42. বারযাখের জগৎ :
আমরা বিশ্বাস করি : এ পৃথিবীর জীবন ও রোজ হাশরের মহা সন্থেমলনের মাঝে মধ্যবর্তী এ সময়ের জন্যে আরেকটি জগৎ আছে-যার নাম হচ্ছে : আলমে“
বারযাখ”
সমস্ত মানুষের আত্মাসমূহ এ পৃথিবীতে মৃত্যু বরণ করার পর থেকে হাশরের মাঠের মহা সন্থেমলনে সমবেত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সে জগতে অবস্থান করবে।
আল্লাহ্ বলেন :“
তাদের মৃত্যুর পশ্চাতে রয়েছে এক“
বারযাখ”
কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত (সময় কালের জন্য)’
( সূরা : আল মু 'মিনূন ,আয়াত নং100)।
অবশ্য এ বারযাখের জগতের বিস্তারিত বিষয়গুলো সম্পর্কে খুব একটা বেশী আমাদের জানা নেই। আর জানা সম্ভব ও নয়। এতটুকুন জানি যে , নেক ও সৎর্কমশীল লোকদের আত্মাসমূহ -যা উচ্চ মর্যাদার অধিকারী , তা সে জগতে অসংখ্য-অগণিত নেয়ামতসমূহ উপভোগ করবে ও সুখ স্বাচ্ছন্দের জীবন যাপন করবে। যেমন আল্লাহ্ বলেন :
‘
কখনো এমনটি চিন্তা করো না যে , যারা আল্লাহর পথে আত্মাহুতি দিয়েছে তারা মরে গেছে। বরং তারা জীবিত আছে। তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে তারা নানা রকম রিযিক ও নেয়ামত লাভ করছে’
(সূরা : আলে ইমরান , আয়াত নং 167)।
অপর পক্ষে , খোদাদ্রোহী জালিম ও তাদের সহযোগীরা সে বারযাখের জগতে শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। যেমন ফিরাউন ও তার সহযোগীদের সম্পর্কে আল কোরআনে বলা হয়েছে :
‘
প্রতিদিন সকাল-সন্ধা তাদেরকে (বারযাখের জগতে) দোযখের আগুনের শাস্তি প্রদান করা হবে। আর যেদিন কেয়ামত অনুষ্ঠিত হবে (সে দিন বলা হবে) ফেরাউনের বংশধরকে কঠিনতর শাস্তির মধ্যে প্রবেশ করাও’
(আল মু 'মিন : 46)।
কিন্তু তৃতীয় যে দলটির পাপ-অপরাধ কম , তারা এ শাস্তিভোগ্য দলেরও অন্তর্ভূক্ত হবে না আর সুখ উপভোগ্য দলের মধ্যে ও শামিল হবে না। মনে হয় যেন তারা বারযাখের জগতে , ঘুমিয়ে থাকার মত অচেতন থাকবে এবং কিয়ামতের দিন জেগে উঠবে। এদের ব্যাপারে আল্লাহ্ বলেন :
‘
আর যেদিন কেয়ামত অনুষ্ঠিত হবে সেদিন অপরাধীরা কসম করে বলবে যে , তারা এক মুহূর্তের বেশী (বারযাখ জগতে) অবস্থান করেনি.... । কিন্তু যাদেরকে জ্ঞান ও ঈমান প্রদান করা হয়েছে তারা (সে সমস্ত অপরাধীর উদ্দেশ্য) বলবে : তোমরা মহান আল্লাহরই নির্দেশে বারযাখের জগতে অবস্থান করছিলে। এখন হাশরের পুনর্জীবিত হওয়ার দিন। কিন্তু তোমরা তা জানো না’
(সূরা : আর-রোম আয়াত নং 55-56)।
এ পর্যায়ে রাসূলে আকরাম (সাঃ) বলেন :‘
কবর হচ্ছে জান্নাতের বাগানসমূহের মধ্যে একটি বাগান অথবা জাহান্নামের গভীর গর্তগুলোর মধ্যে একটি গর্ত। (ছহীহ্ তিরমিযি , 4র্থ খঃ ,“
কিতাবু ছিফাতুল কেয়ামাহ্"শিরোনাম , 26 অধ্যায় , হাদীস নং 2460 , বিহারূল আনোয়ার , 6ষ্ঠ খঃ , পৃঃ 214 ,ও 218 , আমীরুল মু 'মিনীন আলী (আঃ) ও ইমাম আলী ইবনিল হোসাইন (যয়নুল আবেদীন) উভয় সূত্র থেকে পৃথকভাবে বর্ণিত হয়েছে।
43. বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক প্রতিদান :
আমরা বিশ্বাস করি : শেষ বিচারের দিন মানুষের কৃতকর্মের যে প্রতিদান দেয়া হবে তার মধ্যে বৈসয়িক প্রতিদানও রয়েছে এবং আধ্যাত্মিক প্রতিদানও রয়েছে। কেননা , কিয়ামতের পুনরুত্থান শারীরিক ও আত্মিক দু’
ভাবেই হবে। কোরআন ও হাদীসে বেহেশ্তের বাগানসমূহ সম্পর্কে এভাবে বলা হয়েছে :অর্থাৎ‘
বেহেশতের বাগানসমূহ এমন যে , তার (বৃক্ষের) তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ঝর্ণা ধারা’
(সূরা : আত-তাওবাহ্ আয়াত নং 89)।
আরো বলা হয়েছে :‘
সে বাগানসমূহ এমন যে ,তার ফলসমূহ চিরন্তন এবং ছায়াও চিরস্থায়ী’
(আর-রাদ : 35)।
আরো বলা হয়েছে :‘
বেহেশতের অধিবাসীদের জন্যে রয়েছে পাক- পবিত্রা স্ত্রী’
(সূরা : আল-ইমরান , আয়াত নং 15)।
অনুরূপভাবে কোরআন ও হাদীসে অপরাধীদের শাস্তির ব্যাপারে দেখা যায় যে , তার বাহ্যিক দিক রয়েছে , যেমন দোযখের আগুনে পোড়ানো ও যন্ত্রনাদায়ক নানা প্রকার সাজা ইত্যাদি , এ সবই বাহ্যিক প্রতিদানের দিক নির্দেশ করছে।
কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে আধ্যাত্মিক প্রতিদানের বিষয়টি। আল্লাহর নূরানী মা’
রেফাত , তাঁর আধ্যাত্মিক নৈকট্যলাভ ও তাঁর সৌন্দর্য ও মহিমার দীপ্তি দর্শন। এসব এমন এক স্বাদ ও উপভোগের বিষয়-যা কোন ভাষা বা বর্ণনা দ্বারা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কোরআনের কোন কোন আয়াতে বেহেশ্তের পার্থিব নেয়ামতসমূহের কথা (যেমন ফুলে ফলে সমৃদ্ধ ও পাক-পবিত্রার কথা বলার পর) আরো বলছে :‘
খোদার সন্তুষ্টী এসব কিছুর উর্ধে’
। অতঃপর আরো বলছে :অর্থাৎ‘
এটাই হলো বিরাট বিজয়’
(সূরা : আত-তাওবাহ্ , আয়াত নং 72) ।
জী হ্যাঁ ; এর চেয়ে উত্তম ও উচ্চতর স্বাদ ও মজাদায়ক বিষয় আর কি হতে পারে যে , মানুষ উপলব্দি করবে যে , সে তার মহান প্রভুর নিকট গৃহিত হয়েছে এবং তার প্রভুর সন্তুষ্টি ও রেজামন্দির স্বীকৃতির অন্তর্ভূক্ত হতে পেরেছে।
ইমাম আলী ইবনিল হোসাইন (জয়নুল আবেদীন) (আঃ) বলেন :
‘
মহান আল্লাহ্ তাদেরকে বলেন : তোমাদের প্রতি আমার সন্তুষ্টি ও ভালবাসা সে সব নেয়ামতসমূহ অপেক্ষা অতি উত্তম যার মধ্যে এখন তোমরা লিপ্ত আছো.....’
(তাফসীরে আ 'ইয়্যাশী , সূরা : আত-তাওবাহ , 72নং আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসংগ উদ্ধৃত গ্রন্থ , যা আল-মীযান 9ম খণ্ডে বর্ণিত হয়েছে)।
তাঁরাও (বেহেশতীরা) একথা শুনে সত্যায়ন করবে। বস্তুতঃ এর চেয়ে মজার ব্যাপার আর কি হতে পারে যে , মানুষ এ জাতীয় সম্ভাষণের অধিকারী হবে :
‘
হে পরিতৃপ্ত ও নিশ্চিত আত্মা! ফিরে এসো তোমার প্রভুর প্রতি সন্তুষ্টচিওে , আর তোমার প্রভুরও তোমার প্রতি সন্তুষ্ট ও রাজী। আর আমার প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হও ও আমার জান্নাতে প্রবেশ করো’
(সূরা : আল-ফাজর ,আয়াত নং 27-30)।
44. সব সময়ই ইমাম বর্তমান আছেন :
আমরা বিশ্বাস করি : মহান আল্লাহর প্রজ্ঞা ও দর্শনে যেমন মানুষের হেদায়েতের জন্যে নবী ও রাসূলগণকে পাঠানো অপরিহার্য কর্তব্য ছিল , ঠিক তেমনি তাঁরই হিকমত ও প্রজ্ঞার দাবী হচ্ছে যে , রাসূলে আকরাম (সাঃ) এর পর প্রত্যেক যুগে ও সময়েই মানুষের হেদায়েতের জন্যে তাঁর পক্ষ থেকে মনোনীত ইমাম বা নেতা পাঠানো অপরিহার্য কর্তব্য । যাতে করে তাঁরা নবী- রাসূলগণের শরীয়ত ও আল্লাহর দ্বীনকে বিকৃতি ও পরিবর্তনের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন। প্রত্যেক সময় মানুষের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো স্পষ্ট করে দিতে পারেন এবং লোকদেরকে আল্লাহ্ ও রাসূল (সাঃ) অনুসৃত আইন ও বিধানের অনুশীলনের প্রতি দাওয়াত দিতে পারেন। তা না হলে মানুষের সৃষ্টির যে উদ্দেশ্য ছিল ,“
পরিপূর্ণতা ও কল্যাণের চুড়ান্ত পর্যায় গিয়ে উপনীত হবে”
তা ব্যহত ও ব্যার্থ হয়ে যাবে। মানুষ হেদায়েতের পথ থেকে বঞ্চিত থেকে যাবে। নবী-রাসূলগণের শরীয়ত অসার হয়ে পড়বে। আর মানুষ নিরাশ্রয় ও দিশেহারা হয়ে দিক-বিদিক ঘুরবে।
এ কারণেই আমরা বিশ্বাস করি যে , হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) এর পর থেকে প্রত্যেক যুগে ও কালে আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনিত ইমাম এ পৃথিবীতে ছিলেন , আছেন এবং থাকবেন। আল্লাহ্ বলেন :
‘
হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা তাকওয়া ও খোদাভিরুতার নীতি অবলম্বন কর এবং সত্যবাদীদের সাথী হয়ে যাও’
(সূরা : আত-তাওবাহ্ আয়াত নং 119)।
এ আয়াতটি কোন বিশেষ কাল বা সময়ের জন্যে নির্দিষ্ট নয়। আর সত্যবাদীদের সংগী- সাথী হওয়ার বিষয়টি কোন প্রকার শর্তাবলী ব্যাতীতই এ কথা প্রমাণ করে যে , প্রত্যেক যুগেই মা‘
সুম ইমাম বর্তমান রয়েছেন যার অনুসরণ করা উচিৎ এবং করতে হবে। যেমন নাকি শিয়া- সুন্নী উভয় মাযহাবেরই বহু মোফাস্সিরগণ এ বিষয়ে ইংগিত করেছেন।
আল্লামা ফখরুদ্দীন রাজী এ আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ব্যাপক আলোচনার এক পর্যায়ে এভাবে বললেন : এ আয়াতটি এ বিষয়টিকে প্রমাণিত করছে যে , যে ব্যক্তি মা‘
সুম নয় অর্থাৎ যার পাপ করার অবকাশ আছে তার জন্যে অপরিহার্য কর্তব্য হচ্ছে যে , এমন ব্যক্তির সহগামী হবে ও তাঁর অনুসরণ করবে যিনি নিস্পাপ-মা‘
সুম। আর মা‘
সুম হচ্ছেন সে সমস্তব্যক্তিবর্গ যাঁদেরকে মহান আল্লাহ ছাদেকীন (সত্যবাদীগণ) বলে ঘোষণা করেছেন। সুতরাং এ কথা ও বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে , যাদের গুনাহ্ করার অবকাশ আছে তাদের জন্যে অপরিহার্য কর্তব্য হচ্ছে মা‘
সুমগণের সহগামী ও সাথী হওয়া। যাতে মা‘
সুমগণ তাদেরকে গুনাহ্ থেকে বিরত রাখতে পারেন। আর একথা সর্ব কালের জন্যেই প্রযোজ্য। কোন বিশেষ সময়ের জন্যে নির্দিষ্ট নয়। আরও প্রমাণিত হচ্ছে যে , প্রত্যেক যুগেই মা‘
সুম বর্তমান থাকবেন। (তাফসীরে কবীর ,16শ খঃ ,পৃঃ 221)