সন্তানটি গর্ভে থাকাকালে গর্ভপাত ঘটানোর পরামর্শ দিয়েছিলো তখন ঐ পরামর্শদাতার প্রতি সন্তানটি সন্তুষ্ট হয় , নাকি অসন্তুষ্ট হয় তা লক্ষণীয়। নিঃসন্দেহে সে তার জন্ম না নেয়ার কথাটি কিছুতেই মেনে নিতে পারে না।


22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35