71. নবী-রাসূল ও ইমামগণের কবর যিয়ারাত :
আমরা বিশ্বাস করি : হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) এর আহলে বাইতের ইমামগণের , বিজ্ঞ ওলামাদের ও খোদার পথে শহীদদের কবর যিয়ারত করা তাকিদকৃত মুস্তাহাব। আহলে সুন্নাতের ওলামাদের গ্রন্থাবলীতে রাসূল (সাঃ) এর কবর যিয়ারত সম্পর্কিত অসংখ্য হাদীস লিপিবদ্ধ আছে ; যেমনভাবে শিয়া ওলামাদের গ্রন্থাবলীতে ও এ সম্পর্কে হাদীস উল্লেখ রয়েছে। যদি এ সমস্ত হাদীসসমূহকে সংগ্রহ করে একত্রে একটি গ্রন্থ সংকলন করা হয় তাহলে বেশ বড় ও স্বতন্ত্র একটি গ্রন্থের আকার ধারণ করবে। (এ সমস্ত হাদীসসমূহ জানার জন্যে এবং এ পর্যায়ে বড় বড় ওলামাদের বক্তব্য ও তাদের অবস্থা সম্পর্কে অবগতির জন্য আল গাদীর গ্রন্থের যিয়ারত অধ্যায় পাঠ করুন , ( আল-গাদীর ,5ম খঃ ,পৃঃ 93-207)।
ইতিহাসের এ দীর্ঘ পাতায় ইসলামের ওলামাবৃন্দ , সর্বস্তরের ও সর্ব শ্রেণীর মানুষ এ কবর যিয়ারতের উপর গুরুত্ব প্রদান করে আসছেন। ইসলামী বই-পুস্তক ও গ্রন্থাবলীতে সে সমস্ত লোকদের হাল-অবস্থা বিস্তারিত ও বিশদভাবে লিখিত আছে-যাঁরা রাসূলে আকরাম (সাঃ) ও সমস্ত বিশেষ ব্যক্তিদের কবর যিয়ারতে গমনাগমন করতেন।
(এ হাদীসসমূহ সম্পর্কে এবং বড় বড় ওলামাগণের এ পর্যায়ে বক্তব্য ও তাঁদের নিজেদের অবস্থা যেয়ারত পর্যায়ে কি ছিল তা জানার জন্যে পূর্বোল্লেখিত উদ্ধৃতি গ্রন্থ দেখুন)।
মোট কথা বলা যেতে পারে যে , এ বিষয়টি মুসলমানদের সকল দল ও ফেরকার ঐকমত্য ও সর্ব সম্মত বিষয়।
স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার হচ্ছে , কারো পক্ষেই উচিৎ হবে না“
যিয়ারত”
কে ইবাদতের সাথে ভুল করে বসা। ইবাদত ও উপাসনা কেবলমাত্র খোদার জন্যেই নির্দিষ্ট। আর যিয়ারতের উদ্দেশ্য হচ্ছে মহান ব্যক্তিত্বগণের প্রতি সন্মান প্রদর্শন করা এবং মহান আল্লাহর দরবারে তাঁদের থেকে সুপারিশ প্রার্থনা করা। এমনকি বিভিন্ন হাদীসে দেখা যায় , স্বয়ং রাসূলে আকরাম (সাঃ) নিজেই মাঝে মাঝে জান্নাতুল বাকীতে যিয়ারত করতে যেতেন এবং কবরবাসীদের প্রতি সালাম ও দরুদ পাঠাতেন। এ হাদীসটি ছহীহ্ মুসলিম , আবু দাউদ , নাসাঈ , মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বল , ছহীহ্ তিরমিযি ও সুনানে বায়হাকী গ্রন্থে সমূহে দেখুন।
অতএব , কারোই পক্ষে উচিৎ নয় বা কারো অধিকারও নেই ফীকাহ্গত দৃষ্টিকোন থেকে এ কাজটি যে শারীয়াত সম্মত তাতে সন্দেহের অবকাশ প্রবেশ করানো।
72. শোকানুষ্ঠান পালন ও তার দর্শন :
আমরা বিশ্বাস করি : ইসলামের মহান শহীদদের জন্যে শোক-দুঃখ প্রকাশ করার বিষয়টি বিশেষতঃ কারবালার শহীদদের জন্যে শোক-দুঃখ প্রকাশের কারণ হচ্ছে তাঁদের স্মরণকে জিইয়ে রাখা এবং ইসলামকে রক্ষার জন্যে তাদের ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের সংস্কৃতিকে ধরে রাখা । এ উদ্দেশ্যে , বিভিন্ন সময়ে বিশেষভাবে আশুরার দিনগুলোতে (মুহাররামের প্রথম দশ দিন) যা হযরত হোসাইন ইবনে আলী (আঃ) এর শাহাদাতের সময়-কাল ছিল , শোকানুষ্ঠান পালন করি। তিনি সেই ইমাম হোসাইন-যিনি বেহেশতের যুবকদের সরদার। রাসূল (সাঃ) বলেন : অর্থাৎ‘
ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন বেহেশতের যুবকদের সরদার’
(ছহীহ্ তিরমিযিতে আবু সাঈদ খুদরী ও জনাব হোযাইফাহ্ থেকে বর্ণিত , 2য় খঃ ,পৃঃ নং306-307 ,ছহীহ্ ইবনে মাজাহ , ফাযায়েলে আছহাবে রাসূলিল্লাহ্ অধ্যায়ে ; মুস্তাদরাকুছ ছহীহহাইন , হুলইয়াতুল আওলিয়া , তারিখে বাগদাদ , আছাবিয়া ইবনে হাজার , কানযুল ওম্মাল , যাখায়েরুল উকবা এবং আরো বহু গ্রন্থাবলীতে হাদীসটি উল্লেখ রয়েছে)।
আমিরুল মু 'মিনীন হযরত আলী (আঃ) ও রাসূল কন্যা ফাতিমা যাহরার প্রাণ প্রিয় সন্তান। তাঁর জন্যে আমরা শোখ-দুঃখের অনুষ্ঠান পালন করি। এ সব অনুষ্ঠানে আমরা তাঁদের জীবন ইতিহাস ও তাঁদের বীরত্বের বিশ্লেষণ করি। আর তাঁদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে মানুষের সামনে তুলে ধরি এবং তাঁদের পাক-পবিত্র আত্মা সমূহের প্রতি দরূদ পাঠাই।
ইমাম হোসাইন ইবনে আলী (আঃ) 61 হিজরী সালের মুহাররাম মাসে সে লম্পট ইয়াযীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন-যে ছিল পাপ-পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত এক হীন প্রকৃতির লোক। ইসলাম সম্পর্কে না তার কোন ধারণা ছিল আর না সে ইসলামকে পছন্দ করত। দুঃখজনকভাবে এহেন এক চরিত্রহীন মদ্যপ ইসলামী খেলাফতের মুসনাদ দখল করে নেয়। যদিও ইমাম হোসাইন (আঃ) ও তাঁর সাথী-বন্ধুগণ ইরাকের কারবালা প্রান্তরে শহীদ হয়েছেন এবং তাঁর পরিবারের (রাসূল পরিবারের) নারীগণকে বন্দি করে বিভিন্ন শহরে শহরে ঘুরিয়েছে। কিন্তু তাঁদের শাহাদাতের রক্ত সে কালের মুসলমানদের মধ্যে আশ্চার্য উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল। এরপর থেকে একের পর এক উমাইয়্যাদের বিরুদ্ধে যে সব বিদ্রোহের দাবানল রলে উঠল এবং তাদের অন্যায়-অবিচারের প্রাসাদের দোর গোড়ায় মারাত্মক আঘাত হেনে গুঁড়িয়ে দিতে লাগল। পরিণতিতে তাদের অপবিত্র জীবন ইতিহাস কুঞ্চিত হতে লাগল। এর মধ্যে আকর্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে এ যে , আশুরার মর্মান্তিক ঘটনার পর যতগুলো বিদ্রোহ-বিল্পব উমাইয়্যা শাসকদের বিরুদ্ধে সংঘঠিত হয়েছে। তার শ্লোগান ছিল :‘
মুহাম্মাদের বংশধরের সন্তুষ্টির জন্যে এবং হোসাইনের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যে। এ শ্লোগান , এমনকি সৈরাচারী আব্বাসীদের শাসনকাল পর্যন্ত অব্যহত ছিল’
। (দেখুন :আবু মুসা খোরাসানী যিনি বনী উমাইয়্যাদের শাসন-ক্ষমতার জড় কেটে দিয়েছিলেন , তিনি সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে এ শ্লোগানটির সাহায্য নিয়েছেন (কামেল ইবনে আছীর 5ম খঃ , পৃঃ নং 372 ,) তাওয়্যাবীনদের বিদ্রোহ্ ও বিল্পব সংঘটিত হয়েছিল এ শ্লোগানের মাধ্যমে : (কামেল ইবনে আছীর 4র্থ খঃ , পৃঃ নং 175)।
জনাব মোখতার ইবনে আবি ওবায়দাহ্ ছাফাফীর বিল্পবেও এ শ্লোগানগুলোর সাহায্য নিয়েছিলেন। (কামেল ইবনে আছীর 4র্থ খঃ , 288)।
বনী-আব্বাসীদের বিরুদ্ধে“
জনাব হোসাইন ইবনে আলী ফাখ যে বিদ্রোহ্ করেছিলেন তাঁর আহ্বান ছিল :অর্থাৎ‘
তোমাদেরকে নবী বংশের সন্তুষ্টী অর্জনের জন্যে আহবান জানাচ্ছি’
(মাকাতেলুত-তালেবীন পৃঃ নং 299 , তারিখে তাবারী 8ম খঃ , পৃঃ নং 194)।
ইমাম হোসাইন (আঃ) এর রক্তে রঞ্ছিত বিল্পব আজকেও আমাদের শীয়া 'দের জন্যে এক মহান আদর্শ। যে কোন স্বৈরতন্ত্র উপনিবেসবাদ , নির্যাতন-নিপিড়ন ও জুলুম-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কর্মসূচী গ্রহণের অনুপ্রেরনার উৎস সৃষ্টি করেছে আমাদের মধ্যে এ শ্লোগানগুলো :‘
অপমান আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাক’
(আমরা অপমানের জীবন যাপন করতে চাই না)।
‘
প্রকৃত জীবন হচ্ছে ঈমান ও জিহাদ’
। যার সূচনা হয়েছে রক্তঝরা কারবালায়। আর সব সময় আমাদেরকে সাহায্য করে আসছে জালিম শাসকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে এবং শহীদদের সরদার ইমাম হোসাইন ও তাঁর সাথীদের অনুসরণ করে জালিম শাসকদের অন্যায়-অবিচারকে উৎখাত করে দিতে। (ইসলামী বিল্পবের আন্দোলন চলাকালে ইরানের সবর্ত্র আমরা এ শ্লোগানগুলোকে প্রত্যক্ষ করেছি)।
সংক্ষিপ্ত কথা হচ্ছে যে , ইসলামের মহান শহীদদের স্মৃতি বিশেষ করে কারবালার শহীদদের রক্তাক্ত স্মৃতি , ঈমান ও আকীদার পথে আত্মত্যাগ , সংগ্রাম , বীরত্ব সাহসীকতা ইত্যাদি সব সময় আমাদেরকে উজ্জীবিত করে রাখে এবং আমাদেরকে জালিমের সামনে মাথানত না করে উন্নত শিরে বেঁচে থাকার শিক্ষা দান করে। এ হচ্ছে শহীদদের স্মৃতি জীবিত করে ধরে রাখা এবং প্রতি বছর নতূন করে শোক-মাতমের অনুষ্ঠানাদি পালন করার দর্শন।
হয়তো বা কিছু সংখ্যক লোক আছে যারা জানে না যে , আমরা শোক অনুষ্ঠানসমূহে কি করি এবং এ ঘটনাকে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসাবে এভাবে চিন্তা করবে যে , ভুলে যাওয়ার ধুলাবালি এর উপর পড়ে গেছে। কিন্তু আমরা নিজেরা জানি , এ স্মৃতিসমূহকে জীবিত করে ধরে রাখার কারণে কী প্রতিফল অতিতে পাওয়া গেছে , বর্তমানে কী সুফল দিচ্ছে ও আগামীতে কী সুফল বয়ে আনবে।
অহুদের যুদ্ধের পর সাইয়্যেদুশ্শুহাদা হযরত হামযা (আঃ) এর উপর রাসূলে আকরাম (সাঃ) ও অন্যান্য মুসলমানদের শোক অনুষ্ঠান পালনের কথা সমস্ত প্রসিদ্ধ ইতিহাস গ্রন্থাবলীতে লিপিবদ্ধ আছে যে , রাসূলে আকরাম (সাঃ) এক আনছারের বাড়ীর কিনারা দিয়ে যাচ্ছিলেন , রোনাজারী ও শোকগাঁথার শব্দ শুনতে পেলেন , রাসূলের চক্ষুদ্বয় অশ্রুসিক্ত হল , তাঁর গন্ডদেশ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো। তিনি বললেন : কিন্তু আমার চাচা জনাব হামযাহর কোন শোকবহ ও শোকার্ত নেই। সা’
দ ইবনে মায়ায রাসূলের এ কথাটি শনুলেন এবং বনী আব্দুল আশহালের একটি গোত্রের নিকট গেলেন। সেখানকার নারীদেরকে বললেন : তোমরা রাসূলের চাচা হযরত হামযাহর বাড়ীতে যাও এবং সাইয়্যেদুশ্শুহাদা হযরত হামযার জন্য শোক মাতম করো। (কামেল ইবনে আছীর , 2য় খঃ , পৃঃ নং 163। সীরায়ে ইবনে হিশাম , 3য় খঃ , পৃঃ নং 104)।
এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে , এই কাজ ও এই অনুষ্ঠান শুধুমাত্র হযরত হামযার জন্যে নির্দিষ্ট ছিল না বরং এটা ছিল একটা গৃহিত কর্মসূচী-যা সমস্ত শহীদদের ক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে। আর তাঁদের শাহাদাতের স্মৃতিকে বতর্মান বংশধর ও ভবিষ্যৎ উত্তরসুরীদের জন্যে বজায় রাখতে হবে। এখন আমি 1417 হিজরী সালের মুহররামের দশ তারিখ বা আশুরার দিনের পরিস্থিতি সম্পর্কে কয়েকটি বাক্য লিখছি ; সত্যি সত্যি সমগ্র শিয়া জগতে এক বিরাট আবেগ উত্তেজনা ছেয়ে আছে। বালক-কিশোর , নব যুবক , যুবক , পৌড়-বৃদ্ধ সর্বস্তরের লোকেরা সকলেই কালো পোষাক পরিধান করে আছে , সকলেই ঐক্যবদ্ধভাবে ইমাম হোসাইন ও কারবালার অন্যান্য শহীদদের শোকপালন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছে। তাদের জীবন-যিন্দেগী ও চিন্তা-ভাবনার মধ্যে এমন এক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে যে , এ মূহুর্তে যদি তাদেরকে ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে লড়াই করার আহ্বান জানানো হয় তাহলে সাথে সাথেই অস্ত্র হাতে নিয়ে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়বে। যে কোন প্রকারের ত্যাগ ও কোরবানী দিতে বিন্দু মাত্র দ্বিধা করবেনা। মনে হয় যেন শাহাদতের রক্ত তাদের ধমনীতে ছুটাছুটি করছে। মনে হচ্ছে এ সময়ই ও এ মূহুর্তেই তাঁরা ইমাম হোসাইন ও তাঁর সাথীগণকে কারবালার ময়দানে ইসলামের পথে নিজেদেরকে উৎসর্গ করার জন্যে তাদেরই সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
বীরত্বগাথা যে সমস্ত কবিতা এ মহান অনুষ্ঠানে পাঠ করা হচ্ছে তা বিশ্ব সৌর শক্তি ও উপনিবেসবাদীদের উপর মারাত্মক আঘাত হানছে এবং জুলুম-নির্যাতনের সামনে আত্মসমর্পন না করার জন্যে আত্মবল সৃষ্টি করছে। আর অপমানের জীবনের চাইতে গর্ব ও বীরত্বের মৃত্যু অতি উত্তম বলে উৎসাহিত করছে।
আমরা বিশ্বাস করি : এ শোকানুষ্ঠানসমূহ একটা বিরাট আধ্যাত্মিক পুঁজি , যার হেফাজত করা দরকার এবং ইসলাম , ঈমান ও তাকওয়াকে জিইয়ে রাখার জন্যে এটা অত্যন্ত জরুরী।