7. নবীগণের মু 'জিযাহ্ আল্লাহর অনুমতিক্রমে :
আমরা বিশ্বাস করি : আসল ক্রিয়াগত একত্ববাদ এ বাস্তবতার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করে যে , নবী-রাসূলগণ কর্তৃক যে সমস্ত অসাধারণ ও অলৌকিক ঘটনাবলী -যা মু 'জিযাহ সংঘঠিত হত সেগুলো সবই ছিল মহান আল্লাহর অনুমতিক্রমে। যেমন আল কোরআনে ঈসা (আঃ) সম্পর্কে বলা হয়েছে :
)
وَتُبْرِئُ الْأَكْمَهَ وَالْأَبْرَصَ بِإِذْنِي وَإِذْ تُخْرِجُ الْمَوْتَى بِإِذْنِي(
“
আর তুমি আমারই অনুমতিক্রমে জন্মগত অন্ধ লোকদেরকে , দূরারোগ্য কুষ্ঠ রোগগ্রস্ত্য লোকদেরকে নিরাময় করে দিতে এবং আমারই আদেশে মৃতদেহকে জীবিত করতে। (সূরা : আল-মায়েদাহ্ , আয়াত নং 110)।
হযরত সুলাইমানের (আঃ) একজন মন্ত্রী সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন :
)
قَالَ الَّذِي عِنْدَهُ عِلْمٌ مِنَ الْكِتَابِ أَنَا آتِيكَ بِهِ قَبْلَ أَنْ يَرْتَدَّ إِلَيْكَ طَرْفُكَ فَلَمَّا رَآهُ مُسْتَقِرًّا عِنْدَهُ قَالَ هَذَا مِنْ فَضْلِ رَبِّي لِيَبْلُوَنِي أَأَشْكُرُ أَمْ أَكْفُرُ وَمَنْ شَكَرَ فَإِنَّمَا يَشْكُرُ لِنَفْسِهِ وَمَنْ كَفَرَ فَإِنَّ رَبِّي غَنِيٌّ كَرِيمٌ(
“
যার নিকট আসমানী গ্রন্থের জ্ঞান ছিল সে বলল : চোখের পলক দেয়ার পূর্বেই আমি তা (সাবা সম্রাজ্ঞীর বিলকিসের সিংহাসনটিকে) এনে আপনার সন্মুখে উপস্থিত করবো। অতঃপর (হযরত সুলাইমান (আঃ)) যখন তা নিজের চোখের পলকের সামনে দৃঢ়ভাবে স্থাপিত দেখতে পেলেন তখন বললেন : এটা আমার প্রভুরই অনুগ্রহ। (সূরা : আন-নামল আয়াত নং 40)
অতএব , দূরারোগ্য ও ব্যধিগ্রস্তদের নিরাময় করা , জন্মান্ধকে চক্ষু দান করা এবং মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করা , এ কাজগুলো হযরত ঈসা (আঃ) মহান আল্লাহরই অনুমতি ও আদেশক্রমে করেছিলেন ; যা আল-কোরআনে উল্লেখ হয়েছে তা একত্ববাদেরই প্রতিভু।
8. আল্লাহর ফেরেশতা :
আমরা বিশ্বাস করি : আল্লাহর ফেরেশ্তাদের অস্তিত্ব রয়েছে। এরা প্রত্যেকেই বিশেষ বিশেষ দায়িত্বে নিয়োজিত। কোন কোন ফেরেশ্তা নবী-রাসূলগণের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রত্যাদেশ বা ওহী পৌঁছানোর কাজে নিয়োজিত। (সূরা বাকারাহ আয়াত নং 97)
একদল ফেরেশ্তা মানুষের কাজ-কর্ম তথা আমল অনুশীলনের সংরক্ষণের কাজে নিয়োজিত। (সূরা : ইনফিতার আয়াত নং 10)
আরেকদল ফেরেশ্তা রূহ কবয করা তথা মৃত্যু সংঘটিত করার কাজে নিয়োজিত। (সূরা আরাফ আয়াত নং 37)
আরেকদল ফেরেশ্তা অবিচলভাবে মু’
মিনদের সাহায্য-সহযোগিতার কাজে নিয়োজিত। (সূরা : ফুচ্ছিলাত আয়াত নং 30)
অন্য একদল ফেরেশ্তা যুদ্ধের ময়দানে মু’
মিনদের সাহায্যের কাজে নিয়োজিত। (সূরা আহযাব আয়াত নং9)
আরেকদল ফেরেশতা খোদাদ্রোহী জাতিগুলোকে শায়েস্থা করার (শাস্তি দেয়ার) কাজে নিয়োজিত , (সূরা : হুদ আয়াত নং 77)।
এভাবে আরো অন্যান্য দলে বিভক্ত ফেরেশ্তারা এ পৃথিবীতে বিভিন্ন দায়িত্ব-কর্তব্যে লিপ্ত আছেন।
নিঃসন্দেহে এ সব দায়িত্ব-কর্তব্য যেমন আল্লাহর অনুমতি , আদেশ ও খোদায়ী শক্তির বলে প্রতিপালিত হয়ে আসছে তেমনি মূল ক্রিয়াগত একত্ববাদের সাথে কোন অসংগতি ও বিরোধ নেই। বরং আরো অধিক গুরুত্বের দাবীদার।
এখান থেকে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে , নবী-রাসূল , মা‘
সুম ও ফেরেশ্তাদের শাফাআ 'ত করার বিষয়টি যেহেতু আল্লাহর অনুমতিক্রমে সেহেতু তা একত্ববাদেরই নামান্তর । আল্লাহ্ বলেন : কোন সুপারিশকারীই নেই তাঁর অনুমতি ছাড়া , (সূরা : ইউনুস. আয়াত নং 3)। এ বিষয়ে আরও অধিক কথা-বার্তা এবং তাওয়াস্সুলের বিষয়ে নবুয়্যাতের অধ্যায়ে আলোচনা করব।
9. ইবাদত শুধু আল্লাহর জন্যেই নির্দিষ্ট :
আমরা বিশ্বাস করি : ইবাদত কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যেই নির্দিষ্ট। (যেমন ইবাদতগত একত্ববাদের আলোচনায় উল্লেখ করেছি)। অতএব , যে ব্যক্তি তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করল সে মুশরিক। সমস্ত নবী-রাসূলগণের দাওয়াত এরই মধ্যে কেন্দ্রীয়ভূত ছিল। আল্লাহ্ বলেন :অর্থাৎ কেবলমাত্র মহান আল্লাহরই ইবাদত করো , কেননা তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন মা’
বুদ নেই , (সূরাঃ আল-আরাফ , আয়াত নং 59 ,65 ,73 ,85)।
এটা এমন একটা বক্তব্য যে , কোরআন মজীদে বারবার নবী-রাসূলগণকে উদ্দেশ্য করে মহান আল্লাহ্ এ কথাটি বলেছেন। সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে যে , আমরা মুসলমানরা সব সময় নিজেদের নামাজের মধ্যে যখন সূরা : ফাতিহা তিলাওয়াত করি তখন এ ঘোষনাটি বারবার উচ্চারণ করি : আমরা শুধুমাত্র তোমারই ইবাদত করি আর কেবলমাত্র তোমারই নিকট চাই সাহায্য। এ কথা স্পষ্ট যে , নবী-রাসূল ও ফেরেশ্তাদের সুপারিশ আল্লাহর অনুমতি ও আদেশক্রমে হয় -যা কোরআনের আয়াতসমূহে এসেছে , এ বিশ্বাসের অর্থ ইবাদত নয়। অনুরূপভাবে“
তাওয়াসসুল" তথা নবী-রাসূলগণের সহায়তা চাওয়া। তাঁদের কাছে চাওয়ার হচ্ছে অর্থে যে , তাঁরা যেন মহান আল্লাহর পাকের দরবারে তাওয়াসসুলকারী ব্যক্তির সমস্যার সমাধান চান , এটা ইবাদত উপাসনা হিসাবেও গণ্য হবে না , আর এটা ক্রিয়াগত একত্ববাদ বা ইবাদতগত একত্ববাদের সাথেও কোন বিরোধ সৃষ্টি করবে না। এ বিষয়ের ব্যাখ্যা নবুয়্যাতের অধ্যায়ে আসবে।
10. আল্লাহর অস্তিত্বের প্রকৃত রহস্য সবার জন্য গোপন রয়েছে :
আমরা বিশ্বাস করি : মহান আল্লাহর শক্তির নিদর্শনাদি ও প্রভাব , সমগ্র সৃষ্টি জগতে ব্যাপকভাবে ছেয়ে থাকা সত্বেও তাঁর অস্তিতের প্রকৃত রহস্য কারো কাছেই স্পষ্ট নয়। কেউ তাঁর অস্তিত্বের গুরুরহস্য খুঁজে বের করতে সক্ষম নয়। কেননা , তাঁর অস্তিত্বের বিষয়টি সকল দিক থেকেই সীমিত ও সীমাবদ্ধ। এ কারণেই তাঁর অস্তিত্বের রহস্য আয়ত্তে আনা আমাদের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু আমরা সম্পূর্ণরূপে তারঁই আয়াত্তাধীন। আল্লাহ্ বলেন :
“
মনে রেখো! সব কিছু তাঁরই আয়ত্তাধীন’
(সূরা : ফুচ্ছিলাত , আয়াত নং 54)।
আল্লাহ্ আরো বলেন :‘
মহান আল্লাহ্ সব কিছুর উপর পূর্ণ আয়াত্ত রাখেন’
(সূরা : আল-বুরুজ , আয়াত নং20)।
কবি হাকীম বলেন :
তববুদ্ধি পর হাকীম দম্ভ কত আর ?
যত ভাবো তত দূর-কোথা পাবে পার ?
কত যে জটিল প্রভূভেদ বুঝা নাহি যায় ;
ডুবন্ত নাবিক সায়রে যাঁচে-তৃণ যদি পায়।
মহা নবী (সঃ) থেকে একটি বিখ্যাত হাদীস আছে। তিনি বলেন :
‘
তোমার যতটুকু অধিকার ছিল আমরা ততখানি ইবাদত করতে পারিনি। আর তোমার যে পরিচয় জানা দরকার ছিল , আমরা সেভাবে তোমাকে চিনতে পারিনি’
(বিহারুল আনোয়ার 68 খঃ ,23 পৃঃ)।
এখানে ভুল বুঝাবুঝির অবকাশ নেই। উল্লেখিত বক্তব্যের অর্থ এ নয় যে , যেহেতু আমরা মহান আল্লাহর মূল অস্তিত্বের ব্যাপারে পুঙ্খানুপুঙ্খ জ্ঞাত নই , কাজেই তাঁর পরিচয় জানার লক্ষ্যে সাধারণ জ্ঞান-বিজ্ঞান থেকেও হাত গুটিয়ে নেব এবং আল্লাহর মা’
রিফাত সম্পর্কিত কিছু শব্দ আওড়াতে থাকব -যার কোনই তাৎপর্য নেই।
বস্তুতঃ এ ধরনের মা’
রিফাত -যার তাৎপর্য অনুদঘাটিত , তা আমাদের নিকট গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত নয় এবং আমরা তাতে বিশ্বাসীও নই। কেননা , মহাগ্রন্থ আল-কোরআন ও অন্যান্য সমস্ত আসমানী কিতাবসমূহ আল্লাহর মা’
রিফাত বা পরিচয় তুলে ধরার জন্য অবতীর্ণ হয়েছে।
এ পর্যায়ে যথেষ্ট উদাহরণ উপস্থাপন করা যেতে পারে। যেমন , আমরা রূহ বা আত্মার প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে জানি না যে , তা কী ? কিন্তু নিঃসন্দেহে আত্মা সম্পর্কে আমাদের একটা ধারণা ও পরিচিতি জানা আছে। আমরা জানি যে , আত্মার অস্তিত্ব আছে এবং তার প্রভাব ও নিদর্শন আমরা প্রত্যক্ষ করি।
হযরত ইমাম মুহাম্মদ ইবনে আলী আল বাকের (আঃ) থেকে এ পর্যায়ে একটি আকর্ষণীয় হাদীস বর্ণিত আছে। তিনি বলেন :
‘
প্রত্যেক বস্তুকে যখন চিন্তা-ভাবনা ও ধ্যান-ধারনা দ্বারা তার যথার্থ অর্থের কথা কল্পনাকরবে তখন তা হবে তোমারই সৃষ্ট ও নিরূপিত এবং তা তোমাদের নিজেদের মতই হবে ,আর তোমাদের দিকেই প্রত্যাবর্তন করবে’
(বিহারুল আনোয়ার , খঃ-66 , পৃঃ 293)।
আমীরুল মু 'মিনীন হযরত আলী (আঃ) থেকে অন্য একটি হাদীসে আল্লাহর মা’
রিফাত ও পরিচয় সম্পর্কে অত্যন্ত সুন্দর ও স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন :
‘
মহান আল্লাহ্ আকল-বুদ্ধি ও বিবেককে স্বীয় (অস্তিত্বগত) মারিফাত সম্পর্কে অবহিত করেননি। পক্ষান্তরে স্বীয় মা 'রিফাত ও পরিচিতি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় অবগতি অর্জনের পথে অন্তরায় ও বাঁধার সৃষ্টি করেননি এবং বাতিল করেননি’
(গুরারুল হিকাম)।
11. তা 'তীলও নয় তাশবীহ্ও নয় :
আমরা বিশ্বাস করি : যেমনি ভাবে“
তাতীল”
তথা মহান আল্লাহর অস্তিত্বের প্রকৃত রহস্য জানা সঠিক কাজ নয় তেমনিভাবে আল্লাহকে কারো সাথে ,‘
তাশবীহ’
তথা সমকক্ষ ও সমতুল্য মনে করা কিংবা কোন আকার আকৃতির সাথে তুলনা করার কাজে অবতীর্ণ হওয়া ভুল ও শিরক জনিত কাজ। অর্থাৎ আমরা একথা বলতে পারব না যে , মহান আল্লাহকে আদৌ চেনা যাবে না এবং তাঁকে চেনার রাস্তাও উন্মুক্ত নয় , যেমন তাঁকে কোন সৃষ্টির সাথে তুলনা করা যায় না। এ দু 'টি নীতির একটি হলো 'এফরাত ' তথা অতিরজ্ঞন ও বাড়াবাড়ি আর দ্বিতীয়টি হলো 'তাফরীত ' তথা চরমবাড়াবাড়ি ।