বিশ্বলোকে স্রষ্টার অস্তিত্বের নিদর্শন
এ বিশ্বলোকের উৎস যে এক অবস্তুগত অপরিহার্য সত্তা , এটা মানবিক বিচারবুদ্ধির অকাট্য রায়। বিচারবুদ্ধি বিভিন্ন পন্থায় এ সত্যে উপনীত হয়। অবশ্য এর মধ্যে কতক পন্থা কিছুটা জটিল এবং উচ্চতর বুদ্ধিবৃত্তিকতার সাথে জড়িত , আবার কতক পন্থা খুবই সহজ-সরল। তবে সহজ-সরল মানেই গুরুত্বহীন নয়। কারণ , অনেক সময় যা সহজলভ্য তার গুরুত্ব দুর্লভের তুলনায়ও বেশী হয়ে থাকে। যেমন: খাদ্যের তুলনায় পানি সহজলভ্য , কিন্তু প্রাণ বাঁচাতে তার গুরুত্ব খাদ্যের চেয়ে বেশী। তেমনি পানির তুলনায় বায়ু অধিকতর সহজলভ্য , কিন্তু বেঁচে থাকার জন্যে তার গুরুত্ব পানির তুলনায় বহু গুণে বেশী।
অনুরূপভাবে বিচারবুদ্ধি যে সব সহজ-সরল পন্থায় জীবন ও জগতের উৎসের সন্ধান দেয় তা সুস্থ ও নিষ্কলুষ বিচারবুদ্ধির অধিকারী সরলমনা মানুষের নিকট সহজে গ্রহণযোগ্য হলেও যাদের বিচারবুদ্ধির ওপর ভ্রান্ত জ্ঞানের পর্দা পড়েছে সেই পাণ্ডিত্যাভিমানী নাস্তিকরা তাতে সন্তুষ্ট হতে পারে না। কারণ , তাদের দৃষ্টিতে যা অত্যন্ত জটিল প্রশ্ন , তার সহজ জবাব তথা জটিল সমস্যার সহজ সমাধান তাদের মনে খুঁতখুঁতে ভাব সৃষ্টি করে। কিন্তু বিচারবুদ্ধির সহজ জবাব নিয়ে খানিকক্ষণ চিন্তা করলেই এ জবাবের সহজতায় মনের মধ্যে খুঁতখুঁতে ভাব সৃষ্টির পরিবর্তে এহেন সহজ জবাবটি ইতিপূর্বে দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ায় বিস্মিত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।
নাস্তিকরা জীবন ও জগতের মূলে নিহিত রহস্য উদ্ঘাটনে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। জীবন ও জগতের উৎস সম্পর্কে তারা যা কিছু এ পর্যন্ত দাবী করেছে তা না তাদের অভিজ্ঞতার ফসল , না তা তাদের গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফসল। তা সত্ত্বেও তারা অত্যন্ত হাস্যস্করভাবে তাদের এতদসংক্রান্ত কাল্পনিক ধারণাকে‘
বৈজ্ঞানিক ধারণা’
বলে দাবী করেছে। অথচ পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা - এ দু’
য়ের বাইরে প্রাপ্ত কোনো তথ্য বা প্রদত্ত কোন বক্তব্য বস্তুবিজ্ঞানের আওতায় আসে না এবং‘
বিজ্ঞান’
পরিভাষাটি যখন‘
বস্তুবিজ্ঞান’
অর্থে ব্যবহৃত হয় (যদিও আমাদের দৃষ্টিতে তা ভুল ব্যবহার) তখন এরূপ কোনো ধারণা‘
বৈজ্ঞানিক ধারণা’
হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না।
এর চেয়েও বিড়ম্বনাকর বিষয় হলো , তারা তাদের নাস্তিকতার যথার্থতা প্রমাণ করতে গিয়ে গতকাল যে কাল্পনিক দাবী পেশ করেছে , আজ তার কাল্পনিকতা ধরা পড়ে যাওয়ায় তারা তা বাতিল করে দিয়ে নতুন কাল্পনিক দাবী পেশ করছে এবং সন্দেহ নেই যে , আগামী কাল তাদের আজকের দাবীর ভ্রান্তি ধরা পড়ে যাবার পর তারা নতুন অন্য কোনো কাল্পনিক দাবী পেশ করবে।
আসলে নাস্তিকরা তাদের নাস্তিকতার প্রশ্নে অন্ধবিশ্বাসী বা কুসংস্কারাচ্ছন্ন। তাই তারা যে কোনো মূল্যে তাদের নাস্তিকতার দাবীকে প্রমাণিত বলে দেখানোর জন্যে যে কোন ধরনের গোঁজামিলের আশ্রয় নিতে দ্বিধাবোধ করে না। তাই একবার তাদের দাবী: বিশ্বলোকের আদি উৎস‘
স্রেফ বস্তু’
; বস্তুর সৃষ্টিও নেই , ধ্বংসও নেই ; আদিতে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবিহীন এ‘
স্রেফ বস্তু’
তে আলোড়ন বা বিস্ফোরণ সৃষ্টি এবং তার ফলে উদ্ভূত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পরিণতিতে লক্ষ-কোটি বছরের ব্যবধানে বিশ্বলোক রূপ পরিগ্রহ করেছে ও বর্তমান অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু তাদেরকে যখন প্রশ্ন করা হয় যে
,
তোমাদেরই দাবী অনুযায়ী এ বস্তুজগত যখন
‘
কারণ ও ফলাফল
’
(cause and effect)বিধির অধীন
(
এবং আসলেও তা
-
ই
)
,
তখন আদি কালের সেই ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়াহীন নিথর
‘
স্রেফ বস্তু
’
কোন্ কারণে এবং কোন্ উৎস থেকে কীভাবে উৎসারিত হয়েছিলো
?
তখন তারা এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারে নি। তেমনি তারা এ প্রশ্নেরও জবাব দিতে পারে নি যে
,
আদি কালের সেই ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়াহীন নিথর
‘
স্রেফ বস্তু
’
তে কোন্ কারণে প্রথম বারের মতো আলোড়ন সৃষ্টি বা বিস্ফোরণ সংঘটিত হলো
?
কথিত এ আলোড়ন কে সৃষ্টি করলো বা এ বিস্ফোরণ কে ঘটালো
?
কোন্ নিয়ম বা বিধির অধীনে কথিত এ আলোড়ন বা বিস্ফোরণ সংঘটিত হলো
?
আর কে সেই কথিত আলোড়ন বা বিস্ফোরণের বিধি ও তার পরবর্তীতে কার্যকর প্রাকৃতিক বিধিবিধান প্রণয়ণ করলো যার পরিণতিতে এ অত্যন্ত জটিল ও বিস্ময়কর বিশ্বজগত রূপলাভ করলো
?
পরবর্তীকালে বস্তুর বাইরে সর্বত্র বস্তুবহির্ভূত অস্তিত্বসমূহ
,
বিশেষ করে শক্তির মহাসমারোহের সন্ধান পাবার পর নাস্তিক বিজ্ঞানীরা সৃষ্টির উৎস ও সূচনা সংক্রান্ত তাদের নাস্তিক্যবাদী তত্ত্বকে পরিবর্তিত রূপে উপস্থাপন করে। এখন আর তারা সৃষ্টিপ্রক্রিয়া শুরুর পূর্বে সর্বত্র নিথর
-
নিশ্চল ক্রিয়াপ্রতিক্
রিয়াহীন সীমাহীন
‘
স্রেফ বস্তু
’
র অস্তিত্ব ছিলো বলে দাবী করে না
,
বরং সীমাহীন সম্ভাবনাযুক্ত
‘
আদি বস্তুকণিকা
’
র
( primary particle)কথা বলে এবং বিগ্ ব্যাং বা এক মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে সৃষ্টির সূচনা হয়েছে বলে দাবী করে থাকে।
অবশ্য বিগ্ ব্যাং তত্ত্ব খণ্ডন করা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব প্রমাণের জন্যে অপরিহার্য নয়। কারণ , সৃষ্টিকর্তা যদি একটি আদি বস্তুকণা বা একটি আদি পরমাণুর মাধ্যমে গোটা সৃষ্টিলোককে পর্যায়ক্রমে অস্তিত্ব দান করে থাকেন এবং বিগ্ ব্যাং-এর মাধ্যমে সে সৃষ্টিকর্মের সূচনা করে থাকেন তো তাতে সমস্যা কোথায় ? যে সৃষ্টিকর্তা সীমাহীন জ্ঞান ও শক্তি-ক্ষমতার অধিকারী - যে কারণে তিনি কোনো উপায়-উপাদান ছাড়াই সৃষ্টি করতে সক্ষম , বরং উপায়-উপাদানেরই স্রষ্টা ; যিনি সৃষ্টিকর্ম সম্পাদনের জন্যে কোনোরূপ নিয়ম বা বিধির অনুসরণে বাধ্য নন , বরং স্বয়ং নিয়ম ও বিধির স্রষ্টা , তিনি তো যেমন খুশী ও যেভাবে খুশী সৃষ্টি করবেন। তাঁর সম্বন্ধে তো বলা চলে না যে , তিনি প্রতিটি বস্তু ও প্রজাতিকে আলাদা আলাদাভাবে সৃষ্টি করতে বাধ্য , অতএব , বিগ্ ব্যাং-এর মাধ্যমে‘
আদি বস্তুকণিকা’
থেকে বিশ্বলোক সৃষ্টি হয়ে থাকলে প্রমাণিত হবে যে , কোনো সৃষ্টিকর্তা ছাড়াই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি হয়েছে।
কিন্তু পরিহাসের বিষয় এই যে
,
বিজ্ঞানমনস্ক হবার দাবীদার নাস্তিক্যবাদীরা তাদের নাস্তিক্যবাদে অন্ধ বিশ্বাসী বিধায় তারা কথিত এ
‘
আদি বস্তুকণিকা ও বিগ্ ব্যাং
’
-
এর তত্ত্বকে স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকৃতির অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করছে। তাই অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গতভাবেই তাদেরকে প্রশ্ন করা যেতে পারে যে
,
কথিত এ আদি বস্তুকণিকার উৎস কী
?
তাদের কাছে এ প্রশ্নের কোনো সন্তোষজনক জবাব নেই। তারা বলে
:
“
এটি ছিলো।
”
প্রশ্ন হচ্ছে
:
এটি কোত্থেকে এলো যে
,
বলবো
,
“
ছিলো
”
?
‘
বস্তু যখন
‘
কারণ ও ফলাফল
’
(cause and effect)বিধির অধীন তখন কথিত এ আদি বস্তুকণিকাকেও কোথাও থেকে বা কারো কাছ থেকে অস্তিত্ব লাভ করতে হবে।
কারণ
,
পরিবর্তনশীল বস্তুকণিকা আদিতে অপরিবর্তিতরূপে অস্তিত্বমান ছিলো
,
অস্তিত্ব
‘
লাভ করে নি
’
-
এটা পুরোপুরি অসম্ভব ব্যাপার। বরং পরিবর্তনশীলতার গতিধারার ও ধারাবাহিকতার দাবীই হচ্ছে এই যে
,
যেহেতু সে পরিবর্তনশীল অস্তিত্ব সেহেতু সে ছিল না
,
বরং অস্তিত্ব লাভ করেছে অর্থাৎ তাকে কেউ অস্তিত্বদান করেছে এবং অস্তিত্ব লাভের পর মুহূর্ত থেকেই সে পরিবর্তিত হয়ে চলেছে
,
অবশ্য সুনির্দিষ্ট নিয়ম
-
বিধির অধীনে
,
যে নিয়ম
-
বিধি সে নিজে সৃষ্টি করে নি।