চতুর্থ অধ্যায়
কিয়ামত ও পূনর্জীবন
34. পরকাল ব্যতীত জীবন অর্থহীন :
আমরা বিশ্বাস করি : সমস্ত মানুষ মৃত্যুর পর একদিন পুনরায় জীবিত হবে। আর তাদের কৃতকর্মের হিসাব-নিকাশ নেয়া হবে। সৎ কর্মশীল ও নেক্কার লোকেরা বেহেশ্তের মধ্যে চিরকালের জন্যে স্থান লাভ করবে এবং অসৎ কর্মশীল ও পাপী লোকেরা নরকে নিক্ষিপ্ত হবে। আল্লাহ্ বলেন :‘
আল্লাহ্ সে মহান সত্তা যিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই। নিঃসন্দেহে তোমাদের সকলকে শেষ বিচার দিবসে অবশ্যই সমবেত করা হবে , যে দিনের ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই’
( সূরা : আন-নিসা , আয়াত নং 87)।
আল্লাহ্ আরো বলেন :
‘
কিন্তু যে ব্যক্তি বিদ্রোহ করবে ও পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনা করবে , নিঃসন্দেহে তার স্থান হচ্ছে জাহান্নাম। আর যে ব্যক্তি তার প্রভূর বিচার আদালতকে ভয় করে চলবে এবং নিজের আত্মাকে প্রবৃত্তির চাহিদা থেকে নিবৃত্ত রাখবে , নিঃসন্দেহে তার বাসস্থান হচ্ছে বেহেশ্ত’
(সূরা : আন-নাযিয়াত , আয়াত নং 37-41)।
আমরা বিশ্বাস করি : এ পৃথিবীটা প্রকৃত পক্ষে একটা পুল বা সেতু স্বরূপ। সমস্ত মানুষকেই তা অতিক্রম করে যেতে হবে এবং নিজের চির আবাসে গিয়ে পৌঁছতে হবে। অন্য কথায় , এ পৃথিবীকে একটা বিদ্যাপীঠ বলা যেতে পারে। অথবা এটা একটা ব্যবসা কেন্দ্র কিংবা এটা একটা কৃষিক্ষেত্র , আর বাসস্থান অন্যত্র।
হযরত আলী (আঃ) এ পৃথিবী সম্পর্কে বলেন :
‘
পৃথিবী সত্য ও সত্যবাদীতার স্থান সে ব্যক্তির জন্যে যে এর সাথে সত্যবাদীতার সাথে কাজ করে দুনিয়া একটি অমুখাপেক্ষীতার স্থান , যে রসদ সঞ্চয় করে। এ জগৎ একটি জাগ্রত ও শিক্ষা গ্রহণ করার স্থান সে ব্যক্তির জন্যে যে এর থেকে শিক্ষা নিতে চায়। এটা খোদার বন্ধুদের জন্যে মসজিদ ; আল্লাহর ফেরেশতাদের নামাযের স্থান , আল্লাহর অহী বা প্রত্যাদেশ অবতীর্ণের স্থান ও খোদার অলি আওলিয়াদের ব্যবসাকেন্দ্র’
(নাহজুল বালাগাহ্ ,কালিমাতি কেসার নং 131)।
35. পরকালের দলীল-প্রমাণ সুস্পর্ষ্ট :
আমরা বিশ্বাস করি : কিয়ামত বা পরকালের দলীল-প্রমাণ সুস্পষ্ট। কেননা , প্রথমতঃ এ পৃথিবীর জীবনই নির্দেশ করছে যে , মানব সৃষ্টির চুড়ান্ত ও মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এ পৃথিবীর জীবন হতে পারে না। মানুষ কিছু দিনের জন্যে এখানে আসবে , তারপর অসংখ্য সমস্যা বিজড়িত জীবন যাপন করবে , এরপর সবকিছুর পরিসমাপ্তি ঘটবে , আর মানুষ অনস্তিত্বের রাজ্যে বিলিন হয়ে যাবে। আল্লাহ্ বলেন :
‘
তোমরা কি ভেবে নিয়েছ যে , আমরা তোমাদেরকে অহেতুক সৃষ্টি করেছি , আরতোমাদেরকে আমাদের কাছে ফিরে আসতে হবে না ?’
(আল-মু 'মিনুন : 115)।
এ আয়াতটি এ কথারই ইংগিত করছে যে , যদি পরকালের ব্যাপারই না থেকে থাকে তাহলে তো এ দুনিয়ার জীবন একটা নিছক পুতুল খেলা মাত্র।দ্বিতীয়ত : আল্লাহর আদ্ল বা ন্যায়-ইনসাফের অপরিহার্য দাবী হচ্ছে যে , সৎ কর্মশীল ও অসৎকর্মশীল লোকেরা যারা প্রায়শই এ জগতে একই কাতারে সারিবদ্ধ হয় আবার কখনো অসৎকর্মশীল লোকেরা এগিয়ে চলে যায় , তারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ কৃতকর্মের পরিণতি ভোগ করবে। আল্লাহ্ বলেন :
‘
যারা পাপ-অপরাধে অপরাধী তারা কি মনে করে নিয়েছে যে , আমরা তাদেরকে সে সমস্তলোকদের সমপর্যায়ের বলে বিবেচনা করব-যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্মগুলো সম্পাদনকরেছে-যার ফলে তাদের জীবন ও মরণ সমভাবে হবে ? তাদের এ ফয়সালা কতোইনা মন্দ!’
(সূরা : আল-জাছিয়াহ , আয়াত নং 21)।
তৃতীয়ত : আল্লাহর অনন্ত-অসীম দয়ার অপরিহার্য দাবী হচ্ছে যে , তাঁর অনুগ্রহ ও নেয়ামতসমূহ মানুষের মৃত্যুর কারণে তার থেকে বিছিন্ন হয়ে যাবে না। যোগ্য ও প্রতিভাবান লোকদের পর্যায়ক্রমিক পূর্ণতা লাভ যথারীতি অব্যাহত থাকবে। আল্লাহ্ বলেন :‘
আল্লাহ্ অনুগ্রহ ও দয়া করাকে নিজের প্রতি নিজে কর্তব্য কাজ করে নিয়েছেন। আর তোমাদের সকলকে শেষ বিচার বা কেয়ামতের দিন অবশ্যই সমবেত করবেন , যে দিনের ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই’
(সূরা : আল আনআ 'ম আয়াত নং 12)।
পরকাল সম্পর্কে যারা সন্দেহ পোষণ করে কোরআন তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেছে : আল্লাহর শক্তি ও ক্ষমতার ব্যাপারে কি করে সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে যে তিনি মৃতদেরকে জীবিত করবেন ? অথচ তোমাদেরকে প্রথম বারে সৃষ্টিও তিনিই করেছেন। আবার তিনি তোমাকে পুনরায় জীবন দান করবেন। আল্লাহ্ বলেন :
‘
আমরা কি প্রথমবারের সৃষ্টির সময় অপারগ ছিলাম ( যে ,পরকালে আবার সৃষ্টি করতে পারবো না ?) কিন্তু তারা (এ স্পষ্ট দলীল-প্রমাণ থাকার পর ও) পরকালে নতুন করে সৃষ্টির ব্যাপারে সন্দেহ পোষন করছে’
। (কাফ : 15)।
আল্লাহ্ বলেন
‘
সে আমাদের ব্যাপারে একটি উদাহরণ উপস্থাপন করলো। কিন্তু সে নিজের সৃষ্টির কথা ভুলে গেল ও বললো : এ পঁচা-গলা হাড়গুলোকে কে জীবিত করবে ? তুমি বলে দাও! সে সওাই (পুনরায় জীবিত করবেন) যিনি প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলেন। আর তিনি সমস্ত সৃষ্টি সম্পর্কেই সম্যক অবগত আছেন’
(ইয়াসীন : (78-79)।
এছাড়া মানুষের সৃষ্টি কি আকাশ-মন্ডল ও ভূ-মন্ডলের সৃষ্টির চেয়ে আরো অধিকতর গুরুত্বের দাবীদার ? যিনি এ বিরাট-বিশাল সৃষ্টি জগৎকে এত সব বিস্ময়কর ভাবে সৃষ্টি করেছেন , তিনি মৃত মানুষকে জীবিত করার ক্ষমতাও রাখেন।
আল্লাহ্ বলেন :
‘
তারা কি জানেনা যে , আল্লাহ্ এ আসমান সমূহ ও পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন , আর এ গুলো সৃষ্টির কারণে অপারগ ও ক্লান্ত হননি ? তিনি মৃত মানুষকে আবার জীবিত করতেও সক্ষম। হ্যাঁ ; তিনি সব কিছুর উপরই পূর্ণ ক্ষমতাবান’
(আল-আহকাফ : 33)।
36. শারীরিক পরকাল :
আমরা বিশ্বাস করি : শুধুমাত্র মানুষের আত্মাই নয় বরং আত্মা ও দেহ একসংগে পরকালে আল্লাহর দরগাহে প্রত্যাবর্তন করবে এবং নতুন জীবন লাভ করবে। কেননা , এ জগতে যা-কিছু করেছে , এ দেহ ও আত্মাই ছিল। সুতরাং পুরস্কার হোক আর শাস্তি হোক এ দুটোকেই ভোগ করা উচিৎ।
কোরআন মজীদে পরকাল সম্পর্কিত আয়াতসমূহের অধিকাংশ আয়াতেই স্ব-শরীরে পুনরুত্থানের কথা ইংগিত করা হয়েছে এবং বিরোধীদের আশ্চর্যজনক কথাগুলোর মোকাবেলায় এভাবে বলছে যে , তারা বলতো :“
এ পচাঁ-গলা হাড়গুলো কিভাবে আবার পূনর্জীবন লাভ করবে ?”
এর জবাবে কোরআন বলে :‘
তুমি বলে দাও! যে সওা প্রথমবার মাটি থেকে এ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তিনি পুনরায় জীবিত করতেও সক্ষম’
(ইয়াসীন : 79)।
কোরআন আরো বলে :
‘
মানুষ কি মনে করে আমরা তাদের (পচাঁ-গলা) হাড়গুলোকে একত্রিত (করে তাকে জীবিত) করব না ? হ্যাঁ ; আমরা সক্ষম ; এমনকি তাদের আঙ্গুলের দাগগুলোকে পর্যন্ত একত্রিত করে পূর্বের ন্যায় ঠিক করবো’
(আল কিয়ামাহ্ : 3-4)।
এ আয়াতটি ও এ জাতীয় অন্যান্য আয়াতসমূহ সমস্তই স্পষ্ট ভাবে নির্দেশ করছে যে , পরকালে পুনরুত্থান স্বশরীরেই অনুষ্ঠিত হবে।
এ ছাড়া , যে সমস্ত আয়াত এ কথা বলে যে , তোমাদেরকে তোমাদের কবর থেকে জাগ্রত করা হবে। এ আয়াতসমূহও পরকালে স্বশরীরে উত্থাপনের বিষয়টিকে পরিঙ্কার করে দেয়।
বস্তুতঃ পরকাল সম্পর্কিত অধিকাংশ আয়াতই আত্মা ও দেহের একত্রে উত্থানের প্রতি ইংগিত করছে।
37. মৃত্যুর পর আশ্চর্যজনক এক জগৎ :
আমরা বিশ্বাস করিঃ মৃত্যুর পরবর্তী জগতে (আলমে বারযাখে) , মহা প্রলয় বা কেয়ামতেরসময়ে , বেহেশ্ত ও দোযখের রাজ্যে যা কিছু ঘটবে তা আমরা এ সীমিত পৃথিবীতে যা কিছু জানতে পারছি তার থেকে অনেক অনেক উচ্চতর। আল্লাহ্ বলেন :
‘
কারো জানা নেই যে ,এরূপ (পূণ্যবান) লোকদের জন্যে নয়ন জুড়ানো জিনিসপত্র (আল্লাহর) অদৃশ্য ভান্ডারে মওজুদ রয়েছে’
(সূরা : আস-সিজদাহ ,আয়াত নং 17)।
রাসূল (সাঃ) এর একটি বিখ্যাত হাদীস আছে , তিনি বলেন :
‘
আল্লাহ্ বলেন : আমি আমার সৎকর্মশীল বান্দাদের জন্যে এমন সব নেয়ামতসমূহ আয়োজন করে রেখেছি-যা কোন চক্ষু দেখতে পায়নি ,কোন কান শুনতে পায়নি আর কোন মানুষের অন্তরে এমন কথা স্মরণেও আসেনি’
(বিখ্যাত মুহাদ্দিসগণ যেমন , বোখারি ও মুসলিম এবং খ্যাতনামা মুফাস্সিরগণ যেমন , তাবারসী ,আলুসী ও কোরতবী নিজ নিজ গ্রন্থাবলীতে এ হাদীসটি লিপিবদ্ধ করেছেন)।
আসলে আমরা এ পৃথিবীতে সে ভ্রূণের ন্যায়-যা মাতৃগর্ভের সীমিত পরিসরে থাকে। যদি ধরে নেয়া হয় যে , মাতৃগর্ভের সে ভ্রূণের জ্ঞান-বুদ্ধি আছে , তাহলেও তা মাতৃগর্ভের বহির্জগতে যা কিছু আছে যেমন , উজ্জল চন্দ্র ,সূর্য ,শীতল বায়ুপ্রবাহ ,সুশোভিত ফুলের দৃশ্য ,সমূদ্রের ঢেউ-তরঙ্গের তর্জন-গর্জন ইত্যাদি অনুভব করতে পারছে না। ঠিক তেমনিভাবে , এ পৃথিবীটাও পরকালের তুলনায় সে মাতৃগর্ভের ভ্রূণের মত। ভেবে দেখুন।