18. তাওয়াস্সুল বা উছিলা গ্রহণ :
আমরা বিশ্বাস করি : তাওয়াস্সুল বা কারো শরণাপন্ন হয়ে সহায়তা গ্রহণের বিষয়টিও সুপারিশের বিষয়টির মতই একটি বিষয়। এ বিষয়টি এবং যে ব্যক্তি আত্মিক ও জাগতিক কোন বিপদের বা সমস্যার সন্মুখীন হবে তখন তার জন্যে সুযোগ থাকবে যে , তার সমস্যার সমাধানকল্পে অলি-আউলিয়াদের তাওয়াসসুল করে মহান আল্লাহর দরবারে এগিয়ে যাবে। অপর দিকে সে আল্লাহর অলি-আউলিয়াদেরকে উছিলা হিসাবে উপস্থাপন করবে। আল্লাহ্ বলেন :‘
তারা যদি নিজেদের প্রতি নিজেরা জুলুম-অত্যাচার করার পর তোমার নিকট আসত এবং আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করত আর আল্লাহর রাসূলও তাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন তাহলে তারা আল্লাহকে অবশ্যই তওবা গ্রহণকারী ও করুনাময় হিসেবে পেত’
(সূরা : আন-নিসা আয়াত নং 64)।
এরূপে হযরত ইউসুফ (আঃ) এর ভাইদের ঘটনাতেও আমরা দেখি , তারা তাদের পিতার শরণাপন্ন হয়ে বলল :
‘
হে আমাদের পিতা! আমাদের জন্যে মহান আল্লাহর সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা করুন! কেননা , আমরা বড়ই অপরাধী ছিলাম’
(সূরা : ইউসুফ আয়াত নং 97)।
তাদের বৃদ্ধ পিতা হযরত ইয়া’
কুব (আঃ) তাদের এ আবেদন গ্রহণ করলেন এবং তাদেরকে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। আর বললেন :‘
খুব শীঘ্রই আমি তোমাদের জন্যে আমার প্রভূর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করব’
(সূরা : ইফসুফ , 98 নং আয়াত)।
এই ঘটনাটি এ কথারই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে , পূর্ববর্তী উম্মতদের মধ্যেও তাওয়াস্সুলের নীতি প্রচলিত ছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে যুক্তিসংগত সীমা অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়া উচিৎ নয়। আর অলি- আওলিয়াগণকে এ পর্যায়ে কার্যকারি ও খোদার অনুমতির ক্ষেত্রে নিস্প্রয়োজনীয়তা মনে করা শিরক ও কুফুরীর শামিল।
অনুরুপভাবে , অলি-আউলিয়াদের তাওয়াস্সুল কখনো তাদেরকে উপাসনা করা হচ্ছে এ দৃষ্টিতে দেখা উচিৎ হবে না। কেননা এরূপ হওয়াটাও শিরক ও কুফুরীর মধ্যে গণ্য। এ কারণে যে , তাঁরা প্রকৃতিগতভাবে আল্লাহর অনুমতি ব্যতিরেকে , না কল্যাণ করার আর না ক্ষতি সাধনের অধিকারী। আল্লাহ্ বলেন :‘
তাদেরকে বলে দাও! (এমনকি) আমি আমার নিজের কল্যাণ সাধন ও ক্ষতি করার অধিকারী নই , কিন্তু ততটুকুরই অধিকারী যতটুকু আল্লাহ্ চাহেন’
( সূরা : আল-আরাফ 188)।
সাধারণতঃ ইসলামী র্ফিকাসমূহের প্রায় সব ফিরকাতেই অন্ততপক্ষে একদল সাধারণ মানুষকে এ তাওয়াস্সুলের ব্যাপারে সীমাতিক্রম ও বাড়াবাড়ি করতে দেখা যায়। এদের সংশোধন ও হেদায়েত হওয়া অত্যন্ত জরুরী।
19. নবীগণের দাওয়াতের পদ্ধিতি অভিন্ন :
আমরা বিশ্বাস করি : আল্লাহর নবী-রাসূলগণ সকলেই একটা লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে অনুসরণ করতেন আর তা ছিল মানুষের কল্যাণ সাধন করা। আর তা আল্লাহর ও শেষ বিচার দিনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমে , দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে সঠিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এবং মানব সমাজের চারিত্রিক বলিষ্ঠতার উন্নয়নের মাধ্যমে। এ কারণেই আমাদের নিকট সমস্ত নবী- রাসূলগণই সন্মানের পাত্র। এ কথাটি আল-কোরআনে আল্লাহ্ আমাদেরকে এভাবে শিক্ষা দিয়েছেন :‘
আমরা আল্লাহর রাসূলগণের মধ্যে কোন পার্থক্য করি না’
(সূরাঃ আল-বাকারাহ্ 285)।
যদিও হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) পূর্বে যতই দিন-কাল অতিবাহিত হত ততই মানুষ উচ্চতর ও অধিকতর শিক্ষার্জনের জন্যে আসত। অনুরূপভাবে আল্লাহর দ্বীনও ক্রমাগতভাবে পূর্ণতার দিকে এগুতে থাকল। আর তাদের শিক্ষা-দীক্ষা গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকলো। এভাবে আল্লাহর দ্বীন চুড়ান্তভাবে পরিপূর্ণতা লাভের পর্যায়ে এসে উপস্থিত হল। অর্থাৎ আল্লাহর দ্বীন ইসলাম পরিপূর্ণতা লাভ করল। আল্লাহ্ বলেন :‘
আজ তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামতকে সম্পূর্ণ করলাম। আর ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে মনোনিত করলাম’
(সূরা : আল-মায়িদা আয়াত নং 3)।
20. পূর্ববর্তী নবীগণের সংবাদ দান :
আমরা বিশ্বাস করি : অনেক নবীগণই তাঁর পরবর্তীতে আগত নবীর সংবাদ পরিবেশন করে গেছেন। যেমন : হযরত মুসা (আঃ) ও হযরত ঈসা (আঃ) রাসূলে আকরাম (সাঃ) এর আগমন সম্পর্কে সুস্পষ্ট সংবাদ পরিবেশন করে গেছেন , যার কোন কোনটি আজও তাদের গ্রন্থাবলীতে বর্তমান রয়েছে। আল্লাহ্ বলেন :
)
الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الرَّسُولَ النَّبِيَّ الْأُمِّيَّ الَّذِي يَجِدُونَهُ مَكْتُوبًا عِنْدَهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ يَأْمُرُهُمْ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَاهُمْ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ وَيَضَعُ عَنْهُمْ إِصْرَهُمْ وَالْأَغْلَالَ الَّتِي كَانَتْ عَلَيْهِمْ فَالَّذِينَ آمَنُوا بِهِ وَعَزَّرُوهُ وَنَصَرُوهُ وَاتَّبَعُوا النُّورَ الَّذِي أُنْزِلَ مَعَهُ أُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ(
‘
যারা আনুগত্য ও অনুসরণ করে এমন এক রাসূলের যিনি একজন উম্মী নবী , (তাঁর বৈশিষ্ট্যাবলী ও নিদর্শনাদি) তারা তাদের কাছে যে ইঞ্জিল ও তাওরাত গ্রন্থ রয়েছে তাতে তারা স্পষ্ট লিখিত দেখতে পাচ্ছে , এরূপ লোকেরাই পূর্ণ সফলকাম’
(সূরা : আল-আরাফ 157)।
এ কারণে ঐতিহাসিকগণ বলেন : রাসূলে আকরাম (সাঃ) এর আবির্ভাবের কিছুকাল পূর্বে ইয়াহুদীদের বিরাট একটা দল মদীনায় আসলো এবং তাঁর আবির্ভাবের অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ থাকল। কেননা , তারা তাদের গ্রন্থাবলীতে দেখতে পেয়েছিল যে , তিনি এ ভু-খন্ড থেকে আবির্ভূত হবেন। যা হোক , প্রত্যাশিত এ উজ্জল সূর্যটি উদিত হবার পর একদল ইয়াহুদী ঈমান এনেছিল , আর অপর একটি দল যারা নিজেদের স্বার্থ-সুবিধাকে বিপদের সন্মুখীন দেখতে পেলো যার ফলশ্রুতিতে তারা তাঁর বিরোধীতায় লেগে গেল।
21. নবীগণ ও জীবনের সার্বিক সংশোধন :
আমরা বিশ্বাস করি : নবী-রাসূলগণের প্রতি মহান আল্লাহ্ যে দ্বীন অবতীর্ণ করেছেন , বিশেষতঃ ইসলামী জীবন দর্শনের লক্ষ্য হচ্ছে শুধুমাত্র ব্যক্তি সংশোধন অথবা কেবলমাত্র আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক বিষয়াবলীর ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং সমাজ জীবনের সর্বাঙ্গে সংশোধন ও জীবনের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় অনেক জ্ঞান-বিজ্ঞান এ নবী-রাসূলগণের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেছে , কোন কোনটার ইংগিত স্বয়ং কোরআনেও রয়েছে।
আমরা আরো বিশ্বাস করি : এ সমস্ত খোদায়ী নেতৃবৃন্দের অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য- উদ্দেশ্যাবলীর মধ্যে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হচ্ছে মানব সমাজে ন্যায়-নিষ্ঠা প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহ্ বলেন :‘
আমরা আমাদের রাসূলগণকে স্পষ্ট দলিল-প্রমাণসহ পাঠিয়েছি এবং তাঁদের সাথে অবতীর্ণকরেছি আসমানী কিতাব ও (হক ও বাতিল চেনার ও ন্যায়নিষ্ঠার বিধি-বিধান সমৃদ্ধ)মানদন্ড-যাতে করে বিশ্ববাসীরা ন্যায় নীতি প্রতিষ্ঠা করতে পারে’
(সূরা : আল-হাদিদ ,আয়াত নং 25)।
22. গোত্র ও গোষ্ঠী পুজা নিষিদ্ধ :
আমরা বিশ্বাস করি : কোন নবী-রাসূলই বিশেষতঃ বিশ্বনবী (সাঃ) কোন প্রকার গোত্রগত ও গোষ্ঠিগত আভিজাত্যকে মেনে নেননি। বরং তাঁর দৃষ্টিতে জগতের সমস্ত ভাষা , গোষ্টী ও জাতি সমান মর্যাদার অধিকারি। তাইতো কোরআন বলেছে :
)
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ(
‘
হে লোক সকল! আমরা তোমাদেরকে একজন মাত্র পুরুষ ও নারী হতে সৃষ্টি করেছি এবংতোমাদেরকে বিভিন্ন গোত্র ও গোষ্ঠীভুক্ত করেছি , যাতে করে পরস্পরকে সহজে চিনতেপার। অর্থাৎ এ সবগুলো শ্রেষ্ঠত্ব ও আভিজাত্যের জন্য নয় বস্তুতঃ তোমাদের মধ্যে সেইব্যক্তিই সবচেয়ে বেশি সন্মানিত যে ব্যক্তি , সবচেয়ে বেশী খোদাভীরু-পরহেযগার’
(সূরা :আল হুজুরাত ,আয়াত নং-13)।
এ পর্যায়ে রাসূলে আকরাম (সাঃ) এর একটি বিখ্যাত হাদীস আছে , যা তিনি (হজ্বের সময়) উটের পিঠে আরোহণ অবস্থায় মিনাতে লোকদেরকে উদ্দেশ্য করে বক্তৃতার আকারে বলেন :-
‘
হে মানব সকল! জেনে রেখো : তোমাদের প্রভু এক। তোমাদের পিতাও এক। আরবরা আজমদের (অনারবদের) উপর কোন শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী নয়। আর না অনারবরা আরবদের উপর শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার হতে পারে। অনুরূপভাবে না কালোদের উপর শ্বেতাঙ্গ(চামড়া বিশিষ্টদের) আভিজাত্যের অবকাশ আছে , আর না শ্বেতাঙ্গদের উপর কালোদের আভিজাত্যের অবকাশ আছে ; কিন্তু খোদাভীরুতা ও পরহেযগারীর ভিত্তিতে (অবশ্যই মর্যাদার পার্থক্য রয়েছে)। আমি কি আল্লাহর নির্দেশ তোমাদের নিকট পৌঁছে দিয়েছি ? সকলেই বলল : জী হ্যাঁ! তখনি বললেন : আমার এ বক্তব্যটি যারা উপস্থিত আছো তারাঅনুপস্থিত লোকদের নিকট পৌছে দিও । (তাফসীরে কোরতবী , নবম খঃ পৃঃ 6162)
23. ইসলাম ও মানব-প্রকৃতি :
আমরা বিশ্বাস করি : আল্লাহ্ ও তাঁর একত্ববাদে বিশ্বাস এবং নবী-রাসূলগণের শিক্ষানীতি মোটামুটি প্রকৃতিগতভাবেই সমস্ত মানুষের হৃদয়ে বর্তমান রয়েছে। আল্লাহর নবী-রাসূলগণ ফলদায়ক বীজগুলোকে পানি ও ওহী দ্বারা সিঞ্চন কাজ চালিয়ে , শিরক ও বিচ্যুতির আগাছা- পরগাছা তার আশপাশ থেকে দূর করে দিয়েছেন। আল্লাহ্ বলেন :
)
فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا فِطْرَتَ اللَّهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لَا تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّهِ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ(
‘
অর্থাৎ (আল্লাহর বিধান হচ্ছে) আল্লাহর নির্ভেজাল প্রকৃতি-যার উপর সমগ্র মানব প্রকৃতিকে সৃষ্টি করা হয়েছে। খোদার এ সৃষ্টিনীতিকে কোন পরিবর্তন করা উচিৎ নয়। এটাই হচ্ছে খোদার মজবুত দ্বীন। কিন্তু অধিকাংশ লোকই তা জানে না’
(সূরা : আর-রূম 30)।
এ জন্যেই ইতিহাসের দীর্ঘ পাতায় সব সময়ই দ্বীন বর্তমান ছিল এবং বড় বড় ঐতিহাসিকদের বিশ্বাস মতে দ্বীনশূন্য পৃথিবীর চিন্তা , বিরল ও ব্যতিক্রম ব্যাপার। এমনকি , যে জাতিসমূহ বছরের পর বছর ধরে দ্বীন বিরোধী প্রচার-প্রপাগান্ডার চাপের মুখে ছিল , তারা যখনই স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছে , সাথে সাথেই আবার দ্বীনের দিকে প্রত্যাবর্তন করেছে। কিন্তু একথা অস্বীকার করার জো নেই যে , পূর্ববর্তী জাতিসমূহের সাংস্কৃতিক অবস্থান নীচু থাকার কারণে আকীদা-বিশ্বাস ও দ্বীনি তাহ্যীব-তামাদ্দুন (সংস্কৃতি) কুসংস্কার যুক্ত হয়ে পড়ে ছিল এবং নবীগণের কর্মসূচীর সিংহভাগ কাজই ছিল এ কুসংস্কারের মরিচা দূর করা।