পরিশিষ্ট-1
ডারউইন -
তত্ত্ব :
বিজ্ঞানের নামে অন্ধ বিশ্বাস
পাশ্চাত্য জগত থেকে বিজ্ঞানের নামে উদ্ভূত যে সব তত্ত্ব সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে তার মধ্যে ডারউনের তত্ত্ব অন্যতম। বিশেষ করে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত প্রাচ্যবাসীদের প্রায় সকলের নিকট এ তত্ত্ব অভ্রান্ত বলে গণ্য হয়েছে। এ কারণে , এমনকি পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীদের মধ্যেও এ তত্ত্বের যথার্থতা সম্বন্ধে বিতর্ক ও সংশয় সৃষ্টি হলেও প্রাচ্যে তা এখনো প্রায় ঐশী বাণীর ন্যায় চোখ বুঁজে গ্রহণ করা হচ্ছে।
বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে
,
যে সব মৌলিক ধর্মগ্রন্থকে ঐশী বলে দাবী করা হয় অনেকে তার মধ্যে যেটিতে বিশ্বাসী বা ঈমানদার হবার দাবী করে সে গ্রন্থের অনেক কথার যথার্থতায় সন্দেহ পোষণ করলেও পাশ্চাত্য থেকে বিজ্ঞানের নামে প্রচারিত কোনো তত্ত্বে
,
বিশেষ করে
‘
বিবর্তনবাদ
’
(Theory of Evolution)নামে অভিহিত ডারউইন
-
তত্ত্বে বিন্দুমাত্র সন্দেহ পোষণ করতে রাযী নয়।
(
ইদানীং
,
বিশেষ করে পাঠ্যপুস্তকে
Theory of Evolution-
এর অনুবাদ
‘
অভিব্যক্তিবাদ
’
করতে দেখা যাচ্ছে যা এ বাংলা শব্দটির
‘
প্রথম তাৎপর্যের
’
বিচারে ভুল অনুবাদ
;
অবশ্য
‘
ক্রমবিকাশবাদ
’
অনুবাদ ভুল নয়।
)
অথচ বিজ্ঞানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সন্দেহ পোষণ করা এবং সন্দেহ পোষণের পরিপ্রেক্ষিতে পর্যালোচনা ও অনুসন্ধান করা। কিন্তু অনে
কেই বিজ্ঞানমনস্ক হবার ভান বা দাবী করলেও এ জাতীয় তত্ত্বের ক্ষেত্রে তাদের আচরণ পুরোপুরি অবৈজ্ঞানিক
,
বরং অন্ধ বিশ্বাসী আচরণ।
এ প্রসঙ্গে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় যে , কোনো তত্ত্বকে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বলে দাবী করা বা কোনো বিজ্ঞানীর পক্ষ থেকে উপস্থাপন করা হলেই যে তা সত্যি সত্যিই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের পর্যায়ভুক্ত হবে তা মনে করার কারণ নেই। কারণ , একটি তত্ত্বের বিজ্ঞানভিত্তিক হবার জন্যে বিভিন্ন শর্ত রয়েছে ; সে সব শর্তের সবগুলো পূরণ না হলে তাকে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বলা চলে না।
যে কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকেই বিষয়বস্তুভেদে অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা বা পরীক্ষা দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হতে হবে। শুধু যুক্তি দ্বারা কোনো কিছু প্রমাণ করা দর্শনের কাজ
,
বিজ্ঞানের
(
প্রচলিত সীমাবদ্ধ অর্থে তথা বস্তুবিজ্ঞান অর্থে
)
কাজ নয়। কিন্তু সকল যুগেই দেখা গেছে
,
বস্তুবিজ্ঞানী
(
এবং দার্শনিকও
)
এমন বিষয়ে কথা বলেছেন
যা তাঁর বিষয়ের
( Subject)আওতাভুক্ত নয়
,
অথবা আওতাভুক্ত হলেও অকাট্যভাবে প্রমাণিত হবার জন্যে প্রয়োজনীয় শর্তাবলী পূরণ করা হয় নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও একজন প্রথিতযশা বিজ্ঞানীর পক্ষ থেকে উপস্থাপিত হবার কারণে লোকেরা তা অন্ধভাবে গ্রহণ করেছে।
কুসংস্কারাচ্ছন্ন খৃস্টান ধর্মের ধর্মনেতাদের নিপীড়নমূলক কঠোর নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ইউরোপে যে রেনেসাঁ সংঘটিত হয় তার পৃষ্ঠপোষকতায় সেখানে বিজ্ঞান ও শিল্পের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয় (যদিও তা সম্ভব হয়েছিল প্রাচ্যের উপনিবেশসমূহ থেকে লুণ্ঠিত সম্পদলব্ধ পুঁজি বিনিয়োগ করে)। এ কারণে পাশ্চাত্যে এক অর্থে বিজ্ঞান ধর্মের স্থলাভিষিক্ত হয় এবং বিজ্ঞানের নামে যা কিছু উপস্থাপিত হয় লোকেরা তাকেই অভ্রান্ত বলে অন্ধভাবে বিশ্বাস করতে থাকে। ফলে যে কোনো বক্তব্য গ্রহণ করানোর জন্যে সহজতম পন্থা হয়ে দাঁড়ায় তা বিজ্ঞানের নামে উপস্থাপন করা।
এ প্রবণতার কারণে পাশ্চাত্যে বিজ্ঞানের নামে এমন অনেক দাবী উপস্থাপন করা হয় যা পরবর্তীকালে অকাট্যভাবে ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে অথবা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে , সংশ্লিষ্ট তত্ত্বটি অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ , বিশেষ করে হীনমন্যতায় আক্রান্ত প্রাচ্যের পাশ্চাত্যানুসারীরা তাকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করতেই থাকে। ডারউইন-তত্ত্ব এ ধরনেরই একটি তত্ত্ব।
এ প্রসঙ্গে সর্বপ্রথম যে কথাটি উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করি তা হচ্ছে , অনেকে ডারউইনের বিবর্তন বা ক্রমবিকাশ তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্টিকর্তার প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করতে চাইছে যদিও তা এক মূর্খতাব্যঞ্জক উপসংহার বৈ নয়। কারণ , বিবর্তনবাদ দ্বারা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের অপরিহার্যতা অপ্রমাণিত হয় না।
বস্তুতঃ প্রাণের সৃষ্টি ও প্রজাতিসমূহের উদ্ভব যদি বিবর্তনের মধ্য দিয়ে ঘটে থাকে তাহলেও এটা অনস্বীকার্য যে , তা‘
কারণ ও ফলাফল বিধি’
র আওতায় (যাকে সাধারণতঃ‘
কার্যকারণ বিধি’
বলা হয়ে থাকে) সংঘটিত হয়েছিল।
কথিত বিবর্তনের বিধি সহ সকল প্রাকৃতিক বিধি এমনই সূক্ষ্ম ও নির্ভুল হিসাব
-
নিকাশভিত্তিক বৈজ্ঞানিক বিধি যে
,
একজন সর্বজ্ঞ মহাবিজ্ঞানী ব্যতীত কারো পক্ষে এ সব বিধি তৈরী করা সম্ভব নয়
;
নিজে নিজেই এ সব বিধি তৈরী ও কার্যকর হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। এ
‘
পরিবর্তনশীল বা বিবর্তনশীল
’
বিশ্ব ও তার মধ্যস্থ অসংখ্য প্রাণশীল অস্তিত্ব ও প্রাণহীন বস্তুর উদ্ভব বা অন্ততঃ প্রথম সূচনার জন্যে পরিবর্তন ও বিবর্তনের উর্ধে একটি পরম বিজ্ঞানী উৎসের অস্তিত্ব অপরিহার্য। অন্যথায় অস্তিত্ব
-
জ
গতের সূচনাকে ব্যাখ্যা করা যায় না। কারণ
,
সৃষ্টির সূচনা কথিত প্রসারিত
‘
আদি বস্তু
’
থেকেই হোক বা
‘
আদি কণিকা
’
(Primary Particle)থেকেই হোক
,
তার উৎস এবং তাতে সৃষ্ট আলোড়ন বা বিষ্ফোরণ
(
যা অবশ্যই সুপরিকল্পিত বা উদ্দেশ্যমুখী ছিলো
)
সৃষ্টির জন্যে একটি কারণের প্রয়োজন
এবং অনিবার্যভাবেই সে কারণকে পরম ইচ্ছাশক্তি
,
পরম জ্ঞান ও সীমাহীন শক্তি
-
ক্ষমতার অধিকারী হতে হবে। এ রকম একজন সত্তার অস্তিত্ব মেনে নেয়া ছাড়া সকল বিজ্ঞান ও দর্শন সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এক সময়
‘
জানি না
’
বলে মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। আর
‘
জানি না
’
বলার পরে সংশ্লিষ্ট তত্ত্বের গোটাটাই ধ্বসে পড়তে বাধ্য।
অন্যদিকে যারা বলে ,‘
এমনিতেই ছিলো’
বা‘
এমনিই হয়েছিলো’
তারা তাদের না-জানার কথা স্বীকার করার মতো সৎ সাহসও রাখে না এবং স্বীয় অজ্ঞতাকে অস্বীকার করতে গিয়ে প্রকারান্তরে কারণ ও ফলাফল বিধির দাবীকেও অস্বীকার করছে।
যা-ই হোক , সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের বিষয়টি একটি স্বতঃপ্রমাণিত বিষয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে , তিনি কীভাবে এ বিশ্বলোক ও তার অন্তর্ভুক্ত সব কিছু সৃষ্টি করেছেন ? প্রতিটি বস্তু ও প্রাণীপ্রজাতিকে স্বতন্ত্রভাবে সৃষ্টি করেছেন , নাকি বিবর্তনপ্রক্রিয়ায় ?
বলা বাহুল্য যে
,
সৃষ্টিকর্তা চাইলে প্রতিটি সৃষ্টিকে স্বতন্ত্রভাবে সৃষ্টি করতে পারেন
,
আবার চাইলে কারণ ও ফলাফল বিধিকে এমনভাবে বিন্যস্ত করে দিতে পারেন যাতে বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় যথাসময়ে একেকটি বস্তু ও প্রজাতির আবির্ভাব ঘটবে। এ ব্যাপারে তিনি পুরোপুরি স্বাধীন এবং ঊভয় অবস্থায়ই সমগ্র সৃষ্টি তাঁর মুখাপেক্ষী। তিনি এ দু
’
টি প্রক্রিয়ার কোনটি অবলম্বন করেছেন তা আমরা প্রত্যক্ষ ও পর্যবেক্ষণ করতে পারি নি
,
কারণ তা সৃদূর অতীতের এমন এক সময়ের ব্যাপার যে সময়ের কোনো অকাট্য দলীল
( Document)বা সাক্ষ্য
( Evidence)থাকা সম্ভব নয়।
সৃষ্টিলোকের নিদর্শনাদির পরীক্ষামূলক বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মাধ্যমেও এ ব্যাপারে অকাট্য ধারণায় উপনীত হওয়া সম্ভব নয় , কারণ পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান এখনো ততোখানি অগ্রগতি হাসিল করতে পারে নি ; হয়তো ভবিষ্যতে কখনো হবে।
তবে পর্যবেক্ষণ থেকে অকাট্যভাবে এ ধারণায় উপনীত হওয়া যায় যে , প্রাণহীন বস্তুর প্রাকৃতিক পরিবর্তনসমূহ একটি পূর্বনির্ধারিত সুদীর্ঘকালীন যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তথা বিবর্তনপ্রক্রিয়ায় সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু প্রাণীপ্রজাতিসমূহের উদ্ভব যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হওয়ার সম্ভাবনা পর্যবেক্ষণ ও যৌক্তিক উপসংহার কোনোটাতেই প্রমাণিত হয় না।
আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা এমন কোন যান্ত্রিক প্রাকৃতিক বিধির সন্ধান পান নি যার ফলে কোনো প্রাণশীলের হস্তক্ষেপ ছাড়াই নিষ্প্রাণ পদার্থ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রাণের বা প্রাণশীল কোনকিছু (এমনকি তা এক কোষ বিশিষ্ট অণুজীব হলেও) অস্তিত্বলাভ করতে পারে।
প্রকৃত পক্ষে বস্তুজগতে প্রাণের প্রথম বিকাশ এক মহাবিস্ময়। অন্যদিকে বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যকার পার্থক্যগুলোও এমন যে , কারো হস্তক্ষেপ ছাড়া কেবল পরিবেশগত পরিবর্তনের কারণেই এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির উদ্ভব ঘটা সম্ভব নয়। কারণ , বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যকার পার্থক্য কেবল বাহ্যিক বা শারীরিক পার্থক্যই নয় , বরং অভ্যন্তরীণ পার্থক্যও বটে । অবশ্য একই প্রজাতির বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার মধ্যে (যাদের ক্রোমোজম্-সংখ্যা অভিন্ন ও জেনেটিক বৈশিষ্ট্য প্রায়-অভিন্ন) পরিবেশগত পরিবর্তনের কারণে (অভ্যাস পরিবর্তনও যার ওপর নির্ভরশীল) বাহ্যিক পার্থক্য গড়ে উঠতে পারে। কিন্তু দু’
টি নিকটতর প্রজাতির মধ্যে ক্রোমোজমের পার্থক্য ও জেনেটিক গঠনের উল্লেখযোগ্য পার্থক্য পরিবেশগত পরিবর্তনের কারণে গড়ে উঠতে পারে না। এ ধরনের পরিবর্তনের দাবীদার ডারউইন বা তাঁর উত্তরসুরিরা তাঁদের এ সংক্রান্ত দাবীর সপক্ষে কোনো অকাট্য প্রমাণ (পরীক্ষণীয় বা পর্যবেক্ষণীয়) পেশ করতে পারেন নি।
ডারউইন ও তাঁর উত্তরসুরিগণ প্রজাতিবৈচিত্র্যের যে বিবর্তনবাদী ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাতে তাঁরা বিভিন্ন স্তরের যে সব দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন কয়েকটি কারণে তা থেকে তাঁদের দাবী প্রমাণিত হয় না। প্রথমতঃ বিবর্তন তত্ত্বের দাবী অনুযায়ী বিদ্যমান দু’
টি নিকটতর প্রজাতির মাঝামাঝি আরো বহু প্রজাতির অস্তিত্ব থাকা অপরিহার্য যাদের প্রতি দু’
টির মধ্যে খুব সামান্য পার্থক্য থাকবে। কিন্তু বাস্তবে তা নেই।
যে কোনো নিকটতর দুই প্রজাতির মধ্যে পার্থক্য এতোই বেশী যে
,
এক প্রজাতি থেকে অপর প্রজাতিতে উত্তরণ বিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্যশীল সর্পগতিতে সম্ভব নয়
,
বরং কেবল ভেকগতিতে সম্ভব। আর বলা বাহুল্য যে
,
ভেকগতি বিবর্তন
( Evolution)প্রমাণ করে না
,
বরং
‘
পরিবর্তন ঘটানো
’
(Revolution)প্রমাণ করে। অর্থাৎ কোনো সজ্ঞান শক্তির হস্তক্ষেপের ফলেই এরূপ পরিবর্তন সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ
,
মানুষ ও তার নিকটতম প্রজাতি শিম্পাঞ্জী বা ওরাংওটাং
-
এর মধ্যকার পার্থক্যের কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।
মানুষ ও শিম্পাঞ্জী বা ওরাংওটাং-এর মধ্যে শুধু দৈহিক আকৃতি ও বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্যই বিরাট নয় , বরং তাদের অভ্যন্তরীণ বস্তুগত পার্থক্য আরো বেশী। কারণ , তাদের ক্রোমোজমের সংখ্যা এক নয় এবং তাদের জেনেটিক বৈশিষ্ট্যে পার্থক্য বিস্ময়কররূপে বেশী। বানর থেকে মানুষে উত্তরণের দাবীর সপক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে কেউ কেউ সাম্প্রতিক যে আবিষ্কারকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করার চেষ্টা করেছেন তা হচ্ছে , মানুষ ও শিম্পাঞ্জীর ডিএনএ-র মধ্যে 95 শতাংশ মিল রয়েছে। তাঁরা অবশিষ্ট 5 শতাংশ অমিলকে গুরুত্ব দিতে চান নি। অথচ এই পাঁচ শতাংশ পার্থক্য হচ্ছে এমন মৌলিক পার্থক্য যার বদৌলতে মানুষ সমগ্র প্রজাতিকুলের ওপর আধিপত্য করছে।
একজন মানুষের মস্তিষ্কের একেকটি স্মৃতিকোষের ক্ষমতা একেকটি সুপার কম্পিউটারের সমান , আর একজন মানুষের মস্তিষ্কের স্মৃতিকোষের সংখ্যা 100 কোটি। এর সাথে একটি শিম্পাঞ্জীর স্মৃতিকোষের ক্ষমতা ও সংখ্যার তুলনা করুন।
দ্বিতীয়তঃ শিম্পাঞ্জী থেকে বিবর্তনপ্রক্রিয়ায় মানুষে উত্তরণের ধারণা মেনে নিলে এ দুই প্রজাতির মধ্যবর্তী আরো শত শত প্রজাতির অস্তিত্ব থাকা অপরিহার্য। কিন্তু বাস্তবে তা নেই। এমনকি ফসিল থেকে যে সব নিদর্শন পাওয়া গেছে তার সাহায্যে কোনোভাবেই এ‘
বিবর্তন-চেইন’
তৈরী করা সম্ভব নয়। মধ্যবর্তী প্রজাতিগুলো পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যাবার দাবীও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ , শিম্পাঞ্জী টিকে থাকবে , কিন্তু তা থেকে উদ্ভূত উন্নততর অসংখ্য প্রজাতির সবগুলোই পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যাবে , আবার এ ধারাক্রমে ঊদ্ভূত সর্বশেষ প্রজাতি মানুষ পুরোপুরি টিকে থাকবে - এরূপ দাবী একেবারেই অযৌক্তিক। বিবর্তন তত্ত্ব সঠিক হলে মানুষ ও শিম্পাঞ্জীর মধ্যবর্তী প্রজাতিসমূহের অন্ততঃ কতগুলোর কিছু শাখা-প্রশাখা টিকে থাকতো।
যদিও এমন কোনো কোনো প্রাণীর পূর্ণাঙ্গ বা অপূর্ণাঙ্গ ফসিল পাওয়া গেছে যেগুলোকে শিম্পাঞ্জীর চেয়ে উন্নততর এবং বর্তমান মানুষের চেয়ে নিম্নতর মধ্যবর্তী প্রজাতির বলে দাবী করা হয়েছে , তবে তা বর্তমান মানুষের পূর্বপুরুষ না হয়ে মানুষের সাথে সম্পর্করহিত কোনো স্বতন্ত্র প্রজাতিও হতে পারে যা কোনো না কোনো কারণে কালের প্রবাহে হারিয়ে গিয়ে থাকবে। এমনকি এ ধরনের ফসিল বর্তমান মানুষেরই সমপ্রজাতির কোনো শারিরীক ত্রুটিপূর্ণ সদস্যেরও হতে পারে এবং আমাদের থেকে তার পার্থক্য বর্তমান মানব প্রজাতির মধ্যকার ত্রুটিহীন উন্নততর ও ত্রুটিপূর্ণ নিম্নতর ব্যক্তির মধ্যকার পার্থক্যের সমতুল্য হতে পারে যাকে পর্যবেক্ষণক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে স্বতন্ত্র প্রজাতি মনে করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে , এ ধরনের ফসিলের সংখ্যা খুবই কম , একটি প্রজাতির অস্তিত্ব সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য যা মোটেই যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে উন্নততর বুদ্ধিসম্পন্ন কোনো প্রজাতির (যেমন: বানর ও মানুষ) ক্ষেত্রে খাদ্যাভাবে পুরো প্রজাতিরই ধ্বংস হয়ে যাওয়া অকল্পনীয় , কারণ , তাদের খাদ্যতালিকা অনেক প্রশস্ত। এরূপ প্রজাতির পুরোটা ধংস হয়ে যাওয়া কেবল ব্যাপক বিস্তৃত ভূমিকম্পে চাপাপড়ার মতো দুর্ঘটনার ফলেই সম্ভব। আর সে ক্ষেত্রে বিপুল সংখ্যক ফসিল-নিদর্শন প্রাপ্তিই স্বাভাবিক। এমনকি প্রাপ্ত ফসিলকে যদি শিম্পাঞ্জীর উত্তর পুরুষ ও মানুষের পূর্বপুরুষ কোনো মধ্যবর্তী প্রজাতির বলে ধরেও নেই তথাপি প্রশ্ন থেকে যায় যে , এর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অসংখ্য প্রজাতির কোনো নিদর্শনই থাকবে না এটা কেমন কথা ?
বিষয়টি অন্য এক দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখা যেতে পারে। তা হচ্ছে , বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যকার গুণগত বৈশিষ্ট্যের পার্থক্যের দিকে গভীরভাবে দৃষ্টি দিলে বহু বিস্ময়কর বিষয় ধরা পড়ে। তবে লক্ষ্য করা যায় যে , মানুষ ও অন্যান্য প্রজাতির মধ্যকার গুণগত পার্থক্য সর্বোচ্চ বিস্ময়কর মাত্রায় অবস্থান করছে ।
মানুষ ও অন্যান্য প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হচ্ছে এই যে
,
অন্যান্য প্রজাতি প্রধানতঃ সহজাত প্রবণতা দ্বারা পরিচালিত হয় এবং মানুষের নিকটতর প্রজাতিসমূহেরও বুদ্ধিমত্তার
( Intellect)পরিমাণ মানুষের তুলনায় খুবই কম। অন্যদিকে মানুষের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে তার বুদ্ধিবৃত্তিকতা এবং তার মধ্যে নিহিত সম্ভাবনা
(
বা প্রতিভা
)
যা থে
কে অন্যান্য প্রজাতি বঞ্চিত।
আবার অনেক ক্ষেত্রে কাছাকাছি প্রজাতিসমূহের মধ্যেও সহজাত প্রবণতায় বিস্ময়কর পার্থক্য বিদ্যমান। উদাহরণস্বরূপ , মৌমাছি যেভাবে মৌচাক তৈরী ও মধু উৎপাদন করে কাছাকাছি প্রজাতি হওয়া সত্ত্বেও বোলতা বা ভ্রমর তা পারে না বা দেখেও তাদের মধ্যে তা শেখার প্রবণতা তৈরী হয় না। অনুরূপভাবে চড়ুই পাখী ও বাবুই পাখী বাহ্যতঃ খুবই কাছাকাছি হলেও চড়ুইর মনে কখনো বাবুইর মতো শিল্পসমৃদ্ধ বাসা তৈরীর আগ্রহ জাগে না যদিও প্রকৃতিতে এর উপাদানের কোনোই অভাব নেই।
ডারউইন-তত্ত্বে পরিবেশগত পরিবর্তন ও তার অনিবার্য দাবী হিসেবে প্রয়োজনের তাগিদে অভ্যাস পরিবর্তনকে প্রজাতিসমূহের বিবর্তনের সর্বপ্রধান কারণ বলে দাবী করা হয়েছে। কিন্তু উদ্ভিদ জগতের বৈচিত্র্যকে এর আলোকে ব্যাখ্যা করা মোটেই সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ , ট্রাভের্লাস্ ট্রি-র পাতাগুলো কলাগাছের পাতার ন্যায় গাছটির চারদিকে বিস্তৃত না হয়ে দুই দিকে সুবিন্যস্ত হয়ে এক অনুপম সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। কোন্ প্রয়োজন এবং কোন্ অভ্যাস তাকে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে ? বরং এর একটাই ব্যাখ্যা হতে পারে , তা হচ্ছে , কোনো সৌন্দর্যবোধসম্পন্ন মহাশিল্পী স্রষ্টা সৌন্দর্য সৃষ্টির লক্ষ্যেই তাকে এভাবে সৃষ্টি করেছেন।
এক ধরনের ফুল আছে যার বিকশিত অবস্থা দেখে মনে হয় , একটি ফুলের ওপর একটি কালো প্রজাপতি বসে আছে। এটা কীভাবে সম্ভব হলো ? ফুল নিজেই কি নিজের প্রয়োজনে এমন রূপ ধারণ করেছে ? তাহলে তো তাকে মানুষ-বিজ্ঞানীদের চেয়েও বড় এক মহাবিজ্ঞানী শিল্পী বলতে হবে। নাকি কোনো মহাবিজ্ঞানী শিল্পী ইচ্ছাকৃতভাবেই সৌন্দর্য সৃষ্টির লক্ষ্যেই তাকে এমন করেই সৃষ্টি করেছেন ?
উদ্ভিদজগতের অসংখ্য প্রজাতির বীচি থেকে চারা গজায় এবং প্রাথমিক অবস্থায় বীচির শাস তার নতুন চারার খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু কোনো কোনো প্রজাতির উদ্ভিদের বীচির ওপরে কেবল একটা খোসা থাকে এবং কোনো কোনো প্রজাতির উদ্ভিদে ফল হয় ও ফলের মধ্যে বীচি হয়। ঐ ফল উদ্ভিদটির বা তার চারার কোনো কাজেই লাগে না। তবে কি কোনো স্রষ্টা পশু-পাখী ও মানুষের খাদ্য হিসেবেই ঐসব ফল সৃষ্টি করেছেন ?
তেমনি ওষধি উদ্ভিদসমূহে মানুষের (এবং অংশতঃ পশুপাখীর) রোগব্যাধি ও দুর্ঘটনাজনিত ক্ষত ও ব্যথা-বেদনার চিকিৎসার উপাদান নিহিত রয়েছে যা সংশ্লিষ্ট উদ্ভিদের নিজের কোনো কাজেই লাগে না। কোনো মহাবিজ্ঞানী স্রষ্টা কি মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর চিকিৎসার জন্যই এগুলো সৃষ্টি করেছেন ?
শুধু উদ্ভিদজগত কেন , প্রাণীজগতেও অনুরূপ দৃষ্টান্তের অভাব নেই। ময়ূরের লেজে যে সুদীর্ঘ মনোহারী পালক আছে তা তার নিজের কোন্ কাজে লাগে ? বিশেষ করে পুরুষ ময়ূর যে পেখম মেলে নাচে তা কি কেবল স্ত্রী ময়ূরকে আকৃষ্ট করার জন্যে ? যে সব প্রজাতির পাখীর ময়ূরের ন্যায় সুদীর্ঘ মনোহারী পালক নেই সে সব প্রজাতির স্ত্রী পাখীরা কি পুরুষ পাখীদের প্রতি আকৃষ্ট হয় না ? তাহলে ময়ূরের সুদীর্ঘ মনোহারী পালক গজানো , বিশেষতঃ পুরুষ ময়ূরের মধ্যে পেখম মেলে নাচার সহজাত প্রবণতার পিছনে কি কোনো মহাবিজ্ঞানী মহাশিল্পীর পরিকল্পনা রয়েছে - যার অন্যতম , বরং প্রধান , উদ্দেশ্য হচ্ছে এক অনুপম সৌন্দর্য সৃষ্টি এবং সে সৌন্দর্য দ্বারা অন্য কোনো প্রজাতিকে , ধরুন মানুষকে , আনন্দদান করা ?
পুরুষ সিংহের কেশরের পিছনেও কি অনুরূপ উদ্দেশ্য নিহিত ?
যে ছোট্ট মাছটির লেজ ও পাখনা তার শরীরের প্রায় সমান আয়তনের যা দেখতে মসৃণ রেশমী কাপড়ের মতো - যে জন্য তাকে হাত বুলিয়ে আদর করতে ইচ্ছা করে , তা কি এ জন্য যে , মানুষ তাকে সযত্নে অ্যাকুরিয়ামে রেখে লালন-পালন করবে এবং তার সৌন্দর্য দেখে নয়ন পরিতৃপ্ত করবে ?
অনেক মানুষ যেখানে ডলফিন হত্যা করে ভক্ষণ করে তা সত্ত্বেও ডলফিন কেন মানুষকে এতো পসন্দ করে এবং তার সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করে ? তার কোন্ প্রয়োজন পূরণের জন্যে তার মধ্যে এ সহজাত প্রবণতা গড়ে উঠেছে ?
পাখীর পাখা কি তার প্রয়োজনের কারণেই গজিয়েছে ? মানুষেরও তো পাখার প্রয়োজন ছিল ; অন্ততঃ বিমান তৈরীর পূর্ব পর্যন্ত। মানবপ্রজাতির অস্তিত্বের ইতিহাসে সম্ভবতঃ এমন কোনো যুগই ছিলো না যখন মানুষ পাখার অভাব বোধ করে নি এবং পাখা কামনা করে নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও লক্ষ লক্ষ বছরেও কেন তার পাখা গজালো না ? সে কি এ কারণে যে , তার সৃষ্টিকর্তা জানতেন যে , তার পাখা থাকলে সে পাখা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবে ; স্পেসশিপ্ তো দূরের কথা , কোনোদিনই বিমান তৈরী করতে পারবে না ?
মোদ্দা কথা , অনস্বীকার্য যে , প্রজাতিসমূহের উদ্ভব কোনো স্রষ্টা ছাড়া নিজে নিজে হয় নি। অবশ্য সৃষ্টিকর্তা চাইলে এমন একটি প্রোগ্রামের মাধ্যমে সৃষ্টির সূচনা করতে পারতেন যার ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিবর্তন-প্রক্রিয়ায় প্রজাতিসমূহ সৃষ্টি হতো। কিন্তু তাহলে একবার সৃষ্টির সূচনা করে দেয়ার পর আর তাঁর কোনো কিছু করণীয় থাকতো না। কিন্তু সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারী স্রষ্টা সদাই নিত্য নতুন সৃষ্টিকে অস্তিত্বদান করতে থাকবেন এটাই স্বাভাবিক ; বিচারবুদ্ধির দাবীও এটাই।
তাছাড়া পর্যবেক্ষণ প্রমাণ করে যে , প্রজাতিসমূহের উদ্ভব সর্প-গতিতে বা ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে ঘটে নি , বরং ভেকগতিতে ঘটেছে। সে ক্ষেত্রে দু’
টি প্রক্রিয়ায় তা হতে পারে: কোনো প্রজাতির কতক সদস্যের ওপর জেনেটিক অপারেশন চালিয়ে , অথবা প্রাথমিক বা মৌলিক উপাদান দিয়ে পুরোপুরি নতুনভাবে সৃষ্টি। এর কোনো প্রক্রিয়াই সৃষ্টিকর্তার জন্য অমর্যাদাকর নয়। বিজ্ঞানের পক্ষে এখনো নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় যে , এ দু’
টি প্রক্রিয়ার মধ্যে কোনটি অবলম্বন করা হয়েছিলো। তবে ধর্মীয় সূত্রের বর্ণনা অনুযায়ী , অন্ততঃ মানুষকে মৌলিক উপাদান দ্বারা সরাসরি সৃষ্টি করা হয়েছে।
(সাপ্তাহিক রোববার , ঢাকা: 12ই নভেম্বর 2006 সংখ্যায় প্রকাশিত)