30. কোরআনের তফসিরের বিধান :
আমরা বিশ্বাস করি : আল-কোরআনের শব্দসমূহকে প্রচলিত ও আভিধানিক অর্থে প্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু যদি কোরআনের আয়াতের অভ্যন্তরে কিংবা এর বাইরে জ্ঞান-বুদ্ধিগত অথবা বর্ণনাগত কোন আলামত ও নির্দেশ পাওয়া যায় তাহলে অন্য অর্থ করা যেতে পারে। (কিন্তু সন্দেহজনক নিদর্শনাদির উপর ভরসা করা উচিৎ নয় বরং সেগুলোকে পরিহার করাই শ্রেয়। আর কোরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা ধারণা প্রসূত হওয়া উচিৎ নয়)। যেমন কোরআন বলছে :
‘
যে ব্যক্তি এ জগতে অন্ধ থাকবে সে পরকালেও অন্ধ ও দৃষ্টি হীন থাকবে’
(সূরা : বনী ইস্রাইল , আয়াত নং 72)।
আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস , এখানে“
অন্ধ”
এর বাহ্যিকভাবে যে আভিধানিক অর্থ রয়েছে প্রকৃত অর্থ তা নয়। কেননা , অনেক অনেক পূর্ণ্যবান ও পাক পবিত্র লোক এ জগতে অন্ধ ছিলেন ও আছেন। কাজেই এখানে অন্ধের বাহ্যিক অর্থ দৃষ্টিহীন লোকজন নয়। বরং কুটিল আত্মা সম্পন্ন তথা আত্মার দিক থেকে যারা অন্ধ ও পথভ্রষ্ট সে সব লোক। এখানে জ্ঞান-বুদ্ধি ও নির্দেশে এ ব্যাখ্যাই প্রকৃত ব্যাখ্যা। অনুরূপভাবে কোরআন , ইসলামের দুশমন-একদল লোক সম্পর্কে বলেছে :‘
তারা বধির , বোবা ও অন্ধ। অতএব , তারা কিছুই বুঝে না’
(বাকারাহ্ : আয়াত নং 171)।
এ কথা স্পষ্ট যে , এ লোকগুলো বাহ্যিক দিক থেকে বধির , বোবা ও অন্ধ ছিল না বরং এটা তাদের আভ্যন্তরীন বৈশিষ্ট্য। (এ ব্যাখ্যাটি আমরা এখানে এ কারণে করলাম যে , এখানে আমাদের হাতে আলামত বা জ্ঞান-বুদ্ধিগত নির্দেশ ছিল)। এভাবে কোরআন যখন মহান আল্লাহ্ সম্পর্কে বলে :‘
আল্লাহর দু 'হাতই প্রশস্ত’
(সূরা : আল-মায়েদাহ্ 64)।
কোরআন আরো বলে :‘
(হে নূহ্!) তুমি আমাদের চোখের সামনেই নৌকা তৈরী করো’
(হুদ : 37)।
উপরোল্লেখিত আয়াত দু 'টির অর্থ কখনই আল্লাহর শরীরের চোখ , কান , হাত ইত্যাদি অঙ্গ- প্রত্যঙ্গের ব্যাপারে নয়। কেননা , প্রত্যেক শরীরেরই অঙ্গ-প্রতঙ্গ থাকে। আর সেগুলোর জন্যে স্থান-কাল ও কারণ থাকে এবং অবশেষে একদিন ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। সুতরাং এখানে আল্লাহর“
হাত '”
এর উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর সেই পূর্ণাঙ্গ শক্তি , যার ক্ষমতাবলে তিনি সমগ্র জাহানকে নিজের প্রতিপত্তির আওতায় রেখেছেন। আর তাঁর“
চক্ষু”
এর অর্থ হচ্ছে তাঁর জ্ঞান-পরিজ্ঞান-যা সব কিছুর ব্যাপারেই তাঁর রয়েছে।
অতএব উপরোক্ত বক্তব্যের প্রেক্ষিতে , আমরা কখনো চাইনা যে , আল্লাহর বৈশিষ্ট্যের বিষয় হোক অথবা অন্য কোন ব্যাপার হোক জ্ঞান-বুদ্ধিগত ও বণর্নাগত আলামত ও নির্দেশকে কোরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অলক্ষ্যে বাদ যাক। কেননা , জগতের সমস্ত অভিজ্ঞ ও বিজ্ঞ মহল এ নীতিকে অবলম্বন করেছেন এবং এ নীতি-পদ্ধতিকে স্বীকার করে নিয়েছেন। আল্লাহ্ বলেন :‘
আমরা কোন রাসূলকেই প্রেরণ করিনি ; কিন্তু তাদের জাতির ভাষাভাষী লোক ব্যতীত’
(সূরা : র্ইরাহীম , আয়াত নং 4)।
কিন্তু সে আলামত ও নির্দেশ সন্দেহমুক্ত ও নিশ্চিত হতে হবে , ধারণা প্রসুত নয়।
31. মনগড়া তফসিরের বিপদ :
আমরা বিশ্বাস করি : মনগড়া তফসির কোরআন সম্পর্কে বিপদজনক কর্মসূচীগুলোর একটি অন্যতম কর্মসূচী। ইসলামী বর্ণনা মতে এ কাজটি“
কবীরাহ্ গুনাহ্”
তথা মহা পাপ বলে পরিগণিত এবং আল্লাহর দরবার থেকে বিতাড়িত হবার কারণ। এক হাদীসে আছে যে , মহান আল্লাহ্ বলেন :‘
যে ব্যক্তি আমার বাণীকে তার নিজের ইচ্ছা মত ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণ করে (অর্থাৎ নিজের প্রবৃওির চাহিদা মোতাবেক) সে আমার প্রতি ঈমান আনেনি’
(অসায়েল , 18শ খঃ , পৃঃ28 ,হাদীস নং22)।
এ কথা স্পষ্ট যে , যদি সত্যিকারের ঈমান তার মধ্যে থাকত তাহলে খোদার বাণীকে ঠিক যেভাবে আছে সেভাবেই গ্রহণ করে নিত। তার প্রবৃত্তির কথা মত নিত না। বিখ্যাত অনেক হাদীস গ্রন্থে যেমন : ছহীহ্ তিরমিযি , নাসাঈ ও আবুদাউদ গ্রন্থে এ হাদীসটি রাসূল (সাঃ) থেকে বর্ণিত :‘
যারা কোরআনের বাণী কে নিজেদের ইচ্ছা মোতাবেক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে অথবা যে বিষয়ে সে জানেনা তা বলে , সে যেন প্রস্তত থাকে যে , তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম’
(রিয়াদের প্রখ্যাত বিজ্ঞ ব্যক্তি জনাব মান্নায়িল খলীল আল কাত্তান রচিত-কিতাবু মাবাহিছু ফী উ 'লুমিল কোরআন পৃঃ 304)।
মনগড়া তাফসীর করার অর্থ হচ্ছে কোরআনের বাণীকে কোন ব্যক্তির নিজের ইচ্ছা ও বিশ্বাস মত অথবা নিজের দলের চাহিদা ও বিশ্বাস মোতাবেক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা এবং তদানুযায়ী খাপ খাইয়ে ও মিলিয়ে দেয়া। অথচ , এ ব্যাপারে কোন আলামত বা নিদর্শন তাদের পক্ষে নেই। প্রকৃত পক্ষে এ ধরনের লোকেরা কোরআনের অনুসারী নয় বরং তারা চায় কোরআনকে তাদের অনুসারী বানাতে। তারা যদি কোরআনের প্রতি ঈমান বা বিশ্বাস পোষণ করত তাহলে কখনোই এমন কাজ করতে পারত না।
এতে কোন সন্দেহ নেই যে , যদি কোরআনের তফসিরের ক্ষেত্রে মনগড়া তফসির করার দরজা খুলে দেয়া হয় তাহলে কোরআন সার্বিকভাবে নির্ভরতা হারিয়ে ফেলবে। আর যে কেউ তখন নিজের ইচ্ছা মত ব্যাখ্যা করা শুরু করবে এবং সকল বাতিল পন্থীরাই নিজেদের বিশ্বাসের সাথে কোরআনের আয়াত মিলিয়ে নিবে।
অতএব , কোরআনের মনগড়া তফসিরের অর্থ হচ্ছে : আভিধানিক মানদন্ডের খেলাফ , আরবী সাহিত্যের পরিপন্থী , আরবী ভাষাভাষী লোকদের বুঝের বহির্ভুত , অনুমানের সাথে মিলিয়ে দেয়া , বাতিল ও ধারণা প্রসূত , ব্যক্তিগত ও দলগত ইচ্ছানুযায়ী ব্যাখ্যা দান করা , যা দ্বারা কোরআনের অর্থের বিকৃতি ঘটে।
কোরআনের মনগড়া ব্যাখ্যা দানের নানা রকম শাখা প্রশাখাও রয়েছে , তন্মধ্যে একটি হচ্ছে কোরআনের আয়াতকে বেছে নেয়া। এ অর্থে যে , যেমন শাফায়াত বা সুপারিশের বিষয় , তৌওহীদ বা একত্ববাদের ক্ষেত্রে ইমামত বা নেতৃত্বের পর্যায়ে ও অন্যান্য ব্যাপারে কেবলমাত্র সেই সব আয়াতের নিকটই যায় -যা তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের পথে সহায়ক হয়। আর অন্য যে আয়াতসমূহ তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় কিন্তু অন্য আয়াতের সম্পুরক ও বিশ্লেষক সে আয়াতসমূহকে অলক্ষ্যে বাদ দিয়ে দেয় অথবা সে আয়াতসমূহের প্রতি অমনোযোগ সহকারে পাশ কেটে যায়।
সার কথা হচ্ছে : কোরআনে ব্যবহৃত শব্দসমূহের উপর দৃঢ়ভাবে বসে থাকা এবং জ্ঞান- বুদ্ধিগত ও নির্ভরযোগ্য বণর্নাগত দলীল প্রমাণ ভিত্তিক আলামত ও নির্দেশের প্রতি দৃষ্টিপাত না করা , যেমন এক প্রকারের বিকৃতি , তেমনি মনগড়া তফসির তথা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও বিকৃতি হিসাবে পরিগণিত হবে। আর দু 'টি পন্থাই কোরআনের মহা মূল্যবান উচ্চ শিক্ষা থেকে দুরে নিক্ষিপ্ত হওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। চিন্তা করে দেখুন।
32. হাদীস , কোরআন কর্তৃক অনুমোদিত :
আমরা বিশ্বাস করি : কোন ব্যক্তিই একথা বলতে পারে না যে , অর্থাৎ আমাদের জন্যে আল্লাহর কিতাব কোরআনই যথেষ্ট। আর হাদীস ও নবীর সুন্নত , যা তফসির সম্পর্কীত , কোরআনের হকীকত বর্ণনাকারী , নাসেখ ও মানসুখ তথা বাতিলকারী ও বাতিলকৃত আয়াতের সনাক্তকারী এবং সাধারণ ও বিশেষ আয়াতের পার্থক্যকারী অথবা ইসলামের মৌলিক শাখা-প্রশাখার শিক্ষার সাথে সম্পর্কযুক্ত , তা অলক্ষ্যে উপেক্ষা করা যায় না। কেননা , কোরআনের আয়াতই রাসূলে আকরাম (সাঃ) এর আদর্শ-চরিত্র , তাঁর বলা-বক্তব্য ও তাঁর কৃতকর্মকে মুসলমানদের জন্যে হুজ্জাত তথা দলীল বলে গণনা করেছে এবং সে হাদীসসমূহকে ইসলাম জানা ও বুঝার এবং ইসলামী হুকুম-আহ্কাম নির্ণয় করার উৎস বলে ঘোষণা করেছে। কোরআন বলেছে :
‘
যা কিছু রাসূলে আকরাম (সাঃ) তোমাদের জন্যে নিয়ে এসেছেন (ও তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন) তা গ্রহণ কর। (আমল কর) এবং তিনি যা নিষেধ করেছেন তা পরিহার করো’
(সূরা : আল হাশর আয়াত নং7)।
কোরআন আরো বলেছে :
‘
ঈমানদার নর-নারী কারোই অধিকার নেই যে , যখন আল্লাহ্ ও রাসূল কোন বিষয়ে জরুরী মনে করেন ও নির্দেশ দান করেন তখন তা তারা নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী করবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্ রাসূলের কথা অমান্য করলো সে তো স্পষ্ট পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত হলো’
(সূরা : আল আহযাব , আয়াতনং 36)।
‘
যারা রাসূলের হাদীসের প্রতি তোয়াক্কাহীন , প্রকৃতপক্ষে তারা কোরআনকেই উপেক্ষা করছে।
কিন্তু এ কথা স্পষ্ট যে , রাসূলের হাদীস অবশ্যই নির্ভরযোগ্য সূত্রে স্থির হতে হবে। যে কোন বক্তব্যই , যে কোন লোক রাসূলের সাথে সম্বন্ধযুক্ত করে দিলেই তা গ্রহণ করা যেতে পারে না। হযরত আলী (আঃ) একবার এক বক্তৃতায় এরূপ বলেন :
‘
রাসূলের জীবদ্দশায়ই তার নামে মিথ্যা (হাদীস) বাঁধা হয়েছে , অবশেষে রাসূল (সঃ) একদিন দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছিলেন। তাতে তিনি বললেন : যে ব্যক্তি আমার নামে মিথ্যা (হাদীস) ইচ্ছা করে বাঁধবে , সে যেন প্রস্তুত থাকে যে , তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম’
(নাহজুল বালাগাহ , খোৎবা নং210)।
অনুরূপ অর্থের একটি হাদীস ছহীহ্ বোখারীতেও আছে। (দেখুন , ছহীহ্ বোখারী , 1ম খঃ , পৃঃ 28 , বাবে ইসমুমান কাজিবা আলান্নাবী (সাঃ))।
33. আহলে বাইতের ইমামগণের হাদীস :
আমরা আরো বিশ্বাস করি : রাসূলের আহলে বাইতের ইমামগণের হাদীসসমূহ ও রাসূলের নির্দেশমতে মেনে চলা অপরিহার্য কর্তব্য। কেননা ,
প্রথমতঃ শিয়া-সুন্নী উভয় ফিরকার অধিকাংশ বিখ্যাত হাদীস গ্রন্থসমূহে“
হাদীসে মোতাওয়াতের '' রয়েছে যা এ কথারই বিশ্লেষণ করেছে। ছহীহ্ তিরমিযিতে বর্ণিত হয়েছে যে , রাসূলে আকরাম (সাঃ) বলেন :‘
হে লোক সকল! আমি তোমাদের মাঝে এমন জিনিস রেখে যাচ্ছি , যদি তোমরা তা আঁকড়ে ধরে থাক তাহলে কখনই পথভ্রষ্ট-গোমরাহ্ হবে না। আর তা হলো আল্লাহর কিতাব (আল-কোরআন) ও আমার আহলে বাইতের বংশধারা’
(ছহীহ্ তিরমিযি , 5ম খঃ ,পৃঃ :662 ,বাবে মানাকিবে আহলে বাইতিন্নাবী (সঃ) , হাদীস নং 3786)।
এ হাদীসের বহু সংখ্যক সনদ ইমামতের অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
দ্বিতীয়ত : আহলে বাইতের ইমামগণ নিজেদের সমস্ত হাদীসই রাসূলে আকরাম (সাঃ) থেকে বণর্না করেছেন। তাঁরা বলেন : আমরা যা কিছু বলি তা আমাদের পূর্বপুরুষদের মাধ্যমে রাসূল (সাঃ) থেকে আমাদের নিকট পৌছিয়েছে।
জী হ্যাঁ ; হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) মুসলমানদের ভবিষ্যত ও তাদের সমস্যাবলী ভালভাবেই বুঝতে পারছিলেন এবং তাদের এ অসংখ্য সমস্যা সমাধানের পথ পৃথিবীর মহাপ্রলয় অবধি কোরআন ও আহলে বাইতের অনুসরণের মধ্যে নিহিত আছে বলে ঘোষণা করেছেন।
যে হাদীসটি এত গুরুত্বের দাবীদার এবং যার মধ্যে এত সব বিষয়াদি শামিল আর যা এত সনদ সমৃদ্ধ তা কি উপেক্ষা করা যেতে পারে ? আর খুব সহজেই কি তার পাশ কেটে চলে যাওয়া যায় ? এ কারণেই আমরা বিশ্বাস করি : যদি এ ব্যাপারটিতে অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করা হত তাহলে আজকের মুসলমানরা আকীদা-বিশ্বাসের সব ক্ষেত্রে , কোরআনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ময়দানে ও ফীকাহ্ শাস্ত্রের মাসআলা-মাসায়েলের জগতে যে সমস্ত সমস্যার সন্মুখীন , তার কিছুই দেখা দিত না।